অর্থ : নিশ্চয়ই আমি এটি (আল কোরআন) এক বরকত ও কল্যাণময় রাতে নাজিল করেছি। নিশ্চয়ই আমি তো (জাহান্নাম থেকে) সতর্ককারী।
"রামাদান মাস, যার মধ্যে আল কোরআন নাজিল করা হয়েছে, যা মানবজাতির জন্য পুরোপুরি হিদায়াত"।
তিরমিযী হাদীসে একটি হাদীস এসেছে, যা মা আয়েশা রাঃ থেকে বর্ণিত। তিনি জানান, এক মধ্য শাবানের রাতে রাসুলুল্লাহ সাঃ কবর যিয়ারত করেছেন। এবং জানান যে, এই রাতে আল্লাহ্ আসমানে নেমে এসে অসংখ্য মানুষকে ক্ষমা করেন। (দুর্বল হাদীস)
মা আয়েশা রাঃ থেকে অন্য হাদীসে এসেছে, এই রাতে আল্লাহ্ ক্ষমা প্রার্থনাকারীকে ক্ষমা করে এবং রহমত প্রদান করেন। হিংসুকদের তাদের অবস্থায় ছেড়ে দেন। (বাইহাকী তার শুয়াবুল ঈমান কিতাবে বর্ণনা করেছেন। হাদিসটি মুরসাল)
হযরত আলী রাঃ থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ বলেন, এই রাতে তোমরা রাত জেগে সালাত আদায় কর এবং সিয়াম পালন কর। কেননা সূর্যাস্তের পরে আল্লাহ্ নিকট আসমানে নেমে আসেন। এবং বলেন, যে আমাকে ডাকবে তাকে আমি সাড়া দিবো। যে প্রার্থনা করবে তাকে দান করা হবে। যে ক্ষমা চাইবে তাকে ক্ষমা করা হবে। (ইবনে মাজাহ ও বাইহাকী। দুর্বল এবং সহীহ্ হাদিস বিরোধী)
উসমান ইবনে আবিল আস (রাঃ) থেকে বর্ণিত হাদিসটি আলী রাঃ হাদিসের অনুরূপ। তবে এখানে এসেছে মুশরিক এবং ব্যবিচারী ব্যতীত সকলের প্রার্থনা কবুল করা হবে। (বাইহাকী, শুয়াবুল ঈমান। দুর্বল হাদিস)
শবেবরাত নিয়ে হাসান পর্যায়ের হাদীস রয়েছে। আবূ মূসা আল-আশআরী (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, আল্লাহ মধ্য শাবানের রাতে আত্মপ্রকাশ করেন এবং মুশরিক ও হিংসুক ব্যতীত তাঁর সৃষ্টির সকলকে ক্ষমা করেন। (সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস নং ১৩৯০)
এইসব হাদিসের কোথাও শবেবরাত নামে কিছুই নেই। যা উপমহাদেশে ভাগ্যরজনী নামে পরিচিত। এই রাতের জন্য স্পেশাল কোনো সালাত নেই। কেননা এই রাতের যে ফজিলতের কথা এসেছে তা অন্যান্য দিনের মতোই। বিশেষকরে আল্লাহ্ প্রতি রাতে নিকট আসমানে নেমে আসেন এবং প্রার্থনা কবুল করেন (বুখারী ও মুসলিম)। সুতরাং যে ব্যক্তি নিয়মিত তাহাজ্জুদের সালাত আদায় করে তার জন্য এইদিন কখনোই স্পেশাল নয়।
সেইসাথে এই রাতে যদি স্পেশাল সালাত থাকতো তাহলে তা রাসুলুল্লাহ সাঃ তার স্ত্রীদেরও আদায়ের নির্দেশ দিতেন। কিন্তু কোনো হাদীসেই এমনটা আসেনি। তাহলে এই রাত সম্পর্কে হাদীস থেকে আমরা যা পাচ্ছি তা হলো আল্লাহ্ এই রাতে নিকট আসমানে নেমে এসে প্রার্থনা কবুল করেন যা অন্যান্য রাতের মতো। সেইসাথে তিনি তাঁর বান্দাদের ক্ষমা করেন।
তাদের কাছে জিজ্ঞাস্য হলো, কোনো ব্যক্তি সারাবছর সালাত আদায় না করে বিশেষ বিশেষ রাতে সালাত আদায় করলে কি আল্লাহ্ তাকে মেনে নিবেন? তাও আবার এমন সালাত যা রাসুলুল্লাহ সাঃ থেকে স্বীকৃত নয় এবং যা বিদআত।
২. এই রাতের সকালে দিনে অধিক সওয়াবের আশায় রোজা রাখা।
৩. এই রাতে আল্লাহ সাধারণ ক্ষমা করেন।
৪. এই রাতে বয়স ও রিজিক নির্ধারণ করা হয়।
৫. কবরবাসীকে আলোকিত করতে কবরে মোমবাতি আগরবাতি জ্বালানো।
৬. অধিক সওয়াবের আশায় এই দিনেই বেশি পরিমাণে দান খয়রাত বিশেষ করে মৃতদের নামে বিশেষভাবে দান-খয়রাত করা এবং কাঙ্গালী ভোজের আয়োজন করা।
৮. এই রাতে বিশেষ মর্যাদায় কবর জিয়ারত এবং সওয়াবের নিয়তে বিভিন্ন মাজারে মাজারে গিয়ে জিয়ারত করা।
৯. এই রাতে শিয়া-রাফেযীদের মিথ্যা কল্পিত ইমাম মাহদীর জন্ম দিবস পালন করা।
১০. এই রাতে হালুয়া, রুটি ও মাংস পাকানো এবং তা পড়া প্রতিবেশীদের বিলানো।
১১. এই রাতে আগরবাতি, মোমবাতি জ্বালানো, আলোকসজ্জা এবং আনন্দ উৎসবের মতো পটকা ফুটানো।
১২. এই দিনে সন্ধ্যায় গোসল করে নতুন কাপড় পরে সারারাত নামাজ পড়া সেই সাথে অধিক সওয়াবের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন মসজিদে গমন করা।
১৩. এই রাতে সূরা ইয়াসীন তিনবার পাঠ করা। প্রথমবার বয়স বৃদ্ধির জন্য, দ্বিতীয়বার বালা-মসিবত দূর করার জন্য এবং তৃতীয়বার কোন মানুষেরমুখাপেক্ষীর না হওয়ার জন্য।
১৪. মনে করা হয় এই দিনে ওহুদের যুদ্ধে কাফেররা নবী [সা:]-এর দাঁত মোবারক ভেঙ্গেছিল।
১৫. . এই রাতে জমজমের পানি অন্যান্য দিনের চেয়ে বৃদ্ধি পায় ধারণা করা।
১৬. গত এক বছরে মৃত মানুষের রুহগুলোর আগের রুহের সাথে জমিনে নেমে আসে।
১৭. এই রাতে সূরা দুখান পাঠকারীর জন্য সারা দিন ৭০ হাজার ফেরেশতা দোয়া করবে মনে করে তা পাঠ করা।
১৮. এই দিনে মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে হালুয়া রুটি মুরগি পোলাও রান্না করে পাঠানো।
উপরের উল্লেখিত বিশ্বাস গুলো অঞ্চল ভেধে বিভিন্ন রকম হয়ে থাকে। সুতরাং উপরোক্ত বিষয় থেকে এটা সুস্পষ্ট যে, সুফিরা শবেবরাতের নাম দিয়ে যা করে তা কখনোই কুরআন হাদীস দ্বারা প্রমাণিত নয়। সেইসাথে উপরের উল্লেখিত সকল আকিদা ও কর্মকান্ড উভয়ই বিদআত। যা ইসলাম সমর্থন করে না।
উপমহাদেশে শবেবরাত পালনের কারণঃ
শবেবরাত নিয়ে সুস্পষ্ট দলিল না থাকার পরও, অধিকাংশ মানুষ এই রাতে ও দিনে অতিরিক্ত বিদআতী আমল ইবাদত করতে উৎসাহী। বিশেষ করে সুফি সুন্নীরা। যাদের শরীয়তের ইবাদতের প্রতি অনীহা । যাদের ঈমান আকিদা কখনোই রাসুলের ত্বরিকায় নয়।
সুফি সুন্নীরা এই দিনকে ইবাদতের বিশেষ দিন মনে করে। যারা সারাবছর পীর আউলিয়ার দরবারে খানকায় পড়ে থেকে জীবিত মৃত পিতামাতার খবর নেয় না। মাতাপিতার জন্য সালাত দোয়া নেই। কবর যিয়ারত নেই, দান সদকা ইত্যাদি কিছুই নেই। এই একদিনে সব করে সারাবছর করার সুযোগ নিতে চায়।
এছাড়াও উপমহাদেশের মুসলমানরা ভোজনপ্রিয় জাতি। কোনো না কোন উদ্দেশ্যে পেলেই আমরা খাওয়ায় মেতে উঠি। তাই এই রাতের দোহাই দিয়ে সবাই ব্যাপক খানাপিনার আয়োজন করে। যা পরবর্তীতে সামাজিক স্বীকৃতি নিয়ে এখনো চলমান।
উপমহাদেশে শবেবরাতের প্রভাবের আরেকটি কারণ হলো, শিয়াদের প্রভাব। রাজনৈতিকভাবে উপমহাদেশে শিয়াদের ব্যাপক প্রভাবে সুফি সুন্নীদের আকিদায় শিয়াদের আধিপত্য লক্ষ্য করা যায়। শিয়ারা শবেবরাত পালন করে তাদের ঈমাম মাহাদীর জন্মদিন উপলক্ষে। যা তারা কৌশলে সুফি সুন্নীদের মধ্যে প্রবেশ করিয়ে দিয়েছে।
উপমহাদেশে শবেবরাত প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সবচেয়ে যুক্তিযুক্ত কারণ হলো কুরআন হাদিসের জ্ঞান না থাকা। অতীত থেকেই সুফি দরবেশ দ্বারা সুফিবাদী ইসলাম প্রচার প্রসার হওয়ার কারণে এই অঞ্চল কুরআন হাদিসের সঠিক জ্ঞান থেকে বঞ্চিত। ফলে অধিকাংশ পূর্বপুরুষদের অনুসরণে এখানে সঠিক ইসলামের প্রচার প্রসারতা লাভ করেনি।
শবেবরাতে যা বর্জনীয় করণীয়ঃ
ইসলামে শবেবরাত না থাকলেও মধ্য শাবানের কথা এসেছে। সুতরাং শবেবরাতের নামে সুফি সুন্নীরা যা করছে এবং তাদের অনুসরণে অধিকাংশ মুসলমান যা করে তা সম্পূর্ণ বর্জন করতে হবে। পূর্বপুরুষদের সকল রীতিনীতি বাদ দিতে হবে।
সেইসাথে ইসলামের নিয়মিত আমল ইবাদতের পাশাপাশি এই রাতেও নফল ইবাদত ও নফল সিয়াম পালনে কোনো বাঁধা নেই বরং সওয়াবের। তবে সারাবছর ইবাদত বন্দেগী না করে এক রাতের ইবাদত কখনোই আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য হতে পারেন না। তাই ইবাদত বন্দেগী ছাড়া উপরের উল্লেখিত বাদবাকি সকল বিদআতী কর্মকান্ডকে বর্জন করতে হবে।
শেষকথাঃ
উপরোক্ত সকল তথ্য প্রমাণ দ্বারা প্রমাণিত যে, শবেবরাত নামে বা সমর্থনে কোনো কিছুই কুরআন হাদীসে নেই। বিশেষ করে এই রাত সৌভাগ্যের রাত। এই রাতে মানুষের হায়াৎ, মউত, রিজিক, ধন, দৌলত ইত্যাদি বন্টন করা হয় মনে করা।
এই রাতে যা করার নির্দেশ এবং ফজিলতের কথা সুফি সুন্নীদের দলিলে এসেছে, তা কখনোই এক দিন বা এক রাতের জন্য নয়। একই নির্দেশ এবং ফজিলত অসংখ্য সহীহ্ দ্বারা প্রতিটি রাতের জন্যও প্রমাণিত। সুতরাং এই রাতে সালাত সিয়ামে কোনো সমস্যা নেই। তবে শুধু এই রাতকেই ফজিলত মনে করে বছরের বাকি দিনগুলিতে ইবাদতের ধারেকাছে না থাকা হচ্ছে গোমরাহী।
সুতরাং আসুন আগে চেষ্টা করি ফরজ সালাত প্রতিনিয়ত আদায় করার। সেইসাথে শুধু এই রাত বরং সারাবছর যতটুকু সম্ভব তাহাজ্জুদের সালাত নিজ ঘরে আদায় করার। নিজ আত্মীয় স্বজনদের কবরে গিয়ে তাদের জন্য মাগফেরাত কামনা করার। সিয়াম পালনের উদ্দেশ্যে প্রতি মাসের চাঁদের ১৪,১৫,১৬ তারিখে সিয়াম পালন করা। যা সহীহ্ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। ইনশাআল্লাহ পরম করুণাময় অবশ্যই আমাদের ক্ষমা এবং রহমত দান করবেন।
সাখাওয়াতুল আলম চৌধুরী
২ মার্চ, ২০২২
পতেঙ্গা, চট্টগ্রাম।