গণতান্ত্রিক সংবিধানে যেমন সকল ক্ষমতার উৎস জনগণ। ঠিক তেমনি আমাদের উপমহাদেশে সুফিবাদী মুসলমানদের ধর্মীয় আকিদা হলো অদৃশ্যের সকল ক্ষমতাও অলি আউলিয়াদের।
আকিদা কীঃ
আকীদা (আরবি: عقيدة, বহুবচন: আরবি: عقائد, আকা'ইদ, কখনো কখনো উচ্চারণ করা হয় আকীইদাহ, আক্বিদাহ) এটি একটি ইসলামী পরিভাষা যার অর্থ 'কিছু মূল ভিত্তির উপর বিশ্বাস'। ইসলামে আকিদা খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। যার সম্পর্ক সরাসরি ঈমানের সাথে।
সঠিক আকিদা না থাকলে ঈমান পরিপূর্ণ নয়। আর ঈমান না থাকলে কোনো আমলই আল্লাহর কাছে গ্রহনযোগ্য নয়।
আল্লাহ তাআলা কুরআনে পাকে ঘোষণা করেন-
"যারা কাফের (যাদের ঈমান নেই) তাদের আমলসমূহ মরুভূমির মরিচিকার ন্যায়।' (সুরা নূর : আয়াত ৩৯)
অতএব, সঠিক আকিদার সাথে ঈমান পরিপূর্ণ না হলে কিয়ামতে এর কোনো মূল্য নেই।
উপমহাদেশে মুসলিম আকিদাঃ
এই উপমহাদেশে আমরা যারা জন্মগত মুসলমান, তারা ঈমানের ক্ষেত্রে পূর্বপুরুষদের অনুসরণকেই। ইসলামের মানদণ্ড হিসাবে বিবেচনা করি এবং সেইমতো ধর্ম পালন করি। অথচ ইসলামে পূর্বপুরুষদের অনুসরণকে তিরস্কার করা হয়েছে। আল্লাহ্ বলেন,
"যখন তাদেরকে বলা হয় যে, আল্লাহর নাযিলকৃত বিধান এবং রসূলের দিকে এস, তখন তারা বলে, আমাদের জন্যে তাই যথেষ্ট, যার উপর আমরা আমাদের বাপ-দাদাকে পেয়েছি। [ সুরা মায়েদা ৫:১০৪ ]"
সুফিবাদী মতবাদে পূর্বপুরুষদের অন্ধ অনুসরণের ফলে উপমহাদেশে কুরআন এবং সুন্নাহর সঠিক চর্চা এখানে নেই। কুরআন সুন্নাহর সঠিক জ্ঞান না থাকার কারণে আল্লাহ্ সম্পর্কেও এখানে সঠিক জ্ঞান নেই। যারফলে আল্লাহ্ সম্পর্কে কল্পনাপ্রসূত কল্পকাহিনীর ধারণা নিয়ে ধর্মীয় চর্চা হয় এখানে।
অলি আউলিয়াদের প্রভাবঃ
সঠিক ইতিহাস মতে উপমহাদেশে মুসলিম বণিক ও শাসক দ্বারাই সর্বপ্রথম ইসলাম প্রচার শুরু হয়। পরবর্তীতে মুসলিম সাধু সন্ন্যাসী দরবেশদের দ্বারা সুফিবাদী ইসলামের প্রচার প্রসার হয়। যেহেতু দুনিয়াবিমুখী সাধু দরবেশদের চারিত্রিক শুভ্রতার দ্বারা ইসলামের প্রচার প্রসার হয়, সেহেতু উপমহাদেশের ইসলামে অলি আউলিয়াদের প্রভাবে সুফিবাদী ঈমান আকিদা দৃশ্যমান।
গোমরাহী কোথায় এবং কেনঃ
ইসলাম এসেছে আরব দেশে আরবী ভাষায়। এই উপমহাদেশে আরবী শিক্ষা চর্চা না থাকা সেইসাথে সনাতন ধর্মসহ বিভিন্ন অগ্নি উপাসক ধর্ম থেকে মুসলমান হওয়ায়, উপমহাদেশের ইসলামে গোমরাহীর মূর্খতা এবং ব্যাক্তি অনুসরণ ব্যাপক প্রভাব ফেলে। যারফলে সঠিক ইসলামে কী আছে কী নেই তা কুরআন এবং সুন্নাহ থেকে জানতে মুসলমানরা অপারগ হয়। এই অপারগতার কারণে শতশত বছর উপমহাদেশের মুসলমানগণ সঠিক ইসলাম থেকে দূরে আছে।
উপমহাদেশে সাধু সন্ন্যাসী জাতীয় অলি আউলিয়াদের দ্বারা সুফিবাদের মতো ভ্রান্ত আকিদার ইসলাম প্রচার, মুশরিক থেকে ইসলামে প্রবেশ এবং বিভিন্ন কারণে কুরআন সুন্নাহর সঠিক জ্ঞান না থাকার কারণেও - ইসলামের সঠিক আকিদাসহ শির্ক বিদআতের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় থেকে মুসলমাদগণ যোজন যোজন দূরত্বে অবস্থান করে। যা এখনও বিদ্যমান।
ভুল আকিদার পরিনতিঃ
প্রথমত সুফিদের দ্বারা সুফিবাদের প্রচার, পূর্বপুরুষদের অন্ধ অনুসরণ, শিয়া শাসকদের (শিয়া ধর্মের) ধর্মীয় প্রচার এবং কুরআন সুন্নাহর সঠিক জ্ঞান চর্চার অভাবে উপমহাদেশের মুসলমানগণ আল্লাহর সঠিক পরিচয় পেতে ব্যর্থ হয়।
যারফলে তাদের মধ্যে আল্লাহ্ সম্পর্কে ভুল ধারণার জন্ম নেয়। হিন্দুদের যেমন এক ভগবানের সকল ক্ষমতা ৩৩ কোটি দেবতাদের মধ্যে ভাগ করে দেওয়া হয়েছে, ঠিক তেমনি উপমহাদেশের মুসলমানগণও সুফিবাদের আকিদা অনুযায়ী মনে করে আল্লাহ্ ও তাঁর ক্ষমতা সব শুধুমাত্র উপমহাদেশের সকল অলি আউলিয়াদের ভাগ করে দিয়েছেন।
অর্থাৎ বান্দার যদি কোনো কিছু চাওয়ার প্রয়োজন হয়, তাহলে আল্লাহর কাছে নয় বরং অলি আউলিয়াদের দরবারে, কবরে, খানকা ইত্যাদি জায়গায় যাও। অথচ সকল ক্ষমতার মালিক হচ্ছে একমাত্র আল্লাহ্। তিনি বলেন,
"আল্লাহর সান্নিধ্যেই তোমাদেরকে ফিরে যেতে হবে। আর তিনি সব কিছুর উপর ক্ষমতাবান। [ সুরা হুদ ১১:৪ ]"
আর উপমহাদেশের সুফি মুসলমানদের আকিদা হলো সকল ক্ষমতার মালিক হচ্ছে অলি আউলিয়া। তাদের আকিদা সুস্পষ্ট ভাবে তারা প্রকাশ করে, "আল্লাহর ধন রাসুল কে দিয়ে আল্লাহ গেলেন গায়েব হয়ে। রাসুলের ধন অলিদের দিয়ে তিনিও গেলেন খুশি হয়ে "।
অর্থাৎ আল্লাহ তার সকল ক্ষমতা রাসুলের মাধ্যমে অলি আউলিয়াদের দিয়ে তিনি ক্ষমতাহীন, কর্মহীন এবং অকর্মণ্য হয়ে পড়েছেন(নাউজুবিল্লাহ)। সুতরাং তাকে ডেকে লাভ নেই। যেকোনো প্রয়োজনে ডাকতে হবে অলি আউলিয়াদের। যা সরাসরি কুফরি এবং মুশরিকি আকিদা।
সঠিক ক্ষমতা কারঃ
পবিত্র কুরআনের শতশত আয়াত এবং রাসুলের (সাঃ) জীবনের শিক্ষা দ্বারা একথা সুস্পষ্ট যে, সকল ক্ষমতা একমাত্র আল্লাহর হাতে। তিনি ই একেশ্বর অধিপতি। তিনি কাউকে তাঁর ক্ষমতার ভাগ দেননি। পবিত্র কুরআন এবং সুন্নাহর সুস্পষ্ট নির্দেশের পরও যে ভুল গুলো সুফি সুন্নীরা করে যাচ্ছেঃ-
জন্ম, মৃত্যু,সন্তান দানঃ
উপমহাদেশের সুফিবাদী মুসলমানদের আকিদা হচ্ছে- পীর, অলি আউলিয়ারা জীবিত বা মৃত যেকোনো অবস্থায় মানুষের জন্ম মৃত্যু ঘটাতে পারে। এবং সেইসাথে সন্তান দেওয়ার মালিকও পীর আউলিয়ারা। অথচ মৃত্যু প্রসঙ্গে আল্লাহ্ বলেন,
"আমি (আল্লাহ্) জীবন দান করি, মৃত্যু ঘটাই এবং আমারই দিকে সকলের প্রত্যাবর্তন। [ সুরা ক্বাফ ৫০:৪৩ ]"
অন্য আয়াতে বলেন,
"আল্লাহ মানুষের প্রাণ হরণ করেন তার মৃত্যুর সময়, আর যে মরে না, তার নিদ্রাকালে। অতঃপর যার মৃত্যু অবধারিত করেন, তার প্রাণ ছাড়েন না এবং অন্যান্যদের ছেড়ে দেন এক নির্দিষ্ট সময়ের জন্যে। [ সুরা যুমার ৩৯:৪২ ]"
সন্তান দানের ক্ষেত্রে আল্লাহ্ বলেন,
‘‘আল্লাহ যাকে ইচ্ছা কন্যা সন্তান দান করেন, যাকে ইচ্ছা পুত্র সন্তান দান করেন অথবা ছেলে-মেয়ে উভয়ই দান করেন। আবার যাকে ইচ্ছে বন্ধ্যা করেন।” [সূরা আশ্শূরা ৪২:৫০]
উপরোক্ত আয়াত দ্বারা আল্লাহ্ সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা দিচ্ছেন যে, তিনি-ই যেকোনো জীবন দান করেন এবং মৃত্যু ঘটান। সেইসাথে তিনিই মানুষকে সন্তান দান করেন ছেলে অথবা মেয়ে অথবা উভয়ই। অথবা কাউকে কিছুই দেন না। সুতরাং যেকোনো প্রয়োজনে চাইলে তাঁর কাছেই চাইতে হবে। যেভাবে রাসুল সাঃ আল্লাহর কাছ থেকে চাওয়ার শিক্ষা দিয়েছেন।
সুতরাং যেখানে আল্লাহ্ স্পষ্ট ঘোষণা দিচ্ছেন যে, জন্ম মৃত্যু সন্তান ইত্যাদি সকল কিছু একমাত্র আল্লাহ্ই দিয়ে থাকেন। সেখানে সুফিবাদীরা কীভাবে এইসবের ক্ষমতাকে পীর অলি আউলিয়াদের বলে দাবি করেন? পবিত্র কুরআনে একটি আয়াতও নেই, যেখানে আল্লাহ্ বলেছেন জন্ম মৃত্যু সন্তান ইত্যাদি কোনো পীর অলি আউলিয়া দিতে পারেন বা দেওয়ার ক্ষমতা রয়েছে।
রিজিকঃ
উপমহাদেশের সুফিবাদী মুসলমানদের আকিদা হচ্ছে, ধন, দৌলত, চাকরি-বাকরি, রিজিক ইত্যাদির ক্ষমতা মৃত অলি আউলিয়াদের হাতে। তাই তারা নিয়মিত অলি আউলিয়াদের কবরে মাজারে দরবারে মান্নতের নিয়তে যাওয়া আসা করে। আল্লাহ্ পবিত্র কুরআনে বলেন,
"(হে রাসুল সাঃ আপনি) বলুন, আমার পালনকর্তা যাকে ইচ্ছা রিযিক বাড়িয়ে দেন এবং পরিমিত দেন। কিন্তু অধিকাংশ মানুষ তা বোঝে না। [ সুরা সা’বা ৩৪:৩৬ ]"
আল্লাহরই হাতে সমস্ত রিজিকের চাবিকাঠি। তিনি যাকে ইচ্ছা তাকেই সমৃদ্ধ করবেন অন্যথায় হ্রাস করবেন। এখানে কোনো বান্দার হাত নেই। প্রয়োজনে জীবিত যেকোনো আল্লাহ্ওলার কাছে দোয়া চাওয়া যাবে। তাঁর দোয়ায় আল্লাহ্ চাইলে রিজিক বাড়িয়ে দিতে পারেন। এছাড়াও বান্দার সৎকর্মের দ্বারাও নিজের রিজিক বৃদ্ধি করতে পারেন।
কিন্তু কোনো মৃত ব্যক্তির কবরে গিয়ে ঐ ব্যক্তি থেকে ধন দৌলত রিজিক ইত্যাদি চাওয়া হচ্ছে শিরক । শুধু তাইনয় কবরবাসীর জন্য মানত করা ইসলামে জায়েজ নয়। কেননা আল্লাহ্ কোথাও এমন ঘোষণা দেননাই যে কোনো মৃত ব্যক্তি ধন দৌলত রিজিক ইত্যাদি দিতে পারেন।
এ পৃথিবীতে যার যা- ই প্রয়োজন তা-ই দেন একমাত্র আল্লাহ্। অতএব চাইতে হলে তাঁর কাছেই চাইতে হবে। কেননা তিনিই একমাত্র আমাদের খবর রাখেন। অতএব কোনো মৃত অলি আউলিয়া নয়, বান্দার ধন দৌলত রিজিকের মালিক একমাত্র আল্লাহর। চাইতে হলে একমাত্র তাঁর কাছেই চাইতে হবে।
বিপদে উদ্ধারকারীঃ
উপমহাদেশের সুফিবাদী মুসলমানরা যেকোনো বিপদে পড়ার সাথে সাথে অলি আউলিয়াদের নাম ধরে সাহায্য প্রার্থনা করে। বিপদ থেকে উদ্ধার হওয়ার জন্য মান্নত করে। আর আল্লাহ্ বলেন,
"এবং অবশ্যই আমি তোমাদিগকে পরীক্ষা করব কিছুটা ভয়, ক্ষুধা, মাল ও জানের ক্ষতি ও ফল-ফসল বিনষ্টের মাধ্যমে। তবে সুসংবাদ দাও সবরকারীদের। [ সুরা বাকারা ২:১৫৫ ]"
এই আয়াতে আল্লাহ ঘোষণা দিচ্ছেন, যেকোনো বিপদাপদসহ বিভিন্ন অতর্কিত পরীক্ষা আল্লাহর পক্ষ থেকেই আসে। সুতরাং তিনিই সেই বিপদাপদ থেকে রক্ষা করার মালিক। সুতরাং আমাদের তাঁর কাছেই চাইতে হবে। কোনো অলি আউলিয়ার কাছে নয়।
কেন অন্যদের নিকট চাইবো না সেটাও কুরআনে আল্লাহ বলেছেন। সূরা ইউনুসের ১০৬ ও ১০৭ নং আয়াতে আল্লাহ্ বলেন,
‘‘আল্লাহ ছাড়া এমন মাবুদকে ডেকোনা, যে তোমার উপকার করতে পারবেনা এবং ক্ষতিও করতে পারবেনা। তুমি যদিএমন কর, তাহলে নিশ্চয়ই তুমি যালিমদের অন্তর্ভুক্ত হবে। আর আল্লাহ যদি তোমাকে কোন বিপদে ফেলেন, তাহলে একমাত্র তিনি ব্যতীত অন্য কেউ তা থেকে তোমাকে উদ্ধার করতে পারবে না। আর তিনি যদি তোমার প্রতি অনুগ্রহ করতে চান, তাহলে কেউ তাঁর অনুগ্রহকে প্রতিহত করতে পারেনা। স্বীয় বান্দাদের মধ্য থেকে যাকে চান, তাকেই তিনি স্বীয় অনুগ্রহ দান করেন; তিনিই ক্ষমাশীল, দয়ালু’’।
উপরোক্ত আয়াত থেকে এটা সুস্পষ্ট যে যেকোনো বিপদাপদ আসে একমাত্র আল্লাহর কাছ থেকে। আর এটা আসে কারণ এর দ্বারা আল্লাহ্ বান্দাকে পরীক্ষা করবে। সেইসাথে আল্লাহ্ এটাও বলেছেন, যদি আল্লাহ্ কাউকে বিপদ দেন তবে সেখান থেকে উদ্ধারকারীও একমাত্র আল্লাহ্। তিনি ছাড়া দ্বিতীয় কেউ নেই যিনি আল্লাহ্ প্রদত্ত বিপদ থেকে রক্ষা করবে।
এখন যে পরীক্ষা আল্লাহ্ করছেন, সেই পরীক্ষা থেকে কীভাবে একজন কবরবাসী উদ্ধার করবেন? যেখানে আল্লাহ্ বলছেন তিনি ছাড়া দ্বিতীয় কোনো উদ্ধারকারী নেই। রাসুলের শিক্ষা হচ্ছে দান সদকা আল্লাহর ক্রোধকে দমন করে। অর্থাৎ দান সদকা করলে তাকদিরের লিখিত যেকোনো বিপদাপদ কেটে যায়। কিন্তু সেটা কখনোই কবরবাসীর জন্য মানত নয়।
সুতরাং যেকোনো বিপদে উদ্ধার হওয়ার জন্য একমাত্র আল্লাহর কাছেই চাইতে হবে এবং রাসুলের সাঃ শিক্ষায় জীবনযাপন করতে হবে। কোনো কবরবাসীর কাছে মানত করা কখনোই জায়েজ হবেনা। কেননা কোনো কবরবাসীর এমন কোনো ক্ষমতা নেই যে আল্লাহর দেওয়া বিপদ থেকে কাউকে রক্ষা করতে পারে। অথবা আল্লাহ্ কোনো কবরবাসীকে এমন কোনো ক্ষমতা দেন নাই যে তিনি মানতের টাকা নিয়ে কাউকে বিপদ থেকে উদ্ধার করতে পারেন।
সর্বোত্তম সুপারিশকারীঃ
সুফিবাদের অনুসারীরা পীর মুরিদী মেনে চলে। কারণ তাদের সুস্পষ্ট ধারণা হচ্ছে - তারা দুনিয়ায় যাই করুক না কেন তাদের পীর তাদেরকে সুপারিশের মাধ্যমে জান্নাতে নিয়ে যাবেন। যেকোনো আল্লাহর অলিরা সুপারিশ করতে পারবেন এটা সত্য। তবে তা কখন এবং কীভাবে? আল্লাহ্ বলেন,
" বলুন, সমস্ত সুপারিশ আল্লাহরই ক্ষমতাধীন, আসমান ও যমীনে তাঁরই সাম্রাজ্য। [ সুরা যুমার ৩৯:৪৪ ]"
"আর সে দিনের ভয় কর, যখন কেউ কারও সামান্য উপকারে আসবে না এবং তার পক্ষে কোন সুপারিশও কবুল হবে না; কারও কাছ থেকে ক্ষতিপূরণও নেয়া হবে না এবং তারা কোন রকম সাহায্যও পাবে না। [ সুরা বাকারা ২:৪৮ ]"
অন্য আয়াতে বলেন,
"কে আছ এমন, যে সুপারিশ করবে তাঁর কাছে তাঁর অনুমতি ছাড়া? [ সুরা বাকারা ২:২৫৫ ]
"দয়াময় আল্লাহ যাকে অনুমতি দেবেন এবং যার কথায় সন্তুষ্ট হবেন সে ছাড়া কারও সুপারিশ সেদিন কোন উপকারে আসবে না"। [ সুরা ত্বা-হা ২০:১০৯ ]"
"তারা (পবিত্র ফেরেশতাগণ) শুধু তাদের জন্যে সুপারিশ করে, যাদের প্রতি আল্লাহ সন্তুষ্ট এবং তারা তাঁর ভয়ে ভীত। [ সুরা আম্বিয়া ২১:২৮ ]"
উপরোক্ত আয়াত গুলোতে সুপারিশ সংক্রান্ত সকল বিষয় স্পষ্ট। সুপারিশ করা যাবে আল্লাহর অনুমতিক্রমে। অর্থাৎ আল্লাহ্ যার জন্য অনুমতি দিবেন শুধুমাত্র তার জন্যই সুপারিশকারীরা সুপারিশ করতে পারবেন।
সুতরাং আল্লাহর পছন্দের বান্দা না হয়ে কখনোই কারো সুপারিশ পাওয়া যাবে না। যদি এমন হতো তাহলে আল্লাহর বান্দারা আল্লাহ্ কে বাদ দিয়ে বিভিন্ন ব্যক্তি পূজায় লিপ্ত হতো। যা উপমহাদেশের সুফিবাদী মুসলমানরা করে আসছে।
কে আল্লাহর সামনে সুপারিশ করতে পারবে আর কে পারবে না তা কিয়ামতের ময়দানে নির্ধারিত হবে। দুনিয়াতে কেউ গ্যারান্টি দিতে পারবে না যে, তিনি সুপারিশ করতে পারবেন। কেননা কে আল্লাহর অলি আর কে অলি নন তার সনদ দুনিয়ায় আল্লাহ কাউকেই দেননি। আমরা যা করছি তা শুধুমাত্র অনুমান।
সুতরাং আল্লাহর বিধান মেনে চালাই হচ্ছে প্রকৃত ঈমানদারের কাজ। যে আল্লাহর বিধান সত্যিকারভাবে মেনে চলবে সে যদি কোনো না কোনো পাপ করেও ফেলেও তার উদ্ধার করার মালিকও আল্লাহ্। কিয়ামতের কঠিন ময়দানে ঐ ব্যক্তি অবশ্যই সুপারিশ পাওয়ার যোগ্যতা রাখবে। কেননা তার অভিভাবক হচ্ছেন আল্লাহ্। আল্লাহ্ বলেন,
"তারা কি তাঁকে (অর্থাৎ আল্লাহ্ কে) বাদ দিয়ে বহু অভিভাবক গ্রহণ করেছে? কিন্তু আল্লাহ, তিনিই হলেন প্রকৃত অভিভাবক; তিনিই মৃতকে জীবিত করেন আর তিনি সকল বিষয়ে সর্বক্ষমতাবান।( ৪২: ৯)"
"তিনি ব্যতীত তোমাদের কোন অভিভাবক ও সুপারিশকারী নেই। এরপরও কি তোমরা বুঝবে না"?(৩২ : ৪)
"যারা ঈমান এনেছে আল্লাহ তাদের অভিভাবক, তিনি তাদেরকে অন্ধকার থেকে আলোর দিকে বের করে আনেন। আর যারা কুফরী করে, তাদের অভিভাবক হল তাগূত। তারা তাদেরকে আলো থেকে বের করে অন্ধকারে নিয়ে যায়। তারা আগুনের অধিবাসী, সেখানে তারা স্থায়ী হবে "। (২ : ২৫৭)
উপরোক্ত আয়াত গুলো দ্বারা আল্লাহ্ দ্ব্যর্থহীনভাবে ঘোষণা দিচ্ছেন যে, যেকোনো মুমিনের একমাত্র প্রকৃত অভিভাবক হলো আল্লাহ্। তিনিই তাঁর প্রকৃত বান্দাদের আলোর পথ দেখান। সেইসাথে একমাত্র আল্লাহ্ই হচ্ছে সত্যিকারের সুপারিশকারী। তিনিই সকল সুপারিশের মূল। অতএব আল্লাহর বিধানের ধারে কাছে না থেকে শুধুমাত্র ব্যক্তি পূজা করে কখনোই সুপারিশপ্রাপ্ত হওয়া যাবে না।
হিদায়াতের মালিকঃ
উপমহাদেশের সুফিবাদী মুসলমানদের ধারণা পীর আউলিয়াদের দরবার, কবরে গেলে হিদায়াতপ্রাপ্ত হওয়া যাবে। তাই তারা ইসলামের জ্ঞান চর্চা না করে বিভিন্ন অলি আউলিয়াদের দরবার ও কবরে পড়ে থাকে। অথচ আল্লাহ্ হযরত মুহাম্মদ সাঃ কে উদ্দেশ্য করে কুরআনে বলেন,
"(হে রাসুল) আপনি যাকে ইচ্ছা তাকে হিদায়াত দান করতে পারবেন না। বরং, আল্লাহ যাকে ইচ্ছা হিদায়াত করে থাকেন”(আল কুরআন-২৮:৫৬)। "
এখানে সুস্পষ্ট যে হিদায়াত দেওয়ার মালিক একমাত্র আল্লাহ্। তাহলে আল্লাহ্ কাকে হিদায়াত করবেন? সেই কথাও কুরআনে আল্লাহ্ বলেন,
"মূলত যার অন্তরে সত্য গ্রহণের আগ্রহ থাকে আল্লাহ তা’আলা তাকেই হিদায়াত দান করেন। আর আল্লাহ যাকে ইচ্ছা সরলপথে পরিচালিত করেন।” (আল কুরআন-১২:২৫)।
অর্থাৎ যে কুরআনের এবং হাদিসের সঠিক জ্ঞান অর্জন করতে এবং সেইমতো চলতে চেষ্টা করবে, একমাত্র তাকেই আল্লাহ্ একমাত্র হিদায়াতের সাহায্য করবেন এবং সরল পথে পরিচালিত করবেন।
সুতরাং মৃত কবরবাসী কখনোই কারো হিদায়েতের মালিক হতে পারেন না। শুধু জীবিত নেককার পীর আউলিয়ারা, যারা সঠিক কুরআন সুন্নায় পরিচালিত তাদের অনুসরণ করা যাবে। এইসব নেককার বান্দারা সাধারণ মানুষের পথপ্রদর্শক। তারা মানুষদের আল্লাহর সঠিক পথ দেখাতে সাহায্য করেন। কিন্তু সঠিক পথে ঐ বান্দাকে পরিচালিত করার মালিক এবং হিদায়েতের মালিক একমাত্র আল্লাহ্।
মান্নত সংক্রান্ত ভুলঃ
সুফি সুন্নীদের আকিদাগত চিন্তা ধারণা এটা যে, যেকোনো বিপদ আপদে প্রয়োজনে পীর আউলিয়াদের নাম ধরে ডেকে তাদের নামে মান্নত করা হলেই আল্লাহ্ তা পূরণ করেন। অর্থাৎ মানত করলেই বিপদে উদ্ধারের মালিক ঐ পীর অলি আউলিয়া। অথচ আমরা আগেই জেনেছি বিপদ দেওয়া এবং উদ্ধারের মালিক আল্লাহ্। সুফিরা পীর অলিদের ডেকে আল্লাহর সাথে অংশীদার স্থাপন করেছে। অথচ আল্লাহ্ বলেন,
"তারা আল্লাহর বান্দাদের মধ্য থেকে আল্লাহর অংশ স্থির করেছে। বাস্তবিক মানুষ স্পষ্ট অকৃতজ্ঞ"। [ সুরা যূখরুফ ৪৩:১৫ ]
অন্য আয়াতে আল্লাহ্ আরও বলেন,
"আল্লাহ কি তাঁর বান্দার পক্ষে যথেষ্ট নন"? [ সুরা যুমার ৩৯:৩৬ ]
"আল্লাহ ছাড়া এমন মাবুদকে ডেকোনা, যে তোমার উপকার করতে পারবেনা এবং ক্ষতিও করতে পারবেনা। যদিএমন কর, তাহলে নিশ্চয়ই তুমি যালিমদের অন্তর্ভুক্ত হবে"।। (১০:১০৬)
অর্থাৎ আল্লাহর সাথে অংশীদার স্থাপন করে অন্য কারো নিকট চাওয়া যাবেনা। যেখানে আল্লাহ্ ই যদি বিপদ দিয়ে থাকেন সেখানে তিনি ছাড়া উদ্ধারকারী কেউ নেই।
সুতরাং চাইতে হবে আল্লাহর কাছে। আর মান্নত করা সুস্পষ্ট গোমরাহী। রাসুলুল্লাহ সাঃ জীবনী থেকে আমরা জানতে পারি, তিনি সরাসরি মান্নত করতে নিষেধ করেছেন।
এই বিষয়ে হাদীসে এসেছে :
" আব্দুল্লাহ ইবনে উমার রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেছেন: ‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একদিন আমাদের মানত করতে নিষেধ করেছেন। আর বলেছেন: মানত কোনো কিছুকে ফেরাতে পারে না। তবে মানতের মাধ্যমে কৃপণ ব্যক্তির সম্পদ বের করা হয়।' (সহিহ মুসলিম, হাদীস নং ৪৩২৫)"
এই হাদীসপহ আরও অসংখ্য হাদীস দ্বারা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত যে, কখনোই মানত করা যাবে না। তাছাড়া কবরবাসীর নামে মানত করলে কয়েকটি কবিরা গুনাহ সংঘটিত হয়। যা একজন মানুষের ঈমানকে পর্যন্ত ধ্বংস করে দেয়।
মানুষ কবরবাসীর নামে মানত করে এইজন্য যে, তাদের বিশ্বাস ঐ কবরবাসী মানুষের যেকোনো উপকার করতে পারেন। সন্তান দেওয়া, বিপদে উদ্ধার, ধন দৌলত দান, মৃতকে জীবিত করা ইত্যাদি সহ যেকোনো ক্ষমতার মালিক। অথচ এইসব ক্ষমতা একমাত্র আল্লাহর!
আল্লাহ্ ব্যতীত অন্য কারো এইসব ক্ষমতা আছে বলে বিশ্বাস করার সাথে সাথে ঐ ব্যক্তি আল্লাহর সাথে অংশীদার স্থাপন করে শির্ক করলো। যা ঈমান ভঙ্গের একটি কারণ। সেইসাথে কেউ দানের উদ্দেশ্যে মানত করলে সেটাও জায়েজ হবেনা। কারণ কবরবাসীকে দান করলে সেটা কবরবাসীর কাছে পৌছানোর কোনো উপায় সেখানে নেই।
সেইসাথে দানের যে শর্ত ও খাত রয়েছে তা কবরবাসীর মাজারে অনুপস্থিত। তাই এখানে সওয়াবের নিয়তে দান করা জায়েজ নয়। এছাড়াও যে টাকা পয়সা কবরবাসীর নামে দান করা হয়, তা কখনোই দান সদকার খাতে খরচ হয় না এবং ঐ টাকা কখনোই দানের হিসাবে পড়ে না। একইসাথে কবরবাসীকে দেওয়া দানের টাকা কবরবাসীর ওয়ারিশরাই ভোগদখল করে। যার কোনো সওয়াবই দানকারী বা মানতকারী পাবেনা। সুতরাং পীর আউলিয়াদের দরবার ও কবরে গিয়ে মানত করার অর্থ সরাসরি রাসুল সাঃ এর বিরোধী কাজ। যা কখনোই ইসলাম সম্মত নয়।
আল্লাহর কেবিনেটঃ
সুফিদের মতে আল্লাহর পাশাপাশি ওলী-আওলিয়ারাও দুনিয়া পরিচালনার কাজে সম্পৃক্ত রয়েছেন। সুফিরা বিশ্বাস করে যে, আল্লাহ যেহেতু একা, সেহেতু একা তাঁর পক্ষে পুরো বিশ্বজগত পরিচালনা করা সম্ভব নয়। ফলে তিনি তাঁর বিশ্ব পরিচালনার সুবিধার্থে আরশে মু‘আল্লায় একটি পার্লামেন্ট কায়েম করেছেন।
সেই পার্লামেন্টের সদস্য সংখ্যা মোট ৪৪১ জন। আল্লাহ তাদের স্ব স্ব কাজ বুঝিয়ে দিয়েছেন। তন্মধ্যে নাজীব ৩১৯ জন, নাক্বীব ৭০ জন, আবদাল ৪০ জন, আওতাদ ৭ জন, কুতুব ৫ জন এবং একজন হ’লেন গাওছুল আযম, যিনি মক্কায় থাকেন। উম্মতের মধ্যে আবদাল ৪০ জন আল্লাহ তা‘আলার মধ্যস্থতায় পৃথিবীবাসীর বিপদাপদ দূরীভূত করে থাকেন।
তারা অলীগণের দ্বারা সৃষ্টজীবের হায়াত, রুযী, সন্তান, ছেলে অথবা মেয়ে দান, বৃষ্টি, বৃক্ষ জন্মানো ও মুছীবত বিদূরণের কাজ সম্পাদন করেন। সুফিদের এই আকিদার পক্ষে কুরআন ও সহীহ্ হাদিসের কোনো দলিল নেই। বিশ্বজগত পরিচালনার জন্য আল্লাহর কারো নিকট থেকে সাহায্য নিতে হয় না। তিনি বলেন,
" তিনি (আল্লাহ্) আকাশ থেকে পৃথিবী পর্যন্ত সমস্ত কর্ম পরিচালনা করেন।" (সূরা সাজদা: ৫)
মহান আল্লাহ আকাশ থেকে পৃথিবী পর্যন্ত সমস্ত কাজ নিজেই পরিচালনা করেন। তিনিই সকলের একমাত্র ত্রান কর্তা। অথচ সুফিগণ আব্দুল কাদের জিলানী (রঃ)কে মহা ত্রাণকর্তা হিসেবে বিশ্বাস করেন। তার নাম রেখেছেন গাউছুল আযম যার অর্থ হচ্ছে মহান ত্রাণকর্তা। এভাবে খাজা গরীবে নেওয়াজ যিনি গরীবের ত্রাণকর্তা ইত্যাদি। এভাবে সুফিদের বিভিন্ন অলি আউলিয়ারা বান্দার বিভিন্ন কাজের দায়িত্বে আছেন বলে সুফিরা বিশ্বাস করে।
অথচ রাসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুগে মক্কার মুশরিকরাও বিশ্বাস করত দুনিয়া পরিচালনার কাজে আল্লাহ্ ছাড়া কেউ সম্পৃক্ত নেই। আল্লাহ রব্বুল আলামিন বলেন,
" তাদেরকে জিজ্ঞেস করো, “কে তোমাদের আকাশ ও পৃথিবী থেকে রিযিক দেয়? এই শুনার ও দেখার শক্তি কার কর্তৃত্বে আছে ? কে প্রাণহীন থেকে সজীবকে এবং সজীব থেকে প্রাণহীনকে বের করে? কে চালাচ্ছে এই বিশ্ব ব্যবস্থাপনা”? তারা নিশ্চয়ই বলবে, আল্লাহ৷ বলো, তবুও কি তোমরা বিরোধী পথে চলার ব্যাপারে সতর্ক হচ্ছোনা? (সুরা ইউনুস ৩১)।
এখানে সুস্পষ্ট যে, আল্লাহর কোনো কেবিনেট নয় বরং আল্লাহ্ নিজেই সমস্ত কিছু পরিচালনা করছেন। সেখানে সুফিদের কল্পিত কেবিনেটের কোনো দৃষ্টান্ত কুরআনের কোথাও নেই।
শুধু তাইনয় সুফিরা যাদের কেবিনেটের সদস্য দাবি করে তারা নিজেরাই আল্লাহর কাছে নৈকট্যলাভের উপায় খুঁজে বেড়াচ্ছে। আল্লাহ তাআলা বলেন,
"এরা যাদেরকে (অলি আউলিয়া) ডাকে তারা তো নিজেরাই নিজেদের রবের নৈকট্যলাভের উপায় খুঁজে বেড়াচ্ছে যে, কে তাঁর নিকটতর হয়ে যাবে এবং এরা তাঁর রহমতের প্রত্যাশী এবং তাঁর শাস্তির ভয়ে ভীত। আসলে তোমার রবের শাস্তি ভয় করার মতো৷" (সুরা বনী ইসরাঈল ১৭:৫৭)।
অর্থাৎ সুফিরা যাদের পীর অলি আউলিয়া দাবি করে, তারা নিজেরাই আল্লাহর কাছে কে কত প্রিয়ভাজন হবেন সেই উপায় উছিলা তালাশ করে। সুতরাং দুনিয়া পরিচালনার জন্য অলি আউলিয়াদের নিয়ে আল্লাহর কোনো গোপন কেবিনেট নেই। আল্লাহ্ একাই পুরো বিশ্বজাহানের অধিপতি।
গায়েবের খবর জানাঃ
সুফিদের আকিদা হলো আল্লাহর মতই পীর, অলী আউলিয়া সকলেই অদৃশ্যর জ্ঞান তথা ইলমে গায়েব রাখেন। এটা সুস্পষ্ট কুরআন হাদীস বিরোধী কথা।
আল্লাহ তাআলা বলেন,
" আপনি বলে দিন, আমি আমার নিজের কল্যাণ সাধনের এবং অকল্যাণ সাধনের মালিক নই, কিন্তু যা আল্লাহ চান। আর আমি যদি গায়বের কথা জেনে নিতে পারতাম, তাহলে বহু মঙ্গল অর্জন করে নিতে পারতাম, ফলে আমার কোন অমঙ্গল কখনও হতে পারত না। আমি তো শুধুমাত্র একজন ভীতি প্রদর্শক ও সুসংবাদদাতা ঈমানদারদের জন্য।" [ সুরা আরাফ ৭:১৮৮ ]
এ আয়াতে আল্লাহ তাআলা তাঁর রসূল সাঃকে পরিস্কার ভাবে ঘোষণা দিতে বললেন যে, আমি গায়েবের খবর জানলে, নিজের অনেক কল্যান করতাম এবং কখনো কোন ক্ষতি আমাকে স্পর্শ করতনা। আল্লাহ আরও বলেন,
" বলুন (হে রাসুল), "আমি তোমাদের বলি নাই যে, আমার নিকট আল্লাহ্র ধনভান্ডার রয়েছে। আমি অদৃশ্য সম্বন্ধে জানি না। আমি তোমাদের এ কথা বলি না যে, আমি একজন ফেরেশতা। আমার নিকট যে প্রত্যাদেশ অবতীর্ণ হয়েছে, আমি শুধু তার অনুসরণ করি। বল, অন্ধ ও চক্ষুষ্মান কি এক হতে পারে? তোমরা কি বিবেচনা করবে না? " [আনাম ৬:৫০]
" তাদেরকে বল, আল্লাহ ছাড়া পৃথিবীতে ও আকাশে কেউ অদৃশ্যের জ্ঞান রাখে না৷ এবং তারা জানেনা কবে তাদেরকে উঠিয়ে নেয়া হবে।"[নামল ২৭:৬৫]
" তাঁরই কাছে আছে অদৃশ্যের চাবি, তিনি ছাড়া আর কেউ তা জানে না৷ জলে- স্থলে যা কিছু আছে সবই তিনি জানেন৷ তাঁর অজ্ঞাতসারে গাছের একটি পাতাও পড়ে না৷ মৃত্তিকার অন্ধকার প্রদেশে এমন একটি শস্যকণাও নেই যে সম্পর্কে তিনি অবগত নন৷ শুষ্ক ও আর্দ্র সবকিছুই একটি সুস্পষ্ট কিতাবে লিখিত আছে৷" [আনাম ৬:৫৯]
একমাত্র শুধুমাত্র আল্লাহ্ই হলেন অদৃশ্যের জ্ঞানের অধিকারী। এই সম্পর্কিত আরো আয়াতের রেফারেন্স উল্লেখ করা হল: [মায়েদা- ৫: ১০৯ ১১৬; আনাম- ৬ :৫০ ৫৯ ৭৩; তওবা -৯ : ৪৩,৭৮,৯৫,১০১, ১০৫; নাহল- ১৬:৭৭; ত্বহা -২০:১৫ ১১০; জুকরুক -৪৩:৮৫; তাহরিম -৬৬ : ১; জিন- ৭২ : ২৫ ]
সুতরাং যেখানে রাসুল সাঃ গায়েবের খবর জানেন না বলে কুরআনের দ্বারা প্রমাণিত সেখানে পীর অলি আউলিয়ারা কীভাবে গায়েবের খবর জানেন বা বলতে পারেন। অতএব একমাত্র আল্লাহ্ ছাড়া কেউ গায়েবের খবর জানেন।
পীর আউলিয়ারা হাজির নাজিরঃ
সুফিদের বিশ্বাস সকল অলি আউলিয়ারা পৃথিবীর যেকোনো জায়গায় হাজির এবং নাজির। অর্থাৎ তাঁরা পৃথিবীর যেকোনো জায়গায় যেকোনো মূহুর্তে যেতে পারেন এবং দেখতে পারেন।
সর্বত্র হাজির ও নাজির গুণটি একমাত্র আল্লাহর। শুধুমাত্র আল্লাহ্ই পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তের যেকোনো সময়ের যেকোনো ঘটনা অবলোকন করতে পারেন এবং তিনি তাঁর সর্বময় ক্ষমতা দ্বারা উপস্থিতও থাকেন। সুতরাং আল্লাহর নিজস্ব কোনো গুণকে তাঁর কোনো সৃষ্টির সাথে তুলনা করলে তা হবে সরাসরি শির্ক।
কোনো পীর আউলিয়া নয়, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাজির নাযিরের ক্ষমতা থাকলে হিজরতের প্রয়োজন ছিল না। কারন মূহুর্তেই মক্কা থেকে মদিনা আবার মদিনা থেকে মক্কা যাওয়া আসা করতে পারতেন। অথবা শত্রু পক্ষের যেকোনো গোপন সংবাদ বা যেকোনো বিপদের আশংকা তিনি আগেই জেনে নিতে পারতেন সেখানে উপস্থিত হয়ে।
আল্লাহ রব্বুল আলামিন বলেন,
"তোমরা যদি নবীকে সাহায্য না কর, তাহলে কোন পরোয়া নেই৷ আল্লাহ তাকে এমন সময় সাহায্য করেছেন যখন কাফেররা তাকে বের করে দিয়েছিল, যখন সে ছিল মাত্র দু’জনের মধ্যে দ্বিতীয় জন, যখন তারা দু’জন গুহার মধ্যে ছিল, তখন সে তার সাথীকে বলেছিল, চিন্তিত হয়ো না, আল্লাহ আমাদের সাথে আছেন৷ সে সময় আল্লাহ নিজের পক্ষ থেকে তার ওপর মানসিক প্রশান্তি নাযিল করেন এবং এমন সেনাদল পাঠিয়ে তাকে সাহায্য করেন, যা তোমরা দেখনি এবং তিনি কাফেরদের বক্তব্যকে নীচু করে দেন৷ আর আল্লাহর কথা তো সমুন্নত আছেই৷ আল্লাহ পরাক্রমশালী ও প্রজ্ঞাময়৷ "(তাওবা ৯:৪০)
উপরোক্ত আয়াতটি রাসুলুল্লাহ সাঃএর হিজরতের সাথে সম্পর্কিত। তিনি যদি সবখানেই যেতে পারতেন তাহলে হিজরতের প্রয়োজন ছিলো কেন?
কুরায়শরা রাসুলুল্লাহ (সাঃ) তার মিরাজের ঘটনা কেন্দ্র করে বায়তুল মুকাদ্দাসের এমন সব বিষয় সম্পর্কে জিজ্ঞেস করতে লাগল যা তিনি দেখেন নি। ফলে তিনি খুবই চিন্তিত হয়ে পড়লেন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাজির নাযিরের ক্ষমতা থাকলে তিনি চিন্তিত হতেন না। কেননা মূহুর্তেই তিনি বায়তুল মুকাদ্দাস গিয়ে সব দেখে আসতে পারতেন। এই সম্পর্কিত হাদীসে এসেছে,
যুহায়র ইবন হারব (র)……আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেছেন যে, রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেনঃ আমি হাজরে আসোয়াদের কাছে ছিলাম। এ সময় কুরায়শরা আমাকে আমার মিরাজ সম্পর্কে প্রশ্ন করতে শুরু করে। তারা আমাকে বায়তুল মুকাদ্দাসের এমন সব বিষয় সম্পর্কে জিজ্ঞেস করতে লাগল, তা আমি ভালভাবে দেখিনি। ফলে আমি খুবই চিন্তিত হয়ে পড়লাম। রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেনঃ তারপর আল্লাহ তাআলা আমার সম্মুখে বায়তুল মুকাদ্দাসকে উদ্ভাসিত করে দিলেন এবং আমি তা দেখছিলাম। তারা আমাকে যে প্রশ্ন করছিল, তার জবাব দিতে লাগলাম। (সংক্ষেপিত, সহিহ মুসলিম, কিতাবুল ঈমান, হাদিস ৩২৮)।
উপরোক্ত হাদীস দ্বারা প্রমাণিত যে, আল্লাহর রাসুল সাঃ যেকোনো স্থানে হাজির নাজির নন। যেখানে আল্লাহ্ ঘোষিত পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মানুষ আল্লাহর বন্ধু মুহাম্মদ সাঃ পৃথিবীর যেকোনো স্থানে হাজির নাজির নয়। সেখানে অঘোষিত একজন পীর বা অলী কি করে পৃথিবীর যে কোন স্থানে হাজির নাজির থাকতে পারেন? সুফিদের এ ধরনের বিশ্বাস শির্ক যা তাদের ইসলাম থেকে বহু দুরে নিক্ষেপ করেছে।
পীরের দ্বারা গুনাহ ক্ষমাঃ
আল্লাহ্ অবশ্যই তাঁর বান্দাদের গুনাহ ক্ষমা করেন। তিনি এটাই পছন্দ করেন যে, তাঁর বান্দারা গুনাহ করলে যেন তাঁর কাছে ক্ষমা চায়। এবং তিনি অবশ্যই তাদের ক্ষমা করে দিবেন। কারণ তিনি ক্ষমাশীল।
আর সুফিদের আকিদা হলো বান্দা যখন পাপ করতে করতে চরম পাপী বনে যায়, তখন আল্লাহ্ তার গুনাহ ক্ষমা করেন না। তাই ঐ গুনাহগার ব্যক্তিকে পীর ধরে সেই পীরের মধ্যস্থতায় তার উছিলা বা মাধ্যমে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইতে হবে। তাহলে আল্লাহ্ ঐ পীরের দিকে তাকিয়ে সেই পাপী বান্দাকে ক্ষমা করে দিবেন। অথচ আল্লাহ্ বলেন,
" (হে নবী,) বলে দাও, হে আমার বান্দারা যারা নিজের আত্মার ওপর জুলুম করেছো আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না৷ নিশ্চিতভাবেই আল্লাহ সমস্ত গোনাহ মাফ করে দেন৷ তিনি ক্ষমাশীল ও দয়ালু৷ ফিরে এসো তোমারে রবের দিকে এবং তাঁর অনুগত হয়ে যাও তোমাদের ওপর আযাব আসার পূর্বেই৷ তখন কোন দিক থেকেই আর সাহায্য পাওয়া যাবে না৷ (সুরা জুমার ৩৯:৫৩-৫৪)।
আল্লাহ্ পবিত্র কুরআনে স্পষ্ট করে ঘোষণা দিচ্ছেন যে, যেকেউ যতই পাপ করুন না কেন সে যেন আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ না হয়। যত পাপই মানুষ করুক না কেন আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইলে তিনি অবশ্যই তা ক্ষমা করে দিবেন।
সুতরাং আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হওয়া কুফরি কাজ। কেননা একমাত্র কাফিররাই আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়। শুধু তাইনয় আল্লাহ্ ছাড়া আর কারো কাছে ক্ষমা চাওয়া বা মধ্যস্ততা করা সরাসরি শির্ক। তাই সুফিদের এই বিশ্বাস সম্পূর্ণ ভুল যে পাপ করলে সেই পাপ ক্ষমা পাওয়ার জন্য মাধ্যম বা পীরের প্রয়োজন হবে।
ফিরে আসুনঃ
আল্লাহ্ বলেন তাঁর কাছে সবচেয়ে পছন্দনীয় আমল হচ্ছে কোনো বান্দা পাপ করলে, তওবা করে তাঁর দিকে ফিরে আসা। পবিত্র হাদীসে এই বিষয়ে চমৎকার ঘটনা দ্বারা আল্লাহর রাসুল আমাদের শিক্ষা দিয়েছেন।
"তোমাদের কেউ মরুভূমিতে হারিয়ে যাওয়া উট খুঁজে পেয়ে যতটা খুশি হয়, আল্লাহ তায়ালা বান্দার তওবায় তার চেয়েও অনেক বেশি খুশি হন। (বোখারি : ৬৩০৯) সুবহানাল্লাহ!"
আল্লাহ্ বলেন,
"তোমাদের পালনকর্তা তোমাদের মনে কী আছে তা ভালোই জানেন। যদি তোমরা সৎ হও, তবে তিনি তওবাকারীদের জন্য ক্ষমাশীল"। (বনি ঈসরাইল ২৫)"
আসুন সংশোধিত হয়ে ইসলামের সঠিক আকিদার ঈমান নিয়ে নিজেকে পরিশুদ্ধ করি। আল্লাহ্ বলেন,
"অতঃপর যে তওবা করে স্বীয় অত্যাচারের পর এবং সংশোধিত, নিশ্চয় আল্লাহ তাঁর তওবা কবুল করেন। নিশ্চয় আল্লাহ ক্ষমাশীল, দয়ালু"। (সূরা আল মায়িদাহ ৩৯)"
সুতরাং আমাদের উচিত হবে আল্লাহ্ কে সঠিক রব হিসাবে মেনে তাঁর দিকে ফিরে যাওয়া। অবশ্যই আল্লাহর অলিরা সত্য। তবে তা ততটুকু যতটুকু আল্লাহ্ দিয়ে থাকেন। জীবিত আল্লাহর অলিদের থেকে সবাই দোয়ার মাধ্যমে দুনিয়াবী যেকোনো প্রয়োজন হাসিল করতে করা যায়। এতে কোনো বাঁধা বিপত্তি নেই। কিন্তু মৃত্যুর পরও তাদের দিকে যাওয়া, চাওয়া এবং পাওয়া মনে করা সুস্পষ্ট গোমরাহী।
আল্লাহ্ বলেন,
"আর যে ব্যক্তি আল্লাহর স্বরন থেকে মুখ ফিরে নেয়, আমি তার জন্য নিয়োজিত করি এক শয়তান, অতঃপর সে হয় তার (সর্বক্ষণের) সাথী"। ( সূরা যুখরুফ- ৩৬)"
যে আল্লাহকে ডাকে না তার জন্য আল্লাহ্ নিজেই একজন শয়তান নিয়োগ করে দেন। পরিশেষে শয়তানই হয় তার নিত্যদিনের সঙ্গী। অতএব আমাদের উচিত হবে শুধুমাত্র আল্লাহর দিকে যাওয়া এবং চাওয়া।
কীভাবে চাইবোঃ
আমরা যেহেতু আল্লাহর বান্দা বা দাস, সেহেতু যেকোনো প্রয়োজনে তাঁর কাছেই চাইতে হবে।
আল্লাহ্ বলেন,
" তোমরা আমার কাছে দোয়া করো। আমি তোমাদের দোয়া কবুল করব"(সূরা মুমিন, আয়াত ৬০)
যেখানে আল্লাহ্ সরাসরিই বলছেন দোয়া করার জন্য। এবং তিনি এই গ্যারান্টিও দিচ্ছেন যে, দোয়া কবুলও তিনি করবেন তিনি। সুতরাং আমাদের উচিত হবে তাঁর কাছে চাওয়া। কেননা তিনি বান্দার চাওয়াকে পছন্দ করেন। আল্লাহ্ কে ডাকা সম্পর্কে কুরআনে তিনি বলেন,
‘আল্লাহর রয়েছে সুন্দর সুন্দর নাম। সুতরাং তোমরা তাঁকে সে নামেই ডাকবে"। (সুরা : আরাফ, আয়াত : ১৮০)
"‘তারা ছিল সৎকাজে প্রতিযোগী, তারা আশা ও ভয় নিয়ে আমার প্রার্থনা করত। তারা ছিল আমার প্রতি বিনীত" (সুরা : আম্বিয়া, আয়াত : ৯০)
‘"তোমরা তোমাদের প্রভুর প্রার্থনা করো গোপনে অশ্রুসিক্ত হয়ে"। (সুরা : আরাফ, আয়াত : ৫৫)"
উল্লেখিত আয়াত গুলোর মত আমাদেরও উচিত হবে সেইভাবেই আল্লাহ্ কে ডাকা। যাতে তিনি আমাদের ডাকা সাড়া দেন। সেইসাথে দ্বীনের ক্ষেত্রে আমাদের অনুসরণ করতে একমাত্র রাসুলুল্লাহর সাঃ এর। কেননা তিনিই হচ্ছেন আমাদের মানদন্ড। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ্ বারংবার তাঁর প্রেরিত রাসুলের অনুসরণ এবং আনুগত্যের কথাই বলেছেন।
উপরোক্ত আলোচনা থেকে এটাই প্রমাণিত যে, পৃথিবীর যাবতীয় ক্ষমতার মালিক হচ্ছেন। কুরআন হাদীস থেকে এটা প্রমাণিত নয় যে আল্লাহ্ তাঁর ক্ষমতা কাউকে ভাগ করে দিয়েছেন বা সাব কন্টাক্ট দিয়েছেন। সুতরাং সুফিবাদী সুন্নীদের যে আকিদা পীর আউলিয়ারাই সকল ক্ষমতার মালিক তা সম্পূর্ণ কুফুরি আকিদা। আল্লাহ্ আমাদের সঠিক বুঝার তৌফিক দিন আমিন।
সাখাওয়াতুল আলম চৌধুরী
৯ ডিসেম্বর, ২০২১
পতেঙ্গা, চট্টগ্রাম।