সুফি সুন্নীদের আল্লাহ্ সম্পর্কিত আকিদা সমূহ |
সুফি সুন্নীদের আল্লাহ্ সম্পর্কিত আকিদা সমূহ
আমাদের উপমহাদেশে সুফিদের মাধ্যমেই ইসলাম প্রচারের প্রসার লাভ করে। সুফিদের দ্বারা ইসলাম প্রচার হওয়ার কারণে এখানকার ঈমান আকিদায় সুফিদের প্রবল প্রভাব বিদ্যমান। তৎকালীন সময়ে শিক্ষার প্রসার না থাকার কারণে কুরআন হাদিসের চর্চা ছিলো না। যারফলে ব্যক্তি সুফিদের দ্বারা সুফিবাদের বিভিন্ন ঈমান আকিদা উপমহাদেশে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। সেইসব আকিদা এখনো সুন্নীদের বিশ্বাসের মধ্যে রয়েছে। সেই হিসাবে আজ আমরা জানার চেষ্টা করবো সুফি সুন্নীদের "আল্লাহ্" সম্পর্কিত ঈমান এবং আকিদা কী।
আল্লাহ্ নিরাকার
সুফি সুন্নীদের মতে মহান আল্লাহ্র কোনো আকার নেই। তিনি অস্তিত্ব সম্পন্ন নিরাকার স্রষ্টা। অর্থাৎ তাঁর অস্তিত্ব আছে কিন্তু আমরা তার আকার জানি না। তাই তিনি নিরাকার। অর্থাৎ যেহেতু তাঁর সাদৃশ্য কেউ নেই, সেহেতু তিনি সুন্নীদের কাছে নিরাকার। এই বিশ্বাস উপমহাদেশের সকল মুসলমানদের মধ্যে বিদ্যমান।
আরও পড়ুন জন্মগত মুসলিম ধর্মমতে মুসলিম
আল্লাহ্ সর্বত্র বিরাজমান
যারা সুন্নী সুফিবাদে বিশ্বাসী তাদের আকিদা হলো, আল্লাহ্ সর্বত্র বিরাজমান। অর্থাৎ পৃথিবীর সব জায়গায়তেই আল্লাহ্র শারীরিক অবস্থান বিদ্যমান। পৃথিবীর এমন কোনো জায়গা নেই যেখানে আল্লাহ্ স্বশরীরে নেই। এই জঘন্য আকিদা ইহুদী খ্রিস্টান সহ তৎকালীন মক্কার মুশরিকদেরও ছিলো না। এই আকিদা লালনকারী হচ্ছে সনাতন হিন্দুরা। যেহেতু আমরা উপমহাদেশের মুসলমানরা হিন্দু পরিবর্তিত মুসলিম, সেহেতু আমাদের মধ্যে আল্লাহ্ সম্পর্কিত এই বিশ্বাস খুব সহজেই চলে আসে।
অহেদাতুল অজুদ বা সর্বেশ্বরবাদ
যারা সুফি বিশ্বাসী সুন্নী তাদের বিশ্বাস হচ্ছে সবকিছুর মধ্যেই আল্লাহর অস্তিত্ব রয়েছে। এই পৃথিবীর গাছপালা, জীবজন্তু, শিয়াল, কুকুর, পাথর, মূর্তি ইত্যাদি সবকিছুতেই আল্লাহ্ নিজে রয়েছেন। যা একটি গ্রীক এবং সনাতন হিন্দু ধর্মের আকিদা। মক্কার কাফির মুশরিক, খ্রিস্টান, ইহুদীরাও আল্লাহ্ সম্পর্কে এমন অদ্ভুত আকিদা পোষণ করতো না।
এই বিশ্বাসের জন্মের কারণে হচ্ছে -চতুর্থ হিজরি শতাব্দীর পর ইসলাম আস্ত আস্তে সুফিবাদের দিকে ঝুকতে থাকে, সাথে সাথে যুক্তিবৃত্তিক, বুদ্ধিবৃত্তিক দর্শন প্রসার ঘটে। ষষ্ঠ হিজরি শতাব্দীতে ভারতীয় ‘সর্বেশ্বরবাদ’ বা গ্রীসের ‘Pantheism’ মুসলিমগন “ওয়াহদাতুল ওজুদ” নামে নতুন একটি বিশ্বাস গ্রহন করে।
এর অর্থ এই দাঁড়ায় যে ইসলামের প্রথম পাঁচ শতাব্দীতে “ওয়াহদাতুল ওজুদ” নামে কোন আকিদা ছিল না। (আবু হানিফা রহ. রচিত ফিকহুল আকবর বঙ্গানুবাদ ও ব্যাখ্যা’, “ইসলামী আকীদা ও ভ্রান্ত মতবাদ)।
“মুসলিম নামধরি সুফিদের মধ্যে সর্ব প্রথম তাদের কথিত শায়েখে আকবর ইবনুল আরাবী এই মতবাদটি উদ্ভাবন করেন এবং তার অনুসাবীগণ এটির প্রচার ও প্রসার ঘটান। ইবনুল আরাবী এই মতবাদটি ব্যক্ত করতে গিয়ে বলেন, “সমগ্র সৃষ্টির অস্তিত্ব হুবহু আল্লাহর অস্তিত্ব”। এখানে তিনি ‘ওয়াহদাতুল ওজুদ’ তথা স্রষ্টা ও সৃষ্টির অস্তিত্বের ঐক্য ও অভেদত্বকেই বুঝিয়েছেন। (“ইসলামী আকীদা ও ভ্রান্ত মতবাদ” প্রকাশণায়; মাকতাবাতুল আবরার; পৃষ্ঠা -৫৪৭)।
সুফিদের এই বিশ্বাস এই উপমহাদেশেও তাদের আকিদার সাথে সাথে ছড়িয়ে পড়ে। যে বিশ্বাস এখন উপমহাদেশের প্রায় প্রতিটি সুফি সুন্নীরা লালন করে।
আরও পড়ুন পূর্বপুরুষদের অন্ধ অনুসরণ
হুলূল বা অনুপ্রবেশবাদ
সুফি সুন্নীদের ধর্মীয় বিশ্বাস হচ্ছে একজন বান্দা যখন আল্লাহর প্রেমে এতই মশগুল হয়ে যায় যে, তখন আল্লাহ্ স্বয়ং ঐ বান্দার মধ্যে প্রবেশ করে। তখন আল্লাহ্ এবং বান্দা একাকার হয়ে যায়। এই আকিদাও গ্রীক পারস্য থেকে ধার করা।
এইসব আকিদা প্রচার ও প্রসার হওয়ার কারণ হচ্ছে - সুফিদের পীর মুরিদী ব্যবস্থার প্রচলনের জন্য। আমাদের উপমহাদেশে সবাই পীর মুরিদী পালন না করলেও অবিশ্বাস করে না। যারফলে এইসব আকিদাও তারা অবিশ্বাস করে না।
আরও পড়ুন অধিকাংশ মানুষের মতামত কেন ইসলামে গ্রহণযোগ্য নয়?
ফানাফিল্লাহ
সুন্নি সুফিদের গুরুত্বপূর্ণ একটি বিশ্বাস হচ্ছে ফানাবিল্লাহ বা আল্লাহ্য় বিলীন হওয়া। অর্থাৎ একজন বান্দা আল্লাহ্র প্রেমে মত্ত হয়ে একসময় আল্লাহ্র মধ্যে বিলীন হয়ে যায়। এটাকে বলা হয় ফানাবিল্লাহ। সুন্নীদের মধ্যে যারা পীর - মুরিদের চর্চা করে তারা এই বিশ্বাস খুব প্রবলভাবে ধারণ করে।
বাকিবিল্লাহ
একজন বান্দা আল্লাহর প্রেমে মত্ত হয়ে যখন আল্লাহ্র সাথে স্থায়ীভাবে বসবাস করে তখন তাকে বলা হয় বাকিবিল্লাহ। এই পর্যায়ে বান্দা আর আল্লাহ্ কোনো ফারাক থাকে না। একজন অপরজনের সাথে মিশে একাকার হয়ে যায়। যেমন পানিতে চিনি মেশালে তা আর পৃথক করা যায় না। ঠিক তেমনি বান্দাও আল্লাহর সাথে মিশে একাকার হয়ে যায়। এজন্য সুফিবাদে পীরকে সিজদা করার রীতি প্রচলিত আছে। যা ইসলামে সুস্পষ্ট শির্ক।
আরও পড়ুন হিদায়াত পাওয়ার শর্তসমূহ
এই শির্কি আকিদা আজ প্রতিটি মুসলমানদের বিশ্বাসে মিশে রয়েছে। সাধারণ মুসলমানগণ নিজেরাই জানে না তারা কি আকিদা পোষণ করছে। কেননা উপমহাদেশের মুসলমানগণ কখনোই কুরআন হাদিসের চর্চা করে না। তারা জন্মগত মুসলমান এবং ঈমান আকিদাও জন্মগতভাবে বিশ্বাস করে।
আরও পড়ুন সুফিবাদ কী, কীভাবে উৎপত্তি এবং বর্তমান অবস্থা
দুনিয়ায় আল্লাহ্কে দেখা
সুন্নীদের গুরুত্বপূর্ণ আকিদা হলো দুনিয়ায় বসেই আল্লাহ্কে দেখা সম্ভব। একজন মুসলিম মুরিদ বা ভক্ত যখন আল্লাহ্র প্রেমে দিওয়ানা হয়ে বাকিবিল্লাহ স্তরে পৌঁছে যায় তখন তার অন্তর চক্ষু খুলে যায়। এইসময় সে আরশ, কুরছি, লৌহ, কলব, সাত আসমান, জমিন সবকিছুই দেখতে পায়। এইসবের সাথে সাথে সে আল্লাহ্কেও দেখতে পায়। অথচ প্রকৃত ইসলাম মতে দুনিয়ায় বসে কেউ কখনো জাগ্রত অবস্থায় স্বচক্ষে আল্লাহ্কে দেখতে পারবে না। আল্লাহ্ সম্পর্কে অন্যান্য আকিদার মতো এই আকিদাও একটি ভ্রান্ত আকিদা।
মাধ্যম দিয়ে আল্লাহ্ পাওয়া
সুফি সুন্নীদের একটি ধ্বংসাত্মক ভ্রান্ত আকিদার একটি হলো কোনো মাধ্যম ছাড়া আল্লাহকে পাওয়া যায় না ডাকা যায় না। মাধ্যম ছাড়া ডাকলে তিনি সাড়া দেন না। তাই তাঁর প্রিয় কাউকে মাধ্যম বা মধ্যস্তাকারী হিসাবে ডাকলে আল্লাহ্ দ্রুত সাড়া দেন। তাই সুন্নীরা তাদের পীর অলি আউলিয়াদের মাধ্যম করে আল্লাহ্কে ডাকে। যাতে এইসব অলি আউলিয়াদের মাধ্যমে বা উছিলা করে তারা তাদের যাবতীয় কাজ আল্লাহ্ থেকে হাসিল করতে পারে।
এই ক্ষেত্রে তারা আল্লাহর সাথে রাজা বাদশার তুলনা দেন। সাধারণ মানুষ যেমন রাজা বাদশার কাছে সরাসরি যেতে পারে না বা কিছু চাইতে পারে না। কাউকে রাজা পর্যন্ত পৌঁছেতে হলে কোনো বিশ্বস্ত মাধ্যমে যেতে হয়। যারা রাজার কাছে পরিচিত এবং বিশ্বস্ত। ঠিক একইভাবে আল্লাহর কাছেও কাউকে যেতে হলে বা কিছু চাইতে বা পেতে হলে অবশ্যই আল্লাহর প্রিয় বান্দা আল্লাহর অলিদের মারফতে যেতে হবে।
আরও পড়ুন সুফিবাদের শরীয়তের উৎস ও যৌক্তিকতা
মুমিনের কলব আল্লাহ্র আরশ
সুফি সুন্নীদের মতে প্রতিটি মুমিনের অন্তরে আল্লাহ্ রয়েছে। যে ঠিকমতো পীরের নির্দেশ মেনে তার অন্তরে আল্লাহকে জায়গা দিতে পেরেছে, সে-ই আল্লাহ্অলা হয়ে গেছে। এই ভিত্তিতে যত কল্লা (মানুষ) তত আল্লাহ্। সেজন্য সুফিবাদে মুমিনের অন্তরে আল্লাহ্ থাকার কারণে পীরকে অলি আউলিয়াদের তারা সিজদা করে।
উপরোক্ত বিভিন্ন ঈমান আকিদা আমরা বিচার বিশ্লেষণ করলে দেখতে পাবো যে এইসব ঈমান আকিদা কোনটাই ইসলামের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ নয়। সুতরাং আমাদের উচিত হবে কুরআন এবং হাদিস বিশ্লেষণ করে সঠিক ইসলাম জেনে বুঝে তারপরে ধর্ম পালন করা।
আরও পড়ুন আল্লাহ্ সম্পর্কিত আকিদার জবাব
সাখাওয়াতুল আলম চৌধুরী
২৫ জানুয়ারি, ২০২২
পতেঙ্গা, চট্টগ্রাম।