পীর " (উপমহাদেশে পীরের বাস্তবতা) |
" পীর " (উপমহাদেশে পীরের বাস্তবতা)
পীর নিয়ে আমাদের উপমহাদেশে নানান তত্ত্ব চালু আছে। আমরা কেউ এইসব তত্ত্বের বাইরে নই। যে যাই বলুক আমি নিজে যেমন পীর বিশ্বাস করি তেমন ক্ষেত্র বিশেষে পীরতন্ত্রকে অপছন্দও করি।
পীর বিষয়ক এই গবেষণায় আমি চেষ্টা করব পীর সামগ্রিক যত কিছু আছে তা স্পষ্ট করে তুলে আনার জন্য। আমার ভুলও হতে পারে। যদি হয় তবে সুন্দর উপদেশের মাধ্যমে আমাকে সত্য পথ চেনাতে সাহায্য করবেন আশাকরি।
আমার বিশেষ অনুরোধ এই গবেষণামূলক লেখাটা সম্পূর্ণ পড়ে শেষ করবেন। যদি শেষ করতে পারেন তবে বুঝতে হবে আল্লাহ্ অবশ্যই আপনার উপর সন্তুষ্ট। কেননা আল্লাহ্ তাকেই ইসলামের জ্ঞান অর্জনে সহায়তায় করেন যাকে তিনি পছন্দ করেন। এই লেখাটা হয়তো আপনার আমার নাজাতের মাধ্যমও হতে পারে।
আরও পড়ুন মাজারে দান সদকা করার ইসলামী বিধান
পীর শব্দের অর্থ
পীর শব্দটি ফার্সি। আরবিতে বলা হয়ে থাকে মুর্শিদ। এই শব্দ দুটি বাংলা করলে যা দাঁড়ায় পথপ্রদর্শক। যিনি আল্লাহর আদেশ নিষেধ আল্লাহ্ যেভাবে চান সেইভাবে পালন করার প্রশিক্ষণ দেন তার নাম মুর্শিদ বা পথপ্রদর্শক কিংবা পীর।
মুরিদ শব্দের অর্থ
পীর শব্দ ফার্সি হলেও মুরিদ শব্দটি কিন্তু আরবি। যার সহজ বাংলা হলো -ইচ্ছাপোষণকারী। যে ব্যক্তি আল্লাহর আদেশ নিষেধ আল্লাহ্ যেভাবে চান সেইভাবে পালন করার ইচ্ছা পোষণ করে কোন পথপ্রদর্শক, শিক্ষক, উস্তাদ বা ইসলামী প্রশিক্ষককের হাত ধরে তাকে বলা হচ্ছে মুরিদ।
সোজা কথায় যিনি শরীয়তের আদেশ নিষেধ পালন করার প্রশিক্ষণ দেন তিনি হচ্ছেন "পীর "। আর যারা সেই প্রশিক্ষকের কাছ থেকে ইসলামী শিক্ষা গ্রহণ করেন তারা হচ্ছেন "মুরিদ "।
পীরবাদীদের সংজ্ঞা
যারা পীরতন্ত্রে বিশ্বাসী তাদের মতে "পীর "হচ্ছেন এমন একজন প্রদর্শক, যার দেখানো পথে চললে আল্লাহর দেখা পাওয়া যায়। অর্থাৎ পীরের নির্দেশিত পথে চললে জান্নাত পাওয়া যাবে।
একটা কথা আমাদের জানা রাখা দরকার যে " পীর " শব্দটি যেহেতু ফার্সি সেহেতু পবিত্র কুরআন, হাদীসের কোথাও নেই এবং থাকার কথাও নয়। তবে যারা "পীর "কে প্রতিষ্ঠিত করতে চান তারা কুরআনের বিভিন্ন শব্দ যেমন - অলি, আউলিয়া, মুর্শিদ, ইমাম, ছিদ্দিকীন ইত্যাদি শব্দের দ্বারা পীরের প্রতিশব্দ হিসেবে ব্যবহার করেন।
আরও পড়ুন কবর পাকা করার দলিল খন্ডন
উপমহাদেশে পীর -মুরিদ
আমরা একটু সহজ ভাবে এই বিষয় গুলো আলোচনা করবো। আমি নিজে স্বীকার করি যে, ইসলাম সম্পর্কে জানতে হলে অবশ্যই একজন না একজন বা একাধিক অভিজ্ঞ ইসলামী জ্ঞানীর সংস্পর্শে আসতে হবে। একজন ভালো প্রশিক্ষক ছাড়া কখনোই কোনো কিছু যেমন নিজে নিজে অর্জন করা যায়না। ঠিক তেমনি একজন ইসলামী জ্ঞানীর সংস্পর্শ ছাড়া কেউ ইসলামকে পরিপূর্ণ ভাবে বুঝতে পারবে না। আমরা যে জ্ঞানীর কথা বলছি, সেই জ্ঞানীকে আমাদের উপমহাদেশে বলা হচ্ছে "পীর "। কিন্তু আমাদের সমাজে জ্ঞান অর্জনের হাতিয়ার হিসাবে কতটুকু এই "পীর - মুরিদ "সম্পর্ক প্রতিফলিত হয়? পীর - মুরিদের যে বিষয়টা কুরআন ও হাদীস দ্বারা প্রমাণিত সেই বিষয় গুলো আমাদের উপমহাদেশে সম্পূর্ণ অনুপস্থিত।
কেন পীর ধরতে হয়
আমাদের পীর ধরতে বা মানতে বলা হয়। কারণ আমরা আল্লাহ্ কে ভয় করি। যেহেতু আমাদেরকে একশ্রেণির মানুষ আশ্বস্ত করেছে যে, আল্লাহ্ কে পেতে হলে পীর মানতে হবে। কাল কিয়ামতের ময়দানে আপনাকে উদ্ধার পেতে হলে পীর অবশ্যই ধরা লাগবে। সেকারনে আমরা "পীর "একটি শক্ত খুঁটি মনে করি। ইসলামের খুঁটি হচ্ছে পাঁচটি। কিন্তু উপমহাদেশে ইসলামের খুঁটি মনে করা হয় ছয়টি। কেননা যার পীর নেই তার পীর শয়তান!!! এমন কথাও বলা হয়। এখন কথা হচ্ছে আসলেই এইসব বিষয় কতটুকু সত্য? সেটা জানার জন্য আমাদের আরও গভীরে চিন্তা ভাবনা করতে হবে।
আরও পড়ুন সুফি সুন্নিদের পীর আউলিয়া সম্পর্কিত আকিদার জবাব
পীর - মুরিদের বাস্তবতা
আমাদের দেশে পীর মুরিদের যে সংজ্ঞা দেওয়া হয়(অর্থাৎ পীর - মুরিদ নিয়ে যা চলে) তা কুরআন এবং হাদিসের শক্তিশালী দলিল দ্বারা সুস্পষ্ট ভাবে প্রমাণিত নয় (পীরের দলিল নিয়ে আলোচনা পরের অংশে হবে)। এই কথা শুনে অনেকই এই লেখাটি পড়া বন্ধ করে দিতে পারেন। কিন্তু সত্যিকারের ইসলাম পালন করতে হলে অবশ্যই আপনাকে ইসলাম কী সেটা জানতে হবে। আমরা যারা মুসলিম এটা কোনো পৈত্রিক পরিচয় নয়। মুসলিম হতে হলে জেনে শুনে বুঝেই মুসলিম তথা ইসলাম কে কবুল করতে হবে। যা আমরা অধিকাংশ মানুষই করি না। হাজার হাজার পীরের দরবারে লক্ষ কোটি মুরিদ রয়েছে। কিন্তু তাদের শতকরা ১ ভাগও সত্যিকারের ইসলামকে যাচাই করেছে কিনা সন্দেহ।
প্রকৃত ইসলামকে জানুন
আসুন আমরা "পীর -মুরিদ " জানার আগে সঠিক ইসলামকে জানার চেষ্টা করি। আর ইসলামের মূল স্তম্ভ হলো পবিত্র কুরআন। আপনি যদি পবিত্র কুরআন একবার নিজের ভাষায় পড়ে বুঝতে চেষ্টা করলে খুব সহজেই অনেক কিছু আপনার কাছে পরিষ্কার হয়ে যাবে। এখন অনেকেই বলার চেষ্টা করবেন যে নিজে নিজে কীভাবে কুরআন বুঝবো? কুরআন বুঝতে হলে উস্তাদ লাগবে। এটা সম্পূর্ণ আল্লাহ্ বিরোধী কথা। যদি আপনি আপনার ভাষায় কুরআন পড়ে সাধারণ ভাবে যতটুকু বুঝা উচিত, ততটুকু বুঝতে না পারেন তবে আল্লাহ্ কেন বললো - আমি কুরআন কে খুলে খুলে বর্ণনা করেছি। আল্লাহ্ সবকিছু সহজ ভাবেই বর্ণনা করেছেন যাতে তাঁর বান্দারা সঠিকভাবে আল্লাহ্ কে চিনতে পারে। তবে হ্যাঁ কুরআনের আইনকানুন বুঝতে হলে শরীয়তের বিভিন্ন মাসালা - মাসায়েল বুঝতে হলে অবশ্যই একজন প্রকৃত জ্ঞানী তথা আলেম, ওলামা, শিক্ষক, প্রশিক্ষক বা পীর যাই বলুন তাঁর কাছে যেতে হবে।
আরও পড়ুন সুফিবাদ কী? কীভাবে উৎপত্তি এবং বর্তমান অবস্থা
কিন্তু সহজ বাংলায় যখন কুরআন বুঝতে চেষ্টা করবেন তখন আপনি ইসলামের মৌলিক বিষয় গুলো খুব সহজেই বুঝতে পারবেন। আর ইসলামের জ্ঞান অর্জন করা প্রতিটি মানুষের উপর ফরজ। আমরা যদি নিজেদের মুসলিম দাবি করি তাহলে অবশ্যই আমাদের কুরআন জানতে হবে। এই কুরআন জানা মানে কুরআন হেফজ করা বা আরবিতে রিডিং পড়ে খতম করা নয়। কুরআন জানা হচ্ছে আল্লাহ্ কুরআনে কি দিয়েছেন আমাদের জন্য সেটাই জানা। আমি শতভাগ নিশ্চিত আমাদের উপমহাদেশে সাধারণ যারা মুসলিম তারা তো নয় - ই বরং অনেক ইসলামী শিক্ষায় পড়াশোনা করেও পবিত্র কুরআনের তরজমা তাফসীর পড়েছে কিনা সন্দেহ। এই উপমহাদেশের মুসলিমদের দূর্বলতা এক জায়গায়। তারা ইসলাম পালন করে মানুষের মুখের কথায়। কখনোই কিছু যাচাই করে দেখার চেষ্টা করে না আসলেই এর গভীরে কী আছে।
পীরের দরবারে যেতে হলে
প্রতিটি মুসলিমের জ্ঞান ইসলামী অর্জন ফরজ। এই জ্ঞান অর্জন করার জন্য বা ইসলামের প্রশিক্ষণ নিতে কেউ আলেম উলামা তথা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা পদ্ধতির মাদ্রাসায় পড়তে পারে। কিংবা ভালো একজন পরহেজগার বুজুর্গ, বা সাধারণ ভাষায় পীরের কাছে যেতে পারে। এই দুই জায়গায়ই হচ্ছে জ্ঞান অর্জনের প্রকৃত ক্ষেত্র। আপনি মাদ্রাসায় গেলে যেমন ইসলাম সম্পর্কে জানতে পারবেন, ঠিক তেমনি একজন আল্লাহ্ ওয়ালা ইসলামী জ্ঞানী ব্যক্তির কাছ থেকেও ইসলামের শিক্ষা নিতে পারেন।
যদি আপনি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় যান তবে সেখান সবকিছু আপনি স্পষ্ট ই দেখতে পারবেন ইসলাম কী। আর যদি অপ্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় যান অর্থাৎ পীরের দরবারে তাহলে আপনাকে ইসলামের মূল বিষয় তথা কুরআন জেনেই যাওয়া উচিত। কেননা আপনি ইসলামের কিছুই জানেন না তাহলে যে পীরের দরবারে গেলেন, সেখানে সঠিক ইসলাম না থাকলে আপনি পরকাল হারিয়ে ফেলবেন নিশ্চিত ভাবেই। কারণ আল্লাহ্ আপনাকে জ্ঞান দিয়েছেন সঠিক বিষয় যাচাই বাছাই করার। আপনি দুনিয়ায় একটা জমি কিনলেও হাজার যাচাই বাছাই করে দেখেন। এখন আখিরাতের বিষয়ে কেন যাচাই বাছাই করবেন না? এই যাচাই বাছাই বিশ্লেষণ অবশ্যই কুরআনের ভিত্তিতে হতে হবে। তাই কুরআনটা আপনার জানতে অর্থাৎ পড়তে হবে।
আরও পড়ুন উছিলা কী? উছিলার বিস্তারিত ব্যাখ্যা
আপনি কোনো পীরের দরবারে গেলেন কিন্তু সেখানে কুরআন হাদীসের চর্চা নেই। অথচ আপনি ভালো নিয়ত করে গেছেন। হাদীসে এসেছে কেউ আল্লাহ্ কে পেতে কোথাও গেল কিন্তু যেখানে আল্লাহ্ ও তাঁর রাসুলের (সাঃ) চর্চা নেই, তাহলে আল্লাহ্ নিজেই তার জন্য একজন শয়তান ঠিক করে দেন। তাই আমাদের সঠিক জ্ঞানী চিহ্নিত করতে যাচাই বাছাই করতে হবে।
এখানে আমি পীরের বিরোধিতা করছি না। আমাদের দেশে পীর শব্দের যে ব্যাখ্যা দেওয়া হচ্ছে যেটা কখনোই সঠিক নয়। এই উপমহাদেশের সাধারণ মুসলিমরা খুবই কম ইসলাম সচেতন। তাদের এই দূর্বলতা কাজে লাগাচ্ছে একশ্রেণির প্রতারক। যদি কোনো দরবার বলে এখানে ইসলামের দরস দেওয়া হয় তাহলে সেখানে যাওয়া অবৈধ নয়। কিন্তু আমরা কি এমন দরবার দেখছি? যেখানে শুধু জ্ঞান অর্জনের দরবার খোলা হয়েছে?
কিন্তু আসল সত্যি হলো আমাদের উপমহাদেশে এমন দরবার নেই বললেও চলে। থাকলেও তা হাতেগোনা। যার খবর অধিকাংশ মানুষ জানে না। কারণ হাক্কানী পীরের দরবারে ব্যবসা হয় না। বরং নিজেদের টাকা পয়সা খরচ করে দরবার চালাতে হয়। অতএব সেইসব ৪৮ হাজার তথাকথিত পীরের দরবারে লক্ষ কোটি মুরিদ নিয়ে যা হয় তা কখনোই ইসলাম সমর্থন করে না।
সাখাওয়াতুল আলম চৌধুরী
রাউজান, চট্টগ্রাম।