আমরা মুসলিমরা বর্তমানে আমাদের ধর্মকে একটি আনুষ্ঠানিক রীতিনীতির পর্যায়ে নিয়ে এসেছি। ইসলাম মানেই এখন সালাত, সিয়াম, হজ্জ্ব, যাকাত, কুরবানী ইত্যাদির মধ্যে সীমাবদ্ধ। কিন্তু ইসলাম মানেই শুধু এইসব বাহ্যিকভাবে পালন নয়। আমরা যা পালন করছি তা পরিপূর্ণভাবে আদায় করার না ইসলাম। তাছাড়া এইসব মূল স্তম্ভের সাথে আরও অনেক গুলো বিষয় রয়েছে যা আমাদের সমাজের ইসলাম থেকে হারিয়ে গেছে এবং যাচ্ছে।
ঈমানঃ
ঈমান আনার পরই একজন মানুষ নিজেকে মুসলিম দাবি করতে পারে। কিন্তু আমরা জন্মগত মুসলিম হওয়ার ফলে ঈমান আনা বা ঈমান কী সেটাই ভালোকরে জানি না। ঈমানের মূলে হচ্ছে কালেমা শাহাদাত "লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ " এই সাক্ষ্য দেয়া। অথচ সিংহভাগ বর্তমান মুসলিমরা এই কালেমার মূল বিষয়বস্তু কী সেটা জানে না এবং জানার চেষ্টাও নেই। যারফলে শির্ক (আল্লাহর অংশীদারী) এবং বিদআত (রাসুল সাঃ এর অননুমোদিত ইবাদত) ইত্যাদি ধর্মে অনুপ্রবেশ করেছে। এখন শির্ক বিদআত (সত্যিকার অর্থে) কী সেটা জানে এমন মুসলিম পাওয়া দুষ্কর। অথচ আল্লাহ দুনিয়ায় লক্ষ হাজার নবী রাসুল পাঠিয়েছেন শুধু শির্ক মুক্ত করে তাওহীদ প্রতিষ্ঠা করার জন্য। এই একত্ববাদের কথা বলার জন্যই রাসুল (সাঃ)কে মক্কা থেকে মৃত্যু পরোয়ানা নিয়ে মদীনায় হিজরত করতে হয়েছিল। আর সেই একই একত্ববাদের কথা আমাদের দেশে চালু আছে বলে মনে হচ্ছে না।
এখন আমরা আল্লাহর পাশাপাশি আল্লাহর বিভিন্ন বান্দাকেও ইবাদতের আসনে বসিয়ে দিচ্ছি। সেটা হোক তাদের আইনকানুনকে মেনে নিয়ে হোক তাদেরকে আল্লাহর গুণাবলীতে ভূষিত করে। ইসলাম কখনোই এইসব সমর্থন করে না। অথচ আজ আমরা এইসব করেই নিজেদের মুসলিম দাবি করি। কেননা আমরা ধরেই নিয়েছি বাহ্যিকভাবে সালাত, সিয়াম, হজ্জ্ব যাকাত ইত্যাদিই হচ্ছে ইসলাম। আমাদের আলেমরাও (স্বার্থের কারণে) কখনো এইসব নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করে না। সুতরাং আজ আমরা যারা নিজেদের মুসলিম দাবি করি তাদের অধিকাংশই ইসলাম থেকে বিচ্যুত।
শুধু তাইনয় ঈমানের যে ৭০টিরও শাখাপ্রশাখা আছে আমরা তাও জানি না। আমাদের সমাজে একেঅপরের জন্য উদারতা, বন্ধুত্ব, ভাতৃত্ববোধ, ন্যায়বিচার ইত্যাদি বিষয় সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। কে কাকে ঠকিয়ে দুনিয়ার স্বার্থ আদায় করবে সেই চিন্তায় রত। অথচ ইসলাম বলে মুমিনগণ একটি দেহের মতো। কোনো মুমিন কষ্ট পাওয়া মানে দেহের মধ্যে ব্যাথা অনুভূত হওয়া। কিন্তু আমাদের সমাজে নিজের ভাই বন্ধু সহ নিকট আত্মীয় কষ্ট পেলেও আমরা ফিরে তাকাই না। এইসব করে কখনোই নিজেদের ঈমানদার এবং মুসলিম দাবি করা যাবে না।
সালাতঃ
আমাদের সমাজে অনেকেই সালাত আদায় করে পরিপূর্ণ সালাত সম্পর্কে না জেনে। খুব কম মানুষই সালাত পরিপূর্ণ করে। আমরা না বুঝেই সালাত আদায় করি। অথচ সালাত মানুষকে সকল পাপ থেকে দূরে রাখে। কিন্তু আমাদের সমাজে বড় বড় পাপী দূর্নীতিবাজ, ঘুষখোর সুদখোর, হারামখোর ইত্যাদি ব্যক্তিবর্গ সালাতে সবার আগের কাতারে দাঁড়ায়। সবাই তাদের সম্মান করে মান্য করে। যেন তারা যা(অন্যায়) করে তা কোনো ব্যাপারই নয়। অথচ ইসলাম শিক্ষা দেয় সর্বপ্রকার পাপীদের ঘৃণা করে তাদের সাথে সম্পর্ক না রাখতে। বরং তাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে। আর আমরা তাদের সাথেই সম্পর্ক বেশী রাখি দুনিয়াবী সুবিধার আশায়।
আরেক শ্রেণী আছে ছেলেমেয়ে বিয়ে দেওয়ার পরই সাধারণত সালাত আদায় নয় বরং পড়ার চেষ্টা করে। যৌবন বয়সে খুব কম মানুষই সালাত আদায় করে। অথচ সালাত হচ্ছে মুসলমান এবং কাফেরদের মধ্যে পার্থক্য। সালাত অনাদায়িকারী নিকৃষ্ট কুফরে লিপ্ত। কিন্তু সালাত আদায় না করেও নিজেদের মুসলমান দাবিকারী মানুষই আজ চারদিকে ভরপুর। এইসবের মূল কারণ হচ্ছে আমরা কুরআন জানি না। প্রতিদিন সালাতে যে সূরা ফাতিহা পড়া হয় সেটার অর্থও জানি না। যদি আমরা কুরআন জানতাম তাহলে অবশ্যই আমরা যেকোনো প্রকার পাপ থেকে দূরে থাকতাম। সেইসাথে কারা পাপী এবং তাদের বিষয়ে আল্লাহর ফয়সালা কী সেটাও জানতে পারতাম। কিন্তু দুঃখের বিষয় শুধুমাত্র আলেমরা ছাড়া আমরা কেউ কুরআন জানি না। যারফলে আমরা সমাজের বিভিন্ন পাপ এবং পাপীদের ব্যাপারে উদাসীন। এই উদাসীনতাই আজ ইসলাম ধ্বংসের মূল কারণ।
হজ্জ্বঃ
আমাদের দেশে একশ্রেণির বড়লোক আছে, যারা নিজেদের নামের আগে হাজী এবং আলহাজ্ব লাগানোর জন্য হজ্জ্বে যায়। অথচ হজ্জ্ব করার অনেক নীতিমালা আছে। সেইসাথে হজ্জ্ব করে আসার পর রয়েছে একটি শৃঙ্খল জীবন। অথচ আমাদের সমাজে সম্মান পাওয়ার আশায় হজ্জ্ব করে। এমন এমন ব্যক্তিরাই হজ্জ্ব করছে যাদের আয়ের পথ অবৈধ। অথবা টাকার জোরে হজ্জ্ব করছে, কিন্তু তার আত্মীয়স্বজন রয়েছে যারা দুবেলা খেতে পারে না। আল্লাহ হজ্জ্ব করার জন্য অবশ্যই বলেছেন, কিন্তু আশেপাশের মানুষকে সাহায্য সহযোগিতা না করে কখনোই হজ্জ্ব কবুল হতে পারে না। তাছাড়া হজ্জ্ব হচ্ছে নিজেদের পাপ মুছে এসে নতুন করে পরিচ্ছন্ন জীবনযাপন করা। আর আমাদের দেশে দেখা যায় হাজীরাই বেশী পাজি। নিজের পরিবারকে শুদ্ধ করা তো দূরের কথা, হাজী সার্টিফিকেট নিয়ে এসে অধিকাংশই পুরোদমে মানুষের হক নষ্টের মতো গর্হিত কাজে লিপ্ত হয়। এর একমাত্র কারণ আমরা ইসলামকে না জেনেই পালন করি। হজ্জের মধ্যে যেসব আহকাম আছে তা আমরা জেনে পালন করি না। অথচ সেখানে যে শিক্ষা দেওয়া হয় তা হাজীদের জীবনে অনুপস্থিত। সুতরাং একধরনের লোক দেখানো অনুষ্ঠানের মতোই হজ্জ্ব পালন করছি আমরা।
যাকাতঃ
যাকাত ইসলামী অর্থনীতি ব্যবস্থার মূল ভিত্তি। যদি সবাই সঠিক নিয়মে যাকাত প্রদান করে তাহলে সমাজে ধনী দরিদ্রের এতো বৈষম্য সৃষ্টি হতোনা। কিন্তু এখন যাকাত দেওয়ার পদ্ধতি হয়ে গেছে লোক দেখানো। মানুষ জানুক আমি যাকাত দিচ্ছি এই মানসিকতা নিয়ে সিংহভাগ মানুষ যাকাত প্রদান করে। অথচ যাকাত দেওয়ার পদ্ধতি এটা নয়। যাকাত দিতে হবে এমন ভাবে যাতে, যাকে যাকাত দেওয়া হচ্ছে সে যেন পরিপূর্ণ স্বাবলম্বী হয়ে উঠতে পারে। আল্লাহ কোয়ান্টিটি নয় বরং কোয়ালিটিফুল যাকাত দিতে বলে। যদি সত্যিকার ভাবে আমরা যাকাত দিয়ে প্রতি বছর প্রত্যেকে এক একজনকে স্বাবলম্বী করতে পারি তবে সমাজে ধনী গরিবের ব্যবধান কমে আসতো।
শুধু তাইনয় আমাদের সমাজে কর্জে হাসানা নামক ঋণ দেওয়ার ব্যবস্থাও নেই। আমরা জানি না কর্জে হাসানা কী জিনিস। ধনীদের উচিত কর্জে হাসানা দিয়ে নিকট আত্মীয়স্বজনের সাহায্য করা। যদি এটা সম্ভব হতো তাহলে সমাজে এতো এতো সুদী এনজিওর আবির্ভাব হতো না। এইসব সুদের কারবারে সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হচ্ছে। যে সুদ আল্লাহ হারাম করেছেন সেই সুদ ই এখন প্রতিটি মুসলমানের ঘরে ঘরে পৌঁছে গেছে। তাও আবার নারীদের মাধ্যমে যার বৈধতা ইসলামে নেই।
কুরবানীঃ
আমাদের দেশে হিসাব করা হয় কে কত বড় পশু দিয়ে কুরবানী করছে। বড়লোকেরা নিজেদের সম্মান বিত্তবৈভব দেখানোর জন্য বাজার থেকে বড় গরু ক্রয় করে। কিন্তু নিজেদের মধ্যে থাকা পশুত্বকে কখনোই বিসর্জন দিতে পারে না। কুরবানী অর্থ হলো বিসর্জন দেওয়া। আল্লাহর রাস্তায় নিজেদের বিসর্জন। শুধু টাকা দিয়ে গরু কিনলেই কখনো সত্যিকারে কুরবানী আদায় হবে না। যতক্ষণ না ইসলাম যা বলেছে তা পালন করতে না পারবে। আমাদের সমাজে ভাইয়ে ভাইয়ে অমিল, একে অন্যের কুৎসা রটানো, একজনের হক অন্যজনে জবরদখল করা ইত্যাদি নানান অপকর্ম ভরপুর। শুধু তাইনয় কুরবানী করে নিকট আত্মীয়দের না দিয়ে অনেকে নিজেরাই ফ্রিজজাত করে। সঠিক পরিমাপে কুরবানী কেউ বন্টন করে না। ইসলামী সঠিক অনুশাসন না থাকার কারণে আমরা আজ সেইসব থেকে অনেক দূরে। সুতরাং কুরবানী দিয়ে পশু জবাই নয়। বরং নিজেদের আত্মঅহমিকাসহ সমস্ত পাপকে বিসর্জন দিয়ে সত্য সুন্দরের পথে আসাই হচ্ছে কুরবানীর প্রকৃত শিক্ষা।
মাদক জুয়া অশ্লীলতাঃ
আমাদের মুসলিম সমাজের প্রতিটি ঘরে ঘরে অশ্লীলতা পৌঁছে গেছে অনেক আগেই। খুবই কম সংখ্যক পরিবার নিজের এই অশ্লীলতার জোয়ার থেকে রক্ষা করার চেষ্টা করছে। তারপরও বিভিন্ন কারণে সমাজে ব্যাভিচারী কর্ম বেড়ে যাচ্ছে। সরকারিভাবে পতিতাবৃত্তিকে অনুমোদন দিয়ে সমাজকে অশ্লীলতার চরম পর্যায়ে নিয়ে গেছে। শুধু তাইনয় বিয়ে, গায়েহলুদ জন্মদিন ইত্যাদি অনুষ্ঠানে যে পর্যায়ে বেহায়াপনা এবং অশ্লীল কর্মকান্ড হয় তা অনেক ক্ষেত্রে বিধর্মীদেরও হার মানায়। যা ইসলাম সমর্থিত নয়।
আধুনিক সভ্যতায় নিত্যনতুন মাদকের ছড়াছড়ি। আজ চারদিকে মাদক আর জুয়ার যে ভয়াল চিত্র দেখতে পাচ্ছি তা কোনো বিধর্মী সমাজের নয় বরং মুসলিম সমাজের। প্রতিটি পরিবারে কেউ না কেউ আজ মাদক ও জুয়ায় ডুবে আছে। বিশেষ করে নিম্নবিত্ত এবং উচ্চবিত্ত সমাজে। উচ্চবিত্ত সমাজের লোকদের কেউ কিছু বলে না সাহায্য পাওয়া বিঘ্ন হবে বলে। আর নিম্নবিত্তদের কেউ কিছু বলে না সাহায্য করতে হবে বলে। আর মধ্যবিত্ত সমাজে চেষ্টা করা হয় যতটুকু পারা যায় নিয়ন্ত্রণ করতে । কিন্তু সঠিক ইসলামী অনুশাসন না থাকার কারণে তারাও ব্যর্থ হয়।
এই মাদক ও জুয়া সম্পর্কে ইসলাম খুবই কঠোর। কিন্তু সঠিক ইসলাম প্রচার এবং চর্চার না করার কারণে সাধারণ মুসলমানগণ এটা নিয়ে যৌথভাবে চিন্তা করে না। আর তাই বর্তমান মুসলিম সমাজে মাদক, জুয়া পতিতাবৃত্তির কারণে দিন দিন ধ্বংসের দিকে ধাবিত হচ্ছে। আমরা নিজেদের মুসলিম দাবি করি, কিন্তু ইসলামকে মেনে এখনো মুসলিম হতে পারিনি
সুদঃ
বর্তমান মুসলিম সমাজে হাহাকার হওয়ার অন্যতম কারণ সুদ। আজ মুসলমান গণ জানেই না সুদ হারাম। সুদ এবং মদ সম্পর্কিত দশ ব্যক্তির আয় হারাম। কিন্তু আমাদের অজ্ঞতার কারণে অনায়াসে সুদ দিচ্ছি এবং নিচ্ছি। যা ইসলাম কখনোই সমর্থন করে না। ইসলাম সুদের পরিবর্তে যাকাত এবং কর্জে হাসানার মতো বিধান রেখেছে। কিন্তু আলেমরাও বলে না আমরাও জানি না। এইসব বিষয়ে না জেনে একটি আনুষ্ঠানিক ইসলাম পালন করছি আমরা।
উপরোক্ত বিষয়গুলো খুব গভীরভাবে খেয়াল করলে দেখতে পাবো যে, আমরা আজ নামেমাত্র মুসলিম আছি। শুধু মুখে কালেমা পড়ে বা জন্মগত মুসলমান হয়ে কখনোই সঠিক মুসলিম হওয়ার যায় না। আজ আমরা ঈমানের যে দাবি সেটা পালন করি না। ইসলামের যে মূল বিষয়গুলো আছে তা সঠিক নিয়মে আদায় করিনা। শুধু লোক দেখানো কিছু আচার অনুষ্ঠান করে নিজেদের মুসলিম হিসাবে জাহির করি। যতদিন সত্যিকারের ইসলাম কায়েম করা যাবে না ততদিন আমরা প্রকৃত মুসলিম হতে পারবো না। আজ আমরা মুসলিম ঠিক আছে, তবে তা মুনাফিকী মুসলিম। আমরা আমাদের সুবিধামতো ইসলামকে ব্যবহার এবং আদায় করছি। আসুন আমরা চেষ্টা করি যতটুকু সম্ভব পারা যায় সঠিক ইসলামের অনুসরণ করি। আর এটা করতে হলে অবশ্যই ইসলামকে জানার চেষ্টা করতে হবে। বেশী বেশী কুরআন এবং হাদীসের নিজের ভাষায় চর্চা করতে হবে।
সঠিক ইসলাম জানতে আরও পড়ুনঃ
লা ইলাহা ইল্লাল্লার ব্যাখ্যা
ইবাদতের শির্ক
আবু জাহেলের ইসলাম এবং আমরা