পীরের দরবারে মান্নত পূরণ (শেষ পর্ব)
আমাদের উপমহাদেশের পীর বা মাজারে যাওয়ার আরেকটি বড় কারণ হলো মান্নত পূরণের জন্য। আমাদের বদ্ধমূল বিশ্বাস যে পীরের কাছে বা মাজারে গিয়ে মান্নত করলেই আল্লাহ্ বোধহয় সব কবুল করে নেন। কিন্তু বাস্তবে বিষয়টি কখনোই এমন নয়। কিন্তু অনেকেই এই বিষয়টি বিশ্বাস করেন না। তাই এখন আমরা মান্নত নিয়ে কিছু জানবো।
মানত কিঃ
মানত বা মান্নত আমাদের সমাজে বহুল প্রচলিত একটি শব্দ। সাধারণত আমরা কোনো উদ্দেশ্য লাভের জন্য মান্নত করে থাকি। অনেকে আছে উদ্দেশ্য ছাড়াও মান্নত করেন।
মানত কাকে বলেঃ
আমরা বাংলাতে বলি মানত । আরবিতে বলা হয় نذر (নযর) বহুবচনে নুযুর। মানত বা নযরের আভিধানিক অর্থ হল, নিজের দায়িত্বে নেয়া। যা নিজের দায়িত্ব নয় তা অপরিহার্য করে নেয়া। শরয়ি পরিভাষায় মানত বলা হয়: নিজের উপর এমন কিছু ওয়াজিব (আবশ্যিক) করে নেয়া যা আসলে ওয়াজিব ছিল না। সেটা শর্তযুক্তও হতে পারে আবার শর্ত মুক্তও হতে পারে।
মানতের হুকুমঃ
মানত করার বিধান কি? ফরজ, ওয়াজিব, সুন্নাত না মুস্তাহাব?আসলে মানত করা ঠিক নয়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মানত করতে নিষেধ করেছেন। তিনি এ ব্যাপারে সব সময় উম্মতদের নিরুৎসাহিত করেছেন। বিষয়টি আমরা অনেকেই জানি না। বরং মনে করি মানত করা খুব সওয়াবের কাজ। আসলে এটি কোনো সওয়াবের কাজ নয়। বরং মাকরূহ। অধিকাংশ ইমাম ও ফেকাহবিদের অভিমত এটাই। কারণ, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মানত করতে নিষেধ করেছেন।
মানত করা নিষেধঃ
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মানত করতে নিষেধ করেছেন।
হাদীসে এসেছে : আব্দুল্লাহ ইবনে উমার রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেছেন: ‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একদিন আমাদের মানত করতে নিষেধ করেছেন। আর বলেছেন: মানত কোনো কিছুকে ফেরাতে পারে না। তবে মানতের মাধ্যমে কৃপণ ব্যক্তির সম্পদ বের করা হয়।‘ (সহিহ মুসলিম, হাদীস নং ৪৩২৫)
ইবনু উমার রা. থেকে বর্ণিত, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: ‘মানত কোনো কিছুকে আগেও করে না, পিছেও করে না। বরং এর দ্বারা কেবল কৃপণ ব্যক্তি থেকে বের করা হয়।‘ (সহিহ মুসলিম, হাদীস নং ৪৩২৬, সহিহ সুনান নাসায়ি)
ইবনু উমার রা. থেকে বর্ণিত, ‘নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মানত করতে নিষেধ করেছেন। আর বলেছেন: মানত কোনো কল্যাণ বয়ে আনে না। এটা শুধু কৃপণ ব্যক্তি থেকে মাল খসায়।‘ (সহিহ মুসলিম, হাদীস নং ৪৩২৭, আহমাদ)
আবু হুরাইরা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: ‘তোমরা মানত করবে না। কেননা মানত তাকদীরের কোনো কিছু-কে ফেরাতে পারে না। এটা শুধু কৃপণ থেকে সম্পদ খসায়।‘ (সহিহ বুখারি ও মুসলিম, হাদীস নং ৪৩২৯, সহিহ সুনান তিরমিজি, সহিহ সুনান নাসায়ি)
সাহবি আবু হুরাইরা রা. থেকে বর্ণিত, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: ‘যেই বস্তু মহান আল্লাহ আদম সন্তানের জন্য নির্ধারণ করেননি মানত সেটি তার নিকটবর্তী করে না। বরং তাকদীরে যা আছে মানত সেটাই নিয়ে আসে। এর মাধ্যমে কৃপণ ব্যক্তির সম্পদ বের করা হয় যা সে খরচ করতে চায়নি।‘ (সহিহ মুসলিম, হাদীস নং ৪৩৩১)
উদ্ধৃত হাদীসগুলো থেকে আমরা জানতে পারলামঃ
এক. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মানত করতে নিষেধ করেছেন। অতএব মানত করা ঠিক নয়। আমরা অনেকে বিপদ-আপদে পতিত হলে মানত করে থাকি। আর মনে করি এটা সওয়াবের কাজ। আল্লাহ খুশী হবেন। কিন্তু আসলে তা সওয়াবের কাজ নয়। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যা করতে নিষেধ করেছেন তাতে আল্লাহ খুশী হবেন না। এবং এতে কোনো সওয়াবও হয় না। তাই আমাদের উচিত হবে কোনো অবস্থায় মানত না করা। অবশ্য মানত করে ফেললে তা পালন করতেই হবে কারণ মানত করলে তা পূর্ণ করা ওয়াজিব হয়ে যায়।
দুই. মানত করার মাধ্যমে কৃপণ ব্যক্তির সম্পদ বের করা হয়। এ কথা বলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বুঝিয়েছেন, মানত করা একটি অনর্থক কাজ। সাধারণত কৃপণ স্বভাবের লোকেরা মানত করে থাকে। তারা সুস্থ ও নিরাপদ থাকা কালে দান-সদকা করে না। কিন্তু বিপদে পড়লে আল্লাহর পথে খরচ বা দান সদকা করার বড় বড় মানত করে।
তিন. তাকদীরে যা লেখা আছে তা হবেই। মানত করার মাধ্যমে তাকদীরের লেখা পরিবর্তন করা যায় না। তাকদীরের প্রতি যাদের যথাযথ ঈমান নেই সাধারণত তারাই মানত করে থাকে।
চার. মানত করা হোক বা না হোক। ফলাফল একই হবে। তাকদীরে যা লেখা আছে সেটাই আসবে অবধারিতভাবে।
পাঁচ. আলোচিত সবগুলো হাদীসই মানত না করার জন্য মুসলিমদের-কে নিরোৎসাহিত ও নিষেধ করেছে। বলেছে, এটি কোনো ফল বয়ে আনে না বরং শুধু কৃপণের সম্পদ খরচ করায়। এ সকল বিষয় জানার পর কোনো মুসলিমের পক্ষে কোনো প্রকার মানত করা উচিত নয় ।
উপরোক্ত হাদিস থেকে আমরা বুঝতে পারলাম মানত করা ইসলামে মোটেই জায়েজ নয়। অতএব আমরা পীর বা মাজারে গিয়ে যে মান্নত করছি সেগুলো করা উচিত নয়। মান্নতের মাধ্যমে আমরা স্পষ্ট শিরিকে লিপ্ত হচ্ছি। কেননা প্রতিটি ভালো মন্দের মালিক আল্লাহ্। এখন পীর বা মাজারে গিয়ে আল্লাহর বিধানকেই পাল্টাতে আমরা সচেষ্ট হচ্ছি। আল্লাহ্ আমাদের বলেন ধৈর্য্য ধরার জন্য কিন্তু আমরা আল্লাহর উপর ধৈর্য্যহারা হয়ে পীর বা মাজারে চলে যাই মান্নত করতে। অথচ আল্লাহ্ আমাদের ভালো চান।
আল্লাহ্ বলেন আল্লাহর রাস্তায় খরচ করার জন্য। আর আমরা প্রতিনিয়ত মান্নত বা টাকা পয়সা খরচ করি পীরের দরবারে বা মাজারে দান করে। এই পীর বা মাজারে দান করা পয়সা কখনোই গরীবের উপকারে আসে না এটাই সত্য। যদি কেউ কোন এতিমখানা বা মাদ্রাসায় দান করেন তাহলেই হচ্ছে ভালো কাজ। আর আল্লাহ্ সবার আগে খরচ করতে বলেছেন নিজের পিতামাতা এবং নিকট আত্মীয়স্বজনের জন্য। কিন্তু আমাদের দেশে অধিকাংশ মানুষ নিজের আত্মীয়স্বজনকে বাদ দিয়ে পীর বা মাজারে দান সদকা করতে ব্যস্ত। যা সম্পূর্ণ ইসলাম বিরোধী।
অতএব খুব স্পষ্ট করেই দেখা যাচ্ছে যে যেসব বিষয় দিয়ে পীর মাজার জায়েজ করা হচ্ছে তার প্রতিটি পর্যায়ে রয়েছে ইসলামের বাঁধা।
অতএব এইসব বিষয় যদি ভালোভাবে বিবেচনা করি তাহলে আমরা সত্য উপলব্ধি করতে সক্ষম হবো। আমি বিভিন্ন বিষয়ের খুটিনাটি বিশ্লেষন করে "পীর " ধরা কতটুকু বৈধ এবং অবৈধ তা তুলে ধরতে চেষ্টা করেছি। এখন আপনারা নিজেরাই প্রতিটি বিষয় খুব ভালোভাবে পরীক্ষা করুন। দেখুন কোন কোন জায়গায় আমার ভুল। আমি কোন বিষয়টি ভুল উপস্থাপন করেছি। যদি আমার জানার বা বুঝার ভুল হয়ে থাকে তবে অবশ্যই আমাকে জানান। কেননা এটা আমার সম্পূর্ণ নিজস্ব একটি গবেষণা। আল্লাহ্ আমাকে যে জ্ঞান দান করেছেন সেই জ্ঞানের ভিত্তিতে এই লেখা লিখা চেষ্টা করেছি। ভুল ত্রুটি সংশোধন যোগ্য।
মানত বিষয়ক লেখাগুলো সংগৃহীত।
বাকি পর্ব গুলো এখানেঃ
পীর (উপমহাদেশে পীরের বাস্তবতা)
দলিল ছাড়া পীরতন্ত্রের ভিত্তি ১
দলিল ছাড়া পীরতন্ত্রের ভিত্তি ২
দলিল ছাড়া পীরতন্ত্রের ভিত্তি ৩
কুরআনের আয়াত দ্বারা পীরের দলিল খন্ডন ১
কুরআনের আয়াত দ্বারা পীরের দলিল খন্ডন ২
কুরআনের আয়াত দ্বারা পীরের দলিল খন্ডন ৩
কুরআনের আয়াত দ্বারা পীরের দলিল খন্ডন ৪
কুরআনের আয়াত দ্বারা পীরের দলিল খন্ডন ৫
বাইয়াত দ্বারা পীরের দলিল
সুপারিশকারী পীর
পীরের দরবারে মানত