ইবাদতের শির্ক
শির্ক সম্পর্কে আমরা কম বেশি সবাই অবগত। যে নিজেকে মুসলিম দাবি করে তাকে শির্কের বিপক্ষে সাক্ষী দিয়েই মুসলিম হতে হয়। অতএব যে শির্ক বুঝে না বা জানে না সে ঈমানদার হতে পারে না। আমাদের সমাজে সালাত, সিয়াম, হজ্জ্ব, যাকাত ইত্যাদি ইবাদতকে যতটুকু গুরুত্ব দেওয়া হয় শির্ক সম্পর্কে ততটুকু গুরুত্ব তো দূরের কথা, এটা নিয়ে কেউ ভাবেও না। অথচ কালেমা "লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ " পড়েই ঈমান আনতে হয়। সেই কালেমাতেই রয়েছে শির্ক বর্জনের শর্ত। সাধারণ মুসলমানরা কখনোই এটা চিন্তাও করে না। যদি চিন্তা না করে তবে তাদের ঈমানদার হওয়া এখনো বৈধ নয়। শুধু তাই নয় আল্লাহর দুনিয়ায় সবচেয়ে বড় গুনাহ হচ্ছে শির্ক (খুন, ধর্ষণ ইত্যাদির চেয়েও)। আর তাই আল্লাহ্ কখনোই (দুনিয়াতে তওবা ছাড়া) শির্ক ক্ষমা করবেন না। যদি নিজেদের ঈমানদার হওয়ার দাবি করেন তাহলে আসুন মিলিয়ে নিন আপনার ঈমানে শির্ক আছে কিনা।
শির্কের আকার ব্যাপক। আজ আমরা ইবাদতের শির্ক নিয়ে আলোচনা করব ইনশাআল্লাহ। আসুন জেনে নিই শির্ক অর্থ কী।
শির্ক অর্থঃ
সহজ ভাষায় শির্ক অর্থ অংশীদার বা শরিকদার । যেমন দুজনে মিলে একটি গরু কুরবানী দিলাম সমান শরিকদারে। অর্থাৎ গরুর মাংসে দুজনের সমান ভাগ। ঠিক তেমনি কোনো বিষয়ে আল্লাহর সাথে অন্য একজনের সমান বা কম বেশী অংশ দেওয়াকে বলা হচ্ছে অংশীদার বা শির্ক বা আল্লাহর অংশীদার। এই ভাগ দেওয়া হতে পারে আল্লাহ্ যা পারেন তা অন্য কেউ তার সমান বা কম, বেশি পারেন। হতে পারে আল্লাহর জন্য যা করলাম তার সমান বা কম বেশি অন্য কারো জন্য করলাম। এটাও হতে পারে আল্লাহরটা মানলাম আবার মানুষের তৈরি আল্লাহর বিরুদ্ধেরটাও মানলাম। এককথায় যেসব বিষয় শুধুমাত্র আল্লাহর, সেখানে তাঁর সাথে অন্য কারো তুলনা করা, মানা বা সম্মান করাই হচ্ছে শির্ক বা আল্লাহর সাথে অংশীদার করা।
অর্থাৎ সর্বক্ষেত্রে একমাত্র আল্লাহর ইবাদত, বিধান এবং সিফাতকেই মানতে হবে। এখানে তিনটি বিষয় রয়েছে। আমরা ইবাদতের বিষয়টি নিয়েই আলোচনা করব। ইবাদত যেমন সিজদা, কুরবানী, মানত ইত্যাদি শুধুমাত্র আল্লাহ্ ই পাবেন। যদি কেউ আল্লাহ্ ছাড়া অন্য কাউকে সিজদা করলো বা অন্য কাউকে খুশি করার জন্য গরু ছাগল জবাই করলো অথবা আল্লাহ্ ছাড়া অন্য কারো উদ্দেশ্যে মানত করলো তাহলে সে আল্লাহর সাথে অন্য একজনের অংশীদার দাঁড় করালো। সুতরাং এটা শির্ক।
ইবাদত কীঃ
ইবাদত অর্থ হলো আনুগত্য করা। আল্লাহর ইবাদত হলো আল্লাহর আনুগত্য। সাধারণত সালাত, সিয়াম হজ্জ্ব, যাকাত, কুরবানী ইত্যাদিকে আল্লাহর ইবাদত বলা হয়। যদি আনুগত্য বলি তবে জীবনের প্রতিটি পর্যায়ে আল্লাহকে মেনে নেওয়াই হচ্ছে সঠিক ইবাদত। কেননা আল্লাহ্ বলেন -
তোমাদের উপাস্য একজন, তিনি ব্যতীত আর কেউ উপাসনা পাওয়ার হকদার নয়।” [সূরা আল-বাকারাহ: ১৬৩]। এখানে সাধারণ ইবাদতের মাধ্যমে আমরা কীভাবে শির্ক করছি তা স্পষ্ট করা হবে ইনশাআল্লাহ।
সিজদাঃ
আল্লাহর সর্বশ্রেষ্ঠ ইবাদত সালাত। আর সালাতের সর্বশ্রেষ্ঠ অংশ হচ্ছে সিজদা। সুতরাং সিজদা একমাত্র আল্লাহর জন্য। কিন্তু অধিকাংশ মুসলমান না জেনে বিভিন্ন পীর বা মাজরে গিয়ে সিজদাহ্ দেয় যা স্পষ্টত শির্ক। কেননা সিজদাহ্ একমাত্র আল্লাহর প্রাপ্য। যদি পীর বা মাজারে সিজদাহ্ দেওয়া হয় তাহলে ঐ পীর বা মাজারের করবকে আল্লাহর সাথে সমকক্ষ করা হলো। অথচ আল্লাহর সাথে কাউকে সমান ভাবা যাবে না। পবিত্র কুরআনে আছে
"(হে রাসুল)আপনি বলুনঃ আমার নামায, আমার কোরবাণী এবং আমার জীবন ও মরন বিশ্ব-প্রতি পালক আল্লাহরই জন্যে। [ সুরা আন’য়াম ৬:১৬২ ]"
কুরবানীঃ
ইসলামে আল্লাহ্ কে সন্তুষ্ট করার জন্য পশু কুরবানী করা হয়। কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান না জেনে বা জেনেশুনে পীর বা মাজারে বিভিন্ন উদ্দেশ্যে পূরণের নিমিত্তে পশু কুরবানী মানত করেন। এখানে দুটি গুনাহ হচ্ছে। এক মানত করা। অর্থাৎ আমর ছেলে হলে বা আমার ঐ কাজ হয়ে গেলে অমুক পীর বা মাজারে গরু বা ছাগল ইত্যাদি দিবো। এটা কখনোই করা যাবে না। কারণ রাসুল (সাঃ) সর্বাবস্থায় মানত করতে নিষেধ করেছেন। দুই হচ্ছে আল্লাহ্ কে বাদ দিয়ে অন্য কারো উদ্দেশ্যে মানত করা (বিস্তারিত মানত বিষয়ক লেখা দেখুন)। সুতরাং অন্য কেউ মানত পূরণ করে দিতে পারে মনে করার সাথে সাথে আল্লাহর সাথে অংশীদার স্থাপন হয়ে গেলো। কেননা এই পৃথিবীর যাবতীয় কর্মকাণ্ডের বিধায়ক শুধুমাত্র আল্লাহ্। তিনি ছাড়া আর কারোরই কোন ক্ষমতা নেই কিছু করার। এই সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে স্পষ্ট আয়াত রয়েছে। সুতরাং মানত করে পীর বা মাজারে পশু কুরবানীর সাথে সাথে আল্লাহর শরীক সাব্যস্ত হয়ে গেল।
দান সদকাঃ
আল্লাহ ঈমানদারদের সবসময়ই দান সদকা করার জন্য উৎসাহিত করেছেন। কিন্তু এই ভালো কাজ করার মাধ্যমেও অধিকাংশ মুসলিম আজ শির্কে লিপ্ত। আল্লাহ আমাদের প্রথমত পরিবারের জন্য খরচ করতে বলেন। এরপরে নিকটবর্তী যত আত্মীয়স্বজন পরবর্তীতে দুঃস্থ অসহায়দের এভাবে দান করার জন্য। কিন্তু আমরা দান করি পীর বা মাজারে। যেখানে টাকাপয়সার কোনো প্রয়োজন নেই। যে আল্লাহর অলি দুনিয়া থেকে চলে গেছেন তাঁর টাকাপয়সার দরকার নেই। তার দরকার দোয়া। কিন্তু আমরা নিজের আশেপাশের আত্মীয়স্বজনদের দান সদকা না করে টাকা পয়সা দেই পীর আর মাজারে। যে দান সদকা আত্মীয়স্বজন পেলে তা আল্লাহর জন্য হতো সেই দানের টাকা যাচ্ছে কবরবাসীর জন্য যার টাকার দরকার নেই। শুধু যে দান করছি তা নয়। আমরা মানত করেও টাকাপয়সা দেই পীর আর মাজারে। যা স্পষ্ট ভাবে ইসলামে নিষিদ্ধ।
আল্লাহ্ বলেন-"যদি তোমরা প্রকাশ্যে দান-খয়রাত কর, তবে তা কতইনা উত্তম। আর যদি খয়রাত গোপনে কর এবং অভাবগ্রস্তদের দিয়ে দাও, তবে তা তোমাদের জন্যে আরও উত্তম। [ সুরা বাকারা ২:২৭১ ]
নফল ইবাদতঃ
আমাদের উপমহাদেশে এমন এমন নফল ইবাদত প্রচলিত আছে যা রাসুলুল্লাহ (সাঃ), সাহাবী (রাঃ), তাবেয়ী বা তবে তাবেয়ী (রাহঃ) এর দ্বারা স্বীকৃত নয়। এইসব ইবাদত ভালো মনে করে যদিও আল্লাহর উদ্দেশ্যে করা হয়, কিন্তু এইসব নব্য ইবাদত একদিকে যেমন বিদআত। অন্য দিকে শির্ক। কেননা এইসব নফল ইবাদত রাসুলুল্লাহ (সাঃ) থেকে স্বীকৃত না হওয়ার কারণে বরং যারা এইসব তৈরি করেছেন তাদের অনুসরণে করা হচ্ছে। আর ইবাদতে অনুসরণ একমাত্র আল্লাহ্ যেমন বলেছেন রাসুল (সাঃ) যেমন করেছেন তার বাইরে হতে পারে না। সুতরাং নতুন নতুন নফল ইবাদত সমূহ করার মাধ্যমেও আমরা শির্কে জড়িয়ে পড়ছি।
আল্লাহ্ বলেন-
" তোমরা অনুসরণ কর, যা তোমাদের প্রতি পালকের পক্ষ থেকে অবতীর্ণ হয়েছে এবং আল্লাহকে বাদ দিয়ে অন্য সাথীদের অনুসরণ করো না।[ সুরা আরাফ ৭:৩ ]"
এখানে স্পষ্ট করে বলা হয়েছে অনুসরণ করা যাবে শুধুমাত্র আল্লাহ্ যা দিয়েছেন তা ই।
তওবাঃ
আমাদের দেশে তওবা করার জন্য পীর বা আলেম বজুর্গের কাছে মানুষ ছুটে যায়। অথচ এই তওবার মালিক আল্লাহ্। পাপ হয়েছে আল্লাহর কাছে। আর পাপ ক্ষমা করার মালিক একমাত্র আল্লাহ্।
তিনি বলেন
"মুমিনগণ, তোমরা সবাই আল্লাহর সামনে তওবা কর, যাতে তোমরা সফলকাম হও। [ সুরা নুর ২৪:৩১ ]"
তিনি আরও বলেন
" তারা কখনও কোন অশ্লীল কাজ করে ফেললে কিংবা কোন মন্দ কাজে জড়িত হয়ে নিজের উপর জুলুম করে ফেললে আল্লাহকে স্মরণ করে এবং নিজের পাপের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে। আল্লাহ ছাড়া আর কে পাপ ক্ষমা করবেন? [ সুরা ইমরান ৩:১৩৫ ]
সুতরাং স্পষ্ট যে পাপ করলে তওবা করার মালিক একমাত্র আল্লাহ আর তিনিই ক্ষমা করার অধিকার রাখেন।
কবরবাসীর কাছে প্রার্থনাঃ
আমাদের দেশে সবচেয়ে বেশী শির্কের আখড়া এখন মাজার গুলো। একশ্রেণির আলেমদের কারণে সাধারণ মুসলমানগণ আল্লাহ্ কে ছেড়ে তাঁর বান্দাদের কাছে দোয়া প্রার্থনা করে। অথচ যেকোনো কিছু দেওয়া এবং নেওয়ার মালিক একমাত্র আল্লাহ্। কিন্তু তাদের দাবি অনুযায়ী আল্লাহ তার অলিদের দেওয়ার ক্ষমতা দিয়েছেন। এটা সুস্পষ্ট কুরআন বিরোধী কথা। যদি আল্লাহ্ তার ক্ষমতা সাবকন্ট্রাক্টে দিয়ে দেন, তাহলে মানুষ ইবাদত কেন করবে? আল্লাহর বান্দার কাছে মানত করলে, দোয়া করলেই তো হয়। তাহলে তো আর আল্লাহর প্রয়োজন নেই। পীর আর মাজারে তারাই বেশী যায় যাদের সাথে আল্লাহর দেখা নাই।
আল্লাহ্ আমাদের সূরা ফাতিহায় শিক্ষা দিচ্ছেন -
" (হে আল্লাহ্) আমরা তোমার-ই ইবাদত করি এবং তোমার-ই সাহায্য চাই। আয়াত ৫।
আল্লাহর কাছেই সাহায্য চাইতে হবে কারণ - আল্লাহ্ বলেন-
"আমি জীবন দান করি, মৃত্যু ঘটাই এবং আমারই দিকে সকলের প্রত্যাবর্তন। [ সুরা ক্বাফ ৫০:৪৩ ]।
আরও বলেন -
"এবং অবশ্যই আমি তোমাদিগকে পরীক্ষা করব কিছুটা ভয়, ক্ষুধা, মাল ও জানের ক্ষতি ও ফল-ফসল বিনষ্টের মাধ্যমে। তবে সুসংবাদ দাও সবরকারীদের। [ সুরা বাকারা ২:১৫৫ ]
সুতরাং জীবনের সর্বাবস্থায় আল্লাহর কাছেই চাইতে হবে। কোনো পীর বা মাজারে নয়।
উপরোক্ত সংক্ষিপ্ত আলোচনায় চেষ্টা করেছি প্রতিটি বিষয় সুস্পষ্ট ভাবে তুলে ধরার জন্য। তবুও কোনো জায়গায় আমার বক্তব্য ভুল মনে হলে শুধরে দিন। যাতে আমিও হিদায়াত প্রাপ্ত হতে পারি।
আরও কিছু শির্কঃ
ইবাদতের শির্ক
আল্লাহর সিফাতের সাথে শির্ক
রাষ্ট্রীয় শির্ক
ভোট গনতন্ত্র এবং শির্ক