মাজারে দান সদকা করার ইসলামী বিধান
ভারতীয় উপমহাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানরা মাজারে প্রচুর পরিমাণ দান সদকা করে থাকে। বিভিন্ন নিয়তে নিজেদের মনের আশা পূরণের জন্য হিন্দু মুসলিমসহ অন্যান্য ধর্মাবলম্বীরা মাজারে টাকা দিয়ে থাকে। বেশিরভাগ মুসলমান মানত করে মাজারে টাকা দিয়ে থাকেন। এইযে অধিকাংশ মুসলমান মাজারে মানত করে দান সদকা করে, এই দান ইসলামী দৃষ্টিতে কতটুকু সঠিক তা আমরা আজ জানার চেষ্টা করবো।
মানত কীঃ
প্রথমেই আমাদের জানা উচিত, মানত কী? মানত হচ্ছে সৃষ্টিকর্তা কিংবা কারো নিকটে নিজেদের উদ্দেশ্য পূরণের উদ্দেশ্যে কোনো দৈহিক ইবাদত বা টাকা পয়সা, পশু ইত্যাদি দান করার নিয়ত করা। মোটকথা নিজেদের বিপদে আপদে উদ্ধার কিংবা ভবিষ্যৎ কোনো উদ্দেশ্য পূরণ ইত্যাদির জন্য অর্থ সম্পদ দান করা কিংবা কোনো ইবাদতের নিয়ত করাই হচ্ছে সহজ কথায় মানত।
ইসলামে মানতের বিধানঃ
মানতের বিযয়টি সুদীর্ঘকাল থেকেই পৃথিবীতে প্রচলিত। ইসলাম আসার আগ থেকেই মানতের প্রচলন। শুধুমাত্র আল্লাহর উদ্দেশ্যে যেকোনো ইবাদত, দৈহিক ইবাদত বা দান সদকা ইত্যাদি মানত করা জায়েজ। এবং মানত করলে তা অবশ্যই পূরণ করা ফরজ।
কিন্তু রাসুল সাঃ মানত করতে নিষেধ করছেন। ইসলামের শিক্ষা নয় মানত করা। কারণ মানতের ইতিহাস প্রাচীন। ইসলামের অনেক আগে থেকেই মানুষ আল্লাহ্ এবং অন্যান্য উপাস্যের উদ্দেশ্যে মানত করতো। অথচ মানত জায়েজ শুধুমাত্র আল্লাহর উদ্দেশ্যে। কিন্তু শয়তানের প্ররোচনায় মানুষ আল্লাহ্ ছেড়ে অন্যান্য কৃত্রিম উপাস্যদের অর্থাৎ দেবদেবী কিংবা নবী রাসুল বা বড় বুজুর্গদের উদ্দেশ্যে মানত করতে শুরু করে।
তাই ইসলাম আসার পর যারা অতীতে মানত করেছিল তাদের মানত পূরণের জন্য আল্লাহ্ তাগিদ দেয়। আল্লাহ্ বলেন,
"এরপর তারা যেন দৈহিক ময়লা দূর করে দেয়, তাদের মানত পূর্ণ করে এবং এই সুসংরক্ষিত গৃহের তাওয়াফ করে।"(সূরাঃ হাজ্জ্ব, আয়াতঃ ২৯)
সুতরাং আল্লাহর উদ্দেশ্যে, বিশেষ করে দৈহিক ইবাদত যেমনঃ সালাত, সওম ইত্যাদির মানত করা জায়েজ। তবে আল্লাহ্ ব্যতীত অন্য কাউকে সন্তুষ্ট করার জন্য মানত করা সরাসরি শির্ক। মানতের ব্যাপারে রাসুলুল্লাহর সরাসরি নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। হাদীসে এসেছে,
আব্দুল্লাহ ইবনে উমার রাঃ থেকে বর্ণিত, তিনি বলেছেন: "রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একদিন আমাদের মানত করতে নিষেধ করেছেন। আর বলেছেন: মানত কোনো কিছুকে ফেরাতে পারে না। তবে মানতের মাধ্যমে কৃপণ ব্যক্তির সম্পদ বের করা হয়।" (সহিহ মুসলিম, হাদীস নং ৪৩২৫
আবূ হুরায়রা (রাঃ) সূত্রে নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) থেকে বর্ণিতঃ
তিনি বলেছেনঃ মানত আদম সন্তানকে এমন কিছু এনে দিতে পারে না যা তাকদীরে নির্ধারিত নেই অথচ সে যে মানতটি করে তাও আমি তাকদীরে নির্ধারিত করে দিয়েছি যাতে এর মাধ্যমে কৃপণের নিকট হতে (অর্থ সম্পদ) বের করে নিই। [সহিহ বুখারী, হাদিস নং ৬৬০৯, ৬৬৯৪; মুসলিম ২৬/২, হাঃ ১৬৪০, আহমাদ ৯৩৫১] (আধুনিক প্রকাশনী- ৬১৪৮, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৬১৫৬)
উপরোক্ত হাদিস থেকে শিক্ষা হচ্ছে, মানত করা কখনোই জরুরী কিছু নয়। কারণ মানত বিষয়টি শর্তযুক্ত। মানতের মাধ্যমে বান্দা একপ্রকার আল্লাহর সাথে বিনিময়ের শর্ত যুক্ত করে দেয়। যেমনঃ যদি আমার এই লাভ হয় তাহলে আমি এই টাকাটা দান করবো। তাহলে ঐ কাজ না হলে টাকা দান করবো না। সুতরাং টাকা পাওয়ার জন্য আল্লাহ্ অবশ্যই আমার ঐ কাজ করে দিবেন! (নাঊজুবিল্লাহ)
মানতের মূল কথা কিন্তু এটাই। আমার লাভের জন্য আল্লাহর সাথে একটা ব্যবসায়িক ডিল! হে আল্লাহ্ তুমি আমাকে এটা দাও, আমি তোমাকে ওটা দিব! নাঊজুবিল্লাহ। যে বিষয়টা শুনতেই দৃষ্টিকটু, সেই বিষয়টা পালন করা কতটুকু যুক্তিগত।
যারকারণে রাসুলুল্লাহ সাঃ মানত নিষিদ্ধ এবং নিরুৎসাহিত করেছেন। কেননা মানত দ্বারা কখনোই কারো তাকদীর বিন্দু পরিমাণও পরিবর্তন হতে পারে না। তারপরও ইসলাম মানত না জায়েজ করেননি। এর কারণ মানুষ যাতে আল্লাহর শুকরিয়া স্বরুপ কিছু ইবাদত এবং দান সদকা দ্বারা নিজেদের আমল বৃদ্ধি করতে পারে এই উদ্দেশ্যে।
মানত কি তাকদীর পরিবর্তন করে?
মানুষের তাকদীরে কী আছে কী নেই তা একমাত্র আল্লাহ্ ছাড়া কেউ জানেনা। তিনি সৃষ্টির আগেই তাকদীর লিপিবদ্ধ করে রেখেছেন। অথচ মানতের প্রধান উদ্দেশ্যে হচ্ছে তাকদীর পরিবর্তন করা। অর্থাৎ মানুষ নিজের ভালো মন্দ পরিবর্তনের জন্যই মানত করে। যেমনঃ সন্তান কামনা, বিপদে উদ্ধার, আয় উন্নতি ইত্যাদি। অথচ আগের উল্লেখিত হাদিস অনুযায়ী রাসুলের শিক্ষা হচ্ছে মানত কখনোই কারো তাকদীর পরিবর্তন করে না। যার তাকদীরে যাই লেখা আছে তাই তার সাথে হবে। সুতরাং মানত কখনোই তাকদীর পরিবর্তনকারী নয়
কীসে তাকদীর পরিবর্তন হয়?
কোনো মানুষের তাকদীর হচ্ছে, যা তার জীবনে জীবনে অবশ্যই ঘটবে তার একটি দিকনির্দেশনা। যা একমাত্র আল্লাহ্ ছাড়া কেউ জানে না। যদিও তাকদীর অপরিবর্তনীয়। তবুও তাকদীর পরিবর্তনে কিছু উপায় অবলম্বন অবশ্যই আছে।
তাকদীর হচ্ছে দুই ধরনের। একঃ মুবরাম বা স্থিরীকৃত। দুইঃ মুআল্লাক বা পরিবর্তনশীল। অর্থাৎ মানুষের কিছু বিষয় রয়েছে যা স্থির। যা কখনোই পরিবর্তন হবেনা। আর কিছু বিষয় রয়েছে যা শর্তযুক্ত পরিবর্তনশীল। তাকদীর সম্পর্কে আল্লাহ্ বলেন,
" ছোট ও বড় সবই লিপিবদ্ধ। "(সূরাঃ আল ক্বামার, আয়াতঃ ৫৩)
"পৃথিবীতে এবং ব্যক্তিগতভাবে তোমাদের উপর কোন বিপদ আসে না; কিন্তু তা জগত সৃষ্টির পূর্বেই কিতাবে লিপিবদ্ধ আছে"। (সূরাঃ আল হাদীদ, আয়াতঃ ২২)
উপরোক্ত আয়াত দ্বারা এটা প্রমাণিত যে, তাকদীর অনেক আগে থেকেই লৌহে মাহফুজে লিপিবদ্ধ আছে। এবং যেকোনো বিপদ আপদ অবশ্যই আসবে তাও লিপিবদ্ধ। তবে শর্তসাপেক্ষ কিছু বিষয় হাদীসে এসেছে। যা দ্বারা মানুষের পরিবর্তনশীল তাকদীর তথা মুআল্লাক তাকদীর পরিবর্তন করা যায়। যেমন হাদীসে এসেছে,
সালমান (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ দু’আ ব্যতীত অন্য কোন কিছুই ভাগ্যের পরিবর্তন করতে পারে না এবং সৎকাজ ব্যতীত অন্য কোন কিছুই হায়াত বাড়াতে পারে না।(হাসান, সহীহাহ (১৫৪) জামে' আত-তিরমিজি, হাদিস নং ২১৩৯)
একটি দুর্বল হাদীসে এসেছে, সাওবান(রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ সৎকর্ম ব্যাতীত অন্য কিছু আয়ুস্কাল বাড়াতে পারে না এবং দুআ’ ব্যতীত অন্য কিছুতে তাকদীর রদ হয় না। মানুষ তার পাপকাজের দরুন তার প্রাপ্য রিযিক থেকে বঞ্চিত হয়। হাদীসটি ইমাম ইবনু মাজাহ এককভাবে বর্ণনা করেছেন। সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস নং ৪০২২
উপরোক্ত হাদিস থেকে এটা সুস্পষ্ট যে, দোয়া ছাড়া কারোরই তাকদীর পরিবর্তন হয় না। এই দোয়া হতে পারে মা বাবার, বা কোনো নেককার আবেদী বান্দার। দোয়া ছাড়া সৎকাজের আমলের মাধ্যমেও তাকদীর পরিবর্তন হতে পারে এবং হায়াৎও বৃদ্ধি হতে পারে। মন্দ কাজের দ্বারা রিজিকও কমতে পারে। এছাড়াও অন্য হাদীসে এসেছে,
আনাস ইবনু মালিক (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ দান-খাইরাত আল্লাহ তা'আলার অসন্তুষ্টি কমিয়ে দেয় এবং অপমানজনক মৃত্যু রোধ করে। (জামে' আত-তিরমিজি, হাদিস নং ৬৬৪)
আবু সাঈদ (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন “গোপনে দান প্রতিপালকের ক্রোধ দূরীভূত করে, জ্ঞাতি-বন্ধন অক্ষুন্ন রাখে, আয়ু বৃদ্ধি করে। আর পুণ্যকর্ম সর্বপ্রকার কুমরণ থেকে রক্ষা করে।” (বাইহাক্বীর শুআবুল ঈমান ৩৪৪২, সহীহুল জামে ৩৭৬০, হাদিস সম্ভার, হাদিস নং ৯৭৯)
অর্থাৎ দান সদকা দ্বারা আল্লাহর ক্রোধ বা রাগ থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। যদি তাকদীরে খারাপ মৃত্যু, দুঃখ কষ্ট, বিপদ আপদ ইত্যাদি লেখা থাকে তাহলে দান সদকা সেইসব দুঃখ কষ্ট থেকে মানুষকে রক্ষা করে। সুতরাং দান দ্বারা মানুষের তাকদিরের পরিবর্তন হয়।
অতএব, মানতের দান দ্বারা তাকদীর পরিবর্তনের কোনো সুযোগ নেই। কেউ নিঃশর্তভাবে দান করলে তবেই তার থেকে সুফল পেতে পারে।
মানত যখন হারাম / শির্কঃ
যদিও রাসুলুল্লাহ মানত করা পছন্দ করতেন না। তবুও ইসলাম মানত করা নিষিদ্ধ করেনি। কিন্তু আল্লাহ্ ছাড়া অন্য কারো উদ্দেশ্যে বা অন্য কারো সন্তুষ্টির জন্য মানত করা সরাসরি শির্ক। তাই আল্লাহ্ ছাড়া কারো জন্য মানত করা হারাম।
উপমহাদেশে সুফি সুন্নীরা মাজারের উদ্দেশ্যে যিয়ারত এবং মানত করে থাকে। যা কখনোই শরীয়তসম্মত নয়। কেননা একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য কোনো কিছুর মানত করা জায়েজ। ইসলামের ইতিহাসে তৎকালীন মানত ছিলো দৈহিক ইবাদত নির্ভর। অর্থাৎ মানুষ কোনো ভালো উদ্দেশ্য পূরণের জন্য সালাত সিয়াম ইত্যাদি পালনের মানত করতো।
কিন্তু সুফিবাদীরা নিজেদের লাভের জন্য মানতকে অর্থের মানদন্ডে রূপান্তরিত করে এবং আল্লাহ্ ব্যতীত কবরে শায়িত অলি আউলিয়াদের দিকে ফিরিয়ে দেয়। যারফলে সাধারণ মানুষ আল্লাহর জন্য বা আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য দৈহিক ইবাদত মানত করা ছেড়ে দিয়ে, তাদের কথিত অলি আউলিয়াদের কবরে মাজারে টাকা পয়সা, অর্থ সম্পদ পশু ইত্যাদি মানত করা শুরু করে। যারফলে মানতের আসল উদ্দেশ্য ব্যহত হয়।
এরফলে আল্লাহ্কে ছেড়ে কবরে শায়িত ব্যক্তির সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে মানতের কারণে সুফিরা সুস্পষ্ট শির্কে লিপ্ত হচ্ছে। যা কখনোই ইসলামী শরিয়তে জায়েজ নয়। আল্লাহ্ বলেন,
"যখন লোকমান উপদেশচ্ছলে তার পুত্রকে বললঃ হে বৎস, আল্লাহর সাথে শরীক করো না। নিশ্চয় আল্লাহর সাথে শরীক করা মহা অন্যায়"। (সূরাঃ লোকমান, আয়াতঃ ১৩)
" নিঃসন্দেহে আল্লাহ তাকে ক্ষমা করেন না, যে লোক তাঁর সাথে শরীক করে। তিনি ক্ষমা করেন এর নিম্ন পর্যায়ের পাপ, যার জন্য তিনি ইচ্ছা করেন। আর যে লোক অংশীদার সাব্যস্ত করল আল্লাহর সাথে, সে যেন অপবাদ আরোপ করল।"(সূরাঃ আন নিসা, আয়াতঃ ৪৮)
পবিত্র কুরআনে আল্লাহ্ খুবই স্পষ্ট এবং সরাসরিই উল্লেখ করেছেন যে, কখনোই কোনো অবস্থাতেই শির্ক করা যাবে না। কেননা শির্ক হচ্ছে সবচেয়ে বড় গুনাহ। যার কোনো ক্ষমা নেই আখিরাতে। সুতরাং দুনিয়াবী বিভিন্ন উদ্দেশ্য পূরণের লক্ষ্যে আল্লাহ্কে ছেড়ে সুফি সুন্নীরা তাদের যেসব অলি আউলিয়াদের নামে মানত করে টাকা পয়সা ইত্যাদি দেয়, তা সরাসরি আল্লাহর সাথে শির্ক। অথচ রাসুলের শিক্ষা হচ্ছে,
ইবনু আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
আমি একদা (সওয়ারীর উপর) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পিছনে (বসে) ছিলাম। তিনি বললেন, ‘‘ওহে কিশোর! আমি তোমাকে কয়েকটি (গুরুত্বপূর্ণ কথা শিক্ষা দেব (তুমি সেগুলো স্মরণ রেখো)। তুমি আল্লাহর(বিধানসমূহের) রক্ষণাবেক্ষণ কর (তাহলে) আল্লাহও তোমার রক্ষণাবেক্ষণ করবেন। তুমি আল্লাহর(অধিকারসমূহের)স্মরণ রাখো, তাহলে তুমি তাঁকে তোমার সম্মুখে পাবে। যখন তুমি চাইবে, তখন আল্লাহর কাছেই চাও। আর যখন তুমি প্রার্থনা করবে, তখন একমাত্র আল্লাহর কাছেই সাহায্য প্রার্থনা কর। আর এ কথা জেনে রাখ যে, যদি সমগ্র উম্মত তোমার উপকার করার জন্য একত্রিত হয়ে যায়, তবে ততটুকুই উপকার করতে পারবে, যতটুকু আল্লাহ তোমার (তাকদীরে) লিখে রেখেছেন। আর তারা যদি তোমার ক্ষতি করার জন্য একত্রিত হয়ে যায়, তবে ততটুকুই ক্ষতি করতে পারবে যতটুকু আল্লাহ তোমার (তাকদীরে) লিখে রেখেছেন। কলমসমূহ উঠিয়ে নেওয়া হয়েছে এবং খাতাসমূহ (তাকদীরের লিপি) শুকিয়ে গেছে।’’( তিরমিযী ২৫১৬ (তিনি বলেছেন, হাদীসটি হাসান সহীহ), আহমাদ ২৬৬৪, ২৭৫৮, ২৮০০, রিয়াদুস সলেহিন, হাদিস নং ৬৩)
উপরোক্ত হাদীস থেকে এটা দিনের আলোর মতো পরিস্কার যে, যেকোনো আল্লাহর বান্দা যেকোনো প্রয়োজনে শুধুমাত্র আল্লাহর কাছেই চাইবে। একমাত্র তিনিই বান্দার যাবতীয় ইচ্ছা আকাঙ্ক্ষার প্রয়োজনীয়তা পূরণ করতে পারেন। তিনি ব্যতীত কেউ কোনো কিছুই পূরণ পরিবর্তন করতে পারে না। যার সাথে আল্লাহ্ আছেন তার বিরুদ্ধে পুরো দুনিয়া থাকলেও তার কোনো ক্ষতি কেউ করতে পারবে না। আর যার বিরুদ্ধে আছেন, তার পক্ষে পুরো দুনিয়া থাকলেও কেউ তার উপকার করতে পারবে না।
সুতরাং সর্বাবস্থায় বান্দাদের একমাত্র আল্লাহর কাছেই চাইতে হবে একমাত্র তাঁরই জন্য ইবাদত বন্দেগী করতে হবে। আল্লাহ্ ব্যতীত অন্য কোনো মৃত কবরবাসী পীর মুর্শিদ অলি আউলিয়ারা কখনোই কারো উপকার অপকার করতে পারে না। রাসুলুল্লাহ সাঃ এর এমন কোনো শিক্ষা নেই যে, মৃত ব্যক্তি কারো কথা শুনে তার উপকার অপকার করতে পারে। অতএব মানতের মাধ্যমে কবরবাসীর জন্য টাকা পয়সা পশু ইত্যাদি দান সদকা হারাম এবং শির্ক।
কী নিয়তে দান করা হয়?
যারা সুফিবাদী সুন্নী রয়েছে তারা আল্লাহর সন্তুষ্টি নয় বরং কবরে শায়িত ব্যক্তির সন্তুষ্টির জন্যই দান সদকা করে থাকেন। তারা মুখে বলে যে, সবই আল্লাহ্ করেন। কিন্তু আমাদের চাইতে হবে অলি আউলিয়াদের মাধ্যমে! নাঊজুবিল্লাহ। অর্থাৎ তারা আল্লাহ্কে পেতে মাধ্যম মানেন।
তাই তারা নিজেদের যেকোনো উদ্দেশ্য পূরণের জন্য বিশেষকরে সন্তান কামনা, বিপদে উদ্ধার, আয় উন্নতি ইত্যাদির জন্য মাজারে টাকা পয়সা মানত করে। মোটকথা যে কাজ মূলত আল্লাহর, সেই কাজকে তারা কথিত অলি আউলিয়াদের ক্ষমতা হিসাবে দেখে। তাই তারা মাজারে দান করে।
মাজারে দানের আরেকটা কারণ হলো, অলি আউলিয়াদের কিছু দেওয়ার জন্য মাজারে দানের বাক্স আছে। কিন্তু আল্লাহ্কে দেওয়ার জন্য তো দানের বাক্স তো সরাসরি নেই! তাই সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান মাজারে টাকা দেওয়াকেই সঠিক ইসলাম মনে করে।
সেই দান কার উপকারে আসে?
সাধারণ মানুষ মাজারে টাকা-পয়সা দিলেও, সেই অর্থ কখনোই কবরে শায়িত ব্যক্তির উপকারে আসে না। কেননা কবরে কারোরই অর্থ সম্পদের প্রয়োজন নেই। তাই এইসব দানের টাকা মূলত কবরে শায়িত ব্যক্তির ওয়ারিশদের উপকারে আসে।
এটা চিরাচরিত সত্য যে, মাজারের ওয়ারিশরাই হচ্ছেন ঐ টাকার মালিক। তারা সেই টাকার কিছু অংশ সার্বজনীন বার্ষিক ওরসের মাধ্যমে কিছু মানুষকে খাওয়ায়। কিছু মাজার উন্নয়নে খরচ করে। আর সিংহভাগ টাকা ওয়ারিশরাই ভাগাভাগি করে জীবনযাপন করে।
প্রথমত ইসলামে কোনো ব্যক্তির কবরকে মাজার রুপান্তর করাই জায়েজ নয়। সেখানে মাজার করার পর টাকাপয়সা তুলে নিজেদের ভরনপোষণ করা কতটুকু যুক্তিগত? আমরা যদি নিরপেক্ষভাবে চিন্তা করি তাহলে দেখতে পাবো যে, মাজারের টাকা দিয়ে বছরে দু এক দিন সাধারণ মানুষদের খাওয়ানো হচ্ছে। যদিও সেই খাওয়াও টাকা দিয়ে কিনতে হয় অধিকাংশ মাজারে। সেইসাথে লোক দেখানো কিছু উন্নয়ন ছাড়া আর কিছুই করা হয় না।
কারণ অধিকাংশেরও বেশী মাজারেরই নিজস্ব কোনো মাদ্রাসা বা এতিমখানা নেই। আর মাদ্রাসা বা এতিমখানা থাকলেও সেইসব প্রতিষ্ঠানের ফান্ড সম্পূর্ণ আলাদা। কোনো মাজারের টাকা কখনোই কোনো মসজিদ, মাদ্রাসা বা এতিমখানায় পৌঁছায় না। যারফলে যে টাকাটা উদ্ধৃত থাকে সেটা সেই মাজারের ওয়ারিশদের পকেটেই থাকে। সুতরাং মাজারে মানতের টাকা দিয়ে মূলত কবরে শায়িত ব্যক্তির কোনো উপকারেই আসছে না। তারপরও কেন সেখানে টাকা দেওয়া জায়েজ হবে?
কবরবাসীকে টাকা দেওয়ার বিধানঃ
ইসলামে সুফিবাদী সুন্নীদের মতো কবরকে মাজারে রুপান্তর করার কোনো নজির ইতিহাসে নেই। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে বিভিন্ন নবী রাসুল, সাহাবী, বা কামেল বুজুর্গদের কবর থাকলেও সেইসব কবর মাজারে রুপান্তরিত হয়নি। সেখানে কোথাও মানতের নামে দানবক্স বসানো হয়নি। সেইসাথে সেখানে বার্ষিক ওরসের নামে খানাপিনার আয়োজন করা হয় না।
শুধুমাত্র সুফিবাদী আকিদার সুন্নিরাই কবরকে মাজার, মাজারকে মানতের মাধ্যমে ব্যবসার সুযোগ সৃষ্টি করেছে। এই উপমহাদেশ ও বিশ্বের গুটিকয়েক সুফি আকিদার জায়গায় ছাড়া আর কখনোই এইসব ওরস মানত ইত্যাদির সংস্কৃতি নেই।
শুধু তাইনয়, ইসলামে রাসুলের সাঃ এমন কোনো শিক্ষা নেই যে, কোনো কবরবাসীর কবরেকে মাজারে রুপান্তর করে মানতের মাধ্যমে টাকাপয়সা ইত্যাদির লেনদেন চলবে। সুতরাং ইসলাম কখনোই কবরবাসীকে টাকা দেওয়া বা তাদের উদ্দেশ্যে মানত করা সমর্থন করে না।
ইসলামে দানের বিধানঃ
ইসলামে দান সদকার সুনির্দিষ্ট বিধান রয়েছে। যেকোনো সময় যেকোনো দান সদকা আল্লাহর রাস্তায় বিভিন্ন উপায়ে খরচ করা যায়। কিন্তু কবরবাসীর নামে মানত করে দান করলে তা কখনোই সঠিক দান বলে ইসলামে গন্য হবেনা। কারণ, প্রথমত কবরবাসীর কোনো দানের প্রয়োজন নেই। ইসলামে দান সদকা গ্রহণ করতে পারবে এমন তালিকায় কবরবাসী নেই। আল্লাহ্ বলেন,
"যাকাত হল কেবল ফকির, মিসকীন, যাকাত আদায় কারী ও যাদের চিত্ত আকর্ষণ প্রয়োজন তাদে হক এবং তা দাস-মুক্তির জন্যে-ঋণ গ্রস্তদের জন্য, আল্লাহর পথে জেহাদকারীদের জন্যে এবং মুসাফিরদের জন্যে, এই হল আল্লাহর নির্ধারিত বিধান। আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়।"(সূরাঃ আত তাওবাহ, আয়াতঃ ৬০)
ইসলাম ফকির, মিসকিন, ইয়াতীম, দুঃখ দুর্দশাগ্রস্ত ব্যক্তি, ঋণগ্রস্ত, অভাবগ্রস্ত ব্যক্তি, কন্যাদায়গ্রস্ত পিতা, অভাবী অসুস্থ ব্যক্তি ইত্যাদিকে যাকাত দেওয়া, দান সদকা করা জায়েজ করা হয়েছে। এইসব ব্যক্তিকে দান সদকা করলে তার বিনিময় আল্লাহর কাছে পাওয়া যাবে।
সেইসাথে দান সদকা করা যাবে দ্বীন ইসলামের জন্য। বিশেষকরে মসজিদ, মাদ্রাসা, এতিমখানা ইত্যাদির জন্য। এছাড়াও জনকল্যাণমূলক কাজে দান সদকা করা যাবে। যেমনঃ রাস্তা ঘাট, স্কুল কলেজ, হাসপাতাল, বৃদ্ধাশ্রম, পান নলকূপ, ফলাদি বাগান ইত্যাদি। অর্থাৎ যেসব কাজ করলে সেখান থেকে সকল সাধারণ মানুষ উপকৃত হবে সেইসব কাছে অর্থ সম্পদ ব্যয় করা। এই দান সদকার বিনিময় আল্লাহ্ ততদিন পর্যন্ত দিতে থাকবেন, যতদিন পর্যন্ত ঐসব উপকার দুনিয়া চলতে থাকবে।
সুতরাং দান সদকা করার ক্ষেত্র ইসলাম খুবই সুস্পষ্ট করে দিয়েছে। এখন কেউ যদি কবরবাসীকে খুশি করার জন্য মাজারে দান সদকা করে, তাহলে সেই নিয়ত এবং দান কোনটাই সঠিক হবেনা। প্রথমত ভুল নিয়ত করার কারণে শির্ক করে মুশরিকে পরিনত হবে। দ্বিতীয়ত ভুল জায়গায় দান করার কারণে আল্লাহর সন্তুষ্টি পাওয়া যাবে না। তৃতীয়ত জেনেশুনে ভুল জায়গায় দান করার কারণেও জবাবদিহিতা করতে হবে।
অতএব, কবরবাসীর উদ্দেশ্যে মানত করে দান করলে তা কখনোই সঠিক হবেনা। কেউ কেউ বলেন মাজারে আমরা পশু জবাই করে মানুষকে খাওয়াই। এখানেও প্রথম নিয়ত কবরবাসীর সন্তুষ্টি। যা শির্ক আগেই আলোচনা করা হয়েছে। দ্বিতীয়ত যাদের খাওয়ানো হচ্ছে তারা সবাই বা অধিকাংশই অভাবী নয়। তৃতীয়ত অধিকাংশ ক্ষেত্রেই টাকার বিনিময়ে সেখানে খাওয়ার রীতি প্রচলিত আছে।সুতরাং মাজারে মানত করে দান সদকা বা খাওয়ানো কোনটাই ইসলামের দৃষ্টিতে সঠিক নয়।
উপরোক্ত আলোচনা থেকে এটাই প্রমাণিত হয় যে, ইসলামে মানত করা গেলেও তা শুধুমাত্র আল্লাহর নামে, আল্লাহর জন্য এবং আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য মানত করতে হবে। আল্লাহ্ ব্যতীত অন্য কারো নামে উদ্দেশ্যে বা সন্তুষ্টির জন্য মানত করা যাবে না। সেইসাথে মানতের উদ্দেশ্যে মাজারে দান করা হলেও তা দানের হিসাবে গ্রাহ্য হবেনা। সুতরাং মাজারে মানত করে দান সাদকা করা জায়েজ নয়।
সাখাওয়াতুল আলম চৌধুরী
১৯ ফেব্রুয়ারি, ২০২২
পতেঙ্গা, চট্টগ্রাম।