অলী-আওলীয়াদের আহবান ও উদ্ধারঃ
সুফিদের প্রবল বিশ্বাস যে, তাদের যেকোনো বিপদে অলি আউলিয়ারা তাদের সাহায্য করার ক্ষমতা রাখে এবং সাহায্য করে। তাই তারা যেকোন বিপদে বা সাহায্যের প্রয়োজন হলে আল্লাহ্কে বাদ দিয়ে, ইয়া জিলানী, ইয়া গাউসুল আযম, ইয়া আলী, ইয়া খাজা ইত্যাদি নামে অলি আউলিয়াদের ডেকে থাকে ।
অথচ আল্লাহ তাআলা তাঁকে ছাড়া অন্যেকে ডাকতে করতে নিষেধ করেছেন। সুতরাং কোনো ব্যক্তি যে কাজ আল্লাহ্র সেই কাজের জন্য আল্লাহ্ ছাড়া অন্যের কাছে সাহায্যের প্রার্থনা করবে, সে মুশরিক হিসেবে গণ্য হবে।
আল্লাহ তাআলা বলেনঃ
‘‘তুমি আল্লাহ ব্যতীত এমন বস্তুকে ডাকবে না যে তোমার উপকার কিংবা ক্ষতি কোনটিই করতে পারে না। যদি তুমি তাই কর তবে তুমি নিশ্চিত ভাবেই জালেমদের মধ্যে গন্য হবে। (সূরা ইউনুসঃ ১০৬)।
আল্লাহ তাআলা আরও বলেনঃ
‘‘এবং ঐ ব্যক্তির চেয়ে আর কে বেশী পথভ্রষ্ট যে আল্লাহ ব্যতীত এমন ব্যক্তিদেরকে আহবান করে যারা কিয়ামত পর্যন্ত তার ডাকে সাড়া দিবে না এবং তারা তাদের ঐ আহবান থেকে সম্পূর্ণ বেখবর রয়েছে? (সূরা আহকাফঃ ৫)
তাবলীগি নেসাব ফাযায়েলে আমাল বইয়ে এই ধরণের একটি ঘটনা উল্লেখ আছে। যেখানে বলা হচ্ছে, একজন ব্যক্তি প্রয়োজনে কোথাও যাওয়ার পথে নদী পড়লো। কিন্তু নদী ছিলো উত্তাল। তাই কোনো নৌকাও যাচ্ছিল না। তখন সেখানকার লোকেরা তাকে একজন কামেল মানুষের সন্ধান দিল। যিনি দোয়া করলে নদী শান্ত হয়ে যাবে। তখন ঐ ব্যক্তি সেই কামেল বুজুর্গের কাছে গেলো। এবং তার কথামত নদীও শান্ত হলো। তিনি নদী পার হলেন। তিনি পার হওয়ার পর নদী সেই আগের ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করলো। (ফাযায়েলে আমাল, দ্বিতীয় খন্ড, ১৬২ পৃষ্ঠা)
এখানে সাধারণ মানুষের বিশ্বাস নিয়ে বুজুর্গের যে কারামতের কথা বর্নণা করা হলো। সেই বিশ্বাস মক্কার মুশরিকরাও পোষণ করতো না। তারা যখন সাগর পথে ভ্রমণ করার সময় বিপদে আক্রান্ত হত, তখন তারা সকল দেব-দেবীর কথা ভুলে গিয়ে বিপদ থেকে উদ্ধারের জন্য একমাত্র আল্লাহকেই ডাকতো। আল্লাহ তাআলা মক্কার মুশরিকদের সেই কথা কুরআনে উল্লেখ করে বলেন,
‘‘তারা যখন জলযানে আরোহণ করে তখন একনিষ্ঠভাবে আল্লাহ্কে ডাকে। অতঃপর তিনি যখন স্থলে এনে তাদেরকে উদ্ধার করেন, তখনই তারা শরীক করতে থাকে।’’ (সূরা আনকাবুতঃ ৬৫)
অথচ সুফিদের বিশ্বাস চরম বিপদের সময় আল্লাহকে বাদ দিয়ে কথিত পীর আওলীয়াদেরকে আহবান করা। যা মক্কার তৎকালীন কাফের মুশরিকদের শির্ককেও হার মানিয়েছে। কেননা মক্কার লোকেরা শুধু সুখের সময়ই আল্লাহর সাথে অন্যকে শরীক করতো, কিন্তু বিপদের সময় তারা সেগুলোকে ভুলে গিয়ে একমাত্র আল্লাহকেই ডাকতো।
আর সুফিবাদীরা সুখে দুঃখে উভয় অবস্থাতেই আল্লাহর সাথে শির্ক করছে। এদিক থেকে মূল্যায়ন করলে দেখা যায় যে বর্তমান সুফিবাদীদের শির্কের চেয়ে মক্কার আবু জাহেল, আবু লাহাবদের শির্ক অধিক হালকা ছিল। মোটকথা মক্কার মুশরিকদের তাওহীদে রুবুবীয়া সম্পর্কে যে অগাধ বিশ্বাস ছিল তা উল্লেখ করে আল্লাহ তাআলা বলেনঃ
" হে নবী! আপনি জিজ্ঞেস করুন, তোমাদেরকে আসমান থেকে ও যমীন থেকে কে রুযী দান করেন? কিংবা কে তোমাদের কান ও চোখের মালিক? তাছাড়া কে জীবিতকে মৃতের ভেতর থেকে বের করেন এবং কেইবা মৃতকে জীবিতের মধ্য থেকে বের করেন? কে করেন কর্ম সম্পাদনের ব্যবস্থাপনা? তখন তারা বলে উঠবে, আল্লাহ! তখন তুমি বলো, তারপরেও ভয় করছ না? " (সূরা ইউনুসঃ ৩১)
মোটকথা মক্কার মুশরিকদের যে ঈমান ছিলো, সেই ঈমান পর্যন্ত সুফিদের নেই! এখানে বিশেষভাবে স্মরণ রাখা দরকার যে, গাউস অর্থ হচ্ছে ত্রাণকর্তা বা উদ্ধারকারী। এটি একটি আল্লাহর গুণ। কোন মানুষ গাউছ হতে পারে না। আল-গাউছুল আল-আযাম অর্থ হচ্ছে মহান ত্রাণকর্তা।
সুফিরা আব্দুল কাদের জিলানী (রঃ)কে মহা ত্রাণকর্তা হিসেবে বিশ্বাস করেন। তারা এই বিশ্বাস রেখে কি এ ধরণের কথার মাধ্যমে আব্দুল কাদের জিলানী (রঃ)কে আল্লাহর সমান করে দেন নি? শুধু তাই নয় সুফীদের বিশ্বাস যে, আব্দুল কাদের জিলানী নিজ হাতে লাওহে মাহফুযে নতুন করে বৃদ্ধি করতে বা তা থেকে কিছু কমানোরও অধিকার রাখেন (নাঊজুবিল্লাহ)।
আল্লাহ তাআলা বলেন,
‘‘আর যদি আল্লাহ তোমাকে কোন কষ্ট দেন, তবে তিনি ব্যতীত তা অপসারণকারী কেউ নাই। পক্ষান্তরে যদি তোমার মঙ্গল করেন, তবে তিনি সবকিছুর ওপর ক্ষমতাবান’’। (সূরা আনআমঃ ১৭)
আল্লাহ্ তাআলা আরও বলেন,
" (হে রাসুল) আপনি বলে দিন, আমি আমার নিজের কল্যাণ সাধনের এবং অকল্যাণ সাধনের মালিক নই, কিন্তু যা আল্লাহ্ চান। আর আমি যদি গায়বের কথা জেনে নিতে পারতাম, তাহলে বহু মঙ্গল অর্জন করে নিতে পারতাম। ফলে আমার কোন অমঙ্গল কখনও হতে পারত না। আমি তো শুধু একজন ভীতিপ্রদর্শক ও সুসংবাদাতা ঈমানদারদের জন্য। "(সূরা আ’রাফঃ ১৮৮)
উপরোক্ত আয়াত থেকে এটা সুস্পষ্ট যে আল্লাহ্ যদি কাউকে কষ্ট দিতে চান তাহলে তাকে উদ্ধারকারী আল্লাহ্ ছাড়া আর কেউ নন। আর একইভাবে কারো মঙ্গল করার মালিক আল্লাহ্। শুধু তাইনয় আল্লাহ্ রাসুল কে দিয়ে এটা আমাদের শিক্ষা দিচ্ছেন যে, তিনি রাসুলও কোনো ক্ষমতার মালিক নন যদি আল্লাহ্ না চান। অর্থাৎ আল্লাহ্ চাইলে তবেই রাসুল নিজের ভালো করতে পারেন। আল্লাহ্ ছাড়া তাঁরও কোনো কিছু করার একক নিজস্ব ক্ষমতা নেই।
যেখানে আল্লাহ্ আমাদের রাসুলকে দিয়ে শিক্ষা দিচ্ছেন যে, একমাত্র আল্লাহ্ই যেকোনো ভালো মন্দ ইত্যাদির সবকিছুর মালিক। যেখানে সুফিরা কীভাবে দাবি করতে পারে তাদের পীর আউলিয়ারা আল্লাহর বান্দাদের ভালো মন্দ উপকার-অপকার, লাভ - ক্ষতি ইত্যাদি করতে পারেন?
সুফিদের দ্বারা আল্লাহর কেবিনেটঃ
সুফিদের মতে, রাসুল সাঃ এর সাথে ওলী-আওলিয়ারাও দুনিয়া পরিচালনার কাজে সম্পৃক্ত রয়েছেন। আহমাদ রেযা খান লিখেছেন, ‘ হে গাওছ (আব্দুল কাদের জিলানী)! ‘কুন’-বলার ক্ষমতা লাভ করেছেন মুহাম্মাদ (ছাঃ) তাঁর প্রভুর কাছ থেকে, আর আপনি লাভ করেছেন মুহাম্মাদ (ছাঃ) থেকে। আপনার কাছ থেকে যা-ই প্রকাশিত হয়েছে তা-ই দুনিয়া পরিচালনায় আপনার ক্ষমতা প্রমাণ করেছে। পর্দার আড়াল থেকে আপনিই আসল কারিগর।’
সুফিরা বিশ্বাস করে যে, আল্লাহ যেহেতু একা, সেহেতু একাই তাঁর পক্ষে পুরো বিশ্বজগত পরিচালনা করা সম্ভব নয়। ফলে তিনি তাঁর বিশ্ব পরিচালনার সুবিধার্থে আরশে মু‘আল্লায় একটি পার্লামেন্ট কায়েম করেছেন।
সেই পার্লামেন্টের সদস্য সংখ্যা মোট ৪৪১ জন। আল্লাহ তাদের স্ব স্ব কাজ বুঝিয়ে দিয়েছেন। তন্মধ্যে নাজীব ৩১৯ জন, নাক্বীব ৭০ জন, আবদাল ৪০ জন, আওতাদ ৭ জন, কুতুব ৫ জন এবং একজন হলেন গাওছুল আযম, যিনি মক্কায় থাকেন। উম্মতের মধ্যে আবদাল ৪০ জন আল্লাহ তা‘আলার মধ্যস্থতায় পৃথিবীবাসীর বিপদাপদ দূরীভূত করে থাকেন। তারা অলীগণের দ্বারা সৃষ্টজীবের হায়াত, রুযী, সন্তান, ছেলে অথবা মেয়ে দান, বৃষ্টি, বৃক্ষ জন্মানো ও মুসিবত বিদূরণের কাজ সম্পাদন করেন।
সুফিদের এই আকিদার পক্ষে কুরআন ও সহীহ্ হাদিসের কোনো দলিল নেই। বিশ্বজগত পরিচালনার জন্য আল্লাহর কারো নিকট থেকে সাহায্য নিতে হয় না।
আল্লাহ্ বলেন,
" তিনি (আল্লাহ্) আকাশ থেকে পৃথিবী পর্যন্ত সমস্ত কর্ম পরিচালনা করেন।" (সূরা সাজদা: ৫)
মহান আল্লাহ আকাশ থেকে পৃথিবী পর্যন্ত সমস্ত কাজ নিজেই পরিচালনা করেন। তিনিই সকলের একমাত্র ত্রান কর্তা। অথচ সুফিগণ আব্দুল কাদের জিলানী (রঃ)কে মহা ত্রাণকর্তা হিসেবে বিশ্বাস করেন। তার নাম রেখেছেন গাউছুল আযম। আল-গাউছুল আল-আযাম অর্থ হচ্ছে মহান ত্রাণকর্তা। তাদের বিভিন্ন আলেমদরে মুখে আব্দুল কাদের জিলানী এমন সব আজগুবি গল্প শোনা যায় যাতে সকলেই এটা মনে করে যে তিনি আসলেই সবচেয়ে বড় ত্রানকর্তা।
যেমন অনেকে বিশ্বাস করে, বড় পীর আব্দুল কাদের জিলানী নিজ হাতে লাওহে মাহফুযে নতুন করে বৃদ্ধি করতে বা তা থেকে কিছু কমানোরও অধিকার রাখেন। (নাউযুবিল্লাহ) অথচ রাসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুগে মক্কার মুশরিকরাও বিশ্বাস করত দুনিয়া পরিচালনার কাজে আল্লাহ্ ছাড়া কেউ সম্পৃক্ত নেই।
আল্লাহ রব্বুল আলামিন বলেন,
" তাদেরকে জিজ্ঞেস করো, “কে তোমাদের আকাশ ও পৃথিবী থেকে রিযিক দেয়? এই শুনার ও দেখার শক্তি কার কর্তৃত্বে আছে ? কে প্রাণহীন থেকে সজীবকে এবং সজীব থেকে প্রাণহীনকে বের করে? কে চালাচ্ছে এই বিশ্ব ব্যবস্থাপনা”? তারা নিশ্চয়ই বলবে, আল্লাহ৷ বলো, তবুও কি তোমরা বিরোধী পথে চলার ব্যাপারে সতর্ক হচ্ছোনা? (সুরা ইউনুস ৩১)।
এখানে সুস্পষ্ট যে, আল্লাহর কোনো কেবিনেট নয় বরং আল্লাহ্ নিজেই সমস্ত কিছু পরিচালনা করছেন। সেখানে সুফিদের কল্পিত কেবিনেটের কোনো দৃষ্টান্ত কুরআনের কোথাও নেই।
শুধু তাইনয় যারা কেবিনেটের সদস্য তারা নিজেরাই আল্লাহর কাছে নৈকট্যলাভের উপায় খুঁজে বেড়াচ্ছে। যেমন, আল্লাহ তাআলা বলেন,
"এরা যাদেরকে (অলি আউলিয়া) ডাকে তারা তো নিজেরাই নিজেদের রবের নৈকট্যলাভের উপায় খুঁজে বেড়াচ্ছে যে, কে তাঁর নিকটতর হয়ে যাবে এবং এরা তাঁর রহমতের প্রত্যাশী এবং তাঁর শাস্তির ভয়ে ভীত। আসলে তোমার রবের শাস্তি ভয় করার মতো৷" (সুরা বনী ইসরাঈল ১৭:৫৭)।
সুতরাং দুনিয়া পরিচালনার জন্য আল্লাহর কোন গোপন কেবিনেট নেই। যদি কেউ এমন মনে করে তাহলে তা সুস্পষ্ট শিরক।
পীরকে সেজদাঃ
সুফি সুন্নীদের আকিদা হলো তাদের পীর আউলিয়াদের সরাসরি সেজদা করা জায়েজ। তাদের দাবি এটা তাজিমী বা সম্মানসূচক সেজদা। যে সেজদা ফেরেশতারা হযরত আদম আঃ কে, ইউসুফ আঃ কে তাঁর পরিবারবর্গ দিয়েছিল। যদিও এই দুটি ঘটনা ইসলামের শরিয়তের বহির্ভূত। কেননা ইসলামে আল্লাহ্ ছাড়া অন্য কাউকে সেজদা করা কঠোরভাবে নিষেধ করা হয়েছে। পবিত্র কুরআনের মূল শিক্ষা হলো তাওহীদ । আর তাওহীদের দাবি হলো এক আল্লাহ্ই সমস্ত ইবাদতের মালিক। সুতরাং ইসলামে কোনো ব্যক্তি মূর্তি ভাস্কর্য ইত্যাদিকে সেজদা করা সম্পূর্ণ নিষেধ।
সুফি সুন্নীদের দাবি অনুযায়ী প্রথম সেজদার় ঘটনা ঘটেছে জান্নাতে। দ্বিতীয় ঘটনা ঘটেছে ইউসুফ আঃ এর যুগে তাঁর শরিয়ত অনুসারে। সুতরাং এই দুটি ঘটনা কখনোই রাসুলুল্লাহ সাঃ এর শরিয়তের দলিল হতে পারে না। আল্লাহ্ পবিত্র কুরআনে সুস্পষ্ট উল্লেখ করেছেন,
"নিশ্চয়ই সেজদার স্থানসমূহের মালিক আল্লাহ তাআলা। অতএব তোমরা তার সাথে কারো ইবাদত করো না।" (সুরা জিন : আয়াত ১৮)
অর্থাৎ মসজিদ হলো আল্লাহ্কে সেজদা করার স্থান। আর আল্লাহ্ ছাড়া অন্য কাউকে সেজদা করে আল্লাহ্র সাথে শরিক করে শিরক করা যাবে না। এছাড়াও এটা জায়েজ হতো যদি রাসুলুল্লাহ সাঃ এমন করার নির্দেশ দিতেন এবং সাহাবী তাবেয়ীগণ থেকে এমন আমল যদি আমরা সালফে সালেহীনদের মাধ্যমে জানতে পারতাম। অথচ আমরা হাদিসের সুন্নাহ থেকে এর বিপরীত শিক্ষা পাই। পবিত্র হাদীসে এসেছে,
ক্বায়িস ইবনু সা’দ (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, আমি (কুফার) আল-হীরা শহরে এসে দেখি, সেখানকার লোকেরা তাদের নেতাকে সিজদা করছে। আমি ভাবলাম, (তাহলে তো) রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-ই সিজদার অধিক হকদার। অতঃপর আমি নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর খেদমতে এসে বলি যে, আমি আল-হীরা শহরে গিয়ে দেখে এসেছি, সেখানকার লোকেরা তাদের নেতাকে সিজদা করে। সুতরাং হে আল্লাহ্র রাসূল! (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আপনিই তো এর অধিক হকদার যে, আমরা আপনাকে সিজদা করি?[ তিনি বললেনঃ যদি (মৃত্যুর পর) তুমি আমার ক্ববরের পাশ দিয়ে যাও তখন কি তুমি সেটাকে সিজদা করবে? আমি বললাম, না। (এই অংশ দুর্বল আল-জামি’উস সাগীর ৪৮৪২, ইরওয়া ১৯৯৮, মিশকাত ৩২৬৬)] তিনি বললেনঃ সাবধান! তোমরা এরূপ করবে না। আমি যদি কোন মানুষকে সিজদা করার অনুমতি দিতাম, তবে স্ত্রীদেরকে নির্দেশ দিতাম তাদের স্বামীদেরকে সিজদা করতে। কেননা আল্লাহ্ স্ত্রীদের উপর স্বামীদের অধিকার দিয়েছেন। (সুনানে আবু দাউদ, হাদিস নং ২১৪০)
একবার এক গ্রাম্য লোক মহানবী (সা.)-এর দরবারে হাজির হয়ে বলেছেন,
"হে আল্লাহর রাসুল, আমাকে অনুমতি দিন, আমি আপনাকে সিজদা করতে চাই। মহানবী (সা.) বলেছেন, (আল্লাহ ছাড়া কারো জন্য সিজদা করা বৈধ নয়) আমি যদি কাউকে কারো উদ্দেশে সিজদা করার নির্দেশ দিতাম, তাহলে স্ত্রীদের বলতাম তারা যেন তাদের স্বামীদের সিজদা করে।" (সুনানে দারেমি, হাদিস : ১৪৬৪)
উপরোক্ত সহীহ্ থেকে স্পষ্ট প্রমাণিত যে আল্লাহ্ ছাড়া কারো সম্মানে প্রয়োজনে কখনোই সেজদা করা জায়েজ নয়। এমনকি রাসুলুল্লাহ সাঃও কারো কাছ থেকে সেজদা গ্রহণ করেননি এবং নির্দেশও দেননি।
শুধু তাইনয় কোনো কবর বা কোনো কবরবাসীকেও সেজদা করতে রাসুলুল্লাহ সাঃ কঠোরভাবে নিষেধ করেছেন। পবিত্র হাদীসে এসেছে,
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন ‘সাবধান! তোমাদের পূর্বে যারা ছিল, তাদের নবীগণ ও সৎ ব্যক্তিদের কবরসমূহকে মসজিদ ও সেজদার স্থানে পরিণত করা হয়েছে। সাবধান! তোমরা কবরসমূহকে মসজিদ ও সেজদার স্থানে পরিণত কর না। আমি তোমাদেরকে এ থেকে নিষেধ করছি।" (মুসলিম : ১২১৬)।
হযরত আতা বিন ইয়াছার (রা) বলেন,
"রাসুল (সা.) একদা এই দোয়া করলেন ‘হে আল্লাহ! আমার কবরে প্রতিমা স্থাপন কর না যার পূজা হতে থাকবে। আল্লাহর কঠোর রোষে পতিত হয়েছে সেই জাতি যারা তাদের নবীদের কবরসমূহকে মসজিদ ও সেজদার স্থানে পরিণত করেছে।" (মুয়াত্তা মালেক : ৪১৯)।
উপরোক্ত হাদীস সমূহ থেকে স্পষ্ট প্রমাণিত যে, কখনোই কোনো কবরকে সেজদা করা যাবে না। সুতরাং যেখানে কবরকে সেজদা করা জায়েজ নেই, সেখানে পীরকে কীভাবে সেজদা করা জায়েজ হবে। অতএব, কুরআন হাদিসের আলোকে আল্লাহ্ ছাড়া কাউকে সেজদা করা যাবে না। হোক তিনি জীবিত পীর আউলিয়া বা কবরবাসী কোনো অলি আউলিয়া।
পীরের দ্বারা গুনাহ ক্ষমাঃ
আল্লাহ্ অবশ্যই তাঁর বান্দাদের গুনাহ ক্ষমা করেন। তিনি এটাই পছন্দ করেন যে, তাঁর বান্দারা গুনাহ করলে যেন তাঁর কাছে ক্ষমা চায়। এবং তিনি অবশ্যই তাদের ক্ষমা করে দিবেন। কারণ তিনি ক্ষমাশীল।
আর সুফিদের আকিদা হলো বান্দা যখন পাপ করতে করতে চরম পাপী বনে যায়, তখন আল্লাহ্ তার গুনাহ ক্ষমা করেন না। তাই ঐ গুনাহগার ব্যক্তিকে পীর ধরে সেই পীরের মধ্যস্থতায় তার উছিলা বা মাধ্যমে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইতে হবে। তাহলে আল্লাহ্ ঐ পীরের দিকে তাকিয়ে সেই পাপী বান্দাকে ক্ষমা করে দিবেন।
অথচ আল্লাহ্ বলেন,
" (হে নবী,) বলে দাও, হে আমার বান্দারা যারা নিজের আত্মার ওপর জুলুম করেছো আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না৷ নিশ্চিতভাবেই আল্লাহ সমস্ত গোনাহ মাফ করে দেন৷ তিনি ক্ষমাশীল ও দয়ালু৷ ফিরে এসো তোমারে রবের দিকে এবং তাঁর অনুগত হয়ে যাও তোমাদের ওপর আযাব আসার পূর্বেই৷ তখন কোন দিক থেকেই আর সাহায্য পাওয়া যাবে না৷ (সুরা জুমার ৩৯:৫৩-৫৪)।
আল্লাহ্ পবিত্র কুরআনে স্পষ্ট করে ঘোষণা দিচ্ছেন যে, যেকেউ যতই পাপ করুন না কেন সে যেন আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ না হয়। যত পাপই মানুষ করুক না কেন আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইলে তিনি অবশ্যই তা ক্ষমা করে দিবেন।
সুতরাং আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হওয়া কুফরি কাজ। আল্লাহ্ বলেন,
"নিশ্চয় আল্লাহর রহমত থেকে কাফের সম্প্রদায়, ব্যতীত অন্য কেউ নিরাশ হয় না।" (সূরাঃ ইউসূফ, আয়াতঃ ৮৭)
অতএব, কুরআন থেকে প্রমাণিত একমাত্র কাফিররাই আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়। শুধু তাইনয় আল্লাহ্ ছাড়া আর কারো কাছে ক্ষমা চাওয়া বা মধ্যস্ততা করা সরাসরি শির্ক। তাই সুফিদের এই বিশ্বাস সম্পূর্ণ ভুল যে পাপ করলে সেই পাপ ক্ষমা পাওয়ার জন্য মাধ্যম বা পীরের প্রয়োজন হবে।
সুফিদের অলৌকিক ক্ষমতার যৌক্তিকতাঃ
সুফিবাদীরা তাদের পীর আউলিয়াদের দুই ভাগে ভাগ করে ফেলেছে। একভাগ হচ্ছে হাক্কানী পীর আউলিয়া, অন্যটি হচ্ছে ভন্ড পীর আউলিয়া। আমরা দেখতে চেষ্টা করবো হাক্কানী পীর আউলিয়াদের অলৌকিক কাহিনী কতটুকু কুরআন হাদিসের আলোকে সত্য হতে পারে।
উপমহাদেশে যারা হক্কানী হিসাবে দাবিদার তাদের একজন হল চরমোনাই পীর। তাদের লেখা কিতাব ভেদে মারেফত বা ইয়াদে খোদা বইয়ের ১৫ পৃষ্ঠায় মৃতকে জীবিত করার একটা কাহিনী আছে। যাতে বুঝা যায়, সুফীরা বিশ্বাস করে তাদের অলীরা মৃতকে জীবিত করতে সক্ষম।
কাহিনী সংক্ষেপ হচ্ছে, শামসুদ্দীন তাব্রীজী নামে একজন পীর ছিলেন। তিনি কোথাও যাওয়ার পথে দেখলেন এক অন্ধ বৃদ্ধের নাতি মারা গেছে। বৃদ্ধের ঐ নাতি ছাড়া আর কোনো অবলম্বন না থাকার কারণে কান্নাকাটি করতে থাকে। বৃদ্ধের দুর্দশা দেখে তখন হুজুর বলিলেনঃ "হে ছেলে আমার হুকুমে দাঁড়াও"। ছেলেটি উঠে দাঁড়াল এবং দাদুকে জড়িয়ে ধরলো। বৃদ্ধ তাকে জিজ্ঞাসা করল, তুমি কীভাবে জিন্দা হয়েছ? ছেলে জবাব দিল, আল্লাহর অলি আমাকে জিন্দা করেছেন। (নাউজুবিল্লাহ)
পীর সাহেবের এই খবর যখন তৎকালীন বাদশা জানতে পারলে তিনি তাকে ডেকে পাঠান। তখন বাদশা তাকে জিজ্ঞাসা করল, আপনি কী বলে এই ছেলেকে জিন্দা করলেন? তিনি বললেন, হে ছেলে আমার আদেশে তুমি জিন্দা হয়ে যাও। তখন রাজা বললেন, আপনি যদি বলতেন, আল্লাহ্র আদেশে জিন্দা হও!
তখন হুজুর বললেন, আল্লাহ্কে কি জিজ্ঞাসা করবো? আল্লাহ্র কি আন্দাজ নাই (নাঊজুবিল্লাহ)। এই অন্ধ বৃদ্ধের এই দুর্গতিতে তার একমাত্র নাতি ছাড়া আর কোনো অবলম্বন নাই। আর সেই একমাত্র অবলম্বনকে আল্লাহ্ তুলে নিলেন। তাই আমি জোর করে আল্লাহ্র দরবার থেকে এই ছেলের রূহ নিয়ে এসেছি (নাঊজুবিল্লাহ)।
এরপর বাদশা হুজুরকে শিরক করার অপরাধে তার শরীরের চামড়া খুলে ফেলার নির্দেশ দিলেন। এই কথা শুনে হুজুর নিজেই নিজের চামড়া খুলে বাদশাকে দিয়ে জঙ্গলে চলে গেলেন।
পরদিন সকালে সূর্য উঠলে তার তাপে হুজুরের কষ্ট হলে তিনি সূর্যকে তাকে কষ্ট না দেওয়ার জন্য নির্দেশ দেন। তখন ঐ দেশের জন্য সূর্য অন্ধকার হয়ে গেল। এই অবস্থায় বাদশা পেরেশানিতে পড়ে গেল। তখন তিনি হুজুরকে খুজঁতে লাগলেন।এবং তাকে অনুরোধ করলেন তাদের কষ্ট লাঘব করার জন্য। তখন হুজুর সূর্যকে পুনরায় উঠত বললেন এবং আল্লাহ্ও হুজুরের শরীর ভালো করে দিলেন।
সুফি সুন্নীদের এই ধরনের বহু ঘটনা তাদের বই পুস্তকে বর্ণিত আছে। উক্ত বানোয়াট কাহিনীতে গভীরভাবে দৃষ্টি দিলে দেখা যায় যে এতে একাধিক শির্ক বিদ্যমান। যেমনঃ
মহান আল্লাহ বলেন,
" হে নবী! আপনি জিজ্ঞেস করুন(মুশরিকদের) , তোমাদেরকে আসমান থেকে ও যমীন থেকে কে রুযী দান করেন? কিংবা কে তোমাদের কান ও চোখের মালিক? তাছাড়া কে জীবিতকে মৃতের ভেতর থেকে বের করেন এবং কেইবা মৃতকে জীবিতের মধ্য থেকে বের করেন? কে করেন কর্ম সমপাদনের ব্যবস্থাপনা? তখন তারা (মুশরিকরা) বলে উঠবে, আল্লাহ! তখন তুমি বলো, তারপরেও ভয় করছ না? (সূরা ইউনুসঃ ৩১)
এই আয়াত থেকে বুঝা যায় মক্কার মুশরিকরাও এ কথা বিশ্বাস করত না যে, আল্লাহ্ ছাড়া অন্য কেউ মৃতকে জীবিত বা জীবিতকে মৃত্যু দান করার ক্ষমতা রাখেন না।
আল্লাহ্ তাআলা আরও বলেনঃ
" অথচ আল্লাহ্ই জীবন দান করেন এবং মৃত্যু দেন। তোমাদের সমস্ত কাজই, তোমরা যা কিছুই কর না কেন, আল্লাহ্ সবকিছুই দেখেন। (সূরা আল-ইমরানঃ ১৫৬)
আল্লাহ তাআলা আরও বলেন,
" এভাবে আল্লাহ্ মৃতকে জীবিত করেন এবং তোমাদেরকে তার নিদর্শনসমূহ প্রদর্শন করেন, যাতে তোমরা চিন্তা কর।" (সূরা বাকারাঃ ৭৩)
আল্লাহ্ তাআলা আরও বলেন,
" তারা কি আল্লাহ্ ব্যতীত অপরকে অলী (অভিভাবক ও বন্ধু) স্থির করেছে? উপরন্তু আল্লাহ্ই তো একমাত্র অলী (অভিভাবক ও বন্ধু) । তিনি মৃতদেরকে জীবিত করেন। তিনি সর্ব বিষয়ে ক্ষমতাবান।" (সূরা শূরাঃ ৯)
এছাড়াও আরও অনেক আয়াত রয়েছে, যা থেকে প্রমাণিত হয় যে, আল্লাহ ছাড়া অন্য কেউ মৃতকে জীবিত করতে পারে না। এটি একমাত্র আল্লাহর বৈশিষ্ট্য। এমন কি আমাদের নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অসংখ্য মুজেযা থাকা সত্ত্বেও মৃতকে জীবিত করার মুজেযা তাঁকে দেয়া হয় নি। এটি ছিল একমাত্র ঈসা (আঃ) এর মুজেযা। যেমনঃ আল্লাহ্ ঈসা (আঃ) কে লক্ষ্য করে বলেন,
" এবং যখন তুমি আমার আদেশে মৃতদেরকে বের করে দাড় করিয়ে দিতে।" (সূরা মায়িদাঃ ১১০)।
অতএব উপরের আলোচনায় বুঝা যায়। শামসুদ্দীন তাব্রীজী পীরের নামে বানানো এ কাহিনী সম্পূর্ণ মিথ্যা। এমন ঘটনা ঘটতে পারে না। যখন বিভিন্ন মহল থেকে এই শির্ক ঘটনা ব্যাপক হারে প্রচার পেল, তখন এর জবাবে চরমোনাই মাদ্রাসার একজন মুদাররিস মুফতি ফয়জুল্লাহ বিন ইদরীস ‘মুমিনের হাতিয়ার’ নামে একটা বই লিখেন যার ১১৩ পৃষ্ঠা থেকে ১৬৭ দীর্ঘ আলোচনা করে উক্ত শির্ক কাহিনী সত্য ও নির্ভজাল করার মিথ্যা প্রচেষ্টা চালিয়েছে।
হায় আফসস, যদি তারা বলতেন, এ সকল ঘটনার কোন সনদ নেই, হয়তো মুরিদদের কোন একটা বিষয় বুঝানোর জন্য ভুলবশত সনদ বিহীন ঘটনা তুলে ধরা হয়েছে যাতে শির্ক কথা বিদ্যমান আছে। আমরা আগামী প্রকাশনায় ইহা বাদ দিয়ে প্রকাশ করব, ইনশা আল্লাহ। তাহলে কতই না ভালো হতো। তা না করে এই শির্ক কথাকে কুরআন হাদিসের অপব্যাখ্যা দ্বারা জায়েয প্রমান করছেন। আর মানুষের ঈমান নিয়ে ছিনিমিনি খেলছেন।
মুফতি ফয়জুল্লাহ বিন ইদরীস ‘মুমিনের হাতিয়ার’ নামে একটা বইয়ের ১২ পৃষ্ঠায় লিখেন, মহান আল্লাহ বলেন,
" আর (আল্লাহ্ তাঁকে) বণী ইসরাঈলদের জন্যে রসূল হিসেবে তাকে মনোনীত করবেন। তিনি (ইসা আঃ) বলবেন নিশ্চয়ই আমি তোমাদের নিকট তোমাদের পালনকর্তার পক্ষ থেকে এসেছি নিদর্শনসমূহ নিয়ে। আমি তোমাদের জন্য মাটির দ্বারা পাখীর আকৃতি তৈরী করে দেবো। তারপর তাতে যখন ফুৎকার প্রদান করি, তখন তা উড়ন্ত পাখীতে পরিণত হয়ে যাবে আল্লাহর হুকুমে। আর আমি সুস্থ করে তুলব জন্মান্ধকে এবং শ্বেত কুষ্ঠ রোগীকে। আর আমি জীবিত করে দেবো মৃতকে আল্লাহর হুকুমে। আর আমি তোমাদেরকে বলে দেবো যা তোমরা খেয়ে আস এবং যা তোমরা ঘরে রেখে আস। এতে প্রকৃষ্ট নিদর্শন রয়েছে, যদি তোমরা বিশ্বাসী হও। [ সুরা ইমরান ৩:৪৯ ]
এ আয়াতে ভালভাবে লক্ষ করলে দেখা যায় ঈসা আলাইহিস সালাম মৃতদের জীবিত করতে পারতেন। এ থেকে বুঝা যায় আল্লাহ্ তাঁকে মানুষকে জীবিত করার ক্ষমতা প্রদান করেছেন।
তারপর একটু ব্যাখ্যা করে বলেন, শামসুদ্দীন তাব্রীজী পীরকে আল্লাহ্ এই ক্ষমতা দিয়েছিলেন। তাদের দাবি মতে, ঈসা (আঃ) মৃতকে জীবিত করতেন "তুমি আল্লাহর আদেশে জীবিত হও" এই বলে। যেমনঃআল্লাহ তাআলা ঈসা (আঃ) কে লক্ষ্য করে বলেন,
" এবং যখন তুমি আমার আদেশে মৃতদেরকে বের করে দাড় করিয়ে দিতে।" (সূরা মায়িদাঃ ১১০)
লেখকের দাবি, শামসুদ্দীন তাব্রীজী বললেন " আমার আদেশে উঠে দাঁড়াও" এদুটি কথার মধ্য কোন পার্থক্য নেই। (‘মুমিনের হাতিয়ার’ বইয়ের ১২২ পৃষ্ঠা)। আমারা বিশ্বাস করি মহান আল্লাহ ঈসা আলাইহিস সালামকে মৃত্যুদের জীবিত করার ক্ষমতা দিয়েছিলের যার দলিল সূরা ইমরান ৩:৪৯।
লেখক ইসা আঃএর ক্ষমতার দলিল সুস্পষ্ট করে আমাদের দিলেন যা আমরা জানি এবং মানি। কিন্তু আমরা যা মানতে পারছি না সেই পীরকে যাকে আল্লাহ্ মৃতদের জীবিত করার ক্ষমতা দিয়েছেন তার দলিত কই?
এমন সনদ দলিল বিহীন কল্পকাহিনী বিশ্বাস করলে, অদূর ভবিষ্যতে আল্লাহ্র যেকোনো নিজস্ব গুণকে যেকোন পীরের মুরিদগন তাদের পীরের গুণ বলে দাবি করে বলবে, এটা মহান আল্লাহর গুণ ঠিক আছে, কিন্ত এমন গুণ আমাদের পীরকে আল্লাহ দিয়েছেন। (নাঊজুবিল্লাহ) তাহলে শির্কি বানিজ্য শুরু হয়ে যাবে। এভাবেই সুফি সুন্নীরা তাদের আকিদা সহজ সরল মানুষদের বোকা বানিয়ে প্রতিষ্ঠিত করেছে যুগ যুগ ধরে।
আসলে আল্লাহ অলীদের কারামত সত্য হলেও তার সীমাবদ্ধ অবশ্যই রয়েছে। আল্লাহ্ কখনোই তাঁর নিজস্ব কোনো ক্ষমতা অন্য কাউকে দান করেন না প্রমাণ প্রয়োজন ছাড়া। সুফিরা দাবি করে অলি আওলিয়াদের নিজস্ব কিছু ক্ষমতা আছে। তাই তারা কারামতের ব্যপারে একটু বাড়াবাড়ি করে।
পবিত্র কুরআনে সুস্পষ্ট উল্লেখ আছে যে, প্রতিটি নবী রাসুল আল্লাহ্র ইচ্ছায় বহু মুজিজা মানুষের সামনে উপস্থিত করছেন। এই সকল মুজিজার কোনোটি সম্পর্কে তারা আগে থেকে জানতেন আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে আগে জানতেন না। তাদের নিকট যেহেতু আল্লাহর তরফ থেকে অহী আসত তাই তারা এ সম্পর্কে আগেই জানতে পারতেন। আবার অনেক সময় কিছুই জানতেন না। যেমনঃ
মুসা আলাইহিস সালামকে আল্লাহ বললেন,
" আরও বলা হল, তুমি তোমার লাঠি নিক্ষেপ কর। অতঃপর যখন সে লাঠিকে সর্পের ন্যায় দৌড়াদৌড়ি করতে দেখল, তখন সে মুখ ফিরিয়ে বিপরীত দিকে পালাতে লাগল এবং পেছন ফিরে দেখল না। হে মূসা, সামনে এস এবং ভয় করো না। তোমার কোন আশংকা নেই।" [ সুরা কাসাস ২৮:৩১ ]
মুসা আলাইহিস সালাম লাঠি থেকে সাপ হওয়ার এই মুজিজা সম্পর্কে কিছুই জানতেন ফলে ভয়ে তিনি মুখ ফিরিয়ে বিপরীত দিকে পালাতে লাগল এবং পেছন ফিরে দেখল না।
অলিদের নিকট অহী আসে না তাই তারা কখনও বলতে পাবরেন না যে, আমি এখন এই ধরনের কারামত দেখাব। তবে হ্যা, তিনি দোয়া করতে পারেন, আল্লাহ ইচ্ছা করলে কবুল করতে পারেন আবার নাও কবুল করতে পারেন। আল্লাহ এ কাজে কারো কাছে বাধ্য নন। এমনকি দোয়া কবুল করতেও বাধ্য নন। যেমনঃ মহান আল্লাহ বলেন,
" আপনি কোন কাজের বিষয়ে বলবেন না যে, সেটি আমি আগামী কাল করব।`আল্লাহ ইচ্ছা করলে' বলা ব্যতিরেকে। যখন ভুলে যান, তখন আপনার পালনকর্তাকে স্মরণ করুন এবং বলুনঃ আশা করি আমার পালনকর্তা আমাকে এর চাইতেও নিকটতম সত্যের পথ নির্দেশ করবেন। " (সুরা কা’হফ ১৮:২৩-২৪)।
এ আয়াতের প্রেক্ষাপট হল, মক্কার মুশরিকরা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পরীক্ষা নেবার জন্য আহলে কিতাবীদের পরামর্শক্রমে তাঁর সামনে তিনটি প্রশ্ন করেছিল। প্রশ্ন তিনটি ছিলঃ
১। আসহাবে কাহফ কারা ছিলেন?
২। খিযিরের আলাইহিস সালাম এর ঘটনাটি এবং তার তাৎপর্য কি ?
৩। বাদশা যুলকারনাইনের ঘটনাটি কি ?
জবাবে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মহান আল্লাহর উপর ভবসা রেখে বলে ছিলেন যে, আগামীকাল বলবো। কিন্তু তিনি ইনশাআল্লাহ বলতে ভুলে যান। তাই বেশ কিছু দিন অহী আসা বন্ধ থাকে । তারপর উক্ত আয়াত নাজিল হয়। আর তিনটি কাহিনীও আল্লাহ্ কুরআনে তুলে ধরেন।
এই আয়াতের পেছনে অনেক গুলো শিক্ষা আমাদের জন্য রয়েছে। তার মধ্যে একটি হলো আল্লাহ্ কোনো কিছুর জন্য বাধ্য নন। কারো আবেদনে সাড়া দেওয়া না দেওয়া সম্পূর্ণ আল্লাহর মর্জি। এখানে আরও অনেক গভীর কিছু ব্যাখ্যা রয়েছে।
দেখুন রাসুল সাঃকে পরীক্ষা করার জন্যই কিন্তু বিধর্মীরা প্রশ্ন করেছে। আর আল্লাহ্ রাসুল পাঠিয়েছেন বিধর্মীদের ইসলামে প্রবেশ করানোর জন্য। সুতরাং যখনই বিধর্মীরা নিজ থেকে আল্লাহ্ এবং তাঁর রাসুলকে যাচাই করতে চেয়েছে, তখনই এটা যুক্তিযুক্ত যে, তাদের প্রশ্নের উত্তর দিয়ে তাদেরকে ইসলামে দাখিল করার সুযোগ নেওয়া।
অথচ আল্লাহ্ সর্বজ্ঞ মহান অধিপতি। তিনি জানেন কখন কী করতে হবে। তাই তিনি তৎকালীন বিধর্মীদের শিক্ষা দেওয়ার চাইতে পরবর্তীতে যারা ঈমান আনবে তাদের শিক্ষা দেওয়াটা জরুরী মনে করলেন। তাই তিনি অহী বন্ধ করে অনেক গুলো শিক্ষা আমাদের সামনে উপস্থাপন করলেন। যারমধ্যে একটি হলো তাঁকে সাথে সাথে মোজেজা দেওয়া হবেনা।
যেখানে রাসুল সাঃ এর কোন আবেদনে সাড়া প্রদান মহান আল্লাহর একান্ত ইচ্ছাধীন, সেখানে অলী আউলিয়া পীরদের ব্যাপারতো যোজন যোজন দূরের কথা। তাই একটা কথা মনে রাখতে হবে আল্লাহ কাউকে তার নিজেস্ব ক্ষমতার ভাগ দেন না। এমনকি আমাদের রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কেও না।
কোনো মুমিন নেককার বান্দাকে আল্লাহ তার স্থায়ীগুণ দান করেন এমন কোনো নজীর কুরআন সুন্নায় নেই। তবে পীরদের জীবনীতে সনদবিহীন এমন অনেক শির্কি কাহিনী চালু আছে যা দেখে সাধারণ মুসলমানগণ দিনদিন ধোঁকা খেয়ে সুফিবাদের দিকে ঝুঁকে যাচ্ছে। সেইসাথে প্রতিনিয়ত আল্লাহ্র সাথে শির্কে লিপ্ত হচ্ছে। সুফিবাদ একটি শির্কি মতবাদ তা তাদের আকিদা এবং অলৌকিক অযৌক্তিক কাহিনী শুনলেই সুস্পষ্টভাবে বুঝা যায়।
হিদায়েতের মাধ্যম পীরঃ
সুফিদের ভ্রান্ত আকিদার মধ্যে আরেকটি জঘন্য কুফরি আকিদা হচ্ছে হিদায়েতের মাধ্যম হচ্ছে পীর! তাদের দাবি পীর ছাড়া কেউ কখনোই হিদায়াত পাবে না। যার পীর নাই তার পীর শয়তান। এই জাতীয় কথাই হচ্ছে সুফিদের মূল আকিদা। অথচ পবিত্র কুরআন হাদীস দ্বারা এটিকে দিনের আলোর মতো পরিষ্কার যে, হিদায়েতের মালিক একমাত্র আল্লাহ্। আল্লাহ্ যাকে ইচ্ছা তাকেই হিদায়াত দান করেন। আর যাকে ইচ্ছা পথভ্রষ্ট করেন। এখানে কারো কোনো হাত নেই। আল্লাহ্ বলেন,
" এটিই (পবিত্র কুরআন) আল্লাহর পথনির্দেশ, তিনি যাকে ইচ্ছা তা দিয়ে পথপ্রদর্শন করেন। আল্লাহ যাকে বিভ্রান্ত করেন, তার কোন পথপ্রদর্শক নেই। " (যুমার ২৩)
" আল্লাহ্ যাকে ইচ্ছা পথভ্রষ্ট করেন এবং যাকে ইচ্ছা সঠিক পথে রাখেন।" [সূরা আনআম, ৬:৩৯]
তিনি আরও বলেন:
"আল্লাহ্ যাকে পথ দেখান সে-ই পথ পায় এবং যাদেরকে তিনি পথভ্রষ্ট করেন তারাই ক্ষতিগ্রস্ত।"[সূরা আল-আরাফ, ৭:১৭৮]
উপরোক্ত আয়াত দ্বারা আল্লাহ্ সুস্পষ্ট করে ঘোষণা দিচ্ছেন যে, একমাত্র আল্লাহ্ যাকে হিদায়াত দিবেন ঐ ব্যক্তিই কেবল হিদায়াত প্রাপ্ত হবে। তিনি যাকে হিদায়াত না দিয়ে পথভ্রষ্ট করতে চান ঐ ব্যক্তি অবশ্যই পথভ্রষ্ট হবে। সুতরাং কোনো ব্যক্তির হাতে কারো কোনো হিদায়াত নেই। এই ব্যাপারে আল্লাহ্ বলেন,
" (হে রাসুল) তুমি যাকে ভালবাস তাকে (হিদায়াত) সৎপথ দেখাতে পারবে না, বরং আল্লাহ্ই যাকে চান (হিদায়েতের পথে) সৎ পথে পরিচালিত করেন, সৎপথপ্রাপ্তদের তিনি ভাল করেই জানেন। " (আল কাসাস ৫৬)
এই আয়াতটি রাসুলের চাচা আবু তালিবের ঈমান না প্রসঙ্গে নাযিল হয়েছিল। যখন রাসুল আপ্রাণ চাইছিলেন তাঁর চাচা আল্লাহর উপর ঈমান আনুক। অথচ চাচাকে আল্লাহ্ ঈমান আনার তৌফিক তথা হিদায়াত দেননাই। তখনই এই আয়াত দ্বারা আমাদের বিশ্ববাসীকে আল্লাহ্ জানিয়ে দিলেন যে, রাসুল চাইলেও কাউকে হিদায়াত দিতে পারবেন না। যদি না আল্লাহ্ ঐ ব্যক্তিকে হিদায়াত না দেন।
সুতরাং যেখানে রাসুলের হাতে আল্লাহ্ হিদায়াত সমর্পণ করলেন না। সেখানে স্বঘোষিত পীর অলি আউলিয়াদের হাতে কীভাবে হিদায়াত থাকে? পীরদের এই হিদায়েতের দাবি কি ভ্রান্ত প্রতারণামূলক নয় ?
সুফিরা সূরা কাহাফের ১৭ নং আয়াত দিয়ে দলিল দেওয়ার চেষ্টা করে। আল্লাহ্ বলেন,
" আল্লাহ যাকে সৎপথে পরিচালিত করেন, সে সৎপথ প্রাপ্ত এবং তিনি যাকে পথভ্রষ্ট করেন, তুমি কখনই তার কোন পথ প্রদর্শনকারী অভিভাবক পাবে না।" ( কাহাফ, ১৭)
এখানে আল্লাহ্ যাকে পথভ্রষ্ট করেন তার কোনো অভিভাবক পাওয়া যাবে না বলে আল্লাহ্ নিজেই ঘোষণা দিয়েছেন। আল্লাহ্ অসংখ্য আয়াতে জালিমদের কোনো অভিভাবক নেই বলে ঘোষণা দিয়েছেন। অর্থাৎ সঠিক পথপ্রদর্শনকারী অভিভাবক পাওয়া যাবে না।
এখন আমাদের চিন্তা করতে হবে সঠিক পথপ্রদর্শনকারী কে হতে পারেন? আমরা যদি একটি উদাহরণের সাহায্য বিষয়টি বুঝার চেষ্টা করি তাহলে খুব সহজেই বুঝতে পারবো।
কোনো একজন ব্যক্তি একটি ঠিকানা বরাবর যেতে চায়। কিন্তু সে জানে না কোন পথ দিয়ে গেলে তার নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছাতে পারবে। তখন সে ঐ গন্তব্যের পরিচিত এক ব্যক্তির সাহায্য চাইলে তিনি তাকে কীভাবে কীভাবে কোন পথ দিয়ে যেতে হবে তা জানিয়ে দিলেন।
এখন সে সেই ব্যক্তির দেখানো পথ দিয়ে যাওয়ার জন্য মন স্থির করলো। তখন সেখানে এমন একজনের আগমন ঘটল, যিনি নিজেই ঐ গন্তব্যের শেষ পর্যন্ত যাবেন। তখন নতুন আগত ব্যক্তিটি তাকে হাত ধরে তার গন্তব্যের দিকে নিয়ে যেতে লাগলো এবং পৌঁছে দিল।
এখন কথা হচ্ছে গন্তব্যে গমনকারী ব্যক্তিটি দুজনের সাহায্য পেয়েছেন। একজন পথ দেখিয়ে দিয়েছেন। অন্যজন নিজেই তাকে সেই গন্তব্যে সরাসরি পৌঁছে দিলেন নিজ দায়িত্বে। তাহলে এখানে সঠিক এবং উপকারী পথপ্রদর্শক কে হলেন? যিনি পথ দিয়েছেন? নাকি যিনি নিজে তাকে তার গন্তব্যে পৌঁছে দিলেন?
এর সহজ উত্তর হলো যিনি নিজ হাতে তাকে গন্তব্যে পৌঁছে দিলেন তিনিই হচ্ছেন প্রকৃত পথপ্রদর্শনকারী। সুফিরা যে পথপদর্শকের দাবি করেন তা হচ্ছে ঐ ব্যক্তির মতো, যিনি পথ দেখিয়েছেন কীভাবে গন্তব্যে যেতে হবে। তিনি কিন্তু তার সাথে সাথে সঙ্গী হয়ে যাননি। অর্থাৎ পৃথিবীতে যত নবী রাসুল পয়গম্বর সৎপথ প্রদর্শনকারী রয়েছে, যাদের সুফিরা পীর অলি আউলিয়া বলে উল্লেখ করেন। তাদের কাজ হচ্ছে মুমিনকে সৎপথের সন্ধান দেওয়া। কীভাবে আল্লাহর রাস্তায় চলতে হবে বা কীভাবে চললে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা যাবে ইত্যাদি বলে দেওয়া বা দেখিয়ে দেওয়া।
বাকিটুকু মুমিন নিজে কীভাবে চলবে তথা আল্লাহ্ তাকে কীভাবে চালাবেন তার উপর নির্ভরশীল। অর্থাৎ কেউ যদি চৌরাস্তার মাঝে দাঁড়িয়ে চিন্তা করে, কোন পথে গেলে সে সঠিক সময়ে সঠিক গন্তব্যে পৌঁছে পারবে। তখন তার মন যেদিকে যাওয়ার জন্য সায় দিবে তখন সে ঐপথেই যাবে। যদিও সে জানে না কোন রাস্তা সঠিক। এইযে মনে তাকে সায় দিচ্ছে, সেই সঠিক পথের সায়টা তার মনে একমাত্র আল্লাহ্ই সৃষ্টি করতে পারেন। এখানে দ্বিতীয় কোনো বান্দা নেই যে তাকে সঠিক রাস্তা বাতলে দিবে।
সুতরাং আল্লাহ্ যাকে পছন্দ করেন তাকেই সঠিক পথ চিনিয়ে সঠিক রাস্তায় পরিচালিত করেন। এখানে হিদায়েতের মালিক পীর অলি আউলিয়া নয়। তারা শুধুমাত্র পথপ্রদর্শনের সাহায্যকারী। সঠিক পথে নেওয়ার একমাত্র অভিভাবক হচ্ছেন আল্লাহ্।
যে আয়াতে আল্লাহ্ পথভ্রষ্টকারীর অভিভাবক নেই বললেন, সেই অভিভাবক হচ্ছেন আল্লাহ্ নিজেই। অর্থাৎ আল্লাহ্ই যাকে গোমরাহ করেছেন তাকে হিদায়াত দেওয়ার জন্য আল্লাহ্ ছাড়া আর কেউ নেই। আল্লাহ্ চাইলে তবেই সে হিদায়েতের রাস্তা পাবে।
সুফি চরমোনাইয়ের পীর সাহেব ফজলুল করিম এই আয়াতের ব্যাখ্যা করেছেন যে, যার হিদায়াত আছে তার পীর আছে যার হিদায়াত নেই তার পীর নেই। তিনি বোঝাতে চেয়েছেন যে, যাকে আল্লাহ্ হিদায়াত দেন তাকে পীর ধরার তৌফিক দেন বা তাকে মুরিদ হতে সাহায্য করেন। যদি এটা সত্য ধরে নিই তাহলে আমাদের কিছু প্রশ্ন আছে।
বর্তমান বিশ্বে হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ বিধর্মী ইহুদী খ্রিস্টান মূর্তিপূজারীরা যেভাবে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করছেন, তারা কোনো পীরের কাছে মুরিদ হয়ে ইসলাম গ্রহণ করছেন? অথচ তারা হিদায়াত পেয়েছেন বলেই কিন্তু ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে পেরেছেন।
যদি হিদায়েতের মাধ্যম পীর হয়, তাহলে সুফিদের সবচেয়ে বড় পীর রাসুলুল্লাহ সাঃ কেন তাঁর চাচাকে হিদায়াত দিতে পারেন নাই ? অথচ চাচা আবু তালিব ছিলেন সবচেয়ে বড় আশেকে রাসুল। পৃথিবীতে একমাত্র তিনিই জাহান্নামে কম শাস্তি পাবেন।
উপরোক্ত আলোচনা থেকে এটা দ্ব্যর্থহীনভাবে প্রমাণিত যে, পীর কখনোই হিদায়েতের মালিক বা মাধ্যম নয়। একমাত্র আল্লাহ্ই হচ্ছেন তাঁর বান্দার হিদায়েতের মালিক। তিনি যাকে চান তাকেই পথ দেখান। যাকে চাননা তাকে পথ দেখান না।
ফানা ফিস শাইখঃ
সুফিদের আকিদায় একজন মুরিদ বা শিক্ষার্থীকে প্রথমেই তার পীরের উপর ফানা হতে হবে। ফানা বলতে বিলীন হওয়া বুঝায়। ফানা ফিস শাইখ অর্থ হল শাইখ বা পীরে বিলীন হওয়া। পীর তার মুরিদ কে যে আদেশ করবে তা বিনা বাক্যে সেই মুরিদ মানার যোগ্যতা অর্জন করাই হচ্ছে ফানা ফিস শাইখ বা পীর। পীর প্রকাশ্যে শরীয়ত বিরোধী হুকুম দিলেও তা বিনা আপত্তিতে মেনে নিতে হবে। পীরের নির্দেশ হলে কুরআন এবং সুন্নাহতে কি আছে তা তার জানার দরকার নেই, বরং পীর সাহেবের নির্দেশ পালন করাই জরুরী। মুরিদের জায়েয নাজায়েয খোঁজার কোনো ইখতিয়ার নেই।
যেমনঃ আমাদের দেশে সবচেয়ে হক্কানী পীরের দাবিদার চরমোনাইয়ের পীর সৈয়দ মোহাম্মাদ এছহাক বলেনঃ
‘’কামেল পীরের আদেশ পাইলে, নাপাক শারাবে (মদ) দ্বারাও জায়নামাজ রঙ্গিন করিয়া তাহাতে নামাজ পড়’। (সৈয়দ মোহাম্মাদ এছহাক এর রচনাবলী; আল-এছহাক পাবলিকেশন্স; বাংলাবাজার প্রকাশকাল ফেব্রুয়ারি ২০০৭; আশেক মা’শুক বা এস্কে এলাহী; পৃষ্ঠা নঃ ৩৫)।
মানিকগঞ্জের পীর মোঃ আজহারুল ইসলাম সিদ্দিকের লেখা মারেফাতের ভেদতত্ত্ব বইয়ে বলেন,
“যুক্তি ছাড়া মোর্শেদের বাক্য বিনা দ্বিধায় মানতে হবে। নিজের বিবেক বূদ্ধি, বিদ্যা, যুক্তি, কিতাবের এলম সবই বিসর্জন দিতে হবে। মোর্শেদের কথায় অন্ধভাবে কাজ করে যেতে হবে। তার সামনে একটা মরা মানুষ সাজতে হবে”।
অথচ ইসলামী শরীয়তে একমাত্র আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের অনুগত্য করার জন্য কোনো শর্তারোপ করা হারাম। তাছাড়া আর সকল আলেম উলামা পীর মাশায়েকসহ সকল উলুল আমরদের আনুগত্য শর্ত সাপেক্ষে। তাদের অন্ধ আনুগত্য হারাম।
আল্লাহ তা’আলা কর্তৃক হারামকৃত বিষয়কে হালাল বা হালালকৃত বস্তুকে হারাম করার ক্ষেত্রে আলেমদের আনুগত্য করা হচ্ছে শির্কি কাজ। সুতরাং যেসব লোক হারাম হালালের ক্ষেত্রে তাদের আনুগত্য করল তারা মুলত আল্লাহ তা’আলার সমকক্ষ শির্কে ডুবে গেল।
আল্লাহ তাআলা বলেন,
" তারা আল্লাহকে বাদ দিয়ে নিজেদের উলামা ও দরবেশদেরকে নিজেদের ইলাহতে (উপাস্য) পরিণত করেছে৷ এবং এভাবে মারয়াম পুত্র মসীহকেও৷ অথচ তাদের মা’বুদ ছাড়া আর কারোর বন্দেগী কারার হুকুম দেয়া হয়নি, এমন এক মাবুদ যিনি ছাড়া ইবাদত লাভের যোগ্যতা সম্পন্ন আর কেউ নেই৷ তারা যেসব মুশরিকী কথা বলে তা থেকে তিনি পাক পবিত্র৷ (সুরা তওবা- ৯:৩১)।
আনুগত্যের শির্ক হল, বিনা ভাবনায় শরিয়তের গ্রহণযোগ্য কোন প্রমান ছাড়াই হালাল হারাম জায়েজ নাজায়েজের ব্যপারে আলেম বুজুর্গ বা উপরস্থ কারো সিদ্ধান্ত অন্ধভাবে সন্তুষ্ট চিত্তে মেনে নেয়া।
হাদীসে বলা হয়েছে হযরত আদী ইবনে হাতেম নবী (সা) এর কাছে এসে ইসলাম গ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন খৃস্টান। ইসলাম গ্রহণ করার সময় তিনি নবী (সা) কে কয়েকটি প্রশ্ন করেন। এর মধ্যে একটি প্রশ্ন হচ্ছে, কুরআনের এ আয়াতটিতে (সুরা তওবা- ৯:৩১) আমাদের বিরুদ্ধে উলামা ও দরবেশদেরকে খোদা বানিয়ে নেবার যে দোষারূপ করা হয়েছে তার প্রকৃত তাৎপর্য কী?
জবাবে তিনি বলেন, তারা যেগুলোকে হারাম বলতো তোমরা সেগুলোকে হারাম বলে মেনে নিতে এবং তারা যেগুলোকে হালাল বলতো তোমরা সেগুলোকে হালাল বলে মেনে নিতে, একথা কি সত্য নয়? জবাবে হযরত আদী বলেন , হ্যাঁ, একথা তো ঠিক, আমরা অবশ্যই এমনটি করতাম। রসূলুল্লাহ (সা) বলেন, ব্যাস, এটিই তো হচ্ছে তোমাদের প্রভু বানিয়ে নেয়া। (আহম্মদ, তিরমিজ, তাফসিরে ইবনে কাসির)।
রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলছেনঃ পাপ কাজের আদেশ না আশা পর্যান্ত ইমামের কথা শোনা ও তার আদেশ মান্য করা অপরিহার্য। তবে পাপ কাজের আদেশ করা হলে তা শোনা ও আনুগত্য করা যাবে না। (বুখারী হাদিস নং ২৭৫০)।
রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলছেনঃ স্রষ্টার বিরুদ্ধাচারন করে সৃষ্টির অনুগত্য করা চলবেনা। (আহম্মদ, মুসলিম)
আল্লাহর কিতাবের সনদ ছাড়াই যারা মানব জীবনের জন্য জায়েয ও নাজায়েযের সীমানা নির্ধারণ করে তারা আসলে নিজেদের ধারণা মতে নিজেরাই আল্লাহ্র বিধান দানের মর্যাদায় সমাসীন হয়। সুতরাং শরীয়তের হুকুমের বিপরীতে কেউ যদি হুকুম দেয় এবং সেই হুকুম যে বাে যারা মান্য করবে তারা সুস্পষ্ট শির্ক করবে।
যদি কেউ এমন করে তারা এই আয়াত,
“তারা আল্লাহকে বাদ দিয়ে নিজেদের উলামা ও দরবেশদেরকে নিজেদের খোদায় পরিণত করেছে”
এর অনুসারী হবে। তাই কখনোই পীরের উপর ফানা হওয়া যাবেনা। পীরকে ততক্ষণ পর্যন্ত অনুসরণ করা যাবে যতক্ষণ পর্যন্ত তিনি শরীয়তের উপর থাকবেন।
পীর ছাড়া ঈমানদার নয়ঃ
সুফিবাদের গুরুত্বপূর্ণ বিশ্বাস হলো, প্রতিটি মুসলমানকে অবশ্যই পীর ধরতে হবে। এবং সেই পীরই তাদেরকে ঈমানদার বানাবেন। কোনো পীরের হাতে বাইয়াত না হওয়া পর্যন্ত কোনো মুসলমানই ঈমানদার হতে পারে না। তাদের দাবি হলো, যার পীর নাই তার পীর শয়তান!
তাদের এই বিশ্বাস কতটুকু যুক্তিযুক্ত? আজ পবিত্র কুরআন পড়ে এবং গবেষণা করে হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ বিধর্মীরা ইসলাম গ্রহণ করছে। এইসব মানুষ কুরআন থেকেই হিদায়াত পেয়েছেন। কেননা আল্লাহ্ কুরআনকেই হিদায়েতের মাধ্যম করে বিশ্ববাসীর জন্য নাযিল করেছেন। সেখানে যদি সুফিদের যুক্তি আসলেই যৌক্তিক হতো তাহলে আল্লাহ্ কুরআনকে হিদায়েতের মাধ্যম না বলে পীর অলি আউলিয়াদের হিদায়েতের মাধ্যম বলে অবশ্যই তা কুরআনে উল্লেখ করতেন।
যদি তাদের দাবি সত্য হয়, তাহলে আজ পৃথিবীর লক্ষ লক্ষ হাজার হাজার নওমুসলিম যারা হিদায়াত পেয়ে ইসলামের পতাকা তলে আশ্রয় নিচ্ছে, তারা কখনোই প্রকৃত ঈমানদার হতে পারবে না! কেননা তারা তো উপমহাদেশের পীর ধরে মুসলমান হয়নি! এথেকেই বুঝা যায় সুফিরা কতবড় মিথ্যাচার করে মুসলমানদের ঈমান আকিদা নিয়ে।
সুফিদের জ্ঞান জীবিতদের থেকেঃ
সুফিদের দাবি হলো তাদের কাছে যে জ্ঞান আছে এবং আসে তা সরাসরি আল্লাহর কাছ থেকেই আসে। তাই তাদের জ্ঞানই হচ্ছে সঠিক। কেননা তারা জ্ঞান প্রাপ্ত হয় জীবিত অলি আল্লাহ্দের মাধ্যমে। যে অলি আল্লাহ্রা (তাদের দাবি) সরাসরি আল্লাহর কাছ থেকে জ্ঞান লাভ করে।
এই দাবির ফলে তারা কখনোই কুরআন হাদিসের সঠিক ব্যাখ্যা মেনে নিতে চায় না। তারা তাদের অলি আউলিয়াদের কথাকেই সঠিক মনে করে দ্বীন পালন করে। তাদের দাবি কুরআন হাদীস এসেছে মৃতদের থেকে অর্থাৎ যেহেতু কুরআন, হাদীস সংকলন হয়েছে রাসুলুল্লাহ সাঃএর ওফাতের অনেক পরে। তাই সেখানে যথেষ্ট ভুল ভ্রান্তি থাকতে পারে। আর তারা যেহেতু জীবিত অলি আল্লাহ্ থেকে ফয়েজ লাভ করে সেহেতু তাদের জ্ঞানই হলো সঠিক।
মোটকথা তারা তাদের দাবির পক্ষে সত্যতার জন্য যথেষ্ট পরিমাণ মিথ্যা এবং জালিয়াতির আশ্রয় নেয়। তারা সুস্পষ্ট কুরআনের আয়াতকেও ভুল ব্যাখ্যা করে তাদের স্বপক্ষে আনার চেষ্টা করে। আর সাধারণ মানুষও তাদের কথায় গলে যায়। যেহেতু তাদের কুরআন হাদিসের কোনো জ্ঞান নেই। সেইসাথে সুফিবাদীরা তাদের অনুসারীদের কুরআন হাদীস পড়া এবং জানার জন্য নিষেধাজ্ঞা প্রদান করে তাদের জ্ঞানার্জনের পথকে রুদ্ধ করে রেখেছে।
কাশফকে অলিদের নিজস্ব ক্ষমতা মনে করাঃ
সুফিরা দাবি করেন, অলিদের কাশফ তাদের নিজস্ব ক্ষমতা। তাদের মতে, মানুষের আধ্যাত্মিক সাধনার মাধ্যমে যখন তার হৃদয়ের পর্দা উঠে যায় তখন তাদের সামনে সৃষ্টি জগতের সকল রহস্য উন্মুক্ত হয়ে যায়। তার অন্তর আত্মা খুলে যায়। এবং এই অন্তর আত্মা খুলে যাওয়াকে তাদের পরিভাষায় কাশফ বলা হয়।
কাশফ হাসিল হয়ে গেলে আল্লাহ এবং সুফী সাধকের মাঝে কোন অন্তরায় থাকে না। তখন তারা জান্নাত, জাহান্নাম, সাত আসমান, জমিন, আল্লাহ্র আরশ, লাওহে মাহফুজ পর্যন্ত ঘুরে আসতে পারেন। তারা গায়েবের সকল খবর, মানুষের অন্তরের অবস্থা এবং সাত আসমানে, জমিনে যা আছে তার সবই জানতে পারেন। তাদের স্বীকৃত যত অলী আওলীয়া আছে এবং ছিলো তাদের সকলেরেই কাশফ হত। কাশফ হওয়া অলী হওয়ার একটি শর্ত।
এবার দেখা যাক কাশফ সম্পর্কে ইসলাম কী বলে?
‘কাশফ ' অর্থ প্রকাশিত হওয়া বা অজানা কোন বিষয় নিজের কাছে প্রকাশিত হওয়া। অর্থাৎ আল্লাহ্ কর্তৃক তাঁর কোন বান্দার নিকট আল্লাহর অজানা এমন কিছুর জ্ঞান প্রকাশ করা যা অন্যের নিকট অপ্রকাশিত। এমনিভাবে কাশফ ইচ্ছাধীন কোন বিষয় নয় যে, তা অর্জন করা শরীয়তে কাম্য হবে বা সওয়াবের কাজ হবে। তবে অহী হলে তা কেবলমাত্র নবী-রাসূলগণের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। যেমন আল্লাহ বলেন,
‘তিনি (আল্লাহ্) অদৃশ্য জ্ঞানের অধিকারী। তিনি তাঁর (আল্লাহর) অদৃশ্যের জ্ঞান কারো নিকট প্রকাশ করেন না’। ‘তাঁর মনোনীত রাসূল ব্যতীত। তিনি তার (অহীর) সম্মুখে ও পশ্চাতে প্রহরী নিযুক্ত করেন। (সুরা জিন ৭২:২৬-২৭)।
তবে কখনও কখনও রীতি বহির্ভূতভাবে অন্য কারোও নিকট থেকে অলৈাকিক কিছু ঘটতে পারে বা প্রকাশিত হতে পারে। যেমন ছাহাবী ও তাবেঈগণ থেকে হয়েছে। তবে মনে রাখতে হবে যে, এই ‘কাশফ ' কোন নবীর রাসুলেরও ইচ্ছাধীন নয়। এমনকি আমাদের রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামে ও ইচ্ছাধীন ছিলো না।
যেমন, সহিহ বুখারী, খন্ড ৬, অধ্যায় ৬০, হাদিস ৪৩৪। এর একটি ঘটনা সহীহ বুখারীর “তাফসির” অধ্যায়ে বর্ণনা করা হয়েছে এইভাবে, আয়িশা (রাঃ) হতে বর্ণিতঃ তিনি বলেন, আল্লাহর রসূল (সাঃ) যয়নাব বিনতে জাহশ (রাঃ), রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এর একজন স্ত্রী, এর কাছে মধু পান করতেন এবং সেখানে কিছুক্ষণ থাকতেন। তাই আমি (আয়েশাহ) ও হাফসা একমত হলাম যে, আমাদের যার ঘরেই আল্লাহর রসূল (সাঃ) আসবেন, সে তাঁকে বলবে, আপনি কি মাগাফীর খেয়েছেন? আপনার মুখ থেকে মাগাফীরের গন্ধ পাচ্ছি। (আমরা তাই করলাম) এবং তিনি বললেন, না, বরং আমি যয়নাব বিনতে জাহশ এর ঘরে মধু পান করেছি। তবে আমি কসম করলাম, আর কখনো মধু পান করব না। তুমি এ বিষয়টি আর কাউকে জানাবে না।
আল্লাহ বলেন,
" যখন নবী তাঁর একজন স্ত্রীর কাছে একটি কথা গোপনে বললেন, অতঃপর স্ত্রী যখন তা বলে দিল এবং আল্লাহ নবীকে তা জানিয়ে দিলেন, তখন নবী সে বিষয়ে স্ত্রীকে কিছু বললেন এবং কিছু বললেন না। নবী যখন তা স্ত্রীকে বললেন। তখন স্ত্রী বললেনঃ কে আপনাকে এ সম্পর্কে অবহিত করল? নবী বললেনঃ যিনি সর্বজ্ঞ, ওয়াকিফহাল, তিনি আমাকে অবহিত করেছেন। (সুরা আত-তাহরীমের আয়াত -৩)।
আল্লাহর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের স্ত্রীগন গোপনে আলাপ করল অথচ তিনি কিছুই জানলেন। তার কাশফ ইচ্ছাধীন ক্ষমতা হলে সঙ্গে সঙ্গে জানতে পারতেন।
কোন এক সফরে ‘আয়িশা (রা) হার হারিয়ে গেল। সাহাবিদের পথে আটকিয়ে রেখে হার খোজ করা হল। এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে পেরেসানিতে ফেললেন। অথচ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামক যে উটে তিনি ছিলেন, হার খানা তার নীচে পরে ছিল। আল্লাহর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাশফ ইচ্ছাধীন ক্ষমতা হলে সঙ্গে সেঙ্গে হার খানা পেয়ে যেতেন।
হযরত ইয়াকুব আলাইহিস সালাম দীর্ঘদিন পর্যন্ত ছেলে ইউসুফ আলাইহিস সালামে খবর না পাওয়ার কারণে কাঁদতে কাঁদতে অন্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। যদি কাশফ ইচ্ছেধীন কোন কিছু হতো, তাহলে ইয়াকুব আলাইহিস সালাম কাশফের মাধ্যমে খবর পেলেন নিশ্চয়ই।
অনুরূপ কাশফ হওয়ার জন্য বুযুর্গ হওয়াও শর্ত নয়। বুযুর্গ তো দূরের কথা, মুমিন হওয়াও শর্ত নয়। কাশফ তো অমুসলিমদেরও হতে পারে। বর্তমান সমাজে যেহারে তাবিজ তুমার জাদুটোনা ইত্যাদি চলছে তাও একপ্রকারের কাশফের মতোই। অর্থাৎ যেসব ব্যক্তি হাজিরা দেখার নামে এইসব করছে তারাও কিছু না কিছু সত্য ভক্তদের বলে দিচ্ছে। তা নাহলে আমাদের দেশে ব্যাঙের ছাতার মতো মগ তান্ত্রিক কবিরাজ জাদুটোনা ইত্যাদির ব্যাপক প্রসার হতো না।
অতএব এরূপ যদি কোন মুমিন থেকে হয়, তবে সেটা হবে ‘কারামত’। অর্থাৎ আল্লাহ্ তাকে এর দ্বারা সম্মানিত করেন। আর যদি কাফির থেকে ঘটে, তবে সেটা হবে ফিৎনা। অর্থাৎ আল্লাহ এর দ্বারা তার পরীক্ষা নিচ্ছেন যে, সে এর মাধ্যমে তার কুফরী বৃদ্ধি করবে, না তওবা করে ফিরে আসবে।
কাজেই কাশফকে অলিদের নিজস্ব ক্ষমতা মনে করা কুফরি। আল্লাহ তার বান্দদের মাঝে যাকে ইচ্ছা তাকে অদৃশ্যের খবর জানাবেন এটাই স্বাভাবিক।
অলি আউলিয়াদের কারামত তাদের ইচ্ছাধীনঃ
সুফিরা মনে করে অলি আওলিয়াদের নিজস্ব কিছু ক্ষমতা আছে। তাই তারা কারামতের ব্যপারে একটু বাড়াবাড়ি করে। তারা বিভিন্ন সময় দাবি করে থাকে অলী আওলিয়াগন মৃতকে জীবিত করে, অলীদের আদেশে নদ-নদী ও আসমান-যমিনের কাজ পরিচালিত হয়, ইলমে গায়েবের দাবী করে, ভবিষ্যৎ বর্ননা করে, মায়ের পেটের সন্তানের খবর বলে দেয়, দূরের খবর সেখানে না গিয়েই বলে দেয়, এক জায়গায় বসে অন্য জায়গার খবর বলে দেয় ইত্যাদি।
তাদের জীবিত ও মৃত কল্পিত পীর ও অলীদের মর্যাদা বাড়ানোর জন্য তাদের কারামত বর্ণনায় মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে মাত্রাতিরিক্ত বাড়াবাড়ি করে থাকে। যে সকল কাজ আল্লাহ ছাড়া অন্য কেউ করার ক্ষমতা রাখে না তা কখনও অলীদের কারামত হতে পারে না।
মানুষের হাতে অলৌকিক বা সাধারণ অভ্যাসের বিপরীত কোন ঘটনা ঘটলে তার পিছনে দুটি কারন থাকে। হয় যাদু না হয় কারামত। যে ব্যক্তি কুরআন ও সুন্নাহ পূর্ণ অনুসরণ করে তার হাতে যদি সাধারণ অভ্যাসের বিপরীতে কোন কিছু ঘটে তবে বুঝতে হবে এটা আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে এবং তা কারামত। অপর পক্ষে যে ব্যক্তি কুরআন ও সুন্নাহ পূর্ণ অনুসরণ করে না, তার হাতে যদি সাধারণ অভ্যাসের বিপরীতে কোন কিছু ঘটে তবে বুঝতে হবে এটা আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে নয় এটা হয় ভেলকিবাজি না হয় যাদু। কাজেই বলা যায় কারামত ও যাদুর মধ্যে পার্থক্য করার জন্য কুরআন ও সুন্নাহ হচ্ছে একমাত্র মাপকাঠি।
কারামতে ব্যাপারে আহলে সুন্নাতের বিশ্বাস হচ্ছে, তল আউলীয়াদের কারামত সত্য এবং তাতে বিশ্বাস করা জরুরি। তবে অলী হওয়ার জন্য কারামত প্রকাশিত হওয়া জরুরী নয়।
তবে মনে রাখতে হবে, আওলিয়াদের কারামত তাদের ইচ্ছাধীন নয়। এটা মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে তাদের জন্য একটা সম্মান। এমনকি অলীগণ তা জানতেও পারেন না। চ্যালেঞ্জ করে কারামত ঘটানোর ঘটনা সম্পূর্ণ মিথ্যা। কারন মহান আল্লাহ কারো কাছে দায় বদ্ধ নয়। এমন কি আমাদের প্রিয় রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকটও নয়।
যেমনঃ মহান আল্লাহর বলেন,
" আর দেখো, কোনো জিনিসের ব্যাপারে কখনো একথা বলো না, আমি কাল এ কাজটি করবো৷ তবে যদি আল্লাহ চান৷ যদি ভুলে এমন কথা মুখ থেকে বেরিয়ে যায় তাহলে সাথে সাথেই নিজের রবকে স্মরণ করো এবং বলো, “আশা করা যায়, আমার রব এ ব্যাপারে সত্যের নিকটতর কথার দিকে আমাকে পথ দেখিয়ে দেবেন৷ (সুরা কাহাব :২৩-২৪)।
কুরআন হাদিসে অসংখ্যা প্রমান আছে, পূর্ববর্তী যুগের অনেক সৎ লোক, সাহাবী, তাবেয়ী এবং পরবর্তী যুগের অনেক সৎ লোকের হাতে আল্লাহ্ অসংখ্য কারামত প্রকাশ করেছেন। যেমন মারইয়াম আলাইহিস সালাম, আসহাবে কাহাফ, জুরাইজ, আব্বাদ বিন বিশর, উমার বিন খাত্তাব, উসায়েদ ইবনে হুযায়ের এমনি আরও অনেক সাহাবীর হাতে আল্লাহ তাআলা কারামত প্রকাশ করেছেন।
সুতারং আওলিয়াদের কারামত ইচ্ছাধীন মনে করা কুফরি। এ ব্যপারে আহলে সুন্নাতের আকিদা অনুসরণ করা উচিৎ। বাড়াবাড়ি করা ঠিক নয়।
পীর আউলিয়াদের ইলমে লাদুন্নীঃ
সুফিবাদে পীর আউলিয়াদের ইমলে লাদুন্নী নামে একটি বিশেষ জ্ঞানের কথা বলা হয়। যে বিশেষ জ্ঞান সম্পর্কে কুরআন হাদিসে কোনো সুস্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায় না। এটি এমন একটি জ্ঞান যা আল্লাহ্ সরাসরি তাঁর নির্বাচিত বান্দাদের দিয়ে থাকেন।
যে জ্ঞান দুনিয়ার কোনো জ্ঞান নয়। এই এক রহস্যময় জ্ঞান যা শুধুমাত্র আল্লাহ্ এবং তাঁর ঐ বান্দাদের মধ্যে সীমাবদ্ধ। এই জ্ঞানের দ্বারা পীর অলি আউলিয়ারা অতীত বর্তমান ভবিষ্যৎ দেখতে পারেন। কারো তকদীর পড়তে পারেন। যে কিতাব আল্লাহ্ লৌহে মাহফুজে সংরক্ষিত রেখেছেন সেই কিতাবও এই জ্ঞান দ্বারা পীর আউলিয়ারা জানতে পারেন।
এই জ্ঞান অর্জনের ফলে পীর আউলিয়ারা তাদের মুরিদ ভক্তদের যেকোনো অতীত ভবিষ্যৎ সম্পর্কে জানিয়ে তাদের বিবিধ বিপদ আপদ থেকে উদ্ধার করেন। তাই যারা এই জ্ঞান প্রাপ্তদের সাথে থাকেন তারা তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে নিরাপদে থাকেন। কেননা এই পীর আউলিয়ারা তাদের যেকোনো বিপদে আপদে আগেই জানিয়ে দিয়ে সাহায্য করে থাকেন।
এই ইলমে লাদুন্নী সম্পর্কে কুরআন সুন্নাহ সাহাবী তাবেয়ী তথা সালফে সালেহীন থেকে কোনো স্বীকৃতি বা প্রামাণ্য দলিল পাওয়া যায় না। যদি এই ইলমে লাদুন্নী সত্যিই আল্লাহর পক্ষ থেকে আসতো, তাহলে এই জ্ঞানের সর্বাধিক হকদার হলেন হযরত মুহাম্মদ সাঃ। আল্লাহ্ তাঁর প্রিয় হাবীব এবং সর্বশ্রেষ্ঠ রাসুলকে অবশ্যই সেই জ্ঞান দান করতেন।
যদি তিনি এই জ্ঞান প্রাপ্ত হতেন তাহলে তাঁর জীবনেও কোনো দুঃখ, দূর্দশা, হতাশা ইত্যাদি থাকতো না। কেননা আমরা আগেই দেখেছি যে আল্লাহর রাসুল সাঃ বিভিন্ন ঘটনায় তিনি আগেই কিছু জানতেন না পরেও জানতেন না। যতক্ষণ না আল্লাহ্ তাঁকে জানাচ্ছেন। রাসুলুল্লাহ সাঃ জীবনে এবং সাহাবীদের জীবনে এমন এমন ঘটনা ঘটেছে যা আগে থেকে জানতে পারলে তা অবশ্যই তাদের নগদে উপকার হতো! কিন্তু তা কখনোই আল্লাহ্ করেননি।
সুতরাং যেখানে আল্লাহর রাসুল এবং জান্নাতের সার্টিফিকেট প্রাপ্ত সাহাবীদের মধ্যে কেউ এই ইলমে লাদুন্নী প্রাপ্ত হননি, সেখানে কীভাবে এইসব অলি আউলিয়ারা ইলমে লাদুন্নী পেয়ে যাচ্ছেন বলে দাবি করছেন।
সুফিরা ইলমে লাদুন্নীর প্রমাণ দেওয়ার জন্য পবিত্র কুরআনের কাহাফের ৬৫ আয়াত তুলে ধরেন।
মহান আল্লাহ বলেন,
" অতঃপর তাঁরা আমার বান্দাদের মধ্যে এমন একজনের সাক্ষাত পেলেন, যাকে আমি আমার পক্ষ থেকে রহমত দান করেছিলাম ও আমার পক্ষ থেকে দিয়েছিলাম এক বিশেষ জ্ঞান।" ( সুরা কা’হফ ১৮:৬৫ )।
এই আয়াত উল্লখে করে তারা দাবি করে এই বিশেষ জ্ঞান যা আল্লাহুতা’লা হযরত খিজির আলাইহিস সালাম কে দান করেছেন তা ই হলো “ইলমে লাদুন্নী”। আল্লাহুতা’লা যাকে বিশেষ জ্ঞান বলেছেন, সুফিরা এই বিশেষ জ্ঞান কে “ইলমে লাদুন্নী” বলে চালিয়ে দেন। ইলমে লাদুন্নী বলতে তারা বুঝাতে চায় যে, এটি এমন একটি ইলম যা, আল্লাহর পক্ষ হতে খিজির আলাইহিস সালাম মত সুফীরা পেয়ে থাকে।
তাদের মতে এই জ্ঞান অর্জনের জন্য তাদের বিভিন্ন ত্বরিকার বিভিন্ন বিশেষ পদ্দতিতে সাধনা ও চেষ্টা দরকার। এজন্য তাকে আল্লাহর অলি বা প্রকৃত পীর মোর্শেদের সান্নিধ্যে থেকে পরম জ্ঞানময় আল্লাহ তায়ালার গায়েবী ইলম লাভ করে ইনসানে কামিলে পরিণত হতে হবে। তাদের ধারনা হল, এটি কেবল মাত্র অলী আওলীয়াগন আল্লাহর পক্ষ থেকে অর্জন করে থাকেন। সাধারন কুরআন হাদিসের কোন আলেমে এ জ্ঞান দেয়া হয় না।
সুফিদের এ ধারণা সম্পূর্ণ কল্পিত কারণ যে বিষয় ইসলামে থাকবে অথচ কুরআন হাদিসে থাকবেনা এটা কেমন করে হয়। যদি “ইলমে লাদুন্নী” কোন অলী আওলীয়াগন হাছিল করতে পারে তাহলে তা প্রথমে হাসিল করতেন রাসুলুল্লাহ সাঃ। তাঁর পরবর্তীতে হাসিল করতে পারতেন এই উম্মতের সবচেয়ে বড় অলী আওলীয়া যাদের কুরবাণীতে দ্বীন পেয়েছি সেই সাহাবীগণ। তাদের যেহেতু হাছিল হয়নি তাহলে কার হাছিল হতে পারে? এই জ্ঞান যদি আল্লাহর পক্ষ থেকেই হতো এবং তা রাসুলুল্লাহ সাঃ অবশ্যই প্রকাশ করতেন। কেননা রাসুল কোনো কথাই উম্মতের জন্য গোপন করে যাননি।
আল্লাহ বলেন,
" হে রসূল, পৌঁছে দিন আপনার প্রতিপালকের পক্ষ থেকে আপনার প্রতি যা অবতীর্ণ হয়েছে। আর যদি আপনি এরূপ না করেন, তবে আপনি তাঁর পয়গাম কিছুই পৌঁছালেন না। আল্লাহ আপনাকে মানুষের কাছ থেকে রক্ষা করবেন। নিশ্চয় আল্লাহ কাফেরদেরকে পথ প্রদর্শন করেন না। [ সুরা মায়েদা ৫:৬৭ ]।
এ আয়াতে পরিস্কার বলা হয়েছে রাসূল তার নিকট অবতীর্ণ সকল বিষয় পৌঁছিয়েছেন। যদি তিনি ইলমে লাদুন্নী না পৌঁছে গোপন করেন তবে আল্লাহর কথা মত তিনি রিসালাতের দায়িত্বে অবহেলা করেছেন। (নাউজুবুল্লাহ)। তিনি রিসালাতের দায়িত্বে কোন প্রকার সামান্যতম অবহেলা করেননি, তার প্রমান বিদায় হজ্জে লক্ষাধীক সাহাবি সাক্ষ্য প্রদান।
এই মর্মে সুফিদের একটি বানোয়াট মিথ্যা কথা প্রচলিত আছে যে, জানা ইলমে আমল করলে, আল্লাহ অজানা ইলম দান করেন। আর এই অজানা ইলম হল “ইলমে লাদুন্নী”। যদিও এই কথা কোনো হাদীস নয় তবুও এই কথার ভিতরেই সুফিদের প্রতারণা লুকিয়ে আছে।
কেননা তারা বলছে, জানা ইলম আমল করলে তবেই আল্লাহ্ অজানা ইমল দান করবেন। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, সুফিবাদে শরীয়তের ইলম আমলের চর্চা হচ্ছে কতটুকু? আমরা সুফিদের আকিদা বিশ্লেষণ করে যা পাচ্ছি তাতে শরীয়তের ঈমান আমলের কোনো নাম গন্ধ নেই। বরং তারা সুস্পষ্ট ইসলামী ঈমান আমলের বিরোধী। তাদের ইয়াকীন হয়ে গেলে ইবাদত লাগে না। অথচ আল্লাহর রাসুলেরও তাদের দাবি অনুযায়ী ইয়াকীন আসেই নাই!
এই উপমহাদেশের যত পীর আউলিয়ার দরবার মাজার আছে, তা ভালো করে পর্যবেক্ষণ করলে আমরা তাদের শরীয়তের কোনো আমলই দেখতে পাবো না। অথচ তারা বলে শরিয়তের আমল করেই তারা ইলমে লাদুনী অর্জন করে। সুতরাং যে আমল তারা নিজেরা করে না সেটা দিয়ে কীভাবে ইলমে লাদুনী অর্জিত হয় তা ভেবে দেখার বিষয়। সুতরাং পীর আউলিয়াদের ইলমে লাদুনী নিয়ে যে মিথ্যাচার সুফি সুন্নীরা করে তা কখনোই সঠিক নয়। ইসলামী শরিয়তে এমন কোনো জ্ঞান কারো প্রাপ্ত হতে পারে তার কোনো দলিল নেই।
উপরোক্ত আলোচনা থেকে এটা সুস্পষ্ট প্রমাণিত যে, পীর আউলিয়া সম্পর্কিত সুফি সুন্নীদের যেসব আকিদা রয়েছে তা শির্কি কুফুরি আকিদা। কেউ সুফিদের এইসব আকিদার সাথে একমত পোষণ করলে তার ঈমান নষ্ট হয়ে যাবে। সুতরাং সহীহ্ ইসলামের সাথে সুফিবাদের ইসলামের কোনো সামঞ্জস্য নেই। সুফিবাদ একটি ইসলাম কেন্দ্রিক আলাদা আকিদা।
কৃতজ্ঞতাঃ
মোহাম্মাদ ইস্রাফিল হোসাইন। (বিএ ইন আরবি সাহিত্য ও ইসলাম শিক্ষা)
সাখাওয়াতুল আলম চৌধুরী
২২ জানুয়ারি, ২০২২
পতেঙ্গা, চট্টগ্রাম।
দারুণ বলেছেন
উত্তরমুছুনআপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। জাযাকাল্লাহু খাইরান
উত্তরমুছুন