‘নিশ্চয় সালাত যাবতীয় অন্যায় ও অশ্লীল-অপকর্ম থেকে বিরত রাখে’ (সূরা আনকাবুত: ৪৫)।
আল্লাহ পবিত্র কুরআনে সালাতকে সকল অপকর্মের দূরীকরণ বলে উল্লেখ করেছেন। সালাত এমন একটি ইবাদত যা আদায় করলে মুমিনগণ নিজেদের সকল পাপ থেকে দূরে রাখতে পারে। অর্থাৎ আল্লাহ সালাতের মধ্যে এমন এমন বিষয় রেখেছেন যা দ্বারা তিনি মুমিনকে পাপ করা থেকে বিরত রাখে।
এখন আমাদের সমাজের দিকে তাকালে দেখা যায় যে, সমাজের একশ্রেণির বড়লোক আছে যারা জামাতে সালাত আদায় করে। কিন্তু তাদের আয়ের উৎস এবং তাদের ব্যক্তিগত আচরণ কখনোই ইসলাম সম্মত নয়। তাদের চরিত্রে রাসুলের (সাঃ) আদর্শের কোনো প্রতিচ্ছবি নেই। প্রায় দেখা যায় সুদের কারবারী, ঘুষখোর, দূর্নীতিবাজ ইত্যাদি মানুষগুলো প্রথম কাতারে সালাত আদায় করছে। এ থেকে বুঝা যায় সালাত তাদের চরিত্রের সংশোধন করতে পারেনি। শুধু তাইনয় আমরা যারা সালাত আদায় করি তাদের অধিকাংশই সত্যিকার ইসলাম সম্পর্কে অবগত নই। আমরা জেনে নাজেনে নিজেদের পাপে নিমজ্জিত করি। কিন্তু কেন?
আল্লাহ বলছেন সালাত অশ্লীলতা এবং অপকর্ম থেকে মুমিনকে দূরে রাখে। অথচ বাস্তবে যারা সালাত আদায় করছে তারা (এক শ্রেণীর মুসল্লি) আরও বেশী অপরাধী। তাহলে এখানে নিশ্চয়ই কোনো কারণ আছে। যা আমরা অনেকেই জানি না। আল্লাহর আয়াতের সাথে বাস্তবের কোনো মিল নেই।এর কারণ কী হতে পারে?
এর প্রধান কারণ হলো, আমরা সালাত(নামাজ) পড়ি। কখনোই সালাত আদায় করি না। সালাত পড়ি হচ্ছে, মুখস্ত তিলাওয়াত, রুকু সিজদা ইত্যাদি করা। যদি আদায় হতো তাহলে সালাতে যা পড়ছি এবং করছি তার প্রতি মনোযোগী হতাম। আমরা সাধারণ খুব কম সংখ্যক মুসলিমই কুরআন জেনে পড়ি। আমরা সাধারণ সালাতে এবং সালাতের বাইরে মুখস্ত কুরআন পড়ি। যা পড়ি তা কখনোই বুঝি না।
এই না বুঝার কারণে আমাদের সালাতে পরিপূর্ণতা নেই। সালাতে যে আমরা মনোযোগী হবো তার শর্ত হচ্ছে কুরআন বুঝা। শুধু তোতাপাখির মন্ত্র উচ্চারণের মতো কুরআন পড়লেই সব শেষ নয়। সালাতে কুরআনরে আয়াত পড়া বাধ্যতামূলক। এর কারণ সালাতের মাধ্যমে আল্লাহ যা শিক্ষা দেন তা যেন মুমিনগণ নিজেদের জীবনে প্রতিফলিত করে।
শুধু কুরআন পড়াই যদি সালাতের উদ্দেশ্য হতো, তাহলে এই কুরআন কেন আল্লাহ নাযিল করলেন? আল্লাহ কুরআন নাযিল করেছেন বিশ্ববাসীর হিদায়াতের জন্য। যাতে মানুষ এই কুরআনের দ্বারা অন্ধকার থেকে আলোতে আসতে পারে। আর যারা ঈমান এনে নিজেদের মুসলিম দাবি করবে। তাদের জন্য আল্লাহ ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করেছেন সালাতের মাধ্যমে। অর্থাৎ এই কুরআনের আয়াত সালাতে তিলাওয়াত হবে। সেই তিলাওয়াত শুনে এবং বুঝে মুমিনগণ আল্লাহকে স্বরণ করবে, ভয় করবে, আশা রাখবে।
আল্লাহ পবিত্র কুরআনকে হিদায়াতের মাধ্যম করেছেন। আর তাই সালাতে কুরআন পড়িয়ে আল্লাহ তাঁর বান্দাগণের সেই হিদায়াতের পথ উন্মুক্ত করেন। আল্লাহ সালাতের মাধ্যমে ঈমানদারদের ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করেছেন। দুনিয়ার প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে যেমন বিভিন্ন প্রশিক্ষণ নেওয়ার পরে তা প্রশিক্ষণার্থীগণ তাদের জীবনে চর্চা করে আয় রোজগার করে। ঠিক তেমনি আল্লাহও সালাতের মাধ্যমে মুমিনগণকে প্রশিক্ষণ দেন। যাতে তারা এই দুনিয়ায় আল্লাহর বিধিবিধান অনুসারে জীবনযাপন করে।
সালাত যদি মুমিনের জন্য প্রশিক্ষণই না হবে, তবে এখানে রুকু সিজদা দিয়ে ব্যয়াম করা ছাড়া আর কিছুই নেই। কোনো ব্যক্তি চাইলেই সালাতে একনিষ্ঠতা ধরে রাখতে পারবে না যতক্ষণ না সালাতে মনোযোগী হচ্ছে। আর মনোযোগ তখনই দেওয়া সম্ভব যখন আপনি তা বুঝতে পারবেন। গভীরভাবে খেয়াল করলে আমরা দেখতে পাবো সালাত একধরনের রিয়ামূলক ইবাদত। অর্থাৎ আমি মুসল্লী এটা দেখে যেকেউ আমাকে ভালো বলতে বাধ্য। কিন্তু আমার সালাত কতটুকু আদায় শুদ্ধ হচ্ছে সেটা একমাত্র আল্লাহই ভালো জানেন। কিন্তু সমাজে আমি মুসল্লী হিসাবে পরিচিত হয়ে গেছি। এখন আমি কতটুকু সঠিক মুসল্লী হতে পেরেছি তা আমার কর্মের দ্বারা প্রমাণিত হবে। আমি চমৎকার মুসল্লী হওয়ার পরও আমার চারিত্রিক এবং সামগ্রিক কর্মকাণ্ডে যদি ইসলাম বিরোধী কার্যক্রম থাকে, তবে আমি কীভাবে একজন সঠিক মুসল্লী হলাম?
আমাদের উপমহাদেশের মানুষ যথেষ্ট ধার্মিক। তারপরও আমাদের উপমহাদেশেই শির্ক, বিদআত, সুদ, ঘুষ, ধর্ষণ, মাদক, ইত্যাদি সকল অপকর্ম সহ ইসলাম বিরোধী বিধিবিধান সবচেয়ে বেশী। এই উপমহাদেশে এখনও আল্লাহর আইন প্রতিষ্ঠিত নয়। অথচ আল্লাহ কুরআন দিয়েছেন তাঁর বিধিবিধান পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য। কিন্তু আমাদের অজ্ঞতার কারণে আমরা এইসব কিছুই জানি না। শুধু রুকু সিজদা দিয়ে সালাত আদায় করেই কখনো আল্লাহর ইবাদত পরিপূর্ণ হবেনা। যতক্ষণ না আল্লাহর পরিপূর্ণ দ্বীন প্রতিষ্ঠিত না হবে।
আমরা অসম্ভব মনোযোগী হয়ে সালাত আদায় করি। অথচ আমাদের পরিবার, সমাজে চলছে নানান অনিয়ম, দূর্নীতি, অশ্লীলতা। আল্লাহ আমাদের এইসব নির্মূল করে দূরে থাকার তাগিদ দেয়। আর আমরা মসজিদে প্রথম কাতারে সালাত আদায় করে এইসব কুকর্ম করি প্রতিনিয়ত। তাহলে আল্লাহর আয়াত মিথ্যা হয়ে যাচ্ছে (নাউজুবিল্লাহ)। সুতরাং এটা খুবই স্পষ্ট যে সালাত দ্বারা যতক্ষণ আমি নিজেকে শুদ্ধ করতে না পারবো, ততক্ষণ পর্যন্ত আমার সালাত পরিপূর্ণ হবে না। আর যতক্ষণ সালাত পরিপূর্ণ হবেনা ততক্ষণ পর্যন্ত এই সালাত কাউকেই অশ্লীল এবং কুকর্ম থেকে দূরে রাখতে পারবে না।
আরেকটি বিষয় হচ্ছে আল্লাহর পরিপূর্ণ বিশ্বাসের সহিত সালাত আদায় করা। সাধারণত অধিকাংশ মুসল্লী সালাত পড়তে হয় বলেই পড়ে। কিন্তু একনিষ্ঠ আল্লাহর বিশ্বাসের সহিত সালাত আদায় করে না। যেমন সালাতে প্রতিটি রুকু সিজদা আল্লাহর হুকুম মতো আদায় করে। কিন্তু সালাতের বাইরে আল্লাহর হুকুমের আর মান্য নেই। অধিকাংশ মুসল্লীর মতে আল্লাহর বিধান শুধুমাত্র মসজিদে। সেখানে গিয়ে রুকু সিজদা করলেই আল্লাহর সব হুকুম মানা হয়ে যায়।
কিন্তু বাস্তবা সম্পূর্ণ বিপরীত। আল্লাহর হুকুম শুধুমাত্র সালাতে নয় বরং সালাত থেকে পরিপূর্ণ বিধান শিক্ষা নিয়েই তা বাস্তব জীবনে চর্চা করাই মূল উদ্দেশ্য। সালাতে যেমন আল্লাহকে ভয় করি, ঠিক তেমনি সালাতের বাইরেও আল্লাহকে ভয় করে সমস্ত অশ্লীল পাপ এবং দূর্নীতি থেকে নিজেকে রক্ষা করতে হবে। আর এটা আমাদের মনে তখনই চিন্তা জাগাবে যখন আমরা সত্যিকারের ইসলামকে বুঝতে পারবো।
সর্বশেষ কথা হচ্ছে, সালাত পড়া নয় বরং আদায়ের বিষয়। সালাত তখনই আদায় পরিপূর্ণ হবে যখন তা আমরা বাস্তব জীবনে প্রতিফলন ঘটাতে পারবো। যখন সালাত আমাদের জীবনে প্রতিষ্ঠিত করতে পারবো তখনই সালাতের মাধ্যমে আমরা নিজেদের পাপ থেকে দূরে থাকতে পারবো।
সঠিক ইসলাম জানতে আরও পড়ুনঃ
পীর সম্পর্কে জানতে
লা ইলাহা ইল্লাল্লার ব্যাখ্যা
ইবাদতের শির্ক