ভারতীয় উপমহাদেশে ইসলাম সরাসরি আরব থেকে প্রবেশ করেনি। এখানকার ইসলামের হাতেখড়ি বেশ কয়েকটি উৎস থেকে আগত। তাই উপমহাদেশের ইসলামের সংস্কৃতিতে বিভিন্ন জাতির বৈশিষ্ট্য লক্ষণীয়। একারণে ভারতীয় উপমহাদেশে ব্যবহৃত ইসলামী পরিভাষা গুলো আরবি তথা আরবের না হয়ে অন্যান্য ভাষায় প্রচলিত। যেমনঃ নামাজ, রোজা, ফিরিশতা ইত্যাদি। তাই প্রকৃত ইসলামে কী আছে কী নেই সে সম্পর্কে উপমহাদেশের মুসলমানরা সম্পূর্ণ অবগত নয়। আজ আমরা দেখব উপমহাদেশের ইসলামে যেসব পরিভাষা ব্যবহৃত হয় তা কতটুকু ইসলাম সমর্থিত এবং যুক্তিযুক্ত।
পারিভাষিক শব্দ আরবি না হওয়ার কারণ
আগেই উল্লেখিত যে, উপমহাদেশে ইসলাম প্রবেশ করেছে বিভিন্ন ধারায়। সেইসাথে সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিভিন্ন কারণে এখানকার ইসলামের প্রচার প্রসার ছিলো মিশ্রিত। অর্থাৎ উপমহাদেশের মুসলমানরা ছিলো রূপান্তরিত মুসলমান। এখানকার আদি ধর্ম হচ্ছে প্রধানত সনাতন তথা হিন্দু ধর্ম। তাই এখানকার মানুষ মুসলমান হলেও তাদের সামাজিক কর্মকাণ্ডে হিন্দুয়ানী বিভিন্ন প্রথা প্রচলিত। যেমনঃ নানারকম কুসংস্কারসহ জন্ম মৃত্যুর অনুষ্ঠান, বিয়ে, গায়েহলুদ ইত্যাদিতে হিন্দুয়ানী প্রভাব এখনো বিদ্যমান।
একইভাবে উপমহাদেশে সারাবিশ্ব থেকে ব্যবসা বাণিজ্য করতে আসা বিভিন্ন বণিক সম্প্রদায়ের কারণেও এখানে অন্যান্য অঞ্চলের রীতিনীতি ইত্যাদি প্রভাব বিস্তার করে। উপমহাদেশের মুসলমানরা সবচেয়ে বেশী প্রভাবিত হয়েছে রাজনৈতিক কারণে। যারাই এই উপমহাদেশে এসে ক্ষমতা দখল করেছে তারাই তাদের ভাবধারার ইসলাম প্রচার করার চেষ্টা করেছে। বিশেষকরে শিয়া মতাদর্শী বিভিন্ন ক্ষমতাশালী সম্প্রদায় উপমহাদেশে দীর্ঘমেয়াদী শাসন করে। আমাদের বাংলার শেষ নবাব সিরাজউদ্দৌলাসহ তার পূর্বপুরুষরা সবাই ছিলো শিয়া। এভাবে অতীতের অধিকাংশ মুসলিম শাসকদের পৃষ্টপোষকতায় শিয়া মতাদর্শ উপমহাদেশে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করেছিল।
এছাড়াও তৎকালীন সময়ে সুফি দরবেশরাই উপমহাদেশে ব্যাপকভাবে ইসলাম প্রচার করে। যে ইসলামের মূল ছিলো সুফি দরবেশদের চরিত্রের শুভ্রতা। তারা এখানে কুরআন হাদিসের ব্যাখ্যা দিয়ে বা কুরআন সুন্নাহ দ্বারা ইসলাম প্রচার করেনি। কেননা অনারব হিন্দু অধ্যাসিত এই বিশাল ভূখন্ডে আরবি কুরআন হাদীস বুঝানো খুবই জটিল ছিলো। সেইসাথে যারাই ইসলাম প্রচার করতে এসেছিল তারা নিজেরাও ছিলো অধিকাংশ অনারব পার্সিয়ান তথা ইরাক ইরানের বাসিন্দা।
তাই তারা তাদের ভাষায় তথা ফার্সিতেই ইসলামকে এখানে তুলে ধরে। যারফলে এখনো এই উপমহাদেশে অধিকাংশ ইসলামী পরিভাষা ফার্সি। যেকারণে এখনো আমাদের দেশে হাম নাত গুলো বেশিরভাগই গাওয়া হয় উর্দু ফার্সিতে। এইসব ফার্সি পারিভাষিক শব্দ ইসলামের জন্য ব্যবহৃত হলেও অধিকাংশেরই মূল হচ্ছে শিয়া সমর্থিত ইসলামের প্রকাশ।
যারফলে সুদীর্ঘকাল থেকে যেসব ফার্সি শব্দ আমরা ইসলামের জন্য জেনে এসেছি, তা আসলেই কতটুকু আরবি ইসলাম সমর্থিত তা কখনোই যাচাই করিনি। এই যাচাই না করার কারণে ধীরে ধীরে আমাদের ইসলামের মধ্যে শিয়ারা শিয়াদের বিভিন্ন রীতিনীতি আচার অনুষ্ঠান খুব সুক্ষভাবে প্রবেশ করিয়ে দিয়েছে।
নামাজ ও রোজা
নামাজ শব্দটি আমরা সালাতের জন্য ব্যবহার করে থাকি। আর এটা ফার্সি শব্দ। এখন প্রশ্ন হচ্ছে ইসলাম এসেছে আরব থেকে তাহলে ইসলামের নামে আমরা যা -ই পালন করিনা কেন, তা হতে হবে অবশ্যই আরবিতে। অথচ দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত সালাতকে আমরা নামাজ নামকরণ করে এখনো চলে যাচ্ছি।
ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকেও এই কাজ সমর্থিত নয়। কেননা ইসলামে সবকিছুই করতে হবে সুন্নাহ মোতাবেক। তাহলেই আমরা ঐ কাজ থেকে সওয়াব পাবো। অথচ সুদীর্ঘকাল থেকে আমরা ফার্সি চর্চা করে ইসলামের আসল ভাষার ব্যবহার থেকে দূরে আছি। একইভাবে রোজা শব্দও সাওম শব্দের জন্য ব্যবহৃত হয়।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, নামাজ রোজা ইত্যাদি ফার্সি শব্দ হলেও কাজ তো করছি ইসলামের। তাহলে সমস্যা কোথায়? সমস্যা অবশ্যই আছে। প্রথম কথা হচ্ছে ইসলামে ইবাদত হতে হবে অবশ্যই রাসুলের ত্বরিকায়। আমরা ইবাদত ছাড়া সাধারণ যেকোনো কথাবার্তা ফার্সি কেন, যেকোনো ভাষাতেই বলতে পারি। কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু যেকোনো ইবাদত হতে হবে অবশ্যই আরবিতে। এখন আমরা সালাত ইবাদতের জন্য নামাজ শব্দ ব্যবহার করছি। আমরা কি জানি এই নামাজের আসল অর্থ কী?
নামাজের আসল অর্থ হচ্ছে প্রার্থনা করা। কোন প্রার্থনা? নামাজ শব্দটি মূলত সেইসব পার্সিয়ানরাই ব্যবহার করতো যারা অগ্নি পূজারী ছিলো। তারা তাদের দেবতাদের প্রার্থনাকে নামাজ বলে উল্লেখ করতো। সেই থেকে পারস্যরা সালাতকে নামাজ বলতে শুরু করে। অথচ আরবিতে সালাত শব্দের ব্যাখ্যা অনেক। সালাত পড়া নয় বরং সালাত হচ্ছে কায়েম বা প্রতিষ্ঠার বিষয়। যার অর্থ খুবই ব্যাপক। এখন সালাতকে যখন আমরা নামাজ বানিয়ে ফেলেছি, তখন এর অর্থ শুধু রুকু সিজদা পর্যন্ত শেষ।
অনুরূপভাবে রোজা অর্থ উপবাস। যে শব্দটি পারস্যের অগ্নি পূজারীরা তাদের দেবতাদের জন্য উপবাস সম্পর্কে ব্যবহার করে। এখন আমরা যদি বলি আজ আমি উপবাস আছি তাহলে কি কেউ মনে করবে সে সাওম পালন করছে? কিংবা কেউ উপবাস থাকলে কি আল্লাহ্ তাকে সাওম পালনের সওয়াব দিবে। সুতরাং আরবি ছাড়া অন্যান্য শব্দ ইসলামের জন্য ব্যবহৃত হলেও তা ইসলামের জন্য পরিপূর্ণ নয়।
ধরে নিলাম নামাজ ও রোজা সালাত ও সাওমের সমার্থক শব্দ। তবুও, আরও অন্যান্য যেসব শব্দ উপমহাদেশে প্রচলিত আছে, তা কি ইসলামী পারিভাষিক শব্দ?
খোদা
উপমহাদেশের অধিকাংশেরও বেশী মুসলমান আল্লাহ্কে ডাকতে "খোদা "শব্দটি ব্যবহার করে। যা একটি ফার্সি শব্দ। যার অর্থ যে নিজে নিজেই আগমন করেছেন। খোদা (ফার্সি: خدا, কুর্দি: Xweda, Xuda) হল একটি ইরানি শব্দ, যার দ্বারা ঈশ্বরকে বোঝানো হয়। প্রকৃত পক্ষে এটি আহুরা মাজদা (জরাথুস্ট্রবাদ ধর্মে ঈশ্বর) কে ডাকতে ব্যবহৃত হয়। (উইকিপিডিয়া)
সুতরাং "খোদা " শব্দটির সাথে আল্লাহ্র সাথে মিল থাকলেও অর্থাৎ যিনি নিজেই নিজ থেকে আগমন করেছেন। তিনি কারও কাছে মুখাপেক্ষী নয় ইত্যাদি। এর দ্বারা আল্লাহ্র কোনো গুণ সরাসরি প্রকাশ হয় না। শুধু তাইনয় আল্লাহ্র যে নিরানব্বইটি নাম রয়েছে তার কোনটাই খোদা দ্বারা প্রকাশ হয় না। অতএব আল্লাহ্কে খোদা নামে ডাকা নাজায়েজ না হলেও সওয়াবের কিছুই নেই বরং ক্ষেত্রবিশেষে নিষিদ্ধ। কেননা আল্লাহ্কে সুন্দর নামে ডাকলেও নেকী আছে। আল্লাহ্ বলেন,
"আর আল্লাহর জন্য রয়েছে সব উত্তম নাম। কাজেই সে নাম ধরেই তাঁকে ডাকো।"(সূরাঃ আল আ'রাফ, আয়াতঃ ১৮০)
সুতরাং আল্লাহ্ নিজেই যেখানে তাকে সুন্দর নামে ডাকার জন্য বলছেন। সেখানে আমরা কেন তাঁকে খোদা ডাকবো? যে নামটা ব্যবহার করে পারস্যের অগ্নি উপাসকরা সুতরাং এটা ইসলামে নিষিদ্ধ। শুধু তাইনয়, ইসলামে নামের বিকৃতি করা খুবই মারাত্মক অপরাধ।
আল্লাহ তাআলা বলেন-
‘হে ঈমানদারগণ! কেউ যেন অপর কাউকে উপহাস না করে। কেননা, সে উপহাসকারী অপেক্ষা উত্তম হতে পারে এবং কোনো নারী অপর নারীকেও যেন উপহাস না করে। কেননা, সে উপহাসকারিণী অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ হতে পারে। তোমরা একে অপরের প্রতি দোষারোপ করো না এবং একে অপরকে মন্দ নামে ডাকবে না। কেউ বিশ্বাস স্থাপন করলে তাদের মন্দ নামে ডাকা গোনাহ। যারা এহেন কাজ থেকে তওবাহ না করে তারাই অত্যাচারী।’ (সুরা হুজরাত : আয়াত ১১)
সুতরাং একজন সাধারণ মুসলমানকেও কেউ খারাপ বা মন্দ বা যে নাম তার নয় সেই নামে ডাকা আল্লাহ্ পছন্দ করেন না। শুধু তাইনয় পবিত্র হাদীসে এসেছে,
মহানবী (সা.) বলেছেন,
‘এক মুসলিম আরেক মুসলিমের ভাই। সে তার উপরে জুলুম করে না, তাকে সহযোগিতা করা পরিত্যাগ করে না এবং তাকে লাঞ্ছিত ও হেয় করে না। কোনো ব্যক্তির জন্য তার কোনো মুসলিম ভাইকে হেয় ও ক্ষুদ্র জ্ঞান করার মতো অপকর্ম আর নেই।’ (মুসনাদে আহমাদ : ১৬/২৯৭, ৭৭৫৬)
অতএব কেউ কাউকে খারাপ নামে বা বিকৃত নামে ডেকে তাকে হেয় করা ইসলামে খুবই গুনাহের কাজ। যেখানে একজন সাধারণ মানুষকে বিকৃত নামে ডাকলে আল্লাহ্ নিজেই অসন্তুষ্ট হন, সেখানে খোদ আল্লাহ্কেই কেউ বিকৃত নামে ডাকলে নিশ্চয়ই তিনি খুশি হবেন না?
অতএব আল্লাহ্কে খোদা নামে ডাকার যে সংস্কৃতি উপমহাদেশে আছে কখনোই সঠিক নয়। শুধু খোদা নয় এমন অনেক পারিভাষিক শব্দ ইসলামের নামে এখানে চালু আছে, যা কখনোই ইসলামের জন্য প্রযোজ্য নয়। অথচ যারা এইসব শব্দ ব্যবহার করে এবং সমর্থন করে তারা দাবি করে যে, এইসব ফার্সি হলেও ইসলামের সমর্থক শব্দ। কিন্তু আসলে তা কখনোই নয়। যারা সাধারণ মুসলমান তাদের ইসলাম সম্পর্কে গভীর জ্ঞান না থাকার কারণে এইসব শব্দের মূল উৎস কী তা তারা জানতে পারে না। শুধু পূর্বপুরুষদের অনুসরণে এইসব রীতিনীতি পালন করাকেই ইসলাম মনে করে।
পীর
পীর শব্দের অর্থ মুরুব্বী, উস্তাদ বা শিক্ষক। এটিও একটি ফার্সি শব্দ। পীর আরবি শব্দ নয় এবং বৃহৎ মধ্যপ্রাচ্যে যেখান থেকে ইসলামের সূচনা ও উৎপত্তি সেখানে পীর নামে এমন কিছুই প্রচলিত নেই যা পীর মুরিদ নামে আমাদের উপমহাদেশে চালু আছে। যারা (সুফি সুন্নীরা) পীর মুরিদ মানেন এবং তথাকথিত পীর মুরিদী পদ্ধতিকে জায়েজ মনে করেন। তারা পীর শব্দটি ইসলামে জায়েজ করার জন্য তার স্বপক্ষে নামাজ, রোজার দলিল দেওয়ার চেষ্টা করেন। অর্থাৎ নামাজ রোজা আরবি শব্দ না হলেও তা দিয়ে যেমন সালাত এবং সাওম পালন করাকে বুঝায়। ঠিক তেমনি পীর ফার্সি শব্দ হলেও আরবি শায়েখের সমার্থক শব্দ। অর্থাৎ আরবি শায়খই হলো ফার্সির পীর।
উপরোক্ত যুক্তি নিঃসংকোচে মানা যায়। যদি বলা হয় পীর মানে উস্তাদ, শিক্ষক, মুরুব্বী ইত্যাদি যা আরবি শায়েখের অনুরূপ। কিন্তু যখন দাবি করা হয় পীর ধরা ফরজ। অর্থাৎ সবাইকে পীরের মুরিদ হতে হবে। অর্থাৎ এই উপমহাদেশে পীর মুরিদের নামে যেসব রীতিনীতি প্রচলিত আছে তা সবই ইসলামের অন্তর্ভূক্ত। তাহলে তা কিভাবে মেনে নেওয়া সম্ভব?
কেননা পবিত্র কুরআন এবং হাদীসে কোথাও পীর বা শায়খ ধরার কথা নেই যেভাবে সুফি সুন্নীরা দাবি করে। ইসলাম অবশ্যই জ্ঞান অর্জন করার জন্য যেকোনো উস্তাদ, উলামা বা শিক্ষককের কাছে যেতে বলা হয়েছে। এবং তা একক কোনো শিক্ষক নয়। বরং যার কাছেই জ্ঞান থাকবে তার কাছেই জ্ঞানার্জন করার জন্য যাওয়া যাবে।
অথচ সুফি সুন্নীরা ইসলামের নামে যে পীর মুরিদী দাবি করে তা কুরআন হাদীস এবং আরব বিশ্বে কোথাও নেই। যেমন সালাত আছে বিধায় সালাতকে নামাজ বলা মেনে নেওয়া যায়। অনুরুপ সাওমের পরিবর্তে রোজা। কিন্তু শায়েখের পরিবর্তে কীভাবে পীর মানতে পারি যেখানে ইসলামে বা আরব দেশে পীরের অনুরূপ কর্মকাণ্ডের শায়েখ বলতে কিছুই না থাকে।
যদি ইসলামে পীর মুরিদী জায়েজ এবং ফরজ হতো তাহলে তা রাসুলুল্লাহ সাঃ আমাদের জানিয়ে যেতেন। সেইসাথে তৎকালীন থেকে বর্তমান পর্যন্ত আরবের সকল দেশ ও রাজ্যে পীর মুরিদীর অনুরূপ শায়েখদের আস্তানা থাকতো। আমাদের দেশে যেমন দরগাহ, খানকাহ, মাজার ইত্যাদি রয়েছে। ঠিক একইভাবে আরব দেশেও যুগ যুগ ধরে এইসবের প্রচলন থাকতো।
অথচ ইসলামের ইতিহাসে রাসুলুল্লাহ সাঃ এর জামানা থেকেই এই জাতীয় পীর মুরিদীর দেখা পাওয়া যায় না। তাহলে ইসলামের ইতিহাসে যা নেই, তা কীভাবে ইসলামে অপরিহার্য অংশ হিসাবে বিবেচিত হবে। শুধু তাইনয় উপমহাদেশে সুফি সুন্নীরা সিলসিলা দিয়ে যেভাবে পীর মুরিদীর আসন পাকাপোক্ত করেছে, যদি ইসলামে এইসব জায়েজ হতো তাহলে তা অবশ্যই রাসুলুল্লাহ সাঃ জীবদ্দশায় মুসলমানদের জানিয়ে যেতেন এবং তিনি নিজেই পরবর্তী পীর নির্ধারণ করে যেতেন। কিন্তু এইসবের কিছুই আমরা ইসলামের ইতিহাসে পাই না। যা পাই তা পাচ্ছি ইসলাম প্রতিষ্ঠার পাঁচশ বছর পরের ইতিহাস। সুতরাং এটা সুস্পষ্ট বিদআত।
শুধু তাইনয়, যারা বলে পীর মানে শায়খ, তাদের কাছে জিজ্ঞাস্য আরবের শায়খরা কি উপমহাদেশের মতো বাইয়াত করিয়ে মুরিদ করেন? আরবের শায়করা কি উপমহাদেশের মতো দরবার, দরগাহ, মাজার, খানকাহ ইত্যাদি খুলে বংশ পরস্পরায় ব্যবসা করছেন? আরবের শায়খরা কি তার পরবর্তীতে তার ছেলেকে শায়খ ঘোষণা করে যান, যেমন উপমহাদেশে পীরেরা তাদের সন্তানদের পরবর্তী পীর ঘোষণা করে যান। আরবের শায়খরা কি বিভিন্ন সিলসিলা দিয়ে বিভিন্ন ত্বরিকায় ইসলাম পালন করেন? আরবের শায়খরা কি বলেন, যার শায়খ নাই তার শায়খ শয়তান? আরবের শায়করা কি বছরে দু চারটা ওরস উদযাপন করেন?
যদি আরবি শায়খের প্রতিশব্দ পীর হয়, তাহলে পীর নিয়ে যেসব আমল ইবাদত ও আকিদা উপমহাদেশে চালু আছে তার সবকিছুই আরবের শায়খদের মধ্যে অবশ্যই বিদ্যমান থাকবে। অথচ আমরা উপমহাদেশের পীরের মধ্যে যেসব বৈশষ্ট্য দেখতে পাই, তার কোনো কিছুই আরবের শায়খদের মধ্যে দেখতে পাই না। তাহলে পীর কীভাবে শায়খ হতে পারে?
আমরা নামাজে যা করি তা আরবের সালাতে পাই। রোজাতে যা পালন করি তা আরবের সাওমের মধ্যে পাই। কিন্তু পীরের নামে যা বিশ্বাস করি এবং মানি তা কখনোই আরবের শায়খদের মধ্যে পাচ্ছি না। সুতরাং পীর এবং শায়খ কখনোই এক বিষয় নয়। অতএব পীরের নামে উপমহাদেশে যা চালু আছে তা কখনোই ইসলাম সমর্থিত নয়।
এইসব যুক্তি ছাড়াও সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, পীর শব্দটি এসেছে সেই একই জায়গা অর্থাৎ পারস্যের অগ্নি উপাসকদের কাছ থেকে।
আমরা যদি যাচাই করি পীর শব্দটি কীভাবে এবং কত্থকে এসেছে। তাহলেও আমরা এই সম্পর্কে পরিস্কার ধারণা পেতে পারি। পীর শব্দটি যেহেতু ফার্সি সেহেতু এই শব্দটি মোটেই নতুন নয়। পীরের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, পারস্যের অগ্নি পূজারীরা তাদের ধর্মীয় গুরুদের পীর নামে সম্বোধন করতো। সেখান থেকেই পীর শব্দটি সুফিবাদে প্রবেশ করে। এবং ধীরে ধীরে তা সুফি সুন্নীদের মাঝে প্রবেশ করে দীর্ঘস্থায়ী স্থান করে নেয়। সুতরাং পীর কখনোই ইসলামের কোনো অংশ ছিলো না এবং নেই।
শবেবরাত
উপমহাদেশে সুফি সুন্নীদের ইবাদতের জন্য শবেবরাত একটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ রাত্রি। তাদের বিশ্বাস এই রাত্রে মানুষের ভাগ্য লেখা হয়। তাই এই রাতকে তারা নাম দিয়েছে "শবেবরাত "। যা একটি ফার্সি শব্দ। এখানে শব অর্থ রাত, বরাত অর্থ ভাগ্য। সোজা বাংলায় বলা হয় ভাগ্যরজনী। বরাবরের মতো এই শব্দটিও আরবি নয় এবং ইসলামের ইতিহাসে এমন দিনে এমন রাত্রির উল্লেখ নেই।
ইসলামে লাইলাতুল কদর নামে একটি রাত্রি আছে। যে রাত হাজার মাস রাত অপেক্ষা উত্তম এবং যে রাতের অসংখ্য নিয়ামতের পাশাপাশি মানুষের হায়াৎ রিজিক ভাগ্য ইত্যাদি বন্টন করা হয় বলে কুরআন এবং হাদীসে উল্লেখ আছে। কিন্তু শবেবরাত নামে কোনো কিছুই কুরআন এবং হাদীসে বা আরবিতে উল্লেখ নেই।
তবুও সুফি সুন্নীরা এই রাতকে পূর্বপুরুষদের অনুসরণে পালন করে আসছে। তারা দাবি করে যে, কুরআনে না থাকলেও হাদীসে আছে। তাদের কথামত হাদীসে শবেবরাত খুঁজতে গেলে সেখানে আমরা যা পাই তা হচ্ছে, "লাইলাতুন নিস্ফ মিন শাবান’ অর্থাৎ মধ্য শাবানের রাত্রি। মধ্য শাবানের রাত্রি নিয়ে অসংখ্য জাল যইফ হাদিসের পাশাপাশি সহীহ্ হাসান হাদিসও রয়েছে।
আমরা যদি ঐসব সকল হাদীস পর্যালোচনা করি তাহলে সেখানে কোথাও শবেবরাত নামে কোনো কিছুই পাওয়া যায় না। আর পাওয়া যাবেই বা কীভাবে? শবেবরাত তো সৃষ্টি হয়েছে পারস্য তথা ইরান থেকে। এবং যারাই এর উদ্ভাবন করেছে তারা তাদের আকিদা থেকেই শবেবরাত সৃষ্টি করেছে। এই শবেবরাতের মূল উদ্ভাবক হচ্ছে শিয়া এবং সুফিরা। শিয়ারা এই দিনে তাদের কথিত ইমাম মাহাদীর জন্মদিন পালন করে। আর সুফিরা এটাকে পুঁজি করে নব্য ইবাদত সৃষ্টি করেছে।
আমরা যদি শবেবরাত নিয়ে সুফি সুন্নীদের আকিদা ও বিশ্বাস বিশ্লেষণ করি তাহলে যা পাই তা কখনোই ইসলামী আকিদা ও বিশ্বাসের সাথে যায় না। শুধু তাইনয় তারা যে বিশ্বাস নিয়ে শবেবরাত পালন করে ও দাবি করে, তা কখনোই কুরআন সুন্নাহ দ্বারা প্রমাণিত নয়। যারা শবেবরাত পালন করে তারা পূর্বপুরুষদের অনুসরণেই শবেবরাত পালন করে।
অথচ হাদীস দ্বারা মধ্য শাবানের অনেক ফজিলত প্রমাণিত। তারমধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, এই রাতে আল্লাহ্ অসংখ্য মানুষকে ক্ষমা করেন। তবে দুই শ্রেণীর মানুষকে নয়। এক হচ্ছে মুশরিক, দুই হচ্ছে হিংসুক। এই সহীহ্ দ্বারা প্রমাণিত যে আল্লাহ্ অবশ্যই এই রাতে অসংখ্য মানুষকে ক্ষমা করেন। কিন্তু এর জন্য কোনো শর্ত নেই। অর্থাৎ এই দিনের ক্ষমা পাওয়ার জন্য স্পেশাল কোনো আমলের কথা উল্লেখ নেই। তাই যারাই সারাবছর আল্লাহ্র সঠিক পথে চলবে আল্লাহ্ কেবল তাদেরই এই বিশেষ পুরুস্কার প্রদান করবেন।
অথচ সুফি সুন্নীরা এই রাতকে ঘিরে যেসব নতুন নতুন আমল সৃষ্টি করেছে, তা কখনোই সহীহ্ শুদ্ধ নয়। তারা সারাবছর ইবাদত করার পক্ষপাতী নয়। তারা শুধুমাত্র একদিনের ইবাদত করার জন্য উৎসাহী। এছাড়াও হাদীস থেকে প্রমাণিত যে, আল্লাহ্র রাসুল সাঃ শাবান মাসে বেশী বেশী সাওম পালন করতেন। এই মাসের মাঝামাঝিতে আইয়্যামে বীজ নামের তিনটি সাওম পালন করা উত্তম সুন্নাহ।
সুতরাং এই রাতের ফজিলত পেতে হলে নিয়মিত আল্লাহ্র ইবাদত বন্দেগী করতে হবে। সারাবছর ইবাদতের ধারেকাছে না থেকে একদিনের ইবাদত করে কীভাবে আল্লাহ্র সন্তুষ্টি কামনা করা যায়? অতএব শবেবরাত নামে উপমহাদেশে যা চালু আছে তা প্রকৃত ইসলামকে প্রকাশ করে না। কেননা শবেবরাত কখনোই ভাগ্যরজনী নয়।
আখেরী চাহার শোম্বা
আখেরি চাহর শোম্বা মূলত আরবি ও ফার্সি মিশ্রিত বাক্য। ‘আখেরি’ শব্দটি আরবি ও ফার্সি, যার অর্থ হলো- শেষ। ‘চাহর’ শব্দটি ফার্সি যার অর্থ হলো- সফর মাস এবং ‘শোম্বা’ শব্দটিও ফার্সি যার অর্থ হলো- বুধবার। সুতরাং ‘আখেরি চাহর সোম্বা’ কথাটি হচ্ছে ফার্সি, যার অর্থ দাঁড়ায়- সফর মাসের শেষ বুধবার।
উপমহাদেশের সুফি সুন্নীরা সফর মাসের শেষ বুধবারকে খুশির দিন হিসেবেই উদযাপন করে থাকে। এর কারণ হচ্ছে, এই সফর মাসের শেষ বুধবার হজরত মোহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দীর্ঘ অসুস্থতার পর সাময়িক সুস্থ হয়ে উঠেন। রাসুলুল্লাহ সাঃ এর এই সুস্থ হয়ে উঠাকে কেন্দ্র করে ঐ দিনকে স্মরণ করে সুফি সুন্নীরা যে ইবাদত ও উৎসব করে তাই হচ্ছে ‘আখেরি চাহার সোম্বা’।
উপরোক্ত ইবাদতটি তার নামের কারণেই সুস্পষ্ট বিদআত। কেননা "আখেরি চাহার সোম্বা" নামটি আরবি নয় বরং ফার্সি। যদি তৎকালীন সাহাবাদের সময় থেকেই এই জাতীয় কোনো ইবাদত ইসলামে প্রচলিত থাকতো তাহলে তা অবশ্যই আরবি নামেই প্রচলিত হতো। অথচ আরবি নামে এবং আরব মুসলিম ইতিহাসে এমন কোনো ইবাদতের চিহ্ন পর্যন্ত নেই। শুধু তাইনয় বিকল্প নামেও এই সফর মাসের শেষ বুধবার নিয়ে কিছুই ইসলামে প্রচলিত ছিলো না এবং এখনো নেই।
অথচ এই দিনকে কেন্দ্র করে নানারকম ইবাদত যেমনঃ কলা পাতায় বা কাগজে তাবিজ লিখে তা পান করা, তা দিয়ে গোসল করা। মুরগি জবাই করে ফাতেহা দেওয়া, ভালো রান্নাবান্না করা, বিশেষ নফল সালাত আদায় করা ইত্যাদি প্রচলিত আছে। যার কোনো দলিল কুরআন হাদীসে কোথাও নেই। এমনকি এই দিন উপলক্ষে উপমহাদেশে সরকারি ছুটি পর্যন্ত ঘোষণা করা হয়। এরচেয়ে স্বীকৃত বিদআত আর কী হতে পারে।
অতএব নামে ভিন্নতা থাকলেও কর্মে ভিন্নতা থাকবে এটাই স্বাভাবিক। উপমহাদেশে ফার্সি থেকে যতকিছুই প্রবেশ করেছে তার সবকিছুই পরিবর্তিত হয়েই প্রবেশ করেছে। সালাত যখন নামাজ হয়ে যায়। তখন ঐ নামাজ প্রতিষ্ঠা না হয়ে হয়ে গেছে রুকু সিজদা দ্বারা নামাজ পড়া। অথচ সালাত শব্দের আভিধানিক অর্থ অনেক ব্যাপক। সালাত কখনোই পড়ার বিষয় নয়, বরং প্রতিষ্ঠার বিষয়। একইভাবে সাওম রোজা হয়ে উপবাসে রূপান্তরিত হয়ে গেছে।
আর লাইলাতুন নিসফ মিন শাবান শবেবরাত হয়ে পুরো ইবাদতই পাল্টে নব্য ইবাদতে রূপান্তরিত হয়েছে। আখেরী চাহার সোম্বার কথা তো ইসলামেই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। একইভাবে আরবের শায়খদের উপমহাদেশে পীর বানিয়ে ব্যবসা চলছে। অথচ এই শায়খ সেই পীর কখনোই এক নয়।
সাখাওয়াতুল আলম চৌধুরী
২১ মার্চ, ২০২২
পতেঙ্গা, চট্টগ্রাম।