পথপ্রদর্শক কী? মুমিনের প্রকৃত অভিভাবক ও পথপ্রদর্শক কে? |
পথপ্রদর্শক কী? মুমিনের প্রকৃত অভিভাবক ও পথপ্রদর্শক কে?
আল্লাহ পৃথিবীতে মানুষ পাঠিয়েছেন ইবাদতের মাধ্যমে তাঁর সন্তুষ্টির অর্জন করতে। তাই প্রতিটি মানুষেরই প্রধান কাজ হচ্ছে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা। যার প্রথম পদক্ষেপ হলো ইমান আনা। আর মুমিনরা ইমান আনার পর সঠিক রাস্তায় চলতে হলে প্রয়োজন একজন প্রকৃত পথপ্রদর্শকের। যে মুমিনকে আল্লাহর সঠিক পথে পরিচালিত হতে সাহায্য করবে। এখন আমরা কুরআনের আলোকে জানার চেষ্টা করবো একজন মুমিনের প্রকৃত পথপ্রদর্শক কে? অর্থাৎ একজন মুমিনকে কে সর্বাবস্থায় সঠিক পথ দেখিয়ে সঠিক রাস্তায় পরিচালিত করেন।
পথপ্রদর্শকের অর্থ কী
পথপ্রদর্শকের অর্থ হলো যে বা যিনি কাউকে কোনো গন্তব্যে পৌঁছাতে সাহায্য করেন। অর্থাৎ কেউ তার গন্তব্যের পথ না চিনলে তাকে গন্তব্য পর্যন্ত পৌঁছাতে যিনি সাহায্য করেন তিনি ই হচ্ছেন পথপ্রদর্শক। ইসলামী পরিভাষায় একজন মুমিনকে যিনি আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য পথ দেখান তিনি হচ্ছেন মুমিনের পথপ্রদর্শক।
একজন মুমিন দুনিয়ায় হাজারো পথ দেখতে পায়। কিন্তু সে বুঝতে পারে না যে, কোন পথটি সঠিক ও নির্ভুল। বা কোন পথে চললে আল্লাহর সঠিক রাস্তায় যাওয়া যাবে। তাই সর্বাবস্থায় মুমিনের একজন প্রকৃত পথপ্রদর্শক দিক নিদর্শনকারী প্রয়োজন। সুতরাং যে তাকে সঠিক পথে চলতে সাহায্য করে সে ই হচ্ছেন প্রকৃত পথপ্রদর্শক।
আরও পড়ুন মাজারে দান সদকা করার ইসলামী বিধান
পথপ্রদর্শকের প্রকারভেদঃ
পথপ্রদর্শক দুই প্রকারের। একজন পথপ্রদর্শক হচ্ছেন, যিনি রাস্তা দেখিয়ে দেন। আরেকজন পথপ্রদর্শক হচ্ছেন, যিনি নিজেই সঠিক রাস্তায় একজন মুমিনকে নিয়ে যান। একটি উদাহরণের মাধ্যমে বিষয়টি আরও পরিষ্কার করে বুঝার চেষ্টা করি।
ধরুন কেউ একজন একটি নির্দিষ্ট গন্তব্যে যেতে চায়। কিন্তু সে জানে না গন্তব্যটি কোথায় অবস্থিত এবং এর যাওয়ার রাস্তা কী। তখন সে জানাশোনা কাউকে জিজ্ঞাসা করলে, সে তাকে ঐ গন্তব্য সম্পর্কে বিস্তারিত বলে দেয় যে, কীভাবে কোন রাস্তায় গেলে সে ঐ গন্তব্যে পৌঁছাতে পারবে। তাহলে যিনি গন্তব্যের ঠিকানা বলে দিলেন তিনি একজন পথপ্রদর্শক।
ঠিক একইভাবে কেউ যখন কোনো গন্তব্য সম্পর্কে জানতে চায় এবং কোনো জানাশোনা লোক ঐ ব্যক্তিকে বলে যে, আমিও সেই গন্তব্যে যাবো এবং আমি তা চিনি, চলুন আমার সঙ্গে। আমিই আপনাকে সেই গন্তব্যে পৌঁছে দিবো। তাহলে এই জানাশোনা ব্যক্তিটিও একজন পথপ্রদর্শক। যিনি নিজ হাতে নিজ দায়িত্বে একজনকে তার সঠিক গন্তব্যে সঠিক রাস্তায় সঠিক উপায়ে পৌঁছে দেন। এবং ইনিই হচ্ছেন প্রকৃত পথপ্রদর্শক। কেননা তিনি নিজেই সঠিক গন্তব্য সম্পর্কে অবগত। সুতরাং পথপ্রদর্শক দুই ধরনের।
এক) যিনি দূর থেকে গন্তব্যের রাস্তা দেখিয়ে দেন।
দুই) যিনি নিজেই সাথে করে গন্তব্যে পৌঁছে দেন।
মুমিনের প্রকৃত পথপ্রদর্শক কে
আমরা দুই ধরনের পথপ্রদর্শকের কথা জানতে পারলাম। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, প্রকৃত পথপ্রদর্শক কে? অবশ্যই তিনিই প্রকৃত পথপ্রদর্শক, যিনি নিজ হাতে সঠিক রাস্তায় মুমিনকে পৌঁছে দিবেন।
আল্লাহ যুগে যুগে বিভিন্ন জাতি গোষ্ঠী সম্প্রদায়ের কাছে নবি রাসুলদের (আ:) পাঠিয়েছেন যারা আল্লাহর রাস্তায় ঐসব জাতি গোষ্ঠী সম্প্রদায়কে পরিচালিত করতে। এইসব নবি রাসুলগণ তাদের জাতি গোষ্ঠীদের বিভিন্ন নসিহত ও প্রমাণের মাধ্যমে আল্লাহর রাস্তার ঠিকানা বাতলে দিয়েছেন। যাতে তারা ইমানদার হয়ে সঠিক গন্তব্য তথা জান্নাতে পৌঁছাতে পারে।
এইসব জাতি গোষ্ঠীর মধ্যে কেবলমাত্র তারাই ইমান আনতে সক্ষম হয়েছেন যাদের আল্লাহ নিজেই পথ দেখিয়ে হেদায়েত দিয়েছেন। সুতরাং নবি রাসুল (আ:) গণ হচ্ছেন পথপ্রদর্শক। যারা মানুষদের সঠিক রাস্তা দেখায়। আর আল্লাহ হচ্ছেন ঐ পথপ্রদর্শক, যিনি নিজেই কাউকে হেদায়েত দিয়ে সঠিক রাস্তায় চলতে সাহায্য করেন।
কেননা হেদায়েত একমাত্র আল্লাহর হাতে। তিনিই যাকে পথ দেখাবেন একমাত্র সে-ই সঠিক পথ পাবে। তিনি যাকে পথভ্রষ্ট করবেন তাকে কেউ পথ দেখাতে পারবে না। যেহেতু আল্লাহ জানেন সঠিক পথ কোনটি? এবং তিনি নিজেই যেহেতু বান্দাকে হেদায়েত দিয়ে থাকেন। সেহেতু প্রকৃত পথপ্রদর্শক কোনো ব্যক্তি নয়। প্রকৃত পথপ্রদর্শক হচ্ছেন একমাত্র আল্লাহ। এখন আমরা কুরআন হাদিসের আলোকে জানার চেষ্টা করব কীভাবে আল্লাহ মুমিনের প্রকৃত পথপ্রদর্শক।
আরও পড়ুন কবর পাকা করার দলিল খন্ডন
মুমিনের অভিভাবক হচ্ছেন একমাত্র আল্লাহ
মুমিনদের একমাত্র অভিভাবক হচ্ছেন আল্লাহ। তিনি বলেন,
"যারা ইমান এনেছে, আল্লাহ তাদের অভিভাবক। তাদেরকে তিনি বের করে আনেন অন্ধকার থেকে আলোর দিকে।" (সুরা: আল বাকারা, আয়াত: ২৫৭)
"আর অভিভাবক হিসাবে আল্লাহই যথেষ্ট এবং সাহায্যকারী হিসাবেও আল্লাহই যথেষ্ট।" (সুরা: আন নিসা, আয়াত: ৪৫)উপর্যুক্ত আয়াতসহ অসংখ্য আয়াতে আল্লাহ ঘোষণা দিয়েছেন যে, প্রতিটি মুমিন ইমানদারের একমাত্র অভিভাবক হচ্ছেন আল্লাহ। তিনিই মুমিনের অভিভাবক এবং সাহায্যকারী।
আর অভিভাবক তাকেই বালা হয়, যিনি কারো ভালো মন্দ ভবিষ্যৎ ইত্যাদি সবকিছুর দায়িত্ব নিয়ে নেন। যেমন পিতা মাতা তার সন্তানের অভিভাবক। ঠিক তেমনি আল্লাহ বান্দার জন্য তার পিতামাতার চাইতে অধিক ও সর্বাধিক যত্নশীল এবং দায়িত্ববান। সুতরাং যে মুমিন আল্লাহকে নিজের অভিভাবক করতে পেরেছে, সে-ই হচ্ছে সফল এবং সঠিক পথপ্রাপ্ত।
ব্যক্তি কখনোই বান্দার অভিভাবক নয়
আল্লাহর সাহায্য ও অভিভাবকত্ব ছাড়া কোনো মুমিনের জন্য কোনো ব্যক্তি কখনোই অভিভাবক হতে পারে না। আল্লাহ বলেন,
"কাফেররা কি মনে করে যে, তারা আমার পরিবর্তে আমার বান্দাদেরকে অভিভাবক রূপে গ্রহণ করবে? আমি কাফেরদের অভ্যর্থনার জন্যে জাহান্নামকে প্রস্তুত করে রেখেছি"। (সুরা: কাহফ, আয়াত: ১০২)উপর্যুক্ত আয়াতে আল্লাহর পরিবর্তে কোনো ব্যক্তি বা আল্লাহর কোনো বান্দাদের অভিভাবক হিসাবে গ্রহণ করাকে তিরস্কার করা হয়েছে। যদিও আয়াতটি কাফেরদের জন্য নাযিল হয়েছে, তবুও যারা আল্লাহর পরিবর্তে বান্দাদের অভিভাবক হিসাবে গ্রহণ করবে তাদের অবস্থান হবে জাহান্নাম। অপর আয়াতে আল্লাহ বলেন,
"তারা কি আল্লাহ ব্যতীত অপরকে অভিভাবক স্থির করেছে? পরন্তু আল্লাহই তো একমাত্র অভিভাবক।" (সুরা: আশ-শুরা, আয়াত: ৯)
এই আয়াতেও আল্লাহ আশ্চর্য হচ্ছেন যে, তাঁকে ছাড়া কীভাবে অন্যকে তাঁর বান্দারা অভিভাবক হিসাবে গ্রহণ করছে। সুতরাং কুরআন সুন্নাহর বাইরে গিয়ে সুফিবাদী পীর অলি আউলিয়াদের কখনোই অভিভাবক মানা যাবে না। কেননা তাদের আকিদা সরাসরি কুরআন সুন্নাহ বিরোধী। অতএব আল্লাহ ব্যতীত কখনোই অন্য কেউ প্রকৃত অভিভাবক হতে পারেন না।
আরও পড়ুন সুফি সুন্নিদের পীর আউলিয়া সম্পর্কিত আকিদার জবাব
আল্লাহ ব্যতীত অভিভাবক নেই
প্রতিটি মানুষের জন্যই আল্লাহই একমাত্র অভিভাবক। তিনি ছাড়া অন্য কেউই বান্দার অভিভাবক হতে পারে না। আল্লাহ পবিত্র কুরআনে বলেন,
"(একমাত্র আল্লাহ) তিনি ব্যতীত তোমাদের কোন অভিভাবক ও সুপারিশকারী নেই। এরপরও কি তোমরা বুঝবে না? (সুরা: সেজদাহ, আয়াত: ৪)
উপর্যুক্ত আয়াতে আল্লাহ দ্ব্যর্থহীনভাবে ঘোষণা দিচ্ছেন যে, আল্লাহ হচ্ছেন বান্দার একমাত্র অভিভাবক। তিনি ছাড়া কোনো অভিভাবক নেই। যদি কেউ আল্লাহ ব্যতীত অন্য কাউকে অভিভাবক মেনে নেয়, তার প্রতি আল্লাহর বিশেষ নজরদারি থাকে। আল্লাহ তাদের কর্মকান্ড লক্ষ্য রাখেন। আল্লাহ বলেন,
"যারা আল্লাহ ব্যতীত অপরকে অভিভাবক হিসাবে গ্রহণ করে, আল্লাহ তাদের প্রতি লক্ষ্য রাখেন। আপনার উপর নয় তাদের দায়-দায়িত্ব।" (সুরা: আশ-শুরা, আয়াত: ৬)
অর্থাৎ যারা আল্লাহর পরিবর্তে অন্যকে অভিভাবক হিসাবে গ্রহণ করে তাদের অনুযায়ী আমল করবে, তাদের আমল গুলো আল্লাহ লক্ষ্য করেন। যাতে তাদের আমল গুলোর প্রতিদান তিনি দিতে পারেন। আর সেই প্রতিদান কখনোই শুভ হবেনা। সুতরাং আল্লাহ ছাড়া বান্দার জন্য কখনোই কোনো ব্যক্তি অভিভাবক হতে পারে না। কেননা আল্লাহ বলেন,
"বলুন! কে তোমাদেরকে আল্লাহ থেকে রক্ষা করবে যদি তিনি তোমাদের অমঙ্গল ইচ্ছা করেন অথবা তোমাদের প্রতি অনুকম্পার ইচ্ছা? তারা আল্লাহ ব্যতীত নিজেদের কোন অভিভাবক ও সাহায্যদাতা পাবে না। (সুরা: আল আহযাব, আয়াত: ১৭)
কুরআনের আলোকে উপর্যুক্ত আয়াত গুলো থেকে এটাই প্রমাণিত হয় যে, আল্লাহ ছাড়া তাঁর বান্দাদের আর কোনো অভিভাবক নেই। তাই একমাত্র আল্লাহকেই বান্দাদের অভিভাবক হিসাবে গ্রহণ করা উচিত।
মুমিনের পথপ্রদর্শক একমাত্র আল্লাহ
প্রতিটি মুমিনের একমাত্র পথপ্রদর্শক হচ্ছেন আল্লাহ। আল্লাহ বলেন,
"আল্লাহ যাকে পথ প্রদর্শন করেন, সেই তো সঠিক পথ প্রাপ্ত এবং যাকে পথ ভ্রষ্ট করেন, তাদের জন্যে আপনি আল্লাহ ছাড়া কোন সাহায্যকারী পাবেন না"। (সুরা: বনী ইসরাঈল, আয়াত: ৯৭)
উপর্যুক্ত আয়াতে আল্লাহ স্পষ্ট করে জানিয়ে দিচ্ছেন যে, আল্লাহ যাকে পথ দেখাবেন একমাত্র সেই ব্যক্তিই সঠিক পথ পাবে। আর যাকে পথভ্রষ্ট করবেন তার জন্যও আল্লাহ ছাড়া আর কোনো সাহায্যকারী নেই। সুতরাং বান্দার জন্য শুধুমাত্র আল্লাহই হচ্ছেন প্রকৃত পথপ্রদর্শক। যিনি তাঁর পছন্দের বান্দাদের নিজ দায়িত্ব সঠিক পথে পরিচালিত করেন। শুধু তাইনয় আল্লাহ আরও বলেন,
"আর আল্লাহ যাকে পথপ্রদর্শন করেন, তাকে পথভ্রষ্টকারী কেউ নেই।" (সুরা: আল-যুমার, আয়াত: ৩৭)অর্থাৎ আল্লাহ নিজে যাকে পথ দেখাবেন তাকে কোনো ব্যক্তি বা অন্যান্য কোনো মাধ্যম পথভ্রষ্ট করতে পারে না। সুতরাং প্রকৃত পথপ্রদর্শক হচ্ছেন একমাত্র আল্লাহ।
আরও পড়ুন প্রবৃত্তির অনুসরণ ও তার পরিনতি
পথভ্রষ্ট ব্যক্তির পথপ্রদর্শক নেই
আল্লাহ নিজেই যাকে পথভ্রষ্ট করে দেন, তাকে উদ্ধারের জন্য কোনো পথপ্রদর্শনকারী নেই। আল্লাহ বলেন,
"আর আল্লাহ যাকে গোমরাহ করেন, তার কোন পথপ্রদর্শক নেই।" (সুরা: আল-যুমার, আয়াত: ২৩)
"আল্লাহ যাকে পথভ্রষ্ট করেন, তার কোন পথপ্রদর্শক নেই।"(সুরা: আল-মু'মিন, আয়াত: ৩৩)
সুতরাং আল্লাহ যাকে নিজে গোমরাহ বা পথভ্রষ্ট করবে, তার কোনো পথপ্রদর্শক নেই। কেননা আল্লাহই বান্দাদের একমাত্র পথপ্রদর্শক। শুধু তাইনয় আল্লাহ যাদের পথভ্রষ্ট করেন তাদের তিনি বিভিন্নভাবে তাদের আল্লাহ বিরোধী কর্মকাণ্ডে নিয়োজিত রাখেন। আল্লাহ বলেন,
"আল্লাহ যাকে পথভ্রষ্ট করেন। তার কোন পথপ্রদর্শক নেই। আর আল্লাহ তাদেরকে তাদের দুষ্টামীতে মত্ত অবস্থায় ছেড়ে দিয়ে রাখেন"। (সুরা: আল আ'রাফ, আয়াত: ১৮৬)
পথভ্রষ্টদের জন্য শয়তান নিয়োগ
যারা কুরআন সুন্নাহর বাইরে গিয়ে অন্য কাউকে তাদের অভিভাবক বানায় এবং আল্লাহ থেকে দূরে সরে যায়। তাদের জন্য আল্লাহ নিজেই শয়তান নিয়োগ করে দেন। আল্লাহ বলেন,
"যে ব্যক্তি দয়াময় আল্লাহর স্মরণ থেকে চোখ ফিরিয়ে নেয়, আমি তার জন্যে এক শয়তান নিয়োজিত করে দেই, অতঃপর সে-ই হয় তার সঙ্গী"। (সুরা: যুখরুফ, আয়াত: ৩৬)
অর্থাৎ যারা প্রকৃত ইসলামের পরিবর্তে সুফি সুন্নি আকিদা গ্রহণ করে, তাদের জন্য আল্লাহ নিজেই একটি শয়তান নিয়োগ করেন। আর তারা মনে করে তারা যা আমল করছে তা আসলেই সঠিক। আল্লাহ বলেন,
"শয়তানরাই মানুষকে সৎপথে বাধা দান করে, আর মানুষ মনে করে যে, তারা সৎপথে রয়েছে।" (সুরা: যুখরুফ, আয়াত: ৩৭)
"তারাই সে লোক, যাদের প্রচেষ্টা পার্থিবজীবনে বিভ্রান্ত হয়, অথচ তারা মনে করে যে, তারা সৎকর্ম করেছে।" (সুরা: কাহফ, আয়াত: ১০৪)
অতএব, পথভ্রষ্ট ব্যক্তির কোনো পথপ্রদর্শক নেই। যারা সঠিক ইসলাম ছেড়ে সুফিবাদ গ্রহণ করেছে, তারা মনে করছে এটাই আসল ইসলাম। কিন্তু না, এটা ভুল। কেননা শয়তানই তাদের চোখে কুরআন সুন্নাহ বিরোধী কর্মকান্ডকে সুশোভিত করে তুলেছে। আর তারা মনে করছে তারা যা করছে তা ই সঠিক। সুতরাং পীর অলি আউলিয়ারা কখনোই প্রকৃত পথপ্রদর্শক নয়।
আরও পড়ুন বর্তমান সমাজের মুনাফিকের পরিচয় ও পরিনতি
নবি রাসুলদের পথপ্রদর্শকও আল্লাহ
প্রতিটি নবি রাসুলদের আল্লাহ নিজেই পথপ্রদর্শন করেছেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) কে লক্ষ্য করে আল্লাহ বলেন,
"তিনি আপনাকে পেলেন পথহারা অবস্থায়, অতঃপর তিনি পথের নির্দেশ দিলেন।" (সুরা: আদ্ব-দ্বোহা, আয়াত: ৭)
উপর্যুক্ত আয়াতে রাসুলুল্লাহর নবুওয়াত প্রাপ্তির আগে এবং পরের কথা বলা হচ্ছে। রাসুলুল্লাহ ছাড়াও হযরত ইব্রাহীম (আ:) এর কথাও কুরআনে এসেছে এভাবে,
"যিনি আমাকে সৃষ্টি করেছেন, অতঃপর তিনিই আমাকে পথপ্রদর্শন করেন।" (সুরা: আশ-শো'আরা, আয়াত: ৭৮)
"সে (ইব্রাহীম (আ:) বললঃ আমি আমার পালনকর্তার দিকে চললাম, তিনি আমাকে পথপ্রদর্শন করবেন।" (সুরা: আস-সাফফাত, আয়াত: ৯৯)
সুতরাং প্রকৃত পথপ্রদর্শক একমাত্র আল্লাহ। যিনি নবি রাসুলসহ সবাইকে তাদের অবস্থান মোতাবেক পথ দেখিয়ে থাকেন।
একটি দ্বন্দ্বের নিরসন
কুরআন বলছে একমাত্র আল্লাহই বান্দার পথপ্রদর্শক। আর সুফি সুন্নিরা দাবি করে তাদের পীর অলি আউলিয়ারাওহেদায়েতের মালিক ও বান্দার পথপ্রদর্শক। তাহলে এখানে একটি দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়।
কারণ পীর অলি আউলিয়ারা কোনো ব্যক্তির প্রকৃত পথপ্রদর্শক হতে পারে না। তারা শুধু মুরিদদের রাস্তা দেখিয়ে দিতে পারে মাত্র। যেমন নবি রাসুলগণ তাদের বিভিন্ন উম্মতদের আল্লাহর রাস্তা দেখিয়ে গেছেন। আর তাদের পীরদের দেখানো রাস্তা যে সঠিক ও নির্ভুল তা কিন্তু কেউ কখনোই নিশ্চয়তা দিতে পারে না। কেননা সুফি সুন্নিদের যেসব আকিদা রয়েছে তা সরাসরি ইসলামী বিরোধী আকিদা।
সুতরাং যাদের ইমান আকিদায় ইসলামের সংস্পর্শ নেই বরং শিরক বিদআতের ভরপুর; তারা কীভাবে ভক্ত মুরিদদেরহেদায়েত দিতে পথপ্রদর্শক হতে পারে? সুফি সুন্নিরা কুরআনের একটি আয়াত থেকে দলিল দেওয়ার চেষ্টা করে যে, পীরেরাই বান্দার পথপ্রদর্শক। আল্লাহ বলেন,
"আল্লাহ যাকে সৎপথে চালান, সেই সৎপথ প্রাপ্ত এবং তিনি যাকে পথভ্রষ্ট করেন, আপনি কখনও তার জন্যে পথপ্রদর্শনকারী ও সাহায্যকারী পাবেন না।" (সুরা: কাহফ, আয়াত: ১৭)
উপর্যুক্ত আয়াত দিয়ে সুফিরা দাবি করে যে, আল্লাহ যাকে সৎ পথে চালান তাকে তিনি পীর ধরার তৌফিক দেন। যাকে তিনি পথভ্রষ্ট করেন তার জন্য তিনি কোনো পীরের ব্যবস্থা করেন না। অর্থাৎ আল্লাহ পথপ্রদর্শন করেন পীর ধরার মাধ্যমে।
আরও পড়ুন তাওহিদ কী কীভাবে আল্লাহর তাওহিদ ক্ষুন্ন হয়
তাদের দাবির পক্ষে কুরআন থেকে সরাসরি কোনো আয়াত তারা দলিল দিতে পারে না। তারা যে আয়াত দ্বারা পীর অলি আউলিয়ার দলিল দেওয়ার চেষ্টা করে, সেই আয়াতও তাদের বিপক্ষে সাক্ষী দেয়। তাদের দলিলকৃত আয়াতটি হলো,
"হে ইমানদারগণ! আল্লাহর নির্দেশ মান্য কর, নির্দেশ মান্য কর রসূলের এবং তোমাদের মধ্যে যারা বিচারক তাদের। তারপর যদি তোমরা কোন বিষয়ে বিবাদে প্রবৃত্ত হয়ে পড়, তাহলে তা আল্লাহ ও তাঁর রসূলের প্রতি প্রত্যর্পণ কর-যদি তোমরা আল্লাহ ও কেয়ামত দিবসের উপর বিশ্বাসী হয়ে থাক। আর এটাই কল্যাণকর এবং পরিণতির দিক দিয়ে উত্তম"। (সুরা: আন নিসা, আয়াত: ৫৯)
উপর্যুক্ত আয়াতে আল্লাহ সুস্পষ্ট জানিয়ে দিচ্ছেন যে, সর্বাবস্থায় আল্লাহ এবং রাসুলের আদেশ নির্দেশই মানতে হবে। সেইসাথে মানতে হবে যারা দ্বীন ইসলামের নেতৃবৃন্দ তাদের। অর্থাৎ কুরআন হাদিসের আলোকে ইসলামী আইনকানুন মানার পাশাপাশি সমাজের মুসলিম নেতৃবৃন্দদেরও আনুগত্য করতে হবে।
সুফি সুন্নিরা মুসলিম নেতৃবৃন্দের আনুগত্যের কথা বলে পীর মুরিদী জায়েজ করে। এই আয়াতে আল্লাহ এবং রাসুলের আনুগত্য করাকে নিঃশর্ত করা হয়েছে। অথচ আল্লাহ একই আয়াতে মুসলিম নেতৃবৃন্দের আনুগত্যের জন্য শর্ত জুড়ে দিয়েছেন। অর্থাৎ যদি মুসলিম নেতৃত্ব কোনো কারণে কুরআন হাদিসের বিরুদ্ধে চলে যায়। তাহলে সেই নেতৃত্ব আর মানা যাবে না।
এখন কথা হচ্ছে সুফিরা যেসব আকিদায় বিশ্বাসী, সেইসব আকিদা সুস্পষ্ট কুরআন সুন্নাহর বিরোধী। সুতরাং উপর্যুক্ত আয়াত দ্বারা যারা কুরআন সুন্নাহ বিরোধী তাদের আনুগত্য কখনোই করা যাবে না। সেই হিসাবে সুফি সুফিবাদ এবং পীর মুরিদীও মানা যাবে না। অতএব পীর অলি আউলিয়ারা কখনোই কারো প্রকৃত পথপ্রদর্শক হতে পারে না।
তবে হ্যাঁ, কুরআন সুন্নাহর অনুসারী যেকোনো হাক্কানী আলেম ওলেমা, উস্তাদ, শায়খ ইত্যাদির অনুসরণ করা যাবে। অর্থাৎ যারাই কুরআন সুন্নাহর অনুসারী হবে শুধুমাত্র তাদেরকেই অনুসরণ করা যাবে। তবে তা সুফিদের একক কোনো পীর নয়। সুফিবাদে বান্দা যেকোনো একজন পীরের কাছেই জ্ঞানার্জন করতে পারবে। যা শরীয়ত সম্মত নয়। তাই একক পীর অলি আউলিয়ারা কখনোই বান্দার প্রকৃত পথপ্রদর্শক নয়।
আরও পড়ুন বিশ্বকাপ ফুটবল এবং আমাদের ঈমান আকিদা
ব্যক্তিহেদায়েতের মালিক নয়
ইসলামে একমাত্র আল্লাহইহেদায়েতের মালিক এবং পথপ্রদর্শক। ব্যক্তি কখনোইহেদায়েতের মালিক নয়। অথচ সুফি সুন্নিরা দাবি করে পীর অলি আউলিয়ারা তাদের মুরিদদের হেদায়েতের মালিক। এই পীর আউলিয়ারাই কিয়ামতের দিন তাদের আল্লাহর হাত থেকে বাঁচিয়ে জান্নাতে নিয়ে যাবে। সুতরাং পীর আউলিয়াদেরই অনুসরণ করতে হবে এটাই সুফিদের আকিদা। যা সুস্পষ্ট কুরআন সুন্নাহ বিরোধী। কেননাহেদায়েত ও পথপ্রদর্শকের মালিক একমাত্র আল্লাহ। এমনকি রাসুল (সা.) ও কাউকে হেদায়েত দিতে পারেন না। আল্লাহ বলেন,
"(হে রাসুল) আপনি যাকে পছন্দ করেন, তাকে সৎপথে আনতে পারবেন না, তবে আল্লাহ তা’আলাই যাকে ইচ্ছা সৎপথে আনয়ন করেন। কে সৎপথে আসবে, সে সম্পর্কে তিনিই ভাল জানেন"। (সুরা: আল কাসাস, আয়াত: ৫৬)
উপর্যুক্ত আয়াত যা রাসুলের প্রাণপ্রিয় চাচা আবু তালেবের মৃত্যুর সময় নাযিল হয়েছিল। এই আয়াতে রাসুল (সা.) কে সম্বোধন করে আল্লাহ আমাদের শিক্ষা দিচ্ছেন যে, পৃথিবীতে আল্লাহ ব্যতীত কারো হাতেই হেদায়েত ও সঠিক পথপ্রদর্শনের ক্ষমতা নেই। আল্লাহই যাকে চান তাকে সৎপথ দিয়ে থাকেন। সুতরাং যেখানে রাসুল দ্বারা কারো হেদায়েত নিশ্চিত নয় সেখানে কীভাবে কথিত পীর অলি আউলিয়ারা বান্দাদেরহেদায়েতের ও পথপ্রদর্শকের মালিক হতে পারে?
আরও পড়ুন ঈমান কী? পরিপূর্ণ ঈমানের বিস্তারিত ব্যাখ্যা
পথপ্রদর্শকের প্রকৃত মাধ্যম
পবিত্র কুরআনে অসংখ্য আয়াতে এসেছে প্রথমত আল্লাহই মুমিনের পথপ্রদর্শক। কিন্তু আল্লাহ তো সরাসরি দুনিয়ায় এসে কাউকে হেদায়েত তথা পথপ্রদর্শন করেন না । তাই তিনি যুগে যুগে বিভিন্ন নবি রাসুল পাঠিয়েছেন মানুষদের সৎপথে চলে আল্লাহকে ডাকার জন্য। কিন্তু নবি রাসুলগণ চিরস্থায়ী নন। রাসুল পরবর্তীতে কীভাবে আল্লাহ বান্দাকে পথপ্রদর্শন করবেন? এই প্রশ্নের উত্তর আমরা জানার চেষ্টা করবো পবিত্র কুরআন থেকে। আল্লাহ বলেন,
"আর আমি (হে মুহাম্মদ) তোমার উপর কিতাব নাযিল করেছি প্রতিটি বিষয়ের স্পষ্ট বর্ণনা, হিদায়াত, রহমত ও মুসলিমদের জন্য সুসংবাদস্বরূপ।’ (সূরা আন-নাহল- ৮৯)
"হে মানবকুল, তোমাদের কাছে উপদেশবানী (অর্থাৎ কুরআন) এসেছে তোমাদের পরওয়ারদেগারের পক্ষ থেকে এবং অন্তরের রোগের নিরাময়, হেদায়েত ও রহমত মুসলমানদের জন্য।" (সুরা: ইউনুস, আয়াত: ৫৭)
"এমনিভাবে আমি সুস্পষ্ট আয়াত রূপে কোরআন নাযিল করেছি এবং আল্লাহ-ই যাকে ইচ্ছা হেদায়েত করেন।" (সুরা: হাজ্জ্ব, আয়াত: ১৬)
"এবং নিশ্চিতই এটা (কুরআন) মুমিনদের জন্যে হেদায়েত ও রহমত।" (সুরা: নমল, আয়াত: ৭৭)
"এ সেই কিতাব যাতে কোনই সন্দেহ নেই। পথ প্রদর্শনকারী পরহেযগারদের জন্য।" (সুরা: আল বাকারা, আয়াত: ২)
"আল্লাহ উত্তম বাণী তথা কিতাব নাযিল করেছেন, যা সামঞ্জস্যপূর্ণ, পূনঃ পূনঃ পঠিত। এতে তাদের লোম কাঁটা দিয়ে উঠে চামড়ার উপর, যারা তাদের পালনকর্তাকে ভয় করে, এরপর তাদের চামড়া ও অন্তর আল্লাহর স্মরণে বিনম্র হয়। এটাই আল্লাহর পথ নির্দেশ, এর মাধ্যমে আল্লাহ যাকে ইচ্ছা পথ প্রদর্শন করেন। আর আল্লাহ যাকে গোমরাহ করেন, তার কোন পথপ্রদর্শক নেই।" (সুরা: আল-যুমার, আয়াত: ২৩)
"আমি তোমাদের প্রতি একটি কিতাব অবর্তীর্ণ করেছি; এতে তোমাদের জন্যে উপদেশ রয়েছে। তোমরা কি বোঝ না?" (সুরা: আম্বিয়া, আয়াত: ১০)
"আর এটাই আপনার পালনকর্তার সরল পথ। আমি উপদেশ গ্রহণকারীদের জন্যে আয়াতসমূহ পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ননা করেছি।" (সুরা: আল আনআম, আয়াত: ১২৬)
উপর্যুক্ত আয়াত গুলো থেকে এটা খুবই সুস্পষ্ট যে, আল্লাহ মানুষকে হেদায়েত তথা সঠিক পথপ্রদর্শন করেন পবিত্র কুরআনের মাধ্যমে। অর্থাৎ পবিত্র কুরআনে আল্লাহ ইসলামের আদেশ উপদেশসহ সমূহ মূলনীতিগুলো সুস্পষ্টভাবে বর্নণা করেছেন। যেকেউ পবিত্র কুরআন অনুধাবনের সাথে সাথে যার হেদায়েত লেখা আছে সে পরিপূর্ণভাবে ইসলামে দাখিল হবে।
আরও পড়ুন হেদায়েত কী? হেদায়েতের মাধ্যম কয়টি? কুরআনই কেন হেদায়েতের প্রকৃত মাধ্যম
ইসলামের মূল হলো আকিদা। আর এই নির্ভেজাল আকিদা সম্পর্কে জানা যাবে শুধুমাত্র কুরআনে। আর রাসুলে সুন্নাহ হচ্ছে আমল। যেকোনো পীর বা উস্তাদ বা শিক্ষক একজন মানুষকে আমলের পরিপূর্ণ শিক্ষা দিতে পারে। কিন্তু আকিদার শিক্ষা কুরআন থেকেই নিতে হবে। কুরআন বহির্ভূত কোনো আকিদা ইসলামে গ্রহণযোগ্য নয়।
যে ব্যক্তি কুরআনের জ্ঞান আহরণ করতে পারবে, সে খুব সহজেই হক এবং বাতিলের পার্থক্য নিরুপণ করতে পারবে। যাকে আল্লাহ কুরআনের জ্ঞান দিবেন, সে তার জ্ঞানের সাহায্য এটা বুঝতে সমর্থ হবে যে, কোন পথ সঠিক এবং কোন পথ ভুল। সেইসাথে এটাও বুঝতে পারবে কোন আলেম ওলামা সঠিক পথে আছে কোন আলেম ওলামে ভুল পথে আছে। এখানেই হচ্ছে আল্লাহর হেদায়েত এবং সঠিক পথপ্রদর্শন।
সুতরাং আল্লাহ যাকে পথপ্রদর্শন করবেন তাকে কুরআনের সঠিক জ্ঞান জানার তৌফিক দিয়ে উত্তম হেদায়েত দিবেন। যে কুরআনের মাধ্যমে আল্লাহকে প্রকৃত অভিভাবক এবং পথপ্রদর্শক হিসাবে পাবে, সে অবশ্যইহেদায়েতের পথে থাকবে।
সাখাওয়াতুল আলম চৌধুরী
১৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২২
পতেঙ্গা, চট্টগ্রাম।