জন্মগত মুসলিম বনাম ধর্ম মতে মুসলিম |
জন্মগত মুসলিম বনাম ধর্ম মতে মুসলিম
ভারতীয় উপমহাদেশে বর্তমানে আমরা যারা মুসলমান আছি, তাদের সিংহভাগই বংশগত বা জন্মগত মুসলমান। কিন্তু ইসলাম কখনোই জন্মগত মুসলমান কে প্রকৃত মুমিনের স্বীকৃতি দেয় না, যতক্ষণ না সে পরিপূর্ণ ভাবে ইমানের সহিত ইসলামে প্রবেশ না করছে। তাই জন্মগত মুসলিম কখনোই প্রকৃত মুসলমান নয়। বরং এটি তার একটি খেতাবের মতো। তাই আজ আমরা জানার চেষ্টা করব জন্মগত মুসলিম এবং ধর্মমতে মুসলিম কাকে বলে। ইসলাম কোনো মুসলিম হওয়ার জন্য আমাদের নির্দেশ দিয়েছেন।
মুসলিম শব্দের অর্থ
মুসলমান বা মুসলিম (আরবি:مسلم-অর্থ: আত্মসমর্পণ, অনুগত) । অর্থাৎ মুসলিম হলো সেই লোক যে আল্লাহর উপর ইমান এনে নিজের ইচ্ছাকে আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণ করে ৷ মুসলমানের পরিচয় জানতে হলে দুটি বিষয় সম্পর্কে সুস্পষ্ট জ্ঞান থাকা প্রয়োজন। যার একটি হলো কুফর আর অন্যটি হলো ইসলাম।
কুফর হলো- আল্লাহ তাআলার হুকুম তথা পবিত্র কুরআন এবং সুন্নাহ বর্ণিত আইনকানুনকে অস্বীকার করা এবং সেইমতো জীবনযাপন না করা।
ইসলাম হলো- শুধুমাত্র আল্লাহ তাআলার হুকুম তথা কুরআন এবং সুন্নাহকে মেনে নিয়ে সেইমতো জীবনযাপন করা।
সুতরাং মুসলিম শব্দটি ইমানের সাথে সম্পর্কিত। শুধু নাম বা খেতাবধারী কিংবা জন্মগত মুসলিম মানেই সত্যিকারের মুসলিম নয়। বরং প্রকৃত মুসলমান হচ্ছে সে যে পরিপূর্ণভাবে ইমান এনে ইসলাম পালন করে।
আরও পড়ুন উছিলা কী? উছিলার বিস্তারিত ব্যাখ্যা
ইমান কী
ইমান হচ্ছে ইসলামের পরিপূর্ণ বিধানকে মুখে স্বীকৃতি, অন্তরে বিশ্বাস এবং কাজে পূর্ণ করা। যার সহজ অর্থ হলো ইসলামের বিধানকে মুখে স্বীকার করা, অন্তরে বিশ্বাস করা এবং সেইমতে কাজ করাই হচ্ছে ইমান। যে এই কাজ অর্থাৎ ইমান এনে ইসলামের প্রতি আনুগত্যশীল হয় তাকে বলা হয় মুসলিম।
আরও পড়ুন ঈমান কী? পরিপূর্ণ ঈমানের বিস্তারিত ব্যাখ্যা
ইমান থেকেই মুমিন
একজন মানুষ ইমান আনার পরই মুসলিমে পরিনত হয়। সুতরাং কেউ ইমানদার হলেই সে মুসলিম হবে। আর ইমানদার হতে হলে তার অনেকগুলো গুনাবলীর প্রয়োজন। যার মধ্যে মুমিনের গুণাবলী নেই সে কখনোই মুসলিম নয়।
মুমিনের গুণাবলী
মুমিন বা মুসলিম হতে হলে তার মধ্যে কিছু গুণাবলী থাকা আবশ্যক। আর তা হচ্ছে -
১) কালেমাতে পূর্ণ বিশ্বাস।
২) আল্লাহর কিতাবে সন্দেহ পোষণ না করা।
৩) আল্লাহর বিধানে পূর্ণ আনুগত্য করা।
৪) উদ্যমী হওয়া এবং দ্বীনের জ্ঞানার্জন করা।
৫) শিরকমুক্ত বিশ্বাস এবং নিফাকী বর্জন করা।
৬) অন্ধবিশ্বাস না করা ও পূর্বপুরুষদের অন্ধ অনুসরণ না করা।
৭) রাসুলুল্লাহ সাঃ এর পূর্নাঙ্গ অনুসরণ।
৮) সর্বাবস্থায় আল্লাহর উপর ভরসা করা।
৯) সৎকাজের আদেশ অসৎকাজের নিষেধ করা।
১০) নিয়মিত সালাত আদায় করা।
১১) বিনয় ও কোমলতা ও আল্লাহ ভীরু হওয়া।
১২) তওবাকারী ও তাকওয়া অবলম্বনকারী।
১৩) লজ্জ্বাস্থানের হেফাজতকারী ও পরহেজগারী।
১৪) জিহাদকারী ও আপোষহীন।
১৫) ওয়াদা রক্ষা করা।
১৬) দানশীলতা।
১৭) আমানতদারী হওয়ার
১৮) ধৈর্যশীল হওয়া ইত্যাদি।
আরও পড়ুন সুফিবাদ কী? কীভাবে উৎপত্তি এবং বর্তমান অবস্থা
ইমান জন্মগত নয়
উপরের উল্লিখিত বৈশিষ্ট্য থেকে এটা সুস্পষ্ট যে, কেউ মুসলিম ঘরে জন্ম নিলেই এইসব গুণের অধিকারী হতে পারে না। এইসব গুণ ধারণ করতে হলে জ্ঞান এবং আমলের প্রয়োজন। সুতরাং যে ব্যক্তি জ্ঞানার্জনের মাধ্যমে নিয়মিত আমলের দ্বারা ইসলামে পরিপূর্ণভাবে প্রবেশ করবে, সে ই হবে প্রকৃত মুসলমান।
জন্মগত মুসলিম না হওয়ার বিভিন্ন কারণ
কোনো জন্মগত মুসলিমই প্রকৃত মুসলিম হতে পারে না। যতক্ষন সে জেনেবুঝে ইমান এনে সেইমতো আমল না করে। আমাদের উপমহাদেশেও লক্ষ কোটি জন্মগত মুসলমান থাকলেও তারা সবাই প্রকৃত মুমিন নয়। এর কারণসমূহ হচ্ছে,
শিরক
আল্লাহ বলেন "অধিকাংশ লোকই ইমান আনে শিরকযুক্ত অবস্থায়"। অর্থাৎ মুসলমান হওয়ার পরও তারা মুশরিক। অর্থাৎ তারা ইমান আনার পরও শিরকে লিপ্ত। ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলমানগণ শিরকের সংজ্ঞা-ই জানে না। তারা জানে না শিরক কী? কীভাবে একজন মানুষ শিরকের যুক্ত হয়। আর শিরক এমন একটি অপরাধ যার কোনো ক্ষমা কিয়ামতের মাঠে হবে না। তাই শিরক করা মানেই হচ্ছে ইমানহারা হওয়া। আল্লাহ বলেন,
"নিঃসন্দেহে আল্লাহ তাকে ক্ষমা করেন না, যে লোক তাঁর সাথে শরীক করে। তিনি ক্ষমা করেন এর নিম্ন পর্যায়ের পাপ, যার জন্য তিনি ইচ্ছা করেন।"(সূরাঃ আন নিসা, আয়াতঃ ৪৮)
সুতরাং শিরক করলেই ইমান নষ্ট হয়ে যাবে। যা তওবা ছাড়া কখনোই পরিশুদ্ধ হবেনা। অতএব শিরকের কারণে জন্মগত মুসলমানদের জ্ঞান না থাকার কারণে প্রকৃত মুসলিম থাকে না।
আরও পড়ুন শিরক কী? মানুষ কীভাবে শিরক করে
বিদআত
শিরকের প্রথম পদক্ষেপ হচ্ছে বিদআত। আমাদের এই উপমহাদেশে এখনো বিদআত কী জিনিস সেটাই মুসলমানরা জানে না। বিদআত কীভাবে একজন মানুষকে মুশরিকে পরিনত করে তা আমাদের সাধারণ জ্ঞানে নেই। এই বিদআতের কী কঠিন শান্তি তা এখনো এখানকার মুসলমানগণ উপলব্ধিতে নেই সঠিক জ্ঞানের অভাবে। অথচ আল্লাহর রাসুল বলেন,
"যে ব্যক্তি এমন আমল করল যাতে আমার কোন নির্দেশনা নেই, তা পরিত্যাজ্য।" (মুসলিম হা/১৭১৮)
অন্য হাদিসে এসেছে, রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) হামদ ও ছালাতের পর বলেন,
‘নিশ্চয়ই শ্রেষ্ঠ বাণী হ’ল আল্লাহর কিতাব এবং শ্রেষ্ঠ হেদায়াত হ’ল মুহাম্মাদের হেদায়াত। আর নিকৃষ্টতম কাজ হ’ল দ্বীনের মধ্যে নতুন সৃষ্টি এবং প্রত্যেক নতুন সৃষ্টিই হ’ল ভ্রষ্টতা’ (মুসলিম, মিশকাত হা/১৪১)। আর নাসাঈতে রয়েছে, ‘প্রত্যেক ভ্রষ্টতার পরিণতি জাহান্নাম’ (নাসাঈ হা/১৫৭৮)।
সুতরাং বিদআত এমন একটি বিষয় যা একজন মুসলিমের সমস্ত আমল ধ্বংস করে দেয়। এমনকি নিয়মিত বিদআতী আমলের কারণে একসময় শিরকে লিপ্ত হয়ে পড়ে। যা তাকে ইমানহারা করে দেয়।
আরও পড়ুন বর্তমান সমাজের মুনাফিকের পরিচয় ও পরিনতি
পূর্বপুরুষদের অন্ধ অনুসরণ
বাপ দাদার অন্ধ অনুসরণের কারণেও উপমহাদেশের জন্মগত মুসলমানগণ প্রকৃত মুসলিম নয়। তারা মনে করে বাপ দাদা থেকে যা তারা ইসলাম হিসাবে পেয়েছে, তা-ই বুঝি প্রকৃত ইসলাম। অথচ তারা যাচাই করে দেখার চেষ্টা করে না যে, আমরা যা পালন করছি আসলেই তা সঠিক কিনা? আল্লাহ পবিত্র কুরআনে শতশত আয়াতে পূর্বপুরুষদের অন্ধ অনুসরণ না করার কথা উল্লেখ করেছেন। আল্লাহ বলেন,
"আর যখন তাদেরকে কেউ বলে যে, সে হুকুমেরই আনুগত্য কর যা আল্লাহ তা'আলা নাযিল করেছেন, তখন তারা বলে কখনো না, আমরা তো সে বিষয়েরই অনুসরণ করব। যাতে আমরা আমাদের বাপ-দাদাদের কে দেখেছি। যদি ও তাদের বাপ দাদারা কিছুই জানতো না, জানতো না সরল পথও।" (সুরা বাকারা ২:১৭০)
এই আয়াত দ্বারা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত যে, বাপ দাদার অন্ধ অনুসরণ করা যাবে না। কুরআন এবং সুন্নাহর সঠিক জ্ঞান অর্জন করে যাচাই করে তবেই ইসলাম পালন করতে হবে। যে এমন করবে সে-ই হবে প্রকৃত মুসলমান।
অথচ বাজার থেকে আলু পটল কিনলেও আমরা একটু যাচাই করে দেখি, সেটা আসলে ভালো নাকি নষ্ট! আর যে ইমান এবং আমল দ্বারা দুনিয়া এবং আখিরাত নির্ভর। সেই ইমান এবং আমলের ক্ষেত্রে আমরা অন্ধ অনুসরণকেই প্রাধান্য দিয়ে থাকি। সুতরাং যে ব্যক্তি পূর্বপুরুষদের অন্ধ অনুসরণ করে, যার মধ্যে মুমিনের গুণ এবং শিরক বিদআত সম্পর্কিত কোনো জ্ঞান থাকে না সে কখনোই প্রকৃত মুসলিম নয়। আর যে পূর্বপুরুষদের অন্ধ অনুসরণ করে না এবং জ্ঞানার্জনের মাধ্যমে মুমিনের গুণাবলী ধারণ করে, সে ই প্রকৃত মুসলিম।
আরও পড়ুন প্রবৃত্তির অনুসরণ ও তার পরিনতি
আনুষ্ঠানিক ইবাদত
আমরা মনে করি শুধুমাত্র সালাত, সিয়াম, হজ্জ্ব, যাকাত, কুরবানি ইত্যাদিই হচ্ছে ইসলাম। অধিকাংশ জন্মগত মুসলিমের ধারণা এইসব বিশ্বাস করলে এবং যতটুকু পারা যায় তা পালন করলেই বুঝি ইসলাম পালন হয়ে যাবে। এবং আমরা নিজেকে মুসলিম দাবি করতে পারবো। কিন্তু ইসলাম হচ্ছে পরিপূর্ণ একটি জীবনব্যবস্থা। যেখানে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত একজন ব্যক্তির জীবনযাপন কীভাবে হবে তা বলে দেওয়া হয়েছে। সুতরাং যে এইসব জ্ঞান রাখবে না সে কখনোই মুসলিম হতে পারে না।
যদি জন্মগত মুসলিম হওয়া যেতো তাহলে নূহ আ. এর ছেলে এবং লুত আ. এর সন্তানসন্ততিরাও মুসলিম হতো। অথচ আল্লাহ বলেন তারা কাফির। কেননা তাদের কর্মই তাদেরকে কাফিরে পরিনত করেছে। সুতরাং আমাদের দেশে জন্মগত ভাবে ৯০ ভাগ মুসলমানের দেশ বলা হলেও প্রকৃতপক্ষে আমাদের দেশ ৯০ ভাগ নয় বরং ১০ ভাগ পাওয়া যায় কিনা সন্দেহ।
আরও পড়ুন সুফি সুন্নিদের পীর আউলিয়া সম্পর্কিত আকিদার জবাব
মুমিন হওয়া কখনোই জন্মগত নয়
আমরা পবিত্র কুরআনের অনেক আয়াতের পর্যালোচনা থেকে বুঝতে পারি, জন্মগতভাবে মুসলিম পরিবারে জন্ম নিলেই মুমিন হওয়া যায় না। কেননা আল্লাহ বলেন,
"
এবং অবশ্যই মুসলমান না হয়ে মৃত্যুবরণ করো না।।" ( সুরা ইমরান ৩:১০২ )
‘হে ইমানদাররা! তোমরা পরিপূর্ণভাবে ইসলামে প্রবেশ করো।" (সুরা: বাকারা, আয়াত: ২০৮)
‘যে ব্যক্তি ইসলাম ছাড়া অন্য কোনো ধর্ম সন্ধান করে, কস্মিনকালেও তা গ্রহণ করা হবে না এবং আখেরাতে সে হবে ক্ষতিগ্রস্ত।’ (সুরা আলে ইমরান-৮৫)
"নিঃসন্দেহে আল্লাহর নিকট গ্রহণযোগ্য দ্বীন একমাত্র ইসলাম।" (আলে ইমরান -১৯)
এইসব আয়াত দ্বারা আল্লাহ মানুষকে সুস্পষ্টভাবে ইসলামে প্রবেশ করার কথা, পরিপূর্ণ ইসলাম পালন করার কথা এবং মুসলমান না হয়ে মৃত্যুবরণ পর্যন্ত করতে নিষেধ করা হয়েছে। সেইসাথে ইসলাম ছাড়া কোনো কিছুকেই গ্রহণ করা হবেনা বলে আল্লাহ সুদৃঢ় ঘোষণা দিয়েছেন।
এ থেকে এটা নিশ্চিত যে, জন্মগতভাবে মুসলমান হলেই মুসলিম হওয়া যায় না। বরং মুসলমান হওয়ার জন্য প্রকৃত ইমানের যোগ্যতার প্রয়োজন। যেসব যোগ্যতা একজন মানুষ তার বিশ্বাস আমল এবং তাকওয়ার মাধ্যমে অর্জন করে।
সুতরাং সঠিক মুসলমান হচ্ছে সে- যে ইমানের গুণাবলী অর্জন করে মুসলিম হয়েছে। যা কখনোই শুধুমাত্র জন্ম দ্বারা পরিপূর্ণ হওয়ার নয়।
সাখাওয়াতুল আলম চৌধুরী
১১ ডিসেম্বর, ২০২১
পতেঙ্গা, চট্টগ্রাম।
কৃতজ্ঞতা
By "Bangla Quran" App - https://alquranbd.com/AndroidApp