কুরআনের আয়াতে পীরের দলিল খন্ডন - ৩ (পর্ব -৭)
১০) "যারা তোমাদের ধর্মমতে চলবে, তাদের ছাড়া আর কাউকে বিশ্বাস করবে না। বলে দিন নিঃসন্দেহে হেদায়েত সেটাই, যে হেদায়েত আল্লাহ করেন। আর এসব কিছু এ জন্যে যে, তোমরা যা লাভ করেছিলে তা অন্য কেউ কেন প্রাপ্ত হবে, কিংবা তোমাদের পালনকর্তার সামনে তোমাদের উপর তারা কেন প্রবল হয়ে যাবে! বলে দিন, মর্যাদা আল্লাহরই হাতে; তিনি যাকে ইচ্ছা দান করেন এবং আল্লাহ প্রাচুর্যময় ও সর্বজ্ঞ।" [ সুরা ইমরান ৩:৭৩ ]
"তিনি যাকে ইচ্ছা নিজের বিশেষ অনুগ্রহ দান করেন। আর আল্লাহ মহা অনুগ্রহশীল।" [ সুরা ইমরান ৩:৭৪ ]
সূরা আলে ইমরানের এই দুটি আয়াত ইহুদীদের হিংসা এবং মুসলমানদের নিয়ে তাদের নিকৃষ্ট পরিকল্পনার কথা ব্যক্ত করা হয়েছে (বিস্তারিত রয়েছে তাফসীরে ইবনে কাছীর)। আয়াতের শেষে আল্লাহ্ বলেন তিনি যাকে ইচ্ছে তাকে বিশেষ অনুগ্রহ দান করেন। এই দান অনুগ্রহ বা স্বীয় করুণা বলতে আল্লাহ্ প্রতি ঈমান আনার তৌফিককে বুঝানো হয়েছে। কেননা এই দুনিয়ায় আল্লাহর প্রতি ঈমান আনতে পারাটাই (বিধর্মীদের জন্য) হচ্ছে তাদের প্রতি আল্লাহর সবচাইতে বেশি করুণা করা। এটা তাদের প্রতি বলা হচ্ছে যাদের আল্লাহ্ অনুগ্রহ করেছেন ঈমান আনতে।এই যাকে দ্বারা কেউ কেউ পীরের দলিল দিয়ে থাকেন।
আরও পড়ুন মাজারে দান সদকা করার ইসলামী বিধান
যদি "যাকে "দ্বারা পীর বুঝানো হয় তবে আল্লাহ যে কোটি কোটি মানুষকে ঈমান আনার তৌফিক দিয়ে অনুগ্রহ করেছেন তাঁরা কোথায় যাবে? আল্লাহর দুনিয়ায় কি আর ঈমানদার নেই? অবশ্যই আছে। যদি থাকে তবে কি তারা পীর নামধারণ করে আছেন? উত্তর হবে অবশ্যই না। তাহলে কি আল্লাহ্ শুধুমাত্র উপমহাদেশের কয়েক হাজার পীরদের নিয়েই কি এই আয়াত নাযিল করেছেন?
পবিত্র কুরআনে শত শত জায়গায় ঈমানদার, মুমিন, মুত্তাকী, শহীদ, ছিদ্দিকন এবং সৎকর্মশীলের উল্লেখ করে আয়াত নাযিল হয়েছে। এইসব আয়াতের গুণাবলী যেকোনো ঈমানদার মুসলিমই হতে পারেন। শুধুমাত্র একটি শ্রেণীর জন্য খাস নয় (যেসব আয়াত সরাসরি সাহাবীদের নির্দেশ করেছেন সেসব ব্যতীত)। কিন্তু উপমহাদেশে এই আয়াতের অপব্যাখ্যা দিয়ে সাধারণ মানুষকে গোমরাহ করে ঈমান ধ্বংস করছে। এই আল্লাহর অনুগ্রহ তাঁরাও দাবি করতে পারেন যারা সত্যিকারের পীরের কাজ তথা ইসলামের জ্ঞান বিতরণ, প্রশিক্ষক, জ্ঞানী, উস্তাদ হিসাবে ইসলামের সেবা করছেন। কিন্তু এটা দিনের আলোর মতো পরিষ্কার এইসব কোনো কিছুই কোনো পীরের দরবার এবং মাজারে পাওয়া যায় না। অতএব এই দ্বারাও পীরের দলিল দেওয়া যাবে না।
আরও পড়ুন কবর পাকা করার দলিল খন্ডন
১১) "পৃথিবীকে কুসংস্কারমুক্ত ও ঠিক করার পর তাতে অনর্থ সৃষ্টি করো না। তাঁকে আহবান কর ভয় ও আশা সহকারে। নিশ্চয় আল্লাহর করুণা সৎকর্মশীলদের নিকটবর্তী।" [ সুরা আরাফ ৭:৫৬ ]
এই আয়াতের "সৎকর্মশীল " বলতে পীর বুঝানো হয়েছে! এটা কি কেউ মেনে নিবে? আল্লাহ্ কত সুন্দর করে বলেছেন, আল্লাহ্ কে ডাকো ভয় এবং আশা সহকারে। অর্থাৎ আল্লাহর ইবাদত করতে বা তাঁর রাস্তায় চলতে হবে ভয় অর্থাৎ জাহান্নাম আশা অর্থাৎ জান্নাত মিলবে এই ভেবে। যদি কেউ আল্লাহর রাস্তায় না চলে তবে তার জন্য জাহান্নাম নিশ্চিত। আর যে আল্লাহর রাস্তায় চলে তবে তার জন্য আল্লাহর জান্নাত আশা করা যায়। অতএব যাঁরাই আল্লাহর ইবাদত আইন কানুন, আদেশ নিষেধ পরিপূর্ণ ভাবে মেনে চলবে তাঁরই সৎকর্মশীল। আর এই সৎকর্মশীলদের নিকটেই আল্লাহর অনুগ্রহ, দয়া, সাহায্য ইত্যাদি তথা আল্লাহ্ ই তাঁদের কাছে রয়েছেন।
সুতরাং যারাই চেষ্টা করবেন (সৎকর্ম করে) তারাই আল্লাহর কাছে প্রিয়পাত্র হতে পারবেন। এই আয়াত দ্বারা কীভাবে পীর ধরতে হবে বা এই সৎকর্মশীল ব্যক্তিই হচ্ছেন পীর এবং এটা শুধুমাত্র পীরদের জন্য বরাদ্দ তা কীভাবে সম্ভব? কেননা এই পৃথিবীতে আল্লাহর রাস্তায় চলেন এমন হাজার হাজার মুমিন বান্দা রয়েছেন। যারা সত্যিকারের ইসলাম ধরে রেখে আল্লাহর পথে সৎকর্ম করে যাচ্ছেন। কিন্তু তাঁরা তো পীর নয়।
যদি ধরেও নিই এটা দ্বারা পীর বুঝানো হয়েছে, তারা আল্লাহর রাস্তায় চলে বিধায়! তারা আল্লাহর নিকটবর্তী। তাহলে প্রতিটি পীরের দরবারে মাজারে যে লক্ষ কোটি মুরিদ রয়েছে তারা কি সৎকর্মশীল নয়? আর তারা সৎকর্মশীল না হলে এইসব পীরেরা তাদের কী শিক্ষা দিচ্ছেন? যদি বলেন পীরেরা মুরিদদের সৎ শিক্ষা দিয়ে সৎকর্মশীল তৈরি করছেন তাহলে, এইসব মুরিদই তো পীর হয়ে গেলো এই আয়াত দ্বারা। খুব সহজ বিষয় চেষ্টা করলেই বুঝতে পারবেন।
আর বাস্তবতা হলো বর্তমানে কোনো পীরই ইসলামের সঠিক শিক্ষায় নেই। যেহেতু ইসলামেই নেই সেহেতু তারা সৎকর্মশীল হতে পারে না সৎ কর্মী তৈরি করা তো দূরের কথা। এইসব বিষয়ে বিস্তারিত জানতে হলে অবশ্যই কিছু পড়াশোনা অর্থাৎ বিভিন্ন তাফসীর পড়তে হবে। যাতে করে এইসব আয়াতের সঠিক ব্যাখ্যা জানতে পারেন। যদি সত্যিকারের ইসলাম পালন করতে চান তবে সঠিক ইসলাম সম্পর্কে জানতে হবে। আর জানতে অবশ্যই পড়তে হবে।
আরও পড়ুন সুফি সুন্নিদের পীর আউলিয়া সম্পর্কিত আকিদার জবাব
১২)" তুমি সূর্যকে দেখবে, যখন উদিত হয়, তাদের গুহা থেকে পাশ কেটে ডান দিকে চলে যায় এবং যখন অস্ত যায়, তাদের থেকে পাশ কেটে বামদিকে চলে যায়, অথচ তারা গুহার প্রশস্ত চত্বরে অবস্থিত। এটা আল্লাহর নিদর্শনাবলীর অন্যতম। আল্লাহ যাকে সৎপথে চালান, সেই সৎপথ প্রাপ্ত এবং তিনি যাকে পথভ্রষ্ট করেন, আপনি কখনও তার জন্যে পথপ্রদর্শনকারী ও সাহায্যকারী পাবেন না।" [ সুরা কা’হফ ১৮:১৭ ]
এই সূরা গুহাবাসীদের নিয়ে নাযিল হয়। যাঁরা তাদের অত্যাচারী বাদশাহর ভয়ে ঈমান রক্ষার জন্য গুহায় আশ্রয় নেয়। আল্লাহ্ তাদের তাঁর নিজ দায়িত্বে সৎপথ প্রদর্শন করিয়েছিলেন। তাঁরা গুহার মধ্যে ঘুমিয়ে কাটিয়েছেন কয়েকশত বছর। এখানে সেই কাহিনীর কথাই বলতে গিয়ে আল্লাহ্ বলেন তিনি তাঁদের সৎ পথ দেখিয়েছিলেন বলেই তাঁরা সৎ পথ প্রাপ্ত হয়েছিলেন। অর্থাৎ আল্লাহ্ যাকে সৎ পথে তথা হিদায়াতের পথে পরিচালিত করেন শুধুমাত্র তাঁরাই হিদায়াত প্রাপ্ত তথা সৎপথ প্রাপ্ত হতে পারেন। এবং যাকে তিনি হিদায়াত তথা সৎপথ দেখান না বা যাদের তিনি পথভ্রষ্ট করেন, তাদের জন্য কোনো পথ প্রদর্শনকারী এবং সাহায্যকারী নেই।
আয়াতের শেষ অংশে এবং এইরকম আরো শতশত আয়াতে এসেছে যে - আল্লাহ্ ই মানুষকে হিদায়াত দেন এবং পথভ্রষ্ট করেন। সুতরাং কেউ সৎপথ প্রাপ্ত হওয়ার সম্পূর্ণ আল্লাহ্ ইখতিয়ার। কেউ চাইলেই কাউকে হিদায়াত দিতে পারেন না। এই আয়াতের দ্বারা কীভাবে পীর ধরার বা মানার কথা আছে আমার বুঝে আসে না (হয়তো জ্ঞানের স্বল্পতা)।
সুতরাং যারা আল্লাহর নিয়ামত প্রাপ্ত হয়ে সৎপথে থাকবেন তারাই সফলকাম। আল্লাহর এই নেয়ামত প্রাপ্তি শুধুমাত্র যদি পীরদের জন্য ই বরাদ্দ হতো তবে তা আরব বিশ্বে না দিয়ে সব নেয়ামত উপমহাদেশে বরাদ্দ দিয়েছেন! এটা কি পাগলও বিশ্বাস করবে? আর যারা এই নেয়ামত প্রাপ্ত বান্দা তথা পীরদের সাথে থাকবেন তারা কি নেয়ামত প্রাপ্ত হবেন না। যদি তারাও নেয়ামত প্রাপ্ত হন তবে তারাও তো পীর দাবি করতে পারেন।
আরও পড়ুন বর্তমান সমাজের মুনাফিকের পরিচয় ও পরিনতি
আসলে যুগ যুগ ধরে উপমহাদেশে কুরআনের অপব্যাখ্যাই করা হচ্ছে। এই আয়াত সবার জনই উন্মুক্ত। শুধু এই আয়াত নয়। কুরআনের যেসকল সকল আয়াতে ঈমানদারদের বিভিন্ন গুণাবলি এবং আল্লাহ্ কতৃক সাহায্য প্রাপ্ত হওয়ার ভবিষ্যৎ আভাস রয়েছে তা সর্বকালের সকলের জন্য প্রযোজ্য। শুধুমাত্র কোনো প্রাতিষ্ঠানিক পদের(পীর) জন্য নয়। আল্লাহ্ আমাদের সঠিকভাবে কুরআন বুঝার তৌফিক দান করুন আমিন।
বাকি পর্ব গুলো এখানেঃ
পীর (উপমহাদেশে পীরের বাস্তবতা)
দলিল ছাড়া পীরতন্ত্রের ভিত্তি ১
দলিল ছাড়া পীরতন্ত্রের ভিত্তি ২
দলিল ছাড়া পীরতন্ত্রের ভিত্তি ৩
কুরআনের আয়াত দ্বারা পীরের দলিল খন্ডন ১
কুরআনের আয়াত দ্বারা পীরের দলিল খন্ডন ২
কুরআনের আয়াত দ্বারা পীরের দলিল খন্ডন ৩
কুরআনের আয়াত দ্বারা পীরের দলিল খন্ডন ৪
কুরআনের আয়াত দ্বারা পীরের দলিল খন্ডন ৫