আল্লাহ্কে পেতে মাধ্যম
আল্লাহ্কে পেতে মাধ্যম |
আল্লাহ্ পৃথিবীতে মানুষ পাঠিয়েছেন পরীক্ষা করার জন্য। তিনি দেখতে চান তাঁর বান্দারা কে কী এবং কত ভালো আমল করে। আল্লাহর পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে অবশ্যই আল্লাহ্কে সন্তুষ্ট করতে হবে। আর আল্লাহ্কে সন্তুষ্ট করা মানেই হলো আল্লাহ্কে নিজের করে পাওয়া। অর্থাৎ আল্লাহ্ আপনার উপর সন্তুষ্ট হওয়া। এখন কীভাবে আল্লাহ্ আপনার উপর সন্তুষ্ট হবেন সেটাই হচ্ছে আল্লাহ্কে পাওয়ার মাধ্যম।
বান্দা আল্লাহ্কে চাইবে কেন?
যেহেতু আল্লাহ্ পরীক্ষার জন্যই আমাদের দুনিয়ায় পাঠিয়েছেন, সেহেতু প্রতিটি কাজে আমাদের আল্লাহ্কেই প্রয়োজন হবে। এখন এই পরীক্ষার দুনিয়াবী বিপদাপদে, দুঃখ দূর্দশায় আল্লাহ্কে সন্তুষ্ট করে উদ্ধার পেতে হবে। সেইসাথে আল্লাহ্কে রাজি খুশি করে আখিরাতেও জান্নাত হাসিল করতে হবে। তাই আল্লাহ্কে কাছে পেতে (যাতে দুঃখ লাঘব ও জান্নাত পাওয়ার জন্য) আমাদেরও মাধ্যমের প্রয়োজন।
সোজা কথায় হলো আল্লাহ্কে পেতে অর্থাৎ আল্লাহ্ আমাদের উপর দুনিয়ায় ( বিভিন্ন বিপদাপদে) এবং আখিরাতে (জান্নাত লাভে) সন্তুষ্ট হতে যে কাজ করবো সেটাই হচ্ছে আল্লাহ্ পাওয়ার মাধ্যম।
অতএব আল্লাহর সন্তুষ্টি (দুনিয়া ও আখিরাতে) এবং নৈকট্য পাওয়ার জন্য যে উপায়, পদ্ধতি, পথ অন্বেষণ করবো তাকেই বলা হচ্ছে মাধ্যম।
আরও পড়ুন শিরক কী? মানুষ কীভাবে শিরক করে
কুরআনের আলোকে মাধ্যমঃ
যেহেতু আল্লাহ্ আমাদের দুনিয়ায় পাঠিয়েছেন বিভিন্নভাবে (দুঃখ, দূর্দশা, বিপদাপদ, অশান্তি ইত্যাদি দিয়ে) পরীক্ষা করার জন্য। সেইসাথে তিনি এইসব থেকে মুক্তির উপায়ও বলে দিয়েছেন। যখনই বান্দা নানান ধরনের সমস্যায় পড়বে তখনই তার আল্লাহ্কে ডাকা এবং পাওয়ার প্রয়োজন হবে।
বান্দার এই বিবিধ প্রয়োজনে কীভাবে আল্লাহর কাছে চাইবে সেই শিক্ষা তিনি রাসুলুল্লাহ সাঃএর দ্বারা কুরআনে ও হাদীসে শিক্ষা দিয়েছেন।
আল্লাহ্ পবিত্র কুরআনে বলেন,
" এবং তোমাদের রব (আল্লাহ্ ) বলেছেন, আমার কাছে চাও (প্রার্থনা করো); আমি তা কবুল করব (আখিরাতে) বা তোমাদের দেব (দুনিয়াতে) (সুরা মুমিন, আয়াত-৬০)।
" বরং তিনি (আল্লাহ্) , যিনি (বিপদাপদে, দুঃখ, দূর্দশায়) নিরুপায়ের আহবানে সাড়া দেন এবং বিপদ দূরীভূত করেন " ( সূরা নমল : ৬২)
" আর যারা ঈমান আনে ও সৎকর্ম করে তাদের আহবানে তিনি সাড়া দেন এবং তাদের প্রতি তাঁর অনুগ্রহ বৃদ্ধি করেন। " (আশ শূরা : ২৬)
" আর আল্লাহর জন্যই রয়েছে সুন্দরতম নামসমূহ। সুতরাং তোমরা তাঁকে সেসব নামেই ডাক। " [ আল আরাফ ৭:১৮০ ]
" আর মু'মিনদের সাহায্য করা আমার দায়িত্ব "। [ সূরা আর-রূম: ৪৭ ]
উপরোক্ত আয়াত ছাড়াও আরো অসংখ্য আয়াত দ্বারা এটা প্রমাণিত যে বান্দা যেকোনো (দুনিয়াবী ও পরকালের) প্রয়োজনে শুধুমাত্র একমাত্র আল্লাহর কাছে চাইবে এবং আল্লাহ্ও তা পূরণ করবেন।
এখন যেকেউ আল্লাহর কাছে চাইলেই আল্লাহ্ তাকে তৎক্ষণাৎ সাড়া দিবেন কি দিবেন না তা ঐ বান্দা কতটুকু আল্লাহর প্রিয় তার উপর নির্ভরশীল। আল্লাহর প্রিয় বলতে ঐ ব্যক্তির ঈমান, আমল, আকিদা কী পর্যায়ের তাঁর উপর নির্ভরশীল। অর্থাৎ বান্দাকে আল্লাহর নৈকট্যশীল হতে হবে।
আল্লাহ্ বলেন,
" হে মুমিনগণ, আল্লাহকে ভয় কর এবং তার নৈকট্যের (লাভের উপায়) অনুসন্ধান কর, আর তার রাস্তায় জিহাদ কর, যাতে তোমরা সফল হও। (আল মায়িদাহ : ৩৫)
অর্থাৎ দুনিয়া এবং আখিরাতের সফলতার জন্য আল্লাহর নৈকট্য লাভের বিভিন্ন উপায় অন্বেষণ করতে হবে। যাকে আরবিতে বলা হচ্ছে ওয়াসীলাহ্। এই বিভিন্ন উপায়, পন্থা, পদ্ধতি বা উছিলা হচ্ছে আল্লাহর কাছে প্রিয় হওয়ার মাধ্যম।
আরও পড়ুন সুফিবাদী সুন্নীদের আকিদা সমূহ
উক্ত আয়াতে আল্লাহ্ একটি উপায় বা উছিলা সরাসরি বলেও দিয়েছেন যে, তোমরা আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করো। যা দ্বারা তোমরা আল্লাহর নৈকট্য লাভ করে সফল হতে পারো।
সর্বসম্মতিক্রমে জিহাদ ছাড়াও আরো অনেক উপায় বা মাধ্যম বা উছিলা আছে। যা দ্বারা বান্দারা আল্লাহর কাছে প্রিয় হতে পারে। অর্থাৎ যেসব কাজ বা আমল করলে ঐ কাজ বা আমল দ্বারা আল্লাহর কাছে সাহায্য, সহযোগিতা, দোয়া ইত্যাদি চাইলে, আল্লাহ্ তা তাঁর বান্দাকে প্রদান করেন।
উছিলার বিভিন্ন রূপ রয়েছে যেমনঃ
প্রথমত রয়েছে আল্লাহর প্রতি পরিপূর্ণ ঈমান। পরবর্তীতে রয়েছে আল্লাহর সুন্দরতম নাম, বান্দার নেক আমল অর্থাৎ সালাত, সিয়াম, হজ্জ্ব, যাকাত, দান, সদকা, জিহাদ, কুরবানি, অন্যায় থেকে বেঁচে থাকা, পাপ থেকে বেঁচে থাকা, বিপদে ধৈর্য্য ধরা ইত্যাদি। যা শুধুমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য করা হয়েছে। সেইসাথে এমন কোনো পরহেজগার, মুত্তাকী, মুমিন জীবিত ব্যক্তি যাকে আল্লাহ্কে পছন্দ করেন। তার উছিলা দিয়ে বা তাঁর মাধ্যমে আল্লাহর কাছে সাহায্য চাওয়া।
সুতরাং কেউ যদি আল্লাহ্কে পেতে চায় (দোয়া প্রার্থনার মাধ্যমে) এবং তাঁর (আখিরাতের) সন্তুষ্টি কামনা করে তাহলে তাকে তার বিভিন্ন আমলের উছিলা দিয়ে ডাকতে হবে। এটাই হচ্ছে আল্লাহ্ এবং আল্লাহর রাসুলের শিক্ষা।
উছিলা নিয়ে বিভ্রান্তিঃ
বর্তমানে উছিলা বলতে সাধারণ মানুষ মৃত পীর অলি আউলিয়াকে বুঝে। যা একটি ভ্রান্ত ধারণা। ইসলামে সূফীবাদ সৃষ্টির পূর্বে কখনোই উছিলা নিয়ে বিভ্রান্তি তৈরি হয়নি। সুফী মতবাদে উছিলাকে নিয়ে যথেষ্ট ঈমান সাংঘর্ষিক বিষয়ের অবতারণা করা হয়েছে।যা বর্তমানে সাধারণ মুসলমানদের মধ্যে অনুপ্রবেশ করেছে।
অধিকাংশ মুসলমান কুরআন এবং হাদিসের জ্ঞানের স্বল্পতার কারণে উছিলা নিয়ে চমর ভুলে নিপতিত আছে। যা তাদেরকে আল্লাহর সাথে শির্কে লিপ্ত করছে।
উছিলা মানে মৃত ব্যক্তি নয়ঃ
কীভাবে আল্লাহ্কে পাওয়া যায় তা ইতিমধ্যে বর্ণনা করা হয়েছে। যেখানে সুস্পষ্ট হয়েছে যে আল্লাহ্ তাঁর বান্দাকে কোনো মাধ্যম(ব্যক্তি) ছাড়াই অবশ্যই সরাসরি সাহায্য করেন এবং বান্দার ডাকে সাড়া দেন।
কিন্তু যারা উছিলার ব্যাখ্যা পীর আউলিয়া করে বসে আছে তারা সরাসরি কুরআন হাদীসের বিরোধী। কেননা তাদের মতে পীর আউলিয়াদের রয়েছে গোপন জ্ঞান বা ইলমে বাতেন। তারা কুরআনের জ্ঞানকে বলে জাহেরী জ্ঞান। এবং এই জ্ঞান পরিপূর্ণ জ্ঞান নয়।
শুধুমাত্র পীর আউলিয়াদেরই গোপন জ্ঞান আছে এবং তারা এই জ্ঞান সরাসরি আল্লাহ্ থেকে প্রাপ্ত। তাই তাদের সাথে আল্লাহর রয়েছে সরাসরি যোগাযোগ। যারফলে তাদের মাধ্যমে বা উছিলায় সরাসরি আল্লাহ্ থেকে সবকিছু পাওয়া যায় এবং যাবে। (নাঊজুবিল্লাহ)
সুফি মতবাদ বর্তমানে তথাকথিত আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতে অনুপ্রবেশ করেছে। তারাও ধরে নিয়েছে পীর আউলিয়াই হচ্ছে একমাত্র উছিলা আল্লাহর কাছে কিছু চাওয়ার জন্য। যেকারণে উপমহাদেশের অধিকাংশ মুসলমানরা আজ বিভ্রান্তিতে পতিত হয়ে ঈমানহারা হচ্ছে।
অথচ ইসলামে গোপন জ্ঞান বা শিক্ষা বলতে কিছু নেই। আল্লাহর রাসুল তাঁর রিসালাতের দায়িত্ব পরিপূর্ণ করে তবেই পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন।
আল্লাহ্ বলেন,
" আজ আমি তোমাদের জন্যে তোমাদের দ্বীনকে পূর্নাঙ্গ করে দিলাম, তোমাদের প্রতি আমার অবদান সম্পূর্ণ করে দিলাম এবং ইসলামকে তোমাদের জন্যে দ্বীন হিসেবে পছন্দ করলাম। " (সূরাঃ আল মায়িদাহ, আয়াতঃ ৩)
অর্থাৎ আল্লাহ্ ইসলামকে কোনো ঘাটতি ছাড়াই পরিপূর্ণ করে দিয়েছেন। ভবিষ্যতের জন্য কোনো কিছু বাকি রাখেননি। শুধু তাই নয়, পবিত্র কুরআনেও কোনো কিছু বাকি নেই লিপিবদ্ধ করতে। সেইসাথে রয়েছে প্রতিটি বিষয়ের সুস্পষ্ট বর্ণনা।
আল্লাহ্ বলেন,
" আমি কিতাবে (কুরআনে) কোন ত্রুটি করিনি ।(আল আনআম : ৩৮)
" আর আমি (হে রাসুল) তোমার প্রতি গ্রন্থ (কুরআন) অবতীর্ণ করেছি প্রত্যেক বিষয়ের স্পষ্ট ব্যাখ্যা স্বরূপ। [ আল নাহল : ৮৯ ]
উপরোক্ত আয়াতে আল্লাহ্ স্পষ্টই ঘোষণা দিচ্ছেন যে, কুরআনে সবই বর্ণনা করা হয়েছে এবং তা সুস্পষ্টভাবে। সুতরাং কেউ যদি বলে কুরআনে সবকিছু নেই। বা কুরআনের জ্ঞান ছাড়াও আরো কিছু আল্লাহর জ্ঞান রয়েছে যা রাসুল আমাদের শিক্ষা দিয়ে যাননি। অথবা রাসুল শুধুমাত্র আলী রাঃকে গোপন শিক্ষা দিয়ে গেছেন (সুফীদের মতানুসারে) আর কাউকে দেননি। তাহলে ঐ ব্যক্তি রাসুলের রিসালাতে বিশ্বাসী নয়। যদি এমন হয় তাহলে তার ঈমান নেই। আল্লাহ্ বলেন,
" অতএব তোমার রবের কসম, তারা মুমিন হবে না যতক্ষণ না তাদের মধ্যে সৃষ্ট বিবাদের ব্যাপারে তোমাকে বিচারক নির্ধারণ করে, তারপর তুমি যে ফয়সালা দেবে সে ব্যাপারে নিজদের অন্তরে কোন দ্বিধা অনুভব না করে এবং পূর্ণ সম্মতিতে মেনে নেয়। (আন নিসা : ৬৫)
এই আয়াত দ্বারা স্পষ্ট যে যতক্ষণ পর্যন্ত সবকিছুর জন্য রাসুল সাঃকে মানদন্ড হিসাবে মানা হবেনা এবং রাসুলের সিদ্ধান্তে সন্তুষ্ট হবেনা ততক্ষণ পর্যন্ত কেউ ঈমানদার হতে পারবে না।
সুতরাং যেখানে রাসুল তাঁর দায়িত্ব শেষ করে গেছেন এটা কুরআন এবং হাদীস দ্বারা স্বীকৃত। সেখানে রাসুল পরবর্তীতে পীর আউলিয়ারা কীভাবে দ্বীন ইসলামে নতুন নতুন ইবাদত পদ্ধতি আবিষ্কার করতে পারে? সেইসাথে এই আকিদা কীভাবে পোষণ করতে পারে যে মৃত ব্যক্তিকে উছিলা করে আল্লাহর কাছে পৌঁছা।
এরা অন্ধকারে ঢিল ছোঁড়ার মতো আমল করছে। যা আল্লাহর কাছে কখনোই পৌঁছাবে না। আল্লাহ্ বলেন,
" বলুন: আমি কি তোমাদেরকে আমলের দিক থেকে সবচেয়ে বেশী ক্ষতিগ্রস্তদের সংবাদ দেব? (তারা হলো ঐ সব লোক) যাদের দুনিয়ার জীবনের সমস্ত প্রচেষ্টা পন্ড হয়ে গেছে, অথচ তারা মনে করত কত সুন্দর কাজই না তারা করছে, তারাই সে সব লোক যারা তাদের রবের আয়াতসমূহ ও তার সাথে সাক্ষাৎকে অস্বীকার করেছে, ফলে তাদের সমস্ত আমল বিনষ্ট হয়ে গেছে, সুতরাং কিয়ামতের দিন তাদের জন্য কোন ওজন স্থাপন করবোনা)। {সূরা আল-কাহ্ফ: ১০৩-১০৫}
এই আয়াত দ্বারা আল্লাহ্ বলেই দিয়েছেন যে, তারা মনে করছে তারা ভালো আমল করছে। কিন্তু আসলেই তাদের আমল কিয়ামতে কোনো কাজেই আসবে না।
সুতরাং মৃত ব্যক্তিকে উছিলা বা আল্লাহর কাছে পৌঁছার মাধ্যম মনে করার সাথে সাথে ঈমান এবং আমল ধ্বংসের নামান্তর।
শুধু তাইনয় যারা পীর আউলিয়াকে আল্লাহর কাছে পৌঁছার উছিলা মনে করছে, সেই পীর আউলিয়ারা নিজেরাই আল্লাহর কাছে পৌঁছার জন্য উছিলা সন্ধান করছে। আল্লাহ্ বলেন
" তারা যাদেরকে (উছিলা ধরে) আহবান করে, তারাই তো (পীর আউলিয়ারা) তাদের প্রতিপালকের (আল্লাহর) নৈকট্য লাভের উপায় (উছিলা) সন্ধান করে যে, তাদের মধ্যে কে কত নিকট হতে পারে, তারা তাঁর দয়া প্রত্যাশা করে ও তাঁর শাস্তিকে ভয় করে; নিশ্চয় তোমার প্রতিপালকের শাস্তি ভয়াবহ। (সূরা বনী ইসরাইল : ৫৭)
এই আয়াতে খুবই স্পষ্ট যে, যারা পীর আউলিয়াকে উছিলা মনে করে সেই পীর আউলিয়ারা নিজেরাই উছিলা তালাশ করে আল্লাহর নিকটে নিকটবর্তী হতে। সেখানে যারা পীর আউলিয়াদের নিজেদের উছিলা মনে করছে তাদের ভবিষ্যৎ (দুনিয়া এবং আখিরাতের) পরিস্থিতি কী হবে ভেবে দেখেছে কি?
আরও পড়ুন সুফি সুন্নীরা শয়তানের অলি
সুপারিশ দ্বারা উছিলার ভ্রান্তিঃ
উছিলার আরেকটি পর্যায় হলো সুপারিশ। আল্লাহর কাছে কোনো কিছুর (দুনিয়া এবং আখিরাতের) ব্যাপারে সুপারিশ করা। অর্থাৎ আল্লাহ্ থেকে কোনো কিছু পাওয়ার জন্য সরাসরি আল্লাহ্কে না ডেকে পীর আউলিয়াদের ডাকা। এবং সেই পীর আউলিয়ারাই (মৃত বা জীবিত অবস্থায়) দুনিয়ায় আল্লাহ্ থেকে সব কিছু পাইয়ে দেন। সেইসাথে আখিরাতেও আল্লাহর কাছে সুপারিশ করে গুনাহগার বান্দাদের পার করে জান্নাতে পৌঁছে দিবেন।
এমন বাতিল আকিদা আজ উপমহাদেশের প্রতিটি মুসলিমের ঘরে ঘরে। অথচ সকল প্রকার সুপারিশ একমাত্র আল্লাহর অধীনে। যদিও আল্লাহ্ নবী, অলি, সত্যবাদী, দ্বীনদার ইত্যাদি পরহেজগার ব্যক্তিরা কিয়ামতে সুপারিশ করতে পারবেন। তবে তা আল্লাহর অনুমতি নিয়ে এবং অনুমতি দিলে তবেই তারা সুপারিশ করতে পারবেন।
আল্লাহ্ বলেন,
" কে আছ এমন, যে সুপারিশ করবে তাঁর(আল্লাহর) কাছে তাঁর (আল্লাহর) অনুমতি ছাড়া? (সূরাঃ আল বাকারা, আয়াতঃ ২৫৫)
সুতরাং আল্লাহর অনুমতি ছাড়া কেউ কখনোই সুপারিশ করতে পারবে না। আল্লাহ্ যাকে অনুমতি দিবেন তিনিই কেবল সুপারিশ করতে পারবেন। সেই হিসাবে যেকোনো সুপারিশের মূল হলো আল্লাহ্। অর্থাৎ আল্লাহ্ যাকে পছন্দ করবেন বা যে আল্লাহর পছন্দ মতো চলবে কেবলমাত্র তিনিই আল্লাহর অলিদের সুপারিশ পেয়ে থাকবেন। অতএব যেকেউ পীর আউলিয়াদের উছিলা ধরলে বা সুপারিশকারী হিসাবে মনে করলেই তিনি সুপারিশ পাবেন না।
কেননা আল্লাহ্ অসংখ্য আয়াতে এটা স্পষ্ট করেছেন যে, যারা আল্লাহর বিধি বিধান মেনে চলবে না তারা কখনোই সাহায্যকারী সুপারিশকারী পাবে না।
বর্তমানে যারা দ্বীন ইসলামের পরিপূর্ণ তোয়াক্কা না করে শুধুমাত্র পীর আউলিয়াদের উছিলা এবং সুপারিশকারী হিসাবে ধরে বসে আছেন, তাদের জন্য আল্লাহ্ বলেন,
" তাদেরকে পরিত্যাগ করুন, যারা নিজেদের ধর্মকে ক্রীড়া ও কৌতুকরূপে গ্রহণ করেছে এবং পার্থিব জীবন যাদেরকে ধোঁকায় ফেলে রেখেছে। কোরআন দ্বারা তাদেরকে উপদেশ দিন, যাতে কেউ স্বীয় কর্মে এমন ভাবে গ্রেফতার না হয়ে যায় যে, আল্লাহ ব্যতীত তার কোন সাহায্যকারী ও সুপারিশকারী নেই এবং যদি তারা জগতের বিনিময়ও প্রদান কবে, তবু তাদের কাছ থেকে তা গ্রহণ করা হবে না। " (সূরাঃ আল আনআম, আয়াতঃ ৭০)
অর্থাৎ যারা ধর্ম কর্ম করে না এবং ধর্ম কর্মকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে জীবনযাপন করছে তাদের জন্য আল্লাহ্ ছাড়া কোনো সাহায্যকারী নেই। অর্থাৎ তাদের জন্য অন্য কেউ সুপারিশ করলেও তা গ্রহণ করা হবেনা।
বর্তমানে অধিকাংশ মুসলমান এবং যারা সুফীবাদে বিশ্বাসী তাদের মূল বিশ্বাসই হলো পীর আউলিয়ারাই তাদের দুনিয়ায় এবং আখিরাতে উদ্ধারের মালিক। দুনিয়ায় যতবেশী পীর আউলিয়াদের (হাদিয়া তোফা, মাজারে মানত, জিয়ারত, ইত্যাদি দ্বারা) সান্নিধ্যে থাকা যাবে ততবেশী আখিরাতে লাভ হবে। অথচ আল্লাহ্ বলেন,
" নিশ্চয় যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে অংশীদার স্থির করে, আল্লাহ তার জন্যে জান্নাত হারাম করে দেন। এবং তার বাসস্থান হয় জাহান্নাম। অত্যাচারীদের কোন সাহায্যকারী নেই। "(সূরাঃ আল মায়িদাহ, আয়াতঃ ৭২)
সুতরাং যারা জেনেশুনে পীর আউলিয়াদের আল্লাহর সাথে শরীক করেছে তাদের জন্য জান্নাত হারাম। এবং তাদের জন্য কোনো সাহায্যকারী নেই। অতএব যাদের সাহায্যকারী নেই তাদের সুপারিশকারী কীভাবে থাকবে?
আল্লাহ্ তাঁর রাসুল সাঃকে লক্ষ্য করে বলেন,
" এমনিভাবেই আমি এ কোরআনকে আরবী ভাষায় নির্দেশরূপে অবতীর্ণ করেছি। (হে রাসুল) যদি আপনি তাদের প্রবৃত্তির অনুসরণ করেন আপনার কাছে জ্ঞান পৌঁছার পর, তবে আল্লাহর কবল থেকে আপনার না কোন সাহায্যকারী আছে এবং না কোন রক্ষাকারী। "(সূরাঃ রা'দ, আয়াতঃ ৩৭)
দেখুন আল্লাহর সাবধানতার বাণী। সর্বজন স্বীকৃত যে রাসুলেরা নিষ্পাপ। তাদের দ্বারা কখনোই পাপ সংঘটিত হতে পারে না। সেখানে আল্লাহ্ তাঁর বান্দাদের শিক্ষা দেওয়ার উদ্দেশ্যে রাসুলকে লক্ষ্য করে বলছেন, আল্লাহ্ ভিন্ন অন্য কোনো পথ অনুসরণ করলে রাসুলেরও কোনো সাহায্যকারী (অর্থাৎ আল্লাহর সাহায্য) নেই। (আল্লাহু আকবর)
সুতরাং যেখানে রাসুল সাঃকে সাবধান করা হচ্ছে, সেখানে আজ অধিকাংশ মানুষ কীভাবে আল্লাহর দ্বীন ছেড়ে জাহেলি যুগের মুশরিকী কর্মকাণ্ডে জড়িত।
অধিকাংশ মুসলমান সালাত, সিয়াম, হজ্জ্ব, যাকাত ইত্যাদি সকল আনুষ্ঠানিক ইবাদত করার পরও পীর আউলিয়াদের দরবারে গিয়ে তাদের সুপারিশ আর উছিলা তালাশ করে। যারা আল্লাহ্কেও মানে আবার শয়তানেরও তোয়াজ করে তারা হচ্ছে মুনাফিক।
আল্লাহ্ বলেন,
" নিঃসন্দেহে মুনাফেকরা রয়েছে দোযখের সর্বনিম্ন স্তরে। আর তোমরা তাদের জন্য কোন সাহায্যকারী কখনও পাবে না। (সূরাঃ আন নিসা, আয়াতঃ ১৪৫)
অতএব যারা দো মুখী মুখ নিয়ে মুনাফিক হয়েছে, তারা জাহান্নামের নিম্নস্তরের বাসিন্দা। তাদের কোনো সাহায্যকারী তথা সুপারিশকারী নেই। তাহলে তারা কী আশায় পীর আউলিয়াদের কবরের গিয়ে উছিলা তালাশ করে?
আরও পড়ুন বিশ্বকাপ ফুটবল এবং আমাদের ঈমান আকিদা
এরাই একদিন যখন শেষ বিচারের মুখোমুখী হবে তারা বলবে,
আল্লাহ্ বলেন,
" সেখানে তারা আর্ত চিৎকার করে বলবে, হে আমাদের পালনকর্তা, বের করুন আমাদেরকে (জাহান্নাম থেকে) , আমরা (রাসুলুল্লাহর অনুসরণে) সৎকাজ করব, পূর্বে যা করতাম(শির্কী বিদআত) , তা করব না। (আল্লাহ বলবেন) আমি কি তোমাদেরকে এতটা বয়স দেইনি, যাতে যা চিন্তা করার বিষয় চিন্তা করতে পারতে? উপরন্তু তোমাদের কাছে সতর্ককারীও আগমন করেছিল। অতএব আস্বাদন কর। জালেমদের জন্যে কোন সাহায্যকারী নেই। "(সূরাঃ ফাতির, আয়াতঃ ৩৭)
অতএব যখন সময় শেষ হয়ে যাবে (অর্থাৎ মৃত্যু) তখন আর করার কিছুই থাকবে না। এখনই চিন্তা করতে হবে পীর আউলিয়ার ব্যাপারে তারা কী সীমালঙ্ঘন করছে। আল্লাহর সুস্পষ্ট ঘোষণা জালেমদের কোনো সাহায্যকারী নেই।
আল্লাহ্ বলেন,
" তারা কসম খায় যে, আমরা বলিনি, অথচ নিঃসন্দেহে তারা বলেছে কুফরী বাক্য এবং মুসলমান হবার পর অস্বীকৃতিজ্ঞাপনকারী হয়েছে । আর তারা কামনা করেছিল এমন বস্তুর যা তারা প্রাপ্ত হয়নি। আর এসব তারই পরিণতি ছিল যে, আল্লাহ ও তাঁর রসূল তাদেরকে সম্পদশালী করে দিয়েছিলেন নিজের অনুগ্রহের মাধ্যমে। বস্তুতঃ এরা যদি তওবা করে নেয়, তবে তাদের জন্য মঙ্গল। আর যদি তা না মানে, তবে তাদের কে আযাব দেবেন আল্লাহ তা’আলা, বেদনাদায়ক আযাব দুনিয়া ও আখেরাতে। অতএব, বিশ্বচরাচরে তাদের জন্য কোন সাহায্যকারী-সমর্থক নেই। " (সূরাঃ আত তাওবাহ, আয়াতঃ ৭৪)
সুতরাং যারা মুনাফিকের মতো এখনো ভুল করছে তাদের ফিরে আসার সময় রয়েছে। যারা আল্লাহ্ এবং আল্লাহর রাসুলের আনীত দ্বীনের ব্যাপারে নতুনত্ব সৃষ্টি এবং সীমালঙ্ঘনের মতো কাজে জড়িত তাদের তওবা করে সঠিক দ্বীনে ফিরে আসার সুযোগ আছে। যদি তারা ফিরে আসে তো ভালো। না হলে তারা আল্লাহর দুনিয়াবী (বিভিন্ন দুঃখ দূর্দশায় পীর আউলিয়ার দরবারে মানতের মাধ্যমে সম্পদ বিনষ্ট) এবং আখিরাতের (জাহান্নামের) আযাবে পতিত হবে।
আরও পড়ুন কুরআন ই হিদায়াত প্রকৃত মাধ্যম
অথচ দুনিয়া এবং আখিরাতের জন্য একমাত্র আল্লাহ্ই তাঁর বান্দার জন্য যথেষ্ট। তিনিই সাহায্যকারী হিসাবে উত্তম সাহায্যকারী দুনিয়া (সকল দুঃখ দূর্দশায় উদ্ধারের জন্য) এবং আখিরাতের (জান্নাত লাভের) জন্য। আল্লাহ্ বলেন,
" বরং আল্লাহ তোমাদের সাহায্যকারী, আর তাঁর সাহায্যই হচ্ছে উত্তম সাহায্য। " (সূরাঃ আল ইমরান, আয়াতঃ ১৫০)
" আর অভিভাবক হিসাবে আল্লাহই যথেষ্ট এবং সাহায্যকারী হিসাবেও আল্লাহই যথেষ্ট। " (সূরাঃ আন নিসা, আয়াতঃ ৪৫)
সুতরাং আমাদের উচিত হবে যিনি সর্বোত্তম সাহায্যকারী (আল্লাহ্) তাঁর দিকে মনোনিবেশ করা। অর্থাৎ আল্লাহ্ এবং আল্লাহর রাসুলের আনীত দ্বীনের উপর ঈমান আকিদা নিয়ে আমল করা। কোনো ভ্রান্ত আকিদায় (সুফীবাদ) আমল করে নিজেদের ঈমান আমল ধ্বংস করা হচ্ছে সবচেয়ে বড় মুর্খামি।
উপরোক্ত আলোচনায় এটা স্পষ্ট যে, আল্লাহ্কে পেতে হলে বা আল্লাহর সন্তুষ্টি পেতে হলে সরাসরি আল্লাহর কাছেই চাইতে হবে। তিনিই সর্বোত্তম সাহায্যকারী এবং একমাত্র সুপারিশকারী।
আল্লাহর কাছে নৈকট্য লাভের জন্য যে উছিলা তালাশ করার কথা বলা হচ্ছে তা কখনোই কোনো মৃত পীর আউলিয়া নয়। সুতরাং আমরা যেন উছিলা নিয়ে কোনো বিভ্রান্তিতে না পড়ি। আল্লাহর কাছে আমরা যেন নেক আমল গুলোর উছিলা দেই। যাতে তিনি আমাদের নেক আমল দেখে আমাদের কবুল করেন এবং সাহায্য করেন।
আরও পড়ুন উছিলা কী? উছিলার বিস্তারিত ব্যাখ্যা
যারা নিজেরা নেক আমল করে না, আল্লাহর রাস্তায় কষ্ট করে না তারা হচ্ছে সুবিধাবাদী। সেইসব সুবিধাবাদীদের জন্য আরেক সুবিধাবাদী গ্রুপ উছিলার ভ্রান্ত দরবার খুলে বসে আছে। যা তাদেরকে বিপথে নিয়ে যাচ্ছে। এরাই হচ্ছে শয়তানের সেইসব সাথী। যাদেরকে জাহান্নামী করতে শয়তান আল্লাহর কাছে ওয়াদা করেছে।আল্লাহ্ বলেন,
" সে (শয়তান) বলল, আপনার ইযযতের কসম, আমি অবশ্যই তাদের সবাইকে বিপথগামী করে দেব। তবে তাদের মধ্যে যারা আপনার খাঁটি বান্দা, তাদেরকে ছাড়া। (সূরাঃ ছোয়াদ, আয়াতঃ ৮২, ৮৩)
সুতরাং যারা নেক আমলের মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য চাইবে তারা আল্লাহর খাঁটি বান্দা। যারা নেক আমল ছাড়া কোনো প্রকার কষ্ট বিবর্জিত উপায়ে (টাকা পয়সা ধন দৌলত দিয়ে) আল্লাহর কাছে পৌঁছাতে চেষ্টা করবে তারা হচ্ছে বিপথগামী। আর তারাই শয়তানের অনুসারী।
অতএব, আল্লাহ্কে পেতে কখনোই কোনো ব্যক্তি মাধ্যমের প্রয়োজন নেই। তিনি সরাসরি তাঁর বান্দাদের শোনেন জানেন এবং সাহায্য করেন। সুতরাং আমরা যেন এক একক অদ্বিতীয় আল্লাহ্কে স্বীকার করে সাহায্যকারী পাওয়ার জন্য তাঁর সাথে কাউকে শরিক না করি।
সাখাওয়াতুল আলম চৌধুরী
২৭ অক্টোবর ২০২১,
পতেঙ্গা, চট্টগ্রাম।