মানুষ তার মানবিক কারণেই অনুকরণ প্রিয়। ছোট শিশুরা বড়দের দেখেই শিখে। বড়রা যা করে সেও তাই করে বা করতে চেষ্টা করে। একজন মানুষ তার পরিবেশ থেকেই শিখবে এটাই স্বাভাবিক। যখন কেউ পরিবেশ পরিস্থিতি থেকে কিছু শিখে তখন সে যা শিখে তা কখনোই যাচাই করতে পারে না। অর্থাৎ সে যা শিখছে তা কতটুকু ভালো কিংবা কতটুকু মন্দ।
কেউ চোরের সাথে থেকে চুরি করা শিখল। সে পরিপূর্ণ জ্ঞান হওয়ার আগে বুঝতেই পারে না সে যা করছে সেটা মন্দ বা খারাপ। তাকে বুঝানো হলো চুরি করেই চলতে হবে। চুরি করা ছাড়া খেতে পরতে পারবে না। সে তখন এটা মেনে নিয়েই চলতে থাকলো। যখন বুঝার সঠিক জ্ঞান হয় বা কেউ তাকে শুধরে দিলে তখনই সে বুঝতে পারে এটা করা অপরাধ। তখন সে যদি জেনেবুঝে একই কাজ করতে থাকে তাহলে সে অবশ্যই বড় অপরাধী।
যখন এই বিষয়টা ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে দেখি। তাহলে আমরা দেখি যে ছোটরা বড়দের দেখেই বা বড়দের উৎসাহে, প্রেরণায়, শাসনে ধর্মীয় কাজে উদ্বুদ্ধ বা বাধ্য হয়। বড়রা যা করে ছোটরা তা না বুঝেই করতে থাকে। এভাবে ধর্মীয় বিষয় গুলো অভ্যাসে পরিনত হয়। এইসব ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান সাধারণ কেউ কখনোই যাচাই করে না। তারা ধরেই নেয় যে, তারা যা করছে সবই সঠিক। কেননা এইসব তারা তাদের পূর্বপুরুষ থেকেই শিখে এসেছে। তাদের পূর্বপুরুষ নিশ্চয়ই কম জ্ঞানী আলেম ওলামা ছিলেন না।
সুতরাং বংশ পারস্পরিকভাবে যা তারা করছে তা ই সঠিক। তারা নিজেরা কখনোই যাচাই করে না যে আসলেই আমাদের পূর্বপুরুষ কোনো ভুল করেছে কিনা। অথবা যা করেছে তার সঠিক ভিত্তি আছে কিনা। এটা শতভাগ সত্য যে আমাদের সমাজে ধর্মকে সঠিকভাবে কেউ মানছে না। অর্থাৎ ধর্মীয় অনুশাসন আমাদের সমাজে পুরোপুরি অনুপস্থিত। সেই অবস্থায় যারা মোটামুটি ধর্ম চর্চা করে তারাও ততটা ঘেঁটে ধর্মকে মেনে চলে না। তারা সেই পথেরই অনুসরণ করে যা তাদের বাপ দাদারা করে গিয়েছে।
এই কথা শতভাগ সত্য। কারণ পবিত্র কুরআনে আল্লাহ ইসলাম বিমুখীদের এই বলে তিরস্কার করছে যে, তারা কেন তাদের পূর্বপুরুষদের অনুসরণ করছে? আল্লাহ বলেন-
যখন তাদেরকে বলা হয় যে, আল্লাহর নাযিলকৃত বিধান এবং রসূলের দিকে এস, তখন তারা বলে, আমাদের জন্যে তাই যথেষ্ট, যার উপর আমরা আমাদের বাপ-দাদাকে পেয়েছি। যদি তাদের বাপ দাদারা কোন জ্ঞান না রাখে এবং হেদায়েত প্রাপ্ত না হয় তবুও কি তারা তাই করবে? [ সুরা মায়েদা ৫:১০৪ ]
এই আয়াতে আল্লাহ স্পষ্টভাবে বলছে যে, আল্লাহর নাযিল কৃত বিধান এবং রাসুল (সাঃ) যে পথের সন্ধান তোমাদের দিচ্ছেন সেই পথেই তোমরা আসো। কিন্তু অবিশ্বাসীরা আল্লাহ এবং তাঁর রাসুলের (সাঃ) এর নির্দেশিত বিধান ও পথে না চলে তাদের বাপ দাদারা যা করে গেছে সেই পথকেই সঠিক মনে করছে। আর আল্লাহ বলছেন যদিও তোমাদের পূর্বপুরুষদের সঠিক জ্ঞান না থাকে এবং তারা আল্লাহর পক্ষ থেকে হিদায়াত প্রাপ্ত না হয়। তবুও কি তোমরা পূর্বপুরুষের অনুসরণ ছাড়বে না?
এই আয়াত অবিশ্বাসীদের উদ্দেশ্যে আল্লাহ নাযিল করেছিলেন। কিন্তু পবিত্র কুরআনের বাণী সবসময়ই শাশ্বত। যদি এই আয়াতের মানদন্ডে আমাদের বর্তমান ইসলামী সমাজকে রাখা হয়। যারা স্পষ্টত এমন কিছুকেই ইসলাম মনে করছে যা সত্যিকারে ইসলামে নেই। যা কুরআন এবং সহীহ্ হাদিসে নেই এমন কিছুকেই বর্তমানে আমাদের মুসলিম সমাজ আঁকড়ে ধরে আছে। তারা শুধুমাত্র পূর্বপুরুষেরা করেছে বলেই তা অনুসরণ করছে। তাদের যুক্তি আমাদের বড় বড় আলেমরা কি ভুল করে গেছে? তারা কি ভুল বুঝেছে?
তাদের কথা অবশ্যই চমৎকার। আলেমরা কি ভুল করেছে কি করে নাই তা পরীক্ষার জন্য এখনো পৃথিবীতে কুরআন এবং সহীহ্ হাদিস বিদ্যমান। শুধুমাত্র পূর্বপুরুষদের দোহাই দিয়ে সত্যকে মেনে না নেওয়া হচ্ছে মূর্খতা। বড় বড় আলেমগণ তাদের সময়ে যতটুকু পেরেছেন(হাদীস সংগ্রহ) ততটুকুই ধারণ করে আমল করার চেষ্টা করেছেন। বর্তমানে যদি তাঁদের সময়ের চাইতে বেশী সহীহ্ হাদীস পাওয়া যায় তাহলে তা কি ছুঁড়ে মারা যাবে?
মোটকথা বর্তমান সময়ে আমাদের সমাজে ধর্মের নামে এমন এমন বিষয় চালু হয়ে আছে, যার কুরআন হাদীসের কোনো ভিত্তি নেই। কোনো একজন বড়বুজুর্গ বলেছেন বলেই আমরা তা মেনে নিয়ে অনুসরণ করবো তা কখনোই নয়। কেননা অনুসরণ একমাত্র আল্লাহর এবং তাঁর রাসুলের (সাঃ)। তাছাড়া গত কয়েক দশক ধরে ধর্মের নামে যা চলছে, তা সুস্পষ্ট স্বার্থান্বেষী একটি চক্রান্ত। ধর্মের নামে ব্যবসা এবং ধর্মীয় অনুভূতিকে কাজে লাগিয়েই ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের ঈমান ধ্বংস করে আসছে। এই সবই চলছে পূর্বপুরুষদের দোহাই দিয়ে।
কিন্তু ইসলাম পূর্বপুরুষদের বানানো কোনো ধর্ম নয়। ইসলামের ভিত্তি হবে কুরআন এবং সহীহ্ হাদীসের সুন্নাহ দ্বারা। সুতরাং কেউ ভুল করলে তাকে তা শুধরে দিতে হবে। যদি তাদের পক্ষে কুরআন এবং সুন্নাহর সঠিক প্রমাণাদি না থাকে তবে তাদের সমস্ত কার্যক্রম অবৈধ। ইসলাম সুস্পষ্ট এবং পরিপূর্ণ একমাত্র ধর্ম। যাতে কোনো সন্দেহ নাই। সেইসাথে ইসলাম পরিপূর্ণ একটি ধর্ম যা আল্লাহ নিজেই ঘোষণা দিয়েছেন।
অতএব ইসলামে পূর্বপুরুষদের দোহাই দিয়ে নতুন নতুন কোনো ধর্মকর্ম করা হলে তা সম্পূর্ণ পরিত্যাজ্য। পূর্বপুরুষদের অনুসরণ না করার জন্য পবিত্র কুরআনে অসংখ্য আয়াত আল্লাহ নাযিল করেছেন। কেননা আল্লাহ জানেন যে যুগ যুগ ধরেই একটি শ্রেণী থাকবে যারা ধর্মের নামে পূর্বপুরুষদেরই অনুসরণ করবে। আর তাই (সঠিক প্রমাণাদি ছাড়া)পূর্বপুরুষদের অনুসরণ না করতে এতবেশী আয়াত আল্লাহ নাযিল করেছেন।
আল্লাহ সর্বদা সঠিক মাপকাটির ভিত্তিতে ধর্ম পালন করতে বলেন। ইসলামে কার আনুগত্য। এবং অনুসরণ করতে হবে তা আল্লাহই বলে দিয়েছেন। আল্লাহ বলেন -
তোমরা আল্লাহর আনুগত্য কর এবং রসূলুল্লাহর আনুগত্য কর। [ সুরা তাগাবুন ৬৪:১২ ]
অর্থাৎ একমাত্র আল্লাহ এবং রাসুলের (সাঃ) আনুগত্যের সাথে অনুসরণ করতে হবে। যদি সৎপথ দেখানোর পরও শুধুমাত্র পূর্বপুরুষদের কথা বলে সঠিক ধর্ম থেকে কেউ মুখ ফিরিয়ে নেয় তাহলে আল্লাহ স্বান্তনা দিয়ে বলেন -
হে মুমিনগণ, তোমরা নিজেদের চিন্তা কর। তোমরা যখন সৎপথে রয়েছ, তখন কেউ পথভ্রান্ত হলে তাতে তোমাদের কোন ক্ষতি নাই। তোমাদের সবাইকে আল্লাহর কাছে ফিরে যেতে হবে। তখন তিনি তোমাদেরকে বলে দেবেন, যা কিছু তোমরা করতে। [ সুরা মায়েদা ৫:১০৫ ]
সুতরাং আসুন শুধুমাত্র বাপ দাদারা করেছে বলেই কোনো কিছু করতে হবে, এই মানসিকতা পরিহার করি। যেকোনো কিছু আমল করার আগে সঠিকটা জেনে নিই। কেননা ইসলামে যা ই করতে হবে সবই সঠিক মাপকাটি এবং শক্তিশালী দলিলের ভিত্তিতে করতে হবে। আল্লাহ আমাদের হিদায়াত নসিব করুন আমিন।
আরও জানুনঃ
আবু জাহেলের ইসলাম এবং আমরা
লা ইলাহা ইল্লাল্লার ব্যাখ্যা
ইবাদতের শির্ক
(পীর সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে -
সুপারিশকারী পীর
পীরের দরবারে মানত