কুরআনের আয়াতের মতোই শিশুটি ছিলো প্রাণবন্ত। যা তার বাবা-মায়ের হৃদয়ে এনে দিত প্রশান্তি। ভালোবেসে তারা নাম রেখেছিলেন "আয়াত"। হাঁটি হাঁটি পাপা করে বড় হতে থাকা আয়াতকে, কুরআনের সত্যিকারের আয়াতের সাথে পরিচয় করিয়ে দিতেই বাবা-মা ভর্তি করায় মাদ্রাসায় তাকে। আল্লাহ্র সুন্দর পৃথিবীতে একজন সত্যিকারের দ্বীনি মানুষ হওয়ার জন্যে, সেদিনও তার ছোট্ট পায়ে পথচলা ছিলো মাদ্রাসার দিকে।
ফুটফুটে আয়াত গায়ে প্রজাতির পাখনা লাগিয়ে উড়ে যেতে থাকে আপনমনে। যেতে যেতেই মাদ্রাসার মাঠে দেখা হয় বন্ধুদের সাথে। ওখানে কিছুক্ষণ হই-হুল্লোড় করার ফাঁকে তার দিকে এগিয়ে আসে তারই পরিচিত এক চাচ্চু। আদর করে চাচ্চু তাকে কোলে তুলে নেয়। চাচ্চু তাকে নিয়ে যেতে বাসায়। কিন্তু সে যেতে চায় না। তবুও ছোট্ট আয়াত বুঝে না বুঝে কিংবা চাচ্চুর ছলা কৌশলে ধরা পড়ে যায় তার জালে।
এমনই সুযোগ খুঁজছিল চাচ্চু নামে অমানুষটি। দীর্ঘদিন বেকার, পারিবারিক অশান্তি, ধারদেনার চাপে নিমজ্জিত হয়ে সে মানুষ থেকে অমানুষ হয়ে উঠার চেষ্টা করে। সেই প্রচেষ্টা থেকে নিয়মিত দেখতে থাকে ক্রাইম পেট্রোল, সিআইডিসহ নানান অপরাধমূলক কলাকৌশল। ধীরে ধীরে নিজেকে তৈরি করতে থাকে একজন দক্ষ অপরাধী হিসাবে। এভাবে এমনই একটি সুযোগ খুঁজছিল সে।
বিধাতার বিধির লিখনে কৌশলে আয়াতকে সে নিয়ে আসে তার নিজের কাছে। হঠাৎই আয়াত বুঝতে পারে তার প্রতিদিনের পরিচিত চাচ্চু, আর আজকে তাকে নিয়ে আসা চাচ্চু এক নয়। আজ চাচ্চুর চোখেমুখে অস্থিরতার সর্পিল দৃষ্টি। তাড়াহুড়া করতে থাকে চাচ্চু তাকে বাসায় আটকে রাখতে চায়। কিন্তু কিছু বুঝে না উঠা আয়াত চিৎকার চেঁচামেচি করতে থাকে। আয়াতের এমন চেঁচামেচিতে চাচ্চুর পুরো পরিকল্পনা ভেস্তে যেতে থাকে।
শেষপর্যন্ত দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে অমানুষ চাচ্চু চেপে ধরে আয়াতের মুখ। চেষ্টা করে তাকে শান্ত করতে। কিন্তু উচ্ছল উচ্ছ্বাসে থাকা আয়াত তার চাচ্চুর এমন হাবভাব হতবিহ্বল! তাই সে আরো জোরে কান্না করতে থাকে। পরিস্থিতির এমন অনিশ্চয়তার মাঝে চাচ্চু চেপে ধরে আয়াতের টুঁটি! কত পরিচিত ছোট্ট আয়াতের এই গলা। এই গলা ধরেই দুজনে কত গলাগলি ছিলো।
অথচ মানুষের ভিতরটা যখন অমানুষের দখলে চলে যায়, তখন সে আদরের পরিচিত গলা চেপে ধরতেও দ্বিধা করে না। ধীরে ধীরে প্রাণবন্ত নিষ্পাপ দেহটি লুটিয়ে পড়ে চাচ্চুর পরিচিত আদরমাখা হাতে। হঠাৎই এমন দূর্ঘটনায় মানুষটি বিচলিত হয়ে উঠে। অথচ টিভি দেখে দীর্ঘতম প্রশিক্ষণ নেওয়া অমানুষটি তাকে শান্ত থাকতে সাহায্য করে।
মানুষটির প্লান ছিলো আয়াতকে আটকে রেখে তার বাবা থেকে মোটা অংকের টাকা মুক্তিপণ নেওয়া। সে লক্ষ্যে একটি সস্তা মোবাইল এবং কুড়িয়ে পাওয়া সিমকে কাজে লাগাতে সংগ্রহ করে। কিন্তু ঘটনার আকস্মিকতায় মানুষটি হেরে গেলেও অমানুষটি দমবার নয়। তাই চাচ্চুুুর ভিতরে থাকা অমানুষটি ঠান্ডা মাথায় কাজ শুরু করে।
প্রথমেই মোবাইল খুলে আয়াতের বাবাকে ফোন দিতে চেষ্টা করে। কিন্তু তার তাকদির তার সাথে শত্রুতা করে। সিমটি কোনভাবেই চালু হয় না। তারমানে টাকা চাওয়ার নিরাপদ উপায় নেই। সুতরাং এখন এই প্রজেক্ট এখানেই ক্লোজ করতে হবে। নিজেকে নিরাপদ রাখতে লাশটি এমনভাবে গোপন করতে হবে, যাতে লাশের সূত্র ধরে কেউ তাকে ধরতে না পারে।
যে ভাবা সেই কাজ। পারিবারিক অশান্তির জন্য চাচ্চুর বাবা মা ডিভোর্স হয়ে থাকে আলাদা। মানুষটির যাতায়াত তাই মা-বাবার দুই বাসাতেই। ফলে দুটো ব্যাগ নিয়ে একটিতে আয়াত অন্যটিতে লেপ তোষক নিয়ে মায়ের বাসার দিকে রওনা হয়। নিয়মিত ছেলের যাতায়াতের কারণে মা কিংবা বোনের কোনো সন্দেহ হয়না।
সাবধানে আয়াতকে রেখে দেয় বাথরুমে। পরে সেখানে পারফিউম ছড়িয়ে দেয় যাতে কোনো গন্ধ পাওয়া না যায়। এক ফাঁকে চতুর অমানুষটি দোকান থেকে কার্টার টেপ ইত্যাদি কিনে আনে। সুযোগ বুঝে কার্টার দিয়ে কাটতে চেষ্টা আয়াত নিষ্প্রাণ দেহটি। কিন্তু তাতে সে সফল হয়না। একসময় বটি দিয়ে সে সফলতার সহিত তিনটি টুকরো করে আয়াতকে শব্দে পরিনত করে।
ইতিমধ্যে চারদিকে আয়াতকে খোঁজাখুঁজির রব পড়ে যায়। একসময় চাচ্চুর কাছেও আয়াতের বাবা ধরনা দেয় মেয়েকে খুঁজে দেখার জন্য। অমানুষটি মানুষটিকে সাথে নিয়ে চমৎকার অভিনয় করে যেতে থাকে। নিজের অভিনয়ে নিজেই অভিভূত! ঠান্ডা মাথায় এরই ফাঁকে আয়াতের খন্ডিত টুকরো গুলো সে ফেলে দিয়ে আসে সাগরের অসীম জলে।
এভাবেই সমাপ্তি হয় আয়াতের পৃথিবীর পথচলা। তার বাবা-মায়ের অতৃপ্ত আত্মকে সান্ত্বনা দিতেও খুঁজে পাওয়া যায় না আয়াতে ছিটেফোঁটাও। তথ্যপ্রযুক্তির আধুনিক নিরীক্ষণে ধরা পড়ে অমানুষটির কিছু ফুটেজ। শেষ পর্যন্ত অমানুষটি হাজার চেষ্টা করলেও মানুষটিকে বাঁচাতে পারে না। এভাবেই পরিসমাপ্তি হয় একটি নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ডের।
আজ আমাদের সামাজিক রাজনৈতিক অর্থনৈতিক অবক্ষয়ের কারণে ধীরে ধীরে ধর্মীয় অবক্ষয়ের দিকে জাতি ধাবমান। যেকারণে আজ আমাদের স্নেহ মায়া মমতা আবেগ নীতি নৈতিকতা সভ্যতা ইত্যাদি সবই বিকারগ্রস্ত। আর তাই পিতামাতার ডিভোর্সের কারণে চাচ্চুটি মানসিক অশান্তিতে পড়ে অপরাধের দিকে পা বাড়ায়।
টিআরপির চাপে টেলিভিশন কোম্পানি গুলো আজ অপরাধ এবং অপরাধী নিয়ে নানান অনুষ্ঠানে ব্যতিব্যস্ত। যেখান থেকে সভ্যরা ভালো কিছু না পেলেও অসভ্য বর্বর অপরাধীরা অপরাধ জগতের পদচারণার জন্য পাচ্ছে নানান কলাকৌশল। যার ফলাফল আয়াতের মতো নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ড।
তাই এখনই উচিত অপরাধমূলক অনুষ্ঠান বন্ধ করা। একইসাথে প্রতিটি পরিবারে সহিষ্ণুতার পারিবারিক বন্ধন দৃঢ় করা। যার একমাত্র মাধ্যম হচ্ছে দ্বীনের প্রকৃত শিক্ষা। আজ ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ এবং রাষ্ট্রে প্রকৃত ইসলামকে অনুসরণ করা হলে, এমন নির্মমতার পরিস্থিতিতে পড়তে হতো না। সুতরাং আসুন ব্যক্তিজীবন থেকে শুরু করে পরিবার সমাজ রাষ্ট্রে ইসলামের পথ অনুসরণ করি।
সাখাওয়াতুল আলম চৌধুরী
২৬ নভেম্বর ২০২২ ইংরেজী
পতেঙ্গা, চট্টগ্রাম।