আমাদের উপমহাদেশে তাবিজ একটি পরিচিত শব্দ। সকল ধর্মাবলম্বীরাই তাবিজ ব্যবহার করে। কিন্তু ইসলামে বিভিন্ন কারণে তাবিজ জায়েজ নয়। যদিও এর পক্ষে বিভিন্ন মতামত রয়েছে। আজ আমরা কুরআন হাদিসের আলোকে জানার চেষ্টা করবো জায়েজ হলেও বর্তমান যুগে কেন তাবিজ হারাম। তাবিজ কীভাবে একজন ঈমানদারকে শিরক করিয়ে মুশরিকে পরিনত করে। সেইসাথে বর্তমান যুগে তাবিজের ক্ষতিকর দিক।
তাবিজ কী?
তাবিজ হচ্ছে এমন বস্তু যা বাহুর এক প্রকার অলঙ্কার বিশেষ, কবচ বা মাদুলি।যা মানুষেরা ঐশ্বরিক কোনো লাভের উদ্দেশ্যে পরিধান করে। সোজাকথায় তাবিজ হচ্ছে এমন ক্ষুদ্র বস্তু যার ভালো মন্দ করার নিজস্ব ক্ষমতা থাকার কারণে মানুষ তা শরীরে, বাহুতে বা গলায় ঝুলিয়ে রাখে।আমাদের উপমহাদেশে কাগজে বা কাপড়ে আরবি বা অন্য কোনো ভাষায় লিখিত দোয়া কালামকে তাবিজ বলে। আরবিতে লিখিত ছাড়া শুধু বস্তুকে বলা হয় তামীমা। যেমন হাড়, পিতলের কোনো কিছু বা কড়ি ইত্যাদি।
তাবিজের মূল উদ্দেশ্যঃ
আমাদের উপমহাদেশে তাবিজ দেওয়া এবং নেওয়ার মূল উদ্দেশ্য হলো, এই তাবিজ তাকে গায়েবি খারাপ কোনো কিছু থেকে রক্ষা করবে। বিশেষ করে জ্বীন ভুতের আছর কিংবা কারো উপকার বা অপকার করার উদ্দেশ্যে তাবিজ পরিধান করে।
মোটকথা যারা তাবিজ দেয় এবং নেয় তাদের মূল উদ্দেশ্যই থাকে, এই তাবিজই তার ভালো মন্দ করার মালিক।কোনো মুসলমানই আল্লাহর উপর ভরসা করে তাবিজ দেয় না। বরং তাবিজের উপর ভরসা রেখে আল্লাহর উপর বিশ্বাস রাখে।
তাবিজ সংক্রান্ত হাদীসঃ
রাসুলুল্লাহ সাঃ এর জীবনী থেকে আমরা জানতে পারি যে, তিনি তাবিজ বা তামীমা ব্যবহার নিষিদ্ধ এবং নিষেধ করেছেন। কিন্তু তাবেয়ীদের জীবনীতে কুরআনের আয়াত দ্বারা তাবিজ দেওয়ার প্রমাণও রয়েছে। ফলে তাবিজ নিয়ে ইসলামে দুটি মতের সৃষ্টি হয়েছে। আমরা এখন তাবিজের পক্ষে বিপক্ষের হাদীস গুলো পর্যালোচনা করে বর্তমান সময়ের বিবেচনায় সঠিক সত্যতা নিরূপণ করার চেষ্টা করব ইনশাআল্লাহ।
বিপক্ষের দলিলঃ
তাবিজ সংক্রান্ত যত হাদীস মুহাদিসগণ বর্ণনা করেছেন, তারমধ্যে সর্বাধিক হাদীস এসেছে তাবিজ ব্যবহারের বিরুদ্ধে। অর্থাৎ রাসুলুল্লাহ সাঃ থেকে সরাসরি শক্তিশালী হাদিস দ্বারা প্রমাণিত যে তাবিজ তামীমা ব্যবহার করা সরাসরি হারাম এবং শিরক।
আবূ বাসীর আনসারী আব্বাদ ইবনু তামীমকে থেকে বর্ণিতঃ
তিনি (আবূ বাসীর) রসূলুল্লাহ্ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে কোনও একা সফরে ছিলেন। অতঃপর রসূলুল্লাহ্ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একজনকে কাজে পাঠালেন, আবদুল্লাহ্ ইব্নু আবূ বাকর (রা) বলেন, আমার বিশ্বাস যে, তখন সমস্ত লোক ঘুমিয়েছিল। কাজটি ছিল কোন উটের গলায় কোন হার, তাবীয কিংবা ঘন্টা যেন না থাকে। থাকলে কেটে ফেলতে বলেন। (মুয়াত্তা ইমাম মালিক, হাদিস নং ১৬৮৭, বুখারী ৩০০৫, মুসলিম ২১১৫)
জাহেলী যুগে কুসংস্কারের কারণে উটের গলায় মালা লটকানো হতো যাতে উট বদ নজর থেকে রক্ষা পায়। আল্লাহর রসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এই ভ্রান্ত ধারণা ও রসম উৎখাতের ব্যবস্থা করেন।
উক্ববাহ ইবনু আমির (রাঃ) বলেন, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি তাবিজ ব্যবহার করবে আল্লাহ তাকে পূর্ণতা দিবেন না। আর যে কড়ি ব্যবহার করবে আল্লাহ তাকে মঙ্গল দান করবেন না’।[আহমাদ, হাদীছ হাসান হা/১৭৪৪০। ]
কোন কিছুর দ্বারা তাবিজ বা কড়ি ঝুলানো একই ধরনের অপরাধ।
উক্ববাহ ইবনু আমির (রাঃ) থেকে বর্ণিত, একদা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর খিদমতে একদল লোক উপস্থিত হ’ল। অতঃপর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) দলটির ৯ জনকে বায়‘আত করালেন এবং একজনকে বায়‘আত করালেন না। তারা বলল, হে আল্লাহর রাসুল! আপনি ৯ জনকে বায়‘আত করালেন আর একজনকে ছেড়ে দিলেন? রাসূল (ছাঃ) বললেন, ‘তার সাথে একটি তাবিজ রয়েছে। তখন লোকটি হাত ভিতরে ঢুকিয়ে তাবিজ ছিড়ে ফেললেন। অতঃপর রাসূল (ছাঃ) তাকেও বায়‘আত করালেন এবং বললেন, যে ব্যক্তি তাবিজ ব্যবহার করল সে শিরক করল’।[আহমাদ হা/১৭৪৫৮, সনদ ছহীহ ]
এ থেকে বুঝা যায়, তাবিজ ব্যবহার করা জঘন্য অপরাধ। এরূপ ব্যক্তিকে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বায়‘আত করানো থেকে বিরত থেকেছেন। সেটা যে প্রকারের তাবিজ হোক না কেন। তাহ’লে তাবিজের অপরাধ কত ভয়াবহ তা সহজেই অনুমেয়।
রুওয়াইফা ইবনু ছাবিত (রাঃ) বলেন, একদিন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আমাকে বললেন,
‘হে রুওয়ায়ফা! হয়ত তুমি আমার পরেও অনেক দিন বেঁচে থাকবে। সুতরাং তুমি লোকদেরকে এ কথা বলে দিও যে, যে ব্যক্তি দাড়িতে গিট দিল (জট পাকাল) অথবা তাবীয জাতীয় বেল্ট বা সূতা (ছেলে-মেয়ের বা প্রাণীর গলায়) পরাল কিংবা চতুষ্পদ জন্তুর গোবর অথবা হাড় দিয়ে ইসতেঞ্জা করল, নিশ্চয়ই তার সাথে মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর কোন সম্পর্ক নেই’।[আবুদাঊদ হা/৩৬; নাসাঈ হা/৫০৬৭; মিশকাত হা/৩৫১, সনদ ছহীহ]
অন্য বর্ণনায় রয়েছে, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন,
‘নিশ্চয়ই ঝাড়-ফুঁক, তাবীয এবং ভালবাসা সৃষ্টি করার জন্য কোন কৌশল অবলম্বন করা শিরক’।[আবুদাঊদ হা/৩৮৮৫; ইবনে মাজাহ হা/৩৫৩০; আহমাদ হা/৩৬১৫; মিশকাত হা/৪৫৫২, সনদ ছহীহ]
এতে পরিষ্কার হয়ে গেল যে, তাবীয ব্যবহার করা, বাচ্চাদের গলায় বা কোমরে কালো, সাদা, লাল যেকোনো কিছুই বাঁধা হোক না কেন তা শিরক।
আব্দুল্লাহ ইবনে মাসঊদ (রাঃ)-এর স্ত্রী যয়নব হ’তে বর্ণিত একদা (আমার স্বামী) আব্দুল্লাহ আমার গলায় একখানা তাগা দেখে জিজ্ঞেস করলেন, (তোমার গলায়) এটা কী? বললাম, এটা একটি তাগা, এতে আমার জন্য মন্ত্র পড়া হয়েছে। যয়নব বললেন, তা শুনে তিনি তাগাটি ধরে ছিঁড়ে ফেললেন, অতঃপর বললেন, তোমরা আব্দুল্লাহর পরিবারবর্গ। তোমরা শিরকের মুখাপেক্ষী নও। আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে বলতে শুনেছি, ঝাড়ফুঁক, তাবীয ও জাদুটোনা শিরকী কাজ’।[আবুদাঊদ হা/৩৮৮৫; আহমাদ হা/৩৬১৫; সনদ ছহীহ, মিশকাত হা/৪৫৫২]
উপরোক্ত হাদীস সমূহ থেকে সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়, সকল প্রকার তাবিজ তুমার ব্যবহার হারাম এবং শিরক।
ঝাঁড়ফুক জায়েজঃ
তাবিজের সাথে ঝাঁড়ফুকের একটি সম্পর্ক রয়েছে। যারা ঝাঁড়ফুক করে তারা তাবিজও করে। কেননা ইসলামে ঝাঁড়ফুককে জায়েজ করা হয়েছে কিন্তু তাবিজকে নয়। তাই তাবিজ এবং ঝাঁড়ফুক একে অপরের সাথে সম্পৃক্ত। একারণে অধিকাংশ মানুষ মনে করে ঝাঁড়ফুক যেহেতু জায়েজ সেহেতু তাবিজও জায়েজ। ঝাঁড়ফুক জায়েজ হওয়ার কিছু দলিল দেওয়া হলো।
আওফ ইবনে মালেক আশজায়ী (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন,
" জাহেলী যুগে আমরা মন্ত্র পড়ে ঝাড়-ফুঁক করতাম। সুতরাং (ইসলাম গ্রহণের পর) আমরা জিজ্ঞেস করলাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ! এ সমস্ত মন্ত্র সম্পর্কে আপনার মতামত কী? তখন তিনি বললেন, তোমাদের মন্ত্রগুলি আমাকে পড়ে শুনাও। মন্ত্র দিয়ে ঝাড়-ফুঁক করতে কোন আপত্তি নেই, যদি তার মধ্যে শিরকী কিছু না থাকে’।[মুসলিম হা/৫৮৬২; আবুদাঊদ হা/৩৮৮৬; মিশকাত হা/৪৫৩০]
অর্থাৎ ঝাঁড়ফুকে কুরআন হাদিসের কথা ছাড়া অন্য কোনো মন্ত্র বা শির্কি কথাবার্তা বলা যাবে না।
উম্মে সালমা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত,
"একদা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তার (উম্মে সালমার) ঘরে একটি মেয়েকে দেখতে পেলেন, তার চেহারায় (বদ-নযরের) চিহ্ন ছিল। অর্থাৎ চেহারাটি হলুদ বর্ণ ধারণ করেছিল। তখন তিনি বললেন, ‘এর জন্য ঝাড়-ফুঁক কর, কেননা তার উপর নযর লেগেছে’।[বুখারী হা/৫৭৩৯; মুসলিম হা/৫৮৫৪; মিশকাত হা/৪৫২৮]
সুতরাং বদনজর লাগলে তাকে ঝাঁড়ফুক করা যাবে।
আনাস (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন,
"কারো উপর বদ-নযর লাগলে, কোন বিষাক্ত প্রাণী দংশন করলে এবং পাঁজরে খুজলি (পিপড়ার মত ছোট ছোট জিনিস শরীরে বের হওয়া) উঠলে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ঝাড়-ফুঁক করতে অনুমতি দিয়েছেন’।[মুসলিম হা/৫৮৫৩]
আনাস ইবনু মালিক (রাঃ) হ’তে বর্ণিত যে,
"রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আনছারদের এক পরিবারের লোকদের বিষাক্ত দংশন ও কানব্যাথার কারণে ঝাড়-ফুঁক গ্রহণ করার অনুমতি দেন।[বুখারী হা/৫৭২০]
সুতরাং যেকোনো প্রকার ব্যাথা বেদনা বা কোনো বিষাক্ত প্রাণীর কামড়ে ঝাড়ফুঁক করা জায়েজ। এছাড়াও অসংখ্য সহীহ্ দ্বারা প্রমাণিত যে, যেকোনো অসুস্থতা এবং বাদনজর লাগা ইত্যাদি থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য ঝাঁড়ফুককে জায়েজ করা হয়েছে।
তাবিজের পক্ষের দলিলঃ
বর্তমান যুগে যারা তাবিজকে জায়েজ এবং বৈধ বলে স্বীকৃতি দেয়। তাদের দেওয়া দলিল হলোঃ
আমর ইবনে শুআইব তাঁর পিতা ও তিনি তাঁর দাদা থেকে বর্ণনা করেন যে,
রাসূল (সঃ) ইরশাদ করেন,তোমাদের কেউ যখন ঘুম অবস্থায় ঘাবড়িয়ে উঠে, সে যেন أَعُوذُ بِكَلِمَاتِ اللَّهِ التَّامَّةِ، مِنْ غَضَبِهِ وَشَرِّ عِبَادِهِ، وَمِنْ هَمَزَاتِ الشَّيَاطِينِ وَأَنْ يَحْضُرُونِ দোয়াটি পাঠ করে। আব্দুল্লাহ ইবনে আমর তাঁর উপযুক্ত সন্তানদের তা শিক্ষা দিতেন এবং ছোটদের গলায় তা লিখে লটকিয়ে দিতেন।{সুনানে আবু দাউদ, হাদীস নং-৩৮৯৫}
উপরোক্ত এই একটি হাদীসই পাওয়া যায় তাবেয়ীদের আমল থেকে তাবিজের পক্ষে। এই হাদীসে একটি দোয়া যা বড়দের শিক্ষা দেওয়া এবং ছোটদের গলায় লটকানোর কথা এসেছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে বড়দের যেহেতু শিক্ষা দেওয়া হয়েছে। তাহলে কি ছোটদের শিক্ষা দেওয়ার দরকার নেই? এর উত্তর হবে অবশ্যই আছে। তাহলে ঐ দোয়া কী হিসাবে গলায় লটকানো হয়েছে? এর যুক্তিযুক্ত উত্তর হচ্ছে ঐ দোয়া ছোটদের গলায় শেখানোর উদ্দেশ্যে লিখে লটকিয়ে দেওয়া হয়েছে।
এছাড়াও এখানে সুস্পষ্ট উল্লেখ নেই যে এই দোয়া তাবিজের মতো করে লটকানো হয়েছে। আমরা আগের হাদীস গুলোতে যসুস্পষ্ট পেয়েছি যে তাবিজ লটকানো যাবেনা। এই কথা আবদুল্লাহ ইবনে আমর রাঃ অবশ্যই জানতেন। তাই তিনি ছোটদের শেখানোর উদ্দেশ্যে লটকিয়ে দিয়েছেন। যাতে তারা দেখে দেখে তা শিখতে পারে।
এছাড়াও আরেকটি কারণে এই হাদীস তাবিজের জন্য দলিল হতে পারে না। আর তা হলো, এখানে ছোটদের গলায় তাবিজ দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু আমাদের সমাজে ছোটদের চাইতে বড়রা তাবিজ তুমার বেশী করে। দুনিয়াবী যত সমস্যা আছে, যা আল্লাহর হুকুম ছাড়া সমাধান করা সম্ভব নয়। সেইসব সমস্যার সমাধানও অধিকাংশ মুসলমানরা বিভিন্ন কাফেরদের দিয়ে কুফরি তান্ত্রিক দ্বারা সমাধান করার চেষ্টা করে। যা সরাসরি শির্কি কুফরি কাজ। সুতরাং তাবেয়ীর আমলের এই হাদীস দ্বারা কখনোই তাবিজ জায়েজ হওয়ার দলিল হতে পারে না। যেখানে রাসুলুল্লাহ সাঃ সরাসরি তাবিজের বিপক্ষে নির্দেশ দিয়েছেন।
রাসুল সাঃ কেও যাদুটোনা করা হয়েছিলঃ
যারা তাবিজকে জায়েজ বলেন, তারা বলেন যে, রাসুল সাঃ কেও ইহুদীরা তাবিজ করেছিল। সেই তাবিজের আছরও হয়েছিল মারাত্মক। সুতরাং তাবিজ জায়েজ।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, ইহুদীদের তাবিজের পরিবর্তে আল্লাহ্ এবং রাসুলের শিক্ষা কী? আমরা দেখতে পাই ইহুদীদের তাবিজের পরিবর্তে আল্লাহ্ পবিত্র কুরআনে দুটি সূরা শিক্ষা দিয়েছেন। যা নিয়মিত পাঠে আল্লাহর রাসুল আরোগ্য লাভ করে। সেইসাথে তিনি তাঁর উম্মতদেরও এই দোয়া দুটি নিয়মিত পাঠের নির্দেশ দেন।
অতএব এখন থেকেও তাবিজের পক্ষে কোনো দলিল সাব্যস্ত হয় না। যদি এমন কোনো প্রমাণ থাকতো যে, রাসুল সাঃ এই দোয়া লিখে গলায় ঝুলিয়েছেন এবং উম্মতদেরও লিখে ঝুলানোর শিক্ষা দিয়েছেন। তাহলে সেটা তাঁর উম্মতের জন্য সুন্নাহ হিসাবে দলিল হতো। অথচ তিনি সুস্পষ্ট হাদীসে শিক্ষা দিয়েছেন যে, সকল প্রকার শয়তানী খারাপ আছর থেকে নিজেদের রক্ষার জন্য সূরা ফালাক এবং নাস নিয়মিত ফরজ সালাতের পরে পাঠ করার। সুতরাং রাসুলের শিক্ষা নয় তাবিজ দেওয়ার।
ভরসা আল্লাহর উপরঃ
রাসুলুল্লাহ সাঃ তাবিজ এইজন্যই নিষিদ্ধ করেছেন, যাতে মানুষ আল্লাহর উপর ভরসা ভুলে তাবিজের উপর ভরসা না করে। কেননা যেকোনো বিপদ আপদ দুঃখ দুর্দশা সর্বাবস্থায় আমাদের আল্লাহর উপরই ভরসা রাখতে হবে এবং রাসুলের অনুসরণ করতে হবে। আল্লাহ্ বলেন,
"যদি আল্লাহ তোমাকে কষ্ট দেন, তবে তিনি ব্যতীত তা অপসারণকারী আর কেউ নেই; পক্ষান্তরে তিনি যদি তোমার কল্যাণ দান করেন তবে তিনিই তো সর্ববিষয়ে ক্ষমতাবান’ (আন‘আম ৬/১৭)।
সুতরাং একমাত্র আল্লাহ্ই মানুষকে কষ্ট দেন এবং তিনিই একমাত্র উদ্ধারকারী। যেসব কারণে তাবিজ ব্যবহার হয় তারমধ্যে সবচেয়ে বড় কারণ হচ্ছে জ্বীনের আছর এবং বদনজর। আর এই দুই রোগের চিকিৎসা রাসুলুল্লাহ সাঃ করেছেন এবং নির্দেশ দিয়েছেন ঝাড়ফুঁক এবং নিয়মিত দোয়া কালাম পড়ার মাধ্যমে। সুতরাং আল্লাহর উপর ভরসা রেখে ঝাঁড়ফুক করাই হচ্ছে সঠিক ইসলামের ত্বরিকা।
ঔষধ জায়েজ হলে তাবিজ নয় কেনঃ
যেসব সুফিবাদীরা তাবিজকে জায়েজ করতে চায় তাদের দাবি হলো, অসুস্থ হলে যেমন ঔষধ নিতে হয়। ঠিক তেমনি জ্বীন বা বদনজর সহ অন্যান্য রোগের চিকিৎসাও হলো তাবিজ। ঔষধ নেওয়া যদি জায়েজ হয়। তাহলে তাবিজ নেওয়াও জায়েজ হবে।
তাদের দাবি চমৎকার হলেও ভিত্তি নেই। কারণ অসুস্থ হলে আল্লাহর উপর ভরসা করে ঔষধ খেতে বলেছেন খোদ রাসুলুল্লাহ সাঃ। হাদীসে এসেছে
জাবির (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
"হারূন ইবনু মা‘রূফ এবং আবূ তাহির ও আহমাদ ইবনু ‘ঈসা (রহঃ) ......জাবির (রাঃ) এর সানাদে রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হতে বর্ননা করেন যে, তিনি বলেছেন-প্রতিটি ব্যাধির প্রতিকার রয়েছে। অতএব রোগে যথাযথ ঔষধ প্রয়োগ করা হলে আল্লাহর ইচ্ছায় আরোগ্য লাভ হয়। (সহিহ মুসলিম, হাদিস নং ৫৬৩৪)
সুতরাং যেকোনো রোগের কারণে হালাল ঔষধ নেওয়া জায়েজ। কিন্তু তাবিজ কোনো ঔষধ নয়। বরং তাবিজ হচ্ছে ঐশ্বরিক বিশ্বাস। যার নিজস্ব কোনো ক্ষমতা নেই যে সে কোনো কিছু ভালো মন্দ করতে পারে। অথচ যারা তাবিজ দেন এবং নেন তারা উভয়েরই বিশ্বাস হচ্ছে এই তাবিজের দ্বারাই উপকৃত হবে।
সেইসাথে ঔষধ নেওয়া এবং ঝাড়ফুঁক করা রাসুলুল্লাহর শিক্ষা। কিন্তু তাবিজ নেওয়া এবং দেওয়া কোনটাই রাসুলুল্লাহ সাঃ এর শিক্ষা নয়। অতএব ঔষধের সাথে তাবিজের মিল খোঁজাটা সম্পূর্ণ বোকামি।
তাবিজ জায়েজের শর্তসমূহঃ
যারা তাবিজকে জায়েজ বলে দাবি করে, তারা তাবিজ ব্যবহার করার কিছু শর্ত দিয়ে থাকে। সেগুলো হলো,
প্রথমতঃ তাবিজ লিখতে হবে কুরআন এবং হাদিসের দোয়া দ্বারা।
দ্বিতীয়তঃ তাবিজে কী লেখা আছে তা জানতে হবে।
তৃতীয়তঃ তাবিজের নিজস্ব কোনো ক্ষমতা আছে বলে বিশ্বাস করা যাবে না।
অতএব যারা তাবিজ ব্যবহার করবে তারা অবশ্যই এই শর্তগুলো মানবে। অন্যথায় তাদের জন্য তাবিজ জায়েজ হবেনা। বরং তা হবে হারাম এবং শিরক।
যে কারণে তাবিজ শিরকঃ
তাবেয়ীরা জায়েজ ভাবে তাবিজ ব্যবহার করলেও বর্তমান যুগে তাবিজ হারামের পাশাপাশি শিরক। কেননা বর্তমানে শতভাগ তাবিজ প্রদানকারী এবং ব্যবহারকারী উভয়ই শিরক করছে বিভিন্ন উপায়ে।
তাবিজ জায়েজের শর্তগুলো বর্তমান যুগে কেউ মানে না। এমনকি যারা তাবিজ ব্যবহার করেন তারা পর্যন্ত জানে না যে, তাবিজ জায়েজের শর্ত কী? সুতরাং তাবিজ জায়েজের ধোঁয়া তুলে অধিকাংশেরও বেশী মুসলমান বিশেষ করে সুফি সুন্নীরা আজ তাবিজ ব্যবহার করছে কুফরি আকিদায়।
নকশার তাবিজঃ
মূলত সুফি সুন্নী তাবিজ ব্যবসায়ীরাই তাবিজকে জায়েজ বলে প্রচার করে। তারা মুফতি মাওলানা হলেও তাদের উদ্দেশ্য ঈমান আকিদা নয়। তারা নিজেরাই তাবিজ জায়েজের শর্ত দেয়। আবার নিজেরাই কুরআনের আয়াত দিয়ে তাবিজ না দিয়ে কুরআনের নকশা আকারে তাবিজ প্রদান করে। যিনি তাবিজ ব্যবহার করেন তিনি তো দূরের কথা, যিনি তাবিজ লিখেন তিনিও জানেন না তিনি কী লিখেছেন।
যারফলে তাবিজ ব্যবহারকারীরা আল্লাহর ভরসা ছাড়া শুধুমাত্র তাবিজের উপর সম্পূর্ণ অন্ধ বিশ্বাস রেখে তাবিজ ব্যবহার করেন। যা তাবিজ জায়েজের শর্ত ভঙ্গের একটি। সুতরাং যারাই বর্তমানে তাবিজ ব্যবহার করেন তারা কেউ ই জানে না তাবিজে কী লেখা আছে। সেইসাথে তাদের এই বিশ্বাসই কাজ করে, অমুক হুজুর বা অমুকের তাবিজ ভালো। অমুকের তাবিজে আমি ফল পেয়েছি। অমুকের তাবিজে ফল পায়নি ইত্যাদি। সুতরাং এই বিশ্বাসের কারণে একজন মুসলমান মুশরিকে পরিনত হয়।
কুফরি কালামঃ
সাধারণ মানুষ এটাই বিশ্বাস করে যে, তাবিজ জায়েজ। তাই তারা যেখানেই তাবিজের সন্ধান পায় সেখানেই তাবিজ করতে চলে যায়। অধিকাংশ মুসলমান হুজুরদের থেকে তাবিজ করে না। তারা দ্রুত ফলের আশায় কাফের মুশরিকদের কাছ থেকে তাবিজ নেয়। ফলে অধিকাংশ মুসলমানই কুফরী কালামের তাবিজ ব্যবহার করার কারণে কাফেরে পরিনত হয়।
কুফুরি কাজে তাবিজঃ
তাবিজ জায়েজ মনে করার কারণে অধিকাংশ মুসলমান দুনিয়াবী স্বার্থলোভী কাজে তাবিজের সাহায্য নেয়। এটা অনস্বীকার্য যে যাদুটোনা সত্য। রাসুলুল্লাহ সাঃ এর উপরও যাদু করা হয়েছিল। কিন্তু জাদুর পরিবর্তে জাদু করার শিক্ষা ইসলামে নেই। এটা আল্লাহর একটা পরীক্ষা।
যাদুটোনা সত্য হওয়ার কারণে অধিকাংশ মুসলমান তাবিজের মাধ্যমে যাদুটোনা করে। যা কখনোই শরীয়ত সম্মত নয়। বর্তমানে অধিকাংশ মুসমান কুফরি কাজেও তাবিজ কবজ করছে। যেমনঃ জোর করে কাউকে বিয়ে করা, স্বামীকে বশ করা, মা সন্তানের সম্পর্ক নষ্ট করা, সম্পত্তি অর্জন, শত্রুর ক্ষতি করা ইত্যাদিসহ অসংখ্য দুনিয়াবী কুফুরি স্বার্থের জন্য তাবিজ করা হয়।
ইসলামে যে ব্যক্তি যাদুটোনা করে তার ঈমান নষ্ট হয়ে যায়। আর তাবিজের সম্পর্ক যাদুটোনার সাথে। তাবিজ জায়েজ মনে করার কারণে অধিকাংশেরও বেশি মুসলমান যাদুটোনা করে। এইকারণে অধিকাংশের বেশী মুসলমান নিজের অজান্তে ঈমান ধ্বংস করে দিচ্ছে।
তাবিজ জায়েজে যে সমস্যাঃ
তাবিজ জায়েজ মনে করার কারণে অধিকাংশেরও বেশী মুসলমান নির্দ্বিধায় যাদুটোনা তাবিজ কবজসহ বিভিন্ন কুফুরি কাজে জড়িয়ে পড়ছে । যা উপমহাদেশের মুসলমানগণকে বিভিন্ন ক্ষতির সম্মুখীন করছে।
প্রথমতঃ ঈমান নষ্ট হওয়া। তাবিজ আল্লাহর উপর ভরসা ধ্বংস দেয়। যারা তাবিজ দেয় এবং নেয় তারা সরাসরি তাবিজের উপরই ভরসা করে। সেইসাথে বর্তমানে কুফুরি কালামের সাহায্যে তাবিজ করার ফলে তাদের ঈমান আমল সবই নষ্ট হয়ে যায়।
দ্বিতীয়তঃ স্বার্থপরতা বৃদ্ধি। তাবিজ ব্যবহার করা হয় দুনিয়াবী স্বার্থলোভী কাজে। ফলে মানুষের মধ্যে নিষ্ঠুরতা ও অমানবিকতা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাই মানুষের মধ্যে সহমর্মিতা হ্রাসের এবং স্বার্থপরতা বৃদ্ধির জন্য তাবিজ একটি অন্যতম কারণ।
তৃতীয়তঃ নৈতিক ও সামাজিক অবক্ষয়। বর্তমান সমাজে নৈতিকতার চরম অবক্ষয় চলছে। সেই অবক্ষয়ের একটি কারণ এই যাদুটোনা তাবিজ কবজ। আজকাল ছেলেমেয়েরা নিজেরা নিজেদের পছন্দ করেই বিয়ে সংসার করতে চায়। যা অধিকাংশ ক্ষেত্রে সমাজ এবং পরিবার মেনে নেয় না। তাছাড়া ছেলে যে মেয়েকে পছন্দ করে, সেই মেয়ে তাকে পছন্দ করে না। ফলে তারা এই তাবিজ কবজের আশ্রয়ের মাধ্যমে এইসব সমস্যার সমাধান চায়। যা সম্পূর্ণ নৈতিকতা এবং ইসলাম বিরোধী।
সেইসাথে স্ত্রী তার স্বামীকে তাবিজ দ্বারা বশ করে পিতামাতা থেকে আলাদা হয়ে যায়। ফলে জীবন সংসারে ভাঙ্গন দেয়। বর্তমানে অধিকাংশ পরিবারে এই সমস্যায় জর্জরিত। তাছাড়া তাবিজের মাধ্যমে ভাইয়ে ভাইয়ে দ্বন্দ্ব, স্বামী স্ত্রীতে দ্বন্দ্ব, পিতা পুত্রে দ্বন্দ্ব, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে মালিকে মালিকে দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়। যা সমাজ অধঃপতনের মূল কারণ।
চতুর্থতঃ বিধর্মীদের প্রভাব। তাবিজ জায়েজ মনে করার কারণে অধিকাংশ মুসলমান হিন্দু বৌদ্ধ তান্ত্রিকের কাছ থেকে যাদুটোনা ও তাবিজ ব্যবহার করে। ফলে বিধর্মীদের বিভিন্ন আচার অনুষ্ঠান রসম তারা এইসব কাজে করতে বাধ্য হয়। যারফলে মানুষ নিজের অজান্তেই বিধর্মীদের অনুসারীতে রূপান্তরিত হয়ে ঈমানহারা হয়।
পঞ্চমতঃ যাদুটোনায় লিপ্ত হওয়া। ইসলামে যাদুটোনা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ কুফুরি কাজ। তাবিজ জায়েজ মনে করার কারণে, যারাই তাবিজ করতে যায় তারাই বিভিন্নভাবে বাধ্য হয়ে যাদুটোনায় জড়িয়ে পড়ে। এভাবে তারা সরাসরি ঈমানহারা হয় কুফুরি করে।
উপরোক্ত আলোচনা থেকে সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত যে, রাসুলুল্লাহ সাঃ কখনোই তাবিজ কবজ করেনি এবং করতে নির্দেশও দেননি। বরং যেকোনো ধরনের তাবিজ তামীমাকে নিষিদ্ধ করেছেন। সেইসাথে যেকোনো অসুস্থতায় ঝাড়ফুঁক ও দোয়া কালাম পড়তে রাসুলুল্লাহ নির্দেশ দিয়েছেন।
শুধুমাত্র সুফিবাদী সুন্নীরা তাবিজ কে জায়েজ মনে করে। ফলে তাদের অধিকাংশের বেশী অনুসারী আজ কুফুরিতে পতিত হয়ে ঈমানহারা হচ্ছে। অতএব তাবিজ কখনোই জায়েজ হতে পারে না। যদি জায়েজ মনে করা হয় তাহলে অধিকাংশ মানুষ শয়তানের প্ররোচনায় পড়ে শিরক করে কাফের মুশরিকে পরিনত হবে।
সাখাওয়াতুল আলম চৌধুরী
২৮ ফেব্রুয়ারী, ২০২২
পতেঙ্গা, চট্টগ্রাম।
আরও পড়ুন কুরআনের আলোকে মানুষ সৃষ্টির কারণ
আরও পড়ুন তাওহিদ কী কীভাবে আল্লাহর তাওহিদ ক্ষুন্ন হয়
আরও পড়ুন বিশ্বকাপ ফুটবল এবং আমাদের ঈমান আকিদা
আরও পড়ুন ঈমান কী? পরিপূর্ণ ঈমানের বিস্তারিত ব্যাখ্যা
আরও পড়ুন শিরক কী? মানুষ কীভাবে শিরক করে
আরও পড়ুন সুফিবাদী সুন্নীদের আকিদা সমূহ
আরও পড়ুন সুফি সুন্নীদের বিভিন্ন আকিদা সম্পর্কিত জবাব
আরও পড়ুন শুধু অলি আউলিয়ারাই আল্লাহর অলি নয়