মুমিন কী? মুমিনের বৈশিষ্ট্য সমূহ কী কী |
ইসলাম হচ্ছে আল্লাহর বিধিবিধানের উপর আনুগত্য করা। যারাই আল্লাহকে বিশ্বাস করে তাঁর বিধিবিধানের উপর আনুগত্য করার স্বীকৃতি দেয় তারা হচ্ছে মুসলিম। আর যারা নিজেদের মুসলিম দাবি করে ইসলামের সমস্ত কিছু পরিপূর্ণ করে, তারা হচ্ছে মুমিন। আজ আমরা কুরআন হাদিসের আলোকে জানার চেষ্টা করব মুমিনের বৈশিষ্ট্য গুলো কী কী।
মুমিন কে
একজন মানুষ জন্মগতভাবে মুসলিম পরিবারে জন্ম নিলেই মুসলিম হতে পারে। তবে একজন মুসলিম জন্মগতভাবে মুমিন হতে পারে না। ইসলামে মুমিন হতে হলে তাকে প্রকৃত ঈমানদার হতে হবে। একজন মুসলিম ঈমান এনে আমল করার পরই মুমিন হতে পারে। সুতরাং যারা ঈমানকে (স্বীকৃতি এবং আমলের) দ্বারা পরিপূর্ণ করেছে তাঁরাই মুমিন। এখন আমরা মুমিনের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য গুলো কী তা দেখবো।
১) কালেমাতে বিশ্বাস
যারা প্রকৃত মুমিন তাঁরা কালেমা সংশ্লিষ্ট যেমন, আল্লাহ্, আসমানী কিতাব, মালাইকা, নবী রাসুল, তকদীর, পুনরুত্থান এবং আখিরাতে পরিপূর্ণ আস্থা রাখে। অর্থাৎ অদৃশ্য সম্পর্কিত সকল বিষয়ের উপর পূর্ণ বিশ্বাস রাখে। (সুরা বাকারা : ২-৫)
আরও পড়ুনরাসুল সাঃ ও পীর অলি আউলিয়া সম্পর্কিত আকিদার জবাব
২) সন্দেহ পোষণ না করা
মুমিনগণ আল্লাহ্ সম্পর্কিত কোনো কিছুতেই কখনো সন্দেহ করে না। যা আল্লাহ্ বলেন এবং বিধান হিসাবে নাযিল করেছেন তা নিঃসংকোচে অকপটে মেনে নেয়। (সুরা হুজরাত : ১৫)
৩) সালাতে বিনয়
যারা মুমিন তাঁরা কখনোই সালাতে তাড়াহুড়া করে না। পরিপূর্ণ বিনয়ের সহিত তাঁরা সালাতে মগ্ন থাকে। সালাতের সকল আহকাম সুচারুরূপে তাঁরা আদায় করে। (সুরা মুমিনুন :১-৪)
৪) আল্লাহর বিধানে পূর্ণ আনুগত্য
প্রকৃত মুমিনরা সর্বাবস্থায় আল্লাহ্, রাসুল (সাঃ) এবং ইসলামের বিধান নিঃসংকোচে মেনে নেয়। দুনিয়ার সবকিছু ছেড়ে একমাত্র আল্লাহর আনুগত্য করে। (সুরা নূর -৫১; সুরা তওবা :১১২)
আরও পড়ুন সুফি সুন্নীদের বিভিন্ন আকিদা সম্পর্কিত জবাব
৫) ওয়াদা রক্ষাকারী
মুমিনরা সবসময় ওয়াদ রক্ষা করে চলে। কখনোই তাঁরা ওয়াদার বরখেলাপ করে না। (সুরা - মুমিনুন : ৮)
৬) ধৈর্যশীল বা সবরকারী
জীবনের যেকোনো ঘাত প্রতিঘাতে মুমিরা ধৈর্যের পরিচয় দেয়। তুমুল প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও তাঁরা ধৈর্য্যহারা হয় না। মুমিনগণ ইবাদতে, রাগ নিয়ন্ত্রণে, পাপাচার থেকে বিভিন্ন দূর্ঘটনা ঘটনা থেকে নিজেরা ধৈর্য্য ধরে। (সুরা লোকমান :১৭)
৭) দানশীলতা
মুমিনরা (ধনী বা গরিব) যেকোনো পরিস্থিতিতে সবসময় দানশীল হন। ফরজ যাকাতের পাশাপাশি আত্মীয়স্বজন, নিজ পরিবার, ফকির মিসকীন বা জনকল্যাণমূলক কাজ থেকে শুরু করে যখনই কোন প্রয়োজন হয় তখনই তাঁরা যতটুকু আছে ততটুকু থেকেই দান করে থাকে। (সুরা দাহর :৮,৯)
আরও পড়ুন প্রবৃত্তির অনুসরণ ও তার পরিনতি
৮) ভরসা আল্লাহর উপর
জীবনের যেকোনো মুহূর্তে মুমিনগণ আল্লাহর উপরই ভরসা করে। কোনো বিপদ আপদেই তাঁদেরকে আল্লাহর ভরসা থেকে বিচ্যুত করতে পারে না। (সুরা আলে ইমরান - ১৭৩, হুদ - ৫৬)
৯) সৎকাজের আদেশ অসৎকাজের নিষেধ
প্রকৃত মুমিন তাঁরাই যারা যেকোনো অবস্থায় সৎ কাজের আদেশ দেয় এবং অসৎ কাজের নিষেধ করে। মুমিনরা কখনো সুবিধাবাদী চিন্তা করে না। কে ভালো বললো কে খারাপ বললো তাঁরা তা তোয়াক্কা করে না। (সুরা তওবা -৭১)
১০) আল্লাহর সাহায্যকারী
মুমিনরা সবসময়ই আল্লাহকে সাহায্য করে আল্লাহর রাস্তায় নিজেদের জান এবং মালের দ্বারা। আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠায় তাঁরা সবসময়ই সচেষ্ট থাকে। (সুরা মুহাম্মদ - ৭)
আরও পড়ুন সুফিবাদী সুন্নীদের আকিদা সমূহ
১১) অনর্থক কথা না বলা
মুমিন ব্যক্তি প্রয়োজন ছাড়া বেহুদা কথাবার্তা বলা থেকে বিরত থাকে। যেখানে যতটুকু প্রয়োজন ততটুকুই তাঁরা নিজেদের জড়িত রাখে। অনর্থক হাসি তামাশাতে গল্প গুজব করে সময় পার করে না। (সুরা ফুরকান -৭২)
১২) আমানতদার
মুমিনদের গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো তাঁরা বিশ্বস্ত আমানতদার। যেকোনো পরিস্থিতিতে কখনোই তাঁরা আমানতের খিয়ানত করে না। (সুরা মুমিনুন -৮)
১৩) বিনয় ও কোমলতা
মুমিনদের হৃদয় বিনয় ও কোমলতায় পরিপূর্ণ। তাঁদের মন সবসময় কোমল থাকে। তাঁরা কখনোই ঈমাদারদের প্রতি কঠোর হন না। (সুরা মারিয়ম -৯৬,মায়েদা -৫৪)
আরও পড়ুন সুফি সুন্নীদের বিভিন্ন আকিদা সম্পর্কিত জবাব
১৪) আল্লাহ ভীরু
যারা মুমিন তাঁরা সর্বদা আল্লাহর ভয়ে তটস্থ থাকে। প্রতিটি মুহূর্ত আল্লাহ বিধানের তাঁবেদারীতে তাঁরা আল্লাহ অসন্তুষ্টির ভয়ে ভীত থাকে। (সুরা আনফাল -২-৪)
১৫) তওবাকারী
মুমিনগণ সর্বদা আল্লাহর কাছে তওবায় রত থাকে। শয়তানের ওয়াসওয়াসায় পড়ে যদি মুমিন কোনো পাপ করে ফেলে তাহলে তাঁরা তৎক্ষণাৎ আল্লাহর কাছে তওবা করে নক্ষমা চেয়ে নেয়। (সুরা নূর -৩১, তাহরীম -৮)
১৬) তাকওয়া
মুমিনদের একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তাঁদের তাকওয়া। আল্লাহর পূর্ণ আনুগত্যের সহিত ইবাদতবন্দেগী করার কারণে মুমিনরা পরিপূর্ণ তাকওয়ার অধিকারী হন। (সুরা হুজরাত -১৩)
আরও পড়ুন শুধু অলি আউলিয়ারাই আল্লাহর অলি নয়
১৭) আল্লাহর নিকট বায়াতবদ্ধ
মুমিনগণ নিজেদের জান এবং সম্পদ দ্বারা আল্লাহর নিকট বায়াতবদ্ধ। তাঁরা তাদের জীবন এবং মালের বিনিময়ে আল্লাহর যেকোনো আদেশ নিষেধ মেনে নিতে প্রস্তুত। (সুরা তওবা -১১১, ফাতাহ -১০)
১৮) লজ্জ্বাস্থানের হেফাজতকারী
মুমিনগণ সর্বদা নিজেদের লজ্জ্বাস্থান রক্ষা করে চলেন। তাঁরা এব্যাপারে কখনোই সীমালঙ্ঘন করেন না। তাঁদের দ্বারা কখনোই লজ্জ্বাস্থানের আমানত খিয়ানত হয় না। (সুরা মুমিন ১-৫)
১৯) পরহেজগারী
মুমিনদের সর্বদা চেষ্টা থাকে আল্লাহর ইবাদতবন্দেগীতে লিপ্ত থাকতে। বেশী বেশী নফল ইবাদত দ্বারা তাঁরা আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের পথে প্রতিযোগিতা করে। যাতে করে আল্লাহর জান্নাতে অধিক মর্যাদাশীল স্থান পাওয়া যায়। (সুরা বাকারা: ২১-২২, আলে ইমরান :১৩৩)
আরও পড়ুন বর্তমান সমাজের মুনাফিকের পরিচয় ও পরিনতি
২০) জিহাদকারী
জিহাদই প্রকৃত মুমিনের বৈশিষ্ট্য। আল্লাহ তাদেরই জান মাল কিনে নেন জিহাদের মাধ্যমে। মুমিনগণ জিহাদের বিষয়ে সর্বদা প্রস্তুত থাকে। আল্লাহর বিধান জমিনে প্রতিষ্ঠার জন্য তাঁরা আমৃত্যু সংগ্রাম চালিয়ে যায়। সমাজে সত্যের প্রতিষ্ঠার জন্যও অগ্রনী ভূমিকা রাখে। (সুরা হুজরাত -১৫)
২১) আপোষহীন
যারা প্রকৃত মুমিন তাঁরা কখনোই মিথ্যার সাথে আপোষ করে না। পরিবার সমাজ রাষ্ট্র যেখানেই সত্যের প্রতিবন্ধকতা আসে সেখানেই প্রতিবাদ করে। সত্যকে বিলিয়ে দিতে অসত্যকে কখনোই ছেড়ে দেয় না।(সুরা আলে ইমরান-২৮ আহযাব-৪৭, ৪৮, মুজাদালা -২২)
২২) শির্কমুক্ত বিশ্বাস
যাঁরা সত্যিকারের মুমিন তাদের আল্লাহর বিশ্বাসে কখনো শির্কের ঠাঁই নেই। তাঁরা শুধুমাত্র এক আল্লাহর উপর ঈমান এনে জীবন পরিচালিত করে। সমাজ বা রাষ্ট্রের কোনো প্রকার শির্ক তাঁদের চরিত্রকে কলুষিত করতে পারে না।
আরও পড়ুন শিরক কী? মানুষ কীভাবে শিরক করে
২৩) নিফাকী বর্জন
মুমিনদের চরিত্রে কখনোই নিফাক থাকে না। তাঁরা কথায় এবং কাজে সর্বদা সততার সহিত জীবন যাপন করে। মুনাফেকী যত অসৎ গুণ আছে তা তাঁদের চরিত্রে অনুপস্থিত। (নিসা -১৪৫)
আরও পড়ুন নিফাক কী? মুনাফিকের পরিচয় ও পরিনতি
২৪) রাসুলুল্লাহর (সাঃ) পূর্নাঙ্গ অনুসরণ
মুমিরা তাঁদের চরিত্র রাসুল (সাঃ) এর অনুকরণে সাজায়। জীবনের প্রতিটি পর্যায়ে তাঁরা রাসুল (সাঃ) এর ব্যতিক্রম কিছু করে না। আল্লাহর বিধান আর রাসুলের (সাঃ) এর অনুসরণ এই দুই ই হচ্ছে তাঁদের জীবন।
আরও পড়ুন রাসুলুল্লাহ সাঃএর আদর্শ এবং অনুসরণই হচ্ছে ইসলাম
২৫) ক্রন্দনশীল
সত্যিকারের মুমিনগণ সর্বদা আল্লাহর ভয়ে ক্রন্দনরত থাকে। যখনই তাঁদের সামনে আল্লাহর নাম নেওয়া হয় তখনই তাঁদের আত্মা কান্নায় কেঁপে উঠে। (সুরা আনফাল: ২-৪)
২৬) অন্ধবিশ্বাসী নয়
মুমিনগণে দুনিয়াবী যেকোনো বিষয় অন্ধের মতো বিশ্বাস করে না। তাঁরা যেকোনো কিছু আগে যাচাই বাছাই করার পর সিদ্ধান্ত নেয়। তাঁরা কোনো গুজবে কান দিয়ে মানুষের ক্ষতি করে না। (সুরা হুজুরাত :৬)
আরও পড়ুন পূর্বপুরুষদের অন্ধ অনুসরণ
২৭) দ্বীনের জ্ঞানার্জন
প্রকৃত মুমিনগণ সর্বদা ইসলামের জ্ঞান আহরণের জন্য উদগ্রীব থাকে। যেখানেই যতটুকু সময় মিলুক না কেন সেখানেই জ্ঞানের চর্চা হলে তাঁরা তা লুফে নেয়। ইসলামের সত্যিকারের জ্ঞান ছাড়া কখনোই আল্লাহ কে সন্তুষ্ট করা যায় না। (সুরা যুমার : ৯, ফাতির :২৮)
২৮) উদ্যমী হওয়া
শক্তিশালী মুমিনের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো উদ্যমতা। প্রকৃত মুমিনগণ শয়তানকে প্রশ্রয় দিয়ে অলসতা, অক্ষমতা অকর্মণ্যতা, জীর্ণতা ইত্যাদিকে আশ্রয় দেয় না। তাঁরা দুনিয়াবী এবং আখিরাতী সকল কাজ উদ্যমী হয়ে সম্পাদন করে। রাসুল (সাঃ) সবসময় এই খারাপ অভ্যাস থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাইতেন। (সহিহ বুখারি :৬৩৬৯)
২৯) সংশোধনের প্রচেষ্টা
সত্যিকারের মুমিনগণ শুধু নিজের সংশোধন নয় বরং পরিবার সমাজ এবং রাষ্ট্রেরও সংশোধনের চেষ্টা চালিয়ে যায়। হাদীসে এসেছে যে কোনো অন্যায় দেখবে তাহলে সে যদি পারে হাতেও মুখ দিয়ে বন্ধ করবে। না পারলে ঘৃণা করবে এবং বন্ধ করার পরিকল্পনা করবে। (সহিহ মুসলিম)
আরও পড়ুন বিশ্বকাপ ফুটবল এবং আমাদের ঈমান আকিদা
৩০) পরোপকারী
আল্লাহর মুমিনগণ সর্বদা পরোপকারী হয়। তাঁদের মনমানসিতাই হচ্ছে অন্যের ভালো করে আল্লাহকে সন্তুষ্ট করা।
৩১) স্বাস্থ্য সচেতন
মুমিনরা স্বাস্থ্য সচেতন হন। একজন সুস্বাস্থ্যের অধিকারী যা করতে পারবে একজন অসুস্থ ব্যক্তি তা পারে না। জিহাদ এবং ইসলামের বিকাশে সুস্বাস্থ্য সম্পন্ন ব্যক্তির প্রয়োজন।
৩২) ভুল স্বীকার
যারা নিজেদের প্রকৃত মুমিন মনে করে তাঁরা যেকোনো ভুল ভ্রান্তি আল্লাহ এবং যেখানে ভুল হয় সেখান সাথে সাথে ভুল স্বীকার করে ক্ষমা চেয়ে নেয়।
উপরোক্ত বিভিন্ন গুণাবলীর সমন্বয়ে প্রকৃত মুমিনের বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয়। এইসব গুণ যাদের মধ্যে পাওয়া যাবে তাঁরাই হচ্ছেন প্রকৃত শক্তিশালী মুমিন।
সাখাওয়াতুল আলম চৌধুরী
পতেঙ্গা, চট্টগ্রাম।