ইমান কী? ইমানের শর্ত সমূহ কী কী
ইসলামে একজন মুসলমানের মূল হচ্ছে ইমান। ইমান ছাড়া ইসলামে কোনো কিছুই গ্রহণযোগ্য নয়। আর ইমান কখনোই জন্মগত নয়। একজন মুসলমানের ইমান বিভিন্ন বিষয়ের উপর নির্ভরশীল। এইসব বিভিন্ন শর্ত ছাড়া কখনোই ইমান গ্রহণযোগ্য নয়। আজ আমরা ইমানের বিভিন্ন শর্তসমূহ জানার চেষ্টা করব। যেসব শর্ত ছাড়া কখনোই একজন মুসলমান প্রকৃত ইমানদার হতে পারে না।
ইমান কী
ইমানের সহজ অর্থ হলো ইসলামের বিভিন্ন বিধি-বিধানকে মুখে স্বীকৃতি ও অন্তরে বিশ্বাস করে সেইমতে কাজ করা। অর্থাৎ মুখে স্বীকৃতি, অন্তরে বিশ্বাস এবং তা কাজে পূর্ণ করাই হচ্ছে ইমান। যে এই কাজ অর্থাৎ ইমান এনে ইসলামের প্রতি আনুগত্যশীল হয় তাকে বলা হয় মুসলিম।
ইমান একটি গাছের তিনটি অংশ অর্থাৎ শেখড়, মূল বৃক্ষ আর অসংখ্য শাখাপ্রশখায় বিভক্ত। ইমানের একটি অংশ হলো অন্তরের বিশ্বাস মাটির নীচে মূলের মতো। যা কেউ দেখে না। দ্বিতীয় অংশ মুখের স্বীকৃতি মূল কান্ডের মতো যা বাইরে থেকে দেখা যায়। তৃতীয় অংশ হলো আমল গাছের শাখাপ্রশখা মতো। যা দেখে গাছকে পরিপূর্ণ ও সৌন্দর্যমণ্ডিত দেখায়।
আরও পড়ুন ইবাদত কবুল হওয়ার শর্তসমূহ
ইমানের শর্তসমূহ
ইমান বেশকিছু শর্তের উপর নির্ভরশীল। যারা ইমান আনে কিংবা আনতে চায় অথবা যারা নিজেদের ইমানদার দাবি করতে চায় তাদের এই শর্তসমূহ পূরণ করে তবেই ইমানদার হতে হবে।
১) একমাত্র আল্লাহকে বিশ্বাস
ইমানের প্রথম এবং অনিস্বীকার্য শর্ত হলো এক আল্লাহতে বিশ্বাস। যারা ইমান আনবে তাদেকে আল্লাহকে রব, ইবাদতের একমাত্র মালিক এবং তাঁর মতো গুণের অধিকারী দ্বিতীয় কেউ নয় এমন স্বীকৃতি দিতে হবে।
২) আসমানী কিতাবে বিশ্বাস
পবিত্র কুরআনসহ নাযিলকৃত যত পূর্ববর্তী কিতাব রয়েছে তা সবই আল্লাহর পক্ষ থেকে এসেছে এই বিশ্বাস রাখতে হবে।
৩) মালাইকার প্রতি বিশ্বাস
আল্লাহর সৃষ্ট যত মালাইকা তথা ফিরিশতা রয়েছে তাদের প্রতি বিশ্বাস এবং তাদের নির্ধারিত কাজের প্রতি ইমানদারের বিশ্বাস থাকতে হবে।
৪) নবি রাসুল (আ:) এর প্রতি বিশ্বাস
আল্লাহ পৃথিবীতে যত নবি রাসুল (আ:) পাঠিয়েছেন তাঁদের প্রতি বিশ্বাস থাকতে হবে যে তাঁরা আল্লাহর প্রেরিত নবি রাসুল।
আরও পড়ুন কুরআনের আলোকে মানুষ সৃষ্টির কারণ
৫) তকদীর বিশ্বাস
মানুষের ভাগ্য বা তকদীর আল্লাহর হাতে। তিনি যা চাইবেন তা-ই হচ্ছে এবং হবে। এই জাতীয় বিশ্বাস পরিপূর্ণভাবে থাকতে হবে।
৬) পুনরুত্থানে বিশ্বাস
প্রতিটি মানুষের মৃত্যুর পর আল্লাহ তাদের আবার জীবিত করবেন এবং তাদের। দুনিয়ার কাজের জন্য প্রত্যেকের বিচার হবে এই বিশ্বাস থাকতে হবে।
৭) আখিরাতে বিশ্বাস
পৃথিবীতে একদিন না একদিন কিয়ামত অনুষ্ঠিত হবে এবং আখিরাতে ফয়সালা হবে। এই শেষ বিচারের দিন প্রতিটি জ্বীন এবং মানুষের কৃতকর্মের বিচার হবে এই বিশ্বাস রাখা।
আরও পড়ুনরাসুল সাঃ ও পীর অলি আউলিয়া সম্পর্কিত আকিদার জবাব
৮) শিরক মুক্ত থাকা
ইমানদারের শর্তের মধ্যে অন্যতম হলো শিরক বর্জন করা। আল্লাহর জাত তথা আল্লাহর কোনো সন্তান আছে বা আল্লাহর নিজের কোনো অংশ দিয়ে কাউকে সৃষ্টি করা হয়েছে এমন ধারণা থেকে বিরত থাকা। আল্লাহর সিফাত তথা গুণাবলী অর্থাৎ আল্লাহর যা করতে পারেন তা বান্দাও করতে পারেন এমন ধারণা করা শিরক। যেমন সন্তান দেওয়া বিপদ থেকে উদ্ধার করা ইত্যাদি আল্লাহর গুণ। যদি কেউ মনে করে এই কাজ আল্লাহর কোনো বান্দা বা মালাইকা, পুকুরের কোনো কুমির, কচ্ছপ, বা কোনো গাছ ইত্যাদি এরাও করতে পারে তবে তা শিরকের অন্তর্ভুক্ত হবে। এটা করলে কখনোই ইমানদার থাকা যাবে না। (সুরা নিসা : ৪৮)
আরও পড়ুন শিরক কী? মানুষ কীভাবে শিরক করে
৯) আল্লাহর বিধানে আনুগত্য করা
আল্লাহ যে বিধান পৃথিবীর জন্য নাযিল করেছেন সেই বিধানের ভিত্তিতেই এই পৃথিবীর সমস্ত কাজ পরিচালনা করা। অর্থাৎ আল্লাহর আইনে পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র এবং পুরো পৃথিবী পরিচালিত হবে। যে নিজেকে ইমানদার দাবি করবে তাকে তার জীবনের প্রতিটি পর্যায়ে ইসলামকে মানতে হবে। রাষ্ট্রীয় সংবিধানও ইসলামের হতে হবে। মানুষের তৈরি কোনো সংবিধানের আনুগত্য করা যাবে না। বাধ্য হলে প্রতিকারের ব্যবস্থা নিতে হবে অথবা এইসব বিধানের সহযোগী এবং সহযোগিতা করা যাবে না। যেমন গনতন্ত্র মানা যাবে না। চেষ্টা করতে হবে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করার। যদি সম্ভব না তবে যারা গনতন্ত্রের সাথে আছে তাদের পরিত্যাগ করতে হবে। এবং গনতন্ত্রের অংশ হিসাবে ভোট দেওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে।
আরও পড়ুন তাওহিদ কী কীভাবে আল্লাহর তাওহিদ ক্ষুন্ন হয়
১০) পরিপূর্ণ ইবাদতবন্দেগী
ইসলামের যেসব আনুষ্ঠানিক ইবাদত তথা সালাত, জিকির, সিয়াম, হজ্জ্ব, যাকাত এবং কুরবানী ইত্যাদি পরিপূর্ণভাবে পালন করতে হবে। যা যার উপর ফরজ তা তাকে একাগ্রতার সহিত পালন করতে হবে। এইসব আনুষ্ঠানিক ইবাদত ছাড়া ইমান পূর্ণ হতে পারে না।
১১) উদার ও কঠোরতা
ইসলামি বিবি-বিধান পালনে উদার হতে হবে। অন্যান্য বাতিল ধর্মীয় এবং মানবসৃষ্ট বিধিবিধানের প্রতি কঠোরতা দেখাতে হবে। এইসব বিধিবিধান ও অনুষ্ঠান ঘৃণাভরে বর্জন করতে হবে।
আরও পড়ুন সুফি সুন্নীদের বিভিন্ন আকিদা সম্পর্কিত জবাব
১২) বন্ধুত্ব ও বর্জন
অন্যান্য ইমানদারকে ভালোবেসে ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব তৈরি করতে হবে। ইসলামের জন্য ক্ষতিকর (মুনাফিক, কাফির, মুরতাদ) মানুষদের বর্জন করতে হবে। যারা তা করতে পারবে না তাদের ইমান সন্দেহযুক্ত হবে।
১৩) নিফাকি ও রিয়া বর্জন
নিফাকি ও রিয়া সমৃদ্ধ ইবাদত কখনোই আল্লাহর কাছে কবুল হয়না। তাই ইমানদারদের নিফাক এবং রিয়া ত্যাগ করতে হবে। এইসব বর্জন করা ইমানের শর্ত।
আরও পড়ুন বর্তমান সমাজের মুনাফিকের পরিচয় ও পরিনতি
১৪) শুদ্ধ জীবন অশ্লীলতা বর্জন
যারা ইমানের অধিকারী তারা আল্লাহর বিধানে শুদ্ধ জীবনযাপন করে। যারা ইমানদার তারা বিজাতীয় সংস্কৃতি ও অশ্লীলতা ইত্যাদি বর্জন করে আল্লাহর সুন্দর পথে নিজে এবং পুরো পরিবারকে পরিচালিত করে। সুতরাং অশ্লীলতা বর্জন করাটা ইমানের একটি শর্ত।
১৫) তওবা করে পরিশুদ্ধ
কোনো কারণে ছোট বড় পাপ হয়ে গেলে ইমানদারগণ তৎক্ষণাৎ আল্লাহর কাছে তওবা করে ক্ষমা চায়। যারা ইমানদার নয় তারা পাপ করে আল্লাহ থেকে ক্ষমা চায় না। সুতরাং তওবা করে নিজেকে পরিশুদ্ধ করা ইমানের একটি শর্ত।
১৬) রাসুলুল্লাহর (সা:) সহিহ অনুসরণ
উপরোক্ত যতগুলো শর্তের কথা বলা হয়েছে তার অনুসরণ হতে হবে রাসুল (সা:) এর সহিহ ত্বরিকা অনুযায়ী। যে ইবাদত তিঁনি যেভাবে করেছেন এবং করার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন সেই ইবাদত সেভাবেই করাটা হচ্ছে ইমানের শর্ত। ইসলামের ছোট বড় ফরজ, সুন্নাত, নফল মুস্তাহাব ইত্যাদি যা আছে তা রাসুল (সা:) যেমন করেছেন বলে সহিহ হাদিস দ্বারা প্রমাণিত সেই একইভাবে ইমানদারদেরও করতে হবে। এটাই ইমানের গুরুত্বপূর্ণ শর্ত। যে শর্ত পূরণ না হলে কখনোই কোনো ইবাদত আল্লাহ কবুল করবেন না।
রাসুলুল্লাহ সাঃএর আদর্শ এবং অনুসরণই হচ্ছে ইসলাম
উপরোক্ত শর্তাবলী থেকে এটা স্পষ্ট যে প্রকৃত ইমানদার তারা, যারা রাসুলের (সা:) সঠিক অনুসরণ এবং অনুকরণে ইসলামকে মেনে নিবে। ইমানের মধ্যে কোনো প্রকার শিরকের স্থান নেই। আল্লাহর বিধি বিধান পালনে কোনো কার্পণ্যতা থাকা যাবে না। সর্বাবস্থায় একমাত্র আল্লাহ-ই আমাদের সহায়ক এই বিশ্বাস নিয়ে জীবনযাপন করতে হবে।
সাখাওয়াতুল আলম চৌধুরী
পতেঙ্গা, চট্টগ্রাম
ইমান কী? ইমানের শর্ত সমূহ কী কী |