পীর
পীর নিয়ে আমাদের উপমহাদেশে নানান তত্ত্ব চালু আছে। আমরা কেউ এইসব তত্ত্বের বাইরে নই। যে যাই বলুক আমি নিজে যেমন পীর বিশ্বাস করি তেমন ক্ষেত্র বিশেষে পীরতন্ত্রকে অপছন্দও করি
পীর বিষয়ক এই গবেষণায় আমি চেষ্টা করব পীর সামগ্রিক যত কিছু আছে তা স্পষ্ট করে তুলে আনার জন্য। আমার ভুলও হতে পারে। যদি হয় তবে সুন্দর উপদেশের মাধ্যমে আমাকে সত্য পথ চেনাতে সাহায্য করবেন আশাকরি।
আমার বিশেষ অনুরোধ এই গবেষণামূলক লেখাটা সম্পূর্ণ পড়ে শেষ করবেন। যদি শেষ করতে পারেন তবে বুঝতে হবে আল্লাহ্ অবশ্যই আপনার উপর সন্তুষ্ট। কেননা আল্লাহ্ তাকেই ইসলামের জ্ঞান অর্জনে সহায়তায় করেন যাকে তিনি পছন্দ করেন। এই লেখাটা হয়তো আপনার আমার নাজাতের মাধ্যমও হতে পারে।
পীর শব্দের অর্থঃ
পীর শব্দটি ফার্সি। আরবিতে বলা হয়ে থাকে মুর্শিদ। এই শব্দ দুটি বাংলা করলে যা দাঁড়ায় পথপ্রদর্শক।
যিনি আল্লাহর আদেশ নিষেধ আল্লাহ্ যেভাবে চান সেইভাবে পালন করার প্রশিক্ষণ দেন তার নাম মুর্শিদ বা পথপ্রদর্শক কিংবা পীর।
মুরিদ শব্দের অর্থঃ
পীর শব্দ ফার্সি হলেও মুরিদ শব্দটি কিন্তু আরবি। যার সহজ বাংলা হলো -ইচ্ছাপোষণকারী। যে ব্যক্তি আল্লাহর আদেশ নিষেধ আল্লাহ্ যেভাবে চান সেইভাবে পালন করার ইচ্ছা পোষণ করে কোন পথপ্রদর্শক, শিক্ষক, উস্তাদ বা ইসলামী প্রশিক্ষককের হাত ধরে তাকে বলা হচ্ছে মুরিদ।
সোজা কথায় যিনি শরীয়তের আদেশ নিষেধ পালন করার প্রশিক্ষণ দেন তিনি হচ্ছেন "পীর "। আর যারা সেই প্রশিক্ষকের কাছ থেকে ইসলামী শিক্ষা গ্রহণ করেন তারা হচ্ছেন "মুরিদ "।
পীরবাদীদের সংজ্ঞাঃ
যারা পীরতন্ত্রে বিশ্বাসী তাদের মতে "পীর "হচ্ছেন এমন একজন প্রদর্শক, যার দেখানো পথে চললে আল্লাহর দেখা পাওয়া যায়। অর্থাৎ পীরের নির্দেশিত পথে চললে জান্নাত পাওয়া যাবে।
একটা কথা আমাদের জানা রাখা দরকার যে " পীর " শব্দটি যেহেতু ফার্সি সেহেতু পবিত্র কুরআন, হাদীসের কোথাও নেই এবং থাকার কথাও নয়। তবে যারা "পীর "কে প্রতিষ্ঠিত করতে চান তারা কুরআনের বিভিন্ন শব্দ যেমন - অলি, আউলিয়া, মুর্শিদ, ইমাম, ছিদ্দিকীন ইত্যাদি শব্দের দ্বারা পীরের প্রতিশব্দ হিসেবে ব্যবহার করেন।
উপমহাদেশে পীর -মুরিদঃ
আমরা একটু সহজ ভাবে এই বিষয় গুলো আলোচনা করবো। আমি নিজে স্বীকার করি যে, ইসলাম সম্পর্কে জানতে হলে অবশ্যই একজন না একজন বা একাধিক অভিজ্ঞ ইসলামী জ্ঞানীর সংস্পর্শে আসতে হবে। একজন ভালো প্রশিক্ষক ছাড়া কখনোই কোনো কিছু যেমন নিজে নিজে অর্জন করা যায়না। ঠিক তেমনি একজন ইসলামী জ্ঞানীর সংস্পর্শ ছাড়া কেউ ইসলামকে পরিপূর্ণ ভাবে বুঝতে পারবে না। আমরা যে জ্ঞানীর কথা বলছি, সেই জ্ঞানীকে আমাদের উপমহাদেশে বলা হচ্ছে "পীর "। কিন্তু আমাদের সমাজে জ্ঞান অর্জনের হাতিয়ার হিসাবে কতটুকু এই "পীর - মুরিদ "সম্পর্ক প্রতিফলিত হয়? পীর - মুরিদের যে বিষয়টা কুরআন ও হাদীস দ্বারা প্রমাণিত সেই বিষয় গুলো আমাদের উপমহাদেশে সম্পূর্ণ অনুপস্থিত।
কেন পীর ধরতে হয়ঃ
আমাদের পীর ধরতে বা মানতে বলা হয়। কারণ আমরা আল্লাহ্ কে ভয় করি। যেহেতু আমাদেরকে একশ্রেণির মানুষ আশ্বস্ত করেছে যে, আল্লাহ্ কে পেতে হলে পীর মানতে হবে। কাল কিয়ামতের ময়দানে আপনাকে উদ্ধার পেতে হলে পীর অবশ্যই ধরা লাগবে। সেকারনে আমরা "পীর "একটি শক্ত খুঁটি মনে করি। ইসলামের খুঁটি হচ্ছে পাঁচটি। কিন্তু উপমহাদেশে ইসলামের খুঁটি মনে করা হয় ছয়টি। কেননা যার পীর নেই তার পীর শয়তান!!! এমন কথাও বলা হয়। এখন কথা হচ্ছে আসলেই এইসব বিষয় কতটুকু সত্য? সেটা জানার জন্য আমাদের আরও গভীরে চিন্তা ভাবনা করতে হবে।
পীর - মুরিদের বাস্তবতাঃ
আমাদের দেশে পীর মুরিদের যে সংজ্ঞা দেওয়া হয়(অর্থাৎ পীর - মুরিদ নিয়ে যা চলে) তা কুরআন এবং হাদিসের শক্তিশালী দলিল দ্বারা সুস্পষ্ট ভাবে প্রমাণিত নয় (পীরের দলিল নিয়ে আলোচনা পরের অংশে হবে)। এই কথা শুনে অনেকই এই লেখাটি পড়া বন্ধ করে দিতে পারেন। কিন্তু সত্যিকারের ইসলাম পালন করতে হলে অবশ্যই আপনাকে ইসলাম কী সেটা জানতে হবে। আমরা যারা মুসলিম এটা কোনো পৈত্রিক পরিচয় নয়। মুসলিম হতে হলে জেনে শুনে বুঝেই মুসলিম তথা ইসলাম কে কবুল করতে হবে। যা আমরা অধিকাংশ মানুষই করি না। হাজার হাজার পীরের দরবারে লক্ষ কোটি মুরিদ রয়েছে। কিন্তু তাদের শতকরা ১ ভাগও সত্যিকারের ইসলামকে যাচাই করেছে কিনা সন্দেহ।
প্রকৃত ইসলামকে জানুনঃ
আসুন আমরা "পীর -মুরিদ " জানার আগে সঠিক ইসলামকে জানার চেষ্টা করি। আর ইসলামের মূল স্তম্ভ হলো পবিত্র কুরআন। আপনি যদি পবিত্র কুরআন একবার নিজের ভাষায় পড়ে বুঝতে চেষ্টা করলে খুব সহজেই অনেক কিছু আপনার কাছে পরিষ্কার হয়ে যাবে। এখন অনেকেই বলার চেষ্টা করবেন যে নিজে নিজে কীভাবে কুরআন বুঝবো? কুরআন বুঝতে হলে উস্তাদ লাগবে। এটা সম্পূর্ণ আল্লাহ্ বিরোধী কথা। যদি আপনি আপনার ভাষায় কুরআন পড়ে সাধারণ ভাবে যতটুকু বুঝা উচিত, ততটুকু বুঝতে না পারেন তবে আল্লাহ্ কেন বললো - আমি কুরআন কে খুলে খুলে বর্ণনা করেছি। আল্লাহ্ সবকিছু সহজ ভাবেই বর্ণনা করেছেন যাতে তাঁর বান্দারা সঠিকভাবে আল্লাহ্ কে চিনতে পারে। তবে হ্যাঁ কুরআনের আইনকানুন বুঝতে হলে শরীয়তের বিভিন্ন মাসালা - মাসায়েল বুঝতে হলে অবশ্যই একজন প্রকৃত জ্ঞানী তথা আলেম, ওলামা, শিক্ষক, প্রশিক্ষক বা পীর যাই বলুন তাঁর কাছে যেতে হবে।
কিন্তু সহজ বাংলায় যখন কুরআন বুঝতে চেষ্টা করবেন তখন আপনি ইসলামের মৌলিক বিষয় গুলো খুব সহজেই বুঝতে পারবেন। আর ইসলামের জ্ঞান অর্জন করা প্রতিটি মানুষের উপর ফরজ। আমরা যদি নিজেদের মুসলিম দাবি করি তাহলে অবশ্যই আমাদের কুরআন জানতে হবে। এই কুরআন জানা মানে কুরআন হেফজ করা বা আরবিতে রিডিং পড়ে খতম করা নয়। কুরআন জানা হচ্ছে আল্লাহ্ কুরআনে কি দিয়েছেন আমাদের জন্য সেটাই জানা। আমি শতভাগ নিশ্চিত আমাদের উপমহাদেশে সাধারণ যারা মুসলিম তারা তো নয় - ই বরং অনেক ইসলামী শিক্ষায় পড়াশোনা করেও পবিত্র কুরআনের তরজমা তাফসীর পড়েছে কিনা সন্দেহ। এই উপমহাদেশের মুসলিমদের দূর্বলতা এক জায়গায়। তারা ইসলাম পালন করে মানুষের মুখের কথায়। কখনোই কিছু যাচাই করে দেখার চেষ্টা করে না আসলেই এর গভীরে কী আছে।
পীরের দরবারে যেতে হলেঃ
প্রতিটি মুসলিমের জ্ঞান ইসলামী অর্জন ফরজ। এই জ্ঞান অর্জন করার জন্য বা ইসলামের প্রশিক্ষণ নিতে কেউ আলেম উলামা তথা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা পদ্ধতির মাদ্রাসায় পড়তে পারে। কিংবা ভালো একজন পরহেজগার বুজুর্গ, বা সাধারণ ভাষায় পীরের কাছে যেতে পারে। এই দুই জায়গায়ই হচ্ছে জ্ঞান অর্জনের প্রকৃত ক্ষেত্র। আপনি মাদ্রাসায় গেলে যেমন ইসলাম সম্পর্কে জানতে পারবেন, ঠিক তেমনি একজন আল্লাহ্ ওয়ালা ইসলামী জ্ঞানী ব্যক্তির কাছ থেকেও ইসলামের শিক্ষা নিতে পারেন।
যদি আপনি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় যান তবে সেখান সবকিছু আপনি স্পষ্ট ই দেখতে পারবেন ইসলাম কী। আর যদি অপ্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় যান অর্থাৎ পীরের দরবারে তাহলে আপনাকে ইসলামের মূল বিষয় তথা কুরআন জেনেই যাওয়া উচিত। কেননা আপনি ইসলামের কিছুই জানেন না তাহলে যে পীরের দরবারে গেলেন, সেখানে সঠিক ইসলাম না থাকলে আপনি পরকাল হারিয়ে ফেলবেন নিশ্চিত ভাবেই। কারণ আল্লাহ্ আপনাকে জ্ঞান দিয়েছেন সঠিক বিষয় যাচাই বাছাই করার। আপনি দুনিয়ায় একটা জমি কিনলেও হাজার যাচাই বাছাই করে দেখেন। এখন আখিরাতের বিষয়ে কেন যাচাই বাছাই করবেন না? এই যাচাই বাছাই বিশ্লেষণ অবশ্যই কুরআনের ভিত্তিতে হতে হবে। তাই কুরআনটা আপনার জানতে অর্থাৎ পড়তে হবে।
আপনি কোনো পীরের দরবারে গেলেন কিন্তু সেখানে কুরআন হাদীসের চর্চা নেই। অথচ আপনি ভালো নিয়ত করে গেছেন। হাদীসে এসেছে কেউ আল্লাহ্ কে পেতে কোথাও গেল কিন্তু যেখানে আল্লাহ্ ও তাঁর রাসুলের (সাঃ) চর্চা নেই, তাহলে আল্লাহ্ নিজেই তার জন্য একজন শয়তান ঠিক করে দেন। তাই আমাদের সঠিক জ্ঞানী চিহ্নিত করতে যাচাই বাছাই করতে হবে।
এখানে আমি পীরের বিরোধিতা করছি না। আমাদের দেশে পীর শব্দের যে ব্যাখ্যা দেওয়া হচ্ছে যেটা কখনোই সঠিক নয়। এই উপমহাদেশের সাধারণ মুসলিমরা খুবই কম ইসলাম সচেতন। তাদের এই দূর্বলতা কাজে লাগাচ্ছে একশ্রেণির প্রতারক। যদি কোনো দরবার বলে এখানে ইসলামের দরস দেওয়া হয় তাহলে সেখানে যাওয়া অবৈধ নয়। কিন্তু আমরা কি এমন দরবার দেখছি? যেখানে শুধু জ্ঞান অর্জনের দরবার খোলা হয়েছে?
কিন্তু আসল সত্যি হলো আমাদের উপমহাদেশে এমন দরবার নেই বললেও চলে। থাকলেও তা হাতেগোনা। যার খবর অধিকাংশ মানুষ জানে না। কারণ হাক্কানী পীরের দরবারে ব্যবসা হয় না। বরং নিজেদের টাকা পয়সা খরচ করে দরবার চালাতে হয়। অতএব সেইসব ৪৮ হাজার তথাকথিত পীরের দরবারে লক্ষ কোটি মুরিদ নিয়ে যা হয় তা কখনোই ইসলাম সমর্থন করে না।
দলিল ছাড়া পীরতন্ত্রের ভিত্তিঃ
এখন আমরা বাস্তবতার নিরিখে কিছু বিষয় আলোচনা করব। কুরআন - হাদিসের দলিল নয়। আসুন দেখি সাধারণ কিছু বিষয় নিয়ে এইসব পীরের দরবারকে পরীক্ষা করি তারা আসলেই কতটুকু যুক্তিযুক্ত।
সালাতঃ
যারা নিজেদের মুসলিম দাবি করবে তাদের প্রতি প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্ত সালাত আদায় ফরজ। অর্থাৎ অবশ্যই পালনীয়। যারা কাফির তারা সালাত আদায় করে না। হাদীসে এসেছে - কাফির আর মুসলিমের পার্থক্য হলো সালাত। অর্থাৎ যে এই সালাত আদায় করে না সে কাফির সমতুল্য পরিগণিত হয়। তাহলে এটাই ইসলামের মূল নির্দশন একজন ব্যক্তি নিজেকে মুসলিম দাবি করার।
অথচ আমরা কী দেখি? যদি এইসব পীরের দরবারে সঠিক ভাবে কুরআন এবং হাদীসের চর্চা হতো তাহলে বাংলাদেশের লক্ষ লক্ষ মসজিদ কেন পাঁচ ওয়াক্ত সালাতের সময় খালি থাকে? সপ্তাহে একদিন মসজিদে জায়গা হয় না, নফল ইবাদতের দিন জায়গা নিয়ে মারামারি লাগে। অথচ দৈনিক পাঁচ টি ফরজ কোটি কোটি মুসলমানের উপর ফরজ তা অনাদায়ি থেকে যাচ্ছে। তাহলে কীভাবে এইসব দরবার তথা পীরকে মেনে নেওয়া যায় যেখানে তারা আল্লাহর ফরজ প্রতিষ্ঠিত করতে নির্দেশ দেয় না। অথচ পীর মানতে হচ্ছে ইসলামের আদর্শকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য। শুধু তাই নয় আমার জানা মতে শতশত পীরের দরবার আছে যেখানে সালাত আদায় করা হয় না। তাদের কাছে শরীয়তের সালাত নেই। এইসব মেনে নিয়ে কীভাবে পীর নামক অবাঞ্ছিত বিষয়কে স্বীকৃতি দেওয়া যায়।
যদি ইসলামে এই তথাকথিত "পীরকে " সমর্থন দিতো তাহলে মসজিদ কানায় কানায় পরিপূর্ণ থাকতো। অথচ আমাদের রাসুল (সাঃ) মৃত্যু রোগে আক্রান্ত হওয়ার পরও সালাত ত্যাগ করেননি। অথচ পীরের দরবারে শিক্ষা দেওয়া সালাত ছেড়ে দেওয়ার!!!
জিহাদের ময়দানেও সালাত আদায়ের নির্দেশ এসেছে আল্লাহ্ থেকে। কিয়ামতের ময়দানে সর্বপ্রথম সালাতের হিসাব আগে নেওয়া হবে। অথচ এই সালাত ই সংখ্যাগরিষ্ঠ পীরের দরবারে নেই। তাহলে পীরতন্ত্রকে সমর্থন করবেন কীভাবে? এই বিষয় থেকে স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে পীর - মুরিদ নিয়ে এই উপমহাদেশে যা চলছে তা কুরআন হাদীসের বিপরীত।
অনেকেই বলতে পারেন যে, প্রতিটি দরবার থেকে সালাত আদায়ের নির্দেশ দেওয়া হয়। কিন্তু তা বিভিন্ন কারণে পালন করতে পারে না। এতে দরবারের কী দোষ? আপনার কাছে দোষ নেই। কিন্তু যিনি উপরে আছেন তাকে কি পীরেরা অজুহাত দিয়ে পার পাবেন?
কিছু সংখ্যক দরবার ছাড়া প্রতিটি দরবারেই বলা হয় - যতটুকু পারেন আমল করেন। বাকিটুকু কাল কিয়ামতের ময়দানে "বাবার " সুপারিশে পার পেয়ে যাবেন। এইযে এখানে "সুপারিশ " নামক শুভংকরের ফাঁকি রয়েছে তা সাধারণ জনতা বুঝতে পারে না। তারা এই " সুপারিশ " নামক অমূল্য রতনের আশায় ফরজ আমল ছেড়ে দেয়। তাদের কথা হলো - সালাত আদায় করিনা তো কী হয়েছে? আমার ঈমান অনেক পাক্কা। আমার জানতে ইচ্ছে করে -যে ঈমান একজন মানুষকে সালাতে নিতে পারে না, সেই ঈমান কীভাবে মানুষকে জান্নাতে নিয়ে যাবে? সালাত ত্যাগকারী সুস্পষ্ট কুরআন এবং হাদীস বিরোধী। এটা বুঝার জন্য মুফতি হওয়া লাগে না।
নৈতিকতা, সুদ, জুয়া, মাদক, জেনাঃ
যদি কাউকে জিজ্ঞাসা করা হয় এই দেশে কি সৎ লোক পাওয়া যায়? তার সহজ উত্তরে আমরা সবাই বলবো বর্তমানে সৎ পাওয়া খুবই দুঃসাধ্য একটি ব্যপার। কেননা আজ আমরা পরিস্থিতির কারণে অসৎ হয়ে গেছি বা হচ্ছি। কেউ চাইলেও সৎ থাকতে পারছে না ক্ষেত্র বিশেষে। সমাজের অধঃপতনের মুখে আজ খুব কম মানুষই সৎ থাকতে চায়। যে যেদিকে সুযোগ পাচ্ছে সেদিকে অবৈধ ফায়দা লুটার চেষ্টায় আছে।
এই পরিস্থিতিতে আমরা পবিত্র কুরআনকে যদি জিজ্ঞাসা করি, প্রকৃত মুমিনের কাজ কী? তবে কুরআন আমাদের বলবে, "সৎ কাজের আদেশ অসৎ কাজের নিষেধ। "এই ৪৮ হাজার পীরের দরবার যদি সত্যিকার মুমিনের দরবার হতো - তাহলে সেখান থেকে "সৎ কাজের আদেশ অসৎ কাজের নিষেধ।" এই স্লোগান ভেসে আসতো। যদি এটা হতো তাহলে বাংলাদেশ দূর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন হতো না। আজ রাষ্ট্র, সমাজ, পরিবার প্রতিটি পর্যায়ে দূর্নীতির কালো থাবা লেগে আছে। যদি পীরের দরবার হতে তাদের কোটি কোটি মুরিদদের সঠিক ইসলামের শিক্ষা দেওয়া হতো। যে শিক্ষা রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাঁর সাহাবীদের দিয়েছেন। তাহলে আমাদের দেশে এতো সুদ, জুয়া, মাদক, ঘুষ, স্বজনপ্রীতি, দূর্নীতিতে ভরে যেতো না।
আজ আমাদের সমাজে সুদ, মাদক, জুয়া, জিনা এই বিষয় গুলো যে কত ভয়ংকর হয়ে উঠেছে তা একজন স্বাভাবিক মানুষ মাত্রই অনুধাবন করতে পারেন। যদি আমরা মুনাফেক না হয়ে থাকি তাহলে এই সুদ, মাদক, জুয়া, জিনাকে ঘৃণা ভরে বর্জন করা উচিত। অথচ আজ এই বিষয় গুলো কত সহজেই আমাদেরকে গ্রাস করেছে। ৯০ ভাগ মুসলমানদের দেশে কীভাবে এইসব অনুমতি পেয়েছে। আর কেনইবা পীর নামক প্রকৃত মুমিনরা এইসবের বিরোধিতা করেনি এবং করছে না। প্রতিটি দরবার থেকে যদি ইসলামের সঠিক শিক্ষা দেওয়ার মাধ্যমে সুদের বিরুদ্ধে, মাদকের বিরুদ্ধে, জুয়া এবং জেনার বিরুদ্ধে বলা হতো তাহলে আজ এই দেশের পরিস্থিতি এমন হতো না। যদি পীরের মুরিদরা শিখতো। তারা তাদের পরিবারে সেই শিক্ষা দিতো। তাহলে তাদের সন্তানরা মাদক জুয়ায় ডুবে যেতো না। যদি বজ্র কন্ঠে প্রতিটি দরবার থেকে সুদের বিরুদ্ধে তথা ক্ষুদ্রঋণ এনজিও গুলোর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা হতো তবে এই দেশের মেয়েরা রাস্তায় নেমে যেতো না। সুদের ভারে হাজার হাজার পরিবার ধ্বংস হয়ে যেতো না।
যদি প্রতিটি দরবার থেকে সঠিক ভাবে যাকাত আদায়ের আদেশ দেওয়া হতো তাহলে এই দেশের মানুষ গরীব থাকতো না। যদি প্রতিটি স্বচ্ছল মানুষকে কর্জে হাসানা দেওয়ার জন্য উদ্বুদ্ধ করা হতো। তাহলে পয়সা অলা ব্যক্তির ভাই সুদে টাকা নিয়ে ব্যবসা করতো না। সুদের টাকায় মেয়ে দিতো না। সুদের টাকা না দিতে পেরে ফাঁসিতে ঝুলতো না। আমি নিশ্চিত হাজার হাজার দরবারে এই কর্জে হাসানা কী জিনিস সেটাও জানে না। অথচ আল্লাহ্ বলেন - তোমরা আল্লাহ্ কে উত্তম ঋণ দাও। আর আমরা পড়ে আছি সুদের সাগরে। কীভাবে ব্যাংকে কোটি টাকা রেখে বসে বসে সুদের টাকায় চলবো সেই চিন্তা করি। কিন্তু সাধারণ মুসলমানদের এইসব শিক্ষা কে দিবে? এই শিক্ষা দেওয়ার কথা দরবারের। এই শিক্ষার নাম দিয়েই পীরতন্ত্র চালু হয়েছিল। যখন সুফীরা উপমহাদেশে ইসলাম প্রচার করেন তখন এইসব দরবার দিয়েই ইসলামী শিক্ষা দেওয়া হতো। উপমহাদেশে পীরের প্রয়োজন ছিলো এইসব কাজে। আজ সেই পীরের দরবারকে করা হয়েছে বিনা পুঁজিতে ব্যবসার কাজে।
অনেকেরই আমার কথা পছন্দ হবেনা। কারণ প্রতিটি দরবার বসে থাকে কখন কোন মুরিদ কত টাকা নজরানা, হাদিয়া তোফা দিবে সেই আশায়। যদি মুরিদদের সৎ পথে চলতে বলা হয়, বা তারা সৎ হয়ে গেলে এইসব দরবারে পয়সা আসবে কোথা থেকে? দুহাতে অবৈধ পয়সা আয় করতে পারে বলেই তো দরবারে এতো হাদিয়া তোফা দিয়ে ভরপুর করতে পারে। যদি প্রতিটি দরবার থেকে ঘোষণা করা হতো - যারা মুরিদ হবেন তারা অবৈধ কোনো কাজে জড়িত থাকতে পারবেন না। কোনো প্রকার সুদ, ঘুষ, মাদকাসক্ত, মাদক কারবারী, দূর্নীতিগ্রস্থ ইত্যাদি অনৈতিক কাজে জড়িত হলে তারা পীরের মুরিদ থাকবে না। কিন্তু সত্যি এই যে আজ পর্যন্ত কোন দরবার থেকে এই ধরনের ঘোষণা দেওয়া হয়নি। অতএব এইসব পীরের দরবার বাস্তবতার আলোকে যে প্রশ্নবিদ্ধ তা সহজেই অনুমেয়।
পীরের ত্বরিকাঃ
উপমহাদেশে পীর ধরতে গেলে প্রথমেই করা "বাইয়াত "। অর্থাৎ পীরের প্রতি আনুগত্য। (এই বাইয়াতের সত্যতা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা আছে) । একজন মানুষ বাইয়াত নিয়ে মুরিদ হওয়ার সাথে সাথে তাকে দেওয়া বিভিন্ন জিকির আজগার ও অজিফা। যতবেশী জিকির ততবেশী অন্তর পরিষ্কার। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, যেসব জিকির, অজিফা দেওয়া হয় তা কতটুকু কুরআন এবং হাদীস সম্মত। যারা ঐসব দরবারের মুরিদ তারা শতভাগ কেউ ই এইসব নিয়ে মাথা ঘামায় না এবং এইসব সম্পর্কে জানেও না। কারণ তারা ইসলাম সম্পর্কে অজ্ঞ। যদি ইসলামে পীর ধরার সত্যিই কোন সিস্টেম চালু থাকতো তবে তা সবার চোখে প্রশ্নবিদ্ধ! কেননা একজন সাধারণ মুসলিম যে কিছুই জানে না তাকে যা দেওয়া হচ্ছে তাই গ্রহণ করছে। এখন যেসব পীরের ইসলাম সম্পর্কে নূন্যতম জ্ঞান নেই, তাদের পাল্লায় পড়ে লক্ষ হাজার লোক জাহান্নামের বাসিন্দা হবে। আল্লাহ্ কি সত্যি ই এমন? যে একজন তথাকথিত পীরের কাছে (যে কিনা বংশপরম্পরায় পীর) ইসলামের ঠিকাদারি দিয়ে রাখবেন?
অসুস্থ প্রতিযোগিতাঃ
যেকোনো পীরের দরবারে গেলেই শুনতে পারবেন অন্য পীর বা দরবারের কুৎসা বা গীবত। কে কার থেকে কত ভালো, কার দরবারে কত মুরিদ, কার ওরসে কত গরু, কার দরবার কত জাকজমকপূর্ণ ইত্যাদি নিয়েই রেষারেষি চলছে। এইসব দেখে যেকোন সাধারণ মানুষ মাত্রই বুঝতে পারবে এখানে আল্লাহর দেখা নয় বরং শয়তানের কাজের দেখা মিলবে।
মাজার ভিত্তিক দরবারঃ
বর্তমান সময়ে উপমহাদেশে যত দরবার আছে তার প্রতিটি দরবারের মূল উৎস হলো মাজার। একসময়ের আল্লাহর অলির কবরকে ঘিরেই গড়ে উঠেছে বংশপরম্পরায় পীরের ব্যবসা। যে আল্লাহর অলি দুনিয়া থেকে গত হয়েছেন তার বংশের ই একজনকে গদ্দীনসিন পীর বলে ঘোষণা দেওয়া হয়। ভবিষ্যতে তিনি ও আল্লাহর অলি হয়ে যান। আসলেই কি আল্লাহর অলি হওয়া এতো সহজ। এভাবে কি বংশপরম্পরায় আল্লাহ অলি, জ্ঞানী, উস্তাদ, শিক্ষক,পীর দিয়ে থাকেন? যদি দুনিয়ায় আল্লাহ্ এভাবেই বংশপরম্পরায় অলি পয়দা করেন তাহলে কি তিনি ন্যায় বিচার করছেন? (নাউযুবিল্লাহ)
যেখানে নবীর (আঃ) এর ছেলে, বউ, পিতা, চাচা ইত্যাদি জাহান্নামী হচ্ছে, তাদের বংশ পরিচয় তাদের জান্নাতে নিবে না। সেখানে অলির বংশে জন্ম নেওয়ার কারণে অলি বা পীর হয়ে যাচ্ছেন। ব্যপারটা কি এতোটাই সহজ? একজন আল্লাহর বান্দা তাঁর ইবাদত আমল দিয়ে আল্লাহর প্রিয়ভাজন হতেই পারেন। কিন্তু তার বংশ দিয়ে ক্রমান্বয়ে আল্লাহর অলি দুনিয়ায় চলে আসবেন, এটা কি হাস্যকর নয়?
বর্তমান পীরদের ধর্মীয় শিক্ষাঃ
আগেই বলেছি উপমহাদেশে বংশপারম্পরিক ভাবে পীর নির্বাচন করা হয়। তাই হাতেগোনা কয়েকজন ছাড়া প্রায় সকল নামাধারীর পীরদেরই সত্যিকারের ইসলামী কোনো জ্ঞান নেই। তারা ইসলামের সঠিক রীতিনীতি, মাসালা মাসায়েল, ফিকাহ শাস্ত্র, শরীয়তের খুটিনাটি ইত্যাদি বিষয়ের উপর কোনো জ্ঞান রাখে না। অথচ তারাই হয়ে যাচ্ছেন পীর। যাদের কাছে মানুষ মুরিদ হচ্ছে কিয়ামতে উদ্ধার পাওয়ার জন্য। যদি লক্ষ্য করা হয় বিভিন্ন পীরের দরবারে আল্লাহর নেয়ামত প্রাপ্ত কিছু বান্দা থাকে। যারা আল্লাহর কাছে প্রিয় হলেও তারা কখনোই পীর হতে পারে না শুধুমাত্র বংশের কারণে। অথচ পীর হওয়ার সকল যোগ্যতাই তাদের থাকে। অতএব বর্তমানে পীরের নামে যা চলছে তা কখনোই ইসলাম সম্মত নয় এটা খুবই স্পষ্ট। আপনারা নিজের জ্ঞান দিয়েই বিবেচনা করুন।
ইসলামের পূণ্যভূমিতে পীরতন্ত্রঃ
ইসলামের পূণ্যভূমি যেখানে ইসলামের আবির্ভাব হয়েছে সেখানে কি এই পীর বা পীরতন্ত্র আছে? আমাদের উপমহাদেশে ইসলাম প্রচার করেছেন বিভিন্ন সময়ে আল্লাহর অলিরা। তাঁরা ইসলাম প্রচার করতে গিয়ে বিভিন্ন দরবার বা দরসগাহ প্রতিষ্ঠা করেন। যাতে করে সাধারণ নওমুসলিমরা ইসলামী সঠিক জ্ঞান অর্জন করে পারে। এভাবেই দরবার বা দরসগাহ প্রতিষ্ঠিত হয়। যা বর্তমানে আল্লাহর অলির মৃত্যুর পর দরগাহ নামে পরিচিতি। এখন কথা হচ্ছে যেখানে আসল ইসলামের উৎপত্তি সেখানে কি এমন পীরের দরবার আছে?
যদি ইসলামে সত্যিকারে এই পীরতন্ত্র যা উপমহাদেশে চালু আছে সেটা থাকতো - তবে আরব ভূমির পুরো মধ্যপ্রাচ্যে লক্ষ লক্ষ পীর থাকার কথা। শুধু কি পীর? পীরের সাথে লক্ষ কোটি মুরিদ এবং সেইসাথে থাকতো অলি আল্লাহর মাজার। কিন্তু বাস্তবে কী দেখা যাচ্ছে? সমগ্র আরব বিশ্বে, যেখানে অরিজিনাল ইসলামের উৎপত্তি, যাদের ইসলাম থেকে এই উপমহাদেশে ইসলাম এসেছে সেখানে এইসব পীরতন্ত্র নেই। অথচ তাদের ধার করা ধর্ম আমরা পালন করছি কিন্তু অরিজিনাল না! বিষয়টা কি গোলমেলে নয়?
যদি ইসলামে সত্যিই এই পীরতন্ত্র থাকতো তাহলে তা সেখানে কোনো না কোনো ভাবে চালু থাকতো। কেননা আল্লাহর প্রেরিত ইসলাম ধর্মের মূল গোড়া সেখানে। এখন দেখা যাচ্ছে যেখানে আল্লাহ্ ইসলাম প্রেরণ করেছেন সেখানে আল্লাহর কোনো অলি নেই। যেখানে ২০০/৩০০ বছর পরে ইসলাম এসেছে সেখানেই আল্লাহর অলিতে ঠাসা। (এখানে নামধারী অলির কথা বলা হচ্ছে যারা বংশপারম্পরিক ভাবে অলি বনে যাচ্ছে )। অতএব এই বিষয়টি একটু খোঁজ নিলেই তো সবকিছু স্পষ্ট হয়ে যায় আসলেই ইসলামে কী আছে?
অনেকে না সবাই একবাক্যে বলেন যে, পীরের আরবি "শায়খ "।আমিও বলি পীরের আরবি "শায়খ "অর্থাৎ শিক্ষক বা উস্তাদ। এখন যারা বলেন পীর মানে আরবের শায়খ তাদের কাছে প্রশ্ন -এই শায়খরা আরব দেশে আমাদের উপমহাদেশের মতো কয়টা দরবার খুলে বসে আছেন? কতজনে বাইয়াত দিচ্ছে? কতজন মুরিদ আছে? কয়টি আল্লাহর অলির নামে মাজার আছে?
যে জায়গায় আল্লাহ্ তাঁর প্রিয় রাসুল (সাঃ) কে দ্বীন ইসলাম প্রচার করার জন্য পাঠিয়েছেন, যেখানে আল্লাহর রাসুল (সাঃ) বলে গেছেন ইসলামে প্রথম তিন প্রজন্ম হচ্ছে সবচাইতে শ্রেষ্ঠ ক্রমানুসারে। যে ভূমিতে আল্লাহর রাসুল (সাঃ) সোয়া লক্ষ জান্নাতি সাহাবী রেখে গেছেন। যে পূণ্যভূমিতে তাবেয়ী, তবেতাবেয়ীরা শুয়ে আছেন। সেই ভূমি এখন "বন্ধ্যা (অর্থাৎ সন্তান দানে অক্ষম) "হয়ে গেছে। সেখানে আর আল্লাহর অলি পয়দা হচ্ছে না। বিষয়টা কি এমন? আল্লাহ্ আমাদের জ্ঞান দিয়েছেন আসুন একটু হলেও সেটাকে কাজে লাগায়।
নারী - পুরুষের অবাধ মেলামেশাঃ
ইসলামে নারী পুরুষের অবাধ মেলামেশা বৈধ নয়। ইসলাম সমর্থন করে না বিনা কারণে ঘর থেকে কোথাও গমন করা যেখানে লক্ষ হাজার পরপুরুষের অবাধ চলাচল। এখন আমরা বিবেকের জানালা খুলে যদি পীরের দরবারের দিকে তাকাই তবে কী দেখবো? সেখানে নারী পুরুষের ঠাসাঠাসি ঠেলাঠেলি (বিশেষ করে মাজারের ওরসের সময়)। প্রয়োজনে নারী জ্ঞান অর্জনের জন্য বাইরে অবশ্যই যেতে পারে। তবে তা পর্দা করে এবং ঘরের পুরুষদের সাথে।
এখন আমরা পীরের আস্তানায় যা দেখি - মহিলা মুরিদরা পীরের কোলে বসে মুরিদ হন, ফয়েজ নেন (কিছু দরবার ব্যতীত)। শুধু তাই নয় এমন হাজার হাজার ঘটনা পত্রপত্রিকায় আসে আসছে এসেছে যে পীর মুরিদকে ধর্ষণ করেছে, টাকা পয়সা হাতিয়ে নিচ্ছে, ধর্ষণ করে ব্ল্যাকমেইলও করে যাচ্ছে দিনের পর দিন।
তাহলে কী দাঁড়ালো? জান্নাতের আশায় যারা পীরের দরবারে যাচ্ছে তারা জান্নাত পাবে তো দূরের কথা দুনিয়াটাই তো জাহান্নামে ভরে যাচ্ছে। এটা স্পষ্ট যে ইসলামের আইন (পর্দা) অমান্য করে কোথাও যাওয়াটা সম্পূর্ণ হারাম। সেটা কেন হারাম করেছেন আল্লাহ্? কারণ তিনি জানেন এভাবে অনুমতি দিলে সেখানে এই (ধর্ষণের) ঘটনা গুলিই ঘটবে। ইসলামে এমন কোন বিধিবিধান নেই যার দ্বারা কেউ অবৈধ ফায়দা নিতে পারবে। ইসলাম এমন কোনো কিছুকে সমর্থন করে না যার কেউ অন্যায় করতে পারবে।
যদি ইসলাম এই পীরতন্ত্রকে সমর্থন করতো তাহলে এইসব কুকীর্তি গুলো কখনোই ঘটতো না। নারীদেরও জ্ঞান অর্জনের অধিকার আছে। তবে সীমার আওতায়। নারীরা অবশ্যই জ্ঞানের উদ্দেশ্যে ঘরের পুরুষদের সাথে নিয়ে যেকোনো জায়গায় যেতে পারে যেখানে আল্লাহর বিধানে আছে। কিন্তু আমরা যদি এইসব তথাকথিত পীরের দরবার গুলোর দিকে তাকাই তবে দেখতে পাবো সেখানে জ্ঞানার্জন নয় বরং ভোজন কীর্তন, নাচন কুদন ইত্যাদি-ই হয়। যা ইসলাম সমর্থন করে না। যা ইসলাম অনুমতি দেয়নি সেখানে গিয়ে কীভাবে আপনারা আল্লাহর জান্নাতের আশা করছেন?
বিধর্মীদের অবাধ যাতায়াতঃ
এই উপমহাদেশে এমন এমন পীরের দরবার রয়েছে যেখানকার মুরিদ বিভিন্ন ধর্মের অনুসারীরা। অর্থাৎ পীর মুসলিম হলেও তার মুরিদ অন্য ধর্মের। এইসব দরবার বা পীরের মতবাদ হচ্ছে মানুষ যেই ধর্মের হোক না কেন তাদের কাছে এসে মুরিদ হলেই আল্লাহ্ নাজাত দিবেন (না'উবিল্লাহ)। যেকারণে উপমহাদেশে হাজার হাজার মাজারে বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের ভীড় লেগেই থাকে। তারা কখনোই ইসলামকে পছন্দ করে না। কিন্তু পীরকে বা সেই আল্লাহ্ অলিকে ভালোবাসে। অথচ কুরআনে বলা হচ্ছে মুশরিকরা নাপাক। এই নাপাক ব্যক্তিরা কত অনায়াসেই পীরের মাজারে দরবারে অবাধ মেলামেশা করছে। যা সম্পূর্ণ কুরআন বিরোধী।
তবে হ্যাঁ, তারাও দরবার বা মাজারে যাওয়ার অনুমতি অবশ্যই আছে। তবে তা ইসলাম বুঝার জন্য জানার জন্য। ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট হওয়ার জন্য। যাতে তারা ইসলাম কবুল করতে পারে। ইসলামের সৌন্দর্য দেখতে, ভাতৃত্ববোধ দেখতে অবশ্যই তাদের স্বাগতম জানানো হবে। কিন্তু যারাই সেখানে যায় তারা কখনোই ইসলাম গ্রহণের নিয়তে এইসব দরবার বা মাজারে যান না। এই বিষয় থেকে কী বুঝা যাচ্ছে? যেসব মুশরিক মাজার বা দরবারে যাচ্ছে তারা দুনিয়াবী কারণে যাচ্ছে। তাদের আখিরাতের চিন্তা নেই। কেননা তারা মুশরিক তাদের ঈমান নেই।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে কেন দরবার বা মাজার অলারা এদের আসতে সুযোগ দিচ্ছে? দরবার বা পীরের কাজ হচ্ছে ইসলাম প্রচার এবং প্রসার করা। তাহলে তাদের তো দায়িত্ব হচ্ছে এইসব মুশরিকদের কাছে ইসলাম প্রচার করা। কিন্তু তারা তা করে না। কারণ যদি তারা ইসলাম প্রচারের কাজ করে তবে এইসব মুশরিক, বিধর্মীরা আর দরবার বা মাজারে আসবে না। আর যদি তারা না আসে তাহলে দরবার বা মাজারের ইনকামও হবেনা।
এটা দ্বারা স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে যে পীর নিয়ে যে ধারণা এই উপমহাদেশে প্রচারিত হচ্ছে তা কখনোই সঠিক নয়। যদি সঠিক হতো তাহলে এইসব দরবার হতে দলে দলে ইসলাম প্রচার এবং প্রসারের কাজ হতো। কেউ কোনো দৃষ্টান্ত বর্তমানে দেখাতে পারবে না যেখানে তারা বিধর্মী মুশরিকদের ইসলামে ধর্মান্তরিত করেছে। অথচ যে সময় উপমহাদেশে ইসলাম প্রচার করেন তৎকালীন আল্লাহর অলিরা যারা সত্যিকারের জ্ঞানী (বা পীর) ছিলেন তাঁরা তাদের দরবার প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন ইসলাম প্রচারের জন্য। কোনো প্রকার হাদিয়া তোফা পাওয়ার জন্য নয়। তাদের দুনিয়াবী কোন স্বার্থ ছিলো না। তাদের জীবনীর দিকে তাকালে দেখা যাবে যে তাঁরা কত সাধারণ জীবনযাপন করে দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছেন।
অথচ বর্তমানে এমন কোন পীর বা দরবার বা মাজার নেই যেখানে তাদের কোটি টাকার কম সম্পত্তি আছে। এতেই স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে উপমহাদেশে যে পীরতন্ত্র আল্লাহর অলিদের নাম দিয়ে শুরু করা হয়েছে তার বাস্তব এবং ইসলামী কোনো ভিত্তি এবং যৌক্তিকতা নেই। একটু বিবেক দিয়ে চিন্তা করলেই আমরা তা বুঝতে পারবো।
পীর এবং কবরকে সিজদাঃ
একসময় গোপনে হলেও বর্তমানে খুবই স্পষ্ট এবং খোলামেলা ভাবেই সাধারণ মানুষ পীরকে এবং মাজারে কবরকে সিজদা করছে। অথচ ইসলাম একমাত্র আল্লাহ্ ছাড়া কারো কাছে মাথা নত করার স্বীকৃতি দেয় না। আল্লাহ্ ছাড়া কাউকে সিজদা করার স্পষ্ট অর্থে শির্ক। অর্থাৎ সিজদা একমাত্র আল্লাহ্ পাওয়ার যোগ্য। সেখানে অন্য কাউকে সিজদা করে মানুষ সিজদায় আল্লাহর সাথে অন্যকে তাঁর শরিকদার বা অংশীদার করলো। যা কখনোই ইসলাম সমর্থন করে না। বান্দাদের সকল গুনাহ কিয়ামতে চাইলেই আল্লাহ্ ক্ষমা করে দিতে পারেন। কিন্তু একটিমাত্র পাপ যা সবচাইতে বড় গুনাহ তাহলো "শির্ক " বা অংশীদার করা, এটি কখনোই ক্ষমা করা হবেনা। আর এই সবচাইতে বড় গুনাহটি প্রতিনিয়তই হচ্ছে সকল মাজারে পীরের (গুটিকয়েক বাদে) দরবারে।
ইসলাম এসেছে শির্ক মুক্ত করতে। অথচ এই শির্ক ই মহা ধুমধামের সাথে ১৮০ মাইল বেগে আমাদের উপমহাদেশে চলছে। এতো সর্বনিকৃষ্ট পাপ করার উন্মুক্ত জায়গায় পীরের দরবার আর মাজার হলেও কেন তা ইসলাম বিরোধী নয় তার কোনো ব্যাখ্যা কি আছে?
কুরআনের স্পষ্ট আয়াত দ্বারা প্রমাণিত নিকৃষ্ট কাজকে যারা জায়েজ করতে চান, তারা যুক্তি দেখান যে - হযরত ইউছুফ (আঃ) কে তাঁর পিতামাতাসহ ভাইয়েরা সম্মান সূচক (তাজিমী) সিজদা করেছিল। সেই খাতিরে তারাও পীরকে মাজারের কবরকে সম্মান সূচক সিজদা করছে। অথচ এটা খুবই স্পষ্ট যে প্রতিটি নবী রাসুল (আঃ) এসেছিলেন প্রত্যেকের নির্দিষ্ট জাতি বা গোত্রের কাছে। প্রতিটি নবী রাসুলের (আঃ) এর তৎকালীন ইসলামী শরিয়ত ছিলো আলাদা আলাদা। প্রতিটি নবী রাসুলদের (আঃ) আইনকানুন শুধুমাত্র সেইসব নবী রাসুলদের জাতি বা গোত্রের জন্য ই নির্দিষ্ট ছিলো। তাই আগের নবী রাসুলদের (আঃ) কোনো শরিয়তই এখন কার্যকর নয়।
সহীহ্ বুখারী শরীফে এসেছে -একবার হযরত উমর (রাঃ) ইহুদীদের তাওরাতের একটি অংশ রাসুল (সাঃ) কে পড়ে শোনাচ্ছিলেন। সেইসময় রাসুলুল্লাহর (সাঃ) চেহারা মোবারক রক্তিম হয়ে উঠে। এবং বলেন যে - আজ মুছা (আঃ) নবীও বেঁচে থাকলে তাঁর (মুহাম্মদ সাঃ) আনুগত্য করতে হতে। এটি দ্বারা স্পষ্ট হয়ে যায় যে আগের সকল নবী রাসুলদের কিতাব এবং শরিয়ত সবই আখেরি জামানায় বাতিল হয়ে গেছে। সুতরাং তাদের কোন (ইবাদত ই) এখন দলিল হিসাবে গ্রহণযোগ্য নয়।
পীর বা কবরকে সিজদা না করার শত শত সহীহ্ হাদীস রয়েছে। কিছু সাহাবী ইচ্ছা পোষণ করেছেন যে তাঁরা রাসুল (সাঃ) সিজদা করবেন। কিন্তু রাসুল (সাঃ) স্পষ্ট জানিয়ে দিলেন - আল্লাহ্ ছাড়া কাউকে সিজদা করা যাবে না। যদি যেত তাহলে তিনি বলতেন প্রতিটি স্ত্রীকে তাদের স্বামীকে সিজদা করার জন্য। এখানেও স্পষ্ট যে কোনো মানুষকে সিজদা করা যাবে না। সেখানে পীর বা কবরকে সিজদা কীভাবে জায়েজ হবে?
বুখারী শরিফে আরও স্পষ্ট হাদীসে এসেছে - তোমরা কবরকে সিজদার জায়গা বানিয়ো না। ইহুদি নাসারাদের উপর আল্লাহর লানত যে, তাদের তাদের কবরকে সিজদার স্থান বানিয়েছে। এতো এতো স্পষ্ট সহীহ হাদিসের পরও কীভাবে পীর এবং কবরকে সিজদা করা জায়েজ হবে?
পীর এবং মাজারে মান্নতঃ
আমাদের উপমহাদেশে মান্নত করা খুবই স্বাভাবিক একটি জিনিস। অথচ ইসলামে মান্নত করতে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। যদিও করে তবে তা একমাত্র আল্লাহর উদ্দেশ্যে করতে হবে। আমাদের উপমহাদেশে যা চলছে সবই ইসলামের বিপরীত। এখানে মান্নত করা হয় পীরের দরবার বা মাজারকে কেন্দ্র করে। কোনো বিপদ আপদ বা কোনো ভবিষ্যৎ চাওয়া পাওয়া থাকলে উপমহাদেশের সাধারণ মুসলমানরা মান্নত করে পীরকে বা মাজারকে দেওয়ার জন্য। যা সরাসরি ইসলাম বিরোধী। আমাদের ইসলামী জ্ঞান না থাকার কারণে প্রতিটি জায়গায় আমরা এমন এমন কাজ করে চলেছি আল্লাহর সন্তুষ্টির আশায়। যা কখনোই আল্লাহর সন্তুষ্টি বয়ে আনবে না বরং জাহান্নামে ঠিকানা করছি। কিন্তু যা করছি তা ইবাদত মনে করেই করছি।
ওরসে তবারুক বেচাকেনাঃ
প্রতিটি পীরের দরবার এবং মাজারে প্রতিবছর বিভিন্ন দিবস উপলক্ষে ওরস হয়। এইসব ওরসে সবার জন্যই খাওয়াদাওয়ার আয়োজন হয় সকাল বেলা। যেহেতু ওরস হয় রাত্রে সেহেতু যারা রাত্রে যান তারা খানাপিনা খেতে চাইলে মাজারে অনুদান দিয়ে খেতে হয় (কিছু দরবার ব্যতীত)। অথচ এখানে যা খানাপিনা তৈরি হয় তার সবই সাধারণ মুরিদ এবং জনগণের টাকায়। ইসলাম বলে মানুষকে দান আহার করাও। অথচ পরের টাকায় যা তৈরি হচ্ছে সেই খাবারও বিক্রি হয় এইসব দরবার এবং মাজারে। যদি সত্যিই এই সিস্টেম ইসলামে থাকতো। তাহলে এইসব অনৈইসলামিক কাজ কীভাবে ইসলাম সাপোর্ট করতো? অথচ ইসলাম এইসব কখনোই সমর্থন করে না।
পীর এবং মাজারপন্থীদের বিলাসী এবং কর্মহীন জীবনঃ
প্রতিটি নবী রাসুল (আঃ) গণ খুবই সাধারণ জীবনযাপন করেছেন। তাঁরা নিজেরা কর্ম করে নিজেদের এবং পরিবার পরিজনের ভরণপোষণ দিয়েছেন। সেখানে বর্তমানে যেসব পীর এবং মাজার পন্থী বংশপারম্পরিক মানুষ রয়েছে, তাদের জীবনযাপন লক্ষ্য করলে আমরা কী দেখি? একজন পীর এবং মাজারবাদী লোকও সাধারণ জীবনযাপনে নেই। তাদের রয়েছে আকাশচুম্বী বিলাসী জীবন (যাদের নেই তারা এখনো প্রতিষ্ঠিত হতে পারেনি) । অথচ এই জীবনযাপন ইসলামে সম্পূর্ণ হারাম। এই উপমহাদেশের একজন পীরেরও কোনো নিজস্ব জীবিকা নেই। না তারা চাকরি করে না তারা ব্যবসা করে। তবে হ্যাঁ তারা ব্যবসা করে বিনা পুঁজিতে। যে ব্যবসায় কোনো মূলধন নেই বা লাগে না। শুধু লাগে বংশপরিচয়। এই বংশপারম্পরিক পীর মাজার ব্যবসা করেই তারা আলিশান জীবনযাপন করে।
অথচ আমাদের রাসুল (সাঃ) প্রতিদিন পেট পুরে খেতে পায়নি রুজির অভাবে। কতদিন রাসুল (সাঃ) এবং তাঁর স্ত্রী পরিবার পরিজন এবং সাহাবীগণ না খেয়ে দিন কাটিয়েছেন। আর আমরা যারা পীর বলে ইসলামের মূল একটি পদে বসিয়ে দিচ্ছি যাদের জীবনের সাথে রাসুল (সাঃ) এবং সাহাবীগণ (রাঃ) এর জীবনযাপনের কোনো মিলই নেই। যদি রাসুল (সাঃ) এবং সাহাবীগণ (রাঃ) এর সাথে না মিলে তবে কীভাবে এইসব পীরকে ইসলাম স্বীকৃতি দিবে? আসুন নিজের বিবেকের কাছে প্রশ্ন করি।
ইসলামী আইন প্রবর্তনঃ
প্রতিটি মুমিন মুসলিম থেকে নিয়ে সকল ঈমানদারদের একটাই আদর্শ। সেটা হলো ইসলাম। ইসলাম ছাড়া মুসলমানের কোনো আদর্শ বা আইন নেই। যে নিজেকে মুসলিম এবং ঈমানদার দাবি করবে, তার প্রথম এবং একমাত্র কর্তব্য ই হলো ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ এবং রাষ্ট্রের প্রতিটি পর্যায়ে ইসলামকে তথা ইসলামের বিধিনিষেধ এবং আইনকে সমুন্নত এবং প্রতিষ্ঠিত করা। যারা নিজেদের সত্যিকারের ঈমানদার মুমিন মুত্তাকী, সালেহীন, ছিদ্দিকীন ইত্যাদি দাবি করবেন। তাদের কর্তব্যই হলো ইসলাম প্রতিষ্ঠা করা।
কিন্তু দুঃখজনক হলেও এটাই সত্য যে , রাষ্ট্রে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করা তো দূরের কথা। আমরা পরিবার সমাজেও ইসলাম মেনে চলি না। অথচ যারা পীর কে ইসলামের অত্যাবশ্যকীয় অংশ বলে দাবি করেন, তাদের কি উত্তর দিতে পারবেন? বাংলাদেশ মুসলিম দেশ হয়েও স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পরেও কেন আমাদের দেশ ইসলামী কায়দায় চলে না। কেন আমরা পরিবার সমাজ রাষ্ট্রে ইসলামী অনুশাসনে নেই। এটা কি তাদের দায়িত্ব নয় যাদের পীর বলে ইসলামের অত্যাবশ্যকীয় অংশ বলে জাহির করা হচ্ছে। তারা কীভাবে আল্লাহর ভালোবাসা পেতে পারেন আল্লাহ্ কে ছাড়া। অথচ আল্লাহ্ বলেন তোমরা জমিনে দ্বীনকে প্রতিষ্ঠা করো। ইসলামের জন্য সর্বস্ব ত্যাগ করো। ইসলাম প্রতিষ্ঠার অবিরাম চেষ্টা চালিয়ে যাও। যদি এইসব দরবার থেকে একযোগে ইসলামের জন্য ডাক দেওয়া হতো তাহলে অবশ্যই বাংলাদেশে এতোদিনে ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হতো।
যেহেতু তারা (একটি দরবার ছাড়া) করেনি সেহেতু হয়নি। অতএব এইসব পীর যে মুমিন তো দূরের কথা সত্যিকারের মুসলমানও হতে পেরেছে কী? কিন্তু তারা করছে না কেন? তারা এইজন্যই করছে না তাদের বিনা পুঁজির ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাওয়ার ভয়ে। কোনো কিছু করা ছাড়াই যদি ভালো ইনকাম হয় তাহলে কে যাবে দুনিয়ার ঝামেলায় জড়াতে। আমার ধর্মপ্রাণ ভাইয়েরা যদি আল্লাহর দেওয়া জ্ঞানকে একটু কাজে লাগাই তবে এইসব বিষয় অবশ্যই আমাদের চোখের সামনে স্পষ্ট হয়ে উঠবে।
সাহায্য করার মালিক আল্লাহ্ঃ
আল্লাহ্ সুবহানাহু তাআলা সূরা ফাতেহায় একটি আয়াত দিয়েছেন যা আমরা প্রতিনিয়ত বলে থাকি। তা হচ্ছে -" ইয়া কানাবুদু ওইয়া কানাসতায়ীন " সহজ অর্থ হলো " আমরা শুধু তোমারই ইবাদত করি, শুধু তোমারই সাহায্য প্রার্থনা করি "। এই আয়াত থেকে এটা স্পষ্ট যে, যেকোনো বিপদ আপদে, রোগ শোকে যেকোনো প্রয়োজনে আমরা একমাত্র আল্লাহ্ থেকেই সাহায্য প্রার্থনা করতে পারি। তিনি ছাড়া আর কারো কাছে সাহায্য প্রার্থনা করা একপ্রকার শির্ক বা আল্লাহর অংশীদার করা। কিন্তু যারা পীরের মুরিদ এবং মাজার ভক্ত তাদের মুখে সবসময়ই পীর মাজারঅলার নামে সাহায্য চাইতে দেখি। যা স্পষ্টত শির্ক এবং হারাম। কেননা ইসলামে আল্লাহ্ ছাড়া কারো কাছে গায়েবি সাহায্য চাওয়া শির্ক।
আল্লাহ কুরআনে বলেন যে, তিনি ই বিপদ আপদ দেন এবং তিনিই বিপদ থেকে উদ্ধার করেন। তাহলে এখানে বিপদ থেকে উদ্ধার করার জন্য আল্লাহ্ কোনো থার্ড পাটিকে ইজারা দেন নাই। তিনি বলেননি যে, আমি বিপদ দিচ্ছি আর উনার কাছে সাহায্য নিয়ে বিপদ থেকে উদ্ধার হও। এটা দিনের আলোর মতো পরিষ্কার যে যিনি বিপদ দিবেন একমাত্র তিনিই সেই বিপদ থেকে উদ্ধার করতে পারবেন। অতএব আল্লাহ্ যেমন শিক্ষা সূরা ফাতেহায় দিচ্ছেন ঠিক তেমনই আমাদের উচিত হবে আল্লাহর কাছেই সর্বদা সাহায্য চাওয়া।
কিন্তু আমাদের তথাকথিত পীরেরা (কিছু ব্যতীত) এই শিক্ষা দেয় যে, যেকোনো সময় অমুক বাবা, অমুক শাহ, অমুক ভান্ডার ইত্যাদির কাছে সাহায্য চাইবে। তাহলে মুহূর্তেই তোমরা উদ্ধার হয়ে যাবে। আর এটাই বাস্তবে হচ্ছে। এর সাধারণ মুসলমানদের ঈমান ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। এভাবে যেসব দরবার বা আস্তানা থেকে ঈমান ধ্বংসকারী কার্যক্রম চলে সেইসব দরবারের কার্যক্রম কে কীভাবে ইসলাম সম্মত কাজ বলা যায়। সেটাই এখন ভাবার সময়।
উপরোক্ত বিষয়ে এটা খুবই স্পষ্ট যে সাধারণ বিবেকের মাপকাটিতেও পীরতন্ত্রকে জায়েজ করা যাবে না। আমরা জান্নাত লাভের আশায় পীরের দরবারে যেতে চাইছি। যদি দুনিয়াতে শান্তি আর আখিরাতে জান্নাত না পাই তবে কেনইবা পীর ধরবো?
পীর ধরার দলিল ও খন্ডনঃ
এখন আমরা দেখবো যারা পীরতন্ত্রকে জায়েজ মনে করেন বা এটাকে বিশ্বাস করেন। তারা কয়েকটি বিষয়ের কারণে এটাকে সমর্থন করেন। আসুন দেখি কী কী বিষয় তারা আমাদের দলিল দেয়।
১) তারা বলে আল্লাহ্ কুরআনে পীর ধরতে বলেছেন।
২) রাসুল (সাঃ) বাইয়াত করিয়েছেন।
৩) পীর / অলি লাগবে কিয়ামতে সুপারিশ করার জন্য।
৪) অলি আল্লাহর কাছে মান্নত করলে তাঁরা বিপদে উদ্ধার করেন ইত্যাদি।
১) কুরআনের আয়াত দ্বারা পীরের দলিলঃ
এখন আমরা এই বিষয় গুলো নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করবো। পবিত্র কুরআনের যেসব আয়াত দিয়ে বলা হয়ে থাকে এগুলো পীরের / অলির আয়াত। সেগুলো একটি একটি করে আমরা এখন যাচাই করবো ইনশাআল্লাহ।
১) সূরা নিসার ৫৯ নং আয়াতে
" হে ঈমানদারগণ! আল্লাহর নির্দেশ মান্য কর, নির্দেশ মান্য কর রসূলের এবং তোমাদের মধ্যে যারা বিচারক তাদের। তারপর যদি তোমরা কোন বিষয়ে বিবাদে প্রবৃত্ত হয়ে পড়, তাহলে তা আল্লাহ ও তাঁর রসূলের প্রতি প্রত্যর্পণ কর-যদি তোমরা আল্লাহ ও কেয়ামত দিবসের উপর বিশ্বাসী হয়ে থাক। আর এটাই কল্যাণকর এবং পরিণতির দিক দিয়ে উত্তম। [ সুরা নিসা ৪:৫৯ ]
এই আয়াত দ্বারা অনেকে পীর কে জায়েজ বলে প্রমাণ করতে চান। এখানে "উলিল আমর "শব্দ দ্বারা তারা উৎসাহিত হন। এই শব্দের ব্যাখ্যায় এসেছে - বিচারক, নেতৃত্বদানকারী, ইসলামী শাসনের আমীর, এবং আলেমগণ। যাদের মধ্যে সঠিক এবং পরিপূর্ণ কুরআন এবং সুন্নাহর জ্ঞান এবং চর্চা রয়েছে। যারা সত্যিকার অর্থে আল্লাহর দ্বীনের উপর প্রতিষ্ঠিত। শুধু তাই নয় এই আয়াতে বলা হচ্ছে - যদি এইসব নেতৃত্বদানকারী, আলেমগণ বা বিচারকগণ কোনো বিষয়ে ভুল করে তবে তা আল্লাহ্ এবং তাঁর রাসুলের (সাঃ) দিকে ফিরে যাও। অর্থাৎ এইসব ব্যক্তি যদি কোনো বিষয়ে দ্বিধান্বিত হন, বিভেদ সৃষ্টি হয় তবে তা কুরআন এবং সুন্নাহ দ্বারা যাচাই করো। কুরআন এবং সুন্নাহয় এই বিষয়ে কী আছে সেখান থেকে সিদ্ধান্ত নাও।
অতএব এখানে "উলিল আমর " বলতে যা বোঝানো হয়েছে তা মোটেই এই উপমহাদেশে চলে আসা পীরতন্ত্রের তথাকথিত পীর নয়। যদি এই শব্দ দ্বারা পীরকে বোঝানো হতো তবে তাদের হতে হবে বিচারক, সত্যিকারের আলেম, ইসলামী আমীর, এবং সমাজে নেতৃত্বদানকারী। কিছু কিছু পীর ইসলামী শিক্ষায় শিক্ষিত হলেও (তা না হলে ব্যবসা তো হবেনা) অধিকাংশর ই সেই জ্ঞান নেই। আর বিচারক, আমীর ও নেতৃত্ব দেওয়ার প্রশ্নই উঠেনা। অতএব এই আয়াতের ব্যাখ্যা দ্বারা কখনোই পীরকে জায়েজ বলা যাচ্ছে না। এই বিষয়ে বিস্তারিত জানতে বিশ্ব বিখ্যাত তাফসীর "তাফসীরে ইবনে কাছীর " এবং সুন্নীদের বড় আলেম আলা হযরতের বিখ্যাত তাফসীর "কানজুল ঈমান "দেখতে পারেন।
২) "স্মরণ কর, যেদিন আমি প্রত্যেক দলকে তাদের নেতাসহ আহবান করব, অতঃপর যাদেরকে তাদের ডান হাতে আমলনামা দেয়া হবে, তারা নিজেদের আমলনামা পাঠ করবে এবং তাদের প্রতি সামান্য পরিমাণও জুলুম হবে না। [ সুরা বনী-ইসরাঈল ১৭:৭১ ]
সূরা বনী ইসরাঈল এর এই আয়াত দ্বারা যারা "নেতা " এর আরবি শব্দ দ্বারা পীর বোঝাতে চান তারা এক পর্যায়ে সঠিক। যদি তারা এই নেতা বলতে পীর বুঝায় এবং সর্বোপরি এই নেতার অনুসরণ করেন তবে আপনি সঠিক। যে পীরের অনুসরণ করেন তিনি যদি সঠিক কুরআন এবং সুন্নাহর আলোকে চলেন তবে তারা পরকালে সফল। এতে কোনো সন্দেহ নেই। এখন কথা হচ্ছে এই নেতা শব্দ দ্বারা কি শুধু পীরদেরই বুঝানো হয়েছে? না, তা কখনোই নয়। শুধু পীর নয়। এই নেতা দ্বারা দুনিয়ার সব নেতাদের বুঝানো হয়েছে। আর এটাই দিনের আলোর মতো পরিষ্কার।
যদি ধরে নিই শুধু পীর। তবে আপনি দুনিয়াদারী কাজের জন্য যে নেতার অনুসরণ করছেন সেই নেতা কি আল্লাহর আইন এবং বিচার থেকে বাদ যাবেন? আপনি পীর মানেন একজন কে এবং আপনার দাবি তিনিই আপনার নেতা। আবার ইলেকশন আসলে আপনি ভোট দেন আপনার প্রিয় দল এবং নেতাকে। যাদের ৯০ শতাংশ ইসলামী বিরোধী হিসাবের খাতায় লিপিবদ্ধ। যেসব নেতাকে রাতে খুঁজে পাওয়া যায় না। যারা পশ্চিম দিকে কখনো পড়েছেন কিনা কোনো সাক্ষী নেই! অথচ আপনি তাদেরও মুরিদ। তাদের ভোট দিচ্ছেন। তাদের প্রতিটি কর্মকান্ডে আপনার সায় এবং সহযোগিতা রয়েছে। তাহলে এখন বলুন, পীরকে নেতা বলে আখিরাত পাবেন। এইসব নেতাকে সাপোর্ট করার জন্য কী পাবেন বলে চিন্তা করেছেন? আপনার জাহান্নামের টিকিট কি কনফার্ম নয়?
কেননা একজন নেতা ইসলামের, আরেকজন গনতন্ত্রের। আর গনতন্ত্র আল্লাহর বিধান নয়। এই গনতন্ত্রের মাধ্যমে আমরা ভোট দিয়ে আল্লাহ্ বিরোধী আইন করতে সরকারকে সহযোগিতা করছি। তাহলে কীভাবে আপনি জান্নাত আশা করেন। প্রিয় পীরের মুরিদরা আপনারাই বিবেচনা করুন। (এই বিষয়ে আরো বিস্তারিত লেকচার আছে যদি প্রয়োজন হয়)
৩)"আর ঈমানদার(মুমিন) পুরুষ ও ঈমানদার(মুমিন) নারী একে অপরের সহায়ক। তারা ভাল কথার শিক্ষা দেয় এবং মন্দ থেকে বিরত রাখে। নামায প্রতিষ্ঠা করে, যাকাত দেয় এবং আল্লাহ ও তাঁর রসূলের নির্দেশ অনুযায়ী জীবন যাপন করে। এদেরই উপর আল্লাহ তা'আলা দয়া করবেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ পরাক্রমশীল, সুকৌশলী। "[ সুরা তাওবা ৯:৭১ ]
উপরোক্ত আয়াতে মুমিননের গুণাবলী বর্ননা করা হয়েছে। এবং তারা একে অপরের বন্ধু। অর্থাৎ আপনি পীরকে মুমিন মনে করলেন। যেহেতু আপনি পীরের মুরিদ আপনিও তার বন্ধু। আপনাকে পীরের অর্থাৎ মুমিনের বন্ধু হতে হলে আপনাকেও মুমিন হতে হবে। এখানে স্পষ্ট বলা হয়েছে মুমিন পুরুষ মুমিন নারী একে অপরের বন্ধু। সেই দাবি অনুযায়ী আপনাকে মুমিন হতে হবে। ধরে নিলাম আপনিও মুমিন। যদি আপনি মুমিন হন তবে এই আয়াত অনুযায়ী আপনিও তো একজন পীর! বিষয়টা খুবই সহজ।
এবার আসুন "মুমিন " মানে কী বা কাদের "মুমিন" বলা হয়। ইসলামের পরিভাষায় তাঁরাই মুমিন যারা আল্লাহর সমস্ত আদেশ নিষেধ মেনে চলেন। যাঁরা তাদের জীবনকে রাসুল (সাঃ) এর আদর্শ দ্বারা গঠিত করেছে। যাদের চলার প্রতিটি কদমই হবে কুরআন এবং সুন্নাহর আলোকে। এখন আপনারাই পরীক্ষা করে দেখুন প্রতিটি পীরের দরবার এবং মাজারকে। কয়টি দরবার এবং মাজার কুরআন এবং সুন্নাহর আলোকে পরিচালিত। আমি এর আগে এটা স্পষ্ট করে দেখিয়েছি (যারা পাননি তারা খুঁজে পড়ে দেখেন) যে প্রতিটি দরবার এবং মাজারে কী রূপে কুরআন এবং সুন্নাহকে পদদলিত করা হচ্ছে। এটা জানার পরও যদি আপনার মনে হয়, উপমহাদেশের এই পীর ই কুরআনের এই আয়াতের মুমিন তবে আপনার জন্য আল্লাহ কে নতুন করে ওহী পাঠাতে হবে।
এই আয়াতে খুবই স্পষ্ট করে বলা হয়েছে যে মুমিনগণ একে অপরকে ভালো কাজের আদেশ মন্দ কাজের নিষেধ করে। সালাত আদায় করে যাকাত দেয় এবং রাসুলের (সাঃ) এর আদর্শ মেনে চলে। এইসব যে পীরের দরবারে এবং মাজারে হচ্ছে না তা আগেই স্পষ্ট করা হয়েছে।
এই আয়াতে আরো একটি বিষয় আছে। এখানে পুরুষ এবং নারীর কথা বলা হচ্ছে। আমার প্রশ্ন হচ্ছে - এই উপমহাদেশে কয়জন নারী পীর আছেন যারা আপনাদের মতো মুরিদদের জন্য দরবার খুলেছেন।
অতএব এখানে মোটেই সেইসব পীরের কথা বলা হয়নি যারা পীরের নামে ব্যবসা করে খাচ্ছে। যারা পীর মাজারের নামে প্রতিনিয়ত কুরআন এবং রাসুলের (সাঃ) এর আদর্শ বিরোধী কাজ করে যাচ্ছেন। এখানে তাদের কথাই বলা হচ্ছে যারা ইসলামের সত্যিকারের আদর্শকে বুকে ধারণ করে জীবন পরিচালিত করছে। যারা দুনিয়ার হাজারো কষ্টে বিপদ আপদে ইসলামের আদর্শকে ছেড়ে দেয়নি। তারাই নিজেদেরকে ভালো কাজে উদ্বুদ্ধ এবং মন্দ কাজে বাঁধা প্রদান করে। এবং সর্বদা রাসুলের (সাঃ) আদর্শ অনুযায়ী জীবন পরিচালিত করে। যে সংজ্ঞার মধ্যে কোনো ভাবেই এইসব তথাকথিত পীরেরা পড়ে না।
৫) হে ঈমানদারগণ, আল্লাহকে ভয় কর এবং সত্যবাদীদের সাথে থাক। [ সুরা তাওবা ৯:১১৯ ]
কুরআনের এই আয়াতটি, তিনজন সাহাবীর ব্যাপারে নাযিল হয়েছিল। যাঁরা কিছু ভুল করেছিল এবং আল্লাহর কাছে তাওবা করার পর আল্লাহ্ তওবা কবুল করেন। কারণ তাঁরা সত্যবাদী ছিলেন। এখন এই আয়াত দিয়ে বর্তমান ব্যাখ্যা যদি করি তবে হবে, আমাদেরও সত্য যারা বলে তাদের সাথে থাকতে হবে। এখন কথা হচ্ছে সত্য কী? পৃথিবীতে একমাত্র সত্য হচ্ছে আল্লাহ্ এবং তাঁর বিধান। এখন যারা এই সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করতে চায় তাঁরা প্রকৃত সত্যবাদী। অর্থাৎ যাঁরা ইসলামের মানদন্ড দিয়ে জীবন পরিচালিত করে সত্য পথের দাওআত দেয় তাদেঁর সাথেই আমাদের থাকতে হবে। যদি আল্লাহ অলা জ্ঞানী মানুষের সাথে থাকা যায় তবে আমরাও আল্লাহর পথে চলতে পারবো এবং আল্লাহর নেক দৃষ্টিতে থাকতে পারবো।
এখন এই আয়াত দ্বারা যদি পীরদের পরীক্ষা করি তবে আমরা কতটুকু তারা ইসলামের আলোকে সত্যবাদী? এর আগের বিভিন্ন পয়েন্টে দেখানো হয়েছে তারা কীভাবে কুরআন এবং রাসুলের (সাঃ) আদর্শের বাইরে কাজ করে মুসলমাদের ধোঁকা দিচ্ছে। তারা তাদের কর্মকান্ড দ্বারা ইসলামের চোখে প্রশ্নবিদ্ধ। অতএব এই আয়াত কোনো মতেই সরাসরি পীরদের ইংগিত করে না।
যদি তাদের কথা বলেন যারা সত্যিকারের মুমিন, যারা হাজারো কষ্টে ইসলামকে ছেড়ে দেয়নি তাঁরাই হচ্ছেন এই আয়াতের ভাগিদার। আমাদের সেইসব মুমিনের সাথে থাকতে হবে যারা সত্যিকারে ইসলামের আদর্শে কথা বলে। যারা আখিরাতের জন্য দুনিয়া বিসর্জন দিয়েছেন। অতএব নিজের বিবেকের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে দেখুন কে সত্যিকারের ইসলামী "সত্যবাদী "।
৬) অনুসরণ কর তাদের, যারা তোমাদের কাছে কোন বিনিময় কামনা করে না, অথচ তারা সুপথ প্রাপ্ত। [ সুরা ইয়া-সীন ৩৬:২১ ]
এই আয়াতের ইশারা ইনতাকিয়া শহরের ঘটনা বর্ণনা প্রসঙ্গে। যে শহরে তিনজন নবীকে আল্লাহ প্রেরণ করেছিলেন। এখানে সেই শহরের বাসিন্দাদের নবীদের অনুসরণের ব্যাপারে বলা হচ্ছে (ইবনে কাছীর, কানজুল ঈমান)। তাদের বিষয়ে বলতে গিয়ে আল্লাহ্ বলেন - তাঁরা তোমাদের কাছে বিনিময় চাই না। তাঁরা বিনিময় পাবেন আল্লাহর কাছ থেকে। এবং তাঁরাই সুপথ প্রাপ্ত।
এই আয়াতের বর্তমান প্রেক্ষাপটে যদি বলা হয় "পীরেরা " এই আয়াতের মালিক, এবং তারা বিনিময় চাই না। তবে এর চাইতে জালিম আর কে? বাংলাদেশসহ পুরো উপমহাদেশে এমন কোনো পীরের দরবার বা মাজার আছে যেখানে বিনিময় দেওয়া হয়না? পীরের নজরানা, হাদিয়া, তোফা, মান্নত ইত্যাদি এইসব কী? এগুলো কি বিনিময় নয়?
শুধু কি তাই, টাকা পয়সা ছাড়া তো ভালো মুরিদও হওয়া যায় না। আপনি পীরের কাছাকাছি থাকতে চাইলে আপনাকে মোটা অঙ্কের হাদিয়া মান্নত নজরানা দিতে হবে। যিনি এইসব দিতে পারেন তিনিই পীরের কাছে ভালো মুরিদ। এইসব কোনো বানানো কথা নয়। পীরের দরবার ঘুরলেই এইসব দেখতে পাওয়া যায়।
এই আয়াত অনুযায়ী পীরেরা হবেন নির্লোভ এবং সাধারণ জনগণের থেকে কোনো কিছু আশা করবেনও না নিবেনও না (যতটুকু না হলে চলা দায়)। তাহলেই তিনি (পীর) এই আয়াতের ভাগিদার হতে পারেন। কিন্তু বাস্তব বরই কঠিন এবং নির্মম। আমরা আজ যত পীরের আস্তানা দেখছি (যারা লাইম লাইটে আসতে পারেনি তারা ব্যতীত) তাদের কোনটিরই করুন দশা নেই। বরং তারা এতো এতো টাকা মালিক এবং তা বংশপরম্পরায় পেয়ে আসছেন শূন্য পুঁজি দিয়ে। এইসব দেখে যেকোনো ঈমানদার ব্যক্তিই বুঝতে পারবেন এরা আসলেই কতটুকু ইসলাম বিরোধী। সুতরাং এই আয়াত দ্বারাও পীর প্রমাণিত হয় হলো না।
৭) "আপনার পূর্বে আমি মানুষই প্রেরণ করেছি, যাদের কাছে আমি ওহী পাঠাতাম। অতএব তোমরা যদি না জান তবে যারা স্মরণ রাখে (জ্ঞানীদের, কিতাব অলা ইহুদি নাসারাদের) তাদের জিজ্ঞেস কর।" [ সুরা আম্বিয়া ২১:৭ ]
এই আয়াত তাদের ব্যাপারে নাযিল হয়েছিল যারা রাসুল (সাঃ) এর মানুষ হওয়াকে বিশ্বাস করতো না। এর আগের পরের আয়াত গুলো দিয়ে আল্লাহ সেই কথাই অবিশ্বাসী কাফেরদের যুক্তি দিচ্ছিলেন। এখানে জ্ঞানী বা স্বরণ রাখাকারী বা কিতাব অলা দ্বারা আগের অর্থাৎ ইহুদি এবং খ্রিস্টানদের বুঝানো হয়েছে। কেননা আল্লাহ্ আগেও নবী রাসুল (আঃ) পাঠিয়েছিলেন। এবং তাঁরা ছিলেন মানুষ। অবিশ্বাসী কাফিররা রাসুল (সাঃ) এর মানুষ হওয়া মেনে নিচ্ছিলো না। তাই তাদেরকে বলা হচ্ছে আগে যাদের কাছে অর্থাৎ ইহুদি এবং খ্রিস্টানদের নবী (আঃ) এসেছিলেন তাঁরা কী ছিলেন তা এইসব কিতাবী জ্ঞানীদের জিজ্ঞাসা করো। কেননা আল্লাহ্ তাদের কাছে যে রাসুল (আঃ) পাঠিয়েছিলেন তাঁরা ছিলেন মানুষ। এবং তা ইহুদি খ্রিস্টানরা জানে। তাই তাদের কাছে জিজ্ঞাসা করলে সঠিক উত্তর পাওয়া যাবে এবং তোমাদের (অবিশ্বাসীদের) ভুল ভাঙবে।
এখানে স্পষ্ট যে জ্ঞানী বলতে কাদের বুঝানো হয়েছে। তবুও যারা জ্ঞানী দ্বারা পীরদের বুঝিয়েছেন বলে যুক্তি দেখান। তাদের যুক্তি যদি মেনে নিই তবে আমরা বাস্তবে কী দেখছি? আজ উপমহাদেশের পীরের দরবার গুলোর দিকে তাকান। এইসব দরবারে যারা বংশপারম্পরিক পীর হয়ে বসে আছেন তারা কতটুকু ইসলামের সঠিক জ্ঞানের জ্ঞানী?
এরা কোথায় কার কাছ থেকে ইসলামের জ্ঞান অর্জন করেছেন? এরা কুরআন কতটুকু জানেন? এরা হাদীস শিক্ষা করেছেন কার কার সিলসিলা দিয়ে? এরা কুরআনের তাফসীর কতটুকু জানেন? সহীহ্ হাদীস কতটুকু জানেন? ফিকাহ সম্পর্কে কতটুকু জ্ঞান রাখেন? প্রচলিত ইসলামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে কতটুকুই শিক্ষা অর্জন করেছেন? ইসলামের কল্যাণে কয়টি গবেষনামূলক কিতাব রচনা করছেন?
এইসব প্রশ্নের উত্তর খুবই নগন্য সংখ্যক পীর ছাড়া বাকি সবারই কোনো শক্তিশালী ইসলামী শিক্ষা নেই। যেসব পীরদের মাদ্রাসা আছে তাদের কিছু জ্ঞান থাকলেও বাকিরা সেই বংশপারম্পরিক জ্ঞান দিয়েই পীর মুরিদী ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন। যারা বলেন এরাই (পীরেরা) জ্ঞানী যেসব পীরেরা কতটুকু আর জ্ঞান চর্চা করছেন? তারা তো মুরিদ বাড়াতেই ব্যস্ত। মুরিদদের সঠিক জ্ঞান দানে নয়। বরং তাদের(মুরিদদের) দানের দিকেই তাদের (পীরদের) দৃষ্টি। এখন এমন কোনো দরবার নেই যেখানে সঠিক ইসলামী জ্ঞান চর্চার মাধ্যমে মুরিদদের জ্ঞান দেওয়া হয়।
কুরআনের আয়াতের সঠিক ব্যাখ্যা থেকে এটা খুবই স্পষ্ট এখানে জ্ঞানী দ্বারা মোটেই পীরদের বুঝানো হয়নি। জোর করে কেউ চাইলেই কুরআনের অপব্যাখ্যা দিতে পারে না। যদি এটা করা হয় তবে তারা অবশ্যই আল্লাহ্ বিরোধী কাজ করার দ্বারা ইসলাম থেকে খারিজ হয়ে যাবেন।
৮)" আর যে কেউ আল্লাহর হুকুম এবং তাঁর রসূলের হুকুম মান্য করবে, তাহলে যাঁদের প্রতি আল্লাহ নেয়ামত দান করেছেন, সে তাঁদের সঙ্গী হবে। তাঁরা হলেন নবী, ছিদ্দীক, শহীদ ও সৎকর্মশীল ব্যক্তিবর্গ। আর তাদের সান্নিধ্যই হল উত্তম। [ সুরা নিসা ৪:৬৯ ]
এই আয়াত দ্বারা পীরদের শক্তিশালী দলিল দেওয়া হয়। তবে তারা শুরুর কথা গুলো বলে না। এখানে শুরুতে বলা হয়েছে - যারা আল্লাহ্ এবং রাসুলের (সাঃ) এর হুকুম পালন করবে। অর্থাৎ যারা তাদের জীবন ইসলামী পথে তথা সঠিক কুরআন সুন্নাহর আলোকে গঠন করবে তাঁরাই কিয়ামতে নবী, শহীদ, ছিদ্দিক এবং সৎকর্মশীলের সান্নিধ্য পাবে। এখানে বিষয়টি খুবই স্পষ্ট। কোনপ্রকার লুকোচুরি নেই। যে বা যাঁরা সঠিক ইসলামের আইন আদর্শ মেনে এই দুনিয়ার জীবন অতিবাহিত করবে তাঁরাই কিয়ামতের দিন তাঁদের মর্যাদা অনুযায়ী নবী, শহীদ, ছিদ্দিক এবং সৎকর্মশীলের সাথে থাকবেন। যদি আমরা এই আয়াতের তাফসীর খুলে বুঝার চেষ্টা করি তবে অবশ্যই আল্লাহ্ আমাদের বুঝার তৌফিক এবং হিদায়াত দিবেন ইনশাআল্লাহ।
এই আয়াতে দুটি অংশ একটি হলো যারা আল্লাহ্ এবং রাসুল (সাঃ) এর অনুসারী। অপরটি হলো নবী, শহীদ, ছিদ্দিক এবং সৎকর্মশীল। এখানে যারা আল্লাহ্ ও রাসুলের (সাঃ) অনুসারী হলো মুরিদরা। আর সৎকর্মশীলরা হলেন পীরেরা। যদি পীর মানো তবে পীরের সাথে কিয়ামত হবে। খুবই সুন্দর। কিন্তু কুরআনে পীর মানার কথা নয় বরং আল্লাহ্ এবং রাসুলের (সাঃ) আদর্শ মানার কথা স্পষ্ট ভাবে বলা হয়েছে। যদি আল্লাহ্ এবং রাসুলের (সাঃ) আনুগত্য তথা হুকুম মানার অর্থ হয় পীর মানা, অর্থাৎ পীরেরা আল্লাহ্ এবং রাসুলেরই (সাঃ) আদর্শ অনুসরণ করে বলেই তাদের মান্য করা।
কিন্তু এটা তো সত্য, যে অর্থে উপমহাদেশে পীরেরা অবস্থান করছে সেই অর্থে তারা ইসলামী আদর্শে নেই (আগের বিশ্লেষণ থেকে প্রমাণিত)। অতএব পীর ধরার বা মানার প্রশ্ন আসছে না। এই আয়াতে আল্লাহ্ এবং রাসুলের (সাঃ) এর হুকুম মানার কথা এসেছে। তাই আল্লাহ্ এবং রাসুলের (সাঃ) এর হুকুম পরিপূর্ণ ভাবে পালনের জন্য যদি কোনো জ্ঞানীর কাছে (যিনি সঠিক ইসলামের শিক্ষা দেন) যেতে হয় তবে দোষের কিছু নেই। সুতরাং এই আয়াত দ্বারা কোনো মতেই পীর ধরার দলিল সাব্যস্ত হয় না।
৯) "পিতা-মাতা যদি তোমাকে আমার সাথে এমন বিষয়কে শরীক স্থির করতে পীড়াপীড়ি করে, যার জ্ঞান তোমার নেই; তবে তুমি তাদের কথা মানবে না এবং দুনিয়াতে তাদের সাথে সদ্ভাবে সহঅবস্থান করবে। যে(বিশুদ্ধ চিত্তে) আমার অভিমুখী হয়, তার পথ অনুসরণ করবে। অতঃপর তোমাদের প্রত্যাবর্তন আমারই দিকে এবং তোমরা যা করতে, আমি সে বিষয়ে তোমাদেরকে জ্ঞাত করবো। [ সুরা লুকমান ৩১:১৫ ]
এই আয়াতের যে অংশে বলা হচ্ছে - "যে বিশুদ্ধ চিত্তে আল্লাহ্ অভিমুখী হয় তাঁর অনুসরণ করো। "এর আগের আয়াতে আল্লাহ্ মাতাপিতার প্রতি সদ্ব্যবহার করতে আদেশ দিয়েছেন। পবিত্র কুরআনের অন্যান্য জায়গায় যেখানেই আল্লাহর ইবাদতের কথা আছে সেখানেই পিতামাতার খেদমতের কথা রয়েছে। এখানে বলা হচ্ছে যাঁরা আল্লাহ্ অভিমুখী অর্থাৎ যাঁরা আল্লাহ্ এবং রাসুল (সাঃ) এর আদেশ নিষেধ মেনে চলে পরিপূর্ণ ভাবে তাদের জীবন পরিচালিত করতে পেরেছেন তাঁরাই হলো আয়াতে বলা "বিশুদ্ধ চিত্ত "। বিখ্যাত সুন্নী তাফসীর "কানজুল ঈমানে " এই আয়াতে বলা" বিশুদ্ধ চিত্ত "বলতে রাসুল (সাঃ) এবং তাঁর অনুসারী সাহাবীদের কথা বলা হয়েছে। অর্থাৎ এই বিশুদ্ধ চিত্ত হলো রাসুল (সাঃ) এবং তাঁর সাহাবী। শুধু এই আয়াত নয়, পবিত্র কুরআনে যেখানেই মুমিন, মুত্তাকী, শহীদ, ছিদ্দিক, সালেহীন ইত্যাদির অনুসরণের কথা বলা হয়েছে তাঁরা সবাই হচ্ছেন রাসুল (সাঃ) এর সাহাবী। আর রাসুল (সাঃ) এর সাহাবীরা (রাঃ) গণ কখনোই উপমহাদেশের মতো তথাকথিত পীর ছিলেন না। এই সহজ কথা উপমহাদেশের একশ্রেণির আলেমগণ জেনে বুঝে বিকৃত করে আয়াতের ব্যাখ্যা পীরের দিকে নিয়ে যায়। যাতে করে তাদের ব্যবসা করা সহজ এবং জায়েজ হয়।
যেকোনো সাধারণ মুসলমান বলতেই বুঝতে পারবেন যে, রাসুল (সাঃ) এবং তাঁর সাহাবীদের(রাঃ) অনুসরণ করলেই আল্লাহর সঠিক রাস্তা পাওয়া যায়। এখন বিবেক দিয়ে প্রশ্ন করুন উপমহাদেশের হাজার হাজার পীরের দরবার আর মাজারে রাসুল (সাঃ) এবং তাঁর সাহাবীদের(রাঃ) কতটুকু অনুসরণ করা হয়। অনুসরণ তো দূরের কথা সাহাবীদের (রাঃ) নাম আর জীবনী জানেন কিনা সন্দেহ আছে। তাদের খাদেমদের কথা তো দূরে, আর মুরিদদের কথা তো বলাই যাবে না। আমাদের উপমহাদেশে কতজন মুরিদ বা মুসলমান বিখ্যাত সাহাবীদের (রাঃ) এর নাম জানেন? যদি পীরের দরবার এবং মাজার সঠিক ইসলামের প্রচারক হতো তাহলে তারা অবশ্যই সাহাবীদের (রাঃ) জীবনী থেকেই শিক্ষা নিতেন এবং দিতেন। এই সাহাবীদের (রাঃ) আদর্শে সবার জীবন গড়ার শিক্ষা দিতেন। কিন্তু বাস্তবে এর কিছুই নেই। অথচ তাঁরা (রাঃ) হচ্ছেন আল্লাহ্ এবং রাসুল (সাঃ) এর স্বীকৃত জান্নাতী এবং সুপথ প্রাপ্ত ব্যক্তি। তাঁদের বাদ দিয়ে বিভিন্ন অলি আল্লাহর কাহিনী এমন ভাবে প্রচার করা হয়, যেসব কাহিনীর বাস্তবতা কখনোই পাওয়া যায় না। এমন সব কেরামত বর্ণনা করা হয় যা সাহাবী তো দূরের কথা কোনো নবী রাসুল (আঃ) দেখিয়েছেন কিনা সন্দেহ।
শুধু তাই নয় এই উপমহাদেশে কখনোই সাহাবীদের জীবনী চর্চা করা হয় না। এখানে শুধু চলে বিভিন্ন পীরের দরবার এবং মাজার ভিত্তিক আউলিয়াদের জীবনী ও কারামত বর্ণনা। আমি অলি আউলিয়ার বিরুদ্ধে নই। তবে আল্লাহ্ যাঁদের অনুসরণ অনুকরণ করতে বলেছেন তাঁদেরই আমাদের অনুসরণ করা উচিত। কেননা আল্লাহ্ বলেন - ঈমান আন তাদের মতো যারা ঈমান এনেছে। অর্থাৎ আমাদের ঈমান আনতে হবে সাহাবীদের জীবনী অনুসরণে। কেননা তাঁরা ছিলেন মানুষ অর্থাৎ তাঁদের জীবনেও বিভিন্ন ভুল ত্রুটি ছিলো যা আল্লাহ্ ক্ষমা করেছেন। তাঁদের জীবনের সেই ঘাত প্রতিঘাত থেকেই আমাদের শিক্ষা নিতে হবে।
অথচ লক্ষ্য করলে দেখা যাবে যে আমাদের উপমহাদেশের মুসলমানরা সাহাবীদের চেনেন না। কিন্তু পীর আউলিয়াদের ঠিকই চিনে। এখন কথা হচ্ছে যেসব পীর আউলিয়ার কথা বলে এইসব দরবার চলে, সেইসব আউলিয়ারা প্রচুর কষ্ট করে এই উপমহাদেশে ইসলাম প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। তাঁদের কষ্টসাধ্য ত্যাগের বিনিময়ে আজ আমরা ইসলামের ছায়া পেয়েছি। কিন্তু সেইসব আউলিয়ার মতো কষ্ট কেউ এখন করছে না। তাঁরা ইসলাম প্রচার এবং প্রসার ও বিস্তার লাভের কাজে ছিলেন। এখন পীরের দরবার আর মাজার আছে কে কত বেশি মুরিদ করে ভালো ইনকাম করতে পারবে। কে কাকে খারাপ বলে লোকজন বেশি জোগাড় করতে পারবে এই ধান্দায় ব্যস্ত।
সুতরাং যাদের নিয়ে কুরআনের আয়াত তাঁদের বাদ দিয়ে জোর করে পীরের নাম দিয়ে কুরআনের ব্যাখ্যা করা কখনোই ঈমানদারের লক্ষন নয়। অতএব এইসব ধূর্তামি ছেড়ে সঠিক ইসলামের পথে আমাদের আসা দরকার। তাঁদের পথেই আমাদের চলা দরকার যাঁদের কথা আল্লাহ্ এবং রাসুল (সাঃ) আমাদের জানিয়েছেন।
১০) "যারা তোমাদের ধর্মমতে চলবে, তাদের ছাড়া আর কাউকে বিশ্বাস করবে না। বলে দিন নিঃসন্দেহে হেদায়েত সেটাই, যে হেদায়েত আল্লাহ করেন। আর এসব কিছু এ জন্যে যে, তোমরা যা লাভ করেছিলে তা অন্য কেউ কেন প্রাপ্ত হবে, কিংবা তোমাদের পালনকর্তার সামনে তোমাদের উপর তারা কেন প্রবল হয়ে যাবে! বলে দিন, মর্যাদা আল্লাহরই হাতে; তিনি যাকে ইচ্ছা দান করেন এবং আল্লাহ প্রাচুর্যময় ও সর্বজ্ঞ।" [ সুরা ইমরান ৩:৭৩ ]
"তিনি যাকে ইচ্ছা নিজের বিশেষ অনুগ্রহ দান করেন। আর আল্লাহ মহা অনুগ্রহশীল।" [ সুরা ইমরান ৩:৭৪ ]
সূরা আলে ইমরানের এই দুটি আয়াত ইহুদীদের হিংসা এবং মুসলমানদের নিয়ে তাদের নিকৃষ্ট পরিকল্পনার কথা ব্যক্ত করা হয়েছে (বিস্তারিত রয়েছে তাফসীরে ইবনে কাছীর)। আয়াতের শেষে আল্লাহ্ বলেন তিনি যাকে ইচ্ছে তাকে দান করেন এবং অনুগ্রহ করেন। এই দান অনুগ্রহ বা স্বীয় করুণা বলতে আল্লাহ্ প্রতি ঈমান আনার তৌফিককে বুঝানো হয়েছে। কেননা এই দুনিয়ায় আল্লাহর প্রতি ঈমান আনতে পারাটাই (বিধর্মীদের জন্য) হচ্ছে তাদের প্রতি আল্লাহর সবচাইতে বেশি করুণা করা। এটা তাদের প্রতি বলা হচ্ছে যাদের আল্লাহ্ অনুগ্রহ করেছেন ঈমান আনতে।এই যাকে দ্বারা কেউ কেউ পীরের দলিল দিয়ে থাকেন।
যদি "যাকে "দ্বারা পীর বুঝানো হয় তবে আল্লাহ যে কোটি কোটি মানুষকে ঈমান আনার তৌফিক দিয়ে অনুগ্রহ করেছেন তাঁরা কোথায় যাবে? আল্লাহর দুনিয়ায় কি আর ঈমানদার নেই? অবশ্যই আছে। যদি থাকে তবে কি তারা পীর নামধারণ করে আছেন? উত্তর হবে অবশ্যই না। তাহলে কি আল্লাহ্ শুধুমাত্র উপমহাদেশের কয়েক হাজার পীরদের নিয়েই কি এই আয়াত নাযিল করেছেন?
পবিত্র কুরআনে শত শত জায়গায় ঈমানদার, মুমিন, মুত্তাকী, শহীদ, ছিদ্দিকন এবং সৎকর্মশীলের উল্লেখ করে আয়াত নাযিল হয়েছে। এইসব আয়াতের গুণাবলী যেকোনো ঈমানদার মুসলিমই হতে পারেন। শুধুমাত্র একটি শ্রেণীর জন্য খাস নয় (যেসব আয়াত সরাসরি সাহাবীদের নির্দেশ করেছেন সেসব ব্যতীত)। কিন্তু উপমহাদেশে এই আয়াতের অপব্যাখ্যা দিয়ে সাধারণ মানুষকে গোমরাহ করে ঈমান ধ্বংস করছে। এই আল্লাহর অনুগ্রহ তাঁরাও দাবি করতে পারেন যারা সত্যিকারের পীরের কাজ তথা ইসলামের জ্ঞান বিতরণ, প্রশিক্ষক, জ্ঞানী, উস্তাদ হিসাবে ইসলামের সেবা করছেন। কিন্তু এটা দিনের আলোর মতো পরিষ্কার এইসব কোনো কিছুই কোনো পীরের দরবার এবং মাজারে পাওয়া যায় না। অতএব এই দ্বারাও পীরের দলিল দেওয়া যাবে না।
১১) "পৃথিবীকে কুসংস্কারমুক্ত ও ঠিক করার পর তাতে অনর্থ সৃষ্টি করো না। তাঁকে আহবান কর ভয় ও আশা সহকারে। নিশ্চয় আল্লাহর করুণা সৎকর্মশীলদের নিকটবর্তী।" [ সুরা আরাফ ৭:৫৬ ]
এই আয়াতের "সৎকর্মশীল " বলতে পীর বুঝানো হয়েছে! এটা কি কেউ মেনে নিবে? আল্লাহ্ কত সুন্দর করে বলেছেন, আল্লাহ্ কে ডাকো ভয় এবং আশা সহকারে। অর্থাৎ আল্লাহর ইবাদত করতে বা তাঁর রাস্তায় চলতে হবে ভয় অর্থাৎ জাহান্নাম আশা অর্থাৎ জান্নাত মিলবে এই ভেবে। যদি কেউ আল্লাহর রাস্তায় না চলে তবে তার জন্য জাহান্নাম নিশ্চিত। আর যে আল্লাহর রাস্তায় চলে তবে তার জন্য আল্লাহর জান্নাত আশা করা যায়। অতএব যাঁরাই আল্লাহর ইবাদত আইন কানুন, আদেশ নিষেধ পরিপূর্ণ ভাবে মেনে চলবে তাঁরই সৎকর্মশীল। আর এই সৎকর্মশীলদের নিকটেই আল্লাহর অনুগ্রহ, দয়া, সাহায্য ইত্যাদি তথা আল্লাহ্ ই তাঁদের কাছে রয়েছেন।
সুতরাং যারাই চেষ্টা করবেন(সৎকর্ম করে) তারাই আল্লাহর কাছে প্রিয়পাত্র হতে পারবেন। এই আয়াত দ্বারা কীভাবে পীর ধরতে হবে বা এই সৎকর্মশীল ব্যক্তিই হচ্ছেন পীর এবং এটা শুধুমাত্র পীরদের জন্য বরাদ্দ তা কীভাবে সম্ভব? কেননা এই পৃথিবীতে আল্লাহর রাস্তায় চলেন এমন হাজার হাজার মুমিন বান্দা রয়েছেন। যারা সত্যিকারের ইসলাম ধরে রেখে আল্লাহর পথে সৎকর্ম করে যাচ্ছেন। কিন্তু তাঁরা তো পীর নয়।
যদি ধরেও নিই এটা দ্বারা পীর বুঝানো হয়েছে, তারা আল্লাহর রাস্তায় চলে বিধায়! তারা আল্লাহর নিকটবর্তী। তাহলে প্রতিটি পীরের দরবারে মাজারে যে লক্ষ কোটি মুরিদ রয়েছে তারা কি সৎকর্মশীল নয়? আর তারা সৎকর্মশীল না হলে এইসব পীরেরা তাদের কী শিক্ষা দিচ্ছেন? যদি বলেন পীরেরা মুরিদদের সৎ শিক্ষা দিয়ে সৎকর্মশীল তৈরি করছেন তাহলে, এইসব মুরিদই তো পীর হয়ে গেলো এই আয়াত দ্বারা। খুব সহজ বিষয় চেষ্টা করলেই বুঝতে পারবেন।
আর বাস্তবতা হলো বর্তমানে কোনো পীরই ইসলামের সঠিক শিক্ষায় নেই। যেহেতু ইসলামেই নেই সেহেতু তারা সৎকর্মশীল হতে পারে না সৎ কর্মী তৈরি করা তো দূরের কথা। এইসব বিষয়ে বিস্তারিত জানতে হলে অবশ্যই কিছু পড়াশোনা অর্থাৎ বিভিন্ন তাফসীর পড়তে হবে। যাতে করে এইসব আয়াতের সঠিক ব্যাখ্যা জানতে পারেন। যদি সত্যিকারের ইসলাম পালন করতে চান তবে সঠিক ইসলাম সম্পর্কে জানতে হবে। আর জানতে অবশ্যই পড়তে হবে।
১২)" তুমি সূর্যকে দেখবে, যখন উদিত হয়, তাদের গুহা থেকে পাশ কেটে ডান দিকে চলে যায় এবং যখন অস্ত যায়, তাদের থেকে পাশ কেটে বামদিকে চলে যায়, অথচ তারা গুহার প্রশস্ত চত্বরে অবস্থিত। এটা আল্লাহর নিদর্শনাবলীর অন্যতম। আল্লাহ যাকে সৎপথে চালান, সেই সৎপথ প্রাপ্ত এবং তিনি যাকে পথভ্রষ্ট করেন, আপনি কখনও তার জন্যে পথপ্রদর্শনকারী ও সাহায্যকারী পাবেন না।" [ সুরা কা’হফ ১৮:১৭ ]
এই সূরা গুহাবাসীদের নিয়ে নাযিল হয়। যাঁরা তাদের অত্যাচারী বাদশাহর ভয়ে ঈমান রক্ষার জন্য গুহায় আশ্রয় নেয়। আল্লাহ্ তাদের তাঁর নিজ দায়িত্বে সৎপথ প্রদর্শন করিয়েছিলেন। তাঁরা গুহার মধ্যে ঘুমিয়ে কাটিয়েছেন কয়েকশত বছর। এখানে সেই কাহিনীর কথাই বলতে গিয়ে আল্লাহ্ বলেন তিনি তাঁদের সৎ পথ দেখিয়েছিলেন বলেই তাঁরা সৎ পথ প্রাপ্ত হয়েছিলেন। অর্থাৎ আল্লাহ্ যাকে সৎ পথে তথা হিদায়াতের পথে পরিচালিত করেন শুধুমাত্র তাঁরাই হিদায়াত প্রাপ্ত তথা সৎপথ প্রাপ্ত হতে পারেন। এবং যাকে তিনি হিদায়াত তথা সৎপথ দেখান না বা যাদের তিনি পথভ্রষ্ট করেন, তাদের জন্য কোনো পথ প্রদর্শনকারী এবং সাহায্যকারী নেই।
আয়াতের শেষ অংশে এবং এইরকম আরো শতশত আয়াতে এসেছে যে - আল্লাহ্ ই মানুষকে হিদায়াত দেন এবং পথভ্রষ্ট করেন। সুতরাং কেউ সৎপথ প্রাপ্ত হওয়ার সম্পূর্ণ আল্লাহ্ ইখতিয়ার। কেউ চাইলেই কাউকে হিদায়াত দিতে পারেন না। এই আয়াতের দ্বারা কীভাবে পীর ধরার বা মানার কথা আছে আমার বুঝে আসে না (হয়তো জ্ঞানের স্বল্পতা)।
সুতরাং যারা আল্লাহর নিয়ামত প্রাপ্ত হয়ে সৎপথে থাকবেন তারাই সফলকাম। আল্লাহর এই নেয়ামত প্রাপ্তি শুধুমাত্র যদি পীরদের জন্য ই বরাদ্দ হতো তবে তা আরব বিশ্বে না দিয়ে সব নেয়ামত উপমহাদেশে বরাদ্দ দিয়েছেন! এটা কি পাগলও বিশ্বাস করবে? আর যারা এই নেয়ামত প্রাপ্ত বান্দা তথা পীরদের সাথে থাকবেন তারা কি নেয়ামত প্রাপ্ত হবেন না। যদি তারাও নেয়ামত প্রাপ্ত হন তবে তারাও তো পীর দাবি করতে পারেন।
আসলে যুগ যুগ ধরে উপমহাদেশে কুরআনের অপব্যাখ্যাই করা হচ্ছে। এই আয়াত সবার জনই উন্মুক্ত। শুধু এই আয়াত নয়। কুরআনের যেসকল সকল আয়াতে ঈমানদারদের বিভিন্ন গুণাবলি এবং আল্লাহ্ কতৃক সাহায্য প্রাপ্ত হওয়ার ভবিষ্যৎ আভাস রয়েছে তা সর্বকালের সকলের জন্য প্রযোজ্য। শুধুমাত্র কোনো প্রাতিষ্ঠানিক পদের(পীর) জন্য নয়। আল্লাহ্ আমাদের সঠিকভাবে কুরআন বুঝার তৌফিক দান করুন আমিন।
১৩)" মনে রেখো যারা আল্লাহর বন্ধু, তাদের না কোন ভয় ভীতি আছে, না তারা চিন্তান্বিত হবে। [ সুরা ইউনুস ১০:৬২ ]
যারা ঈমান এনেছে এবং ভয় করতে রয়েছে। [ সুরা ইউনুস ১০:৬৩ ]
তাদের জন্য সুসংবাদ পার্থিব জীবনে ও পরকালীন জীবনে। আল্লাহর কথার কখনো হের-ফের হয় না। এটাই হল মহা সফলতা।" [ সুরা ইউনুস ১০:৬৪ ]
এখানে পরপর তিনটি আয়াত রয়েছে। যারা পীরতন্ত্র দাবি করেন তারা শুধুমাত্র ৬২ নং আয়াত দেখিয়ে বলেন এই হচ্ছে আল্লাহর অলি, বন্ধু তথা পীর যাদের কোনো ভয় নেই এবং তাদের চিন্তাও নেই। এই দাবিদাররা পরের আয়াত গুলো ভুলেও মানুষকে বলেন না। যেখানে বলা হচ্ছে যাঁরা ঈমান এনেছে এবং ভয় করেছে নয়, বরং ভয় করতে রয়েছে। অর্থাৎ যাঁরা ঈমান আনার পর আল্লাহ কে ভয় করতে থাকে তাঁরাই আল্লাহর বন্ধু বা অলি। তাহলে এখানে কি শুধুমাত্র পীরদের কথাই বলা হচ্ছে? পৃথিবীতে কি শুধুমাত্র এই উপমহাদেশের পীররাই কি ঈমান এনে আল্লাহ্ কে ভয় করছে ( যদিও তাদের ঈমান আকিদা কী তা আগেই বিস্তারিত বলেছি)। এর উত্তর আপনি নিজেও খুব সহজেই দিতে পারবেন যে শুধুমাত্র পীরেরাই একমাত্র ঈমানদার এবং আল্লাহ্ ভীতু নয়।
এই পৃথিবীতে যারাই সত্যিকারের ঈমানের সাথে আল্লাহকে ভয় করতে রয়েছে তারাই এই আয়াতের মালিক তথা আল্লাহর বন্ধু। খুব সহজে বললে - যারা ঈমান আনার পর পরহেজগারী অবলম্বন করেছেন তাঁরাই এই আয়াতের আল্লাহর অলি বা বন্ধু। এবং তাঁরা দুনিয়া এবং আখিরাতে সফলকাম। এই বিষয়ে অর্থাৎ আল্লাহর বন্ধু সম্পর্কে তাফসীরে ইবনে কাছীরে এসেছে - রাসুলুল্লাহ (সাঃ) জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি জানান যে, যাঁরা দুনিয়ায় একে অপরকে ভালোবেসেছে শুধুমাত্র আল্লাহর কারণে। কোনো সম্পত্তি বা আত্মীয়তার কারণে নয় (বিস্তারিত ইবনে কাছীর) এবং তাঁরা হচ্ছেন পরহেজগারী। সুতরাং আল্লাহর অলি তারাই হবেন।
এখন যারা আল্লাহর অলি দ্বারা পীর এবং মাজার কে বুঝানোর চেষ্টা করেন তাদের দিকে তাকান। তারা অর্থাৎ পীরেরা কি শুধুমাত্র আল্লাহর জন্য মুরিদ করান? মুরিন করানোর পর তাদের থেকে হাদিয়া তোফা নজরানা নেন না? বিভিন্ন মান্নতের মাধ্যমে মাজারে টাকাপয়সা নেওয়া হয় না?
এর দ্বারা খুব সহজেই বুঝা যাচ্ছে যে এখানে ভালোবাসা যেটা চলছে সেটা একধরনের বিনিময় স্বরূপ। শুধু তাইনয় এক পীরের মৃত্যুর পর তার সন্তানই নতুন পীর হয়ে আবির্ভাব হন। এবং তিনিও অটোমেটিক আল্লাহর অলি হয়ে যান বংশপারম্পরিক ভাবে। হে মুসলমানগণ একটু তো চিন্তা করুন। এটা কি ইসলাম সমর্থন করে? আল্লাহর অলি বংশপরম্পরায় হওয়া যায়? তাহলে তো বর্তমানে যেসব দরকার আছে সেইসব বংশ ছাড়া আর কোনো বংশে আল্লাহ তাঁর অলিদের প্রেরণ করবেন না। আর আল্লাহর অলির সব বংশই শুধু এই ভারত বাংলাদেশ পাকিস্তানে। অথচ যেখানে ইসলাম এসেছে। যারা আল্লাহ্ স্বীকৃত জান্নাতী। সেখানে এবং সেইসব বংশে আল্লাহর অলি প্রেরণ করছেন না। ব্যাপারটা কি যৌক্তিক?
সহজ বাংলায় বললে পীর নিয়ে এইসব ভুল ব্যাখ্যা আজ নতুন নয়। যখন থেকেই স্বার্থান্বেষী একটি শ্রেণী আল্লাহর সত্যিকার অলিদের নিয়ে ব্যবসা শুরু করেছিল তখন থেকেই এইসব পীর মুরিদী জায়েজ করার জন্য কোনো না কোন পথ তারা বের করার চেষ্টায় ছিল। যেহেতু সাধারণ মানুষের কুরআন হাদীসের কোনো জ্ঞান ছিলো না এবং নেই। সেই সুযোগে কুরআনের সার্বজনীন আয়াতকে কোন একটি নির্দিষ্ট পক্ষে (পীর) নিয়ে ব্যাখ্যা করতে সচেষ্ট হয়। যা ইতিমধ্যে প্রতীয়মান হয়েছে প্রমাণসাপেক্ষে।
১৪) "হে মুমিনগণ! আল্লাহকে ভয় কর, তাঁর নৈকট্য (ওয়াসিলা) অন্বেষন কর এবং তাঁর পথে জেহাদ কর যাতে তোমরা সফলকাম হও। [ সুরা মায়েদা ৫:৩৫ ]
এই একটি আয়াত যা দ্বারা লক্ষ লক্ষ মুসলমানকে একশ্রেণির ভন্ডরা বিপদগগামী তথা পথভ্রষ্ট করছে। এই আয়াতকে পুঁজি করে ভন্ডরা বলে বেড়ায় যে এখানে ওয়াসিলা হলো পীর। কতবড় মিথ্যাবাদী হলে কেউ এমন কথা বলে। আর আমাদের সাধারণ মুসলমানগণ না বুঝে যাচাই না করে এইসব কথা বিশ্বাস করে ঈমান আমল ধ্বংস করছে।
এখানে কত স্পষ্ট করে আল্লাহ বলছেন তাঁকে ভয় করতে এবং তাঁর নিকটবর্তী হতে উপায় বা মাধ্যম তালাশ বা অন্বেষণ করতে। এবং আল্লাহ্ নিজেই পরের অংশে বলছেন যে - তোমরা আল্লাহর পথে জিহাদ করো যাতে তোমরা সফল হও। অর্থাৎ আল্লাহর নিকটবর্তী তথা আল্লাহর প্রিয়ভাজন হতে হলে জিহাদ করো। আর জিহাদের মাধ্যমে আল্লাহর নিকটবর্তী হয়ে দুনিয়া এবং আখিরাতে সফল হও।
বিখ্যাত তাফসীরকারক ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন - ওয়াসিলা বলতে আল্লাহর নিষেধকৃত কাজ থেকে বিরত থাকা এবং তাঁর নৈকট্য লাভের চেষ্টা করা। কাতাদাহ (রহ) বলেন - আল্লাহর আনুগত্য স্বীকার এবং তাঁর মর্জি মোতাবেক চলা। ইবনে কাছীরে এসেছে, ওয়াসিলা বলতে ঐ জিনিস যার দ্বারা আকাঙ্খিত বস্তু লাভ করা যায়। ওয়াসিলা হচ্ছে জান্নাতের ঐ উচ্চ ও মনোরোম জায়গায় যা রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এর জন্য নির্দিষ্ট করা হয়েছে। এটা আরশের খুব নিকটে। সহীহ্ বুখারীতে এসেছে যে আজান শুনে আজানের দোয়া পড়বে, তার জন্য রাসুলের (সাঃ) এর শাফায়াত হালাল হয়ে যাবে। সহীহ্ মুসলিমেও এসেছে আজানের পর দোয়ায় আমরা বলি রাসুল (সাঃ) কে ওয়াসিলা নামক স্থান এবং মর্যাদা দান করুন (বিস্তারিত ইবনে কাছীর)।
এখানে ওয়াসিলা বলতে পীর নয়। যদি ওয়াসিলা পীর হয় তবে সহীহ্ হাদীস এবং বিখ্যাত তাফসীরে যা এসেছে তা সবই মিথ্যে। কিন্তু এটা কখনোই সম্ভব নয়। বিখ্যাত তাফসীর এবং সহীহ্ হাদীসে প্রমাণিত যে এখানে "ওয়াসিলা " বলতে কখনোই পীর নয়।
যদি যুক্তির খাতিরে আমরা ধরেও নিই যে এখানে ওয়াসিলা মানে পীর। তবে পরের অংশে জিহাদের কথা আছে। অর্থাৎ আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করতে হবে। আমাদের উপমহাদেশে কোনো দেশেই কখনো ইসলামী শাসন ছিলো না। কখনোই ইসলামী আইন দিয়ে রাষ্ট্র পরিচালিত হয়নি। যদি পীরেরাই ওয়াসিলা হয় তবে তাদের জিহাদ করা এই আয়াত দ্বারা অবশ্যই কর্তব্য। এই জিহাদের মাধ্যমে আল্লাহর আইন কে জমিনে প্রতিষ্ঠিত করা। যদি তারা তা না করেন তবে তারা ভন্ড। এইসব পীর যে ইসলামী কোনো কিছুতে নেই তা আগেই প্রমাণ করেছি।
অথচ এই ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে লক্ষ কোটি মুসলমানের ঈমান ধ্বংস করা হচ্ছে এখনো। শুধু তাইনয় এই আয়াতের ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে দিনদিন পীর - মুরিদী ব্যবসা জমজমাট হচ্ছে। সহীহ্ জিহাদের নাম নিশানাও আজ বিভিন্ন কারণে প্রশ্নবিদ্ধ। আল্লাহ্ আমাদের হিদায়াত দান করুন আমিন।
১৫) "আমি আপনার প্রতি অবতীর্ণ করেছি সত্যগ্রন্থ, যা পূর্ববতী গ্রন্থ সমূহের সত্যায়নকারী এবং সেগুলোর বিষয়বস্তুর রক্ষণাবেক্ষণকারী। অতএব, আপনি তাদের পারস্পারিক ব্যাপারাদিতে আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন, তদনুযায়ী ফয়সালা করুন এবং আপনার কাছে যে সৎপথ এসেছে, তা ছেড়ে তাদের প্রবৃত্তির অনুসরণ করবেন না। আমি তোমাদের প্রত্যেককে একটি আইন ও পথ দিয়েছি। যদি আল্লাহ চাইতেন, তবে তোমাদের সবাইকে এক উম্মত করে দিতেন, কিন্তু এরূপ করেননি-যাতে তোমাদেরকে যে ধর্ম দিয়েছেন, তাতে তোমাদের পরীক্ষা নেন। অতএব, দৌড়ে কল্যাণকর বিষয়াদি অর্জন কর। তোমাদের সবাইকে আল্লাহর কাছে প্রত্যাবর্তন করতে হবে। অতঃপর তিনি অবহিত করবেন সে বিষয়, যাতে তোমরা মতবিরোধ করতে।" [ সুরা মায়েদা ৫:৪৮ ]
এই আয়াতের একটি অংশে বলা হয়েছে যে আল্লাহ্ আমাদের একটি আইন (শরীয়ত) এবং একটি পথ দিয়েছেন। এই আইন বা শরীয়ত দ্বারা ইসলামের শরীয়ত। এবং রাস্তা দ্বারা এইসব পীর মাজার ভক্তরা বলে যে ত্বরিকত। অথচ এখানে আরবিতে ত্বরিকা বা ত্বরিকত শব্দ নেই।
এই আয়াতের পুরো ব্যাখ্যা যদি আমরা করি তাহলে দেখবো যে, আল্লাহ্ বলছেন ইসলাম আগে থেকেই ছিলো। এই পবিত্র কুরআন আগের কিতাবগুলোর সত্যায়নকারী। প্রতিটি নবী রাসুলদের (আঃ) ই নির্দিষ্ট বিধিবিধান বা শরীয়ত এবং নির্দিষ্ট কিছু কর্মপন্থা ছিলো। এখন শেষ নবী (সাঃ) যে বিধিবিধান নিয়ে এসেছেন তা ই সকলকে মানতে হবে। অতএব এখানে বিধিবিধান হচ্ছে ইসলামী শরীয়ত এবং কর্মপন্থা হচ্ছে ইসলামে চলার রাস্তা। যা রাসুলুল্লাহ (সাঃ) তাঁর জীবনের প্রতিটি কর্মকান্ড দ্বারা আমাদের শিক্ষা দিয়ে গেছেন। সুতরাং এই আয়াত দ্বারা পীর মুরিদী কোনো ভাবেই সাব্যস্ত হয়নি।
১৬) " হে মুমিনগণ, তোমাদের মধ্যে যে স্বীয় ধর্ম থেকে ফিরে যাবে, অচিরে আল্লাহ এমন সম্প্রদায় সৃষ্টি করবেন, যাদেরকে তিনি ভালবাসবেন এবং তারা তাঁকে ভালবাসবে। তারা মুসলমানদের প্রতি বিনয়-নম্র হবে এবং কাফেরদের প্রতি কঠোর হবে। তারা আল্লাহর পথে জেহাদ করবে এবং কোন তিরস্কারকারীর তিরস্কারে ভীত হবে না। এটি আল্লাহর অনুগ্রহ-তিনি যাকে ইচ্ছা দান করেন। আল্লাহ প্রাচুর্য দানকারী, মহাজ্ঞানী। [ সুরা মায়েদা ৫:৫৪ ]
তোমাদের বন্ধু তো আল্লাহ তাঁর রসূল এবং মুমিনবৃন্দ- যারা নামায কায়েম করে, যাকাত দেয় এবং বিনম্র। [ সুরা মায়েদা ৫:৫৫ ]
আর যারা আল্লাহ তাঁর রসূল এবং বিশ্বাসীদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করে, তারাই আল্লাহর দল এবং তারাই বিজয়ী। [ সুরা মায়েদা ৫:৫৬ ]
এখানে তিনটি আয়াত রয়েছে। তবে পীরবাদীরা ৫৪ নং বলে না। এর ব্যাখ্যা পরে করছি। এখানে বলা হচ্ছে সাধারণ মুসলমানদের বন্ধু বা অলি হলো আল্লাহ্, তাঁর রাসুল (সাঃ) এবং মুমিনগণ। যদি এদেরকে বন্ধু রূপে গ্রহণ করা যায় তাহলে তারা বিজয়ী। এখানে বিজয়ী কথা কেন এসেছে? এটার দুটি ব্যাখ্যা এই বিজয় প্রথমত দুনিয়ায়। দ্বিতীয়ত আখিরাতে। দুনিয়ার বিজয় কী? এই দুনিয়ার বিজয় জানতে হলে ৫৪ নং আয়াতে যেতে হবে। সেখানে আল্লাহর বন্ধুদের গুণাবলী বলা হচ্ছে - তারা আল্লাহ্ কে ভালোবাসবেন আল্লাহও তাঁদের ভালোবাসবেন। তাঁরা মুসলমানদের প্রতি নম্র হবেন এবং কাফেরদের (যারা ইসলাম বিদ্বেষী) তাদের প্রতি হবেন খুবই কঠোর জিহাদের মাধ্যমে।
অর্থাৎ এরা হচ্ছেন আল্লাহর সেইসব অলি বা বন্ধু যারা ইসলামের জন্য সর্বাবস্থায় কঠোর এবং সাধারণ মুসলমানদের জন্য দয়ালু। এখন যদি বলা এইসব বন্ধু মানে পীরেরা। তাহলে বাস্তবতা একটু মিলিয়ে দেখুন। এক পীর আরেক পীরের বদনাম ছাড়া সুনাম কখনোই করতে পারে না। অতএব তারা (পীরেরা) সাধারণ মুসলমানরের জন্য দয়ালু বা নম্র নন।
দ্বিতীয়ত কথা হচ্ছে পীরেরা ইসলামী শত্রুদের প্রতি হবেন খুবই কঠোর (জিহাদ বাদই দিলাম)। এখন বাস্তবতা হচ্ছে আজ পর্যন্ত কোনো দরবার থেকে ইসলামী শত্রু বিভিন্ন নাস্তিক মুরতাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন তো দূরের কথা, কোনো বক্তব্য প্রতিবাদও হয়নি। শুধু তাইনয়, বিরুদ্ধে কথা বলা তো দূরের থাক। এইসব ইসলাম বিদ্বেষী ব্যক্তি এবং দলের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করে ইসলামী বিরোধী আইন প্রনয়ণে সার্বিক সহযোগিতা করে। এটা করেই শেষ নয়। যারা ইসলাম বিরোধী শক্তির সাথে লড়াই করে তাদের বিরুদ্ধে এইসব দরবার মাজার লেগে থাকে। বাস্তবতা নিজ দায়িত্ব বিবেচনা করুন।
অতএব এইসব আয়াত দ্বারা যাদের ইসলামের জ্ঞান নেই তাদের বুঝানো সহজ হবে। কিন্তু যাদের আল্লাহ্ নিজ দায়িত্ব ইসলামের জ্ঞান দিয়েছেন তাদের ভোলানো যাবে না।
১৭) "নিশ্চয় যারা মুসলমান, যারা ইহুদী, ছাবেয়ী বা খ্রীষ্টান, তাদের মধ্যে যারা বিশ্বাস স্থাপন করে আল্লাহর প্রতি, কিয়ামতের প্রতি এবং সৎকর্ম সম্পাদন করে, তাদের কোন ভয় নেই এবং তারা দুঃখিত হবে না। [ সুরা মায়েদা ৫:৬৯ ]
এই আয়াত দিয়েও ভ্রান্তবাদীরা পীরের দলিল দেয়। অথচ এখানে স্পষ্ট বলা হচ্ছে - মুসলিম, ইহুদি, সাবেয়ী বা খ্রিস্টানের মধ্য থেকে যারাই আল্লাহর প্রতি ঈমান আনেন এবং সৎ কর্ম করে তাদের কোনো ভয় নেই এবং তাঁরা নিরাশ বা দুঃখিত হবেন না। এখানে পীরের কথা বলা হয়েছে তা কোন পাগলে বলবে?
১৮) "সেদিন দয়াময়ের কাছে পরহেযগারদেরকে অতিথিরূপে সমবেত করব, [ সুরা মারঈয়াম ১৯:৮৫ ]
এবং অপরাধীদেরকে পিপাসার্ত অবস্থায় জাহান্নামের দিকে হাঁকিয়ে নিয়ে যাব। [ সুরা মারঈয়াম ১৯:৮৬
যে দয়াময় আল্লাহর কাছ থেকে প্রতিশ্রুতি গ্রহণ করেছে, সে ব্যতীত আর কেউ সুপারিশ করার অধিকারী হবে না। [ সুরা মারঈয়াম ১৯:৮৭ ]
এখানে ৮৭ নং আয়াত থেকে "যে দয়াময় আল্লাহ থেকে প্রতিশ্রুতি গ্রহণ করেছে "এই বাক্য দ্বারা পীর সাব্যস্ত করেন। অর্থাৎ শুধুমাত্র পীরেরা আল্লাহ্ থেকে প্রতিশ্রুতি পেয়েছেন সুপারিশ করার। আমরা যদি ৮৫ নং আয়াতের দিকে তাকাই তাহলে দেখা যাচ্ছে যে, পরহেজগার মুত্তাকী অর্থাৎ যারা আল্লাহর আদেশ নিষেধ মেনে চলে সমস্ত পাপ থেকে দূরে থেকে দুনিয়ার জীবন পরিচালিত করেছেন তাঁদের আল্লাহ্ তাআলা মেহমান রূপে কিয়ামতের ময়দানে হাজির করবেন (ইবনে কাছীর)। এটা তাঁদের জন্য একটি পুরুষ্কার স্বরূপ।
পরবর্তী ৮৭ নং আয়াতে বলা হচ্ছে যারা আল্লাহ্ থেকে প্রতিশ্রুতি গ্রহণ করেছে সে ব্যতীত আর কেউ সুপারিশ করতে পারবে না। এরদ্বারা নবী (আঃ) রাসুল (সাঃ) এবং সৎকর্মশীল ব্যক্তিবর্গ। সৎকর্মশীল বলতে প্রকৃত মুমিন যারা তাঁরা। যাঁরা আল্লাহর রাস্তায় নিজেদের পরিচালিত করেছেন (বিস্তারিত আগে দেওয়া হয়েছিল)।
সাধারণ মুমিন মুত্তাকীগণ সুপারিশ করতে পারবেন এটা ঠিক আছে। কিন্তু তাঁরা কাদের জন্য সুপারিশ করতে পারবেন সেটারও একটা সীমা আছে। কুরআনের অন্যান্য আয়াত দ্বারা প্রমাণিত যে, যারা ঈমান এনেছে এবং আল্লাহর সাথে শির্ক করেনি। আল্লাহ্ কিয়ামতের ময়দানে চাইলেই (তাঁর ক্ষমাশীল গুণের কারণে) যেকোনো কাউকে ক্ষমা করতে পারেন। কিন্তু একশ্রেণির ব্যক্তি ছাড়া। তারা হলো মুশরিক অর্থাৎ শির্ককারী। আল্লাহর সাথে যারা অন্যান্যদের অংশীদার স্থাপন করেছে।
এ থেকে বুঝা যাচ্ছে যে ব্যক্তি মুমিন মুত্তাকী সে যেই হোক না কেন তিনি সুপারিশ করতে পারেন যাদের জন্য সুপারিশ প্রযোজ্য। আমাদের দেশের বিভিন্ন দরবারে ও মাযারে কী চলছে তা আগেই বর্ণনা করেছি। অতএব তারা এই আয়াতের অধিকারী নয়।
আর তাদের মুরিদরা পীর মাজারে স্পষ্ট শির্ক করার কারণে তারাও কারো কাছ থেকে সুপারিশ পাওয়ার যোগ্যতা রাখে না।
১৯) "আল্লাহর সামনে তারা আপনার কোন উপকারে আসবে না। যালেমরা একে অপরের বন্ধু। আর আল্লাহ পরহেযগারদের বন্ধু। [ সুরা যাসিয়া ৪৫:১৯ ]
সেই একই কথা। এখানেও পরহেযগারদের কথা বলা হয়েছে। আর পরহেযগার কারা আগেই আলোচনা হয়েছে। সুতরাং এই পরহেযগার মানে শুধুমাত্র পীর নয়। এটা সকল ঈমানদার মুমিন, মুত্তাকী যারা পরহেজগারী তাদের জন্য উন্মুক্ত।
সুতরাং এইসব আয়াতের ব্যাখ্যা দ্বারা এটাই প্রমাণিত - যেসব আয়াত দিয়ে পীর জায়েজ করা হয়েছে তা মোটেই যুক্তিযুক্ত নয়। আমরা যারা সত্যিকার ভাবে কুরআনকে জানি না বুঝি না তাদেরকে বোকা বানিয়ে একশ্রেণির স্বার্থবাদী মহল সাধারণ মুসলমানদের ঈমান ধ্বংসের কাজে নিয়োজিত। এই ধ্বংসাত্মক কাজে সাধারণ মুসলমানের ঈমান ধ্বংস হলেও ঐ শ্রেণীর মতলববাজদের দুনিয়ার ফায়দা ঠিকই হচ্ছে। সুতরাং আমাদের উচিত হবে এই ফাঁদে পা দেওয়ার আগে সব কিছু যাচাই বাছাই করে নেওয়া। যাতে আমাদের ইহকাল পরকাল দুটোই ঠিক থাকে।
২) বাইয়াত দ্বারা দলিলঃ
পবিত্র কুরআন শরীফে বাইয়াতের কথা আছে। রাসুলুল্লাহ (সাঃ) তাঁর সাহাবীদের কাছ থেকে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন বিষয়ের উপর বাইয়াত করিয়েছেন তার প্রমাণ হাদীসে আছে। এখন আমরা দেখবো রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এর বাইয়াত আর বর্তমান উপমহাদেশের পীরদের বাইয়াত কি এক নাকি ভিন্ন।
বাইয়াতঃ
বাইয়াত শব্দের অর্থ হলো - ক্ষমতা প্রদান, প্রতিজ্ঞা গ্রহণ, আনুগত্যের শপথ, ওয়াদাবদ্ধ হওয়া, ক্রয় বিক্রয় করা ইত্যাদি। বাইয়াত হওয়ার অর্থ হলো নিজেদের সব কিছুর বিনিময়ে বিক্রিত হওয়া। আরবিতে বাইয়াত অর্থ বিক্রয় হিসাবে এসেছে। যা চুক্তি, অঙ্গীকার বা শপথ হিসাবে বলা হয়।
বিক্রয় করা মালের উপর যেমন নিজের অধিকার থাকে না। ঠিক তেমনি কারো নিকট বাইয়াত হলেও তার আর নিজস্ব অধিকার থাকে না। কোনো বিধর্মী যখন ইসলাম কবুল করে তখন তাকে সব ত্যাগ দিয়ে শুধুমাত্র ইসলামকেই মেনে নিতে হবে। অতএব বাইয়াত হলো কারো কাছে বিভিন্ন বিষয়ের উপর অঙ্গীকার বা শপথ করা।
রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এর বাইয়াতঃ
হুজুর পাক (সাঃ) বিভিন্ন সময় তাঁর সাহাবীদের কাছ থেকে বাইয়াত নিয়েছিলেন। বেশ কিছু বাইয়াতের কথা পবিত্র কুরআনে এসেছে।
বাইয়াতের মাধ্যমে রাসুল (সাঃ) বিভিন্ন বিষয়ের উপর সাহাবীদের থেকে অঙ্গীকার বা শপথ নিয়েছিলেন। আমরা যদি কুরআন এবং হাদীস পর্যালোচনা করি তবে সেখান থেকে বাইয়াতের দুটি দিক দেখতে পাই।
১ ) রাষ্ট্রীয় বাইয়াত
২) ধর্মীয় বাইয়াত
রাষ্ট্রীয় বাইয়াতঃ
ইসলামী রাষ্ট্রের আমীর, খলিফা বা রাষ্ট্র প্রধানের অধীনে যে বাইয়াত নেওয়া তা হচ্ছে রাষ্ট্রীয় বাইয়াত। এইসব বাইয়াত ইসলামের রাষ্ট্রীয় আনুগত্য, রাষ্ট্রপ্রধানের আনুগত্য এবং সর্বোপরি জিহাদের জন্য আনুগত্যের বাইয়াতকে রাষ্ট্রীয় বাইয়াত বলা হয়।
এইসব বাইয়াত রাসুল (সাঃ) এবং তাঁর পরবর্তীতে খলিফায়ে রাশেদীন নিয়েছিলেন। রাষ্ট্রীয় বাইয়াতের মূল উদ্দেশ্য হলো ইসলাম প্রতিষ্ঠা করার নিমিত্তে যাবতীয় আনুগত্য করা। আমরা কুরআনের আয়ত এবং বিভিন্ন হাদীস দ্বারা রাষ্ট্রীয় বাইয়াতের বিভিন্ন ঘটনা দেখতে পাই।
ধর্মীয় বাইয়াতঃ
ধর্মীয় বাইয়াত মূলত ঈমান আনা এবং সেই অনুযায়ী জীবন পরিচালিত করার জন্য বাইয়াত হওয়া। রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বিভিন্ন সময় তাঁর সাহাবীদের থেকে ইসলামের উপর অটল থাকা এবং সেই অনুযায়ী আমল করার জন্য বাইয়াত নিয়েছেন। যদিও বাইয়াত মূলত ইসলামী আমীরের পক্ষে হয়ে থাকে। কিন্তু যখন ইসলামী শাসনের পতন হয় তখন বিভিন্ন বুজুর্গ ব্যক্তিবর্গ সাধারণ মানুষদের ইসলামের দিকে ধাবিত করার জন্য বাইয়াত ব্যবস্থা চালু করেন। যা বর্তমানে বিভিন্ন পীরের দরবারে চালু আছে।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাধারনত নিম্মে বর্ণিত বাইয়াত সমূহ সাহাবিদের করিয়েছেন।
১। ইসলাম গ্রহনের বাইয়াত। (ঈমান আনার জন্য বাইয়াত)
২। শির্কি কাজ (অর্থাৎ আল্লাহর সাথে অন্যান্য কারো ইবাদত করা) ত্যাগ করার বাইয়াত।
৩। সালাত আদায়, যাকাত প্রদান করার বাইয়াত।
৪। মুসলমানকে নসীহত করার বাইয়াত। (সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ)
৫। জিহাদের বাইয়াত।
৬। রাষ্ট্রনেতার বিরুদ্ধে যুদ্ধ না করার বাইয়াত। (যতক্ষণ না প্রকাশ্য কুফরী লিপ্ত হয়)
৭। সর্বদা সত্য কথা বলার বাইয়াত গ্রহণ করা।
৮। শর্তহীনভাবে আল্লাহ ও তার রাসূল (সাঃ) এর আনুগত্যের বাইয়াত।
৯। খারাপ কাজ না করার বাইয়াত। (চুরি, ব্যভিচার, সন্তানদেরকে হত্যা, কোনোরূপ অন্যের সম্পদ আত্মসাৎ না করা, কারও প্রতি মিথ্যা অপবাদ বা দোষারোপ করব না করা।)
১০। আমীরের আনুগত্যের বাইয়াত।
১১। ইসলামী রাষ্ট্রের রাষ্ট্র প্রধানের আনুগত্যের বাইয়াত।
১৩। কাফেরদের নির্যাতনে বিপরীতে নারী ও শিশুর ন্যয় নবী করিম কে হেফাজাত করার বাইয়াত।
১৪। পক্ষ্যান্তরে ইসলামের বিজয় আসলে নিজ সম্প্রদায়ের কাছে ফিরে না আসার নবী কতৃক ওয়াদা
উপরোক্ত বিষয় সমূহ নিয়েই রাসুলুল্লাহ (সাঃ) তাঁর সাহাবীদের থেকে বাইয়াত নিয়েছেন। রাসুল (সাঃ) পরবর্তীতে যারা ইসলামের খিলাফতে অধিষ্ঠিত ছিলো তারাও এইসবের উপর ভিত্তি করে বাইয়াত নিয়েছেন। ইসলামী খিলাফতের পরবর্তীতেও বর্তমানে আরব বিশ্বে যেখানে রাজতন্ত্র আছে সেখানেও তারা সাধারণ জনগণ থেকে বাইয়াত নেয়।
মোট কথা বাইয়াত নেওয়া এখনো চলছে এবং এটা চলা উচিত। বিশেষ করে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করার জন্য। প্রতিটি মুসলমানের উচিত কারো কাছে বাইয়াত হয়ে ইসলামের জন্য কাজ করা। পবিত্র কুরআনে বাইয়াতের যে আয়াত নাযিল হয় তা মূলত জিহাদ তথা ইসলাম প্রতিষ্ঠা করার জন্য। সুতরাং আজও আমাদের বাইয়াত হতে হবে মূলত ইসলামকে সমুন্নত করার জন্য। যেখানে ইসলাম প্রতিষ্ঠিত সেখানে ইসলাম মানা এবং আমল করা সহজ।
এখন আমরা দেখবো উপমহাদেশের পীরেরা যে বাইয়াত নিচ্ছেন তা কীসের ভিত্তিতে। আমরা যদি বিভিন্ন দরবারের দিকে তাকাই তবে দেখতে পাবো যে শুধুমাত্র পীরের আনুগত্যের জন্য বাইয়াত নেওয়া হয়। অথচ রাসুল (সাঃ) যেসব বিষয় নিয়ে বাইয়াত নিয়েছেন তার কোনো কিছুই এইসব দরবারে পালন এবং দেখা যায় না।
রাসুলুল্লাহ (সাঃ) ধর্মীয় বাইয়াত নিয়েছেন শির্ক না করার জন্য। অথচ হাতে গোনা কয়েকটি দরবার বাদে সবখানেই শির্কের আখড়া তৈরি হয়েছে। ইসলামের বাইয়াতের মূল উদ্দেশ্য হলো ইসলাম প্রতিষ্ঠা করা। যা কোনো দরবার থেকে করা তো দূরের কথা বলাই হয় না (একটি দরবার ব্যতীত) । শুধু তাইনয় ইসলাম বিরোধী শক্তির সাথে একাত্ম হয়ে এইসব দরবার একাকার হয়ে গেছে। তাহলে পীরেরা যে বাইয়াত নিচ্ছেন তা কি ইসলাম সম্মত হচ্ছে?
একটু খেয়াল করলেই বুঝতে পারবেন রাসুল (সাঃ) যেসব বিষয়ের উপর বাইয়াত নিয়েছিলেন তার বেশিরভাগই আজ দরবারে অনুপস্থিত। সুতরাং বাইয়াত দিয়ে যে পীর জায়েজ তা কখনোই হতে পারে না। যেখানে একটি সহীহ্ হাদিসে এসেছে ইসলামে বাইয়াত নেওয়ার ক্ষমতা সর্বসম্মতিক্রমে একজনের। সেখানে দুজন দাবি করলে পরের জনকে হত্যা করতে বলা হয়েছে। এই বাইয়াত নিয়ে মতবিরোধের কারণে কারবালার ময়দানে হযরত হুসাইন (রাঃ) কে শহীদ করা হয়েছিল।
কেননা বেশিরভাগ পক্ষ ইয়াযীদকে সমর্থন করে বাইয়াত হয়েছিল। ইরাকের কুফার এলাকার জনগণ হযরত হুসাইন (রাঃ) এর কাছে বাইয়াত হতে চেয়েছিল। পরবর্তীতে ইয়াযীদ সৈন্য কতৃক হযরত হুসাইন (রাঃ) কে শহীদ করা হয়। যদিও হযরত হুসাইন (রাঃ) খিলাফতের দাবি ছেড়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু কুচক্রীরা তাঁকে ছেড়ে দেয়নি। তাহলে বুঝা যাচ্ছে খিলাফত এবং বাইয়াত খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ইসলামে। যার জন্য রাসুল (সাঃ) প্রাণপ্রিয় নাতিকে পর্যন্ত শহীদ হতে হলো। সুতরাং যেকোনো বিষয় আমাদের ইতিহাস এবং ইসলাম সম্মত কিনা যাচাই করে দেখা উচিত।
৩) সুপারিশকারী
আমাদের উপমহাদেশে পীর ধরার একমাত্র এবং অন্যতম কারণ হচ্ছে কিয়ামতে "সুপারিশ "এর জন্য। আমাদের ভিতরে বদ্ধমূল ধারণা একশ্রেণির আলেম ওলামারা দিতে পেরেছে যে, কিয়ামতে অবশ্যই সুপারিশ লাগবে। আর সুপারিশ পাওয়ার জন্য কোনো না কোনো পীরের দরবারে মুরিদ হওয়া লাগবে। সুতরাং যে বুঝে সেও যাচ্ছে যে বুঝে না সেও পীরের দরবারে মাথা ঠুকে যাচ্ছে।
সুপারিশকারী কারাঃ
সুপারিশ বিষয়টি সর্বজনবিদিত। এটা সবাই জানে কিয়ামতের ময়দানে আল্লাহ্ তাআলা কিছু কিছু মানুষকে সুপারিশ করার সুযোগ দিবেন। যারা নিজেদের পরিপূর্ণ ভাবে ইসলামের পথে পরিচালিত করতে পেরেছে। যাদের কথা কুরআন এবং হাদীসে এসেছে তাঁরা অবশ্যই কিয়ামতে সুপারিশ করবেন। আমাদের জানতে হবে কারা কারা সুপারিশ করতে পারবেন।
পবিত্র কুরআন ও হাদীসের আলোকে নবী (আঃ) গণ রাসুল (সাঃ) ছিদ্দিকগণ, শহীদগণ, মালাইকাগণ, সৎকর্মশীল ব্যক্তিবর্গ, আলেমগণ, কুরআনের হাফিজ, পবিত্র কুরআন, মসজিদ, নাবালক সন্তান প্রমুখ।
সুপারিশ কাদের প্রয়োজনঃ
আমাদের আগে দেখতে হবে আমরা সুপারিশ চাইব কেন? কী কারণে সুপারিশ দরকার। দুনিয়াবী হিসাবে দেখলে আমরা সুপারিশ করি তার জন্য যার যোগ্যতা নেই। অর্থাৎ যে দূর্বল এবং ঐ পদ বা বিষয়ের জন্য উপযুক্ত নয় তার জন্য সুপারিশ করা হয়। ফলে সুপারিশকারী নিজের প্রভাব প্রতিপত্তি দিয়ে পদ বা বিষয় আদায় করে দেন। কোনো উপযুক্ত ব্যক্তির জন্য কখনোই কোন সুপারিশ করা হয় না বা করতে হয় না।
কেননা সে নিজেই এর উপযুক্ততা অর্জন করতে পেরেছে। যদি কম যোগ্যতা সম্পন্ন কাউকে ঐ পদ বা বিষয় দিতে হয় তবে তার ঐ পদ বা বিষয়ের জন্য মোটামুটি যোগ্যতা থাকা লাগবে। সুপারিশকারী থাকলেও যদি কারও মোটামুটিও যোগ্যতা না থাকে তার জন্য কি কেউ সুপারিশ করবেন নাকি পারবেন? অবশ্যই না। কেননা যেকোনো কিছু অর্জন করতে চাইলে সে সম্পর্কে নুন্যতম জ্ঞান থাকা লাগে।
ঠিক একই কথা কিয়ামতেও আসবে। আল্লাহ আমাদের দুনিয়ায় পাঠিয়েছেন পরীক্ষা নেওয়া জন্য। আমাদের উচিত হবে আল্লাহর পরীক্ষা পাস করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করা। এখন আপ্রাণ চেষ্টার পরও যদি কোনো পরীক্ষার্থী পাস করতে না পারেন তবে তাঁর প্রিয়ভাজন শিক্ষক নিজ চেষ্টায় পাস করানোর জন্য সুপারিশ করবেন। অর্থাৎ দুনিয়ায় আমাদের চেষ্টা থাকতে হবে পরিপূর্ণ ইসলাম মেনে চলতে। সময়ের সাথে পরিস্থিতি বিবেচনায় সবক্ষেত্রে অনেকেই ইসলাম মেনে সব করতে পারে না। তবে তার চেষ্টা থাকে। যদি সে চেষ্টা করার পর আল্লাহর কাছে গুনাহগার হয়ে যায় তবে এইসব সুপারিশকারীগণ আমাদের জন্য সুপারিশ করবেন। ইনশাআল্লাহ আমরা সুপারিশ প্রাপ্ত হবো যদি আমাদের সর্বাত্মক চেষ্টা থাকে।
পীর দ্বারা সুপারিশের যৌক্তিকতাঃ
এখন আমাদের জানতে হবে কারা কারা সুপারিশ লাভের অধিকারী হবেন। মুসলমান হলেই কি সুপারিশ পাওয়া যাবে? পবিত্র কুরআন এবং হাদীসে এসেছে যাদের মধ্যে পরিপূর্ণ ঈমান থাকবে তারা সুপারিশ লাভ করবে। যেহেতু আল্লাহ আমাদের পরীক্ষার জন্য দুনিয়ায় পাঠিয়েছেন সেহেতু আমাদের এখানে পরীক্ষা দিতে হবে প্রতিটি মুহূর্তে। এখন আমরা যারা পীর বা মাজার ধরে বসে আছি তাদের উদ্দেশ্য সৎ নয়। কেননা আপনি ধরেই নিয়েছেন পীর বা মাজার আপনাকে কিয়ামতে উদ্ধার করবেন। সুতরাং ইসলামী অনুশাসন পরিপূর্ণভাবে মানার দরকার কি? কেউ এই নিয়তে গেলে তার ইহকাল পরকাল সব শেষ। যদি এমন পীর বা মাজারে গেলেন যে, যেখানে সঠিক ইসলাম শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে। অতএব আমরা এইসব পরিপূর্ণ ভাবে মেনে চলার চেষ্টা করবো বাকিটুকু আল্লাহর অলির হাতে। যদি বিষয়টা এমন হয় তবে এখানে কোনো দ্বিমত নেই।
আল্লাহ্ নিজেও চান বান্দাকে ক্ষমা করতে। যদি আমরা সত্যিকার ইসলাম মেনে চলার পরও যদি ভুল ভ্রান্তি হয়ে যায় তবে আল্লাহ "ক্ষমাশীল "। আল্লাহর ক্ষমার গুণেও অনেকে ক্ষমা পেয়ে যাবেন। কিন্তু আমাদের উদ্দেশ্য হচ্ছে দুনিয়ার মজাও নিবো আখিরাতের মজাও নিবো। যা কখনোই ইসলাম সমর্থন করে না। এই মজা নেওয়া শ্রেণীর মুসলমানদের জন্যই হচ্ছে পীর মাজারের সুপারিশ। তা না হলে পীর মাজার থেকে যদি ইসলামের পরিপূর্ণ শিক্ষা দেওয়া হয় তবে আল্লাহ নিজেই তাঁর বান্দার জন্য যথেষ্ট। তারপরও যেহেতু আল্লাহ্ সুযোগ রেখেছেন সৎকর্মশীলদের সুপারিশ করার, সেহেতু আমরা আশা রাখতে পারি যারা পরিপূর্ণ ঈমানের দাবি করি তারা। যদি ঈমান ই না থাকে তবে স্বয়ং আল্লাহও কাউকে জান্নাত দিতে পারেন না।
এর আগে এটা প্রমাণিত হয়েছে যে পীরের দরবার এবং মাজারে কীভাবে ঈমান ধ্বংসের কার্যক্রম চলছে। যেখানে ঈমান ই থাকার সম্ভাবনা নেই সেখান থেকে কীভাবে আমরা আখিরাতের সুপারিশ আশা করতে পারি?
৪) মান্নত পূরণ
আমাদের উপমহাদেশের পীর বা মাজারে যাওয়ার আরেকটি বড় কারণ হলো মান্নত পূরণের জন্য। আমাদের বদ্ধমূল বিশ্বাস যে পীরের কাছে বা মাজারে গিয়ে মান্নত করলেই আল্লাহ্ বোধহয় সব কবুল করে নেন। কিন্তু বাস্তবে বিষয়টি কখনোই এমন নয়। কিন্তু অনেকেই এই বিষয়টি বিশ্বাস করেন না। তাই এখন আমরা মান্নত নিয়ে কিছু জানবো।
মানত কি?
মানত বা মান্নত আমাদের সমাজে বহুল প্রচলিত একটি শব্দ। সাধারণত আমরা কোনো উদ্দেশ্য লাভের জন্য মান্নত করে থাকি। অনেকে আছে উদ্দেশ্য ছাড়াও মান্নত করেন।
মানত কাকে বলে?
আমরা বাংলাতে বলি মানত । আরবিতে বলা হয় نذر (নযর) বহুবচনে নুযুর। মানত বা নযরের আভিধানিক অর্থ হল, নিজের দায়িত্বে নেয়া। যা নিজের দায়িত্ব নয় তা অপরিহার্য করে নেয়া।
শরয়ি পরিভাষায় মানত বলা হয়: নিজের উপর এমন কিছু ওয়াজিব (আবশ্যিক) করে নেয়া যা আসলে ওয়াজিব ছিল না। সেটা শর্তযুক্তও হতে পারে আবার শর্ত মুক্তও হতে পারে।
মানতের হুকুম
মানত করার বিধান কি? ফরজ, ওয়াজিব, সুন্নাত না মুস্তাহাব?
আসলে মানত করা ঠিক নয়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মানত করতে নিষেধ করেছেন। তিনি এ ব্যাপারে সব সময় উম্মতদের নিরুৎসাহিত করেছেন। বিষয়টি আমরা অনেকেই জানি না। বরং মনে করি মানত করা খুব সওয়াবের কাজ। আসলে এটি কোনো সওয়াবের কাজ নয়। বরং মাকরূহ। অধিকাংশ ইমাম ও ফেকাহবিদের অভিমত এটাই। কারণ, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মানত করতে নিষেধ করেছেন।
মানত করা নিষেধ
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মানত করতে নিষেধ করেছেন। হাদীসে এসেছে : আব্দুল্লাহ ইবনে উমার রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেছেন: ‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একদিন আমাদের মানত করতে নিষেধ করেছেন। আর বলেছেন: মানত কোনো কিছুকে ফেরাতে পারে না। তবে মানতের মাধ্যমে কৃপণ ব্যক্তির সম্পদ বের করা হয়।‘ (সহিহ মুসলিম, হাদীস নং ৪৩২৫)
ইবনু উমার রা. থেকে বর্ণিত, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: ‘মানত কোনো কিছুকে আগেও করে না, পিছেও করে না। বরং এর দ্বারা কেবল কৃপণ ব্যক্তি থেকে বের করা হয়।‘ (সহিহ মুসলিম, হাদীস নং ৪৩২৬, সহিহ সুনান নাসায়ি)
ইবনু উমার রা. থেকে বর্ণিত, ‘নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মানত করতে নিষেধ করেছেন। আর বলেছেন: মানত কোনো কল্যাণ বয়ে আনে না। এটা শুধু কৃপণ ব্যক্তি থেকে মাল খসায়।‘ (সহিহ মুসলিম, হাদীস নং ৪৩২৭, আহমাদ)
আবু হুরাইরা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: ‘তোমরা মানত করবে না। কেননা মানত তাকদীরের কোনো কিছু-কে ফেরাতে পারে না। এটা শুধু কৃপণ থেকে সম্পদ খসায়।‘ (সহিহ বুখারি ও মুসলিম, হাদীস নং ৪৩২৯, সহিহ সুনান তিরমিজি, সহিহ সুনান নাসায়ি)
সাহবি আবু হুরাইরা রা. থেকে বর্ণিত, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: ‘যেই বস্তু মহান আল্লাহ আদম সন্তানের জন্য নির্ধারণ করেননি মানত সেটি তার নিকটবর্তী করে না। বরং তাকদীরে যা আছে মানত সেটাই নিয়ে আসে। এর মাধ্যমে কৃপণ ব্যক্তির সম্পদ বের করা হয় যা সে খরচ করতে চায়নি।‘ (সহিহ মুসলিম, হাদীস নং ৪৩৩১)
উদ্ধৃত হাদীসগুলো থেকে আমরা জানতে পারলামঃ
এক. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মানত করতে নিষেধ করেছেন। অতএব মানত করা ঠিক নয়। আমরা অনেকে বিপদ-আপদে পতিত হলে মানত করে থাকি। আর মনে করি এটা সওয়াবের কাজ। আল্লাহ খুশী হবেন। কিন্তু আসলে তা সওয়াবের কাজ নয়। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যা করতে নিষেধ করেছেন তাতে আল্লাহ খুশী হবেন না। এবং এতে কোনো সওয়াবও হয় না। তাই আমাদের উচিত হবে কোনো অবস্থায় মানত না করা। অবশ্য মানত করে ফেললে তা পালন করতেই হবে কারণ মানত করলে তা পূর্ণ করা ওয়াজিব হয়ে যায়।
দুই. মানত করার মাধ্যমে কৃপণ ব্যক্তির সম্পদ বের করা হয়। এ কথা বলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বুঝিয়েছেন, মানত করা একটি অনর্থক কাজ। সাধারণত কৃপণ স্বভাবের লোকেরা মানত করে থাকে। তারা সুস্থ ও নিরাপদ থাকা কালে দান-সদকা করে না। কিন্তু বিপদে পড়লে আল্লাহর পথে খরচ বা দান সদকা করার বড় বড় মানত করে।
তিন. তাকদীরে যা লেখা আছে তা হবেই। মানত করার মাধ্যমে তাকদীরের লেখা পরিবর্তন করা যায় না। তাকদীরের প্রতি যাদের যথাযথ ঈমান নেই সাধারণত তারাই মানত করে থাকে।
চার. মানত করা হোক বা না হোক। ফলাফল একই হবে। তাকদীরে যা লেখা আছে সেটাই আসবে অবধারিতভাবে।
পাঁচ. আলোচিত সবগুলো হাদীসই মানত না করার জন্য মুসলিমদের-কে নিরোৎসাহিত ও নিষেধ করেছে। বলেছে, এটি কোনো ফল বয়ে আনে না বরং শুধু কৃপণের সম্পদ খরচ করায়। এ সকল বিষয় জানার পর কোনো মুসলিমের পক্ষে কোনো প্রকার মানত করা উচিত নয় ।
উপরোক্ত হাদিস থেকে আমরা বুঝতে পারলাম মানত করা ইসলামে মোটেই জায়েজ নয়। অতএব আমরা পীর বা মাজারে গিয়ে যে মান্নত করছি সেগুলো করা উচিত নয়। মান্নতের মাধ্যমে আমরা স্পষ্ট শিরিকে লিপ্ত হচ্ছি। কেননা প্রতিটি ভালো মন্দের মালিক আল্লাহ্। এখন পীর বা মাজারে গিয়ে আল্লাহর বিধানকেই পাল্টাতে আমরা সচেষ্ট হচ্ছি। আল্লাহ্ আমাদের বলেন ধৈর্য্য ধরার জন্য কিন্তু আমরা আল্লাহর উপর ধৈর্য্যহারা হয়ে পীর বা মাজারে চলে যাই মান্নত করতে। অথচ আল্লাহ্ আমাদের ভালো চান।
আল্লাহ্ বলেন আল্লাহর রাস্তায় খরচ করার জন্য। আর আমরা প্রতিনিয়ত মান্নত বা টাকা পয়সা খরচ করি পীরের দরবারে বা মাজারে দান করে। এই পীর বা মাজারে দান করা পয়সা কখনোই গরীবের উপকারে আসে না এটাই সত্য। যদি কেউ কোন এতিমখানা বা মাদ্রাসায় দান করেন তাহলেই হচ্ছে ভালো কাজ। আর আল্লাহ্ সবার আগে খরচ করতে বলেছেন নিজের পিতামাতা এবং নিকট আত্মীয়স্বজনের জন্য। কিন্তু আমাদের দেশে অধিকাংশ মানুষ নিজের আত্মীয়স্বজনকে বাদ দিয়ে পীর বা মাজারে দান সদকা করতে ব্যস্ত। যা সম্পূর্ণ ইসলাম বিরোধী।
অতএব খুব স্পষ্ট করেই দেখা যাচ্ছে যে যেসব বিষয় দিয়ে পীর মাজার জায়েজ করা হচ্ছে তার প্রতিটি পর্যায়ে রয়েছে ইসলামের বাঁধা।
অতএব এইসব বিষয় যদি ভালোভাবে বিবেচনা করি তাহলে আমরা সত্য উপলব্ধি করতে সক্ষম হবো। আমি বিভিন্ন বিষয়ের খুটিনাটি বিশ্লেষন করে "পীর " ধরা কতটুকু বৈধ এবং অবৈধ তা তুলে ধরতে চেষ্টা করেছি। এখন আপনারা নিজেরাই প্রতিটি বিষয় খুব ভালোভাবে পরীক্ষা করুন। দেখুন কোন কোন জায়গায় আমার ভুল। আমি কোন বিষয়টি ভুল উপস্থাপন করেছি। যদি আমার জানার বা বুঝার ভুল হয়ে থাকে তবে অবশ্যই আমাকে জানান। কেননা এটা আমার সম্পূর্ণ নিজস্ব একটি গবেষণা। আল্লাহ্ আমাকে যে জ্ঞান দান করেছেন সেই জ্ঞানের ভিত্তিতে এই লেখা লিখা চেষ্টা করেছি। ভুল ত্রুটি সংশোধন যোগ্য।
যেকোনো প্রয়োজনে shakawatarticle2020@gmail.com