একজন মুসলমান ইসলামের কিছু মৌলিক বিষয়ের উপর বিশ্বাস রাখে। যাকে বলা হয় আকিদা। ইসলামের মূল আকিদা বা বিশ্বাস খুবই স্পষ্ট এবং স্বতন্ত্র। ঠিক তেমনি সুফিবাদী সুন্নীদেরও কিছু মৌলিক বিশ্বাস বা আকিদা রয়েছে। যা ইসলামের মূল আকিদায় নেই।
যদিও সুফিবাদীরা নিজেদের মুসলিম দাবি করে। কিন্তু তাদের নিজস্ব যে আকিদা বা বিশ্বাস রয়েছে তা সম্পূর্ণ ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক। তবুও সংখ্যাগরিষ্ঠতার বলে তারা আজ পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় নিজের মত প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছে।
আসুন জেনে নিই সুফীবাদের আকিদা গুলো কী কী এবং তা কতটুকু ইসলামের সাথে সংগতিপূর্ণ। সুফিদের বিভিন্ন আকিদা রয়েছে। যা তারা বিশ্বাস করে এবং আমল করে। সুতরাং বিভিন্ন বিষয়ের উপর তাদের আকিদাকে আমরা বিষয়ভিত্তিক বিভিন্ন ভাগে ভাগ করে জানার চেষ্টা করবো।
আল্লাহ্ সম্পর্কিত সুফিদের আকিদাঃ-
আল্লাহ্ নিরাকারঃ
সুফিদের মতে মহান আল্লাহ্র কোনো আকার নেই। তিনি অস্তিত্ব সম্পন্ন নিরাকার স্রষ্টা। অর্থাৎ তাঁর অস্তিত্ব আছে কিন্তু আমরা তার আকার জানি না। তাই তিনি নিরাকার। অর্থাৎ যেহেতু তাঁর সাদৃশ্য কেউ নেই, সেহেতু তিনি সুফিদের কাছে নিরাকার।
আল্লাহ্ সর্বত্র বিরাজমানঃ
যারা সুফিবাদে বিশ্বাসী তাদের আকিদা হলো, আল্লাহ্ সর্বত্র বিরাজমান। অর্থাৎ পৃথিবীর সব জায়গায়তেই আল্লাহ্র শারীরিক অবস্থান বিদ্যমান। পৃথিবীর এমন কোনো জায়গা নেই যেখানে আল্লাহ্ স্বশরীরে নেই। এই জঘন্য আকিদা ইহুদী খ্রিস্টান সহ তৎকালীন মক্কার মুশরিকদেরও ছিলো না। এই আকিদা লালনকারী হচ্ছে সনাতন হিন্দুরা।
অহেদাতুল অজুদ বা সর্বেশ্বরবাদঃ
সুফিদের বিশ্বাস হচ্ছে সবকিছুর মধ্যেই আল্লাহর অস্তিত্ব রয়েছে। এই পৃথিবীর গাছপালা, জীবজন্তু, শিয়াল, কুকুর, পাথর, মূর্তি ইত্যাদি সবকিছুতেই আল্লাহ্ নিজে রয়েছেন। যা একটি গ্রীক এবং সনাতন হিন্দু ধর্মের আকিদা। মক্কার কাফির মুশরিক, খ্রিস্টান, ইহুদীরাও আল্লাহ্ সম্পর্কে এমন জঘন্য বিশ্বাস করতো না।
চতুর্থ হিজরি শতাব্দীর পর ইসলাম আস্ত আস্তে সুফিবাদের দিকে ঝুকতে থাকে, সাথে সাথে যুক্তিবৃত্তিক, বুদ্ধিবৃত্তিক দর্শন প্রসার ঘটে। ষষ্ঠ হিজরি শতাব্দীতে ভারতীয় ‘সর্বেশ্বরবাদ’ বা গ্রীসের ‘Pantheism’ মুসলিমগন “ওয়াহদাতুল ওজুদ” নামে গ্রহন করে। তার অর্থ দাড়ায় ইসলামের প্রথম পাঁচ শতাব্দীতে “ওয়াহদাতুল ওজুদ” নামে কোন আকিদা ছিল না। ( ‘আবু হানিফা রহ. রচিত ফিকহুল আকবর বঙ্গানুবাদ ও ব্যাখ্যা’, “ইসলামী আকীদা ও ভ্রান্ত মতবাদ”)।
“মুসলিম নামধরি সুফিদের মধ্যে সর্ব প্রথম শায়েখে আকবর ইবনুল আরাবী এই মতবাদটি উদ্ভাবন করেন এবং তার অনুসাবীগণ এটির প্রচার ও প্রসার ঘটান। ইবনুল আরাবী এই মতবাদটি ব্যক্ত করতে গিয়ে বলেন, “সমগ্র সৃষ্টির অস্তিত্ব হুবহু আল্লাহর অস্তিত্ব”। এখানে তিনি ‘ওয়াহদাতুল ওজুদ’ তথা স্রষ্টা ও সৃষ্টির অস্তিত্বের ঐক্য ও অভেদত্বকেই বুঝিয়েছেন। (“ইসলামী আকীদা ও ভ্রান্ত মতবাদ” প্রকাশণায়; মাকতাবাতুল আবরার; পৃষ্ঠা -৫৪৭)।
হুলূল বা অনুপ্রবেশবাদঃ
সুফিদের ধর্মীয় বিশ্বাস হচ্ছে একজন বান্দা যখন আল্লাহর প্রেমে এতই মশগুল হয়ে যায়, তখন আল্লাহ্ স্বয়ং ঐ বান্দার মধ্যে প্রবেশ করে। তখন আল্লাহ্ এবং বান্দা একাকার হয়ে যায়। এই আকিদাও গ্রীক পারস্য থেকে ধার করা।
ফানাফিল্লাহঃ
সুফিদের গুরুত্বপূর্ণ একটি বিশ্বাস হচ্ছে ফানাবিল্লাহ বা আল্লাহ্য় বিলীন হওয়া। অর্থাৎ একজন বান্দা আল্লাহ্র প্রেমে মত্ত হয়ে একসময় আল্লাহ্র মধ্যে বিলীন হয়ে যায়। এটাকে বলা হয় ফানাবিল্লাহ।
বাকিবিল্লাহঃ
একজন বান্দা আল্লাহর প্রেমে মত্ত হয়ে যখন আল্লাহ্র সাথে স্থায়ীভাবে বসবাস করে তখন তাকে বলা হয় বাকিবিল্লাহ। এই পর্যায়ে বান্দা আর আল্লাহ্ কোনো ফারাক থাকে না। একজন অপরজনের সাথে মিশে একাকার হয়ে যায়। যেমন পানিতে চিনি মেশালে তা আর পৃথক করা যায় না। ঠিক তেমনি বান্দাও আল্লাহর সাথে মিশে একাকার হয়ে যায়। এজন্য সুফিবাদে পীরকে সিজদা করার রীতি প্রচলিত আছে। যা ইসলামে সুস্পষ্ট শির্ক।
দুনিয়ায় আল্লাহ্কে দেখাঃ
সুফিদের গুরুত্বপূর্ণ আকিদা হলো দুনিয়ায় বসেই আল্লাহ্কে দেখা সম্ভব। একজন মুরিদ বা ভক্ত যখন আল্লাহ্র প্রেমে দিওয়ানা হয়ে বাকিবিল্লাহ স্তরে পৌঁছে যায় তখন তার অন্তর চক্ষু খুলে যায়। এইসময় সে আরশ, কুরছি, লৌহ, কলব, সাত আসমান, জমিন সবকিছুই দেখতে পায়। এইসবের সাথে সাথে সে আল্লাহ্কেও দেখতে পায়।
মাধ্যম দিয়ে আল্লাহ্ পাওয়াঃ
সুফিদের ভ্রান্ত বিশ্বাসের একটি বিশ্বাস হলো কোনো মাধ্যম ছাড়া আল্লাহকে পাওয়া যায় না ডাকা যায় না। মাধ্যম ছাড়া ডাকলে তিনি সাড়া দেন না। তাই তাঁর প্রিয় কাউকে মাধ্যম বা মধ্যস্তাকারী হিসাবে ডাকলে আল্লাহ্ দ্রুত সাড়া দেন। তাই সুফিগণ তাদের পীর অলি আউলিয়াদের মাধ্যম করে আল্লাহ্কে ডাকে। যাতে এইসব অলি আউলিয়াদের উছিলায় বা মাধ্যমে তারা তাদের যাবতীয় কাজ আল্লাহ্ থেকে হাসিল করতে পারে।
এই ক্ষেত্রে তারা আল্লাহর সাথে রাজা বাদশার তুলনা দেন। সাধারণ মানুষ যেমন রাজা বাদশার কাছে সরাসরি যেতে পারে না বা কিছু চাইতে পারে না। কাউকে রাজা পর্যন্ত পৌঁছেতে হলে কোনো বিশ্বস্ত মাধ্যমে যেতে হয়। বিশেষ করে যারা রাজার কাছে পরিচিত এবং বিশ্বস্ত। ঠিক একইভাবে আল্লাহর কাছেও কাউকে যেতে হলে বা কিছু চাইতে বা পেতে হলে অবশ্যই আল্লাহর প্রিয় বান্দা আল্লাহর অলিদের মারফতে যেতে হবে।
মুমিনের কলব আল্লাহ্র আরশঃ
সুফিদের মতে প্রতিটি মুমিনের অন্তরে আল্লাহ্ রয়েছে। যে ঠিকমতো পীরের নির্দেশ মেনে তার অন্তরে আল্লাহকে জায়গা দিতে পেরেছে, সে ই আল্লাহ্অলা হয়ে গেছে। এই ভিত্তিতে যত কল্লা (মানুষ) তত আল্লাহ্। সেজন্য সুফিবাদে মুমিনের অন্তরে আল্লাহ্ থাকার কারণে পীরকে তারা সিজদা করে।
নবী রাসুল পীর আউলিয়াদের নিয়ে সুফিদের আকিদা সমূহঃ-
আল্লাহ্ ও রাসুল একাকারঃ
সুফিদের বিশ্বাস হচ্ছে আল্লাহ্ এবং তাঁর রাসুলের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই শুধুমাত্র একটি "মীম" ছাড়া। তাই তারা বলে, আহমদ তথা রাসুল আহাদ মানে আল্লাহ্। এখন আহমদের "মীম " সরিয়ে নিয়ে নিলে হয়ে যায় আহাদ। সুতরাং আল্লাহ্ এবং রাসুল এক। আল্লাহর যেসব ক্ষমতা আছে তার সবই আছে রাসুলের। যেমন, রাসুল আল্লাহর নিজস্ব নূরে তৈরি, তিনি হাজির নাজির, তিনি গায়েব জানেন, তিনি উম্মতের ভালো মন্দ করতে পারেন ইত্যাদি। সেইসাথে তাদের বিশ্বাস যে, আল্লাহ্ নিজেই রাসুলের ভিতর দিয়ে দুনিয়ায় আত্মপ্রকাশ করেছেন। তাদের মাহফিল গুলোতে রাসুল সাঃ নিজে উপস্থিত হন। তাই তারা দাঁড়িয়ে রাসুল সাঃকে সালাম পেশ করেন। তিনি তাদের সালাম নেন এবং জবাব দেন ইত্যাদি।
রাসুল আল্লাহ্র জাতি নূরের তৈরিঃ
আল্লাহ্ তাঁর নিজের শরীরের নূর থেকে রাসুল সাঃকে সৃষ্টি করেছেন এমন আকিদা হচ্ছে সুফিবাদের। সুফিরা এটাই বিশ্বাস করে যে, আল্লাহর নিজস্ব জাতি নূর থেকে রাসুল সাঃকে তৈরি করেছেন। সুতরাং তিনি হচ্ছেন নূরের তৈরি।
রাসুলুল্লাহসহ সকল অলিরা জীবিতঃ
সুফিবাদের গুরুত্বপূর্ণ বিশ্বাস হচ্ছে, রাসুলুল্লাহ সাঃসহ সকল পীর আউলিয়া মৃত্যুর পর কবরে সাধারণ জীবিত মানুষের মতোই জীবিত। তাঁরা সাধারণ মানুষের সবকিছু দেখেন বুঝেন এবং উপকার অপকার করতে পারবেন। সুতরাং তাঁদের কাছে যেকোনো জীবিত ব্যক্তির মতোই চাওয়া যাবে এবং পাওয়া যাবে।
পীরেরা আল্লাহর গুণে গুণান্বিতঃ
সুফিদের বিশ্বাস যে, তাদের পীরেরাও আল্লাহর মতো পৃথিবীর সব জায়গায় হাজির নাজির, তারা ইলমে গায়েব জানেন, তারা তাদের মুরিদ ভক্তদের ভালো মন্দ করতে পারেন। তারা সন্তান দেওয়ার ক্ষমতা রাখেন, তারা বিপদে উদ্ধার করতে পারেন ইত্যাদি। পীরেরা তাদের ভক্তদের ফরিয়াদ আর্জি শুনেন এবং সেইমতো তাদের সাহায্য সহযোগিতা করেন। সেইসাথে তাদের সাথে আল্লাহ্ রয়েছে সরাসরি যোগাযোগ। যারফলে তারা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ইবাদত আমল বা শরীয়তের বিভিন্ন হুকুম আহকাম তৈরি করে এবং ভক্তদের তা মানার ও পালনের নির্দেশ দেন।
পীরেরা গুনাহ মাপ করিয়ে নেনঃ
সুফিদের বিশ্বাস যে যেকোনো মুরিদ বা ভক্ত যত গুনাহই করুক না কেন একজন পীর বা অলি জীবিত মৃত যেকোনো অবস্থায় ঐ মুরিদ বা ভক্তের গুনাহ আল্লাহ্ থেকে ক্ষমা করিয়ে নিতে পারেন। যেকোনো কেউ পীর বা অলি আউলিয়ার দরবারে গিয়ে তাদের উছিলা দিলে সব মাপ হয়ে যায়।
পীর আউলিয়ারা সুপারিশকারীঃ
সুফিদের বিশ্বাস হলো তাদের পীর আউলিয়ারা কিয়ামতের মাঠে আল্লাহ্ থেকে সুপারিশ করে তাদের ভক্তদের বাঁচিয়ে দিবে। সুফিবাদীরা যতই গুনাহ করুন না কেন তাদের যদি পীর থাকে তাহলে সেই পীর কিয়ামতের মাঠে ঐসব গুনাহগার ভক্ত মুরিদের জন্য। আল্লাহর কাছে সুপারিশ করবেন। আর সেই সুপারিশে যত বড় গুনাহগার ব্যক্তিই হোক না কেন তারা জাহান্নাম থেকে মুক্তি পাবেন।
হিদায়েতের মালিক হচ্ছে পীরঃ
সুফিদের অন্ধ বিশ্বাস হলো পীর ছাড়া কখনোই হিদায়াত পাওয়া যাবে না। যেকোনো মানুষের হিদায়েতের জন্য অবশ্যই একজন পীরের প্রয়োজন। তাদের মতে যার পীর নাই তার পীর শয়তান। অর্থাৎ যে ব্যক্তি পীর ধরবে সে হিদায়াত পাবে। যে পীর ধরবে না সে কখনোই হিদায়াত পাবে না। যা একটি কুরআন সুন্নাহ বিরোধী কথা।
ফানা ফিস শায়খঃ
একজন মুরিদ যখন পীরের কাছে বাইয়াত হয়ে দীক্ষা নিতে আসে, তখন তাকে তার পীরের সম্পূর্ণ অনুগত হতে হয়। এমন অনুগত যে, পীর যা বলে বা পীর যা যা আদেশ নির্দেশ দেয় তা ই মুরিদের জন্য অবশ্যই পালনীয়। পীর শরীয়তের বিপরীত কিছু করতে বললেও তা মুরিদের জন্য পালনীয়। তখন পীরই মুরিদের জন্য সবকিছু। যে মুরিদ এমন আদেশ নির্দেশ মেনে চলে তাকে বলা হয় ফানা ফিস শায়খ। অর্থাৎ পীরের কাছে বিলীন হওয়া।
অলি আউলিয়াদের কেবিনেটঃ
সুফিবাদীরা বিশ্বাস করে যে, পুরো বিশ্বজাহান চালানোর জন্য আল্লাহ্ তাঁর কিছু খাছ বান্দাদের দিয়ে একটি কেবিনেট গঠন করেন। তারাই পৃথিবীতে বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করেন।সেই পার্লামেন্টের সদস্য সংখ্যা মোট ৪৪১ জন।
আল্লাহ তাদের স্ব স্ব কাজ বুঝিয়ে দিয়েছেন। তন্মধ্যে নাজীব ৩১৯ জন, নাক্বীব ৭০ জন, আবদাল ৪০ জন, আওতাদ ৭ জন, কুতুব ৫ জন এবং একজন হলেন গাওছুল আযম, যিনি মক্কায় থাকেন। উম্মতের মধ্যে আবদাল ৪০ জন আল্লাহ তা‘আলার মধ্যস্থতায় বান্দাদের ফরিয়াদ আর্জি মোতাবেক পৃথিবীবাসীর বিপদাপদ দূরীভূত করে থাকেন। তারা অলীগণের দ্বারা সৃষ্টজীবের হায়াত, রুযী, বৃষ্টি, বৃক্ষ জন্মানো ও মুছীবত বিদূরণের কাজ সম্পাদন করেন।
বিপদে উদ্ধারকারী অলি আউলিয়াঃ
সুফিদের আকিদা হচ্ছে, তাদের যেকোনো বিপদে বিভিন্ন অলি আউলিয়ারা তাদের উদ্ধার করেন। তাই তারা যেকোনো বিপদে পড়ার সাথে সাথে বা বিপদের কোনো সম্ভাবনা দেখলে তাদের বড় বড় পীর আউলিয়াদের ডাক দিয়ে সাহায্য প্রার্থনা করে। যা একটি সুস্পষ্ট শির্কি আকিদা।
বংশপরস্পরায় পীর, অলি,আউলিয়াঃ
বর্তমান সুফিবাদে বংশপরস্পরায় পীর আউলিয়া বানানো হয়। আগে একজনকে পীর হতে হলে যথেষ্ট সাধনা করতে হতো। অতীতে সুফিবাদে কঠোর সাধনাকে খুবই গুরুত্ব দেওয়া হতো। হাল আমলে সবকিছুই আর্টিফিশিয়াল হয়েছে। এখন পীর মুরিদ কেউ কঠোর সাধনা তো দূরের কথা, সাধনা করারই মন নেই। পীর সাহেবেরা হাদিয়া তোফা নিয়ে ব্যস্ত মুরিদেরা পীরের উছিলা নিয়ে শান্ত।
এই প্রেক্ষিতে পীরের বংশীয় আওলাদরাই পরবর্তীতে পীর সাব্যস্ত হচ্ছে বা তাদের পীর বানিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এখানে দেখা হচ্ছে না যাকে পীরের দায়িত্ব দেওয়া হলো সে কতটুকু এর উপযুক্ত। তার একটাই যোগ্যতা আর তাহলো সে পীরের সন্তান। সুতরাং পীর আউলিয়া যাকে বলা হয় আল্লাহর বন্ধু। সেই বন্ধু আল্লাহ্ দ্বারা নির্বাচিত নির্ধারিত নয়। বরং বংশ পরিচয় দ্বারা বর্তমানে নির্ধারিত হচ্ছে।
ইচ্ছাধীন কাশফ এবং কারামতঃ
সুফিদের মতে তাদের গুরু, পীর, অলি, আউলিয়ারা নিজের ইচ্ছামত কাশফ, কারামত ইত্যাদি দেখতে এবং দেখাতে পারেন। তারা তাদের অন্তদৃষ্টি দিয়ে ইচ্ছামতো আল্লাহর আরশ কুর্ছি ইত্যাদিতে পরিভ্রমন করতে পারেন। এভাবে তারা তাদের ভক্ত মুরিদের যেকোনো আশা আকাঙ্ক্ষা জরুরত পূরণ করতে পারেন।
ফিরাসাতঃ
ফিরাসাতের অর্থ হচ্ছে অন্তর্দৃষ্টি। সুফিদের আকিদা অনুযায়ী যেকোনো পীর অলি আউলিয়ারা তাদের মুরিদ ভক্তদের অন্তরের খবর জানতে পারেন। পীর আউলিয়ারা তাদের মুরিদদের অন্তরে ঢুকে তার সম্পর্কে সবকিছু জেনে নেওয়ার ক্ষমতাই হচ্ছে ফিরাসাত। এই ফিরাসাতের দ্বারা যেকোনো পীর অলি তাদের মুরিদদের অন্তর সম্পর্কে জানতে পারেন। মুরিদের মনে কী আছে কী নেই তা পীর সাহেব তার অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে জেনে নিতে পারেন। এবং সেই অনুযায়ী পীরেরা তাদের ভক্তদের সাহায্য করেন বলে দাবি করেন। সেইসাথে মুদিদদের মধ্যে কেউ পাপী তাপী হলে পীরেরা সেই মুরিদের অন্তরকে সংশোধনের চেষ্টা করেন।
তাওয়াজ্জুঃ
তাওয়াজ্জুর অর্থ হলো নিক্ষেপ করা। সুফিদের ভাষায় কোনো পীর অলি আউলিয়া তার পাপী ভক্ত মুরিদদের অন্তরে যে নূর নিক্ষেপ করে তাকে তাওয়াজ্জু বলে। অর্থাৎ কোনো পাপী মুরিদকে ভালো করার উদ্দেশ্যে তার কলবের দিকে পীর যে দৃষ্টি দিয়ে বা গায়েবী নূর দিয়ে অন্তরকে পরিশুদ্ধ করেন তাকে বলা হয় তাওয়াজ্জু। এই তাওয়াজ্জুর দ্বারা পীর অলি আউলিয়ারা তাদের মুরিদদের পাপ কাজ থেকে বিরত করে ভালো পথে আনার চেষ্টা করে। সুফিদের আকিদা হচ্ছে কেউ কোনো পীরের মুরিদ হলে, সেই পীর তাকে নূরানি তাওয়াজ্জু দিয়ে অন্তর পরিষ্কার করে আল্লাহ্অলা করে দেন। এভাবেই পীরেরা মুরিদদের হিদায়াত দিয়ে থাকেন।
ঈমান সম্পর্কিত আকিদাঃ-
ঈমানের হ্রাস বৃদ্ধি নেইঃ
সুফিদের ঈমানের সংজ্ঞায় আল্লাহ্কে মুখে স্বীকৃতি এবং অন্তরে বিশ্বাস করলেই ঈমানদার হওয়া যায়। যে ব্যক্তি মুখে ও অন্তরে আল্লাহ্কে মেনে নেয় তার আমল করা না করা নিয়ে ঈমানের সাথে কোনো সম্পর্ক নেই।
অর্থাৎ সে কোনো আমল না করলেও ঈমানদার থেকে যাবে এবং একদিন না একদিন জান্নাতে চলে যাবে। কেউ আমল করলে তা তার জন্য নেকী হবে। কিন্তু কেউ আমল না করলে ঈমান নষ্ট হবে না। সেইসাথে যে একবার ঈমান আনে সে যত শির্ক বিদআত করুক না কেন তার ঈমানের কোনো তারতম্য হবেনা।
এইজন্যই সুফিবাদী সুন্নীদের বলতে শোনা যায় নামাজ পড়ি না তো কী হয়েছে? আমার ঈমান তো ঠিক আছে! সুফিদের যেহেতু শরীয়তের উপর জোর আমল নেই সেহেতু তারা শরীয়তের নিয়মিত আমলের ক্ষেত্রে যথেষ্ট গাফিলতি প্রদর্শন করে। এর মূল কারণ তাদের আকিদাই হলো ঈমান থাকলেই তো জান্নাত নিশ্চিত। টুকটাক গুনাহ করলে কিছুদিন জাহান্নামে থেকে আবার জান্নাতে চলে আসতে পারবো।
সুফি অনুসারীদের ঈমান নিয়ে এইধরণের ভ্রান্তির কারণে অধিকাংশ সাধারণ মুসলমান না জেনে আমল না করার পাপে নিমজ্জিত। অধিকাংশ সুফি অনুসারীরা যৌবনে কোনো ইবাদত বন্দেগীর ধার ধারে না। পড়ন্ত বয়সে দাড়ি টুপি নিয়ে রাতদিন মসজিদে পড়ে থাকে। এর মূল কারণ হচ্ছে ঈমান নিয়ে তাদের দূর্বল আকিদা।
সুফিদের ঈমান নষ্ট হয়নাঃ
সুফিদের মতে যে একবার আল্লাহর উপর ঈমান আনে তার ঈমানের আর তারতম্য ঘটে না। ফলে যতক্ষণ না সে নিজেকে নাস্তিক মুরতাত ঘোষণা করছে ততক্ষণ পর্যন্ত সে পূর্নাঙ্গ ঈমানদার। ইসলামে ঈমানের সাথে আমল জরুরী। কিন্তু সুফিদের আকিদায় ঈমানের সাথে আমল জরুরী নয়। যে ব্যক্তি একবার আল্লাহ্কে মেনে নিয়েছে, সেই ব্যক্তি যতই শির্ক বিদআত করুক না কেন তার ঈমান নষ্ট হবে না।
অর্থাৎ কেউ একবার আল্লাহর উপর ঈমান আনলেই তার ঈমান আর ভঙ্গ বা নষ্ট হবেনা। সে আমল করুক বা না করুক। অথবা ইসলামে নাস্তিক মুরতাত হওয়া ছাড়াও যেসব কারণে ঈমান নষ্ট বা ভেঙ্গে যেতে পারে, সেইসব কারণেও সুফিদের আকিদা অনুযায়ী ঈমান ঠিক থাকে। যারফলে সুফি অনুসারীদের মধ্যে ঈমান আকিদা আমল নিয়ে কোনপ্রকার গুরুত্ব দেখা যায় না।
সুফিদের ঈমান আমল আকিদা সবই তাদের পীর অলি আউলিয়া ভিত্তিক। সুফি অনুসারীরা পীরদের বিভিন্ন অজিফার আমলকে বিশেষ গুরুত্ব দেয়। শরীয়তের নিয়মিত আমলের প্রতি তাদের তেমন ভ্রুক্ষেপ দেখা যায় না। কেননা তাদের আকিদা অনুযায়ী ঈমানের জন্য কোনো প্রকার আমল শর্ত নয়।
কুরআন সম্পর্কিত আকিদাঃ-
কুরআনের জ্ঞান জাহেরীঃ
সুফিদের মতে আল্লাহর জ্ঞান দুই ধরনের। একটি হচ্ছে জাহেরী বা প্রকাশ্য জ্ঞান। আরেকটি হচ্ছে বাতেনী জ্ঞান বা অপ্রকাশ্য জ্ঞান। যারা শুধু কুরআন পড়ে শিখে জানে তারা আল্লাহর জাহেরী জ্ঞান বা প্রকাশ্য জ্ঞান লাভ করে। আর যারা সুফিদের অনুসরণ করে পীর অলি আউলিয়াদের কাছে জ্ঞান আহরণ করতে চেষ্টা করে, তারা আল্লাহর অপ্রকাশ্য জ্ঞান বা বাতেনী জ্ঞান লাভ করে। এই বাতেনী জ্ঞান একমাত্র সুফিদের পীর আউলিয়াদের কাছেই আছে। যা আল্লাহ্ শুধুমাত্র তাদেরকে দিয়ে থাকেন।
পবিত্র কুরআন নব্বই পারাঃ
সুফিদের মতে পবিত্র নব্বই পারা। সাধারণ মানুষের জন্য প্রকাশ্যে ত্রিশপারা কুরআন। আর আল্লাহর অলিদের কাছে রয়েছে আরো ষাটপারা কুরআনের জ্ঞান। যে জ্ঞান আল্লাহ্ সরাসরি তাদের পীর অলি আউলিয়াদের কলবে দান করেন। সেই জ্ঞানের দ্বারাই অলি আউলিয়ারা আসমান জমিন আরশ কুরছি ইত্যাদির জ্ঞান লাভ করে। সেইসাথে তাদের ভক্ত মুরিদদের সাহায্য সহযোগিতা করে।
জান্নাত জাহান্নাম সম্পর্কিত আকিদাঃ-
জান্নাত জাহান্নামের জন্য ইবাদত নয়ঃ
সুফিদের আকিদা হলো, জাহান্নামের ভয়ে এবং জান্নাতের আশায় কোনো ইবাদত করা যাবে না। যদি এইসবের উদ্দেশ্যে ইবাদত করা হয় তাহলে তা হবে শির্ক। তাদের মতে জান্নাত জাহান্নাম হচ্ছে আল্লাহর সৃষ্টি। আর আল্লাহর সৃষ্টির জন্য কোনো ইবাদত করলেই তা শির্ক। অতএব কেউ যদি জান্নাতের আশায় এবং জাহান্নামের ভয়ে ঈমান আমল আকিদা পালন করে তাহলে সে শির্কে লিপ্ত হবে। সুতরাং সুফিদের মতে জান্নাত জাহান্নামের কারণে ইবাদত করা বৈধ নয়।
জন্মগত মুসলিম হলেও সে জান্নাতীঃ-
সুফিদের প্রবল বিশ্বাস যে, তারা যেহেতু মুসলিম সুতরাং তারা যত পাপই করুক না কেন, একদিন না একদিন তারা জান্নাতে প্রবেশ করবে। অর্থাৎ জেনেশুনে ঈমান না আনলেও জন্মগত মুসলিম হলেও সে ব্যক্তি ঈমানদার। সুতরাং ঐ ব্যক্তি জান্নাতে কোনো না কোনো সময় যাবেই।
সুফিদের বিশ্বাস আল্লাহর প্রতি ঈমান থাকার কারণে তারা তাদের পাপ সমূহের শাস্তি ভোগ করার পর আবার জান্নাতে প্রবেশ করবে। কেননা জান্নাত হচ্ছে মানুষের দাদার বাড়ি। অর্থাৎ প্রথম মানুষ আমাদের আদি পিতা হযরত আদম আঃ যেহেতু জান্নাতে ছিলেন, সেহেতু জান্নাত হচ্ছে আমাদের তথা মানুষের দাদার বাড়ি।
শরীয়ত সম্পর্কিত আকিদাঃ-
শরীয়তের নিজস্ব উৎসঃ
ইসলামের নিজস্ব নির্দিষ্ট স্বতন্ত্র শরীয়তের থাকার পরও সুফিবাদের নিজস্ব শরীয়তের উৎস রয়েছে। তাদের বিভিন্ন পীর আউলিয়ারা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ইবাদত, আমল এবং ইবাদতের নিজস্ব নতুন নতুন পদ্ধতি আবিষ্কার করে এবং করতে পারে। তাদের উদ্ভাবিত ইবাদত এবং পদ্ধতি তাদের জন্য জায়েজ। যদিও আল্লাহর হুকুম এবং সুন্নাহ পদ্ধতি ছাড়া ইসলামে কোনো ইবাদতই গ্রহণযোগ্য নয়।
ইসলামী শরীয়তের প্রতি অনীহাঃ
সুফিরা সুপ্রাচীনকাল থেকে নিজস্ব ধ্যানধারণা নিয়ে চলতে অভ্যস্ত। সুফিদের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে সেটা আরো স্পষ্ট হবে। সেকারণে সুফিগণ ইসলামকে কেন্দ্র করে আশ্রয় নিলেও কখনোই ইসলামী শরীয়তের প্রতি আনুগত্য ও শ্রদ্ধাশীল হয়নি।
তাদের উচ্চ স্তরে বিশ্বাস যে সুফিরা নিজস্ব ইবাদত পদ্ধতি দিয়েই যখন আল্লাহ্ পর্যন্ত পৌঁছে যাচ্ছে সেহেতু শরীয়তের আনুষ্ঠানিক ইবাদত তাদের প্রয়োজন নেই। কুরআনের একটি আয়াতে ইয়াকীন না আসা পর্যন্ত আল্লাহর ইবাদত করতে বলা হয়েছে। সুতরাং সেহেতু সুফিরা আল্লাহ্ প্রাপ্তির ফলে ইয়াকীন পর্যন্ত পৌঁছে যায়। সেহেতু তাদের আর শরীয়তের আনুষ্ঠানিক ইবাদতের প্রয়োজন থাকে না। কেননা সুফিরা শুধুমাত্র আল্লাহ্ সন্তুষ্টি কামনা করে। তারা জান্নাতের আশায় অথবা জাহান্নামের ভয়ে ইবাদত করে না।
হিদায়েতের বিভিন্ন ত্বরিকার সৃষ্টিঃ
যদিও আল্লাহর কাছে হিদায়েতের পথ একটাই। আর তাহলো ইসলাম। কিন্তু সুফিদের মতে হিদায়াত পাওয়ার জন্য পথ বা রাস্তা কমপক্ষে ১২৬ টি (ভেদে মারেফাত) বা তারও বেশী। সুফিদের মতে আল্লাহর যেকোনো বান্দা সুফিবাদে এসে যেকোনো রাস্তায় গেলে অবশ্যই নাজাত পাবে। অর্থাৎ সুফিদের তৈরিকৃত বিভিন্ন ত্বরিকার যেকোনো একটিকে অনুসরণ করলেই যেকেউ নাজাত পাবে।
আমলগত আকিদাঃ-
ভক্তি প্রেমে আত্মশুদ্ধিঃ
সুফিদের মূল আকিদা হলো ভক্তি বা প্রেম। তারা আল্লাহর প্রেমে প্রেমিক হতে চায়। তাই তারা প্রথমে পীরের ভক্তি প্রেমে প্রেমিক হয়ে পরবর্তীতে আল্লাহ্ প্রেমে আল্লাহর প্রেমিক হয়ে উঠে। আল্লাহর সাথে আত্মিক এই প্রেমের সম্পর্ক তৈরি করার জন্য প্রতিটি মানুষকে নিজের আত্ম পরিচয় জানতে হয়।
আত্ম পরিচয় জানার পর নিজের কু প্রবৃত্তির নফসকে নিয়ন্ত্রণ করে আত্মশুদ্ধির চর্চা করতে হবে। পীরের সহচার্যে থেকে একজন মানুষ নিজেকে পরিশুদ্ধি করাই হচ্ছে সুফিদের উদ্দেশ্য। সুফিদের দাবি ইসলামী শরীয়তের আমল করে কখনোই মানুষ তার কু প্রবৃত্তির নফসকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। এই নফসকে নিয়ন্ত্রণ করতে হলে অবশ্যই সুফিদের অনুসারী হয়ে পীর অলি আউলিয়াদের হাতে বাইয়াত হতে হবে।
বিদআতের প্রচলনঃ
সুফিরা যেহেতু ইসলামী শরীয়তের বাইরেও নিজস্ব শরীয়তের উপর আমল করে, সেহেতু তাদের ঈমান আকিদা আমলে নিত্যনতুন ঈমান আমল যুক্ত হতে থাকে। সুফিবাদে বিভিন্ন গোষ্ঠী বিভিন্ন ত্বরিকায় ইবাদত আমলে অভ্যস্ত। তাই তাদের ঈমান আমল আকিদা হচ্ছে বিদআতের স্বর্গরাজ্য।
যেহেতু তাদের সংবিধানে বিদআত জায়েজ সেহেতু তারা বিদআতী আমলকে বিদআত মনে করে না। ইসলাম যেখানে বিদআতী আমলকে জাহান্নামের আগুনের সাথে তুলনা করা হয়েছে, সেই জাহান্নামের আগুনের আমলকে সুফিরা গ্রাহ্যই করে না। কেননা তাদের আকিদায় বিদআতকে বিদআতে হাসানা বলে জায়েজ করা হয়েছে। সুতরাং সুফিরা বিদআত করে জাহান্নামের আকিদার অনুসারী।
ইলমে লাদুনীতে বিশ্বাসঃ
সুফিগণ গোপন জ্ঞানার্জনে বিশ্বাসী। তারা তপস্যা সাধনায় এমন এমন জ্ঞান অর্জন করে যা প্রকাশ করা নিষিদ্ধ। সেইসব গোপন জ্ঞানের মাধ্যমে তারা আল্লাহ্কে ডাকে তাঁর কাছে যায়। সেইসব জ্ঞানই তাদের ভক্তদের তারা শিক্ষা দেয়। যদিও আদৌ সেইসব জ্ঞানের কোনো কুল কিনারা কেউ পায়নি। এইসব গোপন জ্ঞানের নাম সুফিরা দিয়েছেন ইলমে লাদুনী। যে জ্ঞানার্জনের কথা কুরআন হাদীসের কোথাও নেই।
লতিফার আমলঃ
সুফিবাদে আধ্যাত্মিকতার উৎকর্ষের জন্য লতিফা নামক কাল্পনিক একটি আমল চালু রয়েছে। যা সূফিবাদে একটি গুরুত্বপূর্ণ আলোচ্য বিষয়। তাদের মতে লতিফার সাথে মানুষের জড় জগতের কোন সম্পর্ক নেই। লতিফা বিষয়টি সম্পূর্ণরুপে আধ্যাত্মিক। সূফিদের ভাষায়, লতিফা মানুষের অন্তরের ভিতর অবস্থিত এমন কিছু নির্দিষ্ট স্থান, যার উপর আল্লাহ পাকের যিকিররত অবস্থায় আল্লাহ পাকের নূর অবতীর্ণ হয়। তারা বলে থাকে, লতিফা হল চিকন, পাতলা, সুক্ষ্মস্তর বিশিষ্ট একটি বস্তু যা মানুষের অন্তরের ভিতর বিশেষ স্থানে অবস্থিত। লতিফা এমন এক বিষয় যা কখনও চোখে দেখা যায় না, কানে শোনা যায় না এবং মস্তিষ্কে কল্পনা করা যায় না
লতিফা মোট দশটি। তাদের নাম হলঃ কলব, রুহ, শিররুন, খাবী, আকফা, নাফস, আব, আতস, খাক, বাদ লতিফা। তবে এসকল লতিফার ভিতর প্রথম ছয়টি লতিফা হল মূখ্য আর বাকিগুলো হল গৌণ।
মানতঃ
সুফিরা মানতে বিশ্বাসী। সুফিবাদে যেকোনো বিপদে আপদে, সন্তান কামনায়, দুনিয়াবী যেকোনো ইচ্ছাপূরণে পীর আউলিয়াদের নিকট মানত করে আর্জি দিলে তা পীর আউলিয়ারা ভক্তদের পূরণ করে দেন। উপমহাদেশে প্রতিটি পীর আউলিয়ার দরবারে মানতের জন্য আলাদা দানবক্স রাখা হয়। যেখানে যেকোনো ধর্মের লোকেরা তাদের মানত পূরণ হওয়ার জন্য টাকাপয়সা হাদিয়া দিয়ে থাকেন।
সংসার বিরাগী বৈরাগ্যবাদঃ
সুফিবাদের মুল গোড়াপত্তন হলো সংসার বিরাগী বৈরাগ্যবাদ থেকে। পৃথিবীর প্রায় সকল ধর্মে সংসার বিরাগী জীবনযাপনকে সাধুবাদ জানানো হয়েছে। যদিও ইসলাম এর বিপরতী। তবুও ইসলামের নামে সুফিবাদ সৃষ্টির শুরু থেকেই বৈরাগ্যবাদকে প্রাধান্য দিয়ে ধর্ম প্রচার করা হতো। ধীরে ধীরে সুফিদের বিভিন্ন আচার অনুষ্ঠানের পরিবর্তনের সাথে সাথে এই বৈরাগ্যবাদেও ভাটা পড়েছে।
আধুনিক বিশ্বের উন্নতির ফলে চারদিকে বিলাসিতার প্রভাব সুফিবাদেও পড়েছে। হাল আমলে সুফিদের প্রাতিষ্ঠানিক অংশ বৈরাগ্যবাদে বিশ্বাসী নয়। তারা আজ বিলাসি জীবনযাপন অভ্যস্ত। ভক্তদের হাদিয়া তোফার বরাতে প্রতিটি পীর আউলিয়ার দরবার আজ প্রাচুর্যে ভরপুর। ভক্তদের সাদাসিধে জীবনের বাণী শোনালেও নিজেরা ঠিকই বিলাসি জীবনে মত্ত।
বার্ষিক ওরস উদযাপনঃ
ইসলামে জন্ম মৃত্যু নিয়ে বার্ষিক কোনো অনুষ্ঠান নেই। কিন্তু সুফিবাদে পীর আউলিয়াদের জন্মবার্ষিকী ও মৃত্যুবার্ষিকী নিয়ে বিভিন্ন অনুষ্ঠান চালু আছে। সুফিদের পীর আউলিয়াদের জন্ম মৃত্যু নিয়ে তারা উরস উদযাপন করে। যেখানে পীরের ভক্তরা ঐদিন সবাই একত্রিত হয়। নাচ, গান, ওয়াজ, মাহফিল খানাপিনায় তারা উৎসব উদযাপন করে।
নাচ গান জায়েজঃ
মূল ইসলামে সকল প্রকার নাচ গান হারাম। কিন্তু সুফিবাদে নাচ গান করা জায়েজ। শুধু তাইনয় নারীপুরুষ নির্বিশেষে একত্রে আল্লাহর মনোরঞ্জনের জন্য নাচ গান হই হুল্লোড় করা জায়েজ। অর্থাৎ নাচ গানের মাধ্যমে আল্লাহর গুণকীর্তন করা। সুফিরা শরীয়তের দৈনন্দিন ইবাদতের চাইতে নাচ গানের আসরের দ্বারা আল্লাহর নৈকট্য হাসিলের চেষ্টা করে।
কবর সম্পর্কিত আকিদাঃ-
কবর মাজার সিজদাঃ
যেহেতু সুফিবাদ নিত্যনতুন ইবাদত আমল আবিষ্কারের বিশ্বাসী সেহেতু তাদের ঈমান আকিদায়ও নিত্যনতুন বিশ্বাস যুক্ত হতে থাকে। সুফিদের বিশ্বাস হচ্ছে পীর আউলিয়ারা মৃত্যুর পরও জীবিত। তাই তাদের কাছে চাইলে যেকোনো কিছু পাওয়া যায়। এইকারণে অতীতে সকল সুফিদের কবর মাজার হলেও কখনো সেখানে সিজদা হতো না। গত তিনি চারশ বছর ধরে প্রতিটি সুফির এবং তাদের খাদেমদের কবরও মাজারে রূপান্তরিত হচ্ছে। সেইসাথে ধীরে ধীরে প্রতিটি মাজার ভক্তদের সিজদার জায়গায় পরিনত হচ্ছে।
মৃত অলি আউলিয়ার কবরকে ভয়ঃ
সুফিদের বিশ্বাস যে, মৃত অলি আউলিয়ারা কবরে থেকেও মানুষের লাভ ক্ষতি করতে পারেন। তাই তারা মৃত অলি আউলিয়াদের কবরকে ভীতিসহকারে শ্রদ্ধা করে। তাদের বিশ্বাস যদি অলি আউলিয়ার কবরকে ভয় না করি, তাহলে তারা আমাদের ক্ষতি করতে পারে। তাই তারা আল্লাহ্কে যতটুকু না ভয় করে, তারচেয়ে অধিক ভয় করে অলি আউলিয়াদের কবরকে।
তাই সুফিরা কখনোই কবরকে অশ্রদ্ধা করে না এবং তাদের কবরকে অধিক থেকে অধিকতর সম্মান করে। তাদের কবরকে কখনো পিছনে দিয়ে কোনো কাজ করে না। রাস্তার পাশে কবর হলে কবরবাসীর ভয়ে তারা গাড়ি নেমে চলাচল করে। শুধু তাইনয় যারা চোর তারাও কবরবাসীকে ভয় করে। চোরেরা আল্লাহর ঘর মসজিদ থেকে টাকাপয়সা চুরি করলেও কখনোই মাজার থেকে কিছু চুরি করে না।
তাদের বিশ্বাস মসজিদ থেকে চুরি করলে আল্লাহ্ ক্ষমা করে শাস্তি দিবেন না। কিন্তু মাজার থেকে চুরি করলে অলি আউলিয়ারা নগদে শাস্তি দিবেন।অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সুফিদের আকিদা হলো, তারা আল্লাহকে ভয় পাওয়ার চাইতে মৃত অলি আউলিয়াদের ভয় বেশী পায়। তাদের ধারণা কোনো ভুল করলে আল্লাহ্ ক্ষমা করে দিলেও অলি আউলিয়ারা ক্ষমা করবেন না। তাই তাদের সাথে বিয়াদপী করা যাবে না। অর্থাৎ আল্লাহর ভয়ের চাইতে বান্দার ভয় বেশী।
নফসের জিহাদঃ
ইসলামে জিহাদ একটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ। যদি কখনো বিধর্মীদের দ্বারা ইসলামে আঘাত আসে তাহলে তা জিহাদ তথা সংগ্রামের মাধ্যমে প্রতিহত করা হচ্ছে একজন মুমিনের কাজ। সুফিগণ এই জিহাদে বিশ্বাসী নয়। তাদের মতে এই জিহাদের চেয়ে বড় জিহাদ হলো নফসের জিহাদ। অর্থাৎ আত্মশুদ্ধির জিহাদ।
শয়তান মানুষকে কু প্রবৃত্তির দিকে আহবান করে। আর আল্লাহ্ চায় যে মানুষ শয়তান থেকে বেঁচে থেকে আল্লাহর আরাধনা করুক। তাই সুফিদের মতে মানুষের মনের যেসব কু প্রবৃত্তি রয়েছে তা শয়তানের সাথে যুদ্ধ করে নিজেকে শুদ্ধ রাখতে পারেটাই হচ্ছে সবচেয়ে বড় জিহাদ। যাকে বলা হয় নফসের জিহাদ।
সুফিদের মতে রণাঙ্গনে জিহাদের ময়দানে যুদ্ধ করার চেয়ে শয়তানের সাথে যুদ্ধ করা কঠিন। তাই তারা জিহাদের ময়দন নয় মনের ময়দানকেই বেশী গুরুত্ব দেয়। যারফলে অধিকাংশ সুফিরা জিহাদ হাঙ্গামাকে পছন্দ করে না। তারা ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে সাম্যবাদী অসম্প্রদায়িক চিন্তাধারায় বিশ্বাসী।
সকল ধর্মই সত্যঃ
সুফিরা মানব প্রেমে বিশ্বাসী। তাদের ধ্যানধারণায় সবসময়ই কাজ করে মানবের সাথে ইশ্বরের প্রেম। সেজন্য প্রতিটি ধর্মের মানুষের সাথে সুফিদের রয়েছে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক। প্রতিটি ধর্মের অনুসারীরা পীর আউলিয়াদের দরবারে মাজারে গিয়ে মানত করে, আর্জি দেয় সিজদা দেয়। সুফিবাদী মুসলমাদের মধ্যে সিজদা চর্চা এদের থেকেই প্রভাবিত।
সুফিদের মতে প্রতিটি ধর্মীয় বিশ্বাসের মানুষই নাজাত পাবে যদি সঠিক ইশ্বর প্রেম থাকে। যেহেতু প্রতিটি মানুষই আল্লাহর সৃষ্টি সেহেতু প্রতিটি মানুষের ভালো কাজের বিনিময় অবশ্যই তারা পরকালে পাবে। এখানে তাদের আল্লাহর প্রতি ঈমান আনা শর্ত নয়। তারা যেকোনো ভাবে যেকোনো আল্লাহর অলির দরবারে নিজেকে সোপর্দ করলেই তারা পরকালে মুক্তি লাভ করবে।
শয়তান থেকে সাহায্য নেওয়াঃ
সুফিদের বিশ্বাস মাঝে মাঝে শয়তানও সত্য কথা বলে মুমিনদের উপকার করে। অর্থাৎ বিভিন্ন স্বপ্ন যোগে শয়তানও এমন কিছুর দিকনির্দেশনা দেয় যা মুমিনের জন্য সত্য।
শিয়া আকিদার অনুসারীঃ
সুফিদের অধিকাংশ আকিদাই হচ্ছে শিয়াদের আকিদা। শিয়াদের ঈমান আকিদার সাথে সুফিদের ঈমান আকিদার যথেষ্ট সাদৃশ্য রয়েছে। শিয়াদের উৎপত্তি ইরাক ইরানে। সুফিদের উৎপত্তিও পারস্য থেকে। শিয়ারা তাদের ইমামদের নবী রাসুল সমতুল্য মনে করে। ঠিক তেমনি সুফিরা অলি আউলিয়াদের। শিয়াদের ইমামরা যে সিলসিলায় প্রতিষ্ঠিত। সুফিরাও একই সিলসিলাহ তাদের পীর অলিদের জন্য ব্যবহার করে। মোটকথা গুটিকয়েক আকিদা ছাড়া অধিকাংশ আকিদাই হচ্ছে শিয়াদের আকিদা।
কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ
মোহাম্মাদ ইস্রাফিল হোসাইন। (বিএ ইন আরবি সাহিত্য ও ইসলাম শিক্ষা)
সাখাওয়াতুল আলম চৌধুরী
১২ নভেম্বর ২০২১
অলংকার, চট্টগ্রাম।