সুফীবাদ হচ্ছে বৈরাগ্যবাদের একটি সংস্করণ। যা যুগের সাথে সাথে ইসলামী মতবাদ বলে স্বীকৃত করা হচ্ছে । যা হিজরী তিনশত বছর পরে ভিত্তি লাভ করেছিল। যার মূল ভিত্তি হিসাবে ধরা হয় তাসাউফ যা ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এই তাসাউফকে কেন্দ্র করেই সুফিবাদের সৃষ্টি।
হিজরী তিনশো শতক পরে কিছু আল্লাহ্ ভীরু মানুষ দুনিয়াবিমুখ জীবনযাপনের দিকে ঝুকে পড়ে। ঐসব আল্লাহ্অলা ধর্মভীরু মানুষদের সাধারণ সাদামাটা জীবন তৎকালীন সবার দৃষ্টি কাড়ে। সেই সাদামাটা জীবনযাপনকে কেন্দ্র করে ইসলামের তাসাউফের পোশাক পড়ে সুফীরা এই সুফীবাদের গোড়াপত্তন করে।
যে মতবাদের সাথে জড়িত হয়ে পড়ে নানান ধর্মের নানান রীতিনীতি আচার আচরণ। বিশেষকরে ইরানী দর্শন, বেদান্ত দর্শন, গ্রীক দর্শন, জরথ্রোষ্ট দর্শন, হিন্দু দর্শন, বৌদ্ধ দর্শন ইত্যাদির সংমিশ্রণে ধীরে ধীরে প্রতিষ্ঠা লাভ এবং বিকশিত হতে শুরু সুফীবাদ।
সুফিরা যে উদ্দেশ্যে এই মতবাদ প্রতিষ্ঠা করে তা সরাসরি ইসলাম বহির্ভূত নয়। তবে সুফিরা ধীরে ধীরে যে আদর্শ আকিদা রীতিনীতি আচরণ অনুষ্ঠান ইত্যাদি পালন করা শুরু করেছে, তা সরাসরি ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক। সুফি নাম বা এই জাতীয় আকিদা পবিত্র কুরআন এবং সুন্নায় কোথাও পাওয়া যায় না। শুধু তাইনয় রাসুল সাঃ পরবর্তীতে সাহাবী, তাবেয়ী, তবেতাবেয়ীগণের মধ্যেও এই (যা বর্তমানে প্রতিষ্ঠিত) জাতীয় আকিদা মতবাদ ইত্যাদি পাওয়া যায় না।
সুফীবাদ পৃথিবীতে নতুন কোনো মতবাদ নয়। ইসলামের পূর্বেও সুফীবাদ তথা বৈরাগ্যবাদ ছিলো। হিন্দু, খ্রিস্টান, বৌদ্ধসহ প্রায় সকল ধর্মের মূলে রয়েছে বৈরাগ্য বা সংসার বিরাগী। এই বিযয়ে বিস্তারিত জানার অবকাশ আছে।
সুফীবাদের ইসলাম মুলত এমন একটি চিন্তাধারা বা মতবাদ যা দুনিয়াবিমুখীতা এবং আল্লাহ্ভীরু হতে শিক্ষা দেয়। ইসলামের মূল দর্শনের (কুরআন এবং সুন্নাহর) বাইরে কিছু মৌলিক দর্শনের (তাসাউফ, দুনিয়া বিমুখ, আল্লাহ্ ভীরু) ভিত্তিতে এই সুফীবাদ প্রতিষ্ঠিত। সুফীবাদ একটি চিন্তা, চেতনা, আধ্যাত্মিকতা, ইত্যাদির সংমিশ্রণের একটি দর্শন বা মতবাদ। যা ধীরে ধীরে সময়ে সময়ে পরিবর্তিত, পরিমার্জিত, বর্ধিত হয়ে বিভিন্ন মতানুসারে বিভিন্ন ধারায় ইসলামের ছায়াতলে এখনো টিকে আছে।
সময়ে সময়ে কালের বিবর্তনে সুফীবাদ নতুন নতুন ধ্যান ধারণা আমল আকিদা ইত্যাদি সংযোজন করে বিভিন্ন পথ এবং মতে বিভক্ত হয়েছে। যা এখনো চলমান। মূলত সুফীবাদ হচ্ছে এমন একটি ধ্যানধারণা যা সময়ের সাথে পরিবর্তিত হতে পারে। অর্থাৎ এদের মূল আকিদাই সুফি গুরু যারা তারা প্রয়োজনে যেকোনো আইন, ইবাদত, পদ্ধতি ইত্যাদি সংযোজন বিয়োজন করার ক্ষমতা রাখেন। যা ইসলামের মূল দর্শনের সাথে সাংঘর্ষিক।
সুফি কারা?
হযরত ইবনে তাইমিয়াহর রহ বলেন, কেউ বলেন, ‘সুফি’ শব্দটি ‘আহলে সুফ্ফাহ’-এর সাথে জড়িত। তবে এটা ভুল। কারণ যদি এর সাথে জড়িত হতো, তাহলে এদের সুফ্ফী বলা হত।
কেউ বলেন, এটা আল্লাহর সামনে দাঁড়ানো প্রথম সফ্ (কাতার) এর সাথে জড়িত। কিন্তু এটাও ভুল। কারণ যদি তাই হতো তাহলে এদের বলা হতো সাফ্ফী।
কেউ কেউ বলেন, আল্লাহর সৃষ্টির মধ্যে ছাটাইকৃত ‘সাফ্ফাহ’-এর সাথে এই শব্দটি জড়িত। তবে এটা সঠিক নয়। যদি এমন হতো তাহলে তাদের বলা হতো সাফভী।
কেউ কেউ বলেন, এটা আরবের এক গোত্র ‘সূফাহ ইবনু বিশ্র ইবনু উদ্দ ইবনে তাবিখাত’-এর সাথে সম্পৃক্ত। এরা প্রাচীন যুগ থেকে মাক্কার আশেপাশে থাকতেন। অধিক ‘ইবাদাতকারীগণ এদেরই সাথে সম্পর্কিত হতেন। শব্দের সাথে সম্পর্কের দিক দিয়ে এই সম্পর্কটা ঠিক মনে হলেও এটা দুর্বল অভিমত।
কারণ ঐ গোত্রটি অধিক ‘ইবাদাতকারীদের অধিকাংশের নিকট অখ্যাত ও অপ্রসিদ্ধ। কারণ ‘ইবাদাতকারীগণ যদি তদের সাথে সম্পর্কিত হতেন তাহলে এই সম্পর্কটা সহাবী ও তাবিয়ী এবং তাবি-তাবিয়ীদের যুগে উত্তম হতো। সেইসাথে ঐ গোত্রের কেউই সূফী নামে প্রসিদ্ধি লাভ করেনি। আর কেউ ঐ কাফিরী যুগের গোত্রের সাথে সম্পর্কিত হতে রাযীও হবে না। (ইবনু তাইমিয়াহ মাজমুয়ায়ে ফাতাওয়া ১১ খন্ড, পৃষ্ঠা ৬৫)।
মোল্লা জামী বলেন, শব্দটি صفاء (পবিত্রতা ও স্বচ্ছতা) থেকে নির্গত হয়েছে। কেননা তারা পূতপবিত্র ও স্বচ্ছ জীবন যাপন করতেন। সুফীর সংজ্ঞায় বর্ণিত এই কথাটি ঠিক নয়। কারণ সুফীরা নিজেদের কে صوفي বলে উল্লেখ করেন। صفاء শব্দ থেকে সুফীর উৎপত্তি হয়ে থাকলে তারা নিজেদেরকে صفائي সাফায়ী বলতেন।
অথচ এই মতবাদে বিশ্বাসী কোন লোক নিজেকে সাফায়ী বলেন না, বরং সুফী বলেন। এ থেকে আমরা বুঝতে পারি, সুফী হচ্ছেন ঐ ব্যক্তি, যিনি পশমী ও মোটা কাপড় পরিধান করেন এবং দুনিয়ার ভোগ-বিলাস পরিহার করে সরল সোজা ও সাদামাটা জীবন যাপন করেন।
আবার কেউ কেউ মনে করেন, 'সূফী' শব্দটি সাফ (পবিত্রতা) অথবা সূফ (পশম) অথবা সূফফা থেকে উৎপন্ন হয়েছে। তাসাউফ পন্থীদেরকে সূফী বলা হয়। এরা আধ্যাত্মিকতাবাদীও বটে। এদের গুরুকে পীর নামে অভিহিত করা হয়। (সূফী তত্বের অন্তরালে, অধ্যাপক আব্দুন নূর সালাফী ১ পৃষ্ঠা)।
শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রাহিমাহুল্লাহ আরও বলেন, আল সুফিয়াহ বা সুফিবাদ শব্দটি দ্বারা ওলেন তৈরি পোশাক পরিধান করাকে নির্দেশ করে, আর এটাই সঠিক অর্থ। (ইবনু তাইমিয়াহ মাজমুয়ায়ে ফাতাওয়া ১১/১৬৮)।
সুফিদের মূল ভিত্তি যুহদ
যুহদ হচ্ছে এমন বিষয় যা মানুষকে দুনিয়া বিমুখ করে আল্লাহ্ ভীরুতার শিক্ষা দেয়। রাসুল সাঃ পরবর্তীতে ইসলামের প্রথম চার খলিফার রাজত্বের পরে ইসলামের শাসনব্যবস্থায় ব্যাপক পরিবর্তন সাধিত হয়।
ইসলামের মূল ভিত্তি হলো আল্লাহ্ ভীরুতা এবং দুনিয়া বিমুখীতা। অর্থাৎ ইসলামে দুনিয়ার চাইতে আখিরাতের প্রাধান্য বেশী। ইসলামের শুরুর দিকে মুসলমানরা ছিলো আর্থিকভাবে নিঃস্ব। পরবর্তীতে বিভিন্ন দেশ এবং রাজ্য বিজয়ের ফলে ইসলাম দিক বিদিক ছড়িয়ে পড়ে। মুসলমানরা পরিচিত হয় বিভিন্ন দেশ ও রাজ্যের বিভিন্ন সমাজ সংস্কৃতির সাথে।
আরব ছাড়া অন্যান্য দেশ এবং রাজ্য অনেক আগেই সমাজ, সংস্কৃতি, ধন, দৌলত বিলাসিতায় পরিপূর্ণ ছিলো। মুসলমানরা বিভিন্ন দেশ জয়ের ফলে সেইসব দেশ ও বিলাসীতাপূর্ণ সংস্কৃতির সাথে পরিচিত হয়। এই ধন দৌলত জৌলুস কিছু নামধারী মুসলমানকে আকৃষ্ট করে। যারা নিজেদের ঐসব সংস্কৃতিতে পরিচালিত করার চেষ্টা করে। যা বন্ধ করতে হযরত উমর রাঃ কঠোর ছিলেন। তাঁর পরবর্তীতে ইসলামী খেলাফতের দৃঢ়তা ধীরে ধীরে দূর্বল হতে থাকে।
একসময় ইসলামে নেমে আসে চরম অন্ধকার। হযরত ওসমান বাঃএর শহীদ হওয়া এবং আলী রাঃ কতৃক ক্ষমতা গ্রহণ এবং তাকে মুয়াবিয়া রাঃ সাহায্য সহযোগিতা না করা ইত্যাদি সব মিলিয়ে তখন ইসলাম খুবই কঠিন এক সময় পার করে।
এতকিছুর পরও বিভিন্ন দেশ ও রাজ্যে ইসলামের প্রচার প্রসার বৃদ্ধি হতে থাকে। ধীরে ধীরে বিজিত রাজ্যের জৌলুসে ইসলামী শাসকগণ নিজেরাই জড়িয়ে পড়ে। ইসলামী শাসকদের এমন বিলাসীতাপূর্ণ জীবনযাপন এবং ইসলামের মূল ভিত্তি সরে যাওয়া দেখে কিছু তাবেয়ী এবং তবেতাবেয়ী রাঃগণ আল্লাহ্ ভীরুতার দিকে মনোযোগ দেন।
তাঁরা নিজেরা দুনিয়াবিমুখ জীবনযাপন করে এবং সাধারণ মানুষকে সেই জীবনযাপনে আকৃষ্ট এবং উদ্বুদ্ধ করতেন থাকেন। শাসকদের বিলাসীতা এবং ইসলামবেমুখীতার বিরুদ্ধে তাঁদের এই অভিনব প্রতিবাদ এবং ধর্মীয় দর্শন তৎকালীন সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হয়েছিল।
ইসলামে দুনিয়া থেকে আখিরাতকে প্রাধান্য বেশী দেওয়া হয়েছে । সেইসাথে আল্লাহ্ ভীরুতার সাথে ইবাদত অধিক গ্রহণযোগ্য। তবে ইসলামে কখনোই বৈরাগ্যবাদের স্থান নেই। বৈরাগ্যবাদ তথা সংসার বিমুখীতা কখনোই আল্লাহ্ সমর্থন করেননি এবং করে না। এই ব্যাপারের পবিত্র কুরআনে স্পষ্ট করে বলা আছে যে,
" আর সন্ন্যাসবাদী (বৈরাগ্যবাদ)—এটা তো তারা (খ্রিস্টানরা) নিজেরাই আল্লাহ্র সন্তুষ্টি লাভের জন্য প্রবর্তন করেছিল। আমরা তাদেরকে এটার বিধান দেইনি; অথচ এটাও ওরা যথাযথভাবে পালন করেনি। অতঃপর তাদের মধ্যে যারা ঈমান এনেছিল, তাদেরকে আমরা দিয়েছিলাম তাদের পুরস্কার। আর তাদের অধিকাংশই ছিল ফাসিক।" (সূরা হাদীদ : ২৭)
খ্রিস্টানরা আল্লাহ্কে সন্তুষ্ট করার জন্য নিজেরাই সংসার বিমুখী বৈরাগ্যতার পদ্ধতি বেছে নেয়। যা আল্লাহ্ তাদের জন্য ফরজ করেননি। তবুও তারা সেই বৈরাগ্যতাও ঠিকমতো পালন করেনি। সুতরাং আল্লাহ্ বৈরাগ্যতা তথা পছন্দ করেন না। তবে দুনিয়াবিমুখীতা পছন্দ করেন। অর্থাৎ দুনিয়ার সবকিছু ঠিক রেখে আল্লাহ্কে সন্তুষ্ট করা। যাকে বলা হয় " যুহদ "।
তৎকালীন কয়েকজন তাবেয়ী এবং তবেতাবেয়ীগণ বিশেষ করে হাসান বসরী, জুনাইদ, রাবেয়া বসরী যুহদের চর্চা করতেন যা অন্যান্য সবাইকে শিক্ষা দেওয়ার জন্য। এই দুনিয়াবিমুখীতা এবং আল্লাহ্ ভীরুতাকে নিয়ে পরবর্তীতে কিছু মনীষী নিজস্ব মতামতের ভিত্তিতে বৈরাগ্যবাদ তথা সুফীবাদ সৃষ্টি করে।
সুফিবাদে তারা আল্লাহর ইবাদত ও দুনিয়াবিমুখীতার জন্য নিজেকে প্রচুর কষ্ট দিতো। অর্থাৎ ক্ষুধা দারিদ্র্য সংসার বিমুখ প্রচুর নফল ইবাদতে মশগুল থাকতো। যা তৎকালীন তাবেয়ীগণ এবং তবেতাবেয়ীগণ প্রত্যাখ্যান করেন।
তবুও বিভিন্ন জগৎ বিখ্যাত মীনীষা এবং বু্ুজুর্গগণ বিভিন্ন যুগে তাদের আধ্যাত্মিকতার মোড়কে ইসলামের তাসাউফকে পুঁজি করে সুফীবাদের বিভিন্ন ত্বরিকা প্রতিষ্ঠিত করেন। যা সরাসরি কুরআন এবং হাদীস দ্বারা প্রমাণিত নয় বরং সাংঘর্ষিক।
সুফীবাদে ইসলাম বিচ্যুতি
যদিও ইসলামের তাসাউফ তথা আত্মশুদ্ধিকে কেন্দ্র করে সুফীবাদ প্রতিষ্ঠিত। তবুও সুফীবাদে মারেফাতের নাম করে বিভিন্ন বিষয়ের অবতারণা করা হয়। যা কখনোই ইসলাম সমর্থিত নয়। যুগে যুগে বিভিন্ন সুফিদের হাত ধরে বিভিন্ন ধর্মের গোত্রের বিভিন্ন মতবাদের আশ্রয়ে সুফিবাদের বিভিন্ন মতবাদ প্রতিষ্ঠিত হয়।
বিভিন্ন ধর্মের এবং সংস্কৃতির বিভিন্ন ধর্মীয় চিন্তাধারা ও রাজনৈতিক মতবাদে একত্রিত হতে থাকে সুফীবাদে। যারফলে ইসলামের মূল আকিদার যে ভিত্তি তা থেকে সুফিবাদ ধীরে ধীরে দূরে সরে যেতে থাকে। ফলে হিজরি তৃতীয় শতকের পরবর্তী থেকেই সুফিদের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু হয়। এবং তারা মূল ধারার ইসলাম থেকে সরে গিয়ে জনমানবশূন্য এলাকায় বসতি স্থাপন করে তাদের সুফিবাদের চর্চা শুরু করে।
মূল মুসলিম জনগণ থেকে দূরে সরে গিয়ে প্রথম দিকের সুফিগণ তাদের আধ্যাত্মিকতা, ন্যায়পরায়ণতা, ব্যক্তিগত আদর্শ এবং দুনিয়াবিমুখীতা দিয়ে সাধারণ মুসলমানদের আকৃষ্ট করে। যেখানে দৈনন্দিন ইবাদতের চাইতে আধ্যাত্মিকতাকে বেশী গুরুত্ব দেওয়া হতো।
আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, সুফিবাদ তথা বৈরাগ্যবাদ পৃথিবীতে ধর্ম চর্চার শুরু থেকে চলে আসছিল। যা পৃথিবীর বর্তমান অন্যান্য ধর্মের মধ্যে পরিলক্ষিত। সে পথে অনুসরণে তাসাউফের নামে আধ্যাত্মিকতাকে পুঁজি করে নতুন নতুন ইবাদত আমল আকিদা দ্বারা সুফিবাদেও প্রতিষ্ঠিত। যা সরাসরি, প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে ইসলামের মূল ঈমান আকিদার বিপরীত। যেকারণে সুফীবাদ সৃষ্টির তৎকালীন সময় থেকেই প্রশ্নবিদ্ধ। এই সুফিবাদ মূল ইসলামের কেন্দ্রে (মক্কা মদিনায়) কখনোই গ্রহণযোগ্য হয়নি।
পরবর্তীতে সুফিগণ বিভিন্ন দেশ রাজ্যে ইসলাম প্রচারের নামে সুফিবাদ প্রতিষ্ঠা করে। যা আমাদের উপমহাদেশেও প্রতিষ্ঠিত। এভাবে বিভিন্ন দেশ ও রাজ্যে সুফিদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে মূল ইসলাম বিকৃত হয়ে সুফিবাদী ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। যা এখনো চলমান।
এই সুফিবাদ অধিকাংশ শিয়া মতবাদের আশ্রয়ে গঠিত। অর্থাৎ শিয়াদের ঈমান আকিদার সাথে সুফিদের ঈমান আকিদার মিল রয়েছে। শিয়াদের প্রভাব থাকার কারণ হলো, উমর রাঃ যখন পারস্য জয় করেন তখন সেখানে ছিলো অগ্নি উপাসকের উপাসনা। তারা বৈরাগ্যবাদে বিশ্বাসী ছিলো। ইসলামী রাজনৈতিক কারণে পরবর্তীতে সেখানে মূল ইসলামের প্রচার প্রসার এবং শিক্ষা কোনটাই সম্ভব হয়নি। যারফলে পারস্যে সুফিবাদের বিস্তার লাভ সহজ হয়। ধরা হয়ে থাকে যে পারস্য থেকেই ইসলামে সুফিবাদের বীজ বপন হয়।
সুফিবাদের আধ্যাত্মিকতা
সুফিবাদ তাসাউফকে কেন্দ্র করেই উৎপত্তি। তাই সুফিরা আল্লাহ্ ভীরুতা এবং দুনিয়াবিমুখীতাকে প্রাধান্য দেয়। সেই হিসাবে বর্তমান সুফিবাদের অর্থ হলো, তাসাউফ তথা আত্মশুদ্ধির মাধ্যমে মানব আত্মার থেকে পরমআত্মার সাথে বিলীন হওয়ায়। এখানে পরমআত্মা হলো আল্লাহ্।
অর্থাৎ শয়তানের সাথে জিহাদ করে কাম ক্রোধ হিংসা অহংকার ইত্যাদিকে নিয়ন্ত্রণ করে তাকে পরাজিত করাই হচ্ছে আত্মার পরিশুদ্ধি।আত্মার পরিশুদ্ধির জন্য সকল পাপ থেকে মুখ ফিরিয়ে একমাত্র আল্লাহ্ মুখী হওয়ায়ই হচ্ছে সুফিদের দর্শন।
এই আত্মার পরিশুদ্ধির জন্য প্রতিটি মানুষকে একজন গুরু বা পীরের কাছে ছাত্রত্ব গ্রহণ করতে হয়। ছাত্রকে বলা হয় মুরিদ। এই মুরিদ তার গুরু থেকে আত্মশুদ্ধির বিভিন্ন পন্থা শিখে অনুসরণ করে প্রথমত পীরের কাছে বিলীন হয়। পরবর্তীতে জ্ঞানার্জন করে মুরিদ আল্লাহ্তে বিলীন হয়ে ফানাবিল্লাহ অর্জন করে। এর পরে চূড়ান্ত জ্ঞানার্জন ও অধ্যবসায় করে স্থায়ীভাবে আল্লাহ্তে অবস্থান করাই হচ্ছে বাকিবিল্লাহ।
বাকাবিল্লাহ অর্জিত হলে সুফি দর্শন অনুযায়ী সুফি বা পীরের মুরিদ আল্লাহ প্রদত্ত বিশেষ শক্তিতে শক্তিমান হন। তখন মুরিদের অন্তরে সার্বক্ষণিক শান্তি ও আনন্দ বিরাজ করে। সুফিগণের মতে, মুহম্মাদ (সাঃ) স্বয়ং সুফিদর্শনের প্রবর্তক।
এর সপক্ষে সুফিগণ রাসুল (সাঃ) একটি হাদিস উল্লেখ করেন যা হল, “মানব দেহে একটি বিশেষ অঙ্গ আছে যা সুস্থ থাকল সমগ্র দেহ সুস্থ থাকবে, আর যা অসুস্থ থাকলে সমগ্র দেহ অসুস্থ থাকবে। আর তা হল অস্তকরণ বা কলব। জেনে রেখ এই কলব আল্লাহ স্মরনে কলুষমুক্ত হয়”।
সুফিবাদে আল্লাহ্ নিরাকার (আল্লাহর আকার আছে তবে ধরণ জানি না )। এই নিরাকার আল্লাহর প্রেমে মত্ত হয়ে তাঁর মধ্যে বিলীন হওয়াটাই হচ্ছে সুফীবাদ।
সার্বক্ষণিক আল্লাহর স্মরণের মাধ্যমে কলবকে কলুষমুক্ত করে আল্লাহর প্রেমার্জন সুফিবাদের উদ্দেশ্য। যাঁরা তাঁর প্রেমার্জন করেছেন তাদের তরিকা বা পথ অনুসরণ করে ফানাফিল্লাহর মাধ্যমে বাকাবিল্লাহ অর্জন করাই হলো সুফিদর্শন। (সূত্রঃ উইকিপিডিয়া)
বিভিন্ন সুফিদের বিভিন্ন পথ, পদ্ধতি, পন্থা, আকিদা, আমল ইত্যাদি রয়েছে। বিভিন্ন বিখ্যাত সুফিদের মতাদর্শ নিয়ে বিভিন্ন ত্বরিকা বা পথ সৃষ্টি হয়েছে। সুফিদের মতে যেকোনো ত্বরিকা বা পথ অবলম্বন করেই আল্লাহকে পাওয়া যায়। এইসব ত্বরিকার মধ্যে রয়েছে কাদেরিয়া, সাবেরিয়া, চিশতিয়া, নক্সবন্দী ইত্যাদি।
এইসব ত্বরিকা ছাড়াও হিন্দু মুসলিম যৌথ ধর্ম ভিত্তিক সুফি দর্শন হলো বাউল সম্প্রদায়। যারা নিজেদের সুফিবাদের অংশ মনে করে। যাদের ইবাদতের মূল নাচ গান ভজন ইত্যাদি দ্বারা আল্লাহ্কে সন্তুষ্ট করা। যারা মূলত সাম্যবাদী মনমানসিকত নিয়ে পৃথিবীতে একমাত্র মানব ধর্মের পূজা করে। যাদের মূল চিন্তাধারা হচ্ছে মানুষ মানুষের জন্য। মানব প্রেমই ইশ্বর প্রেম। মানব সন্তুষ্ট হলেই ইশ্বর সন্তুষ্ট। পৃথিবীতে যে বিভিন্ন ধর্ম জাতি, গোষ্ঠী জাত পাত ইত্যাদি আছে তা থেকে তারা সম্পূর্ণ মুক্ত। এই মতবাদের প্রবক্তারা হলেন লালন ফকির বা লানল শাহ, হাসন রাজা।
সুফিদের বর্তমান পরিস্থিতি
অতীতে সুফিরা লোক জনসমাগমের বাইরে থেকে আল্লাহর ইবাদতে আধ্যাত্মিকতার চর্চা করত। গত একশ বছর আগেও সুফিদের প্রাতিষ্ঠানিক কোনো শৃঙ্খলা ছিলো না। অর্থাৎ সুফিদের আধ্যাত্মিকতার চর্চার কোনো প্রাতিষ্ঠানিক রূপ ছিলো না।
প্রতিটি পীরের দরবারে মুরিদের সমাগম থাকতো। তারা তাদের পীরদের থেকে জ্ঞান নিয়ে তা নিজেরা চর্চা করতো। গত কয়েক যুগ ধরে আধুনিকতার ছোঁয়ায় সবকিছুই প্রাতিষ্ঠানিকভাবে চলা শুরু হয়েছে। একটা নিয়মের মধ্যে প্রতিটি দরবারের কার্যক্রম চলছে। অলি আউলিয়াদের জন্মবার্ষিকী মৃত্যুবার্ষিকীসহ বিভিন্ন বার্ষিক বিভিন্ন অনুষ্ঠান চালু হয়েছে। বিভিন্ন নির্ধারিত অজিফার জিকির আজকারের মাধ্যমে আধ্যাত্মিকতার একটি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া হয়েছে। সেইসাথে হাদিয়া তোফার বাধ্যতামূল সিস্টেম চালু হয়েছে।
এইসব প্রাতিষ্ঠানিক কর্মকান্ড ছাড়াও বংশ পরস্পরায় পীর বা আল্লাহর অলি নির্বাচন করার নতুন পদ্ধতি চালু হয়েছে। অতীতে সুফিদের পীর স্বীকৃতি পেতেন যিনি কঠোর তপস্যা করে আল্লাহ্কে পাওয়ার জন্য কষ্ট সাধনা করে উচ্চ মকামে পৌঁছেছেন। কিন্তু যুগের সাথে সাথে সেই পদ্ধতি ছেড়ে দিয়ে পীরের বংশ থেকেই তাদের আওলাদকেই পরবর্তী পীর ঘোষণা দেওয়া হচ্ছে। যদিও তাদের যোগ্যতা না থাকে।
অর্থাৎ পীর আউলিয়া হওয়া এখন যোগ্যতার বিষয় নয় বরং রাজতন্ত্রের বংশ পরস্পরায় পীর আউলিয়া নির্বাচিত বা নির্ধারিত হয়ে আসছে। শুধু তাইনয় সুফিদের মূল উদ্দেশ্য যেখানে দুনিয়াবিমুখীতা। সেখানে আধুনিক সময়ের সুফিরা দুনিয়াবিমুখীতা বর্জন করে বিলাসিতায় গা বাসিয়ে দিচ্ছে।
প্রতিটি দরবারে হাদিয়া তোফার জন্য বিশাল বিশাল দানবক্স রাখা হচ্ছে। সেখানে ভক্তরা দুনিয়া এবং আখিরাতের আশায় পীরদের জন্য টাকাপয়সা দিচ্ছেন দুহাত ভরে। এই দান সদকার সিংহভাগ টাকাই ব্যায় হচ্ছে পীর আউলিয়াদের বিলাসি জীবনযাপন এবং ভরনপোষনে।
ধর্মের নামে সুফিরা বর্তমানে ধর্ম ব্যবসা নিয়ে ব্যস্ত। সুফিরা নিজেদের বিভিন্ন ত্বরিকতের গোত্রে ভাগ করে বিভিন্ন দলে বিভক্ত। সুফিদের দলাদলির কারণে তাদের অনুসারীদের মধ্যেও বিভাজন বিদ্যমান। ধর্ম নিয়ে এই বিভাজনের ফলে সাধারণ মুসলমানদের মধ্যে ব্যাপক বিভেদ বিদ্বেষ সৃষ্টি হচ্ছে। যা কখনোই ইসলামে কাম্য নয়।
উপরোক্ত বিশ্লেষণে এটাই স্পষ্ট প্রতীয়মান যে, সুফিবাদ ইসলামে নব্য একটি ধারণার উদ্ভাবন করেছে। যা সাধারণ মুসলমানকে কুরআন সুন্নাহ থেকে দূরে ঠেলে দিয়ে ব্যক্তিপূজায় লিপ্ত করেছে। বিভিন্ন বিদআতী ঈমান আমলের মাধ্যমে সাধারণ অজ্ঞ মুসলমানদের শির্কের চর্চা ছড়িয়ে দিচ্ছে। যা ইসলামের সাথে সরাসরি সাংঘর্ষিক।
কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ
মোহাম্মাদ ইস্রাফিল হোসাইন। (বিএ ইন আরবি সাহিত্য ও ইসলাম শিক্ষা)
সাখাওয়াতুল আলম চৌধুরী
অক্টোবর ২০২১
অলংকার, চট্টগ্রাম।