দলিল ছাড়া পীরতন্ত্রের ভিত্তি- ৩(পর্ব -৪)
পীর এবং মাজারে মান্নতঃ
আমাদের উপমহাদেশে মান্নত করা খুবই স্বাভাবিক একটি জিনিস। অথচ ইসলামে মান্নত করতে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। যদিও করে তবে তা একমাত্র আল্লাহর উদ্দেশ্যে করতে হবে। আমাদের উপমহাদেশে যা চলছে সবই ইসলামের বিপরীত। এখানে মান্নত করা হয় পীরের দরবার বা মাজারকে কেন্দ্র করে। কোনো বিপদ আপদ বা কোনো ভবিষ্যৎ চাওয়া পাওয়া থাকলে উপমহাদেশের সাধারণ মুসলমানরা মান্নত করে পীরকে বা মাজারকে দেওয়ার জন্য। যা সরাসরি ইসলাম বিরোধী। আমাদের ইসলামী জ্ঞান না থাকার কারণে প্রতিটি জায়গায় আমরা এমন এমন কাজ করে চলেছি আল্লাহর সন্তুষ্টির আশায়। যা কখনোই আল্লাহর সন্তুষ্টি বয়ে আনবে না বরং জাহান্নামে ঠিকানা করছি। কিন্তু যা করছি তা ইবাদত মনে করেই করছি।
এই বিষয়ে বিস্তারিত এখানেঃ
ওরসে তবারুক বেচাকেনাঃ
প্রতিটি পীরের দরবার এবং মাজারে প্রতিবছর বিভিন্ন দিবস উপলক্ষে ওরস হয়। এইসব ওরসে সবার জন্যই খাওয়াদাওয়ার আয়োজন হয় সকাল বেলা। যেহেতু ওরস হয় রাত্রে সেহেতু যারা রাত্রে যান তারা খানাপিনা খেতে চাইলে মাজারে অনুদান দিয়ে খেতে হয় (কিছু দরবার ব্যতীত)। অথচ এখানে যা খানাপিনা তৈরি হয় তার সবই সাধারণ মুরিদ এবং জনগণের টাকায়। ইসলাম বলে মানুষকে দান আহার করাও। অথচ পরের টাকায় যা তৈরি হচ্ছে সেই খাবারও বিক্রি হয় এইসব দরবার এবং মাজারে। যদি সত্যিই এই সিস্টেম ইসলামে থাকতো। তাহলে এইসব অনৈইসলামিক কাজ কীভাবে ইসলাম সাপোর্ট করতো? অথচ ইসলাম এইসব কখনোই সমর্থন করে না।
পীর এবং মাজারপন্থীদের বিলাসী এবং কর্মহীন জীবনঃ
প্রতিটি নবী রাসুল (আঃ) গণ খুবই সাধারণ জীবনযাপন করেছেন। তাঁরা নিজেরা কর্ম করে নিজেদের এবং পরিবার পরিজনের ভরণপোষণ দিয়েছেন। সেখানে বর্তমানে যেসব পীর এবং মাজার পন্থী বংশপারম্পরিক মানুষ রয়েছে, তাদের জীবনযাপন লক্ষ্য করলে আমরা কী দেখি? একজন পীর এবং মাজারবাদী লোকও সাধারণ জীবনযাপনে নেই। তাদের রয়েছে আকাশচুম্বী বিলাসী জীবন (যাদের নেই তারা এখনো প্রতিষ্ঠিত হতে পারেনি) । অথচ এই জীবনযাপন ইসলামে সম্পূর্ণ হারাম। এই উপমহাদেশের একজন পীরেরও কোনো নিজস্ব জীবিকা নেই। না তারা চাকরি করে না তারা ব্যবসা করে। তবে হ্যাঁ তারা ব্যবসা করে বিনা পুঁজিতে। যে ব্যবসায় কোনো মূলধন নেই বা লাগে না। শুধু লাগে বংশপরিচয়। এই বংশপারম্পরিক পীর মাজার ব্যবসা করেই তারা আলিশান জীবনযাপন করে।
অথচ আমাদের রাসুল (সাঃ) প্রতিদিন পেট পুরে খেতে পায়নি রুজির অভাবে। কতদিন রাসুল (সাঃ) এবং তাঁর স্ত্রী পরিবার পরিজন এবং সাহাবীগণ না খেয়ে দিন কাটিয়েছেন। আর আমরা যারা পীর বলে ইসলামের মূল একটি পদে বসিয়ে দিচ্ছি যাদের জীবনের সাথে রাসুল (সাঃ) এবং সাহাবীগণ (রাঃ) এর জীবনযাপনের কোনো মিলই নেই। যদি রাসুল (সাঃ) এবং সাহাবীগণ (রাঃ) এর সাথে না মিলে তবে কীভাবে এইসব পীরকে ইসলাম স্বীকৃতি দিবে? আসুন নিজের বিবেকের কাছে প্রশ্ন করি।
ইসলামী আইন প্রবর্তনঃ
প্রতিটি মুমিন মুসলিম থেকে নিয়ে সকল ঈমানদারদের একটাই আদর্শ। সেটা হলো ইসলাম। ইসলাম ছাড়া মুসলমানের কোনো আদর্শ বা আইন নেই। যে নিজেকে মুসলিম এবং ঈমানদার দাবি করবে, তার প্রথম এবং একমাত্র কর্তব্য ই হলো ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ এবং রাষ্ট্রের প্রতিটি পর্যায়ে ইসলামকে তথা ইসলামের বিধিনিষেধ এবং আইনকে সমুন্নত এবং প্রতিষ্ঠিত করা। যারা নিজেদের সত্যিকারের ঈমানদার মুমিন মুত্তাকী, সালেহীন, ছিদ্দিকীন ইত্যাদি দাবি করবেন। তাদের কর্তব্যই হলো ইসলাম প্রতিষ্ঠা করা।
কিন্তু দুঃখজনক হলেও এটাই সত্য যে , রাষ্ট্রে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করা তো দূরের কথা। আমরা পরিবার সমাজেও ইসলাম মেনে চলি না। অথচ যারা পীর কে ইসলামের অত্যাবশ্যকীয় অংশ বলে দাবি করেন, তাদের কি উত্তর দিতে পারবেন? বাংলাদেশ মুসলিম দেশ হয়েও স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পরেও কেন আমাদের দেশ ইসলামী কায়দায় চলে না। কেন আমরা পরিবার সমাজ রাষ্ট্রে ইসলামী অনুশাসনে নেই। এটা কি তাদের দায়িত্ব নয় যাদের পীর বলে ইসলামের অত্যাবশ্যকীয় অংশ বলে জাহির করা হচ্ছে। তারা কীভাবে আল্লাহর ভালোবাসা পেতে পারেন আল্লাহ্ কে ছাড়া। অথচ আল্লাহ্ বলেন তোমরা জমিনে দ্বীনকে প্রতিষ্ঠা করো। ইসলামের জন্য সর্বস্ব ত্যাগ করো। ইসলাম প্রতিষ্ঠার অবিরাম চেষ্টা চালিয়ে যাও। যদি এইসব দরবার থেকে একযোগে ইসলামের জন্য ডাক দেওয়া হতো তাহলে অবশ্যই বাংলাদেশে এতোদিনে ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হতো।
যেহেতু তারা (একটি দরবার ছাড়া) করেনি সেহেতু হয়নি। অতএব এইসব পীর যে মুমিন তো দূরের কথা সত্যিকারের মুসলমানও হতে পেরেছে কী? কিন্তু তারা করছে না কেন? তারা এইজন্যই করছে না তাদের বিনা পুঁজির ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাওয়ার ভয়ে। কোনো কিছু করা ছাড়াই যদি ভালো ইনকাম হয় তাহলে কে যাবে দুনিয়ার ঝামেলায় জড়াতে। আমার ধর্মপ্রাণ ভাইয়েরা যদি আল্লাহর দেওয়া জ্ঞানকে একটু কাজে লাগাই তবে এইসব বিষয় অবশ্যই আমাদের চোখের সামনে স্পষ্ট হয়ে উঠবে।
সাহায্য করার মালিক আল্লাহ্ঃ
আল্লাহ্ সুবহানাহু তাআলা সূরা ফাতেহায় একটি আয়াত দিয়েছেন যা আমরা প্রতিনিয়ত বলে থাকি। তা হচ্ছে-
" ইয়া কানাবুদু ওইয়া কানাসতায়ীন " সহজ অর্থ হলো " আমরা শুধু তোমারই ইবাদত করি, শুধু তোমারই সাহায্য প্রার্থনা করি "।
এই আয়াত থেকে এটা স্পষ্ট যে, যেকোনো বিপদ আপদে, রোগ শোকে যেকোনো প্রয়োজনে আমরা একমাত্র আল্লাহ্ থেকেই সাহায্য প্রার্থনা করতে পারি। তিনি ছাড়া আর কারো কাছে সাহায্য প্রার্থনা করা একপ্রকার শির্ক বা আল্লাহর অংশীদার করা। কিন্তু যারা পীরের মুরিদ এবং মাজার ভক্ত তাদের মুখে সবসময়ই পীর মাজারঅলার নামে সাহায্য চাইতে দেখি। যা স্পষ্টত শির্ক এবং হারাম। কেননা ইসলামে আল্লাহ্ ছাড়া কারো কাছে গায়েবি সাহায্য চাওয়া শির্ক।
এই বিষয়ে বিস্তারিত জানতে এখানে দেখুনঃ
আল্লাহ কুরআনে বলেন যে, তিনি ই বিপদ আপদ দেন এবং তিনিই বিপদ থেকে উদ্ধার করেন। তাহলে এখানে বিপদ থেকে উদ্ধার করার জন্য আল্লাহ্ কোনো থার্ড পাটিকে ইজারা দেন নাই। তিনি বলেননি যে, আমি বিপদ দিচ্ছি আর উনার কাছে সাহায্য নিয়ে বিপদ থেকে উদ্ধার হও। এটা দিনের আলোর মতো পরিষ্কার যে যিনি বিপদ দিবেন একমাত্র তিনিই সেই বিপদ থেকে উদ্ধার করতে পারবেন। অতএব আল্লাহ্ যেমন শিক্ষা সূরা ফাতেহায় দিচ্ছেন ঠিক তেমনই আমাদের উচিত হবে আল্লাহর কাছেই সর্বদা সাহায্য চাওয়া।
কিন্তু আমাদের তথাকথিত পীরেরা (কিছু ব্যতীত) এই শিক্ষা দেয় যে, যেকোনো সময় অমুক বাবা, অমুক শাহ, অমুক ভান্ডার ইত্যাদির কাছে সাহায্য চাইবে। তাহলে মুহূর্তেই তোমরা উদ্ধার হয়ে যাবে। আর এটাই বাস্তবে হচ্ছে। এর সাধারণ মুসলমানদের ঈমান ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। এভাবে যেসব দরবার বা আস্তানা থেকে ঈমান ধ্বংসকারী কার্যক্রম চলে সেইসব দরবারের কার্যক্রম কে কীভাবে ইসলাম সম্মত কাজ বলা যায়। সেটাই এখন ভাবার সময়।
উপরোক্ত বিষয়ে এটা খুবই স্পষ্ট যে সাধারণ বিবেকের মাপকাটিতেও পীরতন্ত্রকে জায়েজ করা যাবে না। আমরা জান্নাত লাভের আশায় পীরের দরবারে যেতে চাইছি। যদি দুনিয়াতে শান্তি আর আখিরাতে জান্নাত না পাই তবে কেনইবা পীর ধরবো?
বাকি পর্ব গুলো এখানেঃ