কুরআনের আয়াতে পীরের দলিল খন্ডন-১ (পর্ব -৫)
এখন আমরা এই বিষয় গুলো নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করবো। পবিত্র কুরআনের যেসব আয়াত দিয়ে বলা হয়ে থাকে এগুলো পীরের / অলির আয়াত। সেগুলো একটি একটি করে আমরা এখন যাচাই করবো ইনশাআল্লাহ।
১) সূরা নিসার ৫৯ নং আয়াতে " হে ঈমানদারগণ! আল্লাহর নির্দেশ মান্য কর, নির্দেশ মান্য কর রসূলের এবং তোমাদের মধ্যে যারা বিচারক তাদের। তারপর যদি তোমরা কোন বিষয়ে বিবাদে প্রবৃত্ত হয়ে পড়, তাহলে তা আল্লাহ ও তাঁর রসূলের প্রতি প্রত্যর্পণ কর-যদি তোমরা আল্লাহ ও কেয়ামত দিবসের উপর বিশ্বাসী হয়ে থাক। আর এটাই কল্যাণকর এবং পরিণতির দিক দিয়ে উত্তম। [ সুরা নিসা ৪:৫৯ ]
এই আয়াত দ্বারা অনেকে পীর কে জায়েজ বলে প্রমাণ করতে চান। এখানে "উলিল আমর "শব্দ দ্বারা তারা উৎসাহিত হন। এই শব্দের ব্যাখ্যায় এসেছে - বিচারক, নেতৃত্বদানকারী, ইসলামী শাসনের আমীর, এবং আলেমগণ। যাদের মধ্যেটক সঠিক এবং পরিপূর্ণ কুরআন এবং সুন্নাহর জ্ঞান এবং চর্চা রয়েছে। যারা সত্যিকার অর্থে আল্লাহর দ্বীনের উপর প্রতিষ্ঠিত। শুধু তাই নয় এই আয়াতে বলা হচ্ছে - যদি এইসব নেতৃত্বদানকারী, আলেমগণ বা বিচারকগণ কোনো বিষয়ে ভুল করে তবে তা আল্লাহ্ এবং তাঁর রাসুলের (সাঃ) দিকে ফিরে যাও। অর্থাৎ এইসব ব্যক্তি যদি কোনো বিষয়ে দ্বিধান্বিত হন, বিভেদ সৃষ্টি হয় তবে তা কুরআন এবং সুন্নাহ দ্বারা যাচাই করো। কুরআন এবং সুন্নাহয় এই বিষয়ে কী আছে সেখান থেকে সিদ্ধান্ত নাও।
অতএব এখানে "উলিল আমর " বলতে যা বোঝানো হয়েছে তা মোটেই এই উপমহাদেশে চলে আসা পীরতন্ত্রের তথাকথিত পীর নয়। যদি এই শব্দ দ্বারা পীরকে বোঝানো হতো তবে তাদের হতে হবে বিচারক, সত্যিকারের আলেম, ইসলামী আমীর, এবং সমাজে নেতৃত্বদানকারী। কিছু কিছু পীর ইসলামী শিক্ষায় শিক্ষিত হলেও (তা না হলে ব্যবসা তো হবেনা) অধিকাংশর ই সেই জ্ঞান নেই। আর বিচারক, আমীর ও নেতৃত্ব দেওয়ার প্রশ্নই উঠেনা। অতএব এই আয়াতের ব্যাখ্যা দ্বারা কখনোই পীরকে জায়েজ বলা যাচ্ছে না। এই বিষয়ে বিস্তারিত জানতে বিশ্ব বিখ্যাত তাফসীর "তাফসীরে ইবনে কাছীর " এবং সুন্নীদের বড় আলেম আলা হযরতের বিখ্যাত তাফসীর "কানজুল ঈমান "দেখতে পারেন।
২) "স্মরণ কর, যেদিন আমি প্রত্যেক দলকে তাদের নেতাসহ আহবান করব, অতঃপর যাদেরকে তাদের ডান হাতে আমলনামা দেয়া হবে, তারা নিজেদের আমলনামা পাঠ করবে এবং তাদের প্রতি সামান্য পরিমাণও জুলুম হবে না। [ সুরা বনী-ইসরাঈল ১৭:৭১ ]
সূরা বনী ইসরাঈল এর এই আয়াত দ্বারা যারা "নেতা " এর আরবি শব্দ দ্বারা পীর বোঝাতে চান তারা এক পর্যায়ে সঠিক। যদি তারা এই নেতা বলতে পীর বুঝায় এবং সর্বোপরি এই নেতার অনুসরণ করেন তবে আপনি সঠিক। যে পীরের অনুসরণ করেন তিনি যদি সঠিক কুরআন এবং সুন্নাহর আলোকে চলেন তবে তারা পরকালে সফল। এতে কোনো সন্দেহ নেই। এখন কথা হচ্ছে এই নেতা শব্দ দ্বারা কি শুধু পীরদেরই বুঝানো হয়েছে? না, তা কখনোই নয়। শুধু পীর নয়। এই নেতা দ্বারা দুনিয়ার সব নেতাদের বুঝানো হয়েছে। আর এটাই দিনের আলোর মতো পরিষ্কার।
যদি ধরে নিই শুধু পীর। তবে আপনি দুনিয়াদারী কাজের জন্য যে নেতার অনুসরণ করছেন সেই নেতা কি আল্লাহর আইন এবং বিচার থেকে বাদ যাবেন? আপনি পীর মানেন একজন কে এবং আপনার দাবি তিনিই আপনার নেতা। আবার ইলেকশন আসলে আপনি ভোট দেন আপনার প্রিয় দল এবং নেতাকে। যাদের ৯০ শতাংশ ইসলামী বিরোধী হিসাবের খাতায় লিপিবদ্ধ। যেসব নেতাকে রাতে খুঁজে পাওয়া যায় না। যারা পশ্চিম দিকে কখনো পড়েছেন কিনা কোনো সাক্ষী নেই! অথচ আপনি তাদেরও মুরিদ। তাদের ভোট দিচ্ছেন। তাদের প্রতিটি কর্মকান্ডে আপনার সায় এবং সহযোগিতা রয়েছে। তাহলে এখন বলুন, পীরকে নেতা বলে আখিরাত পাবেন। এইসব নেতাকে সাপোর্ট করার জন্য কী পাবেন বলে চিন্তা করেছেন? আপনার জাহান্নামের টিকিট কি কনফার্ম নয়?
কেননা একজন নেতা ইসলামের, আরেকজন গনতন্ত্রের। আর গনতন্ত্র আল্লাহর বিধান নয়। এই গনতন্ত্রের মাধ্যমে আমরা ভোট দিয়ে আল্লাহ্ বিরোধী আইন করতে সরকারকে সহযোগিতা করছি। তাহলে কীভাবে আপনি জান্নাত আশা করেন। প্রিয় পীরের মুরিদরা আপনারাই বিবেচনা করুন। (এই বিষয়ে আরো বিস্তারিত লেকচার আছে যদি প্রয়োজন হয়)
৩)"আর ঈমানদার(মুমিন) পুরুষ ও ঈমানদার(মুমিন) নারী একে অপরের সহায়ক। তারা ভাল কথার শিক্ষা দেয় এবং মন্দ থেকে বিরত রাখে। নামায প্রতিষ্ঠা করে, যাকাত দেয় এবং আল্লাহ ও তাঁর রসূলের নির্দেশ অনুযায়ী জীবন যাপন করে। এদেরই উপর আল্লাহ তা'আলা দয়া করবেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ পরাক্রমশীল, সুকৌশলী। "[ সুরা তাওবা ৯:৭১ ]
উপরোক্ত আয়াতে মুমিননের গুণাবলী বর্ননা করা হয়েছে। এবং তারা একে অপরের বন্ধু। অর্থাৎ আপনি পীরকে মুমিন মনে করলেন। যেহেতু আপনি পীরের মুরিদ আপনিও তার বন্ধু। আপনাকে পীরের অর্থাৎ মুমিনের বন্ধু হতে হলে আপনাকেও মুমিন হতে হবে। এখানে স্পষ্ট বলা হয়েছে মুমিন পুরুষ মুমিন নারী একে অপরের বন্ধু। সেই দাবি অনুযায়ী আপনাকে মুমিন হতে হবে। ধরে নিলাম আপনিও মুমিন। যদি আপনি মুমিন হন তবে এই আয়াত অনুযায়ী আপনিও তো একজন পীর! বিষয়টা খুবই সহজ।
এবার আসুন "মুমিন " মানে কী বা কাদের "মুমিন" বলা হয়। ইসলামের পরিভাষায় তাঁরাই মুমিন যারা আল্লাহর সমস্ত আদেশ নিষেধ মেনে চলেন। যাঁরা তাদের জীবনকে রাসুল (সাঃ) এর আদর্শ দ্বারা গঠিত করেছে। যাদের চলার প্রতিটি কদমই হবে কুরআন এবং সুন্নাহর আলোকে। এখন আপনারাই পরীক্ষা করে দেখুন প্রতিটি পীরের দরবার এবং মাজারকে। কয়টি দরবার এবং মাজার কুরআন এবং সুন্নাহর আলোকে পরিচালিত। আমি এর আগে এটা স্পষ্ট করে দেখিয়েছি (যারা পাননি তারা খুঁজে পড়ে দেখেন) যে প্রতিটি দরবার এবং মাজারে কী রূপে কুরআন এবং সুন্নাহকে পদদলিত করা হচ্ছে। এটা জানার পরও যদি আপনার মনে হয়, উপমহাদেশের এই পীর ই কুরআনের এই আয়াতের মুমিন তবে আপনার জন্য আল্লাহ কে নতুন করে ওহী পাঠাতে হবে।
এই আয়াতে খুবই স্পষ্ট করে বলা হয়েছে যে মুমিনগণ একে অপরকে ভালো কাজের আদেশ মন্দ কাজের নিষেধ করে। সালাত আদায় করে যাকাত দেয় এবং রাসুলের (সাঃ) এর আদর্শ মেনে চলে। এইসব যে পীরের দরবারে এবং মাজারে হচ্ছে না তা আগেই স্পষ্ট করা হয়েছে।
এই আয়াতে আরো একটি বিষয় আছে। এখানে পুরুষ এবং নারীর কথা বলা হচ্ছে। আমার প্রশ্ন হচ্ছে - এই উপমহাদেশে কয়জন নারী পীর আছেন যারা আপনাদের মতো মুরিদদের জন্য দরবার খুলেছেন।
অতএব এখানে মোটেই সেইসব পীরের কথা বলা হয়নি যারা পীরের নামে ব্যবসা করে খাচ্ছে। যারা পীর মাজারের নামে প্রতিনিয়ত কুরআন এবং রাসুলের (সাঃ) এর আদর্শ বিরোধী কাজ করে যাচ্ছেন। এখানে তাদের কথাই বলা হচ্ছে যারা ইসলামের সত্যিকারের আদর্শকে বুকে ধারণ করে জীবন পরিচালিত করছে। যারা দুনিয়ার হাজারো কষ্টে বিপদ আপদে ইসলামের আদর্শকে ছেড়ে দেয়নি। তারাই নিজেদেরকে ভালো কাজে উদ্বুদ্ধ এবং মন্দ কাজে বাঁধা প্রদান করে। এবং সর্বদা রাসুলের (সাঃ) আদর্শ অনুযায়ী জীবন পরিচালিত করে। যে সংজ্ঞার মধ্যে কোনো ভাবেই এইসব তথাকথিত পীরেরা পড়ে না।
৫) হে ঈমানদারগণ, আল্লাহকে ভয় কর এবং সত্যবাদীদের সাথে থাক। [ সুরা তাওবা ৯:১১৯ ]
কুরআনের এই আয়াতটি, তিনজন সাহাবীর ব্যাপারে নাযিল হয়েছিল। যাঁরা কিছু ভুল করেছিল এবং আল্লাহর কাছে তাওবা করার পর আল্লাহ্ তওবা কবুল করেন। কারণ তাঁরা সত্যবাদী ছিলেন। এখন এই আয়াত দিয়ে বর্তমান ব্যাখ্যা যদি করি তবে হবে, আমাদেরও সত্য যারা বলে তাদের সাথে থাকতে হবে। এখন কথা হচ্ছে সত্য কী? পৃথিবীতে একমাত্র সত্য হচ্ছে আল্লাহ্ এবং তাঁর বিধান। এখন যারা এই সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করতে চায় তাঁরা প্রকৃত সত্যবাদী। অর্থাৎ যাঁরা ইসলামের মানদন্ড দিয়ে জীবন পরিচালিত করে সত্য পথের দাওআত দেয় তাদেঁর সাথেই আমাদের থাকতে হবে। যদি আল্লাহ অলা জ্ঞানী মানুষের সাথে থাকা যায় তবে আমরাও আল্লাহর পথে চলতে পারবো এবং আল্লাহর নেক দৃষ্টিতে থাকতে পারবো।
এখন এই আয়াত দ্বারা যদি পীরদের পরীক্ষা করি তবে আমরা কতটুকু তারা ইসলামের আলোকে সত্যবাদী? এর আগের বিভিন্ন পয়েন্টে দেখানো হয়েছে তারা কীভাবে কুরআন এবং রাসুলের (সাঃ) আদর্শের বাইরে কাজ করে মুসলমাদের ধোঁকা দিচ্ছে। তারা তাদের কর্মকান্ড দ্বারা ইসলামের চোখে প্রশ্নবিদ্ধ। অতএব এই আয়াত কোনো মতেই সরাসরি পীরদের ইংগিত করে না।
যদি তাদের কথা বলেন যারা সত্যিকারের মুমিন, যারা হাজারো কষ্টে ইসলামকে ছেড়ে দেয়নি তাঁরাই হচ্ছেন এই আয়াতের ভাগিদার। আমাদের সেইসব মুমিনের সাথে থাকতে হবে যারা সত্যিকারে ইসলামের আদর্শে কথা বলে। যারা আখিরাতের জন্য দুনিয়া বিসর্জন দিয়েছেন। অতএব নিজের বিবেকের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে দেখুন কে সত্যিকারের ইসলামী "সত্যবাদী "।
৬) অনুসরণ কর তাদের, যারা তোমাদের কাছে কোন বিনিময় কামনা করে না, অথচ তারা সুপথ প্রাপ্ত। [সুরা ইয়া-সীন ৩৬:২১ ]
এই আয়াতের ইশারা ইনতাকিয়া শহরের ঘটনা বর্ণনা প্রসঙ্গে। যে শহরে তিনজন নবীকে আল্লাহ প্রেরণ করেছিলেন। এখানে সেই শহরের বাসিন্দাদের নবীদের অনুসরণের ব্যাপারে বলা হচ্ছে (ইবনে কাছীর, কানজুল ঈমান)। তাদের বিষয়ে বলতে গিয়ে আল্লাহ্ বলেন - তাঁরা তোমাদের কাছে বিনিময় চাই না। তাঁরা বিনিময় পাবেন আল্লাহর কাছ থেকে। এবং তাঁরাই সুপথ প্রাপ্ত।
এই আয়াতের বর্তমান প্রেক্ষাপটে যদি বলা হয় "পীরেরা " এই আয়াতের মালিক, এবং তারা বিনিময় চাই না। তবে এর চাইতে জালিম আর কে? বাংলাদেশসহ পুরো উপমহাদেশে এমন কোনো পীরের দরবার বা মাজার আছে যেখানে বিনিময় দেওয়া হয়না? পীরের নজরানা, হাদিয়া, তোফা, মান্নত ইত্যাদি এইসব কী? এগুলো কি বিনিময় নয়?
শুধু কি তাই, টাকা পয়সা ছাড়া তো ভালো মুরিদও হওয়া যায় না। আপনি পীরের কাছাকাছি থাকতে চাইলে আপনাকে মোটা অঙ্কের হাদিয়া মান্নত নজরানা দিতে হবে। যিনি এইসব দিতে পারেন তিনিই পীরের কাছে ভালো মুরিদ। এইসব কোনো বানানো কথা নয়। পীরের দরবার ঘুরলেই এইসব দেখতে পাওয়া যায়।
এই আয়াত অনুযায়ী পীরেরা হবেন নির্লোভ এবং সাধারণ জনগণের থেকে কোনো কিছু আশা করবেনও না নিবেনও না (যতটুকু না হলে চলা দায়)। তাহলেই তিনি (পীর) এই আয়াতের ভাগিদার হতে পারেন। কিন্তু বাস্তব বরই কঠিন এবং নির্মম। আমরা আজ যত পীরের আস্তানা দেখছি (যারা লাইম লাইটে আসতে পারেনি তারা ব্যতীত) তাদের কোনটিরই করুন দশা নেই। বরং তারা এতো এতো টাকা মালিক এবং তা বংশপরম্পরায় পেয়ে আসছেন শূন্য পুঁজি দিয়ে। এইসব দেখে যেকোনো ঈমানদার ব্যক্তিই বুঝতে পারবেন এরা আসলেই কতটুকু ইসলাম বিরোধী। সুতরাং এই আয়াত দ্বারাও পীর প্রমাণিত হয় হলো না।
বাকি পর্ব গুলো এখানেঃ
পীর (উপমহাদেশে পীরের বাস্তবতা)
দলিল ছাড়া পীরতন্ত্রের ভিত্তি ১
দলিল ছাড়া পীরতন্ত্রের ভিত্তি ২
দলিল ছাড়া পীরতন্ত্রের ভিত্তি ৩
কুরআনের আয়াত দ্বারা পীরের দলিল খন্ডন ১
কুরআনের আয়াত দ্বারা পীরের দলিল খন্ডন ২
কুরআনের আয়াত দ্বারা পীরের দলিল খন্ডন ৩
কুরআনের আয়াত দ্বারা পীরের দলিল খন্ডন ৪
কুরআনের আয়াত দ্বারা পীরের দলিল খন্ডন ৫
বাইয়াত দ্বারা পীরের দলিল
সুপারিশকারী পীর
পীরের দরবারে মানত