রাসুল সম্পর্কিত সুন্নি (সম্পূর্ণ) আকিদার জবাব
সুফি সুন্নীরা আল্লাহর রাসুল সাঃকে বিভিন্ন বিশেষণে বিশেষায়িত করে থাকেন। সুন্নীরা রাসুল সম্পর্কে এমন এমন সব আকিদা পোষণ করে যা কখনোই ইসলাম স্বীকৃত নয়। এইসব ভ্রান্ত আকিদা সমূহ এমন যে, তা একজন ঈমানদারকে মুশরিকে পরিনত করে ঈমান হারা করে দেয়। এখন আমরা কুরআন এবং সহীহ্ হাদিসের আলোকে সুন্নীদের সেইসব আকিদার জবাব পাওয়ার চেষ্টা করবো।
রাসুল আল্লাহর জাতি নূরে সৃষ্টি
সুফিদের আকিদা হলো রাসুলুল্লাহ সাঃ আল্লাহর জাতি নুরে তৈরি। তিনি অন্যান্য সবার মতো মানুষ নন। অথচ পবিত্র কুরআনে রাসুল আল্লাহর নিজস্ব নূরে সৃষ্টি এমন কোনো একটি আয়াতও নেই। কিন্তু তিনি যে মানুষ তার স্বপক্ষে শতশত আয়াত রয়েছে। আল্লাহ্ আমাদের জানাচ্ছেন, "হে নবী, এদের বলে দাও, আমি তো তোমাদের মতই একজন মানুষ৷ আমাকে অহীর মাধ্যমে জানিয়ে দেয়া হয় যে, একজনই মাত্র তোমাদের ইলাহ কাজেই সোজা তাঁর প্রতি নিবিষ্ট হও এবং তাঁর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করো৷ মুশরিকদের জন্য ধ্বংস।" (হা মিম সিজদা-৪১:৬)।
কুরআনের উপরোক্ত আয়াতে স্পষ্ট যে রাসুল সাঃ একজন মানুষ। আর মানুষকে আল্লাহ্ কী দিয়ে সৃষ্টি করেছেন তা কুরআনের আয়াত দ্বারা স্পষ্ট। আল্লাহ্ বলেন, "তাঁর নিদর্শনাবলীর মধ্যে রয়েছে, তিনি তোমাদের সৃষ্টি করেছেন মাটি থেকে তাঁরপর সহসা তোমরা হলে মানুষ, পৃথিবীর বুকে ছড়িয়ে পড়ছো। [সুরা রুম-৩০:২০]
"আমি মানুষকে তৈরী করেছি মাটির উপাদান থেকে। (মুমিনুন-২৩:১২)
মানুষ মাটির তৈরি এ সম্পর্কিত আরও আয়াত: আল ইমরান-৩:৫৯; আনাম-৬:২; আরাফ-৭:১২; সাফফাত-৩৭:১১; সোয়াদ- ৩৮:৭১; সোয়াদ- ৩৮:৭৫-৭৬
কুরআনের আয়াত দ্বারা বুঝা যাচ্ছে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একজন বাশার বা মানুষ ছিলেন আর মানুষ মাটির তৈরি। সুতরাং রাসুলও মাটিরই তৈরি। এটা কুরআনের কথা বা দলিল। যদিও রাসুল সাঃ কিসের তৈরি তা বিচার বিশ্লেষণ করা ঈমানের অংশ নয়। তবে ভুল আকিদা পোষণ করলে ঈমান নষ্টের আশংকা রয়েছে।
আরও পড়ুন রাসুলুল্লাহ সাঃএর আদর্শ এবং অনুসরণই হচ্ছে ইসলাম
তাই কুরআন যদি সুস্পষ্ট দলিল দিতো যে রাসুল আল্লাহর জাতি নূরে তৈরি, তাহলে আর কোনো সমস্যা থাকতো না এটা মেনে নিতে। আর আল্লাহ্ তার অন্যান্য সৃষ্টিকে কী দিয়ে সৃষ্টি করেছেন তাও তিনি স্পষ্ট করেছেন।
আল্লাহ তায়ালা ফিরেস্তাদের সৃষ্টি করছেন নুর দিয়ে (মুসলিম-), জিনদের সৃষ্টি করেছেন আগুণের শিখা থেকে (সুরা আর রহমান ৫৫:১৫)। আর মানুষকে সৃষ্টি করছেন মাটির উপাদান থেকে। প্রত্যেক সৃষ্টির উপাদান আলাদা তাই সৃষ্টির বৈশিষ্ট ও আলাদা। মানুষ হিসাবে মানুষের কিছু মানবীয় বৈশিষ্ট আছে। যেমনঃ খাবার গ্রহন করা, পিপাসার জন্য পানি পান করা, বিবাহ করা, সন্তানের জম্ম দেওয়া, বাজারে গমন করা, দুনিয়াবি বিভিন্ন কাজে অংশ গ্রহন করা ইত্যাদি। এই মানবীয় বৈশিষ্টগুলি মুহাম্মদ সাঃসহ প্রতিটি নবী রাসুলদের ছিলো।
তাছাড়া সুপ্রসিদ্ধ হাদিস গ্রন্থ বুখারি, মুসলিম, তিরমিজি, আবু দাউদ, নাসাঈ, ইবনে মাজাহ, মুসনাদ আবী হানীফা, মুআত্তা মালিক, মুসনাদ আহমাদ, মেশকাত শরীফসহ কোন হাদিস গ্রন্থে রাসুল সাঃ আল্লাহর নূরে সৃষ্টি এমন কোনো কিছুই নেই। চার ইমামসহ ইসলামের প্রথম ৫০০ বৎসরের মধ্যে কেউই তাঁদের কোন হাদিস গ্রন্থে নূর সম্পর্কে কোন হাদীস লিপিবদ্ধ করেন নাই।
রাসুলসহ অন্যান্যদের ইলমে গায়েব
সুফি সুন্নীদের আকিদা হলো আল্লাহর মতই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামসহ সকল পীর অলি আউলিয়ারা অদৃশ্যর জ্ঞান তথা ইলমে গায়েব রাখেন। এটা সুস্পষ্ট কুরআন হাদীস বিরোধী কথা। আল্লাহ তাআলা বলেন, "আপনি বলে দিন, আমি আমার নিজের কল্যাণ সাধনের এবং অকল্যাণ সাধনের মালিক নই, কিন্তু যা আল্লাহ চান। আর আমি যদি গায়বের কথা জেনে নিতে পারতাম, তাহলে বহু মঙ্গল অর্জন করে নিতে পারতাম, ফলে আমার কোন অমঙ্গল কখনও হতে পারত না। আমি তো শুধুমাত্র একজন ভীতি প্রদর্শক ও সুসংবাদদাতা ঈমানদারদের জন্য।" [ সুরা আরাফ ৭:১৮৮ ]
এ আয়াতে আল্লাহ তাআলা তাঁর রসূল সাঃকে পরিস্কার ভাবে ঘোষণা দিতে বললেন যে, আমি গায়েবের খবর জানলে, নিজের অনেক কল্যান করতাম এবং কখনো কোন ক্ষতি আমাকে স্পর্শ করত না। আল্লাহ তাআলা বলেন, "বলুন (হে রাসুল), "আমি তোমাদের বলি নাই যে, আমার নিকট আল্লাহ্র ধনভান্ডার রয়েছে। আমি অদৃশ্য সম্বন্ধে জানি না। আমি তোমাদের এ কথা বলি না যে, আমি একজন ফেরেশতা। আমার নিকট যে প্রত্যাদেশ অবতীর্ণ হয়েছে, আমি শুধু তার অনুসরণ করি। বল, অন্ধ ও চক্ষুষ্মান কি এক হতে পারে? তোমরা কি বিবেচনা করবে না? " [আনাম ৬:৫০]
আল্লাহ্ আরও বলেন, "তাদেরকে বল, আল্লাহ ছাড়া পৃথিবীতে ও আকাশে কেউ অদৃশ্যের জ্ঞান রাখে না৷ এবং তারা জানেনা কবে তাদেরকে উঠিয়ে নেয়া হবে।"[নামল ২৭:৬৫]
আল্লাহ্ অন্য আয়াতে বলেন, "তাঁরই কাছে আছে অদৃশ্যের চাবি, তিনি ছাড়া আর কেউ তা জানে না৷ জলে- স্থলে যা কিছু আছে সবই তিনি জানেন৷ তাঁর অজ্ঞাতসারে গাছের একটি পাতাও পড়ে না৷ মৃত্তিকার অন্ধকার প্রদেশে এমন একটি শস্যকণাও নেই যে সম্পর্কে তিনি অবগত নন৷ শুষ্ক ও আর্দ্র সবকিছুই একটি সুস্পষ্ট কিতাবে লিখিত আছে৷" [আনাম ৬:৫৯]
একমাত্র শুধুমাত্র আল্লাহ্ই হলেন অদৃশ্যের জ্ঞানের অধিকারী। এই সম্পর্কিত আরো আয়াতের রেফারেন্স উল্লেখ করা হল: [মায়েদা- ৫: ১০৯ ১১৬; আনাম- ৬ :৫০ ৫৯ ৭৩; তওবা -৯ : ৪৩,৭৮,৯৫,১০১, ১০৫; নাহল- ১৬:৭৭; ত্বহা -২০:১৫ ১১০; জুকরুক -৪৩:৮৫; তাহরিম -৬৬ : ১; জিন- ৭২ : ২৫ ]
এই সম্পর্কে জানতে আমরা কুরআনের সুরা আত-তাহরীমের শুরুর দিকের তিনটি আয়াত আলোচনা করব। আল্লাহ তাআলা বলেন,
১। হে নবী, আল্লাহ যে জিনিস হালাল করেছেন তা তুমি হারাম করছো কেন? (তা কি এ জন্য যে) তুমি তোমার স্ত্রীদের সন্তুষ্টি চাও? আল্লাহ ক্ষমাশীল এবং দয়ালু৷
২। আল্লাহ তোমাদের জন্য কসমের বাধ্যবাধকতা থেকে মুক্ত হওয়ার পন্থা নির্ধারণ করে দিয়েছেন৷ আল্লাহ তোমাদের অভিভাবক এবং তিনি মহাজ্ঞানী ও মহা কৌশলী৷
৩। (এ ব্যাপারটিও লক্ষণীয় যে,) নবী তাঁর এক স্ত্রীকে গোপনে একটি কথা বলেছিলেন৷ পরে সেই স্ত্রী যখন (অন্য কারো কাছে) সেই গোপনীয় বিষয়টি প্রকাশ করে দিল এবং আল্লাহ নবীকে এই (গোপনীয় বিষয় প্রকাশ করার) ব্যাপারটি জানিয়ে দিলেন তখন নবী (ঐ স্ত্রীকে) কিছুটা সাবধান করলেন এবং কিছুটা মাফ করে দিলেন৷ নবী যখন তাকে (গোপনীয়তা প্রকাশের) এই কথা জানালেন তখন সে জিজ্ঞেস করলো : কে আপনাকে এ বিষয়ে অবহিত করেছে ? নবী বললেন : আমাকে তিনি অবহিত করেছেন যদি সবকিছু জানেন এবং সর্বাধিক অবহিত।
এই আয়াতগুলোর শানে নূযুল জানা না থাকলে এর অর্থ বোধগম্য হবেনা। এখানে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও তাঁর পবিত্র বিবিগণের সাথে দাম্পত্য জীবনের সাথে জড়িত দুইটি ঘটনা নিয়ে ওহী করা হয়েছিলো। হাদীসে এসেছে, আয়িশা (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ "যে, নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যাইনাব বিন্ত জাহাশের নিকট কিছু (বেশী সময় অবস্থান) করতেন এবং সেখানে তিনি মধু পান করতেন। আমি ও হাফসাহ পরামর্শ করে ঠিক করলাম যে, আমাদের মধ্যে যার নিকটই নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) প্রবেশ করবেন, সেই যেন বলি-আমি আপনার নিকট হতে মাগাফীর-এর গন্ধ পাচ্ছি। আপনি কি মাগাফীর খেয়েছেন। এরপর তিনি তাদের একজনের নিকট প্রবেশ করলে তিনি তাঁকে সেরূপ বললেন। তিনি বললেনঃ আমি তো যাইনাব বিন্ত জাহাশের নিকট মধু পান করেছি। আমি পুনরায় এ কাজ করব না। এ প্রসঙ্গেই অবতীর্ণ হয় (মহান আল্লাহর বাণী): “হে নবী! আল্লাহ যা তোমার জন্য হালাল করেছেন তা তুমি কেন হারাম করছ?....... তোমারা দু‘জন যদি অনুশোচনাভরে আল্লাহ্র দিকে ফিরে আস (তবে তা তোমাদের জন্য উত্তম)” (সূরাহ আত-তাহরীম ৬৬ : ১-৪) পর্যন্ত। এখানে 'আয়িশা ও হাফসাহ -কে উদ্দেশ্য করে বলা হয়েছে। আর আল্লাহ্র বাণী “যখন নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর স্ত্রীদের একজনকে গোপনে কিছু বলেছিলেন”- ‘বরং আমি মধু পান করেছি’-এ কথার প্রেক্ষাপটে অবতীর্ণ হয়। (সহীহ্ বুখারী ৪৯১২, ৫২১৬, ৫২৬৭, ৫২৬৮, ৫৪৩১, ৫৫৯৯, ৫৬১৪, ৫৬৮২, ৬৬৯১, ৬৯৭২ মুসলিম - ৪৯১২, আহমেদ - ২৫৯১০)
নোটঃ মাগাফীর একটা মিষ্টি কিন্তু দুর্গন্ধযুক্ত গাছের রস (রেসিন), রাসুলুল্লাহ (সাঃ) হালাল হলেও কখনো দুর্গন্ধযুক্ত খাবার খেতেন না, এটা তাঁর রীতি ছিলো। যয়নাব বিনতে জাহশ (রাঃ) এর ঘরে মধু পান করা ও কিছু সময় কাটানো এটা তাঁর অপর দুই সতীন আয়িশা (রাঃ) ও হাফসা (রাঃ) স্বাভাবিকভাবে নিতে পারেন নি।
আরও পড়ুন বিদআত কী এবং এর পরিনাম
সতীনের প্রতি নারীদের স্বাভাবিক বিদ্বেষপরায়ণ মনোভাব থেকে তারা দুইজন এই যুক্তি করেন, পরবর্তীতে রাসুলুল্লাহ (সাঃ) যদি যয়নাব বিনতে জাহশ (রাঃ) এর কাছ থেক মধু পান করেন তাহলে তাঁরা এই কথা বলবেন যে আপনি কি মাগফীর খেয়েছন? সে অনুযায়ী, আয়িশাহ ও হাফসাহ দুইজনের কাছেই রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এইরকম কথা শুনে মনে করেছিলেন, সত্যিই বুঝি এই মধু খেলে মুখে দুর্গন্ধ সৃষ্টি হয়।
তাই তিনি কসম করে বললেন, এই মধু আর খাবেন না (এটাই ছিলো আয়িশাহ ও হাফসার উদ্দেশ্যে, যাতে করে তিনি যয়নবের ঘরে ঐ সময়টা আর না কাটান), আর যেহেতু তাঁর রীতি ছিলো দুর্গন্ধযুক্ত খাবার না খাওয়া, তাই তিনি তাদেরকে এই কথাটা অন্য কাউকে বলতে না বলেন। এই ঘটনার প্রেক্ষিতে আল্লাহ সুরা তাহরীমের এই আয়াতগুলো নাযিল করেন।
আয়াতগুলো থেকে শিক্ষা
যদিও উপরোক্ত আয়াত রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এর ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে তবুও কুরআন নাযিল করার পেছনে উদ্দেশ্য রয়েছে।
প্রথমত রাসুলুল্লাহ (সাঃ) নিজে থেকে কোনো কিছু হালাল বা হারাম করতে পারেন।
দ্বিতীয়ত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও গায়বের খবর জানেন না। কারন তাঁর স্ত্রী আয়েশাহ (রাঃ) ও হাফসা (রাঃ) পাশের ঘরে বসেই একমত হন যে, আমাদের যার ঘরেই আল্লাহর রসূল সাঃ আসবেন, সে তাঁকে বলবে, আপনি কি মাগাফীর খেয়েছেন অথচ আল্লাহর রসূল সাঃ কিছুই জানলেন। তাহলে তিনি কীভাবে গায়েবের খবর জানেন আমরা দাবি করতে পারি?আল্লাহ্ আরও পরিষ্কার ভাবে তৃতীয় আয়াতের শেষে বলেন,“নবী যখন তা স্ত্রীকে বললেন, তখন স্ত্রী বললেনঃ কে আপনাকে এ সম্পর্কে অবহিত করল? নবী বললেনঃ যিনি সর্বজ্ঞ, ওয়াকিফহাল, তিনি আমাকে অবহিত করেছেন”।
অর্থ দাড়াল আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের স্ত্রীদেরও আকিদা ছিল, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম গায়বের খবর জানেন না। তাই উনারা গোপনে কৌশল করে কিছু আদায় করতে সচেষ্ট ছিলেন।
এই জাতীয় আরো কিছু ঘটনা রয়েছে যাতে প্রমাণ হয় রাসুল সাঃ নিজ থেকে কখনোই কোনো গায়েবের খবর জানতেন না বা দিতেন না। তিনি ততটুকুই জানতেন এবং দিতেন যতটুকু আল্লাহ্ তাঁকে জানিয়েছেন।
অতএব, মহান আল্লাহর শ্রেষ্ঠ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজ থেকে গায়েব জানতেন না। যতটুকু তাঁকে জানানো হতো তা ব্যতীত। সুতরাং পবিত্র কুরআনের সুস্পষ্ট আয়াত দ্বারা এটা প্রমাণিত হলো যে আল্লাহর রাসুল কখনোই আল্লাহর সমতুল্য গায়েব জানতেন না যতটুকু না আল্লাহ্ তাঁকে জানিয়েছেন। আর যেখানে রাসুল সাঃ গায়েবের খবর জানেন না, সেখানে তথাকথিত পীর আউলিয়ারা কীভাবে গায়েবের খবর জানতে পারবেন?
আরও পড়ুন জন্মগত মুসলিম ধর্মমতে মুসলিম
হাজির ও নাজির
তথাকথিত সুফি সুন্নীদের বিশ্বাস রাসুলুল্লাহ সাঃ সহ সকল পীর আউলিয়ারা পৃথিবীর যেকোনো জায়গায় যেকোনো সময় হাজির এবং নাজির। অর্থাৎ তিনি পৃথিবীর যেকোনো জায়গায় যেকোনো মূহুর্তে যেতে পারেন এবং দেখতে পারেন।
সর্বত্র হাজির ও নাজির গুণটি একমাত্র আল্লাহর। শুধুমাত্র আল্লাহ্ই পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তের যেকোনো সময়ের যেকোনো ঘটনা অবলোকন করতে পারেন এবং তিনি তাঁর সর্বময় ক্ষমতা দ্বারা উপস্থিতও থাকেন। সুতরাং আল্লাহর নিজস্ব কোনো গুণকে তাঁর কোনো সৃষ্টির সাথে তুলনা করলে তা হবে সরাসরি শির্ক।
মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে হাজির নাযির বিশ্বাস করলে তাঁর দ্বারা মিরাজ সংঘটিত হওয়া মিথ্যা হয়ে যায়।আল্লাহ রব্বুল আলামিন বলেন, "পবিত্র তিনি যিনি নিয়ে গেছেন এক রাতে নিজের বান্দাকে মসজিদুল হারাম থেকে মসজিদুল আক্সা পর্যন্ত, যার পরিবেশকে তিনি বরকতময় করেছেন, যাতে তাকে নিজের কিছু নিদর্শন দেখান৷আসলে তিনিই সবকিছুর শ্রোতা ও দ্রষ্টা"৷ (বনী ইসরাইল ১৭:১)।
মিরাজ হল রাসুলুল্লাহ সাঃ মসজিদুল হারাম থেকে মসজিদুল আক্সা অতপর সপ্ত আকাশ পাড়ি দিয়ে আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের আরশে আজিমে পৌঁছানোর ঘটনা। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সদা সর্বদা সব জায়গায় হাজির নাযির থাকলে তো আর আরশে যাওয়ার প্রয়োজন ছিল না। তিনি তো সেখানেই হাজিরই ছিলেন। তাহলে মিরাজ আর হলো কোথায়?
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে হাজির নাযির বলাটা বাহ্যিকভাবে সম্মানজনক মনে করা হলেও আসলে তা শির্ক, যা একজন মুসলিম কে ইসলাম থেকে বাহির করে দেয়। এর দ্বারা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মিরাজকে অস্বীকার করা হয়।
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাজির নাযিরের ক্ষমতা থাকলে হিজরতের প্রয়োজন ছিল না। কারন মূহুর্তেই মক্কা থেকে মদিনা আবার মদিনা থেকে মক্কা যাওয়া আসা করতে পারতেন। অথবা শত্রু পক্ষের যেকোনো গোপন সংবাদ বা যেকোনো বিপদের আশংকা তিনি আগেই জেনে নিতে পারতেন সেখানে উপস্থিত হয়। আল্লাহ রব্বুল আলামিন বলেন, "তোমরা যদি নবীকে সাহায্য না কর, তাহলে কোন পরোয়া নেই৷ আল্লাহ তাকে এমন সময় সাহায্য করেছেন যখন কাফেররা তাকে বের করে দিয়েছিল, যখন সে ছিল মাত্র দু’জনের মধ্যে দ্বিতীয় জন, যখন তারা দু’জন গুহার মধ্যে ছিল, তখন সে তার সাথীকে বলেছিল, চিন্তিত হয়ো না, আল্লাহ আমাদের সাথে আছেন৷ সে সময় আল্লাহ নিজের পক্ষ থেকে তার ওপর মানসিক প্রশান্তি নাযিল করেন এবং এমন সেনাদল পাঠিয়ে তাকে সাহায্য করেন, যা তোমরা দেখনি এবং তিনি কাফেরদের বক্তব্যকে নীচু করে দেন৷ আর আল্লাহর কথা তো সমুন্নত আছেই৷ আল্লাহ পরাক্রমশালী ও প্রজ্ঞাময়৷ "(তাওবা ৯:৪০)
উপরোক্ত আয়াতটি রাসুলুল্লাহ সাঃএর হিজরতের সাথে সম্পর্কিত। তিনি যদি সবখানেই যেতে পারতেন তাহলে হিজরতের প্রয়োজন ছিলো কেন?
আরও পড়ুন পূর্বপুরুষদের অন্ধ অনুসরণ
কুরায়শরা রাসুলুল্লাহ (সাঃ) তার মিরাজের ঘটনা কেন্দ্র করে বায়তুল মুকাদ্দাসের এমন সব বিষয় সম্পর্কে জিজ্ঞেস করতে লাগল যা তিনি দেখেন নি। ফলে তিনি খুবই চিন্তিত হয়ে পড়লেন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাজির নাযিরের ক্ষমতা থাকলে তিনি চিন্তিত হতেন না। কেননা মূহুর্তেই তিনি বায়তুল মুকাদ্দাস গিয়ে সব দেখে আসতে পারতেন।
এই সম্পর্কিত হাদীসে এসেছে, যুহায়র ইবন হারব (র)……আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেছেন যে, রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেনঃ আমি হাজরে আসোয়াদের কাছে ছিলাম। এ সময় কুরায়শরা আমাকে আমার মিরাজ সম্পর্কে প্রশ্ন করতে শুরু করে। তারা আমাকে বায়তুল মুকাদ্দাসের এমন সব বিষয় সম্পর্কে জিজ্ঞেস করতে লাগল, তা আমি ভালভাবে দেখিনি। ফলে আমি খুবই চিন্তিত হয়ে পড়লাম। রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেনঃ তারপর আল্লাহ তাআলা আমার সম্মুখে বায়তুল মুকাদ্দাসকে উদ্ভাসিত করে দিলেন এবং আমি তা দেখছিলাম। তারা আমাকে যে প্রশ্ন করছিল, তার জবাব দিতে লাগলাম। এরপর নবীদের এক জামাতেও আমি নিজেকে উদ্ভাসিত দেখলাম। মুসা (আঃ)-কে নামাযে দণ্ডায়মান দেখলাম, তিনি শানূয়া গোত্রের লোকদের মত মধ্যমাকৃতির। তাঁর চুল ছিল কোঁকড়ানো। হযরত ঈসা (আঃ)-কেও নামাযে দাঁড়ানো দেখলাম। উরওয়া ইবন মাসঊদ আবু সাকাফী হচ্ছেন তাঁর নিকটতম সদৃশ। ইবরাহীম (আঃ) কেও নামাযে দাঁড়ান দেখলাম। তিনি তোমাদের এ সাথীরই সদৃশ। রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেনঃ তারপর নামাযের সময় হলো, আমি তাঁদের ইমামত করলাম। নামায শেষে এক ব্যক্তি আমাকে বললেন, হে মুহাম্মাদ (সাঃ)! ইনি জাহান্নামের তত্ত্বাবধায়ক ‘মালিক’, ওকে সালাম করুন। আমি তাঁর দিকে তাকালাম। তিনি আমাকে আগেই সালাম করলেন (আঃ)-কেও নামাযে দাঁড়ান দেখলাম। তিনি তোমাদের এ সাথীরই সদৃশ। রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেনঃ তারপর নামাযের সময় হলো, আমি তাঁদের ইমামত করলাম। নামায শেষে এক ব্যক্তি আমাকে বললেন, হে মুহাম্মাদ (সাঃ)! ইনি জাহান্নামের তত্ত্বাবধায়ক ‘মালিক’, ওকে সালাম করুন। আমি তাঁর দিকে তাকালাম। তিনি আমাকে আগেই সালাম করলেন। (সহিহ মুসলিম, কিতাবুল ঈমান, হাদিস ৩২৮)।
উপরোক্ত হাদীস দ্বারা প্রমাণিত যে, আল্লাহর রাসুল সাঃ যেকোনো স্থানে হাজির নাজির নন। যেখানে আল্লাহ্ ঘোষিত পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মানুষ আল্লাহর বন্ধু মুহাম্মদ সাঃ পৃথিবীর যেকোনো স্থানে হাজির নাজির নয়। সুফি সুন্নীদের এ ধরনের বিশ্বাস হচ্ছে সুস্পষ্ট শির্ক। যা তাদের ইসলাম থেকে খারিজ করে দিয়েছে।
আরও পড়ুন সুফিবাদ কী, কীভাবে উৎপত্তি এবং বর্তমান অবস্থা
রাসুলুল্লাহ কবরেও জীবিত
সুফি সুন্নীদের আকিদা হলো রাসুলুল্লাহ সাঃ কবরে অন্যান্য জীবিত মানুষদের মতোই এখনো জীবিত। তাদের মতে রাসুল সাঃ কবরে হুবহু দুনিয়ার মতই জীবনযাপন করছেন। যা সরাসরি ইসলামের মূল আকিদার সাথে সাংঘর্ষিক। আমরা যদি কুরআনের আয়াত পর্যালোচনা করি তাহলে এই বিষয়ে পরিষ্কার ধারণা পেতে পারি। আল্লাহ্ সুবাহানাহুয়াতালা বলেন, "প্রতিটি প্রাণী মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করবে। " আল ইমরান [৩:১৮৫]
প্রতিটি জীবন মানেই মৃত্যু। নবী রসুলেরাও এর ব্যতিক্রম নয়। এর উর্দ্ধে নয় কোন অলী আওলিয়া বা কোন পূণ্যাত্মা মানুষ। পাপী ও পূণ্যাত্মা সকলেই মৃত্যুকে আলিঙ্গন করবে। আল্লাহ বলেন, "নিশ্চয়ই (হে রাসুল) তুমিও মারা যাবে, এবং নিশ্চয়ই তারাও মারা যাবে। (জুমার ৩৯:৩০)
সুতরাং পূর্বের কোন নবী বা রাসুলও এর উর্দ্ধে ছিলন না। কাফেররা মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে বিদ্রূপ করতো যে তিনি যদি সত্য নবী হন তবে মৃত্যু তাঁকে স্পর্শ করবে না। এরই প্রেক্ষিতে উক্ত আয়াত নাজেল হয়। আল্লাহ্ আরো বলেন, "(হে রাসুল পৃথিবীতে) তোমার পূর্বেও কোন মানুষকে অনন্ত জীবন দান করা হয় নাই। সুতারাং তোমার মৃত্যু হলে ওরা কি চিরদিন বেঁচে থাকবে ? প্রতিটি আত্মাকে মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে। আমি তোমাদের মন্দ ও ভালো দ্বারা পরীক্ষা করে থাকি। আমারই নিকট তোমরা ফিরে আসবে, (আম্বিয়া ২১:৩৪-৩৫)
উপরোক্ত আয়াতে এটা সুস্পষ্ট যে রাসুলুল্লাহ সাঃও মৃত্যুবরণ করবেন এবং তাঁকেও মৃত্যুর স্বাদ নিতে হবে। আবু হুরাইরা (রা) থেকে বর্ণিত। "তিনি বলেছেন, যে সময় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইনতিকাল করলেন, তখন উমার ইবনুল খাত্তাব (রা) দাঁড়িয়ে বলতে লাগলেন, “কতকগুলো মুনাফিক বলে বেড়াচ্ছে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মারা গেছেন। আল্লাহর কসম, তিনি মারা যাননি। তিনি কেবল মূসা আলাইহিস সালামের মত সাময়িকভাবে আল্লাহর কাছে গিয়েছেন। মূসা (আ) চল্লিশ দিনের জন্য আল্লাহর কাছে গিয়েছিলেন। তখন প্রচার করা হয়েছিল যে, তিনি মারা গেছেন। অথচ তার পরে তিনি ফিরে এসেছিলেন। আল্লাহর কসম, মূসার (আ) মত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবার ফিরে আসবেন। এখন যারা বলছে যে তিনি মারা গেছেন, তাদের হাত পা কেটে দেয়া হবে।”
আবু বাক্কর (রা:) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ইন্তিকালেরর খবর জানতে পেরে ছুটে এলেন। উমার (রা) তখনও ঐ কথা বলে চলেছেন। সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে তিনি আয়িশার (রা) ঘরে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে চলে গেলেন। তখন তাঁকে ইয়ামনী কাপড় দিয়ে ঘরের এক কোণে ঢেকে রাখা হয়েছিল। এগিয়ে গিয়ে তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মুখের কাপড় সরিয়ে চুমু খেলেন। অতঃপর বললেন, “আপনার জন্য আমার পিতা-মাতা কুরবান হোক। আল্লাহ আপনার জন্য যে মৃত্যু নির্ধারিত করে রেখেছিলেন তা আপনি আস্বাদন করেছেন। এরপর আপনার কাছে আর কখনো মৃত্যু আসবে না।” অতঃপর মুখ ঢেকে দিলেন।
তারপর বাহিরে বেরিয়ে দেখেন উমার (রা) সেই একই কথা বলে চলেছেন। তিনি বললেন, “উমার। তুমি ক্ষান্ত হও। চুপ কর।” উমার (রা) কছিুতেই থামতে রাজী হচ্ছিলেন না। এ অবস্থা দেখে আবু বাক্কর (রা:) জনগণকে লক্ষ্য করে কথা বলতে শুরু করলেন। তাঁর কথা শুনে জনতা উমারকে (রা) রেখে তাঁর দিকে এগিয়ে এল।
আরও পড়ুন কবর = মাজার = শির্ক
তিনি আল্লাহর প্রশংসা করার পর বললেন, “হে জনমন্ডলী, যে ব্যক্তি মুহাম্মাদের পূজা করতো সে জেনে রাখুক যে, মুহাম্মাদ মারা গেছেন। আর যে ব্যক্তি আল্লাহর ইবাদাত করতো সে জেনে রাখুক যে, আল্লাহ চিরঞ্জীব ও অবিনশ্বর।”
তারপর তিনি এই আয়াত তিলাওয়াত করলেন- "মুহাম্মাদ আল্লাহর রাসূল বৈ আর কিছুই নন। তার পূর্বে বহু রাসূল অতিবাহিত হয়েছেন। তিনি যদি মারা যান কিংবা নিহত হন তাহলে কি তোমরা ইসলাম থেকে ফিরে যাবে? যে ফিরে যাবে সে আল্লাহর কোন ক্ষতি করতে পারবে না। কৃতজ্ঞ লোকদের আল্লাহ যথোচিত পুরস্কার দেবেন।” (আলে ইমরান-৩:১৪৪)।
এরপর মানুষের মধ্যে এমন ভাবান্তর ঘটলো যে, মনে হচ্ছিল তারা যেন আবু বাক্করের মুখে শোনার আগে এ আয়াত কখনো শোনেইনি। তারা আয়াতটি আবু বাকরের কাছ থেকে মুখস্থ করে নিল এবং অনবরত তা আবৃত্তি করতে লাগলো। আবু হুরাইরা বলেন,, উমার (রা) বলেছেন, “আবু বাক্করের মুখে এ আয়াত শোনার পর আমি হতবাক ও হতবুদ্ধি হয়ে পড়ে গেলাম। পায়ের ওপর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলাম না। আমি তখনই অনুভব করলাম যে,, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সত্যিই ইনতিকাল করেছেন। (সীরাতে ইবনে হিশাম, প্রকাশনীঃ বাংলাদেশ ইসলামিক সেন্টার)
রাসুলুল্লাহসাঃ এর ওফাত পরবর্তী জীবন সম্পর্কে আমরা যদি একটু বিশ্লেষণ করি তাহলে দেখতে পাই - আল্লাহ্ তায়ালা বলেন, "আর যারা আল্লাহর পথে নিহত হয় তাদেরকে মৃত বলো না ৷ এই ধরনের লোকেরা আসলে জীবিত ৷ কিন্তু (তাদের জীবন সম্পর্কে) তোমারা কোন উপলব্ধি করতে পার না, (বাকারা ২:১৫৪)।
আল্লাহ্ অন্য আয়াতে বলেন, “যারা আল্লাহর পথে নিহত হয়েছে তাদের কখনই মৃত মনে করো না, বরং তারা জীবিত, এবং তাদের রবের নিকট হতে তারা রিযিকপ্রাপ্ত। [আল- ইমরান ৩: ১৬৯]
কুরআনের আয়াতদুটিতে সুস্পষ্ট উল্লেখ করা হয়েছে যে, শহীদগণ মৃত নন, তারা জীবিত ও রিযিক পাচ্ছেন। আমরা জানি, বারযাখে সমস্ত মানুষেরই এক ধরনের জীবন আছে। একজন মুসলিমকে অবশ্যই কবরের ছওয়াল জওয়াব দিতে হবে।
কবরের আযাব/শান্তি ইত্যাদি আছে বিশ্বাস করতে হবে। আর এসব কোন প্রানহীন মানুষর পক্ষে ঘটা সম্ভব নয়। কাজেই এটাও জীবন কিন্তু এই জীবন সাধারণ দুনিয়ার জীবনের মত নয়। এই জীবনটাকে বলা হয় “হায়াতুন বারযাখিয়া’।
আরও পড়ুন কবর নিয়ে তামাশা!
শহীদদের এই বারযাখি জীবন সাধারণ লোকদের বারযাখি জীবনের চেয়ে ভিন্নতর কারন কুরআনে শহীদের সেই জীবন যেভাবে জীবিত ও রিজিক প্রাপ্ত বলে উল্লেখ করা হয়েছে। সাধারন লোকের জীবনের কথা তেমনিভাবে উল্লেখ করা হয়নি। কিন্তু এর অর্থ যদি আমরা এভাবে করি যে, শহীদগন দুনিয়ার জীবনের মত চলাফেরা করেন খাওয়া দাওয়া করেন, তবে নিতান্তই ভুল হবে।
তাদের জীবন সম্পর্কে ব্যাখ্যা বিশ্লষন করা খুবই নির্বুদ্ধিতার কাজ। কারন আয়াতের শেষ অংশে বলা হয়েছে, ‘তোমারা কোন উপলব্ধি করতে পার না’। এরপরও যদি কেউ আল্লাহর আয়াতের বিরোধিতা করে উপলব্ধির চেষ্টা করে বা ব্যাখ্যা বিশ্লষণের চেষ্টা করে তাহলে তা হবে গোমরাহীর নামান্তর। কেননা যা আল্লাহ্ সরাসরিই বলছেন যে, তোমরা উপলব্ধি করতে পারবে না, সেখানে আমরা তাদের জীবনকে সাধারন দুনিয়ার জীবনের মত মনে করি তাহলে তা কতটুকু ঈমানদারের কাজ হবে।
শহীদদের ওফাত পরবর্তী জীবন সাধারণের জীবনের চেয়ে ভিন্নতর কুরআনে যেভাবে উল্লেখ করা হয়েছে, নবীদের কথা তেমনিভাবে উল্লেখ করা হয়নি। যেহেতু আল্লাহর কাছে নবীদের মর্যাদা শহীদের চেয়েও অনেক বেশি। বিভিন্ন হাদিসের রেফারেন্সে অধিকাংশ আলেমগণ উল্লেখ করেছেন যে, নবীদের ওফাত পরবর্তী জীবন শহীদের ওফাত পরবর্তী জীবনের চেয়ে ভিন্নতর। তাহলে বুঝা যাচ্ছে যে সাধারন মুসলিম, শহীদ ও নবীদের ওফাত পরবর্তী জীবনের (বারযাখি জীবনের) মধ্যে পার্থক্য আছে।
ওফাত পরবর্তী জীবন বা বারযাখি জীবন সম্পর্কে হাদিসে সুস্পষ্ট উল্লেখ থাকায় জন্য কারো কোন মতভেদ নাই। যেহেতু সাধারন মুসলিম, শহীদ ও নবীদের বারযাখি জীবনের মধ্যে পার্থক্য আছে। আমরা সাধারণ মুসলমানগণ এই বিষয়ে জ্ঞানার্জনের চেষ্টা না করার ফলে এই পার্থক্য নির্নয় করতে পারি না। যারফলে আমরা এ সম্পর্কে মহা বিভ্রান্তে পতিত হই।
এই পার্থক্য নির্ণয় করতে না পেরে নিজেদের সুবিধার জন্য সুফিবাদীরা কুরআন হাদিসের উপর নির্ভর না করে বিভিন্ন ব্যাখ্যা প্রদান করে। কিন্তু এটা মনে রাখতে হবে, বারযাখি জীবনের কথা একটি গায়েবি বিষয়। কাজেই অহীর দলিল ছাড়া কথা বলা যাবে না। অহীর ব্যাখ্যা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেভাবে করছেন, সাহাবিগন রাঃ যেভাবে বুঝছেন, সলফে সালেহীন যেভাবে পালন করছেন তার ব্যতিক্রম গ্রহনীয় নয়। মৃত্যু পরবর্তী জীবন বা বারযাখি জীবন তিন শ্রেণীতে ভাগ করা যায়ঃ
আরও পড়ুন কবর পাকা করার দলিল খন্ডন
১. সাধারন মুসলিম বা অমুসলিমদের বারযাখি জীবন।
২. শহীদের বারযাখি জীবন।
৩. নবী রাসুলদের আঃ বারযাখি জীবন।
সকলের কাছে এ ব্যাপারটি স্পষ্ট যে মৃত্যুর পর সকলেনই বারযাখি জীবন ভোগ করতে হয়। নিম্নের হাদিস তিনটি লক্ষ্য করলেই সাধারন মুসলিম বা অমুসলিমদের বারযাখি জীবন সম্পর্কে পরিস্কার ধারণা পাওয়া যাবে।
১. আনাস ইবনে মালিক (রা) থেকে বর্ণিত যে, রাসূলুল্লাহ্ (সা) বলেছেন, (মৃত) বান্দাকে যখন তার কবরে রাখা হয় এবং তার সাথী এতটুকু মাত্র দূরে যায় যে সে (মৃত ব্যক্তি) তখনও তাদের জুতার আওয়ায শুনতে পায়। এ সময় দু’জন ফিরিশতা তার কাছে এসে তাকে বসান এবং তাঁরা বলেন, এ ব্যক্তি অর্থাৎ মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সম্পর্কে তুমি কি বলতে? তখন মু’মিন ব্যক্তি বলবে, আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, তিনি আল্লাহর বান্দা এবং তাঁর রাসূল। তখন তাঁকে বলা হবে, জাহান্নামে তোমার অবস্থানস্থলটির দিকে নযজ কর, আল্লাহ তোমাকে তার বদলে জান্নাতের একটি অবস্থানস্থল দান করেছেন। তখন সে দু’টি স্থলের দিকেই দৃষ্টি করে ফেলবে। কাতাদা রহ. বলেন, আমাদের কাছে বর্ণনা করা হয়েছে যে, সে ব্যক্তির জন্য তাঁর কবর প্রশস্ত করে দেওয়া হবে। এরপর তিনি (কাতাদ) পুনরায় আনাস (রা.) এর হাদীসের বর্ণনায় ফিরে আসেন। তিনি (আনাস রা.) বলেন, আর মুনাফিক বা কাফির ব্যক্তিকেও প্রশ্ন করা হবে তুমি এ ব্যক্তি (মুহাম্মাদসাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সম্পর্কে কি বলতে? সে উত্তরে বলবে, আমি জানি না। লোকেরা যা বলত আমি তা-ই বলতাম। তখন তাকে বলা হবে, তুমি না নিজে জেনেছ, না তিলাওয়াত করে শিখেছ। আর তাকে লোহার মুগুর দ্বারা এমনভাবে আঘাত করা হবে, যার ফলে সে এমন বিকট চিৎকার করে উঠবে যে, দু’ জাতি (মানব ও জিন) ব্যতিত তার আশপাশের সকলেই তা শুনতে পাবে। (সহিহ বুখারী, খন্ড- ২, হাদিস ৪৫৬)।
আবূ আইয়ূব আনসারী (রা) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, (একবার) সূর্য ডুবে যাওয়ার পর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বের হলেন। তখন তিনি একটি আওয়ায শুনতে পেয়ে বললেন: ইয়াহুদীদের কবরে আযাব দেওয়া হচ্ছে। (সহিহ বুখারী, খন্ড- ২, হাদিস ৪৫৭)
ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, (একবার) রাসূলুল্লাহ্ (সা) দু’টি কবরের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। তখন তিনি বললেন- ঐ দু’জনকে আযাব দেওয়া হচ্ছে আর কোন কঠিন কাজের কারণে তাদের আযাব দেওয়া হচ্ছে না। এরপর তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেনঃ হ্যাঁ (আযাব দেওয়া হচ্ছে) তবে তাদের একজন পরনিন্দা করে বেড়াত, অন্যজন তার প্রস্রাবের ব্যাপারে সতর্কতা অবলম্বন করত না। (রাবী বলেন) এরপর তিনি একটি ডাল নিয়ে তা দু’খণ্ডে ভেঙ্গে ফেললেন। তারপর সে দু’ খণ্ডের প্রতিটি এক এক কবরে পুঁতে দিলেন। এরপর বললেনঃ আশা করা যায় যে এ দু’টি শুকিয়ে না যাওয়া পর্যন্ত তাদের আযাব লঘু করা হবে। (সহিহ বুখারী, খন্ড-২, হাদিস ৪৬০)
উপরোক্ত হাদিস দ্বারা সাধারন মুমিন, মুনফিক, কাফির ও ইয়াহুদীদের বারযাখি জীবন সম্পর্কে ধারনা পাওয়া যায়। মুমিনকে জান্নাত দেখানো হবে, সামান্য অন্যায়ের আযাবও দেওয়া হবে। মুনফিক ও কাফির আযাবের যন্ত্রনায় চিৎকার করবে। ইয়াহুদী, খৃষ্টান ও কাফির সকলকেই আযাব ভোগ করতে হবে।
যার অর্থ হল এদের সকলেরই বারযাখি জীবন আছে। যদি কেউ বলে, এরা সকলে আযাবে যন্ত্রনায় চিৎকার করছে, কাজেই দুনিয়ার জীবনের সাথে তাদের জীবনের সাদৃশ্য আছে। যেমনটি শহীদদের ব্যাপারে অনেকে বলে থাকেন: আল্লাহ্ সুবাহানাহুয়াতালা বলেন, “যারা আল্লাহর পথে নিহত হয়েছে তাদের কখনই মৃত মনে করো না, বরং তারা জীবিত, এবং তাদের রবের নিকট হতে তারা রিযিকপ্রাপ্ত, (আল- ইমরান ৩: ১৬৯)।
আল্লাহ্ সুবাহানাহুয়াতালার স্পষ্ট ঘোষনা শহীদগন জীবিত ও রিজিক প্রাপ্ত। এ থেকেও বুঝা যায় দুনিয়ার জীবনের সাথে শহীদদের বিশেষ জীবনের অনেক সাদৃশ্য রয়েছে। কারন দুনিয়ার জীবনে খাবার খেতে হয়। আর ও একটু বাড়িয়ে বলা যায়, নবীদের মর্যাদা শহীদের চেয়েও অনেক বেশি তাই দুনিয়ার জীবনের সাথে নবীদের জীবনের অনেক সাদৃশ্য রয়েছে। সুতরাং তারা মরে নাই, তারা জীবিত, খাবার খায়, তারা যেকোনো জায়গায় যেতে পারে দেখতে পারে মানুষের উপকার অপকার ইত্যাদি ইত্যাদি করতে পারে।
অতএব তাঁদের বারযাখি জীবন ও সাধারণের জীবনের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। এভাবে যুক্তিবিদ্যার যুক্তি দেওয়া যায়। কিন্তু আল্লাহর কাছে পার পাওয়া যায় না। আমরা যদি বলি মানুষ ঘাস খায়। যদিও তা সত্য নয়। কিন্তু যুক্তিবিদ্যার যুক্তিতে এটা সত্য। কীভাবে? তা এইভাবে যে, মানুষ গরু খায়, গরু ঘাস খায়। সুতরাং মানুষও ঘাস খায়। এটা খুবই সহজ যুক্তি। তবে এইসব যুক্তি দিয়ে দুনিয়ায় পার পাওয়া গেলেও আখিরাতে পার পাওয়া যাবে না।
এভাবে খোঁড়া যুক্তি দিয়ে ইসলাম চলে না। ইসলাম চলে দলিলের ভিত্তিতে। সুতরাং শহীদগণ জীবিত এবং রিজিকপ্রাপ্ত এবং ততটুকু যতটুকু কুরআন এবং হাদীসে এসেছে ততটুকু। আমাদের এর বাইরে গিয়ে তাদের জীবনের সাথে দুনিয়াবী জীবনের সাদৃশ্য বা বৈসাদৃশ্য দেখার প্রয়োজন নেই। হাদিসে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ওফাত পরবর্তী জীবন সম্পর্কে যা বলছেন তা মোনে নেওয়াই মুমিনের কাজ।
সহীহ মুসলিমে বর্ণিত, হযরত আনাস রা. বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘আমি মিরাজের রাতে (বাইতুল মোকাদ্দেসের পাশে) লাল বালুর ঢিবির কাছে মূসা আঃএর পাশ দিয়ে অতিক্রম করেছি। তখন তিনি তাঁর কবরে দাড়িয়ে সালাত আদায় করছিলেন”।
এই হাদিসটি থেকে বুঝা যায়, যেহেতু মুসা (আ:) কবরে দাড়িয়ে নামায আদায় করছিলেন, সুতারং তিনি জীবিত। অথচ সহিহ মুসলিম, সহিহ বুখারি, নাসাঈ শরীফসহ অনেক গ্রন্থে পাওয়া যায় মিরাজের রাতে ষষ্ঠ আসমানের হযরত মুসা (আঃ)-এর সাক্ষাৎ পান। তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে মারহাবা দেন ও কল্যাণের জন্য দুআ করলেন।
ফিরে আসার সময় মুসা (আঃ)-এর পরামর্শে আল্লাহর নিকট থেকে পঞ্চাশ ওয়াক্ত কমিয়ে পঞ্চাশ ওয়াক্ত সালাত ফরজ করে নিয়ে আসেন। তাই বলে কি তিনি ষষ্ঠ আসমানেই থাকেন? আমাদের আকিদা হবে, মুসা (আ:) কবরে দাড়িয়ে সালাত আদায় করেন আবার আল্লাহর ইচ্ছায় ষষ্ঠ আসমানেও থাকেন। বারযাখী হায়াত সম্পর্কে একমাত্র আল্লাহই ভাল জানেন। কেননা তা গায়েবের খবর। যা কোনো মানুষ জানতে পারে না।
উপরোক্ত হিসাবে মুমিন, মুনফিক, কাফির ও ইয়াহুদী এমনকি পরনিন্দাককারী, প্রস্রাবের ব্যাপারে অসতর্কতা অবলম্বনকারি সকলেই জীবিত। এভাবে দলিলবিহীন ভাবে আয়াতের ভুল ব্যাখ্যা করলে যেকোনো সাধারন মানুষ মহাবিভ্রান্তিতে পড়ে যাবে। অতএব আমাদের ততটুকুই গ্রহণ করা উচিত যতটুকু আল্লাহ্ এবং তাঁর রাসুল আমাদের জানিয়েছেন এবং পৌঁছে দিয়েছেন।
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওফাত পরবর্তী জীবন বা বারযাখি জীবন ও সাধারণের জীবনের মধ্যে কোন পার্থক্য আছে কি নেই তার জন্য কোন ব্যাখ্যার প্রয়োজন নেই। প্রয়োজন শুধু কুরআন হাদিসের মতামত। নবীগণের বিষয়ে কুরআনে কিছু না বলা হলেও সহীহ হাদীসে তাঁদের মৃত্যু পরবর্তী জীবন সম্পর্কে বলা হয়েছে। আনাস ইবনু মালিক (রা) বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘‘নবীগণ তাঁদের কবরের মধ্যে জীবিত, তাঁরা সালাত আদায় করেন।’’(শায়খ নাসীরুদ্দীন আলবানী রাহ. সিলসিলাতুস সহীহা, হাদীস ৬২১)
আবু হুরাইরা (রা.) বলেছেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘‘যখনই যে কেউ আমাকে সালাম করে তখনই আল্লাহ আমার রূহকে আমার কাছে ফিরিয়ে দেন, যেন আমি তার সালামের উত্তর দিতে পারি।’’ [আবূ দাউদ, আস-সুনান ২/২১৮। হাদীসটির সনদ গ্রহণযোগ্য]
অন্য হাদীসে আবু হুরাইরা (রা) বলেছেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘‘কেউ আমার কবরের কাছে থেকে আমার উপর দরুদ পাঠ করলে আমি শুনতে পাই। আর যদি কেউ দূর থেকে আমার উপর দরুদ পাঠ করে তাহলে আমাকে জানান হয়।’’ (হাদীসটির একটি সনদ খুবই দুর্বল হলেও অন্য আরেকটি গ্রহণযোগ্য সনদের কারণে ইবনু হাজার, সাখাবী, সুয়ূতী প্রমুখ মুহাদ্দিস এ সনদটিকে সুন্দর ও গ্রহণযোগ্য বলে উল্লেখ করেছেন।
আউস (রা) বলেছেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘তোমাদের শ্রেষ্ঠ দিনগুলোর একটি হল জুমার দিন। এ দিনেই আদম আলাইহিস সালামকে সৃষ্টি করা হয়েছে। এ দিনেই তাঁর মৃত্যু হয়েছে। এ দিনেই শিঙ্গায় ফুৎকার দেওয়া হবে, আর এ দিনেই সকল প্রাণী মৃত্যুবরণ করবে। সুতরাং এ দিনে তোমরা আমার উপর বেশি করে ছালাত ও সালাম পাঠাও। তোমাদের ছালাত আমার কাছে পেশ করা হবে। সাহাবাগণ বললেন, আমাদের ছালাত আপনার কাছে কীভাবে পেশ করা হবে, তখন যে আপনি (মাটির সাথে মিশে) ক্ষয়প্রাপ্ত (নিঃশেষিত) হয়ে যাবেন? নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘নিশ্চয় আল্লাহ তাআলা মাটির জন্য নবীগণের দেহ খাওয়াকে হারাম করে দিয়েছেন’। (হাদীসটি বাযযার, তাবারানী ও আবুশ শাইখ সংকলন করেছেন। হাদীসের সনদে পরস্পর বর্ণনাকারী রাবীদের মধ্যে দুজন রাবী দুর্বল। এজন্য হাদীসটি যয়ীফ। তবে এ অর্থে আরো কয়েকটি দুর্বল সনদের হাদীস বর্ণিত হয়েছে। সেগুলোর সামগ্রিক বিচারে নাসিরুদ্দীন আলবানী ও অন্যান্য মুহাদ্দিস এ হাদীসটিকে ‘হাসান’ বা গ্রহণযোগ্য বলে গণ্য করছেন)
আরো অনেক সহীহ হাদীসে বলা হয়েছে যে, ফিরিশতাগণ উম্মতের সালাত ও সালাম রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কবর মুবারাকে পৌঁছিয়ে দেবেন। আম্মার বিন ইয়াসির (রা)-এর সূত্রে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণিত: ‘‘আল্লাহ আমার কবরে একজন ফিরিশতা নিয়োগ করছেন, যাকে তিনি সকল সৃষ্টির শ্রবণশক্তি প্রদান করেছেন, কিয়ামত পর্যন্ত যখনই কোনো ব্যক্তি আমার উপর সালাত (দরুদ) পাঠ করবে তখনই ঐ ফিরিশতা সালাত পাঠকারীর নাম ও তাঁর পিতার নাম উল্লেখ করে আমাকে তাঁর সালাত পৌঁছে দিয়ে বলবে : অমুকের ছেলে অমুক আপনার উপর সালাত প্রেরণ করেছে।’’ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, “আল্লাহ তাআলার নির্ধারিত একদল ফেরেশতা রয়েছেন যারা দুনিয়াতে ঘুরে বেড়ান এবং আমার উম্মতের সালাম আমার কাছে পৌঁছে দেন”। (সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস ৯১৪)।
উপরের সহিহ হাদীসগুলো থেকে প্রমাণিত যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে মৃত্যু পরবর্তী জীবন দান করা হয়েছে। এ জীবন হল, তার বারযাখী জীবন। সে সম্পর্কে মনগড়া তথ্য প্রচার করা সম্পূর্ণ হারাম। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এই বারযাখী জীবনটা তার বিশেষ সম্মান ও মর্যাদা বহন করে। যেহেতু এটি গায়েবী জগতের খবর তাই এ বিষয়ে হাদীসে যতটুকু বলা হয়েছে ততটুকুই বলতে হবে এবং বিশ্বাস করতে হবে। এর বেশী বাড়ানো বা কমানো যাবে না। হাদীসের আলোকে বলা যায়, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ অলৌকিক বারযাখী জীবন অনেক ঘটনা ঘটছে যা সাধারন মুমিন থেকে সম্পূর্ণ আলাদা।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এই অলৌকিক বারযাখী জীবনের বৈশিষ্ট হলঃ
১. তাঁর এই জীবনে সালাত আদায়ের সুযোগ রয়েছে।
২.কেউ সালাম দিলে আল্লাহ তাঁর রূহ মুবারাককে ফিরিয়ে দেন সালামের জবাব দেয়ার জন্য।
৩. কবরের নিকট কেউ সালাম দিলে তিনি তা শুনেন, আর দূর থেকে সালাম দিলে তা তাঁর কাছে পৌঁছানো হয়।
৪. নিশ্চয় আল্লাহ তাআলা মাটির জন্য তার দেহ খাওয়াকে হারাম করে দিয়েছেন।
মাসিক আল কাউসার, অক্টোবার ২০১৫ সংখ্যায়, মাওলানা তাহমীদুল মাওলা “প্রসঙ্গঃ আকীদায়ে হায়াতুন্নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম” শিরোনামে এসম্পর্কে সুন্দর ও জ্ঞানগর্ব একটি লেখা উপস্থাপন করছেন। ঐ লেখায় তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মৃত্যু পরবর্তী জীবন সম্পর্কে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআতের আকীদা কি তা উল্লেখ করে লিখেছেন
আরও পড়ুন সুফিবাদের শরীয়তের উৎস ও যৌক্তিকতা
আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআতের আকীদা
১. নির্ধারিত মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করার মাধ্যমে সকল নবীগণের দুনিয়ার জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটেছে।
২. মৃত্যুর পর তাঁরা আল্লাহ তা’আলার পক্ষ থেকে এক বিশেষ জীবন লাভ করেছেন। তাই তারা কবরে জীবিত। তাদের কবরের জীবনের ধরণ বিষয়ে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআর বিশ্বাস হলঃ
ক. আলমে বারযাখে সাধারণ মুমিনের জীবনের চেয়ে শহীদদের জীবন পূর্ণাঙ্গ। আর শহীদের জীবন থেকে নবীদের জীবন আরো পূর্ণাঙ্গ ও উন্নততর।
খ. দুনিয়ার জীবনের সাথে তাঁদের কবরের জীবনের কিছু কিছু বিষয়ে সাদৃশ্য রয়েছে। যেমনঃ কবরে তাঁদের দেহ মোবারক সুরক্ষিত রয়েছে। তাঁরা কবরে সালাত আদায় করেন। যারা কবরের নিকট গিয়ে ছালাত ও সালাম পেশ করে তাঁরা তা সরাসরি শুনেন এবং যারা দূর থেকে সালাম পাঠান তা ফেরেশতাদের মাধ্যমে তাদের কাছে (কবরে) পৌঁছে দেন এবং তাঁরা আল্লাহর পক্ষ থেকে বিশেষ রিযিক প্রাপ্ত হন।
গ. কবরের জীবনের ধরণ সম্পর্কে যে বিষয়গুলো কুরআন-সুন্নাহয় পাওয়া যায় না সে বিষয়ে নিরবতা অবলম্বন করি।
৩. আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাত এও বিশ্বাস করে যে, তাদের কবর-জীবন হুবহু দুনিয়ার জীবনের মত নয়। কবর থেকে স্বাভাবিকভাবে যথা ইচ্ছা গমনাগমন করা, মৃত্যু-পূর্ববর্তী সময়ের মত আদেশ নিষেধ ও পরামর্শ দেওয়া, কারো সাথে সরাসরি সাক্ষাৎ, কথোপকথন ও মুসাফাহা করা ইত্যাদি বিষয়ে শরয়ী কোনো দলিল নেই। তবে যদি স্বপ্ন, কাশফ বা কারামাতের মাধ্যমে এমন কোনো কিছু ঘটা প্রমাণিত হয়, তাহলে সেটি ভিন্ন বিষয়। হায়াতুল আম্বিয়ার আকীদার সাথে এর কোনো সম্পর্ক নেই।
আরও পড়ুন সুফিবাদী সুন্নীদের আকিদা সমূহ
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ অলৌকিক বারযাখী জীবন সাধারন মুমিন থেকে সম্পুর্ণ আলাদা প্রমান করতে গিয়ে হাদিসের আলোকে বারযাখী জীবনের যে চারটি বৈশিষ্ট উল্লেখ করেছি তার সাথে “আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআতের আকীদা” মিলিয় দেখুন সম্পুর্ন মিলে যাবে।
তবে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআতের আকীদায় দুই নম্বরে বলা হয়েছে, “তাই তাঁরা কবরে জীবিত” দুই নম্বরের খ-তে বলা হয়েছে, “দুনিয়ার জীবনের সাথে তাঁদের কবরের জীবনের কিছু কিছু বিষয়ে সাদৃশ্য রয়েছে”। তিন নম্বরটি পড়লেই এর ব্যাখ্যা পেয়ে যাবেন, সেখানে বলা হয়েছে, যে, তাদের কবর-জীবন হুবহু দুনিয়ার জীবনের মত নয়। অর্থাৎ তারা জীবিত কিন্তু বলতে হবে বারযাখী জীবনে বা ওফাত পরবর্তী জীবন।
হায়াতুন্নাবী সম্পর্কে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআতের আকীদাই চুড়ান্ত আকিদা হওয়া উচিৎ। কিন্তু হায়াতুন্নাবী বলতে যদি আমরা বুঝি আমাদের দুনিয়ার জীবনের মত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও কবরে জীবন যাপন করছেন তবে তা হবে মারাত্বক ভুল।
সুফি সুন্নীরা দাবি করে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্বশরীরে কররে জীবিত। কথাটা ঠিক আছে কারণ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দেহ মোবারক আল্লাহ তাআলা মাটির জন্য খাওয়াকে হারাম করে দিয়েছেন।(আলবানী, আস-সহীহা ৪/৪৩-৪৫)। তিনি বারযাখী জীবনে বা ওফাত পরবর্তী জীবনে বিশেষ হায়াত প্রাপ্ত।
তবে স্বশরীরে কররে জীবিত এর দ্বারা যদি কেউ বুঝে থাকেন যে, দুনিয়ার জীবনের মত কবরেও তিনি সাধারণ মানুষের মতো জীবন যাপন করছেন। কবর জিয়ারতে গেলে তিনি তাকিয়ে থাকেন। আমাদের কর্ম সম্পর্কে খোজ খবর নেন। যেমন জীবিত লোকে খোজ খবর নেন। তাহলে তা হবে সম্পূর্ণ ভুল। তাইতো অনেক বিজ্ঞ আলেম হায়াতুন্নাবী শব্দটিও পবিহার করে চলেন। এই লকবটিও দিয়েছেন সুফিবাদের সুফিরা।
হায়াতুন্নাবী বলতে অনেকে বুঝে থাকেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ওফাত পরবর্তী জীবন জাগতিক জীবনের মতই। এ ধারণাটি ভুল এবং তা কুরআন, সুন্নাহ ও সাহাবীগণের রীতির পরিপন্থী। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মৃত্যু পরবর্তী পরের ঘটনাগুলো হাদীসগ্রন্থগুলোতে পাঠ করলেই আমরা অত্যন্ত সুস্পষ্টভাবে বুঝতে পারি যে, সাহাবীগণ তাকে কখনোই জাগতিক জীবনের অধিকারী বলে মনে করেন নি।
তাই তাঁর ওফাতের পর একজন সাধারন মুমিনের মৃত্যুর পর যেসব ইসলামী রীতিনীতি পালন করা হয় ঠিক তেমনই করা হয়েছে। যেমন গোসল করান, কাফন, দাফন ইত্যাদি করা।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জীবদ্দশায় তাঁর পরামর্শ, দোয়া ও অনুমতি ছাড়া কোন সাহাবি কিছু করছেন বলে প্রমান পাওয়া যায় না। কিন্তু তার ওফাতের পরে কখনো কোনো সাহাবী তার কবরে দোয়া, পরামর্শ বা অনুমতি গ্রহণের জন্য আসেন নি।
ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে তার ওফাতের পরে খলীফা নির্বাচনের বিষয়সহ সাহাবীগণ বিভিন্ন সমস্যায় পড়েছেন। নিজেদের মধ্যে ভুল বুঝাবুঝির জন্য যুদ্ধবিগ্রহ করেছেন। আবু বকর (রা)-এর খিলাফত গ্রহণের পরই অনেকে যাকাত দিতে অস্বীকার করে, প্রায় আধা ডজন ব্যক্তি নিজেদের ভন্ড নবী দাবি করে বসে এবং আভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ শুরু হয়।
আরও পড়ুন আল্লাহ্কে পেতে মাধ্যম
উম্মুল মুমিনীন আয়েশার (রা) সাথে আমীরুল মুমিনীন আলীর (রা) কঠিন যুদ্ধ হয়েছে, আমীর মুয়াবিয়ার (রা) সাথেও তার যুদ্ধ হয়েছে। হাজার হজার সাহাবি শহীদ হয়েছেন। তার কলিজার টুকরা ফাতিমর (রাদি:) পুত্র হোসাইন (রাদি:) কারবালায় নির্মমভাবে শহীদ হন। এই ভয়াবহ বিপদের সময় কোনো খলিফা (রা) বা সাহাবী (রা) তার কবরে কাছে দোয়া বা পরামর্শের জন্য গিয়েছেন বলে জানা যায়না।
আল্লাহর কাছে দোয়া করার জন্যও রাসুলুল্লাহর কবর শরীফে সমবেত হয়ে কোনো অনুষ্ঠান করেন নি। এমনকি কারো কাছে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রূহানীভাবেও প্রকাশিত হয়ে কিছু বলেন নি এবং কাউকে স্বপ্নের মধ্যেও নির্দেশ দেননি।
জালিয়াত শিয়ারা হযরত ওমরের (রা) পক্ষে বিপক্ষে, হযরত আলীর (রা) পক্ষে বিপক্ষে হাদিস বানিয়েছেন। কিন্তু ওফাতের পরে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কবর থেকে বা রূহানীভাবেও প্রকাশিত হয়েছে অথবা সাহাবীগণের মাজলিসে এসে কোন পরামর্শ দিয়েছেন বলে কোনো হাদিসে বা ইতিহাস গ্রন্থে আসেনি। সুতারং সুফি সুন্নীরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ওফাত পরবর্তী জীবন জাগতিক জীবনের মত মনে করে তা একটি মিথ্যা রচনা ছাড়া কিছুই না।
‘হাদীসের নামে জালিয়াতি’ নামক বইটিতে, ডঃ খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওফাত পরবর্তী জীবন কিছু জয়িফ ও জাল হাদিস বর্ননা করছেন। শুধু সতর্ক হওয়ার জন্যই হদিসগুলি সরাসরি তুলে ধরছি।
একটি যয়ীফ সনদের হাদীসে বর্ণিত হয়েছেঃ ‘নবীগণকে ৪০ রাতের পরে তাঁদের কবরের মধ্যে রাখা হয় না; কিন্তু তারা মহান আল্লাহর সামনে সালাতে রত থাকেন; শিংগায় ফুঁক দেয়া পর্যন্ত।’’
হাদীসটির বর্ণনাকারী আহমাদ ইবনু আলী আল-হাসনবী মিথ্যাবাদী ও জালিয়াত বলে পরিচিত। এজন্য কোনো কোনো মুহাদ্দিস একে মাউযূ বলে গণ্য করেছেন। অন্যান্য মুহাদ্দিস এ অর্থের অন্যান্য হাদীসের সমন্বয়ে একে দুর্বল বলে উল্লেখ করেছেন। (দাইলামী, আল-ফিরদাউস ১/২২২; ৩/৩৫; ইবনু হাজার, ফাতহুল বারী ৬/৪৮৭; সুয়ূতী, আল-লাআলী ১/২৮৫; আলবানী, যয়ীফুল জামি, পৃ. ২০৫)।
বি: দ্র: তবে বিভিন্ন হাদীসে বর্ণিত মি’রাজের রাত্রিতে মূসা (আ)-কে নিজ কবরে সালাত আদায় করা এবং ঈসা (আ)-কেও দাঁড়িয়ে সালাত আদায় করার কথা আছে।
আরও পড়ুন ওয়াসীলাহ্ নিয়ে ভ্রান্তি
তিনি আমাদের দরুদ-সালাম শুনতে বা দেখতে পান আব্দুল হাই লাখনবী বলেন, প্রচলিত জাল ও মিথ্যাগুলোর একটিঃ যদি কেউ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর দরুদ পাঠ করে, তবে সে ব্যক্তি যত দূরেই থাক, তিনি কারো মাধ্যম ছাড়াই তা শুনতে পান। (আব্দুল হাই লাখনবী, আল-আসার, পৃ. ৪৬)।
তিনি মীলাদের মাহফিলে উপস্থিত হন: আব্দুল হাই লাখনবী বলেন: প্রচলিত আরেকটি জাল ও মিথ্যা কথা:
‘মাওলিদের ওয়াযের মাজলিসে তাঁর মাওলিদ বা জন্মের কথা উল্লেখের সময় তিনি নিজে সেখানে উপস্থিত হন। এ কথার উপরে তারা তাঁর মাওলিদের বা জন্মের কথার সময় সম্মান ও ভক্তি প্রদর্শনের জন্য কিয়াম বা দাঁড়ানোর প্রচলন করেছে।’ (আব্দুল হাই লাখনবী, আল-আসার, পৃ. ৪৬)। উপরের বর্ণিত কথা সনদহীন, ভিত্তিহীন, বানোয়াট ও মিথ্যা কথা। উপরন্তু এ কথা উপরে আলোচিত সহীহ হাদীসগুলোর সুস্পষ্ট বিরোধী।
সুতরাং নবী রাসুলগণের ওফাত পরবর্তী জীবন যেখানে সাধারণ জাগতিক জীবনের মতো নয়। এইসব আকিদার শরীয়তের কোনো ভিত্তি নেই। যেখানে রাসুল সাঃ কবরে জীবিত নন সেখানে তথাকথিত পীর আউলিয়ারা জীবিত থাকার প্রশ্নই আসে না। যারা এইসব চালু করেছে তারা তাদের নিজেদের স্বার্থের জন্যই এইসব চালু করেছে। যাতে শরীয়তের হুকুম আহকাম ছাড়া বিনা পুঁজিতে আল্লাহ্ পেয়ে যায়। আমাদের এইসব শিরকী বিদআতী আকিদা থেকে দূরে থাকা উচিত।
সুফি সুন্নীদের আল্লাহ ও রাসুলের প্রতি ইশক এর জবাব
সুফিদের একটি আকিদা হলো তারা আল্লাহ্ এবং রাসুল সাঃ এর সাথে ইশক বা প্রেম করে আল্লাহ্ ও রাসুলের প্রেমিক হয়ে যান। আরবি ইশক শব্দটির অর্থ প্রেম। হুব্বুন অর্থ ভালবাসা। এ দুটি শব্দের পার্থক্য করতে না পেরে সুফি সুন্নীরা আল্লাহ সাথে ভালবাসা না করে প্রেম করে। প্রেম বা ইশক এমন একটি পরিভাষা যা সকলের জন্য প্রযোজ্য নয়। কিন্ত ভালবাসা পরিভাষাটি সকলের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে।
আরও পড়ুন উছিলা কী?
একটা উদাহরন দিলে তা খুবই স্পষ্ট হবে।
কোন বিবেকবান জ্ঞান সম্পন্ন পুরুষ কি তার মা বাবা, ভাই বোন বা শ্বশুর শাশুরীকে বলতে পারবে আমি আপনার সাথে প্রেম করব বা আমি আপনাদের সাথে প্রেম করি। অথবা আমি আপনাদের প্রেমিক! এগুলো সুস্পষ্ট অসভ্যতা ছাড়া আর কিছুই প্রকাশিত হবেনা।
কারন একজন সুস্থ জ্ঞানবান ব্যক্তি এমন অশোভন কথা বলতে পারেনা। কিন্ত ঐ ব্যাক্তি যাদি তার মা, বোন বা শাশুরীকে বলে আমি আপনাকে, আপনাদের ভালবাসি। আপনাদের প্রতি আমার অশেষ ভালোবাসা। এভাবে বললে কি কোন সমস্যা হবে? নিশ্চয়ই নয়।
সুতরাং যে শব্দটি মা বাবা, ভাই, বোন বা শ্বশুর শাশুরীর জন্য প্রযোজ্য নয় তা কি করে মহান আল্লাহ্ এবং তাঁর রাসুলের জন্য প্রযোজ্য হবে। সুফিরা আল্লাহর সাথে প্রেম করার পাশাপাশি নবী রাসুলদের সাথে ও প্রেম করে থাকে।
অথচ আল্লাহ্ পবিত্র কুরআনে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন কীভাবে তাঁকে ভালোবাসা দিতে এবং নিতে হবে। মহান আল্লাহ বলেন, "বলুন (হে রাসুল) , যদি তোমরা আল্লাহকে ভালবাস, তাহলে আমাকে অনুসরণ কর, যাতে আল্লাহও তোমাদিগকে ভালবাসেন এবং তোমাদিগকে তোমাদের পাপ মার্জনা করে দেন। আর আল্লাহ হলেন ক্ষমাকারী দয়ালু। ( সুরা ইমরান ৩:৩১)।
উপরোক্ত আয়াতে আল্লাহ্ স্পষ্ট করে বলে দিয়েছেন যে, যে কেউ আল্লাহ্র ভালোবাসা পাওয়ার একমাত্র শর্ত হলো, রাসুল সাঃ এর অনুসরণ। যদি তাঁর বান্দা রাসুল সাঃকে পরিপূর্ণ অনুসরণ করে, তাহলে আল্লাহর ভালোবাসা এবং ক্ষমা পাওয়া যাবে।
অথচ সুফি আকিদা থেকে স্পষ্ট প্রমাণিত যে, সুফি সুন্নীদের আকিদা সম্পূর্ণ কুরআন এবং সুন্নাহ বিরোধী। সুফিরা আল্লাহ্ এবং তাঁর রাসুল সাঃকে মুখে মুখে প্রেম করে। কিন্তু কাজের বেলায় অনুসরণ করে না। আর দাবি করে আশেকে রাসুল। এভাবে আল্লাহ্ এবং রাসুলের সাথে প্রেম করে কখনোই আল্লাহ্ এবং রাসুলের ভালোবাসা পাওয়া যাবে না। কেননা আল্লাহ্ এবং রাসুলকে ভালোবাসতে হয়। তাঁদের সাথে প্রেম করা শালীনতা বিরোধী। আল্লাহ্ আমাদের হেদায়েত দান করুন। আমিন।
কৃতজ্ঞতাঃ
মোহাম্মাদ ইস্রাফিল হোসাইন। (বিএ ইন আরবি সাহিত্য ও ইসলাম শিক্ষা)
সাখাওয়াতুল আলম চৌধুরী
২২ জানুয়ারি, ২০২২
পতেঙ্গা, চট্টগ্রাম।