বাইয়াত দ্বারা পীরের দলিল খন্ডন(১০)
পবিত্র কুরআন শরীফে বাইয়াতের কথা আছে। রাসুলুল্লাহ (সাঃ) তাঁর সাহাবীদের কাছ থেকে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন বিষয়ের উপর বাইয়াত করিয়েছেন তার প্রমাণ হাদীসে আছে। এখন আমরা দেখবো রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এর বাইয়াত আর বর্তমান উপমহাদেশের পীরদের বাইয়াত কি এক নাকি ভিন্ন।
বাইয়াতঃ
বাইয়াত শব্দের অর্থ হলো - ক্ষমতা প্রদান, প্রতিজ্ঞা গ্রহণ, আনুগত্যের শপথ, ওয়াদাবদ্ধ হওয়া, ক্রয় বিক্রয় করা ইত্যাদি। বাইয়াত হওয়ার অর্থ হলো নিজেদের সব কিছুর বিনিময়ে বিক্রিত হওয়া। আরবিতে বাইয়াত অর্থ বিক্রয় হিসাবে এসেছে। যা চুক্তি, অঙ্গীকার বা শপথ হিসাবে বলা হয়।
বিক্রয় করা মালের উপর যেমন নিজের অধিকার থাকে না। ঠিক তেমনি কারো নিকট বাইয়াত হলেও তার আর নিজস্ব অধিকার থাকে না। কোনো বিধর্মী যখন ইসলাম কবুল করে তখন তাকে সব ত্যাগ দিয়ে শুধুমাত্র ইসলামকেই মেনে নিতে হবে। অতএব বাইয়াত হলো কারো কাছে বিভিন্ন বিষয়ের উপর অঙ্গীকার বা শপথ করা।
রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এর বাইয়াতঃ
হুজুর পাক (সাঃ) বিভিন্ন সময় তাঁর সাহাবীদের কাছ থেকে বাইয়াত নিয়েছিলেন। বেশ কিছু বাইয়াতের কথা পবিত্র কুরআনে এসেছে।
বাইয়াতের মাধ্যমে রাসুল (সাঃ) বিভিন্ন বিষয়ের উপর সাহাবীদের থেকে অঙ্গীকার বা শপথ নিয়েছিলেন। আমরা যদি কুরআন এবং হাদীস পর্যালোচনা করি তবে সেখান থেকে বাইয়াতের দুটি দিক দেখতে পাই।
১ ) রাষ্ট্রীয় বাইয়াত
২) ধর্মীয় বাইয়াত
রাষ্ট্রীয় বাইয়াতঃ
ইসলামী রাষ্ট্রের আমীর, খলিফা বা রাষ্ট্র প্রধানের অধীনে যে বাইয়াত নেওয়া তা হচ্ছে রাষ্ট্রীয় বাইয়াত। এইসব বাইয়াত ইসলামের রাষ্ট্রীয় আনুগত্য, রাষ্ট্রপ্রধানের আনুগত্য এবং সর্বোপরি জিহাদের জন্য আনুগত্যের বাইয়াতকে রাষ্ট্রীয় বাইয়াত বলা হয়।
এইসব বাইয়াত রাসুল (সাঃ) এবং তাঁর পরবর্তীতে খলিফায়ে রাশেদীন নিয়েছিলেন। রাষ্ট্রীয় বাইয়াতের মূল উদ্দেশ্য হলো ইসলাম প্রতিষ্ঠা করার নিমিত্তে যাবতীয় আনুগত্য করা। আমরা কুরআনের আয়ত এবং বিভিন্ন হাদীস দ্বারা রাষ্ট্রীয় বাইয়াতের বিভিন্ন ঘটনা দেখতে পাই।
ধর্মীয় বাইয়াতঃ
ধর্মীয় বাইয়াত মূলত ঈমান আনা এবং সেই অনুযায়ী জীবন পরিচালিত করার জন্য বাইয়াত হওয়া। রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বিভিন্ন সময় তাঁর সাহাবীদের থেকে ইসলামের উপর অটল থাকা এবং সেই অনুযায়ী আমল করার জন্য বাইয়াত নিয়েছেন। যদিও বাইয়াত মূলত ইসলামী আমীরের পক্ষে হয়ে থাকে। কিন্তু যখন ইসলামী শাসনের পতন হয় তখন বিভিন্ন বুজুর্গ ব্যক্তিবর্গ সাধারণ মানুষদের ইসলামের দিকে ধাবিত করার জন্য বাইয়াত ব্যবস্থা চালু করেন। যা বর্তমানে বিভিন্ন পীরের দরবারে চালু আছে।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাধারনত নিম্মে বর্ণিত বাইয়াত সমূহ সাহাবিদের করিয়েছেন।
১। ইসলাম গ্রহনের বাইয়াত। (ঈমান আনার জন্য বাইয়াত)
২। শির্কি কাজ (অর্থাৎ আল্লাহর সাথে অন্যান্য কারো ইবাদত করা) ত্যাগ করার বাইয়াত।
৩। সালাত আদায়, যাকাত প্রদান করার বাইয়াত।
৪। মুসলমানকে নসীহত করার বাইয়াত। (সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ)
৫। জিহাদের বাইয়াত।
৬। রাষ্ট্রনেতার বিরুদ্ধে যুদ্ধ না করার বাইয়াত। (যতক্ষণ না প্রকাশ্য কুফরী লিপ্ত হয়)
৭। সর্বদা সত্য কথা বলার বাইয়াত গ্রহণ করা।
৮। শর্তহীনভাবে আল্লাহ ও তার রাসূল (সাঃ) এর আনুগত্যের বাইয়াত।
৯। খারাপ কাজ না করার বাইয়াত। (চুরি, ব্যভিচার, সন্তানদেরকে হত্যা, কোনোরূপ অন্যের সম্পদ আত্মসাৎ না করা, কারও প্রতি মিথ্যা অপবাদ বা দোষারোপ করব না করা।)
১০। আমীরের আনুগত্যের বাইয়াত।
১১। ইসলামী রাষ্ট্রের রাষ্ট্র প্রধানের আনুগত্যের বাইয়াত।
১৩। কাফেরদের নির্যাতনে বিপরীতে নারী ও শিশুর ন্যয় নবী করিম কে হেফাজাত করার বাইয়াত।
১৪। পক্ষ্যান্তরে ইসলামের বিজয় আসলে নিজ সম্প্রদায়ের কাছে ফিরে না আসার নবী কতৃক ওয়াদা
উপরোক্ত বিষয় সমূহ নিয়েই রাসুলুল্লাহ (সাঃ) তাঁর সাহাবীদের থেকে বাইয়াত নিয়েছেন। রাসুল (সাঃ) পরবর্তীতে যারা ইসলামের খিলাফতে অধিষ্ঠিত ছিলো তারাও এইসবের উপর ভিত্তি করে বাইয়াত নিয়েছেন। ইসলামী খিলাফতের পরবর্তীতেও বর্তমানে আরব বিশ্বে যেখানে রাজতন্ত্র আছে সেখানেও তারা সাধারণ জনগণ থেকে বাইয়াত নেয়।
মোট কথা বাইয়াত নেওয়া এখনো চলছে এবং এটা চলা উচিত। বিশেষ করে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করার জন্য। প্রতিটি মুসলমানের উচিত কারো কাছে বাইয়াত হয়ে ইসলামের জন্য কাজ করা। পবিত্র কুরআনে বাইয়াতের যে আয়াত নাযিল হয় তা মূলত জিহাদ তথা ইসলাম প্রতিষ্ঠা করার জন্য। সুতরাং আজও আমাদের বাইয়াত হতে হবে মূলত ইসলামকে সমুন্নত করার জন্য। যেখানে ইসলাম প্রতিষ্ঠিত সেখানে ইসলাম মানা এবং আমল করা সহজ।
উপমহাদেশের বাইয়াতঃ
এখন আমরা দেখবো উপমহাদেশের পীরেরা যে বাইয়াত নিচ্ছেন তা কীসের ভিত্তিতে। আমরা যদি বিভিন্ন দরবারের দিকে তাকাই তবে দেখতে পাবো যে শুধুমাত্র পীরের আনুগত্যের জন্য বাইয়াত নেওয়া হয়। অথচ রাসুল (সাঃ) যেসব বিষয় নিয়ে বাইয়াত নিয়েছেন তার কোনো কিছুই এইসব দরবারে পালন এবং দেখা যায় না।
রাসুলুল্লাহ (সাঃ) ধর্মীয় বাইয়াত নিয়েছেন শির্ক না করার জন্য। অথচ হাতে গোনা কয়েকটি দরবার বাদে সবখানেই শির্কের আখড়া তৈরি হয়েছে। ইসলামের বাইয়াতের মূল উদ্দেশ্য হলো ইসলাম প্রতিষ্ঠা করা। যা কোনো দরবার থেকে করা তো দূরের কথা বলাই হয় না (একটি দরবার ব্যতীত) । শুধু তাইনয় ইসলাম বিরোধী শক্তির সাথে একাত্ম হয়ে এইসব দরবার একাকার হয়ে গেছে। তাহলে পীরেরা যে বাইয়াত নিচ্ছেন তা কি ইসলাম সম্মত হচ্ছে?
একটু খেয়াল করলেই বুঝতে পারবেন রাসুল (সাঃ) যেসব বিষয়ের উপর বাইয়াত নিয়েছিলেন তার বেশিরভাগই আজ দরবারে অনুপস্থিত। সুতরাং বাইয়াত দিয়ে যে পীর জায়েজ তা কখনোই হতে পারে না। যেখানে একটি সহীহ্ হাদিসে এসেছে ইসলামে বাইয়াত নেওয়ার ক্ষমতা সর্বসম্মতিক্রমে একজনের। সেখানে দুজন দাবি করলে পরের জনকে হত্যা করতে বলা হয়েছে। এই বাইয়াত নিয়ে মতবিরোধের কারণে কারবালার ময়দানে হযরত হুসাইন (রাঃ) কে শহীদ করা হয়েছিল।
কেননা বেশিরভাগ পক্ষ ইয়াযীদকে সমর্থন করে বাইয়াত হয়েছিল। ইরাকের কুফার এলাকার জনগণ হযরত হুসাইন (রাঃ) এর কাছে বাইয়াত হতে চেয়েছিল। পরবর্তীতে ইয়াযীদ সৈন্য কতৃক হযরত হুসাইন (রাঃ) কে শহীদ করা হয়। যদিও হযরত হুসাইন (রাঃ) খিলাফতের দাবি ছেড়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু কুচক্রীরা তাঁকে ছেড়ে দেয়নি। তাহলে বুঝা যাচ্ছে খিলাফত এবং বাইয়াত খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ইসলামে। যার জন্য রাসুল (সাঃ) প্রাণপ্রিয় নাতিকে পর্যন্ত শহীদ হতে হলো। সুতরাং যেকোনো বিষয় আমাদের ইতিহাস এবং ইসলাম সম্মত কিনা যাচাই করে দেখা উচিত।
বাকি পর্ব গুলো এখানেঃ
পীর (উপমহাদেশে পীরের বাস্তবতা)
দলিল ছাড়া পীরতন্ত্রের ভিত্তি ১
দলিল ছাড়া পীরতন্ত্রের ভিত্তি ২
দলিল ছাড়া পীরতন্ত্রের ভিত্তি ৩
কুরআনের আয়াত দ্বারা পীরের দলিল খন্ডন ১
কুরআনের আয়াত দ্বারা পীরের দলিল খন্ডন ২
কুরআনের আয়াত দ্বারা পীরের দলিল খন্ডন ৩
কুরআনের আয়াত দ্বারা পীরের দলিল খন্ডন ৪
কুরআনের আয়াত দ্বারা পীরের দলিল খন্ডন ৫
বাইয়াত দ্বারা পীরের দলিল
সুপারিশকারী পীর
পীরের দরবারে মানত