সুফি সুন্নীদের আল্লাহ্ সম্পর্কিত আকিদার জবাব |
সুফি সুন্নীদের আল্লাহ্ সম্পর্কিত আকিদার জবাব
সুফিবাদ ইসলামে নতুন একটি মতবাদ। যা ইসলাম প্রতিষ্ঠার তিন চারশ বছর পরে ভিত্তি লাভ করে। পরবর্তীতে বিভিন্ন মতবাদের সমন্বয়ে সুফিবাদের নিজস্ব মতবাদ একটি প্রতিষ্ঠিত রূপ নেয়। সুফি মতবাদ সৃষ্টির শুরু থেকেই প্রশ্নবিদ্ধ। এই মতবাদ যদিও ইসলামকে আশ্রয় করে গড়ে উঠেছে। তবুও এই মতবাদ কখনোই ইসলামে গ্রহণযোগ্য হয়নি। তার কারণ সুফি আকিদা সমূহ সরাসরি ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক।
কিন্তু উপমহাদেশে সুফিদের মাধ্যমে ইসলাম প্রচার হওয়ার কারণে ভারতীয় উপমহাদেশে সুফিদের প্রভাব বেশী। এই সুফিরাই ধীরে ধীরে সুন্নী নাম ধারণ করে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতে নিজেদের আত্মপ্রকাশ করে। এখন আমরা সুফি সুন্নীদের "আল্লাহ্" সম্পর্কিত আকিদার জবাব সমূহ জানার চেষ্টা করবো।
আল্লাহ্ সম্পর্কিত আকিদার জবাব
আল্লাহ স্বশরীরে সর্বত্র বিরাজমান
সুফি সুন্নীদের আকিদা হল মহান আল্লাহতায়ালা স্বসত্তায় সর্বত্র সবকিছুতে বিরাজমান। কিন্তু এটা দালিলিকভাবে সত্য নয়। এ সম্পর্কে জানতে হলে আল্লাহ তাআলার মারেফাত বা পরিচয় সম্পর্কে জানা খুবই জরুরী।
আল্লাহর মারেফাত বা পরিচয়ের একটা দিক হল তিনি কোথায় আছেন। কেউ যদি নিজস্ব জ্ঞান বুদ্ধি আর কল্পনা দ্বারা মানুষের শারীরিক অবস্থানের মত আল্লাহর অবস্থান কল্পনা করে তবে তা হবে ভুল। কারন বিশ্বজাহান সৃষ্টির আগেও তিনি ছিলেন এবং এখনও আছেন। আর মানুষের কল্পনা বিশ্বজাহানের বাইরে যেতে পারেনা।
শরীয়তের যেকোনো বিষয় জানার জন্য দলিল হচ্ছে কুরআন এবং সহীহ্ হাদীস। আমরা কুরআনকে যদি জিজ্ঞাসা করি যে, আল্লাহ্ কোথায় আছেন? তাহলে কুরআন আমাদের কী উত্তর দেয়? কুরআনে আল্লাহ্ বলছেন, "দয়াময় আল্লাহ আরশের উপর সমুন্নত হয়েছেন।” (সূরা ত্বহা-২০:৫)
"(আল্লাহ) যিনি আসমান জমিন ও এতদুভয়ের অন্তর্বর্তী সবকিছু ছয়দিনে সৃষ্টি করেছেন, অতঃপর আরশে সমুন্নত হয়েছেন।" (সূরা ফুরকান ২৫:৫৯)
আল্লাহ রব্বুল আলামিন আরশের উপর সমুন্নত আছেন এ সম্পর্কিত আয়াত সমূহঃ সূরা সাজদা -৪; সূরা ইউনুস -৩; সূরা রাদ -২; সূরা আরাফ -৫৪; সূরা মুলক -১৭; সূরা নিসা -১৫৮; সূরা মাআরিজ -৮; সূরা নাহল -৫০; সূরা মুমিন -৩৭; সূরা বাকারা -৯৭; সূরা আশ শুয়ারা -১৯৩-১৯৪।
আল্লাহ রব্বুল আলামিন সবার নিকটে আছেন, যেদিকেই মুখ ফিরাই সেদিকেই রয়েছেন, সত্যবাদিদের সাথেও আছেন। আল্লাহ রব্বুল আলামিন বলেন, "আল্লাহ আকাশ ও পৃথিবীর প্রতিটি জিনিস সম্পর্কে অবগত, সে ব্যাপারে তুমি কি সচেতন নও? যখনই তিন ব্যক্তির মধ্যে কোন গোপন কানাঘুষা হয়, তখন সেখানে আল্লাহ অবশ্যই চতুর্থজন হিসেবে উপস্থিত থাকেন৷ যখনই পাঁচজনের মধ্যে গোপন সলাপরামর্শ হয় তখন সেখানে ষষ্ঠ জন হিসেবে আল্লাহ অবশ্যই বিদ্যমান থাকেন৷ গোপন সলাপরামর্শকারীরা সংখ্যায় এর চেয়ে কম হোক বা বেশী হোক, এবং তারা যেখানেই থাকুক, আল্লাহ তাদের সাথে থাকেন৷ তারপর কিয়ামতের দিন তিনি তাদেরকে জানিয়ে দেবেন তারা কি কি করেছে৷ আল্লাহ সর্বজ্ঞ৷ (মুজাদালাহ ৫৮:৭)
"পূর্ব এবং পশ্চিম আল্লাহ তায়ালারই। সুতরাং যেদিকেই মুখ ফিরাও, সেদিকেই রয়েছেন আল্লাহ তায়ালা। নিশ্চয় আল্লাহ তায়ালা সর্বব্যাপী সর্বজ্ঞাত।" (বাকারা ২:১১৫)
আরও পড়ুন মাজারে দান সদকা করার ইসলামী বিধান
মহান আল্লাহ সবার নিকটে আছেন এ সম্পর্কিত আয়াতঃ সুরা বাকারা ১৫৩, ১৯৪ এবং সুরা ক্বফ-৫০:১৬। প্রথম দুই আয়াতসহ অনেক আয়াতে বলা হয়েছে আল্লাহ রব্বুল আলামিন আরশের উপর সমুন্নত আছেন। পরের দুই আয়াতসহ অনেক আয়াতে বলা হয়েছে আল্লাহ রব্বুল আলামিন আমাদের সাথে আছেন। তাহলে এই আয়াতগুলোর সঠিক ব্যাখ্যা কী?
আল্লাহ নিজেই এর ব্যাখ্যা দিচ্ছেন কুরআনে, "তিনি নভোমণ্ডল ও ভূমন্ডল সৃষ্টি করেছেন ছয়দিনে, অতঃপর আরশের উপর সমুন্নত হয়েছেন। তিনি জানেন যা ভূমিতে প্রবেশ করে ও যা ভূমি থেকে নির্গত হয় এবং যা আকাশ থেকে বর্ষিত হয় ও যা আকাশে উত্থিত হয়। তিনি তোমাদের সাথে আছেন তোমরা যেখানেই থাক। তোমরা যা কর, আল্লাহ তা দেখেন।” (সূরা হাদীদ : ৫৭:৪)
এখানে আল্লাহ্ প্রথমে বললেন তিনি আরশের উপর সমুন্নত আছেন। পরের আয়াতেই বললেন তিনি আমাদের সাথে আছেন। তাহলে আল্লাহ কি আত্বভোলা (নাউজুবিল্লাহ)? তিনি তোমাদের সাথে আছেন তোমরা যেখানেই থাক। এ আয়াতের তাফসির আয়াতেরই শেষাংশ আর তা হল ' আল্লাহ্ তা দেখেন'।
অর্থাৎ মহান আল্লাহ তা‘আলা তাঁর জ্ঞান, শ্রবণ, দর্শন ও ক্ষমতার মাধ্যমে সকল সৃষ্টির সাথে আছেন। অর্থাৎ তিনি সপ্ত আসমানের উপর অবস্থিত ‘আরশের উপর থেকেই সব কিছু দেখছেন, সব কিছু শুনছেন, সকল বিষয়ে জ্ঞাত আছেন। সুতরাং তিনি দূরে থেকেও যেন কাছেই আছেন।
সাথে থাকার অর্থ, গায়ের সাথে গা লেগে থাকা নয়। মহান আল্লাহ মূসা ও হারূন আলাইহিমাস সালামকে ফির‘আওনের নিকট যেতে বললেন। কিন্তু তারা ফির‘আওনের অত্যাচারের আশংকা ব্যক্ত করলেন। আল্লাহ তাদের সম্বোধন করে বললেন, ‘‘তোমরা ভয় পেও না। নিশ্চয়ই আমি তোমাদের সাথে আছি। (অর্থাৎ) শুনছি এবং দেখছি।”(সূরা ত্ব-হা ২০:৪৬)
এখানে "সাথে থাকার" অর্থ এটা নয় যে, মূসা আলাইহিস সালাম-এর সাথে মহান আল্লাহ তা‘আলাও ফির‘আওনের দরবারে গিয়েছিলেন। বরং "সাথে থাকার" ব্যাখ্যা তিনি নিজেই করছেন এই বলে যে, ‘‘শুনছি এবং দেখছি।” অতএব আল্লাহর সাথে ও কাছে থাকার অর্থ হলো জ্ঞান, শ্রবণ, দর্শন ও ক্ষমতার মাধ্যমে তিনি সবার সাথে আছেন। কিন্তু তিনি স্ব-সত্তায় আরশের উপরই রয়েছেন। তাহলে প্রশ্ন হল “মহান আল্লাহ সর্বত্র স্বসত্ত্বায় বিরাজমান” কথাটা কি সঠিক?
“মহান আল্লাহ সর্বত্র বিরাজমান” বাক্যটির অর্থ যদি হয় ‘‘মহান আল্লাহ স্ব-সত্ত্বায় সর্বত্র বিরাজমান” তা হলে বাক্যটি সরাসরি বাতিল। তবে শর্ত সাপেক্ষে যদি বলা যাবে যে তিনি সর্বত্র বিরাজমান। যেমন যদি কেউ বলে, মহান আল্লাহ তার জ্ঞান, শ্রবণ, দর্শন ও ক্ষমতা দ্বারা সর্বত্র বিরাজমান তবে তা সঠিক হবে।
একটি উদাহরণ হচ্ছে- শত শত কিলোমিটার দুর থেকে যে লাইভ টেলিকাষ্ট আমরা দেখি আর ভাবি এতো আমার চোখের সামনেই ঘটছে। কারন আমার জ্ঞান, শ্রবন, দর্শন ঐ ঘটনার সাথে সরাসরি জড়িত। ঠিক তেমনই আল্লাহ্ আরশের উপর অবস্থান করেই পুরো সৃষ্টিজগতের সকল কিছু তাঁর নখদর্পণে রয়েছে।
সূরা বাকারা ১১৫ নম্বর আয়াতের তাফসীরে বিশ্ববিখ্যাত তাফসীরবিদ হাফেজ ইমাদুদ্দিন ইবনু কাসীর রাহিমাহুল্লাহ “তাফসীর ইবনু কাসীরে” বলেন, "আল্লাহ তা 'আলা হতে কোন জায়গা শূন্য নেই, এর ভাবার্থ যদি আল্লাহ তা 'আলার ‘ইলম’ বা অবগতি হয় তাহলে অর্থ সঠিক হবে। অর্থাৎ কোন স্থানই আল্লাহ পাকের ইলম হতে শূন্য নেই। আর যদি এর ভাবার্থ হয় 'আল্লাহর সত্তা’ তবে এটা সঠিক হবে না। কেননা আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তার সৃষ্ট কোনো কিছুর মধ্য সীমাবদ্ধ থাকবেন তা থেকে তার পবিত্র সত্তা বহু ঊর্ধে"। (তাফসিরে ইবনে কাসির প্রতম খন্ড পৃষ্ঠা ৩৭২)
আবু মুতি আল হাকাম ইবনে আব্দুল্লাহ আল বালাখি বলেন, আমি ইমাম আবু হানিফা রাহিমাহুল্ল কে জিজ্ঞসা করেছিলাম, "কেউ যদি বলে, আমি জানিনা আল্লাহ্ কোথায় পৃথিবীতে না আসমানে,তাহলে তার সম্পর্কে আপনার অভিমত কি?"
প্রত্যুত্তরে তিনি বলেছেন, সে কাফির কেননা আল্লাহ্ বলেছেন, "পরম করুণাময় আরশের উপর সমাসীন। "(সুরা ত্বহা ২০:৫)
আবু মুতি বলেছেন অতপর আমি তাকে জিজ্ঞস করেছিলাম যে, "কেউ যদি বলে, আল্লাহ্ উপরে অধিষ্ঠিত, কিন্তু আমি জানিনা আরশ কোথায় অবস্থিত আকাশে না পৃথিবীতে তাহলে তার সম্পর্কে আপনার অভিমত কি?"
প্রত্যুত্তরে তিনি বলেছেন, সে ব্যক্তি কাফির কেননা সে এ কথা অস্বীকার করে যে, ‘পরম করুণাময় আরশের উপর সমাসীন’।" (আল ফিকহুল আকবার: বঙ্গানুবাদ ও ব্যাখ্যা পৃষ্ঠা -২৬১; ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর রহঃ)
আরও বহু আয়াত ও হাদীস রয়েছে যেগুলো দ্বারা সুস্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় আল্লাহ তায়ালা সব জায়গায় বিরাজমান নন। বরং তার ক্ষমতা, রাজত্ব, পরিচালনা, নিয়ন্ত্রণ, জ্ঞান, দৃষ্টি ইত্যাদি সর্বত্র ও সব কিছুতে বিরাজমান। কিন্তু তিনি স্বত্বাগতভাবে, সাত আসমানের উপর আরশে আযীমে সমুন্নোত। আর এটাই হল বিশুদ্ধ আকীদা। আল্লাহ্ সম্পর্কে এর বিকল্প চিন্তা করা শির্ক।
আরও পড়ুন কবর পাকা করার দলিল খন্ডন
আল্লাহ সর্বত্র বিরাজমান নয় তার প্রমানে এই আয়াতগুলি যথেষ্টঃ সূরা ত্বহা ২০:৫; সুরা ফুরকান ২৫:৫৯; সুরা সেজদা ৩১:৪; সুরা আরফ ৭:৫৪; সুরা ইউসুফ ১০:৩; সুরা রাদ ১৩:২; সুরা মুলক ৬৭: ১৬-১৭; সুরা নিসা ৪:১৫৮।
এ ছাড়া আমাদের সমাজে প্রচলিত চার মাযহাবের চারজন মুজতাহিদ আলেম আবু হানিফা (রহঃ) ইমাম মালিক (রহঃ), ইমাম শাফিঈ রহঃ ইমাম আহম্মদ ইবনে হাম্বল রহঃ এর আকিদা ছিল মহান আল্লাহ আরশে সমুন্নোত আছেন।
কুরআনের কিছু আয়াতে মহান আল্লাহ বলেন, তিনি ধৈর্যশীল, মুত্তাকি ও সতকর্মশীলদের সাথে রয়েছেন। এর অর্থ অধিকাংশ মুফাস্সিরগন বলেছেন, তিনি বান্দার সমর্থন, সাহায্য ও হিফাজতের মাধ্যমে সাথে থাকার কথা বলেছেন। আবার কিছু আয়াতে বান্দার সাথে থাকার কথা বলেছেন, যার অর্থ হলো, মহান আল্লাহ জ্ঞান, শ্রবণ, দর্শন ও ক্ষমতার মাধ্যমে বান্দার সাথে আছেন। কিন্তু তিনি স্বত্বাগতভাবে, সাত আসমানের উপর আরশে আযীমে সমুন্নোত। আর এটাই হল বিশুদ্ধ আকীদা।
আল্লাহ নিরাকার
সুফি সুন্নীদের আকিদা হলো আল্লাহ্ রব্বুল আলামীন নিরাকার। আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের আক্বীদাহ হলো, আল্লাহর সিফাতকে তাঁর কোন মাখ্লুকের সাথে সাদৃশ্য না করে তাঁর উপর বিশ্বাস স্থাপন করতে হবে। কোরআন মাজিদের বিভিন্ন আয়াত ও রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাদিস ও সলফে সালেহীনগনের বিশ্বাস থেকে ও বুঝা যায় যে, আল্লাহ সুবাহানাহুয়াতালার চেহারা, হাত, পা, চক্ষু, যাত বা সত্তা, সুরাত বা আকারের আছে। কিন্তু আকরের ধরন জানা নেই কারন পৃথিবীর কিছুই তার সাদৃশ্য নয়। (সুরা শুরা-৪২:১১)।
আল্লাহ্ সুবাহানাহুয়াতালার আকার আছে তার অন্যতম প্রমান হল তার হাত আছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, "(প্রতিপালক আল্লাহ্) বললেন, “ হে ইবলিস! আমি আমার দু’হাত দিয়ে যাকে তৈরি করেছি তাকে সিজদা করতে তোমাকে কিসে বাধা দিয়েছে? তুমি কি বড়াই করছো, না তুমি কিছু উচ্চ মর্যাদার অধিকারী?” (সুরা সোয়াদ ৩৮:৭৫)
আল্লাহ্ সুবাহানাহুয়াতালার হাত আছে সম্পর্কিত আয়াতঃ জুমার-৬৭; মায়েদা- ৬৪; ইমরান- ২৬, ৭২; ফাতহা-১০; মুলত-১। আল্লাহ্র চেহারা আছে, সেই সম্পর্কে আল্লাহ্ বলেন, "(কিয়ামতের দিন) ভূপৃষ্ঠের সবকিছুই ধ্বংস হয়ে যাবে । (হে রাসুল) আপনার মহিমাময় ও মহানুভব রবের চেহারা অর্থাৎ সত্ত্বাই একমাত্র বাকি থাকবে"। (আর রহমান-৫৫:২৫,২৬)।
আল্লাহ্তালার চেহারা সম্পর্কিত আয়াতঃ সূরা কিয়ামাহ-২২,২৩ কাসাস-৮৮। আল্লাহ্ সুবাহানাহুয়াতালার চোখ আছে। আল্লাহ্ তাআলা নবী মূসা (আঃ) কে লক্ষ্য করে বলছেন, "আমি নিজের পক্ষ থেকে তোমার প্রতি ভালোবাসা সঞ্চার করেছিলাম এবং এমন ব্যবস্থা করেছিলাম যাতে তুমি আমার চোখের সামনে প্রতিপালিত হও।" (সূরা ২০:৩৯)
আল্লাহ্ সুবাহানাহুয়াতালার চোখ আছে সম্পর্কিত আয়াতঃ সূরা আত তুর-৪৮, শুরা-১১ আল্লাহ্ তাআলার ‘পা’ আছে। আল্লাহ্ বলেন, "কিয়ামতের দিনে আল্লাহর হাঁটুর নিম্নাংশ উন্মোচিত করা হবে এবং সাজদা করার জন্য সকলকে আহবান করা হবে, কিন্তু তারা তা করতে সমর্থ হবে না।"( সুরা কালাম ৬৮:৪২)
কোরআনের সকল আয়াত ও হাদীস আল্লাহ্ রব্বুল আলামীন যে নিরাকার বা আকারহীন নন তার অকাট্য প্রমান রয়েছে। আল্লাহ তাআলা কোরআনে তাঁর সিফাত, জাত ও গুনাবলীর বর্ননা করেছেন। তাঁর নিজস্ব সত্তার হাত, পা, মুখ, দৃষ্টিশক্তি, শ্রবণ শক্তি, তাঁর সন্তুষ্টি ও ক্রোধ ইত্যদি উল্লেখ করেছেন। রাসুল সাঃ তা বর্ননা করেছেন এবং সাহাবি (রাঃ) ও সলফে ছালেহিন সেভাবে বুঝেছেন। তার দ্বারা বুঝা যায় আল্লাহর নির্দিষ্ট আকার আছে।
আরও পড়ুন সুফি সুন্নিদের পীর আউলিয়া সম্পর্কিত আকিদার জবাব
তিনি নিরাকার হলে এসব কিছু থাকার কথা নয়। মু’মিনগণ কিয়ামাতের দিন তাকে দেখতে পাবে। জান্নাতের সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ নি‘মাত হবে আল্লাহর দীদার। (কিয়ামাহ ৭৫:২২-২৩)। যা দেখা যায় তার আকার থাকে, কাজেই আল্লাহ আকার আছে। এখন প্রশ্ন হল আল্লাহর যেহেতু আকার আছে তাহলে তার আকার কেমন? এ প্রশ্নের উত্তর স্বয়ং আল্লাহই দিচ্ছেন। আল্লাহ তাআলা বলেন, "আসমান ও যমীনের স্রষ্টা, যিনি তোমাদের আপন প্রজাতি থেকে তোমাদের জোড়া সৃষ্টি করেছেন, অনুরূপ অন্যান্য জীবজন্তুর ও (তাদের নিজ প্রজাতি থেকে ) জোড়া বানিয়েছেন এবং এই নিয়মে তিনি তোমাদের প্রজন্মের বিস্তার ঘটান৷ বিশ্বজাহানের কোন কিছুই তাঁর সদৃশ নয়৷ তিনি সব কিছু শোনেন ও দেখেন"৷ (সুরা শুয়ারা-৪২:১১
আল্লাহ সম্পর্কে ইমাম আবু হানিফা রাহিমাহুল্লাহ বলেন আল্লাহর ইয়াদ (হাত) আছে, ওয়াজহ (মুখমন্ডল) আছে,নফস (সত্তা) আছে কারন কুরআনে আল্লাহ এগুলো উল্লেখ করছেন। কুরআনে আল্লাহ যা কিছু উল্লেখ করেছেন যেমন হাত, মুখমন্ডল, নফস ইত্যাদি সবই তার বিশেষন কোন স্বরূপ বা প্রকৃতি নির্নয় ছাড়া। আবু (হানিফা রচিত আল ফিকহুল আকবারের বঙ্গানুবাদ ও ব্যাখ্যা ড. আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর পৃষ্ঠা – ২২৫)
অতএব কুরআন হাদিসের দলিল দ্বারা এটা প্রমাণিত হয় যে আল্লাহর আকার আছে। কিন্তু তা কেমন সেই সম্পর্কে আমরা জানি না। যদি কেউ আল্লাহ্কে নিরাকার বলে বা দাবি করে তাহলে তাকে তার স্বপক্ষে প্রমাণ দিতে হবে। কুরআন এবং হাদিসের দ্বারা এটা প্রমাণ করতে হবে যে আল্লাহ্ নিরাকার। পবিত্র কুরআনে একটি আয়াতও নেই যেখানে আল্লাহ্ সরাসরি বলছেন তিনি নিরাকার একজন আকারহীন সত্তা।
অহেদাতুল অজুদ বা সর্বেঈশ্বরবাদ
ওয়াহদাতুল ওজুদ এর বাংলা হচ্ছে ‘সর্বেশ্বরবাদ’। অর্থাৎ সব কিছুর মাঝেই ঈশ্বর আছেন। যদিও কথাটি এসেছে হিন্দু ধর্ম থেকে এবং এর চর্চা হতো গ্রীক ধর্মেও। তবুও সুফি সুন্নীদের আকিদায় এর ব্যবহার রয়েছে। অর্থাৎ আল্লাহ্ সবকিছুর মধ্যে বিরাজমান। এই পৃথিবীতে যত জড় পদার্থ বা জীবজন্তু আছে প্রতিটির মধ্যেই আল্লাহর নিজস্ব অস্তিত্ব বিদ্যমান। অথচ ইসলামে এমন কোনো ধারণা নেই, যেখানে আল্লাহ্ নিজেই সবকিছুর মধ্যে আছে। আল্লাহ রব্বুল আলামিন বলেন, "আল্লাহ তায়ালা ব্যতীত কোন মাবুদ নাই। তিনি চিরঞ্জীব, স্ব-প্রতিষ্ঠিত বিশ্বধাতা। তাকে স্পর্শ করে না তন্ত্রা, না নিদ্রা। আসমান এবং জমিনে যা কিছু আছে সব তারই।" (সূরা বাকারা ২:২৫৫)
"তিনিই আদি, তিনিই অন্ত, তিনিই প্রকাশ্য, তিনিই গুপ্ত। তিনিই সর্ব বিষয়ে সম্মক জ্ঞাত।"(সূরা হাদীদ-৩)
"তাঁর সত্তা ব্যতীত সব কিছুই ধ্বংসশীল। (সূরা আনকাবুত-৮৮)
"তাদেরকে জিজ্ঞেস করোঃ যদি তোমরা জানো তাহলে বলো এ পৃথিবী এবং এর মধ্যে যারা বাস করে তারা কার (অধিনে)? তারা নিশ্চয় বলবে, আল্লাহর ৷ বলো, তাহলে তোমরা সচেতন হচ্ছো না কেন" ?
"তাদেরকে জিজ্ঞেস করো, সাত আসমান ও মহান আরশের অধিপতি কে? তারা নিশ্চয়ই বলবে, আল্লাহ। বলো, তাহলে তোমরা ভয় করো না কেন"?
"তাদেরকে জিজ্ঞেস করো, বলো যদি তোমরা জেনে থাকো, কার কর্তৃত্ব চলছে প্রত্যেকটি জিনিসের ওপর? আর কে তিনি যিনি আশ্রয় দেন এবং তাঁর মোকাবিলায় কেউ আশ্রয় দিতে পারে না ? তারা নিশ্চয়ই বলবে, এ বিষয়টি তো আল্লাহরই জন্য নির্ধারিত৷ বলো,তাহলে তোমরা বিভ্রান্ত হচ্ছো কোথা থেকে" ? [সুরা মুমিনুনের- ৮৪-৮৯]
"তবুও তারা তাঁকে ছেড়ে অন্য উপাস্য গ্রহণ করেছে যারা কিছুই সৃষ্টি করতে পারে না বরং ওরা নিজেরাই সৃষ্ট হয়েছে। ওরা নিজেদের অপকার বা উপকার করার ক্ষমতা রাখে না। মৃত্যু , জীবন ও পুনরুত্থানের উপরে তাদের কোন ক্ষমতা নাই, " (ফুরকান ২৫:৩)।
"নিঃসন্দেহে এটা নির্ভুল সত্য বৃত্তান্ত ৷ প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ ছাড়া আর কোন ইলাহ নেই৷ আর আল্লাহর সত্তা প্রবল পরাক্রান্ত এবং তার জ্ঞান ও কর্মকৌশল সমগ্র বিশ্ব ব্যবস্থায় সক্রিয়"। (আল ইমরান ৩:৬২)।
"তোমরা যদি এসব লোকদের জিজ্ঞেস করো, যমীন ও আসমান কে সৃস্টি করেছে, তাহলে এরা নিজেরাই বলবে, ঐগুলো সেই মহাপরাক্রমশালী ও মহাজ্ঞানী সত্তা সৃষ্টি করেছেন"৷ [জুকরূক-৪৩:৯]
"তাদেরকে জিজ্ঞেস করো, “কে তোমাদের আকাশ ও পৃথিবী থেকে রিযিক দেয়? এই শুনার ও দেখার শক্তি কার কর্তৃত্বে আছে ? কে প্রাণহীন থেকে সজীবকে এবং সজীব থেকে প্রাণহীনকে বের করে? কে চালাচ্ছে এই বিশ্ব ব্যবস্থাপনা”?তারা নিশ্চয়ই বলবে, আল্লাহ৷ বলো, তবুও কি তোমরা (সত্যের বিরোধী পথে চলার ব্যাপারে৷)সতর্ক হচ্ছো না? " (সুরা ইউনুস ৩১)।
এমনিভাবে শত শত আয়াতে মহান আল্লাহ তার একক শ্রেষ্ঠত্ব প্রমান করছেন। যেখানে বান্দা এবং আল্লাহর মাঝে বিরাট পার্থক্য করা হয়েছে। কারন মানুষ হল সৃষ্টি, আর আল্লাহ হলেন তাদের স্রষ্টা। এটাই তাদের মাঝে ষ্পষ্ট আকাশ পাতাল পার্থক্য। এবং একথা সুস্পষ্ট প্রমানিত যে, আল্লাহ তায়ালাই একমাত্র সত্তা, যিনি আদি, এবং অনন্ত। তিনি তন্দ্রাও যান না, যান না নিদ্রাও। সব কিছুই ধ্বংস হবে কিন্তু ধ্বংস হবে না আল্লাহ তায়ালার সত্তা।
আরও পড়ুন প্রবৃত্তির অনুসরণ ও তার পরিনতি
তাহলে কি দাঁড়াল? আল্লাহ তায়ালা ছাড়া সকল সৃষ্টির বিদ্যমানতা নশ্বর অর্থাৎ আল্লাহ্ ছাড়া সবকিছুই একদিন না একদিন ধ্বংস হবে। একমাত্র অবিনশ্বর হলেন মহান রাব্বুল আলামীন। আর পৃথিবীতে যা কিছু আছে এগুলোর অস্তিত্বও আছে কেবল আল্লাহর ইচ্ছায়। তিনি যদি চান তাহলে সবই ধ্বংস হয়ে যাবে। সৃষ্টির নিজ ই্চ্ছায় বেঁচে থাকার কোন ক্ষমতা নেই। কিন্তু আল্লাহ তায়ালা তাঁর অস্তিত্বের জন্য তিনি কারো মুখাপেক্ষী নন। তিনি সর্বেসর্বা। বাকি সবই ধ্বংসশীল।
তাহলে আল্লাহ তায়ালার অস্তিত্বের বিপরীতে বাকি সকল সৃষ্টির অস্তিত্ব নেই। একজন কাফির যখন ইসলাম গ্রহন করে মুসলিম হন তখন তাকে কলেমা পড়ে মুসলিম হতে হয়। যার অর্থ, "আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে আল্লাহ ছাড়া সত্যিকারের কোন উপাস্য (ইবাদার পাওয়ার যোগ্য) নাই আরও সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহাম্মাদ আল্লাহর বান্দা ও রসূল।"
ইসলাম ধর্মের সৌন্দর্য দেখুন, ইসলাম গ্রহনের সময়ই ব্যাপারটি স্পষ্ট করে দেওয়া হয় যে, সৃষ্টি ও স্রষ্টা মাঝে বিশাল পার্থক্য। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মানুষ হযরত মুহাম্মদ সাঃই যদি আল্লাহর সৃষ্ট বান্দা বা দাস হন। তাহলে সাধারণ মানুষের অবস্থা কী হবে? কাজেই অহেদাতুল অজুদে বা সর্বেঈশ্বরবাদের আকিদা কুফরি আকিদা তাতে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই।
হুলুল বা অনুপ্রবেশবাদ
হুলুল বা অনুপ্রবেশ মতবাদটি হলো, আল্লাহ্ কোনো কিছুর মধ্যে প্রবেশ করা। এইক্ষেত্রে অর্থ হলো আল্লাহ্ তাঁর কোনো বান্দার মধ্যে প্রবেশ করা বা ঢুকে যাওয়া। সুফি সুন্নীদের মতে আল্লাহ্ নিরাকার। তাই নিরাকার আল্লাহ্ বান্দার প্রেমে বান্দার মধ্যে প্রবেশ করে নিজেকে প্রকাশ করে।
এই মতবাদের জন্মদাতা হচ্ছেন, সুফি ইবনে আরাবী। যদিও এই আকিদা প্রাচীনকাল থেকে মানুষের মধ্যে প্রচলিত। বিশেষকরে খ্রিস্টানদের আকিদা হলো, আল্লাহ্ ইসা আঃ এর মধ্যে প্রবেশ করে নিজেকে আত্মপ্রকাশ করছেন। সুতরাং ইসা আঃ হলো আল্লাহ।
সুফিদের মতে মানবীয় (বান্দার) দৈহিক সত্তায় ঐশী সত্তার (আল্লাহর) পূর্ণতম প্রকাশই হচ্ছে আল্লাহ্। আল্লাহর দীদার বা দর্শন অশরীরী অবস্থায় সম্ভব নয় এবং রমনী রুপে আল্লাহর বিকাশই সবচেয়ে পূর্ণাঙ্গ প্রকাশ। তাই আল্লাহ্ নিজে প্রকাশিত হতেই বান্দার অস্তিত্বে প্রবেশ করে। তখন বান্দা আর বান্দা থাকে না। হয়ে যায় আল্লাহ্ (নাঊজুবিল্লাহ)।
আরও পড়ুন বর্তমান সমাজের মুনাফিকের পরিচয় ও পরিনতি
এই কথাটি সুফিদের মধ্যে প্রথম বলেছিলেন মুনছুর হাল্লাজ। যা তৎকালীন খ্রিস্টানরা বেশী পছন্দ করেছিল। তাই সুফিবাদীদেরকে এখনো খ্রিস্টানরা সাহায্য সহযোগিতা করে যাচ্ছে। এই হুলুল আকিদা বিশ্বাস করতেন কবি জালালুদ্দীন রুমি। তিনি তার মছনবী কিতাবে মুনছুর হাল্লাজের প্রসংশা করেছেন। অথচ মুনছুর হাল্লাজকে তৎকালীন ইসলামী আদালত হত্যা রায় দিয়েছিল। সুতরাং এই আকিদা কখনোই ইসলামী আকিদা নয়।
যারা তাওহীদপন্থীদের (যারা সুফিবাদ বিরোধী) ওহাবী বা আহলে হাদীস বলে গালি দেন, তাদের জানা উচিত যে তৎকালীন সময়ে কোনো ওহাবী বা আহলে হাদিসের কেউ ছিলো না। তখন ছিলো শুধু শিয়া সুন্নি। সুতরাং এই আকিদা কুফরি আকিদা।
ফানাফিল্লাহ
সুফি সুন্নীদের মতে ফানাফিল্লাহ হলো কোনো বান্দা আল্লাহর প্রেমে ইবাদত করতে করতে আল্লাহর সাথে বিলীন হয়ে যায় তখন তাকে বলা হয় ফানাফিল্লাহ। যার স্বপক্ষে কুরআন হাদিসের কোনো দলিল নেই। আগেই প্রমাণ হয়েছে যে, স্রষ্টা এবং সৃষ্টি দুটি সম্পূর্ণ আলাদা বিষয়। কখনোই স্রষ্টা সৃষ্টিতে পরিনত হতে পারে না। পবিত্র কুরআনে এই ফানাফিল্লাহ সমর্থনে কোনো আয়াত নেই। যেখানে বলা হচ্ছে আল্লাহ্ তাঁর বান্দার মধ্যে প্রবেশ করে বা করতে পারে। অথচ কুরআন হচ্ছে সবচেয়ে সহজ এবং সর্ববিষয়ে তথ্যপ্রদানকারী কিতাব। যেখানে কোনো ত্রুটি বিচ্যুতি নেই। সুতরাং এই ফানাফিল্লাহ আকিদা একটি কুফরি আকিদা।
বাকিবিল্লাহ
সুফি সুন্নীদের মতে কোনো বান্দার ফানাফিল্লাহর পর যখন সে ইবাদতের উচ্চ স্তরে পৌঁছে যায় তখন তার বাকিবিল্লাহ লাভ হয়। অর্থাৎ আল্লাহ্ সেই বান্দার মাঝে স্থায়ী বসবাস করে। তখন আল্লাহ্ আর বান্দার কোনো ফারাক থাকে না। যাদের বাকিবিল্লাহ অর্জন হয় তাদের আর শরীয়তের ইবাদত লাগে না। কুরআনের একটি আয়াতের অপব্যাখ্যা দিয়ে তারা এই দাবি করে।
সুফিরা সুরা হিজরের ৯৯ নং আয়াতের রেফারেন্স দেয়। এই আয়াতে মহান আল্লাহ বলেন, "এবং যে চূড়ান্ত সময়টি (ইয়াকীন) আসা পর্যন্ত নিজের রবের বন্দেগী করে যেতে থাকো৷" (সুরা হিজর-৯৯)
“সুফিবাদিরা এর অনুবাদ করেন, ইয়াকিন আসা পর্যন্ত নিজের রবের বন্দেগী করে যেতে থাকো”৷ তাদের দাবি যখন তারা ফানাফিল্লাহ হওয়ার পর বাকাবিল্লাহ লাভ হরে তখন তাদের ইয়াকিন এসে যায়। এই ইয়াকীন আসার সাথে সাথে তারা আল্লাহ নির্দশমত ইবাদাত ছেড়ে দেয়। নাউজুবিল্লহ।
এখানে যে "ইয়াকীন " এর কথা বলা হচ্ছে তার সঠিক অর্থ হলো মৃত্যু। সকল তাফসীরকারকদের মতে এর সঠিক অনুবাদ হলো মৃত্যু। অর্থাৎ মৃত্যু আসার আগ পর্যন্ত আল্লাহর ইবাদত করে যাও।
আরও পড়ুন সুফিবাদ কী? কীভাবে উৎপত্তি এবং বর্তমান অবস্থা
পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মহামানব রাসুলও সাঃ মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সালাত ছেড়ে দেননি। পৃথিবীতে রাসুলুল্লাহ সাঃ এর চাইতে বড় ইবাদত বন্দেগী আল্লাহ্অলা আর কে হতে পারেন? এটা চিন্তা করলেও তো সুস্পষ্ট বুঝা যায় যে এইসব আকিদা কতটুকু ঈমান ধ্বংসকারী।
মুমিনের কলব আল্লাহর আরশ
সুন্নীদের আরেকটি ভ্রান্ত বিশ্বাস হলো মুমিনের অন্তর হচ্ছে আল্লাহর আরশ। এই নির্জলা মিথ্যা প্রমাণ করতে তারা কয়েকটি হাদিসের দলিল দেয়।
‘‘মুমিনের হৃদয় আল্লাহর আরশ’’,
"বাড়ির পাশে আরশি নগর"
" হৃদয় প্রভুর বাড়ি "
"আমার যমিন এবং আমার আসমান আমাকে ধারণ করতে পারে নি, কিন্তু আমার মুমিন বান্দার কলব বা হৃদয় আমাকে ধারণ করেছে।" ইত্যাদি সবই বানোয়াট হাদীস। কোনো কোনো আলিম বাক্যগুলি তাঁদের গ্রন্থে সনদবিহীনভাবে হাদীস হিসাবে উল্লেখ করেছেন। বিশেষ করে ইমাম গাজ্জালী তার গ্রন্থে সনদবিহীন ভাবে এই জাতীয় হাদীস এনেছেন।
মুহাদ্দিসগণ অনেক গবেষণা করেও এগুলোর কোন সনদ পান নি, বা কোনো হাদীসের গ্রন্থে এগুলোর উল্লেখ পান নি। এগুলি সনদবিহীন জাল কথা। যার রেফারেন্স হচ্ছে, মোল্লা আলী কারী, আল আসরার, ১৭০ ও ২০৬ পৃ। আল-মাসনূয়, ১০০ ও ১৩০ পৃ; যারকানী, মুখতাসারুল মাকাসিদ ১৪৬ ও ১৭১ পৃ; আহমাদ ইবন তাইমিয়া, আহাদীসুল কুসসাস, ৫৩-৫৫ পৃ; সাখাবী, আল-মাকাসিদ আল-হাসানা, ৩১৫ ও ৩৭৪ পৃ; ইবনু আর্রাক, তানযীহ ১/১৪৮।
গবেষণায় জানা যায় এই জাল হাদিসটি (আল মাওযূ‘আত লিস্ সাগানী বা সাগানী প্রণীত জাল হাদীসের সমাহার/ভান্ডার- ১/৫০, তাযকিরাতুল মাউযূ‘আত লিল-মাকদিসী ১/৫০ গ্রন্থে জাল হিসাবে পাওয়া যায়।
আমাদের উচিত হবে যেকোনো হাদীস রেফারেন্স হিসাবে আসলে তা যাচাই বাছাই করা। কেননা হাদিসের যথেষ্ট প্রকারভেদ রয়েছে। সুতরাং সহীহ্ বিশুদ্ধ হাদীস ছাড়া অন্যান্য হাদীস কখনোই গ্রহণযোগ্য নয়।
আরও পড়ুন বিশ্বকাপ ফুটবল এবং আমাদের ঈমান আকিদা
আল্লাহ্কে পেতে মাধ্যম লাগে
সুফিদের আকিদা হচ্ছে, আল্লাহ্কে কোনো বান্দা সরাসরি ডাকলে তিনি সাড়া দেন না। আল্লাহ্কে রাজি খুশি করতে হলে অবশ্যই একটি মাধ্যমের প্রয়োজন আর তা হলো পীর অলি আউলিয়া। সুতরাং যাদেরই আল্লাহর কাছে কিছু চাওয়া পাওয়া থাকে তাহলে তাদের পীর অলি আউলিয়াদের দিয়েই চাইতে হবে। তবেই আল্লাহ্ তাদের ডাকে সাড়া দিবেন।
সুফি সুন্নীদের যুক্তি হলো, একজন রাজার কাছে কখনোই একজন প্রজা সরাসরি দেখা করতে পারে না কোনো না কোনো একজন মন্ত্রী এমপি ছাড়া। যেসব মন্ত্রী এমপি ঐ রাজার প্রিয় সেইসব মন্ত্রী এমপির সুপারিশও রাজা গ্রহণ করেন। অতএব আল্লাহ্ হচ্ছেন মহান রাজা আর অলি আউলিয়ারা হচ্ছেন আল্লাহর প্রিয়। সুতরাং যেকেউ আল্লাহর কাছে যেতে হলে এইসব অলি আউলিয়াদের মাধ্যমেই যেতে হবে। তাহলেই আল্লাহ্ সেইসব বান্দাদের শুনবেন দেখবেন এবং মনের বাসনা পূরণ করবেন।
সুন্নীদের এইসব যুক্তি যে কত জঘন্য তা তারা নিজেরাও কল্পনা করে না। দুনিয়ার একজন রাজা তার প্রজা সম্পর্কে কোনো জ্ঞান রাখে না। সে জানে না তার প্রজার কী দুঃখ দূর্দশা বা তার কী প্রয়োজন। সেইসাথে একজন প্রজাও সরাসরি তাকে কিছু বললে সে শুনবে এমন কোনো ক্ষমতাও রাজার নেই। তাই রাজা এবং বান্দার যোগাযোগ করিয়ে দেওয়ার জন্য মাধ্যম হিসাবে মন্ত্রী এমপির প্রয়োজন।
শুধু তাই নয়, একজন প্রজা সরাসরি কোনো রাজার সাথে দেখা করতে চাইলেও রাজা পরিচিত কেউ ছাড়া ঐ অপরিচিত প্রজার সাথে দেখা দেন না। কারণ রাজা জানে না যে ঐ প্রজাটি আসলেই ভালো নাকি খারাপ? অর্থাৎ দেখা সাক্ষাৎ হলে ঐ প্রজা রাজার কোনো প্রকার ক্ষতি করতে পারে কিনা সেই বিষয়ে রাজা কিছুই জানে না। সুতরাং প্রজাটি দুনিয়ায় পরিচিত কোনো মাধ্যম বা ব্যক্তি ছাড়া কখনোই রাজা পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে না।
অথচ আল্লাহ্ সবকিছুর উর্ধ্বে। আল্লাহ্ তাঁর বান্দার কথা সরাসরি শুনেন এবং জানেন। তিনি দেখেন তাঁর বান্দাদের কার কী অবস্থা। যখনই তাঁর বান্দারা তাঁকে ডাকে তিনি তখনই সরাসরি সাড়া দেন। তিনি সমগ্র সৃষ্টির যাবতীয় ক্ষমতার অধিকারী। সুতরাং তাঁর বান্দাদের ডাক শোনার জন্য আল্লাহর কখনোই কোনো মাধ্যমের প্রয়োজন হয়না।
আরও পড়ুন ঈমান কী? পরিপূর্ণ ঈমানের বিস্তারিত ব্যাখ্যা
আল্লাহ্ সম্পর্কে সুফিদের মনগড়া কথা এবং জ্ঞান না থাকার কারণে এমন শির্কি কুফুরি আকিদা পোষণ করে। অথচ আল্লাহ্ পবিত্র কুরআনে সুস্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছেন তাঁর ক্ষমতা সম্পর্কে। আল্লাহ্ বলেন, "যখন আমার বান্দাগণ আমার সম্বন্ধে তোমাকে জিজ্ঞাসা করে, আমি তো প্রকৃতই [তাদের] অতি নিকটে। যখন আহবানকারী আমাকে ডাকে, আমি প্রত্যেক আহবানকারীর আহবানে সাড়া দেই। সুতরাং তারাও আমার ডাকে সাড়া দিক এবং আমার প্রতি ঈমান আনুক, যাতে তারা সঠিক পথে চলতে পারে।" (বাকারা ২:১৮৬)
উপরোক্ত আয়াতে আল্লাহ্ সুস্পষ্ট করেই বলে দিয়েছেন যে, আল্লাহ্ প্রতিটি বান্দার অতি নিকটে। শুধু তাইনয় যেকেউ আল্লাহ্কে ডাকলে তিনি অবশ্যই তার ডাকে সাড়া দেন। আর তখনই তিনি বান্দার ডাকে সাড়া দেন, যখনই কোনো বান্দা পরিপূর্ণ ঈমান এনে আল্লাহ্কে ডাকে।
সুতরাং যে ব্যক্তি পরিপূর্ণ ঈমান এনে রাসুলুল্লাহ সাঃএর প্রদর্শিত পথে চলে আল্লাহ্কে ডাকবে তাকে অবশ্যই আল্লাহ্ সাহায্য সহযোগিতা উদ্ধার সবই করবেন। অতএব এখানে আল্লাহ্কে পেতে তৃতীয় কোনো মাধ্যমের প্রয়োজন নেই।
সুফিরা সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করার জন্য সূরা মায়েদার ৩৫ নং আয়াতের উদাহরণ দেন। যা আরেকটি জালিয়াতির প্রমাণ। যে আয়াতকে তারা মাধ্যম তথা পীর আউলিয়াকে ধরার জন্য পেশ করে। আল্লাহ্ বলেন, "হে ঈমানদারগণ তোমরা আল্লাহকে ভয় করো এবং তার কাছে অসীলা (পূর্ণ আনুগত্যের মাধ্যমে নৈকট্য) অন্বেষণ কর আর তার রাস্তায় জিহাদ কর যাতে করে তোমরা সফলকাম হতে পার"। (সূরা আল-মায়িদাহ্ ৫:৩৫)।
এখানে যে ওয়াসীলার কথা বলা হচ্ছে, তা হচ্ছে নৈকট্য লাভের উপায়। অর্থাৎ আল্লাহ্ বলছেন তোমরা আল্লাহর নৈকট্য লাভ করার জন্য কোনো না কোনো উপায় বের করো। যার দ্বারা তোমরা আল্লাহ্কে সন্তুষ্ট করতে পারো। তথা তোমরা আল্লাহর সন্তুষ্টি নিয়ে সফলকাম অর্থাৎ জান্নাত হাসিল করতে পারো।
আরও পড়ুন শিরক কী? মানুষ কীভাবে শিরক করে
উপরোক্ত আয়াতে আল্লাহ্ নিজেই বলে দিচ্ছেন যে, জিহাদ হলো এমন একটি উছিলা তথা উপায়, যা দ্বারা তোমরা আল্লাহর সন্তুষ্টি পেয়ে জান্নাত পেতে পারো। সুতরাং উছিলা বলতে কী হবে তা আল্লাহ্ নিজেই নির্ধারণ করে দিয়েছেন।
অর্থাৎ তা হবে এমন একটি উপায় যে উপায়ে বান্দারা আল্লাহর নৈকট্য লাভ করতে পারবে। এই আয়াতের ব্যাখ্যায় রাসুলুল্লাহসহ সাহাবী তাবেয়ী ইত্যাদি থেকে প্রমাণিত যে, উছিলা হচ্ছে ঈমান এবং নেক আমল। যে আমলের দ্বারা আল্লাহ্ তাঁর বান্দার উপর সন্তুষ্ট হবে। সেই আমলের দিকে তাকিয়ে আল্লাহ্ তাঁর বান্দার প্রতি রহমত বর্ষণ করবেন।
সুতরাং উছিলা দ্বারা কখনোই পীর সাব্যস্ত হয় না। এই শিক্ষা সালফে সালেহীন থেকে প্রমাণিত নয়। কেননা উছিলা অর্থ যদি পীর বা অলি আউলিয়া ধরা হয় তাহলে তা সম্পূর্ণ ঈমান বিধ্বংসী কথা।
কেননা যারা নেককার বান্দাদেরকে অসীলা হিসাবে গ্রহন করে তাদেরকে আল্লাহ তায়ালা পরিহাস করছেন। কারন তারা যে সকল নেককার বান্দাদেরকে অসীলা বানাচ্ছে তারা (সেই সকল নেককার বান্দারা) নিজেরাই অসীলা তথা আল্লাহর নৈকট্য হাসিলের উপায় তালাস করছে। আল্লাহ তা'আলা পবিত্র কুরআনে বলেন, "এরা যাদেরকে ডাকে তারা তো নিজেরাই নিজেদের রবের নৈকট্যলাভের উপায় (ওয়াসীলাহ্) খুঁজে বেড়াচ্ছে যে, কে তাঁর নিকটতর হয়ে যাবে এবং এরা তাঁর রহমতের প্রত্যাশী এবং তাঁর শাস্তির ভয়ে ভীত৷আসলে তোমার রবের শাস্তি ভয় করার মতো৷" (সূরা আল-ইসরা ৪১:৫৭)
উপরোক্ত আয়াত দ্বারা এটা সুস্পষ্ট যে, উছিলা কখনোই কোনো পীর অলি আউলিয়া হতে পারে না। কেননা সুফিরা যাদের উছিলা মনে করে সাহায্য চায়, তারা (নেককার বান্দারা) নিজেরাই আল্লাহর কাছে প্রিয় হওয়ার জন্য উছিলা তথা উপায় অন্বেষণ করছে।
আরও পড়ুন সুফিবাদী সুন্নীদের আকিদা সমূহ
সুফিদের বিশ্বাস হচ্ছে, বিপদে আপদে আল্লাহর চাইতে অলি আউলিয়ারাই হচ্ছেন বেশী সাহায্যকারী। তাই তারা আল্লাহর কাছে কিছু না চেয়ে অলি আউলিয়াদের কাছে বা কবরে গিয়ে প্রার্থনা করে। তাদের বিশ্বাস সরাসরি আল্লাহ্কে ডাকলে আল্লাহ্ কখনোই সাড়া দিবেন না। আল্লাহ্কে ডাকতে হলে অবশ্যই মাধ্যমের তথা আল্লাহর অলির প্রয়োজন হবে। অথচ আল্লাহ তা'আলা বলেন, “আর মু'মিনদের সাহায্য করা আমার দায়িত্ব" (সূরা আর-রূম ৩০:৪৭)
আল্লাহ তা'আলা আরও বলেন, "হে ঈমান গ্রহণকারীগণ, তোমরা আল্লাহকে সাহায্য করো তাহলে আল্লাহও তোমাদেরকে সাহায্য করবেন এবং তোমাদের পা সুদৃঢ় করে দিবেন৷" (সূরা মুহাম্মাদ ৪৭:৭)
আল্লাহ্ নিজেই যেখানে ঘোষণা দিচ্ছেন মুমিনদের সাহায্য করা আল্লাহর দায়িত্ব, সেখানে সুফিরা দাবি করছে আল্লাহর কাছে চাইতে হলে মাধ্যম লাগবে। এই ভ্রান্ত আকিদা পোষণ করে সুফিবাদীরা আল্লাহর উপর ভরসা না করে নেক আমল করা ছেড়ে দিয়েছে। অথচ আল্লাহ্ তাঁর রাসুল সাঃকে সম্বোধন করে বলেছেন, "হে মুহাম্মাদ ! তাদেরকে বলো,নিজের জন্য লাভ -ক্ষতির কোন ইখতিয়ার আমার নেই৷ একমাত্র আল্লাহই যা কিছু চান তাই হয়৷ আর যদি আমি গায়েবের খবর জানতাম, তাহলে নিজের জন্যে অনেক ফায়দা হাসিল করতে পারতাম এবং কখনো আমার কোন ক্ষতি হতো না৷ ১৪৫ আমি তো যারা আমার কথা মেনে নেয় তাদের জন্য নিছক একজন সতর্ককারী ও সুসংবাদদাতা মাত্র৷" (সূরা আল-আ’রাফ ৮:১৮৮)
যেখানে রাসুলুল্লাহ তাঁর নিজের কল্যাণের জন্য আল্লাহ্ মুখাপেক্ষী সেখানে সাধারণ মানুষের অবস্থা কী হবে সেটাই চিন্তা করা দরকার।
সুতারং আল্লাহ নৈকট্য লভের প্রধান উপকরন হল ঈমান ও কুরআন সুন্নাহ ভিত্তিক নেক আমল। যদি সুফিদের মতো উছিলা অর্থ কোনো নেককার বান্দা মনে করি তাহলে তা হবে মারাত্মক ভুল।
আমরা যদি একটু লক্ষ্য করি, ইউসুফ (আ:) –এর পিতা ইয়াকুব (আ:)। ইয়াকুব (আ:) –এর পিতা ইছহাক (আ:)। ইছহাক (আ:) –এর পিতা ইব্রাহীম (আ:)। এই চার জন জলিল কদর নবী একত্রে মিলে কি তাদের পূর্বপুরুষ ইব্রাহীম (আ:) –এর পিতা আজর কে জান্নাতে নিতে পারবেন? নিশ্চয়ই না।
রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর চাচা, আলীর (রাঃ) বাবা, ফাতিমার (রাঃ) শশুর, হাসান হোসেনের (রাঃ) দাদা, আবু তালিবকে, কি সকলে মিলেও জান্নাতের জন্য সুপারিশকরতে পারবেন? এর উত্তর খুবই সহজ। অর্থাৎ না।
এবার আমাদের চিন্তা করা উচিত যেখানে নবী রাসুলগণ এবং জান্নাতের সার্টিফিকেট প্রাপ্ত সাহাবীগণও কাউকে জান্নাতের জন্য সুপারিশ করতে পারবেন না। সেখানে পীর অলি আউলিয়ারা কীভাবে একজন মানুষকে নিশ্চিন্তে নিশ্চিতভাবে জান্নাতে পৌঁছে দিবেন?
আরও পড়ুন কুরআনের আলোকে মানুষ সৃষ্টির কারণ
আল্লাহর রাসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর কলিজার টুকরা কন্যাকে সম্বোধন করে বলেছেনঃ "হে ফাতিমা! আমার কাছে যত সম্পদ আছে তার থেকে যা ইচ্ছা হয় চেয়ে নাও, আমি আল্লাহর কাছে তোমার কোন কাজে আসবনা। "(বুখারী ও মুসলিম)
তবে হ্যা, ঈমান এনে কুরআন সুন্নাহ মোতাবেক জীবন যাপন করলে অবশ্যই আল্লাহর সন্তুষ্টি পাওয়া যাবে। এরপর চলার পথে ভুলত্রুটি হওয়া স্বাভাবিক ব্যপার। এই পাপগুলি আল্লাহর একান্ত ইচ্ছা মাপ করা বা না করা। এখানেই সুপারিশ দরকার। তখনই নবী রাসুলগন, কুরআন, সাওম, নেক বান্দাসহ অন্যান্যদের সুপারিশ গ্রহন করা হবে, যাদের কথা সহিহ হাদিস সমুহে উল্লেখ আছে। আল্লাহ তা'আলা বলেন, "বলুন: আমি কি তোমাদেরকে আমলের দিক থেকে সবচেয়ে বেশী ক্ষতিগ্রস্তদের সংবাদ দেব? (তারা হলো ঐ সব লোক) যাদের দুনিয়ার জীবনের সমস্ত প্রচেষ্টা পন্ড হয়ে গেছে, অথচ তারা মনে করত কত সুন্দর কাজই না তারা করছে, তারাই সে সব লোক যারা তাদের রবের আয়াতসমূহ ও তার সাথে সাক্ষাৎকে অস্বীকার করেছে, ফলে তাদের সমস্ত আমল বিনষ্ট হয়ে গেছে, সুতরাং কিয়ামতের দিন তাদের জন্য কোন ওজন স্থাপন করবোনা।" (সূরা আল-কাহ্ফ: ১০৩-১০৫)
পবিত্র কুরআন থেকে আমরা সুস্পষ্ট বুঝতে পারলাম আল্লাহ্কে পেতে কখনোই কোনো মাধ্যম লাগে না। সঠিক ইসলামী আকিদা না মেনে যদি কেউ ভ্রান্ত আকিদায় জীবনযাপন করে, তাহলে সে কখনোই সফলকাম হবেনা। সুফিরা তাদের পীর আউলিয়াদের সুপারিশ নিয়ে জান্নাতে যাওয়ার স্বপ্ন দেখে। অথচ সকল সুপারিশের ক্ষমতা একমাত্র একক আল্লাহর হাতে (সূরা বাকারা ১৫৫)। সেইসাথে আল্লাহ্ তাঁর বান্দার সকল গুনাহ চাইলেই ক্ষমা করে দিতে পারেন বা ক্ষমা করিয়ে নিতে পারেন। কিন্তু শির্কের গুনাহ কখনোই তিনি ক্ষমা করবেন না সুস্পষ্ট ঘোষণা (সূরা নিসা ৪৮)।
দুনিয়ায় বসে আল্লাহ্কে দেখা
সুফিদের মতে দুনিয়ায় বসেই আল্লাহ্কে স্বচক্ষে দেখা যাবে। অথচ আল্লাহ্ হযরত মুছা আঃকেও দেখা দেননি। আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন, "অতপর মূসা যখন আমার নির্ধারিত সময়ে উপস্থিত হলো এবং তার রব তার সাথে কথা বললেন তখন সে আকূল আবেদন জানালো, হে প্রভু! আমাকে দর্শনের শক্তি দাও, আমি তোমাকে দেখবো৷ তিনি বললেনঃ তুমি আমাকে দেখতেপারো না৷ হাঁ সামনের পাহাড়ের দিকে তাকাও৷ সেটি যদি নিজের জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকতে পারে তাহলে অবশ্যি তুমি আমাকে দেখতে পাবে৷ কাজেই তার রব যখন পাহাড়ে জ্যোতি প্রকাশ করলেন, তখন তা তাকে চূর্ণ বিচূর্ণ করে দিল এবং মূসা সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়ে গেলো৷ সংজ্ঞা ফিরে পেয়ে মূসা বললো, পাক-পবিত্র তোমার সত্তা৷ আমি তোমার কাছে তাওবা করছি এবং আমিই সর্বপ্রথম মুমিন"৷ (সূরা: আল-‘আরাফ ৭:১৪৩)
উপরোক্ত আয়াত দ্বারা সুস্পষ্ট যে, একজন মর্যাদাশীল রাসুল যখন আল্লাহ্কে দেখতে চেয়েও দেখতে পাননি তাঁর সীমাবদ্ধতার কারণে। সেখানে একজন অঘোষিত অলি আউলিয়া বা তাদের ভক্ত মুরিদ কীভাবে দুনিয়ায় থেকেই আল্লাহ্কে দেখতে পাবে? আল্লাহ্ পবিত্র কুরআনের স্পষ্ট করে বলেন, “মানুষের এমন মর্যাদা নাই যে, আল্লাহ তার সাথে কথা বলবেন ওহীর মাধ্যম ব্যতিরেকে অথবা পর্দার অন্তরাল ব্যতিরেকে অথবা এমন দূত প্রেরণ ব্যতিরেকে যে তাঁর অনুমতিক্রমে তিনি যা চান তা ব্যক্ত করেন, তিনি সর্বোচ্চ ও প্রজ্ঞাময়।" (সূরা আশ-শূরা ২৬:৫১)
আরও পড়ুন তাওহিদ কী কীভাবে আল্লাহর তাওহিদ ক্ষুন্ন হয়
উপরোক্ত সুস্পষ্ট আয়াতের নির্দেশনার আলোকে বলা যায় সুফিগণ ব্যতিত মুসলিম উম্মাহর সকলে একমত যে, পৃথিবীতে কেউ আল্লাহকে দেখতে পারে না। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে একটি সহীহ হাদীসও বর্ণিত হয় নি, যাতে তিনি বলেছেন ‘আমি জাগ্রত অবস্থায় পৃথিবীতে বা মি’রাজে চর্ম চক্ষে আল্লাহকে দেখেছি। কাজেই সুফিদের কর্তৃক আল্লাহর দিদার লাভ বা আল্লাহ দেখতে চাওয়া বিশাল মিথ্যা রচনা। যার স্বপক্ষে কুরআন হাদিসের কোনো দলিল নেই।
কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ
মোহাম্মাদ ইস্রাফিল হোসাইন। (বিএ ইন আরবি সাহিত্য ও ইসলাম শিক্ষা)
সাখাওয়াতুল আলম চৌধুরী
২০ নভেম্বর ২০২১
পতেঙ্গা, চট্টগ্রাম।