শবেবরাত এর দালিলিক পর্যালোচনা
পবিত্র " শবেবরাত ", " লাইলাতুল বারায়াত" বা "লাইলাতুন নিস্ফ মিন শাবান" যাই বলিনা কেন এই রাত্রিটি আমাদের উপমহাদেশের মুসলমানদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি রাত্রি। সুদীর্ঘ কাল থেকে আমাদের উপমহাদেশে এই রাত্রি বিশেষ মর্যাদার আসনে রয়েছে।
যদিও আমরা যারা খুবই সাধারণ মুসলিম তারা কখনোই জানি না বা জানতে চাইওনি কেন এবং কী কারণে এই রাত এতো মর্যাদাপূর্ণ। অথবা কখনো জানতে চেষ্টা করিনি আসলেই কি এই রাত ইসলাম সমর্থিত কিনা? আসুন আজ আমরা শবেবরাতের দালিলিক ভিত্তির পর্যালোচনা করি।
শবেবরাত এর অর্থ
"শবে" ও "বরাত " এখানে দুটি শব্দ। এই শব্দ দুটি সরাসরি এসেছে ফার্সি তথা ইরান থেকে। ‘শব’ শব্দের এর অর্থ রাত। " বরাত" শব্দের অর্থ বলা হয় যে "সৌভাগ্য"। দুটো কে মিলিয়ে হচ্ছে সৌভাগ্য রাত বা রজনী। এটাই উপমহাদেশে প্রচলিত।
যদি "শবেবরাত" কে বাংলা করি তবে কী দাঁড়ায়? "শব" অর্থ মৃত বা মৃতদেহ। "বরাত" অর্থ মারফত বা মাধ্যম। এই দুটি শব্দ একত্রে করলেও কোন যুক্তিযুক্ত কোনো অর্থ দাঁড়ায় না। তারমানে এই "শবেবরাত" এর ইসলাম সম্মত সঠিক বাংলাও নেই। এটা সুস্পষ্ট যে "শবেবরাত" কোনো আরবি শব্দ নয় এবং কুরআন ও সহিহ হাদিসে এই শব্দের কিছু নেই।
তাহলে আরবিতে কী আছে? যেমন আমরা "নামাজ", "রোজা" ফার্সিতে বলি যা আরবিতে হয় "সালাত" এবং "সাওম"। যদিও ফার্সি শব্দ ব্যবহার করা অনুচিত তবুও যুগ যুগ ধরে চলে আসছে। সেই হিসাবে "শবেবরাতেরও" অর্থ নিশ্চয়ই থাকবে। আসুন দেখি আরবিতে কী আছে।
আরও পড়ুন : ইসলামে নামাজ -রোজা থাকলেও, পীর - মুরিদী, শবেবরাত, চাহার শোম্বা নেই
অনেকে একে নামকরণ করেছেন "লাইলাতুল বারায়াত’। এখানে লাইলাতুল হচ্ছে "রাত্রি" আর "বারায়াত" কে যদি আরবী শব্দ ধরা হয় তাহলে এর অর্থ হচ্ছে সম্পর্কচ্ছেদ, পরোক্ষ অর্থে মুক্তি। যেমন কুরআন মাজীদে সূরা "তাওবাতে" ইরশাদ হয়েছে :
بَرَاءَةٌ مِنَ اللَّهِ وَرَسُولِهِ (التوبة:
অর্থ : আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের পক্ষ থেকে সম্পর্ক ছিন্ন করার ঘোষণা। (সূরা তাওবা, ১)
এখানে বারায়াতের অর্থ হল সম্পর্ক ছিন্ন করা। ‘বারায়াত’ মুক্তি অর্থেও আল-কুরআনে এসেছে যেমন :
أَكُفَّارُكُمْ خَيْرٌ مِنْ أُولَئِكُمْ أَمْ لَكُمْ بَرَاءَةٌ فِي الزُّبُرِ . (سورة
অর্থ : তোমাদের মধ্যকার কাফিররা কি তাদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ? না কি তোমাদের মুক্তির সনদ রয়েছে কিতাবসমূহে? (সূরা কামার, ৩৪)।
এখন দেখা যাচ্ছে যে ফার্সিতে যে অর্থ আমরা পাচ্ছি সেই অর্থ কিন্তু আরবিতে পাচ্ছি না। নামাজ রোজার মতো "শবেবরাত" কে আমরা বলতে পারছি না যে এটা দিয়ে "সৌভাগ্য রাত্রি" বুঝানো হয়েছে।
শবেবরাত বলুন আর লাইলাতুল বারায়াত বলুন কোনো আকৃতিতে শব্দটি কুরআন মাজীদে খুজে পাবেন না। সত্য কথাটাকে সহজভাবে বলতে গেলে বলা যায় পবিত্র কুরআন মাজীদে শবেবরাতের কোন আলোচনা নেই। সরাসরি তো দূরের কথা আকার ইংগিতেও নেই।
তাহলে আমারা "শবেবরাত" পালন করেছি কীভাবে? যুগ যুগ ধরে বংশপরম্পরায় আমরা যা পালন করেছি তা কী? যেটাকে সৌভাগ্য বলছি সেটা হয়ে যাচ্ছে সম্পর্কচ্ছেদ। তাহলে আমরা আল্লাহ ও রাসুল (সা.) এর পথের থেকে সম্পর্কচ্ছেদ করেছি?
আসুন আরও পরিষ্কার হই। যারা এই উপমহাদেশে "শবেবরাত "নিয়ে এসেছেন তারা কীভাবে এর দলিল দিয়েছেন তা ব্যাখ্যা করি।
আল কুরআনের দলিল
অনেকে কোরআনের সুরা দোখানের ৩ নম্বর আয়াত দিয়ে শবেবরাত প্রমাণের ব্যর্থ প্রয়াস চালান। আয়াতটি হলো, ‘ইন্না আনজালনাহু ফি লাইলাতিম মোবারাকাতিন ইন্না কুন্না মুনজিরিন।'
অর্থ : নিশ্চয়ই আমি এটি (আল কোরআন) এক বরকত ও কল্যাণময় রাতে নাজিল করেছি। নিশ্চয়ই আমি তো (জাহান্নাম থেকে) সতর্ককারী।
অধিকাংশ আলিম বলেছেন, ‘লাইলাতুম মোবারাকাহ’ হলো ‘লাইলাতুল কদর’। তবে শুধুমাত্র তাবেয়ী ইকরিমা (রহ) বলেছেন, তা হলো মধ্য শাবানের রজনী। তবে এ মতটি কোরআনের দলিল দ্বারাই বাতিল হয়ে যায়।
কারণ, মহান রাব্বুল আলামিন মহাগ্রন্থ আল কোরআনের সুরা বাকারার ১৮৫ নম্বর আয়াতে বলেন, "রামাদান মাস, যার মধ্যে আল কোরআন নাজিল করা হয়েছে, যা মানবজাতির জন্য পুরোপুরি হিদায়াত"।
এই আয়াতটি দ্ব্যর্থহীনভাবে জানাচ্ছে যে, কোরআন অবতীর্ণ হওয়ার সময় রামাদান মাস। তাছাড়া "সূরা কদরে" স্পষ্টভাবে আছে পবিত্র কুরআন মর্যাপূর্ণ রাতে নাজিল হয়েছে। অর্থাৎ কদরের রাতে। যা সহিহ হাদিস দ্বারা স্পষ্টভাবে প্রমাণিত।
তাহলে দুখানের যে আয়াতে বরকতময় রাত্রিতে কুরআন নাজিলের কথা বলা হচ্ছে তা হচ্ছে শবেকদর এবং সেটা হবে রামাদান মাসে। যদি কেউ বলে বা মনে করে যে, এই লাইলাতুম মোবারাকাহ হলো রামাদান ছাড়া শাবান মাসে, তাহলে সে আল্লাহর নামে মিথ্যা বলে কুরআনকে বিকৃত এবং প্রশ্নবিদ্ধ করল।
এই আয়াতের ব্যাখ্যায় বিখ্যাত তাফসিরকারক আল্লামা কুরতুবি (র.) বলেন, ‘লাইলাতুম মোবারাকাহ হলো লাইলাতুল কদর।’ আল্লামা ইবনে কাসির (র.) বলেন, ইকরিমা থেকে বর্ণিত হয়েছে যে বরকতময় রাতটি শাবানের মধ্যম রজনী। এ মতটি একটি অসম্ভব ও অবাস্তব মত। কারণ, কোরআনে দ্ব্যর্থহীনভাবে বলা হয়েছে যে, এ রাতটি রামাদানের মধ্যে। প্রখ্যাত তাফসিরকারকগনই ‘লাইলাতুল মোবারাকাহ’কে লাইলাতুল কদর বলে তাফসির করেছেন এবং এ সম্বন্ধে হাদিসও যথেষ্ট রয়েছে।
এখান থেকেই স্পষ্ট হয়ে গেল যে পবিত্র কুরআনে শাবান মাসে কোন বরকত রাত্রি নেই। যে রাত্রির কথা বলা হয়েছে তা হলো পবিত্র "শবেকদর।" কুরআন এবং সহিহ হাদিস দ্বারা সন্দেহ ছাড়া প্রমাণিত।
আরও পড়ুন রাসুলুল্লাহ সাঃএর আদর্শ এবং অনুসরণই হচ্ছে ইসলাম
হাদিসের দলিল
দুঃখজনক ভাবে হাদিসেও "শবেবরাত" বা "লাইলাতুল বারায়াত" নামে সরাসরি এবং স্পষ্ট কিছু নেই। তবে কিছু হাদিসে শাবান মাসের ১৫তম রাত্রিতে ইবাদত বন্দেগির কথা এসেছে। হাদিসের ভাষায় বলা হয়েছে "লাইলাতুন নিস্ফ মিন শাবান" অর্থাৎ মধ্য শাবানের রাত্রি।
তাহলে এটিও স্পষ্ট যে "শবেবরাত", "লাইলাতুল বারায়াত " এর একটিও কুরআন এবং হাদিসে সুস্পষ্ট ভাবে আসেনি। তবে কিছু হাদিসে শুধু "মধ্য শাবানের" রাতে ইবাদত করার কথা বলা হয়েছে। এখন আমরা দেখবো যেসব হাদিসে "মধ্য শাবানের রাতের" ইবাদত এসেছে তা কি সহিহ নাকি অন্য কিছু!
শাবানের মধ্যরজনীর ফযীলত সম্পর্কিত হাদিসসমূহের পর্যালোচনা
১ নং হাদিস
১-حدثنا أحمد بن منيع أخبرنا يزيد بن هارون أخبرنا الحجاج بن أرطاة عن يحيى بن أبي كثير عن عروة عن عائشة رضى الله عنها قالت : فقدت رسول الله صلى الله عليه وسلم ليلة فخرجت فإذا هو بالبقيع فقال أكنت تخافين أن يحيف الله عليك ورسوله؟ قلت يا رسول الله ظننت أنك أتيت بعض نسائك.
فقال إن الله تبارك وتعالى ينزل ليلة النصف من شعبان إلى سماء الدنيا فيغفر لأكثر من عدد شعر غنم كلب.
قال أبو عيسى: حديث عائشة لا نعرفه إلا من هذا الوجه من حديث الحجاج، وسمعت محمدا يقول يضعف هذا الحديث، وقال: يحيى بن كثير لم يسمع من عروة، قال محمد والحجاج لم يسمع من يحيى بن كثير، انتهى كلامه، فهذا السند منقطع بوجهين.
ইমাম তিরমিযী (রহঃ) বলেন : আমাদের কাছে আহমাদ ইবনে মুনী’ হাদিস বর্ণনা করেছেন যে তিনি ইয়াযীদ ইবনে হারূন থেকে, তিনি হাজ্জাজ ইবনে আরতাহ থেকে, তিনি ইয়াহইয়া ইবনে আবি কাসির থেকে, তিনি উরওয়াহ থেকে, তিনি উম্মুল মু’মিনীন আয়িশা (রা.) থেকে বর্ণনা করেন যে তিনি বলেছেন : "আমি এক রাতে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বিছানায় পেলাম না তাই আমি তাকে খুঁজতে বের হলাম, ‘বাকী’ নামক কবরস্থানে তাকে পেলাম। তিনি (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন : তুমি কি আশংকা করেছো যে আল্লাহ ও তার রাসুল তোমার সাথে অন্যায় আচরণ করবেন? আমি বললামঃ হে আল্লাহর রাসুল! আমি মনে করেছি আপনি আপনার অন্য কোন স্ত্রীর কাছে গিয়েছেন। তিনি বললেনঃ আল্লাহ রাব্বুল আলামীন মধ্য শাবানের রাতে দুনিয়ার আকাশে অবতরণ করেন, অতঃপর কালব গোত্রের পালিত বকরীর পশমের পরিমানের চেয়েও অধিক পরিমান লোকদের ক্ষমা করেন। (তিরমিজি ১/১৫৬ পৃঃ ইবনে মাজা-১০০ পৃঃ, বায়হাকী-৩/৩৭৯ পৃঃ ইত্যাদি)
ইমাম তিরমিযী বলেন : আয়িশা (রা.) এর এই হাদিস আমি হাজ্জাজের বর্ণিত সনদ (সূত্র) ছাড়া অন্য কোনভাবে চিনি না। আমি মুহাম্মাদকে (ইমাম বুখারি) বলতে শুনেছি যে, তিনি হাদিসটিকে দুর্বল বলতেন। তিরমিযী (রহঃ) বলেন : ইয়াহ্ইয়া ইবনে কাসীর উরওয়াহ থেকে হাদিস শুনেননি। এবং মুহাম্মদ (ইমাম বুখারি) বলেছেন : হাজ্জাজ ইয়াহ্ইয়াহ ইবনে কাসীর থেকে শুনেননি।
আরও পড়ুন শিরক কী? মানুষ কীভাবে শিরক করে
এ হাদিসটি সম্পর্কে ইমাম বুখারি ও ইমাম তিরমিযীর মন্তব্যে প্রমাণিত হয় যে, হাদিসটি দুটো দিক থেকে মুনকাতি অর্থাৎ উহার সূত্র থেকে বিচ্ছিন্ন। অপর দিকে এ হাদিসের একজন বর্ণনাকারী হাজ্জাজ ইবনে আরতাহ মুহাদ্দিসীনদের নিকট দুর্বল বলে পরিচিত।
যারা "শবেবরাত" এর প্রণেতা তারা তিরমিযী শরীফের এই হাদিস দিয়েই মূল দলিল দেওয়ার চেষ্টা করেন। প্রখ্যাত মুহাদ্দীসগণ আরএস বিএস খতিয়ানের মতো সবকিছু চুলচেরা বিশ্লেষণের পর যা খুঁজে পেলেন তা আপনাদের সামনে উপস্থাপন করা হলো। যিনি এই হাদিস তাঁর গ্রন্থে লিপিবদ্ধ করেছেন তিনি নিজেই জানাচ্ছেন এই হাদিস সহিহ হতে পারা অসম্ভব! সেখানে আমরা কেন এই দূর্বল হাদিস নিয়ে মাতামাতি করব!!
২নং হাদিস আরেকটি উৎস থেকে : আলা ইবনে হারিস থেকে বর্ণিত, আয়িশা (রা.) বলেন : এক রাতে আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম দাঁড়িয়ে সালাত আদায় করছিলেন। .............. শেষ করে তিনি বললেন : "হে আয়িশা অথবা বললেন হে হুমায়রা! তুুমি কি মনে করেছ আল্লাহর নবি তোমার সাথে --- - - -- - প্রার্থনাকারীদের ক্ষমা করেন এবং রাহমাত প্রার্থনাকারীদের রহম করেন। আর হিংসুকদেরকে তাদের অবস্থার উপর ছেড়ে দেন। (মূল রেখে সংক্ষেপিত করা হলো ) (বাইহাকী তার শুয়াবুল ইমান কিতাবে বর্ণনা করেছেন)
হাদিসটি মুরসাল। সহিহ বা বিশুদ্ধ নয়। কেননা বর্ননাকারী ‘আলা’ আয়িশা (রা.) থেকে শুনেননি।
আরও পড়ুন জন্মগত মুসলিম ধর্মমতে মুসলিম
৩নং হাদিস
আলী ইবনে আবী তালেব (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন : "যখন মধ্য শাবানের রাত আসে তখন তোমরা রাত জেগে সালাত আদায় করবে আর দিবসে সিয়াম পালন করবে। কেননা আল্লাহ তা’আলা সূর্যাস্তের পর দুনিয়ার আকাশে অবতরণ করে বলেন : .................এভাবে ফজর পর্যন্ত বলা হয়ে থাকে। (সংক্ষেপিত)
(ইমাম ইবনে মাজাহ- আসসুনান (ইবনে মাজাহ শরীফ) বাব ১৯১ হাদীস নং ১৪৫১, পৃষ্ঠা ২০২। ইমাম আলী মুত্তাকী – কানযুল উম্মাল ১২:৩১৪, ইমাম আবদুল হক মুহাদ্দিস দেহলবী- মা ছাবাতা বিসসুন্নাহ, পৃষ্ঠা ১৯৯)
প্রথমতঃ এ হাদিসটি দুর্বল। কেননা এ হাদিসের সনদে (সূত্রে) ইবনে আবি সাবুরাহ নামে এক ব্যক্তি আছেন, যিনি অধিকাংশ হাদিস বিশারদের নিকট হাদিস জালকারী হিসাবে পরিচিত। এ যুগের বিখ্যাত মুহাদ্দিস নাসিরুদ্দীন আল-বানী (রহঃ) বলেছেন, হাদিসটি সনদের দিক দিয়ে একেবারেই দুর্বল।
দ্বিতীয়তঃ অপর একটি সহিহ হাদিসের বিরোধী হওয়ার কারণে এ হাদিসটি গ্রহণযোগ্য নয়। সে সহিহ হাদিসটি হাদিসে নুযুল নামে পরিচিত, যা ইমাম বুখারি ও মুসলিম তাদের কিতাবে বর্ণনা করেছেন। এই হাদিসে বলা হচ্ছে আল্লাহ সূর্যাস্তের পরে আকাশে আগমন করেন। অথচ সহিহ এবং প্রসিদ্ধ আরও অনেক হাদিসে এসেছে আল্লাহ প্রতি রাতের শেষে নিকট আসমানে আগমন করেন।
সহিহ হাদিসটি হলো আবূ হুরাইরা (রা.) থেকে বর্ণিত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন : "আমাদের রব আল্লাহ তা’আলা প্রতি রাতের এক তৃতীয়াংশ বাকী থাকতে দুনিয়ার আকাশে অবতরণ করেন ও বলতে থাকেন : কে আছ আমার কাছে দু’আ করবে আমি কবুল করব। কে আছ আমার কাছে চাইবে আমি দান করব। কে আছ আমার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করবে আমি তাকে ক্ষমা করব। (সহিহ : বুখারি ১১৪৫, মুসলিম ৭৫৮)
এ হাদিসটি সর্বমোট ৩০ জন সাহাবী বর্ণনা করেছেন এবং বুখারি এবং মুসলিম ও সুনানের প্রায় সকল কিতাবে এসেছে। তাই হাদিসটি প্রসিদ্ধ। অতএব এই মশহুর হাদিসের বিরোধী হওয়ার কারণে ঐ হাদিসটি পরিত্যাজ্য হবে।
আরও পড়ুন রাষ্ট্রীয় শিরক কী? কীভাবে মানুষ রাষ্ট্রীয় শিরক করে
৪নং হাদিস
উসমান ইবনে আবিল আস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলূল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন : "যখন মধ্য শাবানের রাত আসে তখন একজন ঘোষণাকারী ঘোষণা দেয় : আছে কি কোন ক্ষমা প্রার্থনাকারী আমি তাকে ক্ষমা করব। আছে কি কেহ কিছু চাইবার আমি তাকে তা দিয়ে দিব। রাসুল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন : মুশরিক ও ব্যভিচারী বাদে সকল প্রার্থনাকারীর প্রার্থনা কবুল করা হয়। (ইমাম ইবনে হাজার মক্কী আল ইদাহ ওয়াল বয়ান, পৃষ্ঠা ৭, ইমাম বাইহাকী- শু’আবুল ঈমান ৩:৩৮৩)
বিখ্যাত মুহাদ্দিস নাসিরুদ্দীন আল-বানী (রহঃ) হাদিসটিকে তার সংকলন ‘যয়ীফ আল-জামে’ নামক কিতাবের ৬৫২ নং ক্রমিকে দুর্বল প্রমাণ করেছেন।
শবেবরাত সম্পর্কে এ ছাড়া বর্ণিত অন্যান্য সকল হাদিস সম্পর্কে ইবনে রজব হাম্বলী (রহঃ) বলেন : এ মর্মে বর্ণিত অন্য সকল হাদিসই দুর্বল। এছাড়াও ইমাম মালিক (রহ) এই রাত্রির ইবাদত করতে নিষেধ করেছেন। ইমাম আবু হানীফা (রহ) মতামত হচ্ছে শবেবরাত বা মধ্য শাবানের রাত্রির ইবাদত ভিত্তিহীন। ইমাম শাফেয়ী (রহ) সওয়াবের নিয়তে ঘরেই ইবাদত করতে বলেছেন। সুন্নত হিসাবে নয়।
উপরোক্ত গুরুত্বপূর্ণ হাদিসসমূহ যা "শবেবরাত" জায়েজকারীরা দিয়ে থাকেন। এ থেকে খুব স্পষ্ট ভাবে প্রমাণিত যে, যেসব হাদিস দ্বারা মধ্য শাবানের রাতের ইবাদত বুঝানো হয়েছে তার একটিও সহিহ নয় বরং দূর্বল! কুরআনের পর হাদিসও আমরা "শবেবরাত, লাইলাতুল বারায়াত" ইত্যাদি পেলাম না। যা-ও পেলাম "মধ্য শাবানের রাতের ইবাদত", তাও আবার খুবই দূর্বল এবং ক্ষেত্রে বিশেষে সহিহ হাদিস বিরোধী।
মধ্য শাবানের রাত্রি নিয়ে অসংখ্য জাল এবং দূর্বল হাদিস রয়েছে। এমন এমন হাদিস রয়েছে যা সহিহ হাদিসেরও বিপরীত। উপরের বর্ণিত হাদিস গুলোর বিপরীতে একটি সহিহ হাদিস যা মুয়ায ইবনে জাবাল থেকে বর্ণিত- "রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, আল্লাহ মধ্য শাবানের রাতে আত্নপ্রকাশ করেন এবং মুশরিক ও হিংসুক ব্যতীত তাঁর সৃষ্টির সকলকে ক্ষমা করেন।" — (ইবনু মাজাহ, আস- সুনান ১/৪৪৫; বাযযার, আল-মুসনাদ ১/১৫৭, ২০৭, ৭/১৮৬; আহমদ ইবনু হাম্বল, আল-মুসনাদ ২/১৭৬; ইবনু আবি আসিম, আস-সুন্নাহ,পৃ ২২৩-২২৪; ইবনু হিব্বান, আস-সহিহ ১২/৪৮১; তাবরানী, আল-মুজাম আল-কাবীর, ২০/১০৮, ২২/২২৩; আল-মুজাম আল-আওসাত, ৭/৬৮; বায়হাক্বী, শু’আবুল ইমান, ৩/৩৮১; ইবনু খুযায়মা, কিতাবুত তাওহীদ ১/৩২৫-৩২৬।)
[সনদ সহিহ]
আরও পড়ুন কালেমা (বুঝা) ছাড়া মুসলিম নয়
এই হাদিস ছাড়া যেসব জাল এবং দূর্বল হাদিস রয়েছে তাতে রোজা রাখার কথা বলা হয়েছে। বলা হয়েছে আল্লাহ সূর্যাস্তের পরে আসমানে আগমন করেন। যা সহিহ হাদিসের বিপরীত। রাসুলুল্লাহ (সা.) কবর জিয়ারত করেছেন এই রাতে তাও বলা হয়েছে।
এখন আমরা যদি শাবান মাসের শবেবরাত এর হাদিস এবং ঐ প্রসিদ্ধ সহিহ হাদিসের তুলনা করি তবে কী দেখতে পাই? শবেবরাত এর হাদিস দ্বারা বলা হচ্ছে ঐ রাতেই আল্লাহ মানুষকে ক্ষমা করেন। তাহলে একদিন-ই ইবাদত করো। আর প্রসিদ্ধ হাদিসে বলা হচ্ছে আল্লাহ প্রতিদিন-ই তার বান্দার জন্য অপেক্ষা করছেন। এখন যিনি সত্যিকারের ইমানদার তিনি কোনটি করবেন? যার সত্যিই কিছু চাওয়ার আছে, যার ফেনারাশি পরিমাণ গুনাহ আছে। সে কি ঐ একদিন-ই আল্লাহর কাছে চাইবে? নাকি প্রতিদিন-ই আল্লাহর দরবারে হাজিরা দিবে? আমরা একটু ভেবে দেখি।
একইসাথে হাদিসে এসেছে মুশরিক ও হিংসুক ব্যতীত সবাইকে ক্ষমা করা হয়। তাহলে যেকেউ ইমান এনে মুশরিক ও হিংসুক না হলে আল্লাহ তাকে অবশ্যই ক্ষমা করে দিবেন। একইসাথে এই হাদিসের কোথাও এই রাতে ইবাদত বন্দেগির কথা আসেনি। এমনকি অন্যান্য দূর্বল হাদিসেও সারারাত ইবাদত বন্দেগির কথা আসেনি যা উপমহাদেশে ব্যাপক প্রচার প্রচারণা করে পালন করা হয়। অতএব খুবই দুঃখজনক যে উপমহাদেশের বিপুল সমারোহে যেসব ইবাদত আনুষ্ঠানিক ভাবে পালিত হয় তা স্পষ্ট একটি নতুন সৃষ্টি তথা ইসলামের ভাষায় বিদ'আত।
আমাদের করণীয়
আমরা উপমহাদেশে এই রাত্রিকে সৌভাগ্য রজনী হিসাবেই জানি এবং মানি। অথচ যারা এই দিবসের পক্ষে যুক্তিতর্ক দেন তারাও জানেন যে, কোনো হাদিস দ্বারাই প্রমাণিত নয় যে এই রাত সৌভাগ্যের রাত। ইসলামের কোথাও নেই এই রাত্রিতে কোনো মানুষের হায়াৎ, মউত, রিজিক, ধন, দৌলত ইত্যাদি বন্টন করা হয়।
সুতরাং আমাদের চেষ্টা থাকতে হবে যতটুকু পারা যায় আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার জন্য ইবাদত করা। প্রচলিত "শবেবরাতের" সরাসরি বিরোধীতা কেউ করে না। তবে এই রাতকে কেন্দ্র করে যাবতীয় বিদআত বর্জন করতে হবে। এই রাতের যা ফজিলত তা প্রতি রাত জাগ্রত থাকলেও আল্লাহ তা দেওয়ার ওয়াদা করেছেন। এমনকি রাত্রি জাগরণ না করেও মুশরিক ও হিংসুক না হলেও এর ফজিলত পাওয়া যাবে। সুতরাং এটাকেই যদি একমাত্র হিসাবে মেনে নিই, তাহলে আমাদের সারাবছরের রাত্রের ইবাদত করার মানসিকতা থাকবে না। যা একজন বান্দার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
আরও পড়ুন তাওহিদ কী? কীভাবে আল্লাহর তাওহিদ ক্ষুন্ন হয়
তাছাড়া রাত্রের ইবাদত হচ্ছে নফল বা ঐচ্ছিক ইবাদত। নফলের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং জরুরী ইবাদত হচ্ছে ফরজ ইবাদত। নফল ইবাদতের জন্য কোনো জবাবদিহিতা আল্লাহর কাছে করতে হবেনা। কিন্তু ফরজ ইবাদত পালন না করলে অবশ্যই জবাবদিহি করতে হবে। অথচ আমাদের উপমহাদেশে সিংহভাগ মুসলমানই পাঁচ ওয়াক্ত সালাত আদায়কারী নয়।
সুতরাং আসুন আগে চেষ্টা করি ফরজ সালাত প্রতিনিয়ত আদায় করার। সেইসাথে এই রাতে নিজ ঘরে সারারাত ইবাদত করা। নিজ আত্মীয় স্বজনদের কবরে গিয়ে তাদের জন্য মাগফেরাত কামনা করা। আমাদের রোজা রাখার ইচ্ছা থাকলে ১৪,১৫,১৬ শাবান রোজা রাখতে হবে যা সহিহ হাদিস দ্বারা প্রমাণিত। ইনশাআল্লাহ আল্লাহ অবশ্যই আমাদের ক্ষমা এবং রহমত দান করবেন।
সাখাওয়াতুল আলম চৌধুরী
৫ মার্চ, ২০২১
পতেঙ্গা, চট্টগ্রাম।