ঈমান কী, পরিপূর্ণ ঈমানের বিস্তারিত ব্যাখ্যা |
ঈমান কী, পরিপূর্ণ ঈমানের বিস্তারিত ব্যাখ্যা
ইসলাম হচ্ছে আল্লাহর পূর্ণ বিধানে আনুগত্য করা। এই পরিপূর্ণ বিধানকে মুখে স্বীকৃতি, অন্তরে বিশ্বাস এবং কাজে সম্পূর্ণ করাই হচ্ছে ঈমান। যার সহজ অর্থ হলো ইসলামের বিধানকে মুখে এবং অন্তরে স্বীকার করে সেইমতে কাজ করাই হচ্ছে ঈমান। যে এই কাজ অর্থাৎ ঈমান এনে ইসলামের প্রতি আনুগত্যশীল হয় তাকে বলা হয় মুসলিম। আজ আমরা জানার চেষ্টা করব ঈমান কী এবং ঈমানের পরিপূর্ণ ব্যাখ্যা।
ঈমানের ব্যাখ্যা
একটি গাছের যেমন তিনটি অংশ অর্থাৎ শেখড়, মূল বৃক্ষ এবং শাখাপ্রশখা, ফুল-ফল ইত্যাদি রয়েছে, ঠিক তেমনি ঈমানেরও তিনটি বিষয় বিদ্যমান। ঈমানের একটি অংশ হলো অন্তরের বিশ্বাস বৃক্ষের মূলের মতো। যা কেউ দেখে না। দ্বিতীয় অংশ মুখের স্বীকৃতি মূল কান্ডের মতো যা বাইরে থেকে দেখা যায়। তৃতীয় অংশ হলো আমল যা গাছের শাখাপ্রশখা ও ফুল ফলের মতো। যা দেখে গাছকে পরিপূর্ণ ও সৌন্দর্যমণ্ডিত দেখায়।
এই হিসাবে কিছু কিছু বিশ্বাসের সমষ্টিকে ঈমান ধরা হয়। যেমন আল্লাহ, মালাইকা বা ফিরিশতা, নবী রাসূল, সমস্ত আসমানী কিতাব, তকদীর, এবং মৃত্যুর পর উত্থান ও কিয়ামত ইত্যাদির সামগ্রিক বিশ্বাসই হচ্ছে মূল ঈমান। যা মুখে এবং অন্তর দিয়ে স্বীকৃতি দিতে হয়।
আরও পড়ুন বিশ্বকাপ ফুটবল এবং আমাদের ঈমান আকিদা
ঈমানের মূলে কালেমা
ঈমানের মূল ভিত্তি হলো কালেমা "লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ।" যে এই কালেমা পরিপূর্ণভাবে বুঝে বিশ্বাস এবং আমল করে তবেই তার ঈমান পূর্ণ হবে। সুতরাং ঈমান হলো বিশ্বাসের সাথে আল্লাহর পরিপূর্ণ বিধানের আমল। কালেমাতে আল্লাহকে স্বীকৃতি দেওয়ার অর্থ হলো আল্লাহর জাত, সিফাত এবং ইবাদতে কারো অংশীদার গ্রহণযোগ্য নয়। অর্থাৎ আল্লাহর সাথে কাউকে কোনো কিছুতেই শরীক করা যাবে না। এটাই হচ্ছে মূল ঈমান। যা আমরা অনেকেই জানি বা বুঝি না। শুধু মুখে ও অন্তরে স্বীকার করে সালাত সিয়াম হজ্জ্ব যাকাত পালন করলেই ঈমানদার নয়।
বরং আল্লাহকে এবং তাঁর বিধানকে এমনভাবে বিশ্বাস করতে হবে যে, তিনি ছাড়া দুনিয়ায় আর কেউ তাঁর মতো নয়। অর্থাৎ তিনি যা পারেন তা কেউ পারেন না। এবং তাঁর বিধান ছাড়া আর কোনো বিধানে মাথা নত করা নয়। তিঁনি যা প্রাপ্য (ইবাদত) তা আর কেউ পেতে পারে না। এটাই হচ্ছে ঈমানের মূল বিষয়।
সুতরাং ঈমান হচ্ছে অবিচল বিশ্বাসের নাম। ওহীর মাধ্যমে জানা সকল সত্যকে সত্য বলে বিশ্বাস করা। যেকোনো বিষয়কে শুধু আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি আস্থার ভিত্তিতে মেনে নেওয়া। সত্যের সাক্ষ্যদান এবং আরকানে ইসলাম পালন করা। নিজেকে পরিপূর্ণভাবে ইসলামে সমর্পণ করে শরিয়ত ও উসওয়ায়ে হাসানাকে গ্রহণ করা। ইসলামের বিধিবিধানের প্রতি আস্থা, ভালোবাসা ও ভক্তি-শ্রদ্ধা করা, পরিপূর্ণ তাওহীদ এবং শিরক বর্জিত বিশ্বাস করাই ঈমান। ঈমান শুধু গ্রহণ নয়, বর্জনও বটে। সত্যকে গ্রহণকরা আর বাতিলকে বর্জন করা। বিদ্রূপ ও অবজ্ঞা অস্বীকারের চেয়েও কুফরকে ঘৃণা এবং এর পরিনামকে ভয় করা ইত্যাদি।
আরও পড়ুন ইসলামে নামাজ -রোজা থাকলেও, পীর - মুরিদী, শবেবরাত, চাহার শোম্বা নেই
ঈমানের ফল হচ্ছে আমল
যারা কালেমা পড়ে নিজেদের ঈমানদার ঘোষণা দিবে। তাদের ঈমান পরিলক্ষিত হবে আমলের মাধ্যমে। গাছ যেমন শাখাপ্রশখা পত্রপল্লব ছাড়া শুধু মূল এবং কান্ড দ্বারা পরিপূর্ণ ও সৌন্দর্যমণ্ডিত হয় না। ঠিক তেমনি আমল ছাড়া মুখে স্বীকৃতি এবং অন্তরে বিশ্বাস দিয়ে ঈমানদার দাবি করা যায় না।
কারণ যারা মুনাফিক তাদের আমল নেই। তারা মুখে আল্লাহকে স্বীকার করে কিন্তু সেই বিধান অনুযায়ী চলে না বা আমল করে না। অধিকাংশ মুসলমান আল্লাহকে স্বীকার করে। তারা জানে সালাত অবশ্যই আদায় করতে হবে এবং আদায় না করলে শাস্তি পেতে হবে। কিন্তু তারপরও কখনো সালাত আদায় করে না। তাহলে তারা কীভাবে ঈমানদার থাকলো? সুতরাং তারা কখনোই পরিপূর্ণ ঈমানদার নয়। প্রকৃত ঈমানদার হলো তারাই যারা আল্লাহকে পরিপূর্ণভাবে বিশ্বাস করে তাঁর বিধান অনুযায়ী আমল করে।
ঈমানের স্বাদ
হযরত আনাস (রা:) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্(সা.) ইরশাদ করেন,
"যার মধ্যে তিনটি বৈশিষ্ট্য থাকবে সে ঐ বৈশিষ্ট্যগুলো কারণে ঈমানের স্বাদ অনুভব করতে পারবে। সে বৈশিষ্ট্যগুলো হচ্ছে-(ক) যার নিকট আল্লাহ ও তার রাসূল (সা.) অন্য সবকিছু হতে সর্বাধিক প্রিয় হবে। (খ) যে ব্যক্তি কোনো বান্দাকে কেবল আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে ভালোবাসবে। (গ) যে ব্যক্তি আল্লাহর অনুগ্রহে কুফরি হতে মুক্তি লাভের পর পুনরায় কুফরিতে ফিরে যাওয়াকে এভাবে অপছন্দ করে, যেভাবে অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষিপ্ত হওয়াকে অপছন্দ করে। (সহিহ বুখারী: ২০, সহিহ মুসলিম:৪৩)
সুতরাং তারাই ঈমানের স্বাদ পাবে যারা সত্যিকারে আল্লাহ এবং রাসূলের (সা.) প্রতিষ্ঠিত বিধানের উপর পরিপূর্ণ অবিচল থাকতে পারবে মৃত্যু পর্যন্ত। সুতরাং মুখে বা অন্তরের স্বীকৃতি দিয়ে ঈমানদার হওয়া যাবে না। যে পর্যন্ত না সেই ঈমানকে আমল দ্বারা পরিপূর্ণ করা না হবে।
আরও পড়ুন শিরক কী? মানুষ কীভাবে শিরক করে
ঈমান বাড়ে এবং কমে
আল্লাহ বলেন,
"যারা ঈমানদার, তারা এমন যে, যখন আল্লাহর নাম নেয়া হয় তখন ভীত হয়ে পড়ে তাদের অন্তর। আর যখন তাদের সামনে পাঠ করা হয় (আল্লাহর) কালাম, তখন তাদের ঈমান বেড়ে যায় এবং তারা স্বীয় পরওয়ার দেগারের প্রতি ভরসা পোষণ করে। "(সুরা আনফাল ৮:২)
উপরোক্ত আয়াত দ্বারা প্রমাণিত যে, আল্লাহর কিতাব ঈমানদারদের সামনে পড়া হলে তাদের ঈমান বৃদ্ধি পায়। এটা খুবই স্বাভাবিক। যখন কেউ ঈমান আমল ইহকাল পরকালের কথা শোনে তখন তাদের অন্তরে আল্লাহর প্রশান্তি এবং ভয় এসে আমলের ইচ্ছা জাগ্রত হয়। আবার যখন দুনিয়ার বিভিন্ন কাজে লিপ্ত হয়ে যায় তখন সেই ইচ্ছায় ভাটা পরে যায়। সুতরাং মানবিক কারণেই মানুষের মধ্যে ঈমানের এই হ্রাস বৃদ্ধি ঘটে।
ঈমান কীভাবে কমে
বিভিন্ন কারণে মানুষের ঈমান কমে যায় বা যেতে পারে। যেমন,
১) আল্লাহর গুণাবলী নিয়ে চিন্তা চেতনা গবেষণা ইত্যাদি না করা: আমরা প্রতিনিয়ত শত হাজার পাপ করছি। এই পাপের কারণে তিনি আমাদের পাকড়াও না করে ছেড়ে দিচ্ছেন। এই যে ছেড়ে দিচ্ছেন বলে আমাদের একটি ধারণা হয়ে গেছে যে, আল্লাহ বোধহয় মানুষকে শাস্তি দিতে পারেন না। মনে হয় তাঁর সেই ক্ষমতা নেই (নাউযুবিল্লাহ)। এই ধরনের উদাসীনতা, তাঁর ক্ষমতার প্রতি চিন্তাহীনতা ইত্যাদি আমাদের ঈমান কমিয়ে দেয়।
২) আল্লাহর বিধান নিয়ে গবেষণা না করা: আল্লাহর বিধান নিয়ে গবেষণা না করার কারণেও মানুষের ঈমান কমে যায়। যেমন আমাদের কী কী পাপের জন্য কী কী শাস্তি হতে পারে। আল্লাহ আমাদের জন্য কী কী বিধান দিয়েছেন। কী কী বিধান মেনে চলা উচিত, কী কী অবাধ্যতার কারণে দুনিয়া আখিরাতে কী কী শাস্তি হতে পারে ইত্যাদি চিন্তা ভাবনা না করার কারণে পাপের শাস্তি সম্পর্কে আমরা উদাসীন হয়ে পড়ি। এই উদাসীনতা আমাদের আরও পাপ করতে এবং উদ্ভুদ্ধ করে। এবং আল্লাহর প্রতি ঈমানও কমে যায়।
৩) অতিমাত্রায় পাপ কাজে লিপ্ত হওয়া: ঈমান কমে যাওয়ার আরেকটি কারণ হলো অতিমাত্রায় পাপে লিপ্ত হওয়া। আমরা জেনে না জেনে আল্লাহর বিধিবিধান তোয়াক্কা না করে প্রতিনিয়তই পাপে লিপ্ত হচ্ছি। এতো বেশী পাপের ফলে আল্লাহর প্রতি আমাদের বিশ্বাসও কমতে থাকে। ফলে ধীরে ধীরে আমাদের ঈমানও কমে যেতে থাকে। আর এই ঈমান কমে যাওয়ার ফল হচ্ছে আমাদের আমলের কমতি। যা ঈমানকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।
আরও পড়ুন সুফিবাদী সুন্নীদের আকিদা সমূহ
ঈমান বৃদ্ধির উপায়
পবিত্র কুরআনের আলোকে আমরা জানি যে, ঈমানের হ্রাস বৃদ্ধি হয়। সুতরাং ঈমান বৃদ্ধির বিভিন্ন উপায় উপকরণ রয়েছে। যেমন,
১) আল্লাহর কঠোরতার কথা চিন্তা করা: আল্লাহর রহমত গুণাবলীর পাশাপাশি কঠোর গুণেরও অধিকারী। অর্থাৎ তিনি বান্দাদের যেমন দয়া করেন, ঠিক তেমনি বান্দার বিভিন্ন পাপের কারণে তাকে শাস্তিও দেন এবং দিতে পারেন। তাই আমরা যদি আল্লাহর কঠোরতার দিক চিন্তাভাবনা করি তাহলে আমরা কখনোই পাপের দিকে ধাবিত হবো না। আর পাপ থেকে বিরত থাকা মানেই সৎ থাকা। যে যতবেশী সৎ সে ততবেশী ঈমানের অধিকারী।
২) আল্লাহর নিদর্শন দেখে গবেষণা করা : পৃথিবীকে আল্লাহ কত চমৎকার করে সাজিয়েছেন। আকাশ পাতাল সাগর সমুদ্র যেখানেই আমরা দৃষ্টি দেই না কেন, সেখানেই তাঁর বিভিন্ন চমৎকার নিদর্শন চোখে পড়বে। যা আমাদের অভিভূত করে দেয়। আমরা যদি এইসব নিয়ে নিয়ে গবেষণা বা চিন্তা-ভাবনা করি তাহলে আল্লাহর প্রতি আমাদের ঈমান বাড়বে। যতই আল্লাহর সৃষ্ট জগৎ সম্পর্কে জানার চেষ্টা করব ততোই আমাদের ঈমান বৃদ্ধি পাবে।
৩) সৎ আমল করা: আল্লাহকে ভয় এবং সন্তুষ্টি লাভের আশায় বেশী বেশী নেক আমল করলে ঈমান বৃদ্ধি পায়। যার ভিতরে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য সৎ আমল বা ভালো কাজ করার প্রবণতা থাকবে, নি:সন্দেহে তার ঈমান অন্যদের চেয়ে বেশী হবে। তাই যে যতবেশী সৎ আমল করে সে ততবেশী ঈমানদার হয়ে উঠে।
আরও পড়ুন সুফি সুন্নীদের বিভিন্ন আকিদা সম্পর্কিত জবাব
উপরোক্ত আলোচনা থেকে এটা স্পষ্ট বুঝা গেলো যে, ঈমান কখনোই শুধুমাত্র স্বীকৃতির বিষয় নয়। যদি স্বীকৃতির বিষয় হতো তাহলে সকল নামধারী মুসলিম এবং মুনাফিকরাও ঈমাদার বলে গণ্য হবে। অথচ আল্লাহ বলেন,
"নি:সন্দেহে মুনাফেকরা রয়েছে দোযখের সর্বনিম্ন স্তরে। আর তোমরা তাদের জন্য কোন সাহায্যকারী কখনও পাবে না। "( সুরা নিসা ৪:১৪৫ )
অর্থাৎ শুধু মুখে ঈমান আনলেই মুমিন হওয়া যাবে না। যতক্ষণ না তা কাজে কর্মে পরিলক্ষিত না হবে। কেননা আল্লাহ বলেন,
"অধিকাংশ মানুষ আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে, কিন্তু সাথে সাথে শিরক ও করে। " (সূরা: ইউসূফ, আয়াত: ১০৬)
অর্থাৎ অধিকাংশ মানুষ আল্লাহর উপর বিশ্বাস রেখে তাঁর সাথে শিরক করে। আর যে ব্যক্তি আল্লাহকে স্বীকার করে আবার শিরকও করে তাহলে আল্লাহ তাকে ক্ষমা করবেন না। আল্লাহ বলেন,
"নি:সন্দেহে আল্লাহ তাকে ক্ষমা করেন না, যে লোক তাঁর সাথে শরীক করে। "(সূরা: আন নিসা, আয়াত: ৪৮)
অতএব আমাদের কালেমার প্রকৃত অর্থ এবং ব্যাখ্যা (তাওহীদ, শিরক, বিদআত ইত্যাদি) জেনে পরিপূর্ণভাবে বুঝে বিশ্বাস এবং সেই অনুযায়ী আমল করেই ঈমানদার হতে হবে।
সাখাওয়াতুল আলম চৌধুরী
পতেঙ্গা, চট্টগ্রাম।