ওয়াসীলাহ্ঃ
ওয়াসীলাহ্ (وسيله) আরবি শব্দ। এর অর্থ উপায়, উপকরণ, নৈকট্য, মর্যাদা, অবস্থান, ব্যবস্থা, মাধ্যম যা দ্বারা কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছা যায়।
কুরআনে ওয়াসীলাহ্ র বর্ননাঃ
হে মুমিনগণ! আল্লাহকে ভয় কর এবং তাঁর নৈকট্য লাভের উপায় অন্বেষন কর, (তাঁর বিশেষ একটি উপায় হচ্ছে) তোমরা আল্লাহর পথে জিহাদ করো, সম্ভবত তোমরা সফলকাম হতে পারবে। [ সুরা মায়েদা ৫:৩৫ ]
পবিত্র কুরআনে ওয়াসীলাহ্ শব্দ দ্বারা উপায় বা মাধ্যম বুঝানো হয়েছে। অর্থাৎ যা দ্বারা মুমিনগণ আল্লাহর নিকটবর্তী হতে পারে। একই আয়াতে আল্লাহ নৈকট্য লাভের একটি ভালো উপায় বা মাধ্যমও বলে দিয়েছেন। আর তা হচ্ছে আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ। এটা ছাড়াও আল্লাহর বিভিন্ন ইবাদত বন্দেগী দ্বারাও ওয়াসীলাহ্ বা মাধ্যম করা যাবে। আল্লাহর নির্দেশিত বিভিন্ন আমলের দ্বারাও আল্লাহর নিকটবর্তী হওয়া যাবে। প্রসিদ্ধ সকল তাফসীরকারক আল্লাহর নৈকট্য মাধ্যম তথা ওয়াসীলাহ্ বলতে নেক আমল করা এবং বদ আমল বাদ দেওয়াকে বুঝিয়েছন। এই আয়াত দ্বারা এটাই সঠিক বর্নণা সাব্যস্ত হয়।
হাদিসের বর্ননায় ওয়াসীলাহ্ঃ
পবিত্র হাদীস শরীফে ওয়াসীলাহ্ বলতে যে কর্ম বা আমল বুঝানো হয়েছে, তার স্বপক্ষে কয়েকটি হাদীস রয়েছে।
আদী ইবনু হাতিম (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ তিনি বলেন, আমি রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে বলতে শুনেছিঃ তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি জাহান্নামের আগুন থেকে বেঁচে থাকার সামর্থ্য রাখে সে যেন একটা খেজুর দিয়ে হলেও তাই করে। (অর্থাৎ দান যতই ক্ষুদ্র হোক তাঁকে খাটো করে দেখা যাবে না। সামান্য দানও কবূল হলে নাযাতের ওয়াসীলাহ্ হতে পারে)।
(সহীহ্ মুসলিম যাকাত অধ্যায় ২২৩৭ নং হাদীস, ই.ফা. ২২১৬)
ইবনু ‘উমার (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃতিনি রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনজন লোক হেঁটে চলছিল। তাদের উপর বৃষ্টি শুরু হলে তারা এক পাহাড়ের গুহায় আশ্রয় নেয়। এমন সময় পাহাড় হতে একটি পাথর তাদের গুহার মুখের উপর গড়িয়ে পড়ে এবং মুখ বন্ধ করে ফেলে। তাদের একজন অন্যদের বললোঃ তোমরা তোমাদের কৃত ‘আমালের প্রতি লক্ষ্য করো যে নেক ‘আমাল তোমরা আল্লাহর জন্য করেছ; তার ওয়াসীলাহ্য় আল্লাহর নিকট দু’আ করো। হয়তো তিনি এটি হটিয়ে দেবেন। (এরপর তারা তাদের নেক আমলের ওয়াসীলাহ্ দিয়ে সেই বিপদ থেকে উদ্ধার হন। সংক্ষেপিত)
(সহীহ্ বুখারী, আচার -ব্যবহার -৫৯৭৪, আধুনিক- ৫৫৪১, ই ফা -৫৪৩৬)
এইসব সহীহ্ হাদীস দ্বারা স্পষ্ট প্রমাণিত যে, ওয়াসীলাহ্ হবে বান্দার নেক আমল। যা শুধুমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য করা হয়।
ওয়াসীলাহ্ দ্বারা জান্নাতের একটি স্থানের নামও এসেছে হাদীস শরীফে।
আবূ হুরাইরাহ্ (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ আমার জন্য তোমরা আল্লাহ তা’আলার কাছে ওয়াসীলাহ্ কামনা কর। সাহাবীগণ বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! ওয়াসীলাহ্ কি? তিনি বললেনঃ জান্নাতের সবচাইতে উঁচু স্তর। শুধুমাত্র এক লোকই তা অর্জন করবে। আশা করি আমিই হব সেই ব্যক্তি।
সহীহঃ মিশকাত (৫৭৬৭), মুসলিম (২/৪) ।
আবদুল্লাহ ইবনু ‘আমর ইবনুল ‘আস (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ তিনি নাবী(সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে বলতে শুনেছেনঃ তোমরা যখন মুওয়াযযিনকে আযান দিতে শুন, তখন সে যা বলে তোমরা তাই বল। অতঃপর আমার উপর দুরূদ পাঠ কর। কেননা, যে ব্যক্তি আমার ওপর একবার দরূদ পাঠ করে আল্লাহ তা’আলা এর বিনিময়ে তার উপর দশবার রহমাত বর্ষণ করেন। অতঃপর আমার জন্যে আল্লাহর কাছে ওয়াসীলাহ্ প্রার্থনা কর। কেননা, ‘ওয়াসীলাহ্’ জান্নাতের একটি সম্মানজনক স্থান। এটা আল্লাহর বান্দাদের মধ্যে একজনকেই দেয়া হবে। আমি আশা করি, আমিই হব সে বান্দা। যে ব্যক্তি আল্লাহর কাছে আমার জন্যে ওয়াসীলাহ্ প্রার্থনা করবে তার জন্যে (আমার) শাফা’আত ওয়াজিব হয়ে যাবে।
(সহীহ্ মুসলিম -৭৩৫, ই. ফা. ৭৩৩ )
[অনুরূপ হাদীস এসেছে, জামে' আত-তিরমিজি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ও তাঁর সাহাবীগণের মর্যাদা - ৩৬১২, ৩৬১৪, মিশকাত -৫৭৬৭]
এইসব সহীহ্ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত যে ওয়াসীলাহ্ জান্নাতের একটি উঁচু মর্যাদাশীল একটি স্থান। যা জন্য আমরা প্রতিনিয়ত আযানের দোয়ায় বলে থাকি। সুতরাং এটাও সঠিক যে ওয়াসীলাহ্ জান্নাতের একটি মর্যাদাশীল স্থান।
পবিত্র হাদীসে ওয়াসীলাহ্ দ্বারা জীবিত ব্যক্তিকেও বুঝানো হয়েছে।
আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ‘উমার (রাঃ) অনাবৃষ্টির কারণে দুর্ভিক্ষ দেখা দিলে ‘আব্বাস ইবনু ‘আবদুল মুত্তালিব (রাঃ)-এর ওয়াসীলাহ নিয়ে বৃষ্টি বর্ষণের দু’আ করতেন। তিনি বলতেন, হে আল্লাহ্! আমরা অনাবৃষ্টি দেখা দিলে আমাদের নবীর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ওয়াসীলাহ নিয়ে দু’আ করতাম, তুমি বৃষ্টি বর্ষণ করতে; এখন আমরা আমাদের নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর চাচা ‘আব্বাস (রাঃ)-এর ওয়াসীলাহ্য় বৃষ্টি বর্ষণের দু’আ করছি। তুমি আমাদের উপর বৃষ্টি বর্ষণ কর। তখন বৃষ্টি হত।
[সহীহ্ বুখারী সাহাবীদের মর্যাদা -৩৭১০আধুনিক প্রকাশনীঃ ৩৪৩৫, ইসলামী ফাউন্ডেশনঃ ৩৪৪২]
অনুরূপ হাদীস এসেছে সহিহ বুখারী বৃষ্টির জন্য দোয়া ১০১০ নং হাদীসেও।
সুতরাং এখানে দেখা যাচ্ছে যে, আল্লাহর প্রিয় বান্দাদের নাম দিয়ে ওয়াসীলাহ্ করলে আল্লাহ সেই দোয়া কবুল করেন। এইসব হাদীসে খুবই স্পষ্ট যে জীবিত নেককার আল্লাহর বান্দা দ্বারা ওয়াসীলাহ্ চাওয়া হয়েছে। এমনকি রাসুল (সাঃ) কে দিয়েও নয়। সুতরাং জীবিত যেকোনো আল্লাহর অলির কাছে গিয়ে নিজের যেকোনো প্রয়োজনের জন্য দোয়া চাওয়া যাবে। এবং তাঁকে ওয়সীলাহ্ করে দোয়া বা সাহায্য চাওয়াও যাবে।
উপরোক্ত আলোচনা থেকে এটা খুবই স্পষ্ট যে, পবিত্র কুরআনে আল্লাহ ওয়াসীলাহ দ্বারা আমলকে বুঝিয়েছেন। জিহাদ হচ্ছে এমন একটি আমল যা দ্বারা আল্লাহর সবচেয়ে বেশী নিকটবর্তী হওয়ার সুযোগ থাকে। সুতরাং নেক আমল করতে হবে। যাতে কিয়ামতে আল্লাহর সন্তুষ্টি সহ তাঁর নিকটবর্তী হওয়া যায়।
ওয়াসীলাহ্ দ্বারা জান্নাতের স্থানও বুঝানো হয়েছে। যা রাসুল (সাঃ) কে দেওয়া হবে। আর রাসুলের (সাঃ) শাফায়াত দ্বারা আমরাও কিয়ামতে আল্লাহর নিকটবর্তী হতে পারবো ইনশাআল্লাহ।
ওয়াসীলাহ্ দ্বারা জীবিত আল্লাহর অলিকে বুঝানো হয়েছে। যার মাধ্যমে আল্লাহর কাছে দোয়া চাইলে আল্লাহ ফিরিয়ে দেন না। সুতরাং আল্লাহর নেককার বান্দাদের কাছে গিয়ে দোয়া চাওয়া যাবে। আর এটা দুনিয়ার জন্য। দুনিয়ার যেকোনো প্রয়োজন পূরণের জন্য আল্লাহর অলিদের কাছে সাহায্য চাওয়া যাবে।
ওয়াসীলাহ্ নিয়ে ভ্রান্তিঃ
আমাদের মুসলিম সমাজে অধিকাংশ অজ্ঞ মানুষ এই ওয়াসীলাহ্ বলতে তথাকথিত পীর এবং মৃত আউলিয়াকে বুঝানো হয়েছে বলে প্রচার এবং বিশ্বাস করে। তাদের মতে আল্লাহর নৈকট্য পেতে আল্লাহর অলির(মৃত) মাধ্যমেই যেকোনো কিছু চাইতে হবে।কিন্তু কুরআন স্পষ্ট করেছে জিহাদ একটি মাধ্যম যা দ্বারা আল্লাহর নৈকট্যবর্তী হওয়া যায়। সুতরাং আল্লাহর নৈকট্যবর্তী তথা আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য অবশ্যই আমল করতে হবে। ঈমান এনে আমল করা শর্ত। আর আমলের মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি এবং নৈকট্য লাভ, তথা জান্নাত পাওয়া যাবে।
কুরআন হাদীসে কোথাও এমন নেই যে, মৃত ব্যক্তির ওয়াসীলাহ্ দ্বারা আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ করা যাবে দুনিয়ায়। অর্থাৎ দুনিয়ার কোনো প্রয়োজনে মৃত আল্লাহর অলির ওয়াসীলাহ্ দেওয়া জায়েজ হবে। আমাদের সমাজে আল্লাহর অলিদের কবরে গিয়ে তাদের ওয়াসীলাহ্ দিয়ে আল্লাহর কাছে সাহায্য চাওয়া হয়। শুধু তাইনয়, আল্লাহকে বাদ দিয়ে সরাসরি আল্লাহর অলিদের নিকট সাহায্য চাওয়া হচ্ছে। যা সুস্পষ্ট ভাবে শির্ক। যা দেওয়ার মালিক আল্লাহ তা কীভাবে তাঁর বান্দা থেকে চাওয়া যাবে?
আরেকটি বিষয় হচ্ছে অলি আল্লাহদের ওয়াসীলাহ্ নিয়ে কিয়ামতে পার হওয়ার মানসিকতা। অধিকাংশ মানুষের বদ্ধমূল ধারণা তারা কিয়ামতে অলি আল্লাহদের দ্বারা শাফায়াত প্রাপ্ত হয়ে জান্নাতে চলে যাবে। হ্যাঁ অবশ্যই আল্লাহর নেককার বান্দারা শাফায়াত করবেন। কিন্তু তাঁদের শাফায়াতও হবে আল্লাহর অনুমতি নিয়ে।
কে আছ এমন, যে সুপারিশ করবে তাঁর কাছে তাঁর অনুমতি ছাড়া? [ সুরা বাকারা ২:২৫৫ ]
আল্লাহ তাঁর বান্দাদের বলছেন আমল করার মাধ্যমে তাঁর সন্তুষ্টি অর্জন করতে। সেখানে যারা ইসলামের পরিপূর্ণ আমল করা ছাড়া শুধুমাত্র আল্লাহর অলিদের শাফায়াতের ভরসা করে দিন দুনিয়া করছে। তাদের জন্য আল্লাহ কীভাবে সুপারিশের অনুমতি দিবেন?
যদি এটা এতোটাই সহজ হতো তবে আল্লাহ কেন এতো এতো বিধান দিয়ে রাসুল (সাঃ) কে দুনিয়ায় পাঠালেন? কেন তিঁনি এতো জিহাদ করে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করে গেলেন। মানুষ কেন আমল করবে? তারা তো অলিদের কবরে গিয়ে তাদের ওয়াসীলাহ্ দিয়ে আল্লাহর কাছে পার পেয়ে যেতে পারে। সুতরাং দুনিয়ায় যা ইচ্ছে তাই করো আর কবরের কাছে গিয়ে সাহায্য চাও। সেই কবরবাসী কিয়ামতে আমাদের উদ্ধার করে ফেলবেন কোনো রকম আমাদের আমল ছাড়াই।
এটা কখনোই সম্ভব নয়। আল্লাহর জীবিত নেককার বান্দাদের কাছে গিয়ে আমাদের সঠিক আমলের শিক্ষা নিতে হবে। যদি ইসলামের সঠিক আমল করতে পারি তবেই আমরা কিয়ামতে সফল হবো। আমরা চেষ্টা করার পরও কোনো ভুল ত্রুটি থাকলে তা আল্লাহর অলিগণ সুপারিশ করে আমাদের জান্নাতের পথ পেতে সাহায্য করবেন ইনশাআল্লাহ। কিন্তু যিনি কবরে চলে গেছেন তিনি কোনোভাবেই দুনিয়ায় সাহায্য করতে পারবেন না যা আল্লাহ পারেন।
সুতরাং পবিত্র কুরআনের ওয়াসীলাহ্ দ্বারা আল্লাহ আমাদের সঠিক আমলের তাগিদ দিচ্ছেন। যা দিয়ে তিনি আমাদের তাঁর নিকটবর্তী করবেন। অতএব আমাদের আল্লাহর উপর ভরসা রেখে নিজেদের আমল পরিপূর্ণ করতে হবে। কোনোপ্রকার আমল ছাড়া শুধুমাত্র অলি আল্লাহদের কবরে গিয়ে শির্কি সাহায্য চেয়ে কখনোই কিয়ামতে পার পাওয়া যাবে না।
আরও পড়ুনঃ
ঈমান কী
ঈমানের শর্ত সমূহ
আবু জাহেলের ইসলাম এবং আমরা
লা ইলাহা ইল্লাল্লার ব্যাখ্যা
ইবাদতের শির্ক