মুমিনদের প্রতি আল্লাহর নেয়ামত
ইসলাম হলো আল্লাহর বিধানে আনুগত্য করা। যারা আল্লাহকে বিশ্বাস করে তাঁর বিধানে আনুগত্য করে তাকে বলা মুসলিম। একইভাবে যারা ইমান এনে ইসলামের বিধি-বিধানের পরিপূর্ণ আনুগত্য করে এবং তাকওয়ার সাথে আল্লাহর ইবাদত বন্দেগি করে তাদের বলা মুমিন। যারা ইমান আমলের সাথে নিজেদের প্রকৃত মুমিন হিসাবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে পারে, আল্লাহ তাদের জন্য নির্ধারিত করে দিয়েছেন অশেষ নিয়ামত। আজ আমরা কুরআন হাদিসের আলোকে জানার চেষ্টা করব মুমিনের প্রতি আল্লাহর অশেষ নিয়ামত কী।
১) আল্লাহর স্বরণে শান্তি
যাঁরা মুমিন তাঁদের জন্য আল্লাহর নিয়ামতের মধ্যে রয়েছে অন্তরে আল্লাহর জন্য প্রশান্তি।
আল্লাহ বলেন- "যারা বিশ্বাস স্থাপন করে এবং তাদের অন্তর আল্লাহর যিকির দ্বারা শান্তি লাভ করে; জেনে রাখ, আল্লাহর যিকির দ্বারাই অন্তর সমূহ শান্তি পায়।" (সুরা রা’দ ১৩:২৮)
২) রহমত প্রাপ্তি
যাঁরা ঈমান এনে পরিপূর্ণ মুমিন হয় তাঁদের জন্য রয়েছে আল্লাহর অশেষ রহমত। মুমিনদের বিভিন্ন পদক্ষেপে আল্লাহর সহায়তা সর্বদা বজায় থাকে। আল্লাহ বলেন- "আর ঈমানদার পুরুষ ও ঈমানদার নারী একে অপরের সহায়ক। তারা ভাল কথার শিক্ষা দেয় এবং মন্দ থেকে বিরত রাখে। নামায প্রতিষ্ঠা করে, যাকাত দেয় এবং আল্লাহ ও তাঁর রসূলের নির্দেশ অনুযায়ী জীবন যাপন করে। এদেরই উপর আল্লাহ তা'আলা দয়া করবেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ পরাক্রমশীল, সুকৌশলী।" (সুরা তাওবা ৯:৭১)
আরও পড়ুন প্রবৃত্তির অনুসরণ ও তার পরিনতি
৩) আল্লাহর সাহায্যপ্রাপ্ত
মুমিনগণ আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠাসহ দুনিয়া এবং আখিরাতের বিষয়ে একেঅপরকে সাহায্য করার মাধ্যমে মূলত আল্লাহকে সাহায্য করে থাকে। এই সাহায্যের বিনিময়ে আল্লাহও মুমিনদের সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দেন। আল্লাহ বলেন, "হে বিশ্বাসীগণ! যদি তোমরা আল্লাহকে সাহায্য কর, আল্লাহ তোমাদেরকে সাহায্য করবেন এবং তোমাদের পা দৃঢ়প্রতিষ্ঠ করবেন। ( সুরা মুহাম্মাদ ৪৭:৭ )
"মুমিনদের সাহায্য করা আমার দায়িত্ব।" ( সুরা রূম ৩০:৪৭ )
৪) মুমিনরা বিজয়ী
আল্লাহ যাঁরা মুমিন তাদের দুনিয়া এবং আখিরাতে বিজয়ী করবেন। তাই মুমিনদের নিরাশ হওয়া যাবে না। কেননা মুমিনদের সাহায্য আল্লাহ নিজে করেন। "আর তোমরা নিরাশ হয়ো না এবং দুঃখ করো না। যদি তোমরা মুমিন হও তবে, তোমরাই জয়ী হবে।" ( সুরা ইমরান ৩:১৩৯ )
৫) পৃষ্ঠপোষক আল্লাহ
আল্লাহ একমাত্র মুমিনদের অভিভাবক এবং পৃষ্ঠপোষক। মুমিনগণ সর্বদা আল্লাহর অভিভাবকত্বে থাকেন। "যারা ঈমান এনেছে, আল্লাহ তাদের অভিভাবক।" (সুরা বাকারা ২:২৫৭)
৬) মুমিনরা ভীতিমুক্ত
প্রকৃত মুমিনগণ কখনোই ভীত নয়। দুনিয়াবী কোনো কিছুই তাঁদের অন্তরে ভয়ের কম্পন সৃষ্টি করতে পারে না। "নিশ্চয়ই যারা বিশ্বাস স্থাপন করেছে, সৎকাজ করেছে, নামায প্রতিষ্ঠিত করেছে এবং যাকাত দান করেছে, তাদের জন্যে তাদের পুরষ্কার তাদের পালনকর্তার কছে রয়েছে। তাদের কোন শঙ্কা নেই এবং তারা দুঃখিত হবে না। (সুরা বাকারা ২:২৭৭)
আরও পড়ুন বর্তমান সমাজের মুনাফিকের পরিচয় ও পরিনতি
৭) দুনিয়া ও আখিরাতে প্রতিষ্ঠা
আল্লাহ মুমিনদেরকে দুনিয়া এবং আখিরাতে প্রতিষ্ঠিত করেন। পৃথিবীতে নেক আমল করার তৌফিক এবং এর প্রতিদানে আখিরাতে মর্যাদা প্রদান। "আল্লাহ তা'আলা মুমিনদেরকে মজবুত বাক্য দ্বারা মজবুত করেন। পার্থিবজীবনে এবং পরকালে। এবং আল্লাহ জালেমদেরকে পথভ্রষ্ট করেন। আল্লাহ যা ইচ্ছা, তা করেন।" (সুরা ইবরাহীম ১৪:২৭)
৮) জান্নাতের হকদার
মুমিনদের জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে রয়েছে মহা পুরস্কার। এই পুরস্কার হচ্ছে আল্লাহর নেয়ামত জান্নাত। একমাত্র মুমিনই জান্নাতের দাবিদার। "আপনি মুমিনদেরকে সুসংবাদ দিন যে, তাদের জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে বিরাট অনুগ্রহ রয়েছে।" (সুরা আহযাব ৩৩:৪৭)
"আল্লাহ ঈমানদার পুরুষ ও ঈমানদার নারীদের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেনে কানন-কুঞ্জে র, যার তলদেশে প্রবাহিত হয় প্রস্রবণ। তারা সে গুলোরই মাঝে থাকবে।" (সুরা তাওবা ৯:৭২)
৯) উচ্চ মর্যাদা ও জীবিকা
আল্লাহ মুমিনদের তাকওয়ার ভিত্তিতে দুনিয়া এবং আখিরাতে উচ্চ মর্যাদা এবং জীবিকা প্রদান করেন। "পার্থিব জীবনের উপর কাফেরদিগকে উম্মত্ত করে দেয়া হয়েছে। আর তারা ঈমানদারদের প্রতি লক্ষ্য করে হাসাহাসি করে। পক্ষান্তরে যারা পরহেযগার তারা সেই কাফেরদের তুলনায় কেয়ামতের দিন অত্যন্ত উচ্চমর্যাদায় থাকবে। আর আল্লাহ যাকে ইচ্ছা সীমাহীন রুযী দান করেন।" (সুরা: আল বাকারা, আয়াত: ২১২)
আরও পড়ুন সুফিবাদ কী? কীভাবে উৎপত্তি এবং বর্তমান অবস্থা
১০) আখিরাতে আলো
মুমিনগণ আখিরাতে সফল হবেন আল্লাহর আলো প্রাপ্তিতে। যে আলো দ্বারা তাঁরা কিয়ামতের কঠিন পথ পাড়ি দিবেন অনায়াসেই। এবং তাদের জন্য রয়েছে জান্নাত। "যেদিন আপনি দেখবেন ঈমানদার পুরুষ ও ঈমানদার নারীদেরকে, তাদের সম্মুখ ভাগে ও ডানপার্শ্বে তাদের জ্যোতি ছুটোছুটি করবে বলা হবেঃ আজ তোমাদের জন্যে সুসংবাদ জান্নাতের, যার তলদেশে নদী প্রবাহিত, তাতে তারা চিরকাল থাকবে। এটাই মহাসাফল্য।" (সুরা হাদীদ ৫৭:১২)
১১) আল্লাহ সাথে থাকা
প্রকৃত মুমিনগণ সর্বদা ভরসা রাখে আল্লাহর উপর। দুনিয়ার কাজ এবং আখিরাতের আমলের জন্য তাঁরা সর্বাবস্থায় আল্লাহমুখী। তাই আল্লাহও ওয়াদাবদ্ধ মুমিনদের সাথে থাকার। "জেনে রেখ আল্লাহ রয়েছেন ঈমানদারদের সাথে। (সুরা আনফাল ৮:১৯)
১২) আল্লাহর করুনা প্রাপ্তি
মুমিনগণ দুনিয়ায় বিভিন্ন সময় শয়তানের প্ররোচনায় কিছু ভুল ভ্রান্তি করে ফেলে। যখনই মুমিন ভুল করে তখনই তাঁরা ক্ষমা চেয়ে নেয় আল্লাহর কাছে। আল্লাহও তাঁদের ক্ষমার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। "বস্তুতঃ তিনি তোমাদিগকে ক্ষমা করেছেন। আর আল্লাহর মুমিনদের প্রতি অনুগ্রহশীল।" (সুরা ইমরান ৩:১৫২)
১৩) আল্লাহর বন্ধুত্ব
যাঁদের আল্লাহর মতো বন্ধু রয়েছে তাঁদের দুনিয়া এবং আখিরাতে কোনো শঙ্কা নেই। মুমিনগণ দুনিয়ার বন্ধু নয় বরং আল্লাহর বন্ধুত্ব পেতে কাজ করে। "আল্লাহ হচ্ছেন মুমিনদের বন্ধু।" (সুরা ইমরান ৩:৬৮)
আরও পড়ুন উছিলা কী? উছিলার বিস্তারিত ব্যাখ্যা
১৪) মন্দ মুছে দেওয়া
যারা ঈমান আনে তাঁদের আগের পাপ সমূহ আল্লাহ ক্ষমা করে দেন। সেইসাথে মুমিনগণের বিভিন্ন ভুল ত্রুটির পাপ সমূহও আল্লাহ ক্ষমা করে তাঁদের মন্দ সমূহ মুছে দেন। "আর যারা বিশ্বাস স্থাপন করে ও সৎকর্ম করে, আমি অবশ্যই তাদের মন্দ কাজ গুলো মিটিয়ে দেব এবং তাদেরকে কর্মের উৎকৃষ্টতর প্রতিদান দেব।" (সুরা আনকাবুত ২৯:৭)
১৫) আল্লাহর ভালোবাসা
যাঁরা ঈমান আনার পর সেই অনুযায়ী আমল করতে থাকে তাঁদেরকে আল্লাহ ভালোবাসা দিয়ে থাকেন। মুমিনগণ পরস্পরের প্রতি ভালোবাসার বন্ধনে আবদ্ধ দ্বারা আল্লাহর ভালোবাসও পেয়ে থাকেন। "যারা বিশ্বাস স্থাপন করে এবং সৎকর্ম সম্পাদন করে, তাদেরকে দয়াময় আল্লাহ ভালবাসা দেবেন।" (সুরা মারঈয়াম ১৯:৯৬)
১৬) প্রচেষ্টা ব্যর্থ না হওয়া
মুমিনগণ দুনিয়ামুখী নয়। তাঁদের কোনো কাজই দুনিয়ার জন্য নয়। তাঁরা আল্লাহর রাস্তায় যা ই করে তার হিসাব আল্লাহ লিখে রাখেন। অনেকেই দুনিয়ায় অনেক ভালো কাজ করেন যা আপাত দৃষ্টিতে দেখে মনে হয় কিছুই না। কিন্তু আল্লাহ সেইসব কাজগুলোকে কখনোই ব্যর্থ করেন না। "যারা বিশ্বাস স্থাপন করে এবং সৎকর্ম সম্পাদন করে আমি সৎকর্মশীলদের পুরস্কার নষ্ট করি না।" (সুরা কা’হফ ১৮:৩০)
আরও পড়ুন কুরআন ই হিদায়াত প্রকৃত মাধ্যম
১৭) অন্ধকার থেকে আলোতে আনা
মুমিনদের প্রতি আল্লাহর সবচেয়ে বড় নিয়ামত হলো, আল্লাহ তাঁদের কুফুরি অন্ধকার পথ থেকে আলোর পথ তথা আল্লাহর পথে নিয়োজিত করেছেন। আল্লাহ নিজ দায়িত্ব মুমিনদের আলোর রাস্তায় চালান। "যারা ঈমান এনেছে, আল্লাহ তাদের অভিভাবক। তাদেরকে তিনি বের করে আনেন অন্ধকার থেকে আলোর দিকে।" (সুরা বাকারা ২:২৫৭ )
১৮) শুভসমাপ্তি
মুমিনদের প্রতি আল্লাহর নিয়ামত হচ্ছে শেষ শুভসমাপ্তি। আর তা হলো আল্লাহর ওয়াদাবদ্ধ জান্নাত। "নিশ্চয়ই এ পৃথিবী আল্লাহর। তিনি নিজের বান্দাদের মধ্যে যাকে ইচ্ছা এর উত্তরাধিকারী বানিয়ে দেন এবং শেষ কল্যাণ মুত্তাকীদের জন্যই নির্ধারিত রয়েছে।" (সুরা আরাফ ৭:১২৮)
১৯) ক্ষমা প্রাপ্তি
মুমিনের প্রতি আল্লাহর দয়া হলো, তিনি তাঁর বান্দাদের প্রতিনিয়ত ক্ষমা করেন। আর মুমিনগণ সবসময়ই আল্লাহর কাছে ইস্তেগফারে রত থাকেন। যারাই পাপ করে ক্ষমা চায় তাদেরই আল্লাহ ক্ষমার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। "বলুন, হে আমার বান্দাগণ যারা নিজেদের উপর যুলুম করেছ তোমরা আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না। নিশ্চয় আল্লাহ সমস্ত গোনাহ মাফ করেন। তিনি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।" (সুরা যুমার ৩৯:৫৩)
আরও পড়ুন ইবাদত কবুল হওয়ার শর্তসমূহ
২০) হিদায়াত প্রাপ্তি
আল্লাহ মুমিনগণকে নিজ দায়িত্বে হিদায়াত প্রদান করেন। কেননা হিদায়াতের মালিক একমাত্র আল্লাহ। তিনি যাকে ইচ্ছা তাকেই হিদায়াত দিয়ে থাকেন। আর মুমিনগণই সেই হিদায়াত পেয়ে থাকেন। "অবশ্য যেসব লোক ঈমান এনেছে এবং সৎকাজ করেছে, তাদেরকে হেদায়েত দান করবেন তাদের পালনকর্তা, তাদের ঈমানের মাধ্যমে।" (সুরা ইউনুস ১০:৯)
২১) শয়তান থেকে রক্ষা
শয়তান আল্লাহর সাথে চ্যালেঞ্জ করে তাঁর বান্দাদের বিপথে নেওয়ার জন্য। আর আল্লাহ নিজে তাঁর মুমিন বান্দাদের রক্ষা করে সেই চ্যালেঞ্জের জবাব দেয়। "তার (শয়তানের) আধিপত্য চলে না তাদের উপর যারা (মুমিন) বিশ্বাস স্থাপন করে এবং আপন পালন কর্তার উপর ভরসা রাখে। (সুরা নাহল ১৬:৯৯)
২২) আল্লাহ দৃঢ়পদে রাখেন
প্রতিটি কাজে আল্লাহ তাঁর মুমিন বান্দাদের দৃঢ়পদে রাখেন। যাতে তাঁরা লক্ষ্যচুত না হয়। মুমিনদের প্রতি এটাও আল্লাহর একটি বড় নিয়ামত।রাসুলুল্লাহ (সাঃ) সবসময় দোয়া করতেন "হে ক্কলবের অধিকারী তুমি আমার ক্বলবে দ্বীনের উপর অটুট রাখো " (তিরমিজি : ৩৫২২)
উপর্যুক্ত আলোচনা থেকে আমরা বুঝতে পারলাম আল্লাহ মুমিনদের দুনিয়া এবং আখিরাতের কী কী নিয়ামত দান করেছেন। সুতরাং প্রতিটি মুসলমানের উচিত নিজেদের ইমান আমল দ্বারা প্রকৃত মুমিন হিসাবে গড়ে তোলা।
সাখাওয়াতুল আলম চৌধুরী
পতেঙ্গা, চট্টগ্রাম
কৃতজ্ঞতা By "Bangla Quran" App - https://alquranbd.com/AndroidApp