সুফি সুন্নীরা আল্লাহর রাসুল সাঃকে বিভিন্ন বিশেষণে বিশেষায়িত করে থাকেন। সুন্নীরা রাসুল সম্পর্কে এমন এমন সব আকিদা পোষণ করে যা কখনোই ইসলাম স্বীকৃত নয়। এইসব ভ্রান্ত আকিদা সমূহ এমন যে, তা একজন ঈমানদারকে মুশরিকে পরিনত করে ঈমান হারা করে দেয়। এখন আমরা কুরআন এবং সহীহ্ হাদিসের আলোকে সুন্নীদের সেইসব আকিদার জবাব পাওয়ার চেষ্টা করবো।
রাসুলসহ অন্যান্যদের ইলমে গায়েবঃ
সুফি সুন্নীদের আকিদা হলো আল্লাহর মতই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামসহ সকল পীর অলি আউলিয়ারা অদৃশ্যর জ্ঞান তথা ইলমে গায়েব রাখেন। এটা সুস্পষ্ট কুরআন হাদীস বিরোধী কথা।
আল্লাহ তাআলা বলেন,
" আপনি বলে দিন, আমি আমার নিজের কল্যাণ সাধনের এবং অকল্যাণ সাধনের মালিক নই, কিন্তু যা আল্লাহ চান। আর আমি যদি গায়বের কথা জেনে নিতে পারতাম, তাহলে বহু মঙ্গল অর্জন করে নিতে পারতাম, ফলে আমার কোন অমঙ্গল কখনও হতে পারত না। আমি তো শুধুমাত্র একজন ভীতি প্রদর্শক ও সুসংবাদদাতা ঈমানদারদের জন্য।" [ সুরা আরাফ ৭:১৮৮ ]
এ আয়াতে আল্লাহ তাআলা তাঁর রসূল সাঃকে পরিস্কার ভাবে ঘোষণা দিতে বললেন যে, আমি গায়েবের খবর জানলে, নিজের অনেক কল্যান করতাম এবং কখনো কোন ক্ষতি আমাকে স্পর্শ করত না। আল্লাহ তাআলা বলেন,
" বলুন (হে রাসুল), "আমি তোমাদের বলি নাই যে, আমার নিকট আল্লাহ্র ধনভান্ডার রয়েছে। আমি অদৃশ্য সম্বন্ধে জানি না। আমি তোমাদের এ কথা বলি না যে, আমি একজন ফেরেশতা। আমার নিকট যে প্রত্যাদেশ অবতীর্ণ হয়েছে, আমি শুধু তার অনুসরণ করি। বল, অন্ধ ও চক্ষুষ্মান কি এক হতে পারে? তোমরা কি বিবেচনা করবে না? " [আনাম ৬:৫০]
আল্লাহ্ আরও বলেন,
" তাদেরকে বল, আল্লাহ ছাড়া পৃথিবীতে ও আকাশে কেউ অদৃশ্যের জ্ঞান রাখে না৷ এবং তারা জানেনা কবে তাদেরকে উঠিয়ে নেয়া হবে।"[নামল ২৭:৬৫]
আল্লাহ্ অন্য আয়াতে বলেন,
" তাঁরই কাছে আছে অদৃশ্যের চাবি, তিনি ছাড়া আর কেউ তা জানে না৷ জলে- স্থলে যা কিছু আছে সবই তিনি জানেন৷ তাঁর অজ্ঞাতসারে গাছের একটি পাতাও পড়ে না৷ মৃত্তিকার অন্ধকার প্রদেশে এমন একটি শস্যকণাও নেই যে সম্পর্কে তিনি অবগত নন৷ শুষ্ক ও আর্দ্র সবকিছুই একটি সুস্পষ্ট কিতাবে লিখিত আছে৷" [আনাম ৬:৫৯]
একমাত্র শুধুমাত্র আল্লাহ্ই হলেন অদৃশ্যের জ্ঞানের অধিকারী। এই সম্পর্কিত আরো আয়াতের রেফারেন্স উল্লেখ করা হল: [মায়েদা- ৫: ১০৯ ১১৬; আনাম- ৬ :৫০ ৫৯ ৭৩; তওবা -৯ : ৪৩,৭৮,৯৫,১০১, ১০৫; নাহল- ১৬:৭৭; ত্বহা -২০:১৫ ১১০; জুকরুক -৪৩:৮৫; তাহরিম -৬৬ : ১; জিন- ৭২ : ২৫ ]
এই সম্পর্কে জানতে আমরা কুরআনের সুরা আত-তাহরীমের শুরুর দিকের তিনটি আয়াত আলোচনা করব। আল্লাহ তাআলা বলেন,
১। হে নবী, আল্লাহ যে জিনিস হালাল করেছেন তা তুমি হারাম করছো কেন? (তা কি এ জন্য যে) তুমি তোমার স্ত্রীদের সন্তুষ্টি চাও? আল্লাহ ক্ষমাশীল এবং দয়ালু৷
২। আল্লাহ তোমাদের জন্য কসমের বাধ্যবাধকতা থেকে মুক্ত হওয়ার পন্থা নির্ধারণ করে দিয়েছেন৷ আল্লাহ তোমাদের অভিভাবক এবং তিনি মহাজ্ঞানী ও মহা কৌশলী৷
৩। (এ ব্যাপারটিও লক্ষণীয় যে,) নবী তাঁর এক স্ত্রীকে গোপনে একটি কথা বলেছিলেন৷ পরে সেই স্ত্রী যখন (অন্য কারো কাছে) সেই গোপনীয় বিষয়টি প্রকাশ করে দিল এবং আল্লাহ নবীকে এই (গোপনীয় বিষয় প্রকাশ করার) ব্যাপারটি জানিয়ে দিলেন তখন নবী (ঐ স্ত্রীকে) কিছুটা সাবধান করলেন এবং কিছুটা মাফ করে দিলেন৷ নবী যখন তাকে (গোপনীয়তা প্রকাশের) এই কথা জানালেন তখন সে জিজ্ঞেস করলো : কে আপনাকে এ বিষয়ে অবহিত করেছে ? নবী বললেন : আমাকে তিনি অবহিত করেছেন যদি সবকিছু জানেন এবং সর্বাধিক অবহিত।
এই আয়াতগুলোর শানে নূযুল জানা না থাকলে এর অর্থ বোধগম্য হবেনা। এখানে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও তাঁর পবিত্র বিবিগণের সাথে দাম্পত্য জীবনের সাথে জড়িত দুইটি ঘটনা নিয়ে ওহী করা হয়েছিলো।
হাদীসে এসেছে,
আয়িশা (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
" যে, নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যাইনাব বিন্ত জাহাশের নিকট কিছু (বেশী সময় অবস্থান) করতেন এবং সেখানে তিনি মধু পান করতেন। আমি ও হাফসাহ পরামর্শ করে ঠিক করলাম যে, আমাদের মধ্যে যার নিকটই নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) প্রবেশ করবেন, সেই যেন বলি-আমি আপনার নিকট হতে মাগাফীর-এর গন্ধ পাচ্ছি। আপনি কি মাগাফীর খেয়েছেন। এরপর তিনি তাদের একজনের নিকট প্রবেশ করলে তিনি তাঁকে সেরূপ বললেন। তিনি বললেনঃ আমি তো যাইনাব বিন্ত জাহাশের নিকট মধু পান করেছি। আমি পুনরায় এ কাজ করব না। এ প্রসঙ্গেই অবতীর্ণ হয় (মহান আল্লাহর বাণী): “হে নবী! আল্লাহ যা তোমার জন্য হালাল করেছেন তা তুমি কেন হারাম করছ?....... তোমারা দু‘জন যদি অনুশোচনাভরে আল্লাহ্র দিকে ফিরে আস (তবে তা তোমাদের জন্য উত্তম)” (সূরাহ আত-তাহরীম ৬৬ : ১-৪) পর্যন্ত। এখানে 'আয়িশা ও হাফসাহ -কে উদ্দেশ্য করে বলা হয়েছে। আর আল্লাহ্র বাণী “যখন নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর স্ত্রীদের একজনকে গোপনে কিছু বলেছিলেন”- ‘বরং আমি মধু পান করেছি’-এ কথার প্রেক্ষাপটে অবতীর্ণ হয়। (সহীহ্ বুখারী ৪৯১২, ৫২১৬, ৫২৬৭, ৫২৬৮, ৫৪৩১, ৫৫৯৯, ৫৬১৪, ৫৬৮২, ৬৬৯১, ৬৯৭২ মুসলিম - ৪৯১২, আহমেদ - ২৫৯১০)
নোটঃ মাগাফীর একটা মিষ্টি কিন্তু দুর্গন্ধযুক্ত গাছের রস (রেসিন), রাসুলুল্লাহ (সাঃ) হালাল হলেও কখনো দুর্গন্ধযুক্ত খাবার খেতেন না, এটা তাঁর রীতি ছিলো। যয়নাব বিনতে জাহশ (রাঃ) এর ঘরে মধু পান করা ও কিছু সময় কাটানো এটা তাঁর অপর দুই সতীন আয়িশা (রাঃ) ও হাফসা (রাঃ) স্বাভাবিকভাবে নিতে পারেন নি।
সতীনের প্রতি নারীদের স্বাভাবিক বিদ্বেষপরায়ণ মনোভাব থেকে তারা দুইজন এই যুক্তি করেন, পরবর্তীতে রাসুলুল্লাহ (সাঃ) যদি যয়নাব বিনতে জাহশ (রাঃ) এর কাছ থেক মধু পান করেন তাহলে তাঁরা এই কথা বলবেন যে আপনি কি মাগফীর খেয়েছন? সে অনুযায়ী, আয়িশাহ ও হাফসাহ দুইজনের কাছেই রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এইরকম কথা শুনে মনে করেছিলেন, সত্যিই বুঝি এই মধু খেলে মুখে দুর্গন্ধ সৃষ্টি হয়।
তাই তিনি কসম করে বললেন, এই মধু আর খাবেন না (এটাই ছিলো আয়িশাহ ও হাফসার উদ্দেশ্যে, যাতে করে তিনি যয়নবের ঘরে ঐ সময়টা আর না কাটান), আর যেহেতু তাঁর রীতি ছিলো দুর্গন্ধযুক্ত খাবার না খাওয়া, তাই তিনি তাদেরকে এই কথাটা অন্য কাউকে বলতে না বলেন। এই ঘটনার প্রেক্ষিতে আল্লাহ সুরা তাহরীমের এই আয়াতগুলো নাযিল করেন।
আয়াতগুলো থেকে শিক্ষাঃ
যদিও উপরোক্ত আয়াত রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এর ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে তবুও কুরআন নাযিল করার পেছনে উদ্দেশ্য রয়েছে।
প্রথমত রাসুলুল্লাহ (সাঃ) নিজে থেকে কোনো কিছু হালাল বা হারাম করতে পারেন।
দ্বিতীয়ত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও গায়বের খবর জানেন না।
কারন তাঁর স্ত্রী আয়েশাহ (রাঃ) ও হাফসা (রাঃ) পাশের ঘরে বসেই একমত হন যে, আমাদের যার ঘরেই আল্লাহর রসূল সাঃ আসবেন, সে তাঁকে বলবে, আপনি কি মাগাফীর খেয়েছেন অথচ আল্লাহর রসূল সাঃ কিছুই জানলেন। তাহলে তিনি কীভাবে গায়েবের খবর জানেন আমরা দাবি করতে পারি?
আল্লাহ্ আরও পরিষ্কার ভাবে তৃতীয় আয়াতের শেষে বলেন,
“নবী যখন তা স্ত্রীকে বললেন, তখন স্ত্রী বললেনঃ কে আপনাকে এ সম্পর্কে অবহিত করল? নবী বললেনঃ যিনি সর্বজ্ঞ, ওয়াকিফহাল, তিনি আমাকে অবহিত করেছেন”।
অর্থ দাড়াল আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের স্ত্রীদেরও আকিদা ছিল, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম গায়বের খবর জানেন না। তাই উনারা গোপনে কৌশল করে কিছু আদায় করতে সচেষ্ট ছিলেন।
এই জাতীয় আরো কিছু ঘটনা রয়েছে যাতে প্রমাণ হয় রাসুল সাঃ নিজ থেকে কখনোই কোনো গায়েবের খবর জানতেন না বা দিতেন না। তিনি ততটুকুই জানতেন এবং দিতেন যতটুকু আল্লাহ্ তাঁকে জানিয়েছেন।
অতএব, মহান আল্লাহর শ্রেষ্ঠ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজ থেকে গায়েব জানতেন না। যতটুকু তাঁকে জানানো হতো তা ব্যতীত। সুতরাং পবিত্র কুরআনের সুস্পষ্ট আয়াত দ্বারা এটা প্রমাণিত হলো যে আল্লাহর রাসুল কখনোই আল্লাহর সমতুল্য গায়েব জানতেন না যতটুকু না আল্লাহ্ তাঁকে জানিয়েছেন। আর যেখানে রাসুল সাঃ গায়েবের খবর জানেন না, সেখানে তথাকথিত পীর আউলিয়ারা কীভাবে গায়েবের খবর জানতে পারবেন?
কৃতজ্ঞতাঃ
মোহাম্মাদ ইস্রাফিল হোসাইন। (বিএ ইন আরবি সাহিত্য ও ইসলাম শিক্ষা)
সাখাওয়াতুল আলম চৌধুরী
২২ জানুয়ারি, ২০২২
পতেঙ্গা, চট্টগ্রাম।