কুরআনের আয়াতে পীরের দলিল খন্ডন -৪(পর্ব -৮)
১৩)" মনে রেখো যারা আল্লাহর বন্ধু, তাদের না কোন ভয় ভীতি আছে, না তারা চিন্তান্বিত হবে। [ সুরা ইউনুস ১০:৬২ ]
যারা ঈমান এনেছে এবং ভয় করতে রয়েছে। [ সুরা ইউনুস ১০:৬৩ ]
তাদের জন্য সুসংবাদ পার্থিব জীবনে ও পরকালীন জীবনে। আল্লাহর কথার কখনো হের-ফের হয় না। এটাই হল মহা সফলতা।" [ সুরা ইউনুস ১০:৬৪ ]
এখানে পরপর তিনটি আয়াত রয়েছে। যারা পীরতন্ত্র দাবি করেন তারা শুধুমাত্র ৬২ নং আয়াত দেখিয়ে বলেন এই হচ্ছে আল্লাহর অলি, বন্ধু তথা পীর যাদের কোনো ভয় নেই এবং তাদের চিন্তাও নেই। এই দাবিদাররা পরের আয়াত গুলো ভুলেও মানুষকে বলেন না। যেখানে বলা হচ্ছে যাঁরা ঈমান এনেছে এবং ভয় করেছে নয়, বরং ভয় করতে রয়েছে। অর্থাৎ যাঁরা ঈমান আনার পর আল্লাহ কে ভয় করতে থাকে তাঁরাই আল্লাহর বন্ধু বা অলি। তাহলে এখানে কি শুধুমাত্র পীরদের কথাই বলা হচ্ছে? পৃথিবীতে কি শুধুমাত্র এই উপমহাদেশের পীররাই কি ঈমান এনে আল্লাহ্ কে ভয় করছে ( যদিও তাদের ঈমান আকিদা কী তা আগেই বিস্তারিত বলেছি)। এর উত্তর আপনি নিজেও খুব সহজেই দিতে পারবেন যে শুধুমাত্র পীরেরাই একমাত্র ঈমানদার এবং আল্লাহ্ ভীতু নয়।
এই পৃথিবীতে যারাই সত্যিকারের ঈমানের সাথে আল্লাহকে ভয় করতে রয়েছে তারাই এই আয়াতের মালিক তথা আল্লাহর বন্ধু। খুব সহজে বললে - যারা ঈমান আনার পর পরহেজগারী অবলম্বন করেছেন তাঁরাই এই আয়াতের আল্লাহর অলি বা বন্ধু। এবং তাঁরা দুনিয়া এবং আখিরাতে সফলকাম। এই বিষয়ে অর্থাৎ আল্লাহর বন্ধু সম্পর্কে তাফসীরে ইবনে কাছীরে এসেছে - রাসুলুল্লাহ (সাঃ) জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি জানান যে, যাঁরা দুনিয়ায় একে অপরকে ভালোবেসেছে শুধুমাত্র আল্লাহর কারণে। কোনো সম্পত্তি বা আত্মীয়তার কারণে নয় (বিস্তারিত ইবনে কাছীর) এবং তাঁরা হচ্ছেন পরহেজগারী। সুতরাং আল্লাহর অলি তারাই হবেন।
এখন যারা আল্লাহর অলি দ্বারা পীর এবং মাজার কে বুঝানোর চেষ্টা করেন তাদের দিকে তাকান। তারা অর্থাৎ পীরেরা কি শুধুমাত্র আল্লাহর জন্য মুরিদ করান? মুরিন করানোর পর তাদের থেকে হাদিয়া তোফা নজরানা নেন না? বিভিন্ন মান্নতের মাধ্যমে মাজারে টাকাপয়সা নেওয়া হয় না?
এর দ্বারা খুব সহজেই বুঝা যাচ্ছে যে এখানে ভালোবাসা যেটা চলছে সেটা একধরনের বিনিময় স্বরূপ। শুধু তাইনয় এক পীরের মৃত্যুর পর তার সন্তানই নতুন পীর হয়ে আবির্ভাব হন। এবং তিনিও অটোমেটিক আল্লাহর অলি হয়ে যান বংশপারম্পরিক ভাবে। হে মুসলমানগণ একটু তো চিন্তা করুন। এটা কি ইসলাম সমর্থন করে? আল্লাহর অলি বংশপরম্পরায় হওয়া যায়? তাহলে তো বর্তমানে যেসব দরকার আছে সেইসব বংশ ছাড়া আর কোনো বংশে আল্লাহ তাঁর অলিদের প্রেরণ করবেন না। আর আল্লাহর অলির সব বংশই শুধু এই ভারত বাংলাদেশ পাকিস্তানে। অথচ যেখানে ইসলাম এসেছে। যারা আল্লাহ্ স্বীকৃত জান্নাতী। সেখানে এবং সেইসব বংশে আল্লাহর অলি প্রেরণ করছেন না। ব্যাপারটা কি যৌক্তিক?
সহজ বাংলায় বললে পীর নিয়ে এইসব ভুল ব্যাখ্যা আজ নতুন নয়। যখন থেকেই স্বার্থান্বেষী একটি শ্রেণী আল্লাহর সত্যিকার অলিদের নিয়ে ব্যবসা শুরু করেছিল তখন থেকেই এইসব পীর মুরিদী জায়েজ করার জন্য কোনো না কোন পথ তারা বের করার চেষ্টায় ছিল। যেহেতু সাধারণ মানুষের কুরআন হাদীসের কোনো জ্ঞান ছিলো না এবং নেই। সেই সুযোগে কুরআনের সার্বজনীন আয়াতকে কোন একটি নির্দিষ্ট পক্ষে (পীর) নিয়ে ব্যাখ্যা করতে সচেষ্ট হয়। যা ইতিমধ্যে প্রতীয়মান হয়েছে প্রমাণসাপেক্ষে।
১৪) "হে মুমিনগণ! আল্লাহকে ভয় কর, তাঁর নৈকট্য (ওয়াসিলা) অন্বেষন কর এবং তাঁর পথে জেহাদ কর যাতে তোমরা সফলকাম হও। [ সুরা মায়েদা ৫:৩৫ ]
এই একটি আয়াত যা দ্বারা লক্ষ লক্ষ মুসলমানকে একশ্রেণির ভন্ডরা বিপদগগামী তথা পথভ্রষ্ট করছে। এই আয়াতকে পুঁজি করে ভন্ডরা বলে বেড়ায় যে এখানে ওয়াসিলা হলো পীর। কতবড় মিথ্যাবাদী হলে কেউ এমন কথা বলে। আর আমাদের সাধারণ মুসলমানগণ না বুঝে যাচাই না করে এইসব কথা বিশ্বাস করে ঈমান আমল ধ্বংস করছে।
এখানে কত স্পষ্ট করে আল্লাহ বলছেন তাঁকে ভয় করতে এবং তাঁর নিকটবর্তী হতে উপায় বা মাধ্যম তালাশ বা অন্বেষণ করতে। এবং আল্লাহ্ নিজেই পরের অংশে বলছেন যে - তোমরা আল্লাহর পথে জিহাদ করো যাতে তোমরা সফল হও। অর্থাৎ আল্লাহর নিকটবর্তী তথা আল্লাহর প্রিয়ভাজন হতে হলে জিহাদ করো। আর জিহাদের মাধ্যমে আল্লাহর নিকটবর্তী হয়ে দুনিয়া এবং আখিরাতে সফল হও।
বিখ্যাত তাফসীরকারক ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন - ওয়াসিলা বলতে আল্লাহর নিষেধকৃত কাজ থেকে বিরত থাকা এবং তাঁর নৈকট্য লাভের চেষ্টা করা। কাতাদাহ (রহ) বলেন - আল্লাহর আনুগত্য স্বীকার এবং তাঁর মর্জি মোতাবেক চলা। ইবনে কাছীরে এসেছে, ওয়াসিলা বলতে ঐ জিনিস যার দ্বারা আকাঙ্খিত বস্তু লাভ করা যায়। ওয়াসিলা হচ্ছে জান্নাতের ঐ উচ্চ ও মনোরোম জায়গায় যা রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এর জন্য নির্দিষ্ট করা হয়েছে। এটা আরশের খুব নিকটে। সহীহ্ বুখারীতে এসেছে যে আজান শুনে আজানের দোয়া পড়বে, তার জন্য রাসুলের (সাঃ) এর শাফায়াত হালাল হয়ে যাবে। সহীহ্ মুসলিমেও এসেছে আজানের পর দোয়ায় আমরা বলি রাসুল (সাঃ) কে ওয়াসিলা নামক স্থান এবং মর্যাদা দান করুন (বিস্তারিত ইবনে কাছীর)।
এখানে ওয়াসিলা বলতে পীর নয়। যদি ওয়াসিলা পীর হয় তবে সহীহ্ হাদীস এবং বিখ্যাত তাফসীরে যা এসেছে তা সবই মিথ্যে। কিন্তু এটা কখনোই সম্ভব নয়। বিখ্যাত তাফসীর এবং সহীহ্ হাদীসে প্রমাণিত যে এখানে "ওয়াসিলা " বলতে কখনোই পীর নয়।
যদি যুক্তির খাতিরে আমরা ধরেও নিই যে এখানে ওয়াসিলা মানে পীর। তবে পরের অংশে জিহাদের কথা আছে। অর্থাৎ আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করতে হবে। আমাদের উপমহাদেশে কোনো দেশেই কখনো ইসলামী শাসন ছিলো না। কখনোই ইসলামী আইন দিয়ে রাষ্ট্র পরিচালিত হয়নি। যদি পীরেরাই ওয়াসিলা হয় তবে তাদের জিহাদ করা এই আয়াত দ্বারা অবশ্যই কর্তব্য। এই জিহাদের মাধ্যমে আল্লাহর আইন কে জমিনে প্রতিষ্ঠিত করা। যদি তারা তা না করেন তবে তারা ভন্ড। এইসব পীর যে ইসলামী কোনো কিছুতে নেই তা আগেই প্রমাণ করেছি।
অথচ এই ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে লক্ষ কোটি মুসলমানের ঈমান ধ্বংস করা হচ্ছে এখনো। শুধু তাইনয় এই আয়াতের ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে দিনদিন পীর - মুরিদী ব্যবসা জমজমাট হচ্ছে। সহীহ্ জিহাদের নাম নিশানাও আজ বিভিন্ন কারণে প্রশ্নবিদ্ধ। আল্লাহ্ আমাদের হিদায়াত দান করুন আমিন।
১৫) "আমি আপনার প্রতি অবতীর্ণ করেছি সত্যগ্রন্থ, যা পূর্ববতী গ্রন্থ সমূহের সত্যায়নকারী এবং সেগুলোর বিষয়বস্তুর রক্ষণাবেক্ষণকারী। অতএব, আপনি তাদের পারস্পারিক ব্যাপারাদিতে আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন, তদনুযায়ী ফয়সালা করুন এবং আপনার কাছে যে সৎপথ এসেছে, তা ছেড়ে তাদের প্রবৃত্তির অনুসরণ করবেন না। আমি তোমাদের প্রত্যেককে একটি আইন ও পথ দিয়েছি। যদি আল্লাহ চাইতেন, তবে তোমাদের সবাইকে এক উম্মত করে দিতেন, কিন্তু এরূপ করেননি-যাতে তোমাদেরকে যে ধর্ম দিয়েছেন, তাতে তোমাদের পরীক্ষা নেন। অতএব, দৌড়ে কল্যাণকর বিষয়াদি অর্জন কর। তোমাদের সবাইকে আল্লাহর কাছে প্রত্যাবর্তন করতে হবে। অতঃপর তিনি অবহিত করবেন সে বিষয়, যাতে তোমরা মতবিরোধ করতে।" [ সুরা মায়েদা ৫:৪৮ ]
এই আয়াতের একটি অংশে বলা হয়েছে যে আল্লাহ্ আমাদের একটি আইন (শরীয়ত) এবং একটি পথ দিয়েছেন। এই আইন বা শরীয়ত দ্বারা ইসলামের শরীয়ত। এবং রাস্তা দ্বারা এইসব পীর মাজার ভক্তরা বলে যে ত্বরিকত। অথচ এখানে আরবিতে ত্বরিকা বা ত্বরিকত শব্দ নেই।
এই আয়াতের পুরো ব্যাখ্যা যদি আমরা করি তাহলে দেখবো যে, আল্লাহ্ বলছেন ইসলাম আগে থেকেই ছিলো। এই পবিত্র কুরআন আগের কিতাবগুলোর সত্যায়নকারী। প্রতিটি নবী রাসুলদের (আঃ) ই নির্দিষ্ট বিধিবিধান বা শরীয়ত এবং নির্দিষ্ট কিছু কর্মপন্থা ছিলো। এখন শেষ নবী (সাঃ) যে বিধিবিধান নিয়ে এসেছেন তা ই সকলকে মানতে হবে। অতএব এখানে বিধিবিধান হচ্ছে ইসলামী শরীয়ত এবং কর্মপন্থা হচ্ছে ইসলামে চলার রাস্তা। যা রাসুলুল্লাহ (সাঃ) তাঁর জীবনের প্রতিটি কর্মকান্ড দ্বারা আমাদের শিক্ষা দিয়ে গেছেন। সুতরাং এই আয়াত দ্বারা পীর মুরিদী কোনো ভাবেই সাব্যস্ত হয়নি।
বাকি পর্ব গুলো এখানেঃ
পীর (উপমহাদেশে পীরের বাস্তবতা)
দলিল ছাড়া পীরতন্ত্রের ভিত্তি ১
দলিল ছাড়া পীরতন্ত্রের ভিত্তি ২
দলিল ছাড়া পীরতন্ত্রের ভিত্তি ৩
কুরআনের আয়াত দ্বারা পীরের দলিল খন্ডন ১
কুরআনের আয়াত দ্বারা পীরের দলিল খন্ডন ২
কুরআনের আয়াত দ্বারা পীরের দলিল খন্ডন ৩
কুরআনের আয়াত দ্বারা পীরের দলিল খন্ডন ৪
কুরআনের আয়াত দ্বারা পীরের দলিল খন্ডন ৫
বাইয়াত দ্বারা পীরের দলিল
সুপারিশকারী পীর
পীরের দরবারে মানত