ফানা ফিস শাইখঃ
সুফিদের আকিদায় একজন মুরিদ বা শিক্ষার্থীকে প্রথমেই তার পীরের উপর ফানা হতে হবে। ফানা বলতে বিলীন হওয়া বুঝায়। ফানা ফিস শাইখ অর্থ হল শাইখ বা পীরে বিলীন হওয়া। পীর তার মুরিদ কে যে আদেশ করবে তা বিনা বাক্যে সেই মুরিদ মানার যোগ্যতা অর্জন করাই হচ্ছে ফানা ফিস শাইখ বা পীর। পীর প্রকাশ্যে শরীয়ত বিরোধী হুকুম দিলেও তা বিনা আপত্তিতে মেনে নিতে হবে। পীরের নির্দেশ হলে কুরআন এবং সুন্নাহতে কি আছে তা তার জানার দরকার নেই, বরং পীর সাহেবের নির্দেশ পালন করাই জরুরী। মুরিদের জায়েয নাজায়েয খোঁজার কোনো ইখতিয়ার নেই।
যেমনঃ আমাদের দেশে সবচেয়ে হক্কানী পীরের দাবিদার চরমোনের পীর সৈয়দ মোহাম্মাদ এছহাক বলেনঃ
‘’কামেল পীরের আদেশ পাইলে, নাপাক শারাবে (মদ) দ্বারাও জায়নামাজ রঙ্গিন করিয়া তাহাতে নামাজ পড়’। (সৈয়দ মোহাম্মাদ এছহাক এর রচনাবলী; আল-এছহাক পাবলিকেশন্স; বাংলাবাজার প্রকাশকাল ফেব্রুয়ারি ২০০৭; আশেক মা’শুক বা এস্কে এলাহী; পৃষ্ঠা নঃ ৩৫)।
মানিক গঞ্জের পীর মোঃ আজহারুল ইসলাম সিদ্দকের লেখা মারেফাতের ভেদতত্ত্ব বইয়ে বলেন, “যুক্তি ছাড়া মোর্শেদের বাক্য বিনা দ্বিধায় মানতে হবে। নিজের বিবেক বূদ্ধি, বিদ্যা, যুক্তি, কিতাবের এলম সবই বিসর্জন দিতে হবে। মোর্শেদের কথায় অন্ধভাবে কাজ করে জেতে হবে। তার সামনে একটা মরা মানুষ সাজতে হবে”।
অথচ ইসলামী শরীয়তে একমাত্র আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের অনুগত্য করার জন্য কোন শর্তারোপ করা হামার। তাছাড়া আর সকল আলেম উলামা পীর মাশায়েকসহ সকল উলুল আমরদের আনুগত্যই শর্ত সাপেক্ষে। তাদের অন্ধ আনুগত্য হারাম।
আল্লাহ তা’আলা কর্তৃক হারামকৃত বিষয়কে হালাল বা হালালকৃত বস্তুকে হারাম করার ক্ষেত্রে আলেমদের আনুগত্য করা হচ্ছে শির্কি কাজ। সুতরাং যেসব লোক হারাম হালালের ক্ষেত্রে তাদের আনুগত্য করল তারা মুলত আল্লাহ তা’আলার সমকক্ষ শির্কে ডুবে গেল।
আল্লাহ তাআলা বলেন,
" তারা আল্লাহকে বাদ দিয়ে নিজেদের উলামা ও দরবেশদেরকে নিজেদের ইলাহতে (উপাস্য) পরিণত করেছে৷ এবং এভাবে মারয়াম পুত্র মসীহকেও৷ অথচ তাদের মা’বুদ ছাড়া আর কারোর বন্দেগী কারার হুকুম দেয়া হয়নি, এমন এক মাবুদ যিনি ছাড়া ইবাদত লাভের যোগ্যতা সম্পন্ন আর কেউ নেই৷ তারা যেসব মুশরিকী কথা বলে তা থেকে তিনি পাক পবিত্র "৷ (সুরা তওবা- ৯:৩১)।
আনুগত্যের শির্ক হল, বিনা ভাবনায় শরিয়তের গ্রহণযোগ্য কোন প্রমান ছাড়াই হালাল হারাম জায়েজ নাজায়েজের ব্যপারে আলেম বুজুর্গ বা উপরস্থ কারো সিদ্ধান্ত অন্ধভাবে সন্তুষ্ট চিত্তে মেনে নেয়া।
হাদীসে বলা হয়েছে হযরত আদী ইবনে হাতেম নবী (সা) এর কাছে এসে ইসলাম গ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন খৃস্টান। ইসলাম গ্রহণ করার সময় তিনি নবী (সা) কে কয়েকটি প্রশ্ন করেন। এর মধ্যে একটি প্রশ্ন হচ্ছে, কুরআনের এ আয়াতটিতে (সুরা তওবা- ৯:৩১) আমাদের বিরুদ্ধে উলামা ও দরবেশদেরকে খোদা বানিয়ে নেবার যে দোষারূপ করা হয়েছে তার প্রকৃত তাৎপর্য কি?
জবাবে তিনি বলেন, তারা যেগুলোকে হারাম বলতো তোমরা সেগুলোকে হারাম বলে মেনে নিতে এবং তারা যেগুলোকে হালাল বলতো তোমরা সেগুলোকে হালাল বলে মেনে নিতে, একথা কি সত্য নয়? জবাবে হযরত আদী বলেন , হাঁ, একথা তো ঠিক, আমরা অবশ্যই এমনটি করতাম। রসূলুল্লাহ (সা) বলেন, ব্যাস, এটিই তো হচ্ছে তোমাদের প্রভু বানিয়ে নেয়া। (আহম্মদ, তিরমিজ, তাফসিরে ইবনে কাসির)।
রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলছেনঃ পাপ কাজের আদেশ না আসা পর্যান্ত ইমামের কথা শোনা ও তার আদেশ মান্য করা অপরিহার্য। তবে পাপ কাজের আদেশ করা হলে তা শোনা ও আনুগত্য করা যাবে না। (বুখারী হাদিস নং ২৭৫০)।
রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলছেনঃ স্রষ্টার বিরুদ্ধাচারন করে সৃষ্টির অনুগত্য করা চলবেনা। (আহম্মদ, মুসলিম)
আল্লাহর কিতাবের সনদ ছাড়াই যারা মানব জীবনের জন্য জায়েয ও নাজায়েযের সীমানা নির্ধারণ করে তারা আসলে নিজেদের ধারণা মতে নিজেরাই আল্লাহর বিধান দানের মর্যাদায় সমাসীন হয়। সুতরাং শরীয়তের হুকুমের বিপরীতে কেউ যদি হুকুম দেয় এবং তা যে যারা মান্য করবে তারা সুস্পষ্ট শির্ক করবে।
যদি কেউ এমন করে তারা এই আয়াত,
“তারা আল্লাহকে বাদ দিয়ে নিজেদের উলামা ও দরবেশদেরকে নিজেদের খোদায় পরিণত করেছে” এর অনুসারী হবে। তাই কখনোই পীরের উপর ফানা হওয়া যাবেনা। পীরকে ততক্ষণ পর্যন্ত অনুসরণ করা যাবে যতক্ষণ পর্যন্ত তিনি শরীয়তের উপর থাকবেন।
আল্লাহ ও রাসুলের প্রতি ইশকঃ
সুফিদের একটি আকিদা হলো তারা আল্লাহ্ এবং রাসুল সাঃ প্রতি প্রেম নিবেদন করে আল্লাহ্ প্রেমিক রাসুল প্রেমিক বনে যান। আরবি ইশক শব্দটির অর্থ প্রেম। হুব্বুন অর্থ ভালবাসা। এ দুটি শব্দের পার্থক্য করতে না পেরে সুফিগন আল্লাহ সাথে ভালবাসা না করে প্রেম করে। প্রেম বা ইশক এমন একটি পরিভাষা যা সকলের জন্য প্রযোজ্য নয়। কিন্ত ভালবাসা পরিভাষাটি সকলের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে।
একটা উদাহরন দিলে তা খুবই স্পষ্ট হবে।
কোন বিবেকবান জ্ঞান সম্পন্ন পুরুষ কি তার মা, বোন বা শাশুরীকে বলতে পারবে আমি আপনার সাথে প্রেম করব বা আমি আপনাদের সাথে প্রেম করি। অথবা আমি আপনাদের প্রেমিক! এগুলো সুস্পষ্ট অসভ্যতা ছাড়া আর কিছুই প্রকাশিত হবেনা।
কারন একজন সুস্থ জ্ঞানবান ব্যক্তি এমন অশোভন কথা বলতে পারেনা। কিন্ত ঐ ব্যাক্তি যাদি তার মা, বোন বা শাশুরীকে বলে আমি আপনাকে ভালবাসি। আপনাদের প্রতি আমার অশেষ ভালোবাসা। তাহলে কি কোন সমস্যা হবে? নিশ্চয়ই নয়।
সুতরাং যে শব্দটি মা, বোন বা শাশুরীর জন্য প্রযোজ্য নয় তা কি করে মহান আল্লাহ্ এবং তাঁর রাসুলের জন্য প্রযোজ্য হবে। সুফিরা আল্লাহর সাথে প্রেম করার পাশাপাশি নবী রাসুলদের সাথে ও প্রেম করে থাকে।
অথচ মহান আল্লাহ তার রাসুল (সাঃ) এর অনুসরণ করতে বলেছেন এবং তাতেই তিনি ভালবাসা তাঁর বান্দাদের ভালোবাসা দিবেন।
মহান আল্লাহ বলেন,
" বলুন (হে রাসুল) , যদি তোমরা আল্লাহকে ভালবাস, তাহলে আমাকে অনুসরণ কর, যাতে আল্লাহও তোমাদিগকে ভালবাসেন এবং তোমাদিগকে তোমাদের পাপ মার্জনা করে দেন। আর আল্লাহ হলেন ক্ষমাকারী দয়ালু"। ( সুরা ইমরান ৩:৩১)।
উপরোক্ত আয়াতে স্পষ্ট করে আল্লাহ্ বলে দিয়েছেন যে, রাসুল সাঃকে অনুসরণ করলেই আল্লাহর ভালোবাসা পাওয়া যাবে এবং গুনাহের ক্ষমা পাওয়া যাবে। যদি আল্লাহ্ এবং তাঁর রাসুল সাঃকে মুখে মুখে প্রেম করলাম অথচ অনুসরণ করলাম না তাহলে কখনোই আমরা আল্লাহর ভালোবাসা এবং ক্ষমা পাওয়া যাবে না।
গাউসুল আজমঃ
সুফিদের আকিদা হলো আবদুল কাদের জিলানী হচ্ছেন গাউসুল আযম। অর্থাৎ তিনি সবচেয়ে বড় উদ্ধারকারী। অধিকাংশ সুফিবাদীরা জানেনই না তারা কাকে কী বলে সম্বোধন করছে। সুফিরা জানেই না এটা একটা ফার্সি শব্দ!
আসলে এই পরিভাষাটি একটি শির্কি পরিভাষা। এর শাব্দিক অর্থ না জানার জন্যই এর ব্যবহার বেড়েছে। গাউস শব্দের অর্থ ত্রাণকর্তা, রক্ষাকর্তা, পরিত্রাণদানকারী, উদ্ধারকারী ইত্যাদি।আজম শব্দের অর্থ মহান,বড় বা সর্বশ্রেষ্ঠ।
তাহলে গাউসুল আজম শব্দের অর্থ হল সর্ব শ্রেষ্ঠ ত্রাণকর্তা। কোন অজ্ঞ মুসলিমকেও যদি বলা হয় তোমার বিপদে আপদে কে রক্ষা করে? কে তোমার ত্রানকর্তা? সে বিনা দিধায় বললে নিশ্চয়ই আল্লাহ। আর সুফিদের আকিদা হলো সবচেয়ে বড় উদ্ধারকারী হলো আবদুল কাদের জিলানী।
অথচ মক্কার মুরিশরাও বিশ্বাস করতো সবচেয়ে বড় উদ্ধারকারী এবং সবকিছুর একক ক্ষমতার মালিক হচ্ছেন আল্লাহ্।
আল্লাহ রব্বুল আলামিন বলেন,
" তুমি জিজ্ঞেস কর, কে রুযী দান করে তোমাদেরকে আসমান থেকে ও যমীন থেকে, কিংবা কে তোমাদের কান ও চোখের মালিক? তা ছাড়া কে জীবিতকে মৃতের ভেতর থেকে বের করেন এবং কেইবা মৃতকে জীবিতের মধ্য থেকে বের করেন? কে করেন কর্ম সম্পাদনের ব্যবস্থাপনা? তখন তারা বলে উঠবে, আল্লাহ! তখন তুমি বলো তারপরেও ভয় করছ না"? [ সুরা ইউনুস ১০:৩১ ]।
এই আয়াত দ্বারা এ কথা স্পষ্ট যে রাসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুগে মক্কার মুশরিকরা আল্লাহ তায়ালার তাওহীদে রুববিয়্যাহ ক্ষেত্র মহান আল্লাহর সাথে শির্ক করত না। তারা ত্রানকর্তা হিসাবে আল্লাহ রব্বুল আলামিন কে মানত।
অথচ ইসলামের নামে সুফিবাদ প্রচারকারীরা মুসরিকদের চেয়েও খারাপ ধারনা রাখে আল্লাহ সম্পর্ক। তাদের মতে আব্দুল কাদের জিলানীও ত্রানকর্তা। মহান আল্লাহ ছাড়া অন্য কেউ কি সর্বশ্রেষ্ঠ ত্রাণকর্তা হতে পারেন? কোন মানুষকে এ নামে ডাকার অর্থ হল তাকে আল্লাহর গুণাবলীতে গুণান্বিত করা। অথচ ইতিহাস দেখলে দেখা যায় আবদুল কাদের নিজেও কখনোই নিজেকে "গাউসুল আযম " দাবি করেনি। সুতরাং সুফিরা গাউসুল আযম ডেকে আল্লাহর সাথে সুস্পষ্ট শির্কে লিপ্ত হচ্ছে।
মাযার বা দরগাহঃ
মাযার একটি আরবী শব্দ যার অর্থ দর্শনীয় স্থান। যার ধাতুগত অর্থ ‘যিয়ারতের স্থান’। মাজার শব্দটি শুধু বাংলাতেই ব্যবহৃত হয়। দরগাহ ফারসী শব্দ যার অর্থ একই অর্থাৎ পরিদর্শনের স্থান, দর্শনীয় স্থান বা রাজসভা। তাই মাজার কে বলা যায় ফারসী দরগাহ শব্দের প্রতিশব্দ।
উপমহাদেশে মাজার বলতে সাধারণত আওলিয়া দরবেশগণের কবরকে বোঝায়। সুফিবাদীরা সুফীদের কবরস্থান যিয়ারত করতে পছন্দ করেন। তারা করব কেন্দ্রিক উরস অর্থাৎ জন্ম-মৃত্যুবার্ষিকী পালিত করে। তাদের আকিদাই হলো কবর কেন্দ্রিক। কবরকে তারা ইবাদতের স্থান আশা পূরণের স্থান উদ্ধার হওয়ার স্থান মনে করে।
ভারতীয় উপমহাদেশের আজমীরে খাজা মঈনউদ্দীন চিশতির মাজার, দিল্লিতে নিযামউদ্দীন আওলিয়ার মাজার, লাহোরে ফরিদউদ্দীন গঞ্জ-এ-শাক্কারের মাজার, সিলেটে হযরত শাহ জালালের ও হযরত শাহ পরাণের মাজার মাজার, রাজশাহীর শাহ মখদুম মাজার, ঢাকায় শাহ আলী বাগদাদীর মাজার, খুলনায় খানজাহান আলীর মাজার ইত্যাদি। চট্টগ্রাম মাজারের শহর হিসেবে খ্যাত, কারণ সেখানে বারো-আওলিয়ার মাজার আছে।
সকল পুরুষ মুসলমানের কবরই যিয়ারত করা বৈধ। মুসলমানের দাফনস্থলকে কবর বলা হয়। বুযুর্গ, নেককার ও ওলিদের দাফনস্থলকে মাজার না বলে কবর বলাই উত্তম। কেননা, নবী, রাসূল, সাহাবি, তাবেয়ী, তাবে-তাবেয়ি, ওলি-বুযুর্গ কারও কবরকে কুরআন-হাদীসে কোথাও মাযার শব্দ ব্যবহার হয়নি। তাই কোন কবরকে মাযার বলা যাবে না। রসুল (সা) কবরকে মাজার বলেন নাই, সাহাবীগণও বলেন নাই। কবর শব্দটি কুরআনে মোট আটবার এসেছে।
মহান আল্লাহ বলেন,
" এবং যখন কবরসমূহ উম্মোচিত হবে," [ সুরা ইনফিতার ৮২:৪ ]
সুতরাং কবর বললে আমরা পূণ্যের প্রত্যাশী হইতে পারি। কারণ এটা কুরআনের শব্দ হাদীসে সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ নবীদের দাফনস্থলকেও কবর বলা হয়েছে। এমনকি হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কবরকেও কবর শব্দেই উল্লেখ করা হয়েছে।
যেমনঃ সহীহ বুখারীতে বর্ণিত একটি হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন- ‘ইহুদী ও নাসারাদের উপর আল্লাহর লা’নত, কারণ তারা তাদের নবীদের কবরগুলোকে সিজদার স্থান বানিয়েছে। (সহীহ বুখারী ১/১৮৬)। এই হাদীসে নবীদের দাফনস্থলকে কবর বলা হয়েছে। সুতরাং বোঝা গেল, যত সম্মানিত ব্যক্তিই হোক তার দাফনস্থলকে কবর বলাই উত্তম।
অথচ সুফিরা নিজেদের কবরকে মাজার উল্লেখ করে যাবতীয় বিদআতী নাজায়েজ ইসলাম বিরোধী কার্যকলাপে লিপ্ত। কবর উল্লেখ করলে তো এইসব অনৈসলামিক কার্যক্রম চালানো সম্ভব হতো না।
রওজা বা রওজা শরীফঃ
সুফিরা রাসুলুল্লাহ সাঃএর কবরকে এবং তাদের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ পীর আউলিয়াদের করবকে রওজা বলে উল্লেখ করেন। রওজা একটি আরবী শব্দ। যার অর্থ বাগান বা উদ্যান। সহিহ হাদিসে রওজা শব্দটি এসেছে।
" আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। আমার ঘর ও আমার মিম্বরের মধ্যবর্তী স্থান জান্নাতের (রওজা) বাগান সমূহ হতে একটি বাগান। আর আমার মিম্বর আমার হাউজের ওপরে অবস্থিত। (সহিহ বুখারি ইঃফাঃ – ৬১৩৭)
মহানবী (সাঃ) কবরকে রওজা বলেছেন বা বলতে বলেছেন এমন কোন প্রমাণ নেই। কুরআন বা হাদীসে কোথাও কবরকে রওজা বলা হয় নাই। সাহাবীগণও বলেন নাই, তাবেয়ীগণও বলেন নাই। সুতরাং যারা পূণ্যবান ব্যক্তিগণের কবরকে ‘রওজা পাক’, ‘রওজা মোবারক’ বা ‘রওজা শরীফ’ বলে তা কবরের প্রতি তাদের ভক্তি বা শ্রদ্ধা প্রকাশের জন্যই বলে। এই ভক্তি বা শ্রদ্ধার বিষয়টি তাদের আকিদা বা বিশ্বাসে পরিণত হয়ে যায়। ফলে এটা শির্ক পর্যন্ত পৌঁছে যায়। যা আমরা সুফিদের আকিদায় পাচ্ছি।
এক হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর নিজের ব্যাপারেই বলেন, আমার কবরকে তোমরা উৎসবের স্থান বানিও না। (সুনানে আবু দাউদ ১/২৭৯)।
স্বয়ং সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর নিজের কবরকে যেখানে করব বললেন সেখানে সুফিরা কীভাবে তাকে রওজা বলে? কবরকে কবর বলাই ইসলামী পরিভাষা। কবরকে রওজা, দরগাহ, মাযার বলা যাবে না। সুফিরা এইসব বলে সাধারণ মুসলমানদের মধ্যে কবর প্রীতি সৃষ্টি করে। যে প্রীতি থেকে ভক্তি আসে ভক্তি থেকে বিশ্বাস এবং সর্বশেষে আসে শির্ক।
কাশফকে অলিদের নিজস্ব ক্ষমতা মনে করাঃ
সুফিরা দাবি করেন, অলিদের কাশফ তাদের নিজস্ব ক্ষমতা। তাদের মতে, মানুষের আধ্যাত্মিক সাধনার মাধ্যমে যখন তার হৃদয়ের পর্দা উঠে যায় তখন তাদের সামনে সৃষ্টি জগতের সকল রহস্য উন্মুক্ত হয়ে যায়। তার অন্তর আত্মা খুলে যায়। এবং এই অন্তর আত্মা খুলে যাওয়া কে তাদের পরিভাষায় কাশফ বলা হয়।
কাশফ হাসিল হয়ে গেলে আল্লাহ এবং সুফী সাধকের মাঝে কোন অন্তরায় থাকে না। তখন তারা জান্নাত, জাহান্নাম, সাত আসমান, জমিন আল্লাহর আরশ, লাওহে মাহফুজ পর্যন্ত ঘুরে আসতে পারেন। তারা গায়েবের সকল খবর, মানুষের অন্তরের অবস্থা এবং সাত আসমানে, জমিনে যা আছে তার সবই জানতে পারেন। তাদের স্বীকৃত যত অলী আওলীয়া আছে এবং ছিলো তাদের সকলেরেই কাশফ হত। কাশফ হওয়া অলী হওয়ার একটি শর্ত।
এবার দেখা যাক কাশফ সম্পর্কে ইসলাম কী বলে?
‘কাশফ ' অর্থ প্রকাশিত হওয়া বা অজানা কোন বিষয় নিজের কাছে প্রকাশিত হওয়া। অর্থাৎ আল্লাহ কর্তৃক তাঁর কোন বান্দার নিকট আল্লাহর অজানা এমন কিছুর জ্ঞান প্রকাশ করা যা অন্যের নিকট অপ্রকাশিত। এমনিভাবে কাশফ ইচ্ছাধীন কোন বিষয় নয় যে, তা অর্জন করা শরীয়তে কাম্য হবে বা সওয়াবের কাজ হবে। তবে অহী হলে তা কেবলমাত্র নবী-রাসূলগণের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। যেমন আল্লাহ বলেন,
‘তিনি (আল্লাহ্) অদৃশ্য জ্ঞানের অধিকারী। তিনি তাঁর (আল্লাহর) অদৃশ্যের জ্ঞান কারো নিকট প্রকাশ করেন না’। ‘তাঁর মনোনীত রাসূল ব্যতীত। তিনি তার (অহীর) সম্মুখে ও পশ্চাতে প্রহরী নিযুক্ত করেন। (সুরা জিন ৭২:২৬-২৭)।
তবে কখনও কখনও রীতি বহির্ভূতভাবে অন্য কারু নিকট থেকে অলৈাকিক কিছু ঘটতে পারে বা প্রকাশিত হতে পারে। যেমন ছাহাবী ও তাবেঈগণ থেকে হয়েছে। তবে মনে রাখতে হবে যে, এই ‘কাশফ ' কোন নবীর রাসুলেরও ইচ্ছাধীন নয়। এমনকি আমাদের রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামে ও ইচ্ছাধীন ছিলো না।
যেমন, সহিহ বুখারী, খন্ড ৬, অধ্যায় ৬০, হাদিস ৪৩৪। এর একটি ঘটনা সহীহ বুখারীর “তাফসির” অধ্যায়ে বর্ণনা করা হয়েছে এইভাবে, আয়িশা (রাঃ) হতে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, আল্লাহর রসূল (সাঃ) যয়নাব বিনতে জাহশ (রাঃ), রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এর একজন স্ত্রী, এর কাছে মধু পান করতেন এবং সেখানে কিছুক্ষণ থাকতেন। তাই আমি (আয়েশাহ) ও হাফসা একমত হলাম যে, আমাদের যার ঘরেই আল্লাহর রসূল (সাঃ) আসবেন, সে তাঁকে বলবে, আপনি কি মাগাফীর খেয়েছেন? আপনার মুখ থেকে মাগাফীরের গন্ধ পাচ্ছি। (আমরা তাই করলাম) এবং তিনি বললেন, না, বরং আমি যয়নাব বিনতে জাহশ এর ঘরে মধু পান করেছি। তবে আমি কসম করলাম, আর কখনো মধু পান করব না। তুমি এ বিষয়টি আর কাউকে জানাবে না।
আল্লাহ বলেন,
" যখন নবী তাঁর একজন স্ত্রীর কাছে একটি কথা গোপনে বললেন, অতঃপর স্ত্রী যখন তা বলে দিল এবং আল্লাহ নবীকে তা জানিয়ে দিলেন, তখন নবী সে বিষয়ে স্ত্রীকে কিছু বললেন এবং কিছু বললেন না। নবী যখন তা স্ত্রীকে বললেন। তখন স্ত্রী বললেনঃ কে আপনাকে এ সম্পর্কে অবহিত করল? নবী বললেনঃ যিনি সর্বজ্ঞ, ওয়াকিফহাল, তিনি আমাকে অবহিত করেছেন। (সুরা আত-তাহরীমের আয়াত -৩)।
আল্লাহর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের স্ত্রীগন গোপনে আলাপ করল অথচ তিনি কিছুই জানলেন। তার কাশফ ইচ্ছাধীন ক্ষমতা হলে সঙ্গে সঙ্গে জানতে পারতেন।
কোন এক সফরে ‘আয়িশা (রা) হার হারিয়ে গেল। সাহাবিদের পথে আটকিয়ে রেখে হার খোজ করা হল। এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে পেরেসানিতে ফেললেন। অথচ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামক যে উটে তিনি ছিলেন, হার খানা তার নীচে পড়ে ছিল। আল্লাহর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাশফ ইচ্ছাধীন ক্ষমতা হলে সঙ্গে সঙ্গে হার খানা পেয়ে যেতেন।
হযরত ইয়াকুব আলাইহিস সালাম দীর্ঘদিন পর্যন্ত ছেলে ইউসুফ আলাইহিস সালামে খবর না পাওয়ার কারণে কাঁদতে কাঁদতে অন্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। যদি কাশফ ইচ্ছেধীন কোন কিছু হতো, তাহলে ইয়াকুব আলাইহিস সালাম কাশফের মাধ্যমে খবর পেতেন নিশ্চয়ই।
অনুরূপ কাশফ হওয়ার জন্য বুযুর্গ হওয়াও শর্ত নয়। বুযুর্গ তো দূরের কথা, মুমিন হওয়াও শর্ত নয়। কাশফ তো অমুসলিমদেরও হতে পারে। বর্তমান সমাজে যেহারে তাবিজ তুমার জাদুটোনা ইত্যাদি চলছে তাও একপ্রকারের কাশফের মতোই। অর্থাৎ যেসব ব্যক্তি হাজিরা দেখার নামে এইসব করছে তারাও কিছু না কিছু সত্য ভক্তদের বলে দিচ্ছে। তা নাহলে আমাদের দেশে ব্যাঙের ছাতার মতো মগ তান্ত্রিক কবিরাজ জাদুটোনা ইত্যাদির ব্যাপক প্রসার হতো না।
অতএব এরূপ যদি কোন মুমিন থেকে হয়, তবে সেটা হবে ‘কারামত’। অর্থাৎ আল্লাহ্ তাকে এর দ্বারা সম্মানিত করেন। আর যদি কাফির থেকে ঘটে, তবে সেটা হবে ফিৎনা। অর্থাৎ আল্লাহ এর দ্বারা তার পরীক্ষা নিচ্ছেন যে, সে এর মাধ্যমে তার কুফরী বৃদ্ধি করবে, না তওবা করে ফিরে আসবে।
কাজেই কাশফকে অলিদের নিজস্ব ক্ষমতা মনে করা কুফরি। আল্লাহ তার বান্দদের মাঝে যাকে ইচ্ছা তাকে অদৃশ্যের খবর জানাবেন এটাই স্বাভাবিক।
অলি আউলিয়াদের কারামত তাদের ইচ্ছাধীনঃ
সুফিরা মনে করে অলি আওলিয়াদের নিজস্ব কিছু ক্ষমতা আছে। তাই তারা কারামতের ব্যপারে একটু বাড়াবাড়ি করে। তারা বিভিন্ন সময় দাবি করে থাকে অলী আওলিয়াগন মৃতকে জীবিত করে, অলীদের আদেশে নদ-নদী ও আসমান-যমিনের কাজ পরিচালিত হয়, ইলমে গায়েবের দাবী করে, ভবিষ্যৎ বর্ননা করে, মায়ের পেটের সন্তানের খবর বলে দেয়, দূরের খবর সেখানে না গিয়েই বলে দেয়, এক জায়গায় বসে অন্য জায়গার খবর বলে দেয় ইত্যাদি।
তাদের জীবিত ও মৃত কল্পিত পীর ও অলীদের মর্যাদা বাড়ানোর জন্য তাদের কারামত বর্ণনায় মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে মাত্রাতিরিক্ত বাড়াবাড়ি করে থাকে। যে সকল কাজ আল্লাহ ছাড়া অন্য কেউ করার ক্ষমতা রাখে না তা কখনও অলীদের কারামত হতে পারে না।
মানুষের হাতে অলৌকিক বা সাধারণ অভ্যাসের বিপরীত কোন ঘটনা ঘটলে তার পিছনে দুটি কারন থাকে। হয় যাদু না হয় কারামত। যে ব্যক্তি কুরআন ও সুন্নাহ পূর্ণ অনুসরণ করে তার হাতে যদি সাধারণ অভ্যাসের বিপরীতে কোন কিছু ঘটে তবে বুঝতে হবে এটা আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে এবং তা কারামত।
অপর পক্ষে যে ব্যক্তি কুরআন ও সুন্নাহ পূর্ণ অনুসরণ করে না, তার হাতে যদি সাধারণ অভ্যাসের বিপরীতে কোন কিছু ঘটে তবে বুঝতে হবে এটা আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে নয় এটা হয় ভেলকিবাজি না হয় যাদু। কাজেই বলা যায় কারামত ও যাদুর মধ্যে পার্থক্য করার জন্য কুরআন ও সুন্নাহ হচ্ছে একমাত্র মাপকাঠি।
কারামতে ব্যাপারে আহ্লুস্ সুন্নাতের বিশ্বাস হচ্ছে: আউলীয়াদের কারামত সত্য এবং তাতে বিশ্বাস করা জরুরি। তবে অলী হওয়ার জন্য কারামত প্রকাশিত হওয়া জরুরী নয়।
তবে মনে রাখতে হবে, আওলিয়াদের কারামত তাদের ইচ্ছাধীন নয়। এটা মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে তাদের জন্য একটা সম্মান। এমনকি অলীগণ তা জানতেও পারেন না। চ্যালেঞ্জ করে কারামত ঘটানোর ঘটনা সম্পূর্ণ মিথ্যা। কারন মহান আল্লাহ কারো কাছে দায় বদ্ধ নয়। এমন কি আমাদের প্রিয় রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকটও নয়।
যেমন: মহান আল্লাহর বলেন,
" আর দেখো, কোনো জিনিসের ব্যাপারে কখনো একথা বলো না, আমি কাল এ কাজটি করবো৷ তবে যদি আল্লাহ চান৷ যদি ভুলে এমন কথা মুখ থেকে বেরিয়ে যায় তাহলে সাথে সাথেই নিজের রবকে স্মরণ করো এবং বলো, “আশা করা যায়, আমার রব এ ব্যাপারে সত্যের নিকটতর কথার দিকে আমাকে পথ দেখিয়ে দেবেন৷ (সুরা কাহাব :২৩-২৪)।
কুরআন হাদিসে অসংখ্যা প্রমান আছে, পূর্ববর্তী যুগের অনেক সৎ লোক, সাহাবী, তাবেয়ী এবং পরবর্তী যুগের অনেক সৎ লোকের হাতে আল্লাহ্ অসংখ্য কারামত প্রকাশ করেছেন। যেমন মারইয়াম আলাইহিস সালাম, আসহাবে কাহাফ, জুরাইজ, আব্বাদ বিন বিশর, উমার বিন খাত্তাব, উসায়েদ ইবনে হুযায়ের এমনি আরও অনেক সাহাবীর হাতে আল্লাহ তাআলা কারামত প্রকাশ করেছেন।
সুতারং আওলিয়াদের কারামত ইচ্ছাধীন মনে করা কুফরি। এ ব্যপারে আহ্লুস্ সুন্নাতের আকিতা অনুসরণ করা উচিৎ। বাড়াবাড়ি করা ঠিক নয়।
তাবিজ কবজে বিশ্বাসিঃ
তাবীজ লটকানো, রিং, তাগা পরিধান করা, হাতে লোহা বা রাবারের আংটা লাগানো, সুতা, পুঁতির মালা বা অনুরূপ বস্তু ব্যবহার করা ছোট শির্ক। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
" যে ব্যক্তি কোন জিনিষ লটকাবে, তাকে ঐ জিনিষের দিকেই সোপর্দ করে দেয়া হবে" (তিরমিযী, শায়খ নাসির উদ্দীন আলবানী (রঃ) হাসান বলেছেন; সহীহুত তিরমিযী হা নং- ২০৭২ )
কোন এক সফরে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একজন লোক পাঠিয়ে বলে দিলেন যে, "কোন উটের গলায় ধনুকের রশি বা গাছের ছাল দিয়ে তৈরী হার ঝুলানো থাকলে অথবা যে কোন মালা থাকলে সেটি যেন অবশ্যই কেটে ফেলা হয়" (বুখারী)।
নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, “ঝাড়-ফুঁক করা, তাবীজ লটকানো এবং স্বামী বা স্ত্রীর মাঝে ভালবাসা সৃষ্টির জন্যে যাদুমন্ত্রের আশ্রয় নেয়া শির্ক”, ( আবু দাউদ, শায়খ নাসির উদ্দীন আলবানী হাদীছ সহীহ বলেছেন। দেখুনঃ সিলসিলায়ে সহীহা হাদীছ নং- ৬/১১৬১)।
এখানে যে ঝাড়ফুঁক করাকে শির্ক বলা হয়েছে, তা দ্বারা শির্কী কালামের মাধ্যমে ঝাড়ফুঁক উদ্দেশ্য। তবে ঝাড়ফুঁক যদি আল্লাহর কালাম, আল্লাহর সিফাত বা সহীহ হাদীছে বর্ণিত কোন বাক্যের বা দোয়ার মাধ্যমে হয়, তাতে কোন অসুবিধা নেই। কারন সহিহ হাদিস দ্বারা ঝাড়ফুঁক করাকে শরিয়ত সম্মত বলা হয়েছে।
নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অন্য এক হাদীছে বলেনঃ
“যে ব্যক্তি তাবীজ লটকালো সে শির্ক করল”। (মুসনাদে আহমাদ, (৪/১৫৬) ইমাম আলবানী সহীহ বলেছেন, দেখুন সিলসিলায়ে সহীহা হাদীছ নং- (১/৮০৯)।
নবী (সাঃ) এক ব্যক্তির হাতে পিতলের একটি আংটা দেখে বললেনঃ এটি কী? সে বললঃ এটি দুর্বলতা দূর করার জন্যে পরিধান করেছি। তিনি বললেনঃ “তুমি এটি খুলে ফেল। কারণ এটি তোমার দুর্বলতা আরো বাড়িয়ে দিবে। আর তুমি যদি এটি পরিহিত অবস্থায় মৃত্যু বরণ কর, তাহলে তুমি কখনই সফলতা অর্জন করতে পারবে না”।(মুসনাদে আহমাদ, দেখুনঃ আহমাদ শাকেরের তাহকীক, (১৭/৪৩৫) তিনি হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন।
হুজায়ফা (রাঃ) দেখলেন এক ব্যক্তির হাতে একটি সুতা বাঁধা আছে। তিনি তা কেটে ফেললেন এবং কুরআনের এই আয়াতটি পাঠ করলেনঃ
“তাদের অধিকাংশই আল্লাহকে বিশ্বাস করে; কিন্তু সাথে সাথে শিরকও করে”। (সূরা ইউসুফঃ ১০৬)
সাঈদ বিন জুবায়ের (রাঃ) বলেনঃ যে ব্যক্তি কোন মানুষের শরীর থেকে একটি তাবীজ কেটে ফেলল, সে একটি গোলাম আযাদ করার ছাওয়াব পেল। সাঈদ বিন জুবায়েরের এই কথাটি নবী (সাঃ) হতে বর্ণিত মারফু হাদীছের পর্যায়র্ভূক্ত।
পীর আউলিয়াদের ইলমে লাদুন্নীঃ
সুফিবাদে পীর আউলিয়াদের ইমলে লাদুন্নী নামে একটি বিশেষ জ্ঞানের কথা বলা হয়। যে বিশেষ জ্ঞান সম্পর্কে কুরআন হাদিসে কোনো সুস্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায় না। এটি এমন একটি জ্ঞান যা আল্লাহ্ সরাসরি তাঁর নির্বাচিত বান্দাদের দিয়ে থাকেন।
যে জ্ঞান দুনিয়ার কোনো জ্ঞান নয়। এই এক রহস্যময় জ্ঞান যা শুধুমাত্র আল্লাহ্ এবং তাঁর ঐ বান্দাদের মধ্যে সীমাবদ্ধ। এই জ্ঞানের দ্বারা পীর অলি আউলিয়ারা অতীত বর্তমান ভবিষ্যৎ দেখতে পারেন। কারো তকদীর পড়তে পারেন। যে কিতাব আল্লাহ্ লৌহে মাহফুজে সংরক্ষিত রেখেছেন সেই কিতাবও এই জ্ঞান দ্বারা পীর আউলিয়ারা জানতে পারেন।
এই জ্ঞান অর্জনের ফলে পীর আউলিয়ারা তাদের মুরিদ ভক্তদের যেকোনো অতীত ভবিষ্যৎ সম্পর্কে জানিয়ে তাদের বিবিধ বিপদ আপদ থেকে উদ্ধার করেন। তাই যারা এই জ্ঞান প্রাপ্তদের সাথে থাকেন তারা তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে নিরাপদে থাকেন। কেননা এই পীর আউলিয়ারা তাদের যেকোনো বিপদে আপদে আগেই জানিয়ে দিয়ে সাহায্য করে থাকেন।
এই ইলমে লাদুন্নী সম্পর্কে কুরআন সুন্নাহ সাহাবী তাবেয়ী তথা সালফে সালেহীন থেকে কোনো স্বীকৃতি বা প্রামাণ্য দলিল পাওয়া যায় না। যদি এই ইলমে লাদুন্নী সত্যিই আল্লাহর পক্ষ থেকে আসতো, তাহলে এই জ্ঞানের সর্বাধিক হকদার হলেন হযরত মুহাম্মদ সাঃ। আল্লাহ্ তাঁর প্রিয় হাবীব এবং সর্বশ্রেষ্ঠ রাসুলকে অবশ্যই সেই জ্ঞান দান করতেন।
যদি তিনি এই জ্ঞান প্রাপ্ত হতেন তাহলে তাঁর জীবনেও কোনো দুঃখ, দূর্দশা, হতাশা ইত্যাদি থাকতো না। কেননা আমরা আগেই দেখেছি যে আল্লাহর রাসুল সাঃ বিভিন্ন ঘটনায় তিনি আগেই কিছু জানতেন না পরেও জানতেন না। যতক্ষণ না আল্লাহ্ তাঁকে জানাচ্ছেন। রাসুলুল্লাহ সাঃ জীবনে এবং সাহাবীদের জীবনে এমন এমন ঘটনা ঘটেছে যা আগে থেকে জানতে পারলে তা অবশ্যই তাদের নগদে উপকার হতো! কিন্তু তা কখনোই আল্লাহ্ করেননি।
সুতরাং যেখানে আল্লাহর রাসুল এবং জান্নাতের সার্টিফিকেট প্রাপ্ত সাহাবীদের মধ্যে কেউ এই ইলমে লাদুন্নী প্রাপ্ত হননি, সেখানে কীভাবে এইসব অলি আউলিয়ারা ইলমে লাদুন্নী পেয়ে যাচ্ছেন বলে দাবি করছেন।
সুফিরা ইলমে লাদুন্নীর প্রমাণ দেওয়ার জন্য পবিত্র কুরআনের কাহাফের ৬৫ আয়াত তুলে ধরেন।
মহান আল্লাহ বলেন,
" অতঃপর তাঁরা আমার বান্দাদের মধ্যে এমন একজনের সাক্ষাত পেলেন, যাকে আমি আমার পক্ষ থেকে রহমত দান করেছিলাম ও আমার পক্ষ থেকে দিয়েছিলাম এক বিশেষ জ্ঞান।" ( সুরা কা’হফ ১৮:৬৫ )।
এই আয়াত উল্লখে করে তারা দাবি করে এই বিশেষ জ্ঞান যা আল্লাহুতা’লা হযরত খিজির আলাইহিস সালাম কে দান করেছেন তা ই হলো “ইলমে লাদুন্নী”। আল্লাহুতা’লা যাকে বিশেষ জ্ঞান বলেছেন, সুফিরা এই বিশেষ জ্ঞান কে “ইলমে লাদুন্নী” বলে চালিয়ে দেন। ইলমে লাদুন্নী বলতে তারা বুঝাতে চায় যে, এটি এমন একটি ইলম যা, আল্লাহর পক্ষ হতে খিজির আলাইহিস সালাম মত সুফীরা পেয়ে থাকে।
তাদের মতে এই জ্ঞান অর্জনের জন্য তাদের বিভিন্ন ত্বরিকার বিভিন্ন বিশেষ পদ্দতিতে সাধনা ও চেষ্টা দরকার। এজন্য তাকে আল্লাহর অলি বা প্রকৃত পীর মোর্শেদের সান্নিধ্যে থেকে পরম জ্ঞানময় আল্লাহ তায়ালার গায়েবী ইলম লাভ করে ইনসানে কামিলে পরিণত হতে হবে। তাদের ধারনা হল, এটি কেবল মাত্র অলী আওলীয়াগন আল্লাহর পক্ষ থেকে অর্জন করে থাকেন। সাধারন কুরআন হাদিসের কোন আলেমে এ জ্ঞান দেয়া হয় না।
সুফিদের এ ধারণা সম্পূর্ণ কল্পিত কারণ যে বিষয় ইসলামে থাকবে অথচ কুরআন হাদিসে থাকবেনা এটা কেমন করে হয়। যদি “ইলমে লাদুন্নী” কোন অলী আওলীয়াগন হাছিল করতে পারে তাহলে তা প্রথমে হাসিল করতেন রাসুলুল্লাহ সাঃ। তাঁর পরবর্তীতে হাসিল করতে পারতেন এই উম্মতের সবচেয়ে বড় অলী আওলীয়া যাদের কুরবাণীতে দ্বীন পেয়েছি সেই সাহাবীগণ। তাদের যেহেতু হাছিল হয়নি তাহলে কার হাছিল হতে পারে? এই জ্ঞান যদি আল্লাহর পক্ষ থেকেই হতো এবং তা রাসুলুল্লাহ সাঃ অবশ্যই প্রকাশ করতেন। কেননা রাসুল কোনো কথাই উম্মতের জন্য গোপন করে যাননি।
আল্লাহ বলেন,
" হে রসূল, পৌঁছে দিন আপনার প্রতিপালকের পক্ষ থেকে আপনার প্রতি যা অবতীর্ণ হয়েছে। আর যদি আপনি এরূপ না করেন, তবে আপনি তাঁর পয়গাম কিছুই পৌঁছালেন না। আল্লাহ আপনাকে মানুষের কাছ থেকে রক্ষা করবেন। নিশ্চয় আল্লাহ কাফেরদেরকে পথ প্রদর্শন করেন না"। [ সুরা মায়েদা ৫:৬৭ ]।
এ আয়াতে পরিস্কার বলা হয়েছে রাসূল তার নিকট অবতীর্ণ সকল বিষয় পৌঁছিয়েছেন। যদি তিনি ইলমে লাদুন্নী না পৌঁছে গোপন করেন তবে আল্লাহর কথা মত তিনি রিসালাতের দায়িত্বে অবহেলা করেছেন। (নাউজুবুল্লাহ)। তিনি রিসালাতের দায়িত্বে কোন প্রকার সামান্যতম অবহেলা করেননি, তার প্রমান বিদায় হজ্জে লক্ষাধীক সাহাবি সাক্ষ্য প্রদান।
এই মর্মে সুফিদের একটি বানোয়াট মিথ্যা কথা প্রচলিত আছে যে, জানা ইলমে আমল করলে, আল্লাহ অজানা ইলম দান করেন। আর এই অজানা ইলম হল “ইলমে লাদুন্নী”। যদিও এই কথা কোনো হাদীস নয় তবুও এই কথার ভিতরেই সুফিদের প্রতারণা লুকিয়ে আছে।
কেননা তারা বলছে, জানা ইলম আমল করলে তবেই আল্লাহ্ অজানা ইমল দান করবেন। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, সুফিবাদে শরীয়তের ইলম আমলের চর্চা হচ্ছে কতটুকু? আমরা সুফিদের আকিদা বিশ্লেষণ করে যা পাচ্ছি তাতে শরীয়তের ঈমান আমল আকিদার কোনো নাম গন্ধ নেই। বরং তারা সুস্পষ্ট ইসলামী ঈমান আমলের বিরোধী। তাদের ইয়াকীন হয়ে গেলে ইবাদত লাগে না। অথচ আল্লাহর রাসুলেরও ইয়াকীন আসেই নাই!
এই উপমহাদেশের যত পীর আউলিয়ারা দরবার মাজার আছে, তা ভালো করে পর্যবেক্ষণ করলে আমরা তাদের শরীয়তের কোনো আমল দেখতে পাবো না। সুতরাং তাদের কথায় যদি শরীয়তের আমল করলে গোপন ইলম পাওয়া যায় এবং তারা তা পাচ্ছেন বলে দাবি করছেন। অথচ তারা নিজেরাই শরীয়তের আমল করে না। এটা নিয়ে একটু চিন্তা করলেই আমরা সঠিক সত্যের সন্ধান পেয়ে যাবো ইনশা আল্লাহ্।
কৃতজ্ঞতা স্বীকার মুহাম্মদ ইস্রাফিল
সাখাওয়াতুল আলম চৌধুরী
২০২১
অলংকার, চট্টগ্রাম।