শুধু পীরেরাই আল্লাহর অলি নয়
প্রাক কথা
আমাদের উপমহাদেশে আল্লাহর অলি শব্দটি খুবই পরিচিত। সাধারণত মুসলমানদের মধ্যে যারা সুফিবাদে বিশ্বাসী, তারা অলি আউলিয়াদের অন্যরকম চোখে দেখে। তাদের প্রতি একধরনের অগাধ বিশ্বাস ও ভালোবাসা পরিলক্ষিত হয়, যা শুধুমাত্র আল্লাহর জন্যই প্রযোজ্য। তাই আল্লাহর অলি সম্পর্কে সঠিক তথ্য জানতে হলে প্রথমত সুফিবাদ সম্পর্কে বিস্তারিত জানা আবশ্যক।
কেননা সুফিবাদীরা পীর এবং তাদের কথিত অলি আউলিয়াদেরই শুধুমাত্র আল্লাহর অলি বা বন্ধু রূপে স্বীকার করে ও দাবি করে। তাদের মতে শুধুমাত্র পীর অলিরাই একমাত্র আল্লাহর অলি। তারা ছাড়া আর কেউ আল্লাহর অলি নয় বা হতে পারে না। অর্থাৎ তাদের স্বীকৃত অলি আউলিয়া যারা আছেন তারা এবং তাদের সন্তান বা তাদের বংশপরস্পরায় যারা আসবেন তারাই হবেন শুধুমাত্র আল্লাহর অলি। সেইসাথে আল্লাহ্ নয়, বরং তাদের স্বীকৃতি অলি আউলিয়ারাই আল্লাহর অলি তৈরি করেন বা খেলাফত দেন।
আজ আমরা কুরআন হাদিসের আলোকে আল্লাহর " অলি " কাকে বলে, এবং কারা আল্লাহর অলি, কীভাবে বা কী আমল করলে আল্লাহর অলি হওয়া যায়, বা কী কী গুণ থাকলে আল্লাহর অলি হওয়া যায় তা জানার চেষ্টা করবো ইনশাআল্লাহ। সেইসাথে কথিত পীরেরাই যে শুধুমাত্র আল্লাহর নয়, এটার প্রমাণ কুরআন হাদীস থেকে জানার চেষ্টা করবো।
আরও পড়ুন কুরআনের আলোকে মানুষ সৃষ্টির কারণ
অলি কাকে বলেঃ
অলি আরবি শব্দ। যার অর্থ হলো অভিভাবক বা মুরুব্বি, বন্ধু। আরবি ভাষায় “আউলিয়া” শব্দটি অলির বহুবচন। 'অলি' অর্থ বন্ধু, মিত্র বা অনুসারী। কখনো শব্দটির অর্থ হয় শাসক, অভিভাবক বা কর্তা। (তথ্যসূত্র- আরবি-বাংলা অভিধান, প্রকাশনায় ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ)।
অলি দুই প্রকার
ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে অলি বা বন্ধু বা অনুসারী দুই প্রকারের হয়।
১) আল্লাহর অলিঃ
আল্লাহর অলি বা বন্ধু হলো তারা, যারা আল্লাহ্ এবং তাঁর রাসুলের প্রতি ঈমান এনে নিজেকে মুমিন দাবি করে। এবং আল্লাহর পরিপূর্ণ বিধান অনুযায়ী জীবনযাপন করে তারা হচ্ছে আল্লাহর অলি।
২) শয়তানের অলিঃ
শয়তানের অলি বা বন্ধু হলো যারা সরাসরি আল্লাহর প্রতি ঈমান আনে না, অথবা ঈমান আনলেও আল্লাহর নির্দেশিত পথে না চলে শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করে তাকে বলা হয় শয়তানের অলি।
পবিত্র কুরআনে আল্লাহর অলি এবং শয়তানের অলি উভয় প্রকারের অলি জন্যই আয়াত নাযিল হয়েছে। এইসব আয়াতের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করে আমরা জানার চেষ্টা করবো আসলেই কি শুধু কথিত সুফিবাদের পীরেরাই আল্লাহর অলি? নাকি যেকোনো সাধারণ মুমিন মুত্তাকী মুসলিম আল্লাহর অলি হতে পারেন।
যেকারণে শুধু পীরেরাই আল্লাহর অলি নয়ঃ
উপমহাদেশের সুফিদের দাবি, শুধুমাত্র তাদের পীর অলি আউলিয়ারাই হচ্ছেন আল্লাহর অলি। তারা ছাড়া আর কেউ আল্লাহর অলি হতে পারে না। সেইসাথে তারা দাবি করে যে, তাদের অলি আউলিয়ারাই আল্লাহর অলি সৃষ্টি করেন। অর্থাৎ তাদের হাতেই আল্লাহর অলির জন্ম হয়।
কিন্তু এটা সত্য নয়। কেননা আল্লাহ্ পবিত্র কুরআনে আল্লাহ্ তাঁর বান্দাদের মধ্যে যারাই তাঁর প্রতি ঈমান আনে তাদেরকে তাঁর অলি বা বন্ধু রূপে সম্বোধন করেছেন। আল্লাহ্ বলেন,
" মনে রেখো যারা আল্লাহর বন্ধু, তাদের না কোন ভয় ভীতি আছে, না তারা চিন্তান্বিত হবে। যারা ঈমান এনেছে এবং তাকওয়া অবলম্বন করেছে "। (সূরাঃ ইউনুস, আয়াতঃ ৬২, ৬৩)
উপরোক্ত আয়াতে আল্লাহ্ সুস্পষ্ট ঘোষণা দিচ্ছেন যে, যারাই (পরিপূর্ণ) ঈমান আনবে এবং সেইসাথে তাকওয়া অবলম্বন করবে। তারাই হবে আল্লাহর অলি বা বন্ধু। আর যারাই আল্লাহর বন্ধু হবেন, তাঁরা কখনোই চিন্তিত হবেননা এবং তাঁদের কখনোই কোনো ভয় থাকবে না।
উপরোক্ত আয়াত দ্বারা আল্লাহ্ মুসলিম সমাজের কোনো সুনির্দিষ্ট শ্রেণীকে (পীরকে) আল্লাহর বন্ধু বলে স্বীকৃতি দেননি। বরং আল্লাহর বন্ধু হওয়ার জন্য শর্ত জুড়ে দিয়েছেন যে, যারাই পরিপূর্ণ ঈমান তথা শির্ক মুক্ত বিশ্বাস এবং বিদআত মুক্ত আমল করবে। সেইসাথে তাকওয়া তথা সার্বক্ষণিক আল্লাহর ভয় তাদের অন্তরে বিরাজ করবে তাঁরাই হবে প্রকৃত আল্লাহর অলি তথা বন্ধু।
এমতাবস্থায় যেসব মুমিন এই দুটি গুণ অর্জন করতে পারবেন একমাত্র তাঁরাই হবেন আল্লাহর অলি। সুতরাং কুরআনের আলোকে ঈমান ও আমল ছাড়া আল্লাহর অলি হওয়া কখনোই জন্মগত বা বংশগত নয়। শুধু তাইনয় কে আল্লাহর বন্ধু তা কাউকে দেখেও জানা যাবে না। কারণ আল্লাহ্ এই পর্যন্ত কোথাও উল্লেখ করেননি যে অমুক অমুক বান্দা আমার বন্ধু শুধুমাত্র ইব্রাহীম আঃকে ছাড়া।
অতএব সুফিবাদীরা তাদের পীর আউলিয়াদেরই শুধুমাত্র আল্লাহর অলি বলে যে স্বীকৃতি দিয়ে থাকেন তা এই আয়াত দ্বারা ভুল প্রমাণিত হলো। কেননা আল্লাহ্ তাঁর অলি বা বন্ধু হওয়ার জন্য দুটি শর্ত দিয়েছেন। যার একটি হলো "ঈমান ", অন্যটি হলো "তাকওয়া "।
এই ঈমান যেকোনো মুসলিমেরই আছে। সুতরাং যে মুসলিম পরিপূর্ণ ঈমানের অধিকারী অর্থাৎ শির্কমুক্ত বিশ্বাস এবং বিদআতমুক্ত আমলের দাবিদার। সেইসাথে নির্ভেজাল তাকওয়ার ( অর্থাৎ আল্লাহর ভয়) অধিকারী তিনিই হলেন আল্লাহর অলি।
তাহলে যেসব মুমিন ঈমান আমল আকিদা ও তাকওয়া দ্বারা নিজেদেরকে সমৃদ্ধ করতে পারবে তারাই আল্লাহর অলি বলে আল্লাহর কাছে বিবেচিত হবে। শুধু তাইনয় আল্লাহ্ পবিত্র কুরআনে সরাসরি ঘোষণা দিচ্ছেন যে,
" যারা ঈমান এনেছে, আল্লাহ তাদের অভিভাবক।" (সূরা বাকারা ২ -২৫৭)
অর্থাৎ যারাই প্রকৃতভাবে ঈমান আনবে আল্লাহ্ হবেন তাঁদের অভিভাবক। আর যার অভিভাবক আল্লাহ্ তার কি দুনিয়ায় আর কিছু চাওয়া পাওয়ার আছে? সুতরাং যাঁরাই সত্যিকারের ঈমানের দাবিদার তাঁরাই হচ্ছেন প্রকৃত আল্লাহর অলি বা বন্ধু। সুতরাং শুধুমাত্র সুফিদের পীর আউলিয়ারাই আল্লাহর অলি তা কখনোই সত্য নয়। কেননা কুরআন থেকে "পীরের " স্বপক্ষে কোনো দলিল নেই যে শুধুমাত্র সুফিদের পীরেরাই আল্লাহর অলি। আল্লাহ্ আরও বলেন,
" (হে ঈমানদারগণ) তোমাদের বন্ধু তো আল্লাহ তাঁর রসূল এবং মুমিনবৃন্দ-যারা নামায কায়েম করে, যাকাত দেয় এবং বিনম্র। (সূরাঃ আল মায়িদাহ, আয়াতঃ ৫৫)
উপরোক্ত আয়াত দ্বারাও একই কথা সাব্যস্ত হয় যে, যাঁরাই প্রকৃত ঈমানদার তাদের বন্ধু হলেন আল্লাহ্, তাঁর রাসুল এবং সেইসব মুমিন বা মুসলমানগণ, যাঁরা পরিপূর্ণ সালাত কায়েম করে এবং পরিপূর্ণভাবে যাকাত দেয় এবং যারা হচ্ছেন বিনয়ী ও বিনম্র। সুতরাং যাঁরাই এইসব গুণের অধিকারী হবেন তাঁরাই হবেন আল্লাহর অলি।
ঈমান আমল ছাড়া আল্লাহর বন্ধু হওয়া কখনোই বংশগত বা জন্মগত বা অধিকাংশ মানুষের দ্বারা স্বীকৃত কোনো বিষয় নয়। বরং এটা ঈমান আকিদা এবং আমল দ্বারা অর্জনের বিষয়। সুফিরা শুধুমাত্র তাদের পীরদেরই আল্লাহর অলি বলে দাবি করেন। অথচ সুফিবাদীদের ঈমান আকিদা বিশ্লেষণ করলে আমরা দেখতে পায় যে, তাদের সালাত সিয়ামের বালাই নেই। সুফিবাদ একটি শির্কি বিদআতী আকিদা। যাদের আকিদাই হলো শির্ক বিদআত করা। তারা কীভাবে আল্লাহর অলি হতে পারে? আল্লাহ্ অন্য আয়াতে বলেন,
" মানুষদের মধ্যে (অতীতে) যারা ইব্রাহীমের অনুসরণ করেছিল তারা, আর এই নবী (মুহাম্মদ) এবং যারা এ নবীর (অর্থাৎ মুহাম্মদের) প্রতি ঈমান এনেছে তারা ইব্রাহীমের ঘনিষ্ঠতম-আর আল্লাহ হচ্ছেন মুমিনদের বন্ধু।" (সূরাঃ আল ইমরান, আয়াতঃ ৬৮)
উপরোক্ত আয়াতে আল্লাহ্ কুরআনে ঘোষিত তাঁর বন্ধু ইব্রাহীমের ঘনিষ্ঠজন কারা তার উল্লেখ করেছেন। এবং সেইসাথে এটা উল্লেখ করেছেন যে, যারা ঈমান এনে মুমিন হয়েছেন আল্লাহ্ তাদের বন্ধু।
অতএব, এই আয়াত দ্বারাও এটা প্রমাণিত হচ্ছে যে, যারা প্রকৃত মুমিন তারাই হচ্ছেন আল্লাহর বন্ধু। এই আয়াতেও আল্লাহ্ কোনো সুনির্দিষ্ট বংশ গোষ্ঠী বা কারো দ্বারা স্বীকৃত পীর আউলিয়াদের অলি বলে স্বীকৃতি দেননি। যারাই পরিপূর্ণ ঈমানদার হবেন তারাই আল্লাহর অলি বা বন্ধুতে পরিনত হবেন। আল্লাহ্ আরও উল্লেখ করেন,
"আর আল্লাহ পরহেযগারদের বন্ধু"। (সূরাঃ আল জাসিয়া, আয়াতঃ ১৯)
অর্থাৎ যারা পরিপূর্ণ ঈমান এনে রাসুল সাঃএর আদর্শে আদর্শিক হয়ে তাকওয়ার সহিত আমল করে নিজেদের সকল প্রকার পাপ থেকে মুক্ত রাখতে পেরেছে তারা হচ্ছেন পরহেজগার। আর যাঁরাই পরহেজগার তাঁরাই হচ্ছেন আল্লাহর বন্ধু। অতএব যে মুমিন নিজের ঈমান আকিদা ও আমল দিয়ে আল্লাহ্কে রাজি খুশি করতে পেরেছে, তিনিই হচ্ছেন প্রকৃত আল্লাহর অলি বা বন্ধু। সুতরাং এখানেও ঈমান আমল ছাড়া বংশগত বা জন্মগতভাবে কিংবা মানুষের স্বীকৃতি দ্বারা আল্লাহর অলি হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। পরহেজগারী ব্যতীত যে কাউকে আল্লাহর অলি ভাবা যাবে না।
এটা সর্বজনীনভাবে স্বীকৃত যে, শুধু সুফিবাদীদের পীর আউলিয়ারাই কেবলমাত্র আল্লাহর অলি নয়। তারা যদি আল্লাহর অলি হওয়ার গুণাবলী অর্জন করতে পারে তাহলে তবেই তারা আল্লাহর অলি হবেন। আল্লাহ্ আরও বলেন,
"তোমাদের মধ্যে আল্লাহর নিকট সেই ব্যক্তিই অধিক মর্যাদাসম্পন্ন যে তোমাদের মধ্যে অধিক মুত্তাকী।'' (সূরা হুজুরাত ৪৯ : ১৩)
উপরোক্ত আয়াত থেকে বুঝা যায় যে, বন্ধুর বন্ধুত্বেরও প্রকারভেদ রয়েছে। বন্ধু, কাছের বন্ধু, ঘনিষ্ঠ বন্ধু ইত্যাদি প্রকারভেদের মতো, আল্লাহর কাছে সেই ব্যক্তিই অধিক মর্যাদাবান বা ঘনিষ্ঠ বন্ধু। যে অধিক মুত্তাকী। যিনি অধিক তাকওয়ার অধিকারী তিনিই হচ্ছেন মুত্তাকী। আর কে মুত্তাকী তা একমাত্র আল্লাহ্ই ভালো জানেন। সাধারণ কোনো মানুষের পক্ষে কে মুত্তাকী বা কে মুত্তাকী নয় তা নিরুপণ করা সম্ভব নয়।
সুতরাং আল্লাহর অলি হলেন তাঁরা যারা অধিক তাকওয়াবান। যারাই তাকওয়ার অধিকারী হবেন তারাই আল্লাহর আল্লাহর অলি বা বন্ধু হয়ে যাবেন। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, কোনো মানুষের তাকওয়া কি কখনোই বাইরে থেকে বুঝা যায়? কেননা তাকওয়া হচ্ছে আল্লাহ্ ভীতি। যা যেকোনো মানুষের অন্তরের বিষয়। এই তাকওয়ার খবর একমাত্র আল্লাহ্ ছাড়া আর কেই জানে না। তাহলে মানুষেরা যদি কাউকে আল্লাহর অলি স্বীকৃতি দেয়, তা তারা কীভাবে দিচ্ছে? তারা কি ঐ ব্যক্তির তাকওয়া নিরুপণ করেছে? নাকি আল্লাহ্ তাদের ওহী করেছে যে অমুক ব্যক্তি আমার বন্ধু!
সুতরাং এই তাকওয়া কোনো নির্দিষ্ট বংশ গোষ্ঠী বা শ্রেণীর জন্য নির্ধারিত নয়। এটা একমাত্র আল্লাহর বিষয়। অতএব তাকওয়া ছাড়া যাকে তাকে আল্লাহর অলি ডাকা বা ভাবা যাবে না। যদি কারও এই গুণ থেকে থাকে তিনি কি তা সবাই জানিয়ে দিবেন? কেননা তিনি যদি তার এই তাকওয়ার গুণ সবাইকে জানিয়ে দেন তাহলে তা হবে রিয়া! যা ইসলামে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। অতএব কারও তাকওয়া আছে বা নেই তা শুধুমাত্র আল্লাহ্ দ্বারাই নির্ধারিত।
আল্লাহ্অলারই আল্লাহর অলিঃ
যাঁরা পরিপূর্ণ ঈমান আমলের মাধ্যমে আল্লাহ্কে রাজি খুশি করতে পেরেছে তাঁরাই হচ্ছেন আল্লাহ্অলা। আর যারা সত্যিকারের আল্লাহ্অলা তাঁদের দেখলেই আল্লাহর কথা স্বরণ হয়। পবিত্র হাদীসে এসেছে,
হজরত সাইদ ইবনে জুবাইর (রা.) থেকে বর্ণিত, এক ব্যক্তি মহানবী (সা.)-কে জিজ্ঞাসা করেছেন, ‘হে আল্লাহর রাসুল! আল্লাহর অলি কারা?’ মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘যাদের দেখলে আল্লাহর কথা মনে হয়।’ (ইবনে মাজাহ, ইবনে কাসির)
অর্থাৎ যাদের ঈমান আকিদা আমলে পরিপূর্ণ ইসলামের বহিঃপ্রকাশ ঘটে, এবং যাঁদের দেখলেই আল্লাহর কথা স্বরণ হয়, তারাই হচ্ছেন প্রকৃত আল্লাহর অলি। একটু বিশ্লেষণ করে যদি বলি, আমাদের সমাজে এমন কিছু মানুষ আছে যারা যথেষ্ট পরহেজগার এবং ঈমান আখলাকের অধিকারী। তারা যখনই যেখানে যায় সেখানে দ্বীন বিরোধী কিছু হলেই তার প্রতিবাদ করেন। সেই কারণে সাধারণ মানুষেরা তাকে দেখলেই সাবধান হয়ে যান।
মোটকথা তিনি হচ্ছেন ইসলামের মূর্ত প্রতীক। অর্থাৎ ঐ ব্যক্তির সামনে দ্বীন বিরোধী এমন কিছু করা যায় না যা অন্যান্য সাধারণ মানুষের সামনে নির্দিধায় করা যায়। সেইসাথে এমন কিছু আল্লাহ্ অলা মানুষ আছে যাদের বেশভূষা চালচলন কথাবার্তা পরিপূর্ণ ইসলামের দর্পণ স্বরুপ। তাদের দেখলেই যেকোনো মানুষের অন্তরে আল্লাহর কথা স্বরণ হয়। এবং তাদের আচার আচরণ মানুষের মনে আল্লাহর প্রতি অনুরাগ সৃষ্টি করে। এরাই হচ্ছেন আল্লাহর অলি। যা তাদের ঈমান আমল দ্বারাই অর্জিত।
সফলকাম ব্যক্তিরাই আল্লাহর অলিঃ
যারা সত্যিকারের আল্লাহর বন্ধু হতে পেরেছে তারাই হচ্ছেন দুনিয়ায় সবচেয়ে বড় বেশী সফলকাম ব্যক্তি। আল্লাহ্ বলেন,
"(যারা আল্লাহর অলি) তাদের জন্য দুনিয়ার জীবন ও পরকালীন জীবনে রয়েছে সুসংবাদ। আল্লাহর কথার কখনো রদবদল হয় না। এটাই হল মহা সফলতা" (সুরা ইউনুস : আয়াত ৬৪)
অর্থাৎ যারা তাদের ঈমান আমল আকিদায় সত্যিকারের ঈমানদারের পরিচয় দিতে পেরেছে তাঁরাই হচ্ছেন আল্লাহর অলি। আর যারাই আল্লাহর অলি তারা দুনিয়াবী এবং পরকালীন উভয় জীবনেই সফল। কেননা তাঁরা আল্লাহর পক্ষ থেকে সুসংবাদ প্রাপ্ত। তাদেরকে কখনোই দুনিয়াবী কোনো দুঃখ দূর্দশা গ্রাস করতে পারে না। সুতরাং শুধু সুফিদের পীর আউলিয়ারাই আল্লাহর অলি নয়। যারাই ঈমান আকিদায় পরিপূর্ণ হতে পেরেছে তারাই হচ্ছেন আল্লাহর অলি।
শুধু তাইনয় যারা সত্যিকারের তাকওয়া অবলম্বন করে আল্লাহ্ তাদের ভালোবাসেন। আল্লাহ্ বলেন,
"নিশ্চয় আল্লাহ মুত্তাকীদেরকে ভালবাসেন।’’ (সূরা আল ইমরান:৭৬)
সুতরাং যারা মুত্তাকী, পরহেজগার তারাই হচ্ছেন প্রকৃত আল্লাহর অলি। যা কেউ শুধু পীর অলি আউলিয়ার বংশে জন্মগ্রহণ করার মাধ্যমে, কিংবা কিছু মানুষের সাক্ষ্য দ্বারা লাভ করতে পারে না। যা লাভ করতে হলে অবশ্যই সত্যিকারের ঈমান আমল আকিদার প্রমাণ থাকতে হবে। সুতরাং যারাই ঈমান আকিদার অধিকারী হয়ে নিজেদের মুত্তাকী পরহেজগারী রূপে প্রমাণিত করতে পেরেছে তাঁরাই হচ্ছেন আল্লাহর অলি। আল্লাহ্ আরও বলেন,
" আল্লাহ মুমিনদের হিতৈষী বন্ধু "।(সূরাঃ মুহাম্মদ, আয়াতঃ ১১)
অর্থাৎ যিনি সত্যিকারের মুমিন ব্যক্তি তাঁর বন্ধু হলেন আল্লাহ্। সুতরাং আল্লাহর বন্ধু বা আল্লাহর অলি হওয়া কখনোই জন্মগত বিষয় নয়। কিংবা কেউ কাউকে আল্লাহর অলি বানিয়ে দিতে পারে না। বা কোনো একটি নির্দিষ্ট বংশের মধ্যে বা কোনো একটি নির্দিষ্ট দেশ বা মহাদেশেই শুধু আল্লাহর অলিরা রয়েছে বা থাকবে এমন কোনো কিছুই নয়। পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তেই আল্লাহর অলি থাকতে পারেন বা যেকোনো মুত্তাকী ব্যক্তিই আল্লাহর অলি হতে পারেন।
আল্লাহর অধিক প্রিয়রাই আল্লাহর অলিঃ
যারাই আল্লাহর কাছে অধিক প্রিয় হবেন তাঁরাই হবেন আল্লাহর অলি বা বন্ধু। আল্লাহ্ পবিত্র কুরআনে আরও অসংখ্য আয়াতে তাঁর প্রিয় বান্দাদের কিছু গুণাবলীর বর্ণনা দিয়েছেন। আল্লাহ্ বলেন,
" রহমান-এর বান্দা তারাই, যারা পৃথিবীতে নম্রভাবে চলাফেরা করে এবং তাদের সাথে যখন মুর্খরা কথা বলতে থাকে, তখন তারা বলে, সালাম"। (সূরাঃ আল-ফুরকান, আয়াতঃ ৬৩)
আল্লাহর প্রিয় বান্দা তারা, যারা ব্যক্তিগতভাবে খুবই ভদ্র, নম্র এবং বিনম্রভাবে দুনিয়ায় চলাফেরা করে। সেইসাথে তারা মুর্খদের সাথে তর্কবিতর্ক করে না। সুতরাং যাদের এইসব গুণ রয়েছে তারা হচ্ছেন আল্লাহর প্রিয় বান্দা। আর যারাই আল্লাহর প্রিয় তারাই আল্লাহর অলি বা বন্ধু। অতএব এইসব গুণাবলী যেকোনো মুমিম বান্দার থাকলেই তিনি আল্লাহর প্রিয়পাত্র হতে পারেন। শুধুমাত্র নির্দিষ্ট কোনো শ্রেণী গোষ্ঠী বা বংশপরস্পরায় কেউ আল্লাহর অলি বা বন্ধু বা আল্লাহর প্রিয়পাত্র হতে পারে না। বা কেউ কাউকে আল্লাহর প্রিয়পাত্রতে রূপান্তরিত করতে পারে না। অন্য আয়াতে আল্লাহ্ বলেন,
" অহংকারবশে তুমি মানুষকে অবজ্ঞা করো না এবং পৃথিবীতে গর্বভরে পদচারণ করো না। নিশ্চয় আল্লাহ কোন দাম্ভিক অহংকারীকে পছন্দ করেন না। (সূরাঃ লোকমান, আয়াতঃ ১৮)
উপরোক্ত আয়াত থেকে বুঝা যায় আল্লাহ্ দাম্ভিক অহংকারীদের পছন্দ করেন না। সুতরাং যারা নিরহংকারী বা অহংকারমুক্ত তাদের আল্লাহ্ পছন্দ করেন। আর যারাই নিরহংকারী তারাই আল্লাহর প্রিয় এবং তাঁর বন্ধু। অথচ সুফিবাদীদের পীরেরা নিজেদের কার কত মুরিদ তা নিয়েই প্রকাশ্যে অহংকার করে। তারা কীভাবে নিজেদের মুরিদ ভক্ত অনুসারী বাড়ানো যায় তা নিয়েই ব্যতিব্যস্ত থাকে। কেননা এই মুরিদ ভক্ত অনুসারীদের হাদিয়া তোফা দিয়েই তারা নিজেদের ভোগ বিলাসী জীবনযাপন করে। যাদের চরিত্রে দুনিয়ামুখী এমন গুণ থাকে তারা কীভাবে আল্লাহর অলি হতে পারেন? শুধু তাইনয় আল্লাহ্ বলেন,
" তারা আল্লাহর প্রতি ও কিয়ামত দিবসের প্রতি ঈমান রাখে এবং কল্যাণকর বিষয়ের নির্দেশ দেয়; অকল্যাণ থেকে বারণ করে এবং সৎকাজের জন্য সাধ্যমত চেষ্টা করতে থাকে। আর এরাই হল সৎকর্মশীল"। (সূরাঃ আল ইমরান, আয়াতঃ ১১৪)
" আর যারা সৎকর্মশীল আল্লাহ তাদেরকে ভালবাসেন"। (সূরাঃ আল ইমরান, আয়াতঃ ১৪৮)
" সৎকর্মশীলগণ থাকবে জান্নাতে"। (সূরাঃ আল ইনফিতার, আয়াতঃ ১৩)
উপরোক্ত আয়াত গুলো থেকে এটা সুস্পষ্ট যে, মুমিনদের মধ্যে যারা আল্লাহর প্রতি পরিপূর্ণ ঈমান রাখে, ভালো কাজের নির্দেশ দেয়, অসৎ কাজে বাঁধা দেয় এবং নিজেরাও সৎকাজ করে তারা হলেন আল্লাহর সৎকর্মশীল বান্দা। আর যাঁরা সৎকর্মশীল বান্দা তাঁদের আল্লাহ্ ভালোবাসেন। এবং তাঁরাই হবেন জান্নাতের চিরস্থায়ী বাসিন্দা।
সুতরাং যাঁরাই সৎকর্মশীল এবং জান্নাতের উত্তরাধিকারী তাঁরাই হচ্ছেন আল্লাহর বন্ধু ও প্রিয় বান্দা। অতএব এই আয়াত দ্বারা দেখা যাচ্ছে যারাই আল্লাহর পছন্দের গুণাবলী অর্জন করতে পারবেন তারাই শুধুমাত্র আল্লাহর প্রিয় বান্দা হতে পারবে।
এই হিসাবে সুফিদের পীরেরা এই গুণাবলী অর্জন করলে তারাও আল্লাহর অলি হবেন। কিন্তু বাস্তবে আমরা কী দেখি? সুফিদের ঈমান আকিদা সরাসরি ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক। তারা তাদের অনুসারীদের কল্যাণকর কাজে নির্দেশ না দিয়ে দ্বীন ইসলাম বিরোধী সুফিবাদী মতাদর্শের দিকে আহবান করে।
সেইসাথে তারা এমন এমন সব কাজের নির্দেশ দেয় যা সরাসরি কুরআন সুন্নাহর বিরোধী এবং দ্বীনের জন্য অকল্যাণকর। শুধু তাইনয় তারা নিজেরাও যেসব আকিদা পোষণ এবং আমল করে তা কখনোই ইসলামের দৃষ্টিতে সৎকাজ নয়।সুতরাং সুফিবাদী পীরেরা কীভাবে আল্লাহর অলি হতে পারেন বা আল্লাহর অলি সৃষ্টি করতে পারেন? যেখানে তারা নিজেরাই আল্লাহ্ বিরোধী অসংখ্য কাজে জড়িত।
আরও পড়ুন বিশ্বকাপ ফুটবল এবং আমাদের ঈমান আকিদা
আল্লাহর অলিরা সুসংবাদপ্রাপ্তঃ
আল্লাহ্ তাঁর প্রকৃত ঈমানদারেরকে (দুনিয়া এবং আখিরাতের) সুসংবাদ দিয়ে থাকেন। আল্লাহ্ বলেন,
"তারা তওবাকারী, এবাদতকারী, শোকরগোযার, (দুনিয়ার সাথে) সম্পর্কচ্ছেদকারী, রুকু ও সিজদা আদায়কারী, সৎকাজের আদেশ দানকারী ও মন্দ কাজ থেকে নিবৃতকারী এবং আল্লাহর দেওয়া সীমাসমূহের হেফাযতকারী। বস্তুতঃ সুসংবাদ দাও ঈমানদারদেরকে"।(সূরাঃ আত তাওবাহ, আয়াতঃ ১১২)
উপরোক্ত আয়াত থেকে এটা সুস্পষ্ট যে, যাদের উপরের উল্লিখিত গুণাবলী গুলো থাকবে তারাই হবেন সুসংবাদের অধিকারী। অর্থাৎ এইসব গুণান্বিত ব্যক্তিরাই হবেন জান্নাতের অধিকারী আল্লাহর প্রিয় বান্দা। অথচ সুফিদের পীরেরা এইসব গুণে গুণান্বিত নয়। তারা তাদের মতো ইবাদতকারী যা ইসলাম সমর্থিত নয়।
তারা শোকরগোযারীও নয় দুনিয়ার সাথে সম্পর্কছিন্নকারীও নয়। কেননা তারা তাদের মুরিদ ভক্ত অনুসারীদের প্রতিনিয়ত দরবারে হাদিয়া তোফা এবং মানত করার ব্যাপারে উৎসাহিত করে। যাতেকরে তারা বেশী বেশী অর্থের মালিক হতে পারে। যদি সুফিদের পীরেরা শোকরগোযারী হতো এবং দুনিয়াবিমুখী হতো, তাহলে তারা দুনিয়াবী লোভ লালসা থেকে দূরে থাকতো। অথচ খুব গভীরভাবে লক্ষ্য করলে আমরা জানতে পারবো যে, তাদের দুনিয়াবী জীবন কত বিলাসী।
সেইসাথে তারা সঠিক রুকু সিজদাকারীও নয়। কেননা তাদের আকিদায় সালাত নেই। যখন পীরেরা ইবাদতের চুড়ান্ত সীমায় পৌঁছে যায় তখন থেকে তাদের আর ইবাদত বন্দেগী থাকে না। এটাই তাদের আকিদা। সুতরাং যারা রুকু সিজদা করে না তারা কীভাবে আল্লাহর প্রিয়পাত্র হতে পারে? যদি আল্লাহর প্রিয়পাত্র হতে হয় তাকে অবশ্যই নিয়মিত সালাত আদায়কারী হতে হবে যা সুফিরা পালন করে না।
উপরোক্ত আয়াতে যেসব গুণাবলীর কথা উল্লেখ করে হয়েছে তার কিছুই সুফিবাদী পীরদের নেই। কেননা তারা সৎকাজের আদেশ দেয় না অসৎ কাজের নিষেধও করে না। সেইসাথে তারা আল্লাহর সীমা রক্ষা করেও চলে না। বরং তারা এমন এমন সব সীমা লঙ্ঘনকারী আকিদা পোষণ করে যা তাদের ইসলাম থেকে খারিজ করে দেয়।
সুতরাং এইসব গুণাবলী ছাড়া শুধুমাত্র বংশপরস্পরায় কেউ কখনোই আল্লাহর অলি বা প্রিয় বান্দা হতে পারেন না। অতএব সুফিদের পীরেরা কখনোই আল্লাহর অলি নয়।
মুজাহিদরা জান্নাতের অধিকারীঃ
যারা আল্লাহর রাহে দ্বীন ইসলামের জন্য জিহাদ করে তারা হচ্ছেন মুজাহিদ। আর মুজাহিদরাই হচ্ছেন জান্নাতের অধিকারী এবং আল্লাহর প্রিয় বান্দা। আল্লাহ্ বলেন,
" যারা ঈমান এনেছে, দেশ ত্যাগ করেছে এবং আল্লাহর রাহে নিজেদের জান ও মাল দিয়ে জেহাদ করেছে, তাদের বড় মর্যাদা রয়েছে আল্লাহর কাছে আর তারাই সফলকাম"। (সূরাঃ আত তাওবাহ, আয়াতঃ ২০)
যারা দ্বীন ইসলামের জন্য জিহাদ করবে তারাই হচ্ছে সফলকাম মুমিন। সুতরাং আল্লাহর কাছে প্রিয় হতে হলে অবশ্যই তাকে দ্বীনের প্রয়োজনে জিহাদের ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। অথচ সুফিদের আকিদায় জিহাদের কোনো অস্তিত্বও নেই। তারা মাঠে ময়দানের জিহাদকে পছন্দ করে না। তাদের হিসাবে জিহাদ হচ্ছে নফসের জিহাদ। তাই তারা নফসের জিহাদকেই গুরুত্ব দেয়। অথচ আল্লাহ্ বলেন,
" তোমাদের কি ধারণা, তোমরা জান্নাতে প্রবেশ করবে? অথচ আল্লাহ এখনও দেখেননি তোমাদের মধ্যে কারা জেহাদ করেছে এবং কারা ধৈর্য্যশীল"। (সূরাঃ আল ইমরান, আয়াতঃ ১৪২)
উপরোক্ত আয়াত থেকে বুঝা যাচ্ছে যে, যাদেরকে আল্লাহ্ জান্নাতের সুসংবাদ দিবেন তিনি তাদের পরীক্ষা করবেন জিহাদ এবং ধৈর্যের দ্বারা। যারাই আল্লাহর প্রিয়পাত্র হবেন অবশ্যই তাকে প্রয়োজনে জিহাদের ময়দানেও অংশগ্রহণ করতে হবে। তবেই আল্লাহ্ সেই বান্দাকে প্রিয় মনে করবেন। যদি কেউ জিহাদকে অপছন্দ করে তবে সে কখনোই আল্লাহর প্রিয়পাত্র হতে পারেন না। সুতরাং যারাই আল্লাহর অলি বা বন্ধু হবেন তারা অবশ্যই প্রয়োজনে মুজাহিদের ভূমিকা পালন করবেন।
আর আমরা বাস্তবে কী দেখি? বাস্তবে দেখা যায় যে, সুফিবাদীরা কখনোই জিহাদের পক্ষে কাজ করেনি। তারা প্রকৃত জিহাদের চর্চাই করে না। ইসলামের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ সময়েও সুফিদের জিহাদের কোনো চিহ্ন নেই। সুতরাং যারা জিহাদই পছন্দ করে না তারা কীভাবে আল্লাহর প্রিয়পাত্র হবে? আর তারা আল্লাহর প্রিয়পাত্র না হলে কীভাবে তারা আল্লাহর অলি হতে পারে? বা বানাতে পারে?
মিতব্যয়ীরা আল্লাহর প্রিয়ঃ
যারা পরিমিত এবং মিতব্যয়ী তারা আল্লাহর প্রিয় বান্দা। যারা অপব্যয়কারী তারা হচ্ছেন শয়তানের ভাই। আল্লাহ্ বলেন,
" এবং (যারা আল্লাহর প্রিয় বান্দা) তারা যখন ব্যয় করে, তখন অযথা ব্যয় করে না কৃপণতাও করে না এবং তাদের পন্থা হয় এতদুভয়ের মধ্যবর্তী"। (সূরাঃ আল-ফুরকান, আয়াতঃ ৬৭)
"নিশ্চয় অপব্যয়কারীরা শয়তানের ভাই"। (সূরাঃ বনী ইসরাঈল, আয়াতঃ ২৭)
এই দুই আয়াত থেকে এটা স্পষ্ট যে, যারা মিতব্যয়ী তারা হচ্ছেন আল্লাহর প্রিয় বান্দা। আর যারা অপব্যয়কারী তারা হচ্ছেন শয়তানের ভাই। সুতরাং যারা অপব্যয়কারী হবেন তারা কখনোই আল্লাহর প্রিয়পাত্র হতে পারেন না।
বর্তমান সুফিদের পীর আউলিয়াদের দরবারের দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাবো অপচয় আর জৌলুসের ছড়াছড়ি। ব্যক্তিগত জীবনে তারা ঐশ্বর্য বিলাসী প্রচুর অপব্যয়কারী। তারা তাদের পীর আউলিয়াদের কবর মাজারকে অহেতুক ব্যয়বহুল কারুকাজে সৌন্দর্যমণ্ডিত করে। যা ইসলামের আকিদার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। এইসব অপচয় অপব্যয়কারীরা কখনোই আল্লাহর অলি হতে পারেন না।আল্লাহ্ আরো বলেন,
" এবং (তারা আল্লাহর প্রিয় বান্দা) যারা মিথ্যা কাজে যোগদান করে না এবং যখন অসার ক্রিয়াকর্মের সম্মুখীন হয়, তখন মান রক্ষার্থে ভদ্রভাবে চলে যায়"। (সূরাঃ আল-ফুরকান, আয়াতঃ ৭২)
যারাই মিথ্যা কাজে অর্থাৎ অনর্থক বেহুদা এবং দ্বীন বিরোধী কাজে জড়িত নয়। সেইসাথে কেউ অসার অনর্থক কাজকর্ম করলে সেখান থেকে যারা ভদ্রভাবে চলে যায়। তারাই হচ্ছেন আল্লাহর প্রিয় বান্দা। সুতরাং যারা আল্লাহর প্রিয় বান্দা হবেন তারা সবসময়ই নিজেদের অনর্থক কাজকর্ম বিশেষকরে দ্বীন বিরোধী কাজ থেকে দূরে রাখবে।
অথচ সুফিরা তাদের পীর আউলিয়াদের নামে যেসব ওরস বা জন্মবার্ষিকী মৃত্যুবার্ষিকীর পালন করে তা কখনোই কোনো ইসলামী আচরণ অনুষ্ঠান নয়। বিধর্মীদের অনুসরণে পালিত এইসব বিদআতী অনুষ্ঠান যেহেতু ইসলামের নয়, সেহেতু তা অহেতুক এবং গুনাহের কাজ। সুফিরা এইসব গুনাহের কাজ করেও কীভাবে আল্লাহর অলি হতে পারে তা ভাবার বিষয়।
শির্ক করে কীভাবে আল্লাহর অলিঃ
যারা শির্ক করে তারা মুশিরক। সুতরাং মুশরিকদের ঈমান নেই। যারা আল্লাহর সাথে শির্ক করে না তারাই হচ্ছেন আল্লাহর প্রিয় বান্দা। আল্লাহ্ বলেন,
" এবং (তারা আল্লাহর প্রিয় বান্দা) যারা আল্লাহর সাথে অন্য উপাস্যের এবাদত করে না"। (সূরাঃ আল-ফুরকান, আয়াতঃ ৬৮)
যারা আল্লাহর সত্যিকারের বন্ধু এবং প্রিয়পাত্র তারা কখনোই শির্ক করতে পারে না। তারা শুধুমাত্র এবং একমাত্র আল্লাহরই ইবাদত করবে। সুতরাং আমরা যদি কাউকে আল্লাহর অলি বা বন্ধু মনে করি তাহলে তিনি কখনোই মুশরিক হতে পারবেন না। অথচ শির্কি বিদআতী আকিদায় পরিপূর্ণ সুফিরা তাদের পীর আউলিয়াদের আল্লাহর অলি দাবি করে।
কিন্তু তারা শির্ক বিদআত করে কীভাবে আল্লাহর অলি হতে পারে? তাদের আকিদা বিশ্লেষণ করলে তবেই আমরা তাদের সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পারবো। তাওহীদ সম্পর্কে তাদের আকিদা খুবই জঘন্য। এই জঘন্য তাওহীদ বিরোধী আকিদা পোষণকারীরা কীভাবে আল্লাহর অলি হতে পারে?
আরও পড়ুন সুফিবাদী সুন্নীদের আকিদা সমূহ
আল্লাহর অলিরা কুরআনে বিশ্বাস করেঃ
যারা আল্লাহর প্রিয় বান্দা তারা কুরআনের প্রতিটি আয়াত স্বীকার করে এবং সেইমতো জীবন পরিচালিত করে। আল্লাহ্ বলেন,
" এবং (তারা আল্লাহর প্রিয় বান্দা) যাদেরকে তাদের পালনকর্তার আয়াতসমূহ বোঝানো হলে তাতে অন্ধ ও বধির সদৃশ আচরণ করে না"। (সূরাঃ আল-ফুরকান, আয়াতঃ ৭৩)
উপরোক্ত আয়াত দ্বারা আল্লাহর সেইসব প্রিয় বান্দাদের কথা বলা হচ্ছে যাদের কুরআন ও হাদীস দ্বারা দ্বীন ইসলামের কোনো বিধি বিধানের কথা বলা হলে তাঁরা তা সাথে সাথে নিঃসংকোচে মেনে নেয়। তারা এমন ভাব দেখায় না যে, বধিরের মতো শোনেনি বা অন্ধের মতো দেখি। অর্থাৎ যখনই তাদেরকে কুরআনের দ্বারা বিভিন্ন আইনকানুন তথা সৎপথে চলার বিধি নিষেধ সহ ইসলাম সম্পর্কে যাবতীয় নসিহত করা হলে তারা তা ততক্ষণাৎ স্বীকার করে সেইমতো চলার এবং মানার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ে।
অথচ সুফিদের পীর আউলিয়াদের আল্লাহর অলি দাবি করলেও, তারা কুরআনের অনুসরণে জীবনযাপন এবং দ্বীন ইসলাম পালন করে না। তাদের ঈমান আমল আকিদা ও ইবাদত সবই হচ্ছে কুরআন সুন্নাহ বিরোধী। শুধু তাইনয় তাদের আকিদাই হলো কুরআন অস্বীকার করা। তাদের কুরআনের দিকে আহবান করলে সেখান থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। যেন তারা বধিরের মতো কিছু শোনেনি এবং অন্ধের মতো কিছু দেখেনি। যা আল্লাহর প্রিয়পাত্র হওয়ার নমুনা নয়। সুতরাং তারা কখনোই আল্লাহর অলি হতে পারে না।
আল্লাহর অলিরা তাহাজ্জুদগুজারীঃ
যারা আল্লাহর প্রিয়পাত্র তারা অবশ্যই ধৈর্যশীল সত্যবাদী, আল্লাহর নির্দেশ পালনকারী, আল্লাহর রাস্তায় খরচাকারী এবং শেষ রাতে তাহাজ্জুদের সালাত আদায়কারী । আল্লাহ্ বলেন,
" তারা (যারা জান্নাতের অধিকারী) ধৈর্য্যধারণকারী, সত্যবাদী, বিনয়ের সাথে নির্দেশ সম্পাদনকারী, খরচকারী এবং শেষ রাতে ক্ষমা প্রার্থনাকারী "। (১৭: আলে ইমরান)
যারা আল্লাহর প্রিয় বান্দা এবং তাঁর বন্ধু তারা নিয়মিত সালাত আদায়ের পাশাপাশি রাতের শেষাংশে তাহাজ্জুদের সালাত আদায় করে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চায়। অথচ সুফিদের আকিদায় সালাতের কোনো অবস্থান নেই! তাদের পীর অলি আউলিয়াদের ইয়াকীন এসে গেলে আর তাদের ইবাদত করার প্রয়োজন নেই।সুতরাং যারা আল্লাহর ইবাদতই করে না তারা কীভাবে আল্লাহর অলি হতে পারেন?
উপরোক্ত আলোচনা থেকে এটা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয় যে, যাঁরাই আল্লাহর প্রিয় বান্দা এবং তাঁর বন্ধু হবেন, তাদেরকে তা তাঁদের ঈমান আমল আকিদা দ্বারা এই খেতাব অর্জন করতে হবে। সেইসাথে যারাই আল্লাহর অলি হবেন বা যাকেই আল্লাহর অলি বলা হবে তাঁর এবং তাদের কুরআনের আলোকে উপরোক্ত গুণাবলী গুলো থাকতে হবে।
অথচ উপমহাদেশের সুফিবাদীরা তাদের কথিত পীর আউলিয়াদেরকে বংশগতভাবে এবং আনুমানিকভাবে আল্লাহর অলি বলে সম্বোধন এবং দাবি করেন। সেইসাথে তারা এটাও দাবি করে যে, তারাই আল্লাহর অলি সৃষ্টি করে। কিন্তু তাদের ঈমান আকিদা দ্বারা কুরআনের আয়াতের মাধ্যমে প্রমাণিত হলো যে, তারা কখনোই আল্লাহর অলি নয়। শুধু তাইনয় এই আলোচনা থেকে এটাও প্রমাণিত হয়েছে যে, যেকোনো মুমিন মুত্তাকী পরহেজগার বান্দা অবশ্যই আল্লাহর অলি বা বন্ধু হতে পারেন। অতএব সুফিদের পীরেরাই শুধু আল্লাহর অলি নয়।
সাখাওয়াতুল আলম চৌধুরী
১৮ ডিসেম্বর ২০২১
অলংকার, চট্টগ্রাম।