যা ইসলামী শরীয়তের মানদণ্ড নয় |
ইসলাম হচ্ছে আল্লাহ মনোনীত একমাত্র ধর্ম। ইসলাম মানেই হচ্ছে একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনবিধান। যেখানে ধর্মীয় সামাজিক পারিবারিক রাজনৈতিক এবং ব্যক্তিগত জীবনের সবকিছুই সুস্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে। ইসলামের এইসব বিধিবিধান পবিত্র কুরআন, রাসুলের (সা.) সুন্নাহ, সাহাবিদের ইজতিমা এবং মুজতাহিদ আলেমদের কিয়াস চারটি উৎস থেকেই উৎসরিত। এই চারটি উৎস ব্যতীত ইসলামের কোনো আইনকানুন, ইবাদত বন্দেগী এবং ইমান, আমল ইত্যাদি গ্রহণযোগ্য নয়। এরপরও উপমহাদেশের ইসলামে বিভিন্ন উৎস থেকে নিত্যনতুন ইমান আমল আকিদা যোগ হতে থাকে। যা প্রকৃত সঠিক ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক। আজ আমরা এমন কিছু উৎস সম্পর্কে জানার চেষ্টা করবো, যা কখনোই ইসলামি শরিয়তের মানদণ্ড নয়।
আরও পড়ুন মাজারে দান সদকা করার ইসলামী বিধান
স্বপ্ন
মুসলিম দাবিদার সুফি সুন্নিরা নতুন নতুন ইবাদতের উৎস হিসাবে স্বপ্নকে দলিল দেয়। অর্থাৎ কোনো বুযু্র্গ, কামেল বা আবেদি ব্যক্তির স্বপ্নের উপর ভিত্তি করে নতুন নতুন ইবাদত বা আমল সৃষ্টি হয়। যা কখনোই প্রকৃত ইসলাম সমর্থন করে না।
ইসলামে শুধুমাত্র নবি রাসুলদের (আ:) স্বপ্নের মূল্য থাকে। কেননা তাঁদের স্বপ্ন সত্য এবং তা আল্লাহর পক্ষ থেকেই আসে। স্বপ্ন দ্বারা আল্লাহ তাদের বিভিন্ন নির্দেশনা প্রদান করেন। যেমন: হজরত ইবরাহিম (আ.) তাঁর পুত্র ইসমাইল (আ.)-কে কোরবানি করার বিষয়টি স্বপ্নযোগে অনুধাবন করেছেন। এ বিষয়ে ইবরাহিম (আ.)-এর কথা পবিত্র কোরআনে এভাবে এসেছে :
‘হে ইসমাইল! আমি স্বপ্নে দেখেছি, আমি তোমাকে জবাই (কোরবানি) করছি, এ বিষয়ে তোমার মতামত কী? সে (ইসমাইল) বলল, আব্বু! আপনাকে যা হুকুম করা হয়েছে, আপনি তা-ই করুন। আল্লাহ চাইলে, আপনি আমাকে ধৈর্যশীলদের মধ্যে পাবেন। এরপর যখন তারা দুজন (আল্লাহর নির্দেশের) অনুগত হলো ও ইবরাহিম তার পুত্রকে শায়িত করল, তখন আমি (আল্লাহ) ডাক দিয়ে বললাম, হে ইবরাহিম! তুমি তোমার স্বপ্ন সত্যে পরিণত করে দেখিয়েছ। আমি ভালো মানুষদের এভাবেই পুরস্কৃত করি। ’ (সুরা : সাফফাত, আয়াত : ১০২)
নবি রাসুল ছাড়া বাকি উম্মতের জন্য স্বপ্ন হচ্ছে সুসংবাদ এবং দু:সংবাদের ইশারা মাত্র। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন,
‘ভালো স্বপ্ন আল্লাহর পক্ষ থেকে আর মন্দ স্বপ্ন শয়তানের পক্ষ থেকে। কেউ খারাপ স্বপ্ন দেখলে বাম দিকে থুতু দিবে এবং আল্লাহর কাছে বিতাড়িত শয়তান থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করবে এবং এ স্বপ্ন তার কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। আর এ দু:স্বপ্নের কথা কারো কাছে বলবে না। অপরদিকে ভালো স্বপ্ন দেখলে সুসংবাদ গ্রহণ করবে এবং এ স্বপ্নের কথা মহব্বতের লোকদের কাছেই বর্ণনা করবে। ’ (মুসলিম : ২২৬১)
রাসুলে আকরাম (সা.)-কে স্বপ্নে দেখার বিষয়টি ভিন্ন। কেননা হাদিসে এসেছে,
‘যে ব্যক্তি আমাকে স্বপ্নে দেখল সে সত্যই আমাকে দেখল। কারণ, শয়তান আমার আকৃতি ধারণ করতে পারে না। ’ (মুসলিম : ২২৬৬)।
সুতরাং হাদিস দ্বারা এটা সুস্পষ্ট যে, স্বপ্ন কখনোই ইসলামের দলিল নয়। কেননা এতে শয়তানের প্ররোচনা থাকে। স্বপ্ন নিয়ে স্পষ্ট হাদিস থাকার পরও মুসলিম দাবিদার সুফি সুন্নিরা স্বপ্নকে অনুমান করে তাদের বিভিন্ন আমলের দলিল হিসাবে পেশ করে। অথচ আল্লাহ বলেন,
"তারা শুধু অলীক কল্পনার অনুসরণ করে, এবং সম্পূর্ণ অনুমান ভিত্তিক কথাবার্তা বলে"। ( আন’আম: ১১৬)
সুতরাং স্বপ্ন অনুমান ভিত্তিক কল্পনা ছাড়া কিছুই নয়। যার অনুসরণ করা আল্লাহ নিষিদ্ধ করেছেন। যারা কোনো দলিল ছাড়াই শুধু অনুমান ভিত্তিক কথা বলে আল্লাহ তাদেরকে লা’নত/অভিসাপ দিচ্ছেন এই ভাবে-
"(আল্লাহ বলেন) অনুমানকারীরা ধ্বংস হোক, যারা উদাসীন, গোমরা/ভ্রান্ত"। (সুরা জারিয়াত আয়াত : ১১)
আরও পড়ুন কবর পাকা করার দলিল খন্ডন
কাশফ
উপমহাদেশেদ সুফি সুন্নিরা মনে করে, মানুষের আধ্যাত্মিক সাধনার মাধ্যমে তার হৃদয়ের পর্দা উঠে যায় এবং তার সামনে সৃষ্টি জগতের সকল রহস্য উন্মুক্ত হয়ে যায়। তার অন্তরআত্মা খুলে যায়। এবং এই অন্তর আত্মা খুলে যাওয়া কে তাদের পরিভাষায় কাশফ বলা হয়।
কাশফ হাসিল হয়ে গেলে আল্লাহ এবং সাধকের মাঝে কোন অন্তরায় থাকে না। তখন তারা জান্নাত, জাহান্নাম, সাত আসমান, জমিন আল্লাহর আরশ, লাওহে মাহফুজ পর্যন্ত ঘুরে আসতে পারেন। তারা গায়েবের সকল খবর, মানুষের অন্তরের অবস্থা এবং সাত আসমানে, জমিনে যা আছে তার সবই জানতে পারেন।
ইসলামে কাশফের অবস্থান
কাশফ অর্থ প্রকাশিত হওয়া বা অজানা কোন বিষয় নিজের কাছে প্রকাশিত হওয়া। অর্থাৎ আল্লাহ কর্তৃক তার কোন বান্দার নিকট তার অজানা এমন কিছুর জ্ঞান প্রকাশ করা যা অন্যের নিকট অপ্রকাশিত। এমনিভাবে কাশফ ইচ্ছাধীন কোন বিষয় নয় যে, তা অর্জন করা শরিয়তে কাম্য হবে বা সওয়াবের কাজ হবে। তবে অহি হলে তা কেবলমাত্র নবি-রাসুলগণের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। যেমন আল্লাহ বলেন,
"তিনি অদৃশ্য জ্ঞানের অধিকারী। তিনি তাঁর অদৃশ্যের জ্ঞান কারো নিকট প্রকাশ করেন না’। ‘তাঁর মনোনীত রাসুল ব্যতীত। তিনি তার (অহির) সম্মুখে ও পশ্চাতে প্রহরী নিযুক্ত করেন। (সুরা জিন ৭২:২৬-২৭)।
তবে কখনও কখনও রীতি বহির্ভূতভাবে অন্য কারো নিকট থেকে অলৈাকিক কিছু ঘটতে পারে বা প্রকাশিত হতে পারে। যেমন সাহাবি ও তাবেঈগণ থেকে হয়েছে। তবে মনে রাখতে হবে যে, এই "কাশফ" কোন নবিরও ইচ্ছাধীন নয়। এমনকি আমাদের রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামেরও ইচ্ছাধীন ছিল না। যেমন, সহিহ বুখারী, খন্ড ৬, অধ্যায় ৬০, হাদিস ৪৩৪। এর একটি ঘটনা সহীহ বুখারীর “তাফসির” অধ্যায়ে বর্ণনা করা হয়েছে এইভাবে, আয়িশা (রা:) হতে বর্ণিত: তিনি বলেন,
"আল্লাহর রাসুল (সা.) যয়নাব বিনতে জাহশ (রা:), রাসুলুল্লাহ (সা.) এর একজন স্ত্রী, এর কাছে মধু পান করতেন এবং সেখানে কিছুক্ষণ থাকতেন। তাই আমি (আয়েশাহ) ও হাফসা একমত হলাম যে, আমাদের যার ঘরেই আল্লাহর রাসুল (সা.) আসবেন, সে তাঁকে বলবে, আপনি কি মাগাফীর খেয়েছেন? আপনার মুখ থেকে মাগাফীরের গন্ধ পাচ্ছি। (আমরা তাই করলাম) এবং তিনি বললেন, না, বরং আমি যয়নাব বিনতে জাহশ এর ঘরে মধু পান করেছি। তবে আমি কসম করলাম, আর কখনো মধু পান করব না। তুমি এ বিষয়টি আর কাউকে জানাবে না।
আল্লাহ বলেন,
"যখন নবি তাঁর একজন স্ত্রীর কাছে একটি কথা গোপনে বললেন, অত:পর স্ত্রী যখন তা বলে দিল এবং আল্লাহ নবিকে তা জানিয়ে দিলেন, তখন নবি সে বিষয়ে স্ত্রীকে কিছু বললেন এবং কিছু বললেন না। নবি যখন তা স্ত্রীকে বললেন। তখন স্ত্রী বললেন: কে আপনাকে এ সম্পর্কে অবহিত করল? নবি বললেন: যিনি সর্বজ্ঞ, ওয়াকিফহাল, তিনি আমাকে অবহিত করেছেন। (সুরা আত-তাহরীমের আয়াত : ৩)।
আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের স্ত্রীগণ গোপনে আলাপ করল অথচ তিনি কিছুই জানলেন না। তার কাশফের ইচ্ছাধীন ক্ষমতা হলে সঙ্গে সঙ্গে তিনি সমস্ত কিছু জানতে পারতেন।
কোন এক সফরে ‘আয়িশা (রা:) হার হারিয়ে গেল। সাহাবিদের পথে আটকিয়ে রেখে হার খোঁজ করা হল। এবং রাসুলুল্লাহ (সা.) চিন্তিত হলেন। অথচ রাসুলুল্লাহ (সা.) যে উটে তিনি ছিলেন, হার খানা তার নীচেই পরে ছিল। আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাশফ ইচ্ছাধীন ক্ষমতা হলে সঙ্গে সঙ্গে হার খানা পেয়ে যেতেন।
হযরত ইয়াকুব আলাইহিস সালাম দীর্ঘদিন পর্যন্ত ছেলে ইউসুফ আলাইহিস সালামে খবর না পাওয়ার কারণে কাঁদতে কাঁদতে অন্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। যদি কাশফ ইচ্ছেধীন কোন কিছু হতো, তাহলে ইয়াকুব আলাইহিস সালাম কাশফের মাধ্যমে নিশ্চয়ই খবর পেতেন।
আরও পড়ুন সুফি সুন্নিদের পীর আউলিয়া সম্পর্কিত আকিদার জবাব
অনুরূপ কাশফ হওয়ার জন্য বুযুর্গ হওয়াও শর্ত নয়। বুযুর্গ তো দূরের কথা, মুমিন হওয়াও শর্ত নয়। কাশফ তো অমুসলিমদের ও হতে পারে। এই ধরনের বিভিন্ন অলৌকিক ঘটনা অন্যান্য ধর্মীয় অনুসারীদেরও ঘটছে। অতএব এরূপ যদি কোন মুমিন থেকে হয়, তবে সেটা হবে ‘কারামত’। অর্থাৎ আল্লাহ্ তাকে এর দ্বারা সম্মানিত করেন। আর যদি কাফির থেকে ঘটে, তবে সেটা হবে ফিৎনা। অর্থাৎ আল্লাহ এর দ্বারা তার পরীক্ষা নিচ্ছেন যে, সে এর মাধ্যমে তার কুফুরি বৃদ্ধি করবে, না হয় তওবা করে ফিরে আসবে।
সুতরাং কাশফ দ্বারা কোনো বুযু্র্গ বা আবেদি বান্দা কোনো কিছু বললেই তা ইসলামের শরিয়ত বা ইবাদতের অংশ হবেনা। এটা কখনোই কারো নিজস্ব ক্ষমতা নয়। এটা সম্পূর্ণ আল্লাহর ইচ্ছাধীন। আল্লাহ চাইলেই কোনো কোনো তাঁর মুমিন বান্দাকে কাশফের দ্বারা কিছু কারামত প্রকাশ করেন। তবে কখনোই কাশফ দ্বারা প্রাপ্ত সংবাদ ইসলামের কোনো ইবাদত বা আমলের মানদন্ড হতে পারে না।
কাশফ যদি ইসলামের দলিল হতো, তাহলে শয়তান এর মাধ্যমে বিভিন্ন নতুন নতুন বিভ্রন্তিকর ইবাদত এবং আমলের প্রচলন করতো। যা সুফি সুন্নিরা করে আসছে।
আরও পড়ুন প্রবৃত্তির অনুসরণ ও তার পরিনতি
ইলহাম
ইলহামের পারিভাষিক অর্থ হল, চিন্তা ও চেষ্টা ছাড়াই কোন কথা অন্তরে উদ্রেক হওয়া। ইলহাম কাশফেরই প্রকার বিশেষ। কিন্তু কথা হল ইলহামও স্বপ্নের ন্যায় কখনো আল্লাহর পক্ষ থেকে হয়, আবার কখনো শয়তানের পক্ষ থেকে হয়। হাদিসে এসেছে,
"নিশ্চয় মানুষের অন্তরে শয়তানের পক্ষ থেকেও কথার উদ্রেক হয়, ফেরেশতার পক্ষ থেকেও কথার উদ্রেক হয়। ফেরেশতার উদ্রেক হল, কল্যাণের প্রতি প্রতিশ্রুতি দান এবং হকের সত্যায়ন করা। যে ব্যক্তি এটি অনুভব করবে, তাকে বুঝতে হবে যে, তা আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে, তাই তার প্রশংসা করা উচিত। আর যে ব্যক্তি দ্বিতীয়টি অনুভব করবে, তাকে বিতাড়িত শয়তান থেকে আশ্রয় কামনা করতে হবে। অত:পর তিনি [সুরা বাকারার ২৬৮ নং] আয়াত পাঠ করেন, অর্থাৎ শয়তান তোমাদের অভাব অনটনের ভীতি প্রদর্শন করে এবং অশ্লীলতার আদেশ দেয়। পক্ষান্তরে আল্লাহ তাআলা তোমাদেরকে নিজের পক্ষ থেকে ক্ষমা ও অধিক অনুগ্রহের ওয়াদা করেন। {সুনানুল কুবরা লিননাসায়ী, হাদিস নং-১০৯৮৫, সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদিস নং-৯৯৭, মুসনাদে আবী ইয়ালা, হাদিস নং-৪৯৯৯, সুনানে তিরমিজী, হাদিস নং-২৯৮৮}
এ হাদিসে স্পষ্ট বলা হয়েছে যে, ইলহাম কখনো আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে হয়, আবার কখনো শয়তানের পক্ষ থেকে হয়। কাজেই ইলহাম হক ও বাতিলের মাপকাঠি হতে পারে না এবং শরিয়তের কোনো দলিল হতে পারে না।
তাছাড়া আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে ইলহাম হওয়ার আলামত শুধু এতটুকু বলা হয়েছে যে, তা হক ও ভাল। কিন্তু কোনো অবস্থাতেই ইলহাম কখনোই শরিয়তের মানদন্ড নয়। অর্থাৎ ইলহাম থেকে প্রাপ্ত কোনো আদেশ বা নির্দেশ কখনোই শরিয়তের অংশ হবে না।
আরও পড়ুন বর্তমান সমাজের মুনাফিকের পরিচয় ও পরিনতি
মুসলমানদের সুফি সুন্নিরা বুযু্র্গের ইলহামকে শরিয়তের দলিল বা মাপকাঠি মনে করে। যা কখনোই প্রকৃত ইসলাম দ্বারা স্বীকৃত নয়। যেসব সুফিবাদীরা বুযু্র্গদের ইলহামকে দলিল ধরে বিভিন্ন নতুন নতুন আমল চালু করেছে তারা সুস্পষ্ট গোমরাহীতে নিমজ্জিত। আজ এই উপমহাদেশে শতশত আমলের চর্চা হচ্ছে যার দলিল হচ্ছে বিভিন্ন বুযুর্গ ব্যক্তিদের কাশফ এবং ইলহাম। যা সুস্পষ্ট শিরকের পথে পরিচালিত।
ব্যক্তি বিশেষের অনুসরণ
উপমহাদেশের সুফি সুন্নিরা পীরের অন্ধ অনুসরণ করে। ইসলামে জ্ঞানী লোকের অনুসরণ নিষিদ্ধ নয়। তবে সেই অনুসরণের পথ হতে হবে রাসুলের আদর্শে। রাসুলের সুন্নাহ ছাড়া কারো অন্ধ অনুসরণ ইসলাম স্বীকৃতি দেয় না। অথচ সুফি সুন্নিরা যারা "ফানা ফিস শায়খের" নামে পীরের যেকোনো আদেশকে (হোক সেটা শরিয়ত বিরোধী) ইসলামের আদেশ মনে করে।
ফানা ফিস শাইখ বলতে পীর তার মুরিদ কে যে আদেশ করবেন, তা মুরিদ বিনা বাক্যে মেনে নিবে। পীর প্রকাশ্যে শরিয়ত বিরোধী হুকুম দিলেও তা বিনা আপত্তিতে মেনে নেওয়াই হবে মুরিদের কাজ। পীরের নির্দেশ কুরআন হাদিস বিরোধী হলেও তা মেনে নিতে হবে। মুরিদের ঐ কাজ জায়েয নাজায়েয খোঁজার কোন ইখতিয়ার নেই। যেমন: আমাদের দেশে সবচেয়ে হক্কানি পীরের দাবিদার চরমোনাইয়ের পীর সৈয়দ মোহাম্মাদ এছহাক বলেন:
‘’কামেল পীরের আদেশ পাইলে, নাপাক শারাবে (মদ) দ্বারাও জায়নামাজ রঙ্গিন করিয়া তাহাতে নামাজ পড়’। (সৈয়দ মোহাম্মাদ এছহাক এর রচনাবলী; আল-এছহাক পাবলিকেশন্স; বাংলাবাজার প্রকাশকাল ফেব্রুয়ারি ২০০৭; আশেক মা’শুক বা এস্কে এলাহী; পৃষ্ঠা ন: ৩৫)।
সুফি সুন্নিদের মতে পীরও শরিয়তের মানদন্ড বা দলিল। অথচ কুরআন সুন্নাহ দ্বারা সুস্পষ্ট প্রমাণিত যে, কুরআন এবং সুন্নাহর স্পষ্ট দলিল ছাড়া কারো অন্ধ অনুসরণ হচ্ছে নিশ্চিত গোমরাহী। আল্লাহ বলেন,
"তোমরা অনুসরণ কর, যা তোমাদের প্রতি পালকের পক্ষ থেকে অবতীর্ণ হয়েছে এবং আল্লাহকে বাদ দিয়ে অন্য সাথীদের অনুসরণ করো না। আর তোমরা অল্পই উপদেশ গ্রহণ কর"। [সুরা আরাফ ৭:৩ ]
এখানে আল্লাহকে বাদ দিয়ে বলতে, যারা আল্লাহ এবং রাসুলের সুন্নাহর বিপরীতে আদেশ দিবে তাদের কথা বলা হয়েছে। সুতরাং কুরআন সুন্নাহ ব্যতিরিকে কোনো পীরও শরিয়তের দলিল হতে পারে না।
আরও পড়ুন সুফিবাদ কী? কীভাবে উৎপত্তি এবং বর্তমান অবস্থা
কোনো বিশেষ বংশধারা
কোনো বিশেষ বংশধারা বা খানদানকে সত্যের মাপকাঠি মনে করা ইসলামী শরিয়তের মূলনীতি বিরোধী। কোনো বংশধারা যদি হকের মাপকাঠি হতো তবে নবি (সা.)-এর খানদানকেই বংশপরস্পরায় আজীবনের হকের মাপকাঠি হিসেবে ঘোষণা করা হতো। কিন্তু কোরআন-সুন্নায় তার কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় না। তিনি নিজেও তা কখনো ঘোষণা করেননি। বরং বলেছেন,
‘আমল যাকে পিছিয়ে রেখেছে বংশ তাকে এগিয়ে নিতে পারে না।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ২৬৯৯)
অথচ আমাদের উপমহাদেশে পীরের ছেলেকে পীর বানিয়ে আল্লাহর অলি ঘোষণা করা হয়। ভালো করে খোঁজ নিয়ে দেখলে দেখা যাবে যে পীরের ছেলের চাইতেও যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তি পীর হওয়ার দাবি রাখেন। কিন্তু বংশানুক্রমিক না হাওয়ায় তাদের পীর হিসাবে নিযুক্ত করা হয় না। এখানে শুধুমাত্র একক পীরের বংশকেই প্রাধান্য দেওয়া হয়। অর্থাৎ বংশকেই শরিয়তের দলিল সাব্যস্ত করা হয়। যা ইসলামে স্বীকৃত নয়।
আরও পড়ুন উছিলা কী? উছিলার বিস্তারিত ব্যাখ্যা
অধিকাংশ মানুষের মতামত
অধিকাংশ মানুষ যেই মতে বা পথে বিশ্বাসী, সেই মত এবং পথই যে সঠিক ও হক তা কখনোই নয়। অধিকাংশ মানুষ সবসময়ই সঠিক থাকে না। আল্লাহ পবিত্র কুরআনে বলেন,
"আর যদি আপনি (হে রাসুল সা.) পৃথিবীর অধিকাংশ লোকের কথা মেনে নেন, তবে তারা আপনাকে আল্লাহর পথ থেকে বিপথগামী করে দেবে। তারা শুধু অলীক কল্পনার অনুসরণ করে এবং সম্পূর্ণ অনুমান ভিত্তিক কথাবার্তা বলে থাকে।" (সুরা আনআম : ১১৬)
এই আয়াত দ্বারা সুস্পষ্ট ভাবে প্রমাণিত যে অধিকাংশ লোক কখনোই হক বা সত্যের মাপকাঠি হতে পারে না। এবং তাদের অনুসরণও করা যাবে না। অথচ উপমহাদেশে সুফি সুন্নিদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা দেখে যেকোনো কেউ বলতে পারে যে, এরাই মনে হয় সঠিক পথে আছে। কিন্তু পবিত্র কুরআন বলছে কম সংখ্যক লোকই সঠিক পথে থাকবে। যেমন: আল্লাহ বলেন,
"অতএব, অল্প সংখ্যক ব্যতীত তারা ইমান আনবে না।" (সুরা আন নিসা ৪৬)
"আমার বান্দাদের মধ্যে অল্প সংখ্যক লোকই কৃতজ্ঞ।"(সুরা আস সাবা:১৩)
"অধিকাংশ লোক আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করেও তারা মুশরিক" । (সুরা: ইউসুফ আয়াত: ১০৬)
উপরোক্ত আয়াত দ্বারা প্রমাণিত অল্পসংখ্যক লোকই কিয়ামত পর্যন্ত ইমান আনবে এবং আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞ থাকবে। সেইসাথে অধিকাংশ লোক ইমান আনলেও তারা মুশরিক। সুতরাং কুরআন হাদিসের বিপরীতে অধিকাংশ লোকের অনুসরণ বা
উপরোক্ত আলোচনা থেকে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, ইসলামের মূল চারটি উৎস ছাড়া শরিয়তের আর কোনো উৎস নেই। উপমহাদেশের অধিকাংশ মুসলমান যারা সুফিবাদে বিশ্বাসী তারা সঠিক ইসলামের বাইরেও সুফীবাদের নামে (যা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাত নামধারী) নতুন নতুন ইবাদত ও আমল করে। যা কখনোই রাসুলুল্লাহ (সা.) কতৃক স্বীকৃত নয়। সুতরাং তারা সুস্পষ্ট পথভ্রষ্টতায় নিমজ্জিত।
সাখাওয়াতুল আলম চৌধুরী
১৬ মার্চ, ২০২১
পতেঙ্গা, চট্টগ্রাম।
ট্যাগ
শরিয়তের মানদণ্ড
শরীয়ত মানে কি
শরিয়ত মানে কি
দ্বীন ও শরীয়ত
শরীয়ত ও মারফত কি
শরিয়ত ও মারফত
শরিয়ত ও মারিফত কি
শরিয়ত ও মারফত কি