কুরআনের আয়াতে পীরের দলিল খন্ডন- ২ (পর্ব -৬)
৭) "আপনার পূর্বে আমি মানুষই প্রেরণ করেছি, যাদের কাছে আমি ওহী পাঠাতাম। অতএব তোমরা যদি না জান তবে যারা স্মরণ রাখে (জ্ঞানীদের, কিতাব অলা ইহুদি নাসারাদের) তাদের জিজ্ঞেস কর।" [ সুরা আম্বিয়া ২১:৭ ]
এই আয়াত তাদের ব্যাপারে নাযিল হয়েছিল যারা রাসুল (সাঃ) এর মানুষ হওয়াকে বিশ্বাস করতো না। এর আগের পরের আয়াত গুলো দিয়ে আল্লাহ সেই কথাই অবিশ্বাসী কাফেরদের যুক্তি দিচ্ছিলেন। এখানে জ্ঞানী বা স্বরণ রাখাকারী বা কিতাব অলা দ্বারা আগের অর্থাৎ ইহুদি এবং খ্রিস্টানদের বুঝানো হয়েছে। কেননা আল্লাহ্ আগেও নবী রাসুল (আঃ) পাঠিয়েছিলেন। এবং তাঁরা ছিলেন মানুষ। অবিশ্বাসী কাফিররা রাসুল (সাঃ) এর মানুষ হওয়া মেনে নিচ্ছিলো না। তাই তাদেরকে বলা হচ্ছে আগে যাদের কাছে অর্থাৎ ইহুদি এবং খ্রিস্টানদের নবী (আঃ) এসেছিলেন তাঁরা কী ছিলেন তা এইসব কিতাবী জ্ঞানীদের জিজ্ঞাসা করো। কেননা আল্লাহ্ তাদের কাছে যে রাসুল (আঃ) পাঠিয়েছিলেন তাঁরা ছিলেন মানুষ। এবং তা ইহুদি খ্রিস্টানরা জানে। তাই তাদের কাছে জিজ্ঞাসা করলে সঠিক উত্তর পাওয়া যাবে এবং তোমাদের (অবিশ্বাসীদের) ভুল ভাঙবে।
এখানে স্পষ্ট যে জ্ঞানী বলতে কাদের বুঝানো হয়েছে। তবুও যারা জ্ঞানী দ্বারা পীরদের বুঝিয়েছেন বলে যুক্তি দেখান। তাদের যুক্তি যদি মেনে নিই তবে আমরা বাস্তবে কী দেখছি? আজ উপমহাদেশের পীরের দরবার গুলোর দিকে তাকান। এইসব দরবারে যারা বংশপারম্পরিক পীর হয়ে বসে আছেন তারা কতটুকু ইসলামের সঠিক জ্ঞানের জ্ঞানী?
এরা কোথায় কার কাছ থেকে ইসলামের জ্ঞান অর্জন করেছেন? এরা কুরআন কতটুকু জানেন? এরা হাদীস শিক্ষা করেছেন কার কার সিলসিলা দিয়ে? এরা কুরআনের তাফসীর কতটুকু জানেন? সহীহ্ হাদীস কতটুকু জানেন? ফিকাহ সম্পর্কে কতটুকু জ্ঞান রাখেন? প্রচলিত ইসলামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে কতটুকুই শিক্ষা অর্জন করেছেন? ইসলামের কল্যাণে কয়টি গবেষনামূলক কিতাব রচনা করছেন?
এইসব প্রশ্নের উত্তর খুবই নগন্য সংখ্যক পীর ছাড়া বাকি সবারই কোনো শক্তিশালী ইসলামী শিক্ষা নেই। যেসব পীরদের মাদ্রাসা আছে তাদের কিছু জ্ঞান থাকলেও বাকিরা সেই বংশপারম্পরিক জ্ঞান দিয়েই পীর মুরিদী ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন। যারা বলেন এরাই (পীরেরা) জ্ঞানী যেসব পীরেরা কতটুকু আর জ্ঞান চর্চা করছেন? তারা তো মুরিদ বাড়াতেই ব্যস্ত। মুরিদদের সঠিক জ্ঞান দানে নয়। বরং তাদের(মুরিদদের) দানের দিকেই তাদের (পীরদের) দৃষ্টি। এখন এমন কোনো দরবার নেই যেখানে সঠিক ইসলামী জ্ঞান চর্চার মাধ্যমে মুরিদদের জ্ঞান দেওয়া হয়।
কুরআনের আয়াতের সঠিক ব্যাখ্যা থেকে এটা খুবই স্পষ্ট এখানে জ্ঞানী দ্বারা মোটেই পীরদের বুঝানো হয়নি। জোর করে কেউ চাইলেই কুরআনের অপব্যাখ্যা দিতে পারে না। যদি এটা করা হয় তবে তারা অবশ্যই আল্লাহ্ বিরোধী কাজ করার দ্বারা ইসলাম থেকে খারিজ হয়ে যাবেন।
৮)" আর যে কেউ আল্লাহর হুকুম এবং তাঁর রসূলের হুকুম মান্য করবে, তাহলে যাঁদের প্রতি আল্লাহ নেয়ামত দান করেছেন, সে তাঁদের সঙ্গী হবে। তাঁরা হলেন নবী, ছিদ্দীক, শহীদ ও সৎকর্মশীল ব্যক্তিবর্গ। আর তাদের সান্নিধ্যই হল উত্তম। [ সুরা নিসা ৪:৬৯ ]
এই আয়াত দ্বারা পীরদের শক্তিশালী দলিল দেওয়া হয়। তবে তারা শুরুর কথা গুলো বলে না। এখানে শুরুতে বলা হয়েছে - যারা আল্লাহ্ এবং রাসুলের (সাঃ) এর হুকুম পালন করবে। অর্থাৎ যারা তাদের জীবন ইসলামী পথে তথা সঠিক কুরআন সুন্নাহর আলোকে গঠন করবে তাঁরাই কিয়ামতে নবী, শহীদ, ছিদ্দিক এবং সৎকর্মশীলের সান্নিধ্য পাবে। এখানে বিষয়টি খুবই স্পষ্ট। কোনপ্রকার লুকোচুরি নেই। যে বা যাঁরা সঠিক ইসলামের আইন আদর্শ মেনে এই দুনিয়ার জীবন অতিবাহিত করবে তাঁরাই কিয়ামতের দিন তাঁদের মর্যাদা অনুযায়ী নবী, শহীদ, ছিদ্দিক এবং সৎকর্মশীলের সাথে থাকবেন। যদি আমরা এই আয়াতের তাফসীর খুলে বুঝার চেষ্টা করি তবে অবশ্যই আল্লাহ্ আমাদের বুঝার তৌফিক এবং হিদায়াত দিবেন ইনশাআল্লাহ।
এই আয়াতে দুটি অংশ একটি হলো যারা আল্লাহ্ এবং রাসুল (সাঃ) এর অনুসারী। অপরটি হলো নবী, শহীদ, ছিদ্দিক এবং সৎকর্মশীল। এখানে যারা আল্লাহ্ ও রাসুলের (সাঃ) অনুসারী হলো মুরিদরা। আর সৎকর্মশীলরা হলেন পীরেরা। যদি পীর মানো তবে পীরের সাথে কিয়ামত হবে। খুবই সুন্দর। কিন্তু কুরআনে পীর মানার কথা নয় বরং আল্লাহ্ এবং রাসুলের (সাঃ) আদর্শ মানার কথা স্পষ্ট ভাবে বলা হয়েছে। যদি আল্লাহ্ এবং রাসুলের (সাঃ) আনুগত্য তথা হুকুম মানার অর্থ হয় পীর মানা, অর্থাৎ পীরেরা আল্লাহ্ এবং রাসুলেরই (সাঃ) আদর্শ অনুসরণ করে বলেই তাদের মান্য করা।
কিন্তু এটা তো সত্য, যে অর্থে উপমহাদেশে পীরেরা অবস্থান করছে সেই অর্থে তারা ইসলামী আদর্শে নেই (আগের বিশ্লেষণ থেকে প্রমাণিত)। অতএব পীর ধরার বা মানার প্রশ্ন আসছে না। এই আয়াতে আল্লাহ্ এবং রাসুলের (সাঃ) এর হুকুম মানার কথা এসেছে। তাই আল্লাহ্ এবং রাসুলের (সাঃ) এর হুকুম পরিপূর্ণ ভাবে পালনের জন্য যদি কোনো জ্ঞানীর কাছে (যিনি সঠিক ইসলামের শিক্ষা দেন) যেতে হয় তবে দোষের কিছু নেই। সুতরাং এই আয়াত দ্বারা কোনো মতেই পীর ধরার দলিল সাব্যস্ত হয় না।
৯) "পিতা-মাতা যদি তোমাকে আমার সাথে এমন বিষয়কে শরীক স্থির করতে পীড়াপীড়ি করে, যার জ্ঞান তোমার নেই; তবে তুমি তাদের কথা মানবে না এবং দুনিয়াতে তাদের সাথে সদ্ভাবে সহঅবস্থান করবে। যে(বিশুদ্ধ চিত্তে) আমার অভিমুখী হয়, তার পথ অনুসরণ করবে। অতঃপর তোমাদের প্রত্যাবর্তন আমারই দিকে এবং তোমরা যা করতে, আমি সে বিষয়ে তোমাদেরকে জ্ঞাত করবো। [ সুরা লুকমান ৩১:১৫ ]
এই আয়াতের যে অংশে বলা হচ্ছে - "যে বিশুদ্ধ চিত্তে আল্লাহ্ অভিমুখী হয় তাঁর অনুসরণ করো। "এর আগের আয়াতে আল্লাহ্ মাতাপিতার প্রতি সদ্ব্যবহার করতে আদেশ দিয়েছেন। পবিত্র কুরআনের অন্যান্য জায়গায় যেখানেই আল্লাহর ইবাদতের কথা আছে সেখানেই পিতামাতার খেদমতের কথা রয়েছে। এখানে বলা হচ্ছে যাঁরা আল্লাহ্ অভিমুখী অর্থাৎ যাঁরা আল্লাহ্ এবং রাসুল (সাঃ) এর আদেশ নিষেধ মেনে চলে পরিপূর্ণ ভাবে তাদের জীবন পরিচালিত করতে পেরেছেন তাঁরাই হলো আয়াতে বলা "বিশুদ্ধ চিত্ত "। বিখ্যাত সুন্নী তাফসীর "কানজুল ঈমানে " এই আয়াতে বলা" বিশুদ্ধ চিত্ত "বলতে রাসুল (সাঃ) এবং তাঁর অনুসারী সাহাবীদের কথা বলা হয়েছে। অর্থাৎ এই বিশুদ্ধ চিত্ত হলো রাসুল (সাঃ) এবং তাঁর সাহাবী। শুধু এই আয়াত নয়, পবিত্র কুরআনে যেখানেই মুমিন, মুত্তাকী, শহীদ, ছিদ্দিক, সালেহীন ইত্যাদির অনুসরণের কথা বলা হয়েছে তাঁরা সবাই হচ্ছেন রাসুল (সাঃ) এর সাহাবী। আর রাসুল (সাঃ) এর সাহাবীরা (রাঃ) গণ কখনোই উপমহাদেশের মতো তথাকথিত পীর ছিলেন না। এই সহজ কথা উপমহাদেশের একশ্রেণির আলেমগণ জেনে বুঝে বিকৃত করে আয়াতের ব্যাখ্যা পীরের দিকে নিয়ে যায়। যাতে করে তাদের ব্যবসা করা সহজ এবং জায়েজ হয়।
যেকোনো সাধারণ মুসলমান বলতেই বুঝতে পারবেন যে, রাসুল (সাঃ) এবং তাঁর সাহাবীদের(রাঃ) অনুসরণ করলেই আল্লাহর সঠিক রাস্তা পাওয়া যায়। এখন বিবেক দিয়ে প্রশ্ন করুন উপমহাদেশের হাজার হাজার পীরের দরবার আর মাজারে রাসুল (সাঃ) এবং তাঁর সাহাবীদের(রাঃ) কতটুকু অনুসরণ করা হয়। অনুসরণ তো দূরের কথা সাহাবীদের (রাঃ) নাম আর জীবনী জানেন কিনা সন্দেহ আছে। তাদের খাদেমদের কথা তো দূরে, আর মুরিদদের কথা তো বলাই যাবে না। আমাদের উপমহাদেশে কতজন মুরিদ বা মুসলমান বিখ্যাত সাহাবীদের (রাঃ) এর নাম জানেন?
যদি পীরের দরবার এবং মাজার সঠিক ইসলামের প্রচারক হতো তাহলে তারা অবশ্যই সাহাবীদের (রাঃ) জীবনী থেকেই শিক্ষা নিতেন এবং দিতেন। এই সাহাবীদের (রাঃ) আদর্শে সবার জীবন গড়ার শিক্ষা দিতেন। কিন্তু বাস্তবে এর কিছুই নেই। অথচ তাঁরা (রাঃ) হচ্ছেন আল্লাহ্ এবং রাসুল (সাঃ) এর স্বীকৃত জান্নাতী এবং সুপথ প্রাপ্ত ব্যক্তি। তাঁদের বাদ দিয়ে বিভিন্ন অলি আল্লাহর কাহিনী এমন ভাবে প্রচার করা হয়, যেসব কাহিনীর বাস্তবতা কখনোই পাওয়া যায় না। এমন সব কেরামত বর্ণনা করা হয় যা সাহাবী তো দূরের কথা কোনো নবী রাসুল (আঃ) দেখিয়েছেন কিনা সন্দেহ।
শুধু তাই নয় এই উপমহাদেশে কখনোই সাহাবীদের জীবনী চর্চা করা হয় না। এখানে শুধু চলে বিভিন্ন পীরের দরবার এবং মাজার ভিত্তিক আউলিয়াদের জীবনী ও কারামত বর্ণনা। আমি অলি আউলিয়ার বিরুদ্ধে নই। তবে আল্লাহ্ যাঁদের অনুসরণ অনুকরণ করতে বলেছেন তাঁদেরই আমাদের অনুসরণ করা উচিত। কেননা আল্লাহ্ বলেন - ঈমান আন তাদের মতো যারা ঈমান এনেছে। অর্থাৎ আমাদের ঈমান আনতে হবে সাহাবীদের জীবনী অনুসরণে। কেননা তাঁরা ছিলেন মানুষ অর্থাৎ তাঁদের জীবনেও বিভিন্ন ভুল ত্রুটি ছিলো যা আল্লাহ্ ক্ষমা করেছেন। তাঁদের জীবনের সেই ঘাত প্রতিঘাত থেকেই আমাদের শিক্ষা নিতে হবে।
অথচ লক্ষ্য করলে দেখা যাবে যে আমাদের উপমহাদেশের মুসলমানরা সাহাবীদের চেনেন না। কিন্তু পীর আউলিয়াদের ঠিকই চিনে। এখন কথা হচ্ছে যেসব পীর আউলিয়ার কথা বলে এইসব দরবার চলে, সেইসব আউলিয়ারা প্রচুর কষ্ট করে এই উপমহাদেশে ইসলাম প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। তাঁদের কষ্টসাধ্য ত্যাগের বিনিময়ে আজ আমরা ইসলামের ছায়া পেয়েছি। কিন্তু সেইসব আউলিয়ার মতো কষ্ট কেউ এখন করছে না। তাঁরা ইসলাম প্রচার এবং প্রসার ও বিস্তার লাভের কাজে ছিলেন। এখন পীরের দরবার আর মাজার আছে কে কত বেশি মুরিদ করে ভালো ইনকাম করতে পারবে। কে কাকে খারাপ বলে লোকজন বেশি জোগাড় করতে পারবে এই ধান্দায় ব্যস্ত।
সুতরাং যাদের নিয়ে কুরআনের আয়াত তাঁদের বাদ দিয়ে জোর করে পীরের নাম দিয়ে কুরআনের ব্যাখ্যা করা কখনোই ঈমানদারের লক্ষন নয়। অতএব এইসব ধূর্তামি ছেড়ে সঠিক ইসলামের পথে আমাদের আসা দরকার। তাঁদের পথেই আমাদের চলা দরকার যাঁদের কথা আল্লাহ্ এবং রাসুল (সাঃ) আমাদের জানিয়েছেন।
বাকি পর্ব গুলো এখানেঃ
পীর (উপমহাদেশে পীরের বাস্তবতা)
দলিল ছাড়া পীরতন্ত্রের ভিত্তি ১
দলিল ছাড়া পীরতন্ত্রের ভিত্তি ২
দলিল ছাড়া পীরতন্ত্রের ভিত্তি ৩
কুরআনের আয়াত দ্বারা পীরের দলিল খন্ডন ১
কুরআনের আয়াত দ্বারা পীরের দলিল খন্ডন ২
কুরআনের আয়াত দ্বারা পীরের দলিল খন্ডন ৩
কুরআনের আয়াত দ্বারা পীরের দলিল খন্ডন ৪
কুরআনের আয়াত দ্বারা পীরের দলিল খন্ডন ৫
বাইয়াত দ্বারা পীরের দলিল
সুপারিশকারী পীর
পীরের দরবারে মানত