সুফি সুন্নীদের মাজার সম্পর্কিত আকিদার জবাব
সুফি সুন্নীরা ইসলামের শরিয়ত সম্পর্কে এমন এমন সব আকিদা পোষণ করে যা কখনোই ইসলাম দ্বারা স্বীকৃত নয়। এইসব ভ্রান্ত আকিদা সমূহ এমন যে, তা একজন ঈমানদারকে মুশরিকে পরিনত করে ঈমান হারা করে দেয়। এখন আমরা কুরআন এবং সহীহ্ হাদিসের আলোক সুফি সুন্নীদের শরিয়তের মাজার বা দরগাহ সম্পর্কিত আকিদার জবাব পাওয়ার চেষ্টা করবো ইনশাআল্লাহ।
মাযার বা দরগাহ
মাযার একটি আরবী শব্দ যার অর্থ দর্শনীয় স্থান। যার ধাতুগত অর্থ ‘যিয়ারতের স্থান’। মাজার শব্দটি শুধু বাংলাতেই ব্যবহৃত হয়। দরগাহ ফারসী শব্দ যার অর্থ একই অর্থাৎ পরিদর্শনের স্থান, দর্শনীয় স্থান বা রাজসভা। তাই মাজার কে বলা যায় ফারসী দরগাহ শব্দের প্রতিশব্দ।
উপমহাদেশে মাজার বলতে সাধারণত আওলিয়া দরবেশগণের কবরকে বোঝায়। সুফিবাদীরা সুফীদের কবরস্থান যিয়ারত করতে পছন্দ করেন। তারা করব কেন্দ্রিক উরস অর্থাৎ জন্ম-মৃত্যুবার্ষিকী পালিত করে। তাদের আকিদাই হলো কবর কেন্দ্রিক। কবরকে তারা ইবাদতের স্থান আশা পূরণের স্থান উদ্ধার হওয়ার স্থান বলে মনে করে।
ভারতীয় উপমহাদেশের আজমীরে খাজা মঈনউদ্দীন চিশতির মাজার, দিল্লিতে নিযামউদ্দীন আওলিয়ার মাজার, লাহোরে ফরিদউদ্দীন গঞ্জ-এ-শাক্কারের মাজার, সিলেটে হযরত শাহ জালালের ও হযরত শাহ পরাণের মাজার মাজার, রাজশাহীর শাহ মখদুম মাজার, ঢাকায় শাহ আলী বাগদাদীর মাজার, খুলনায় খানজাহান আলীর মাজার ইত্যাদি।
আরও পড়ুন বিদআত কী এবং এর পরিনাম
চট্টগ্রাম মাজারের শহর হিসেবে খ্যাত, কারণ সেখানে বারো-আওলিয়ার মাজার আছে। সকল পুরুষ মুসলমানের কবরই যিয়ারত করা বৈধ। মুসলমানের দাফনস্থলকে বলা হয় কবর। বুযুর্গ, নেককার ও ওলিদের দাফনস্থলকে মাজার না বলে কবর বলাই উত্তম। কেননা, নবী, রাসূল, সাহাবি, তাবেয়ী, তাবে-তাবেয়ি, ওলি-বুযুর্গ কারও কবরকে কুরআন-হাদীসে কোথাও মাজার শব্দ ব্যবহার হয়নি। তাই কোন কবরকে মাজার বলাতে নেকী নেই। রসুল (সা) কবরকে মাজার বলেন নাই, সাহাবীগণও বলেন নাই। কবর শব্দটি কুরআনে মোট আটবার এসেছে। মহান আল্লাহ বলেন, "এবং যখন কবরসমূহ উম্মোচিত হবে," [সুরা ইনফিতার ৮২:৪]
সুতরাং কবরকে কবর বললে আমরা সওয়াবের আশা করতে পারি। কারণ এটা কুরআনের শব্দ হাদীসে সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ নবীদের দাফনস্থলকেও কবর বলা হয়েছে। এমনকি হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কবরকেও কবর শব্দেই উল্লেখ করা হয়েছে।
যেমনঃ সহীহ বুখারীতে বর্ণিত একটি হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন- ইহুদী ও নাসারাদের উপর আল্লাহর লা’নত, কারণ তারা তাদের নবীদের কবরগুলোকে সিজদার স্থান বানিয়েছে। (সহীহ বুখারী ১/১৮৬) এই হাদীসে নবীদের দাফনস্থলকে কবর বলা হয়েছে। সুতরাং বোঝা গেল, যত সম্মানিত ব্যক্তিই হোক তার দাফনস্থলকে কবর বলাই উত্তম।
অথচ সুফিরা নিজেদের কবরকে মাজার উল্লেখ করে যাবতীয় বিদআতী নাজায়েজ ইসলাম বিরোধী কার্যকলাপে লিপ্ত। কবর উল্লেখ করলে তো এইসব অনৈসলামিক কার্যক্রম চালানো সম্ভব হতো না।
আরও পড়ুন বিদআত মানে সুন্নাত বিদায়
রওজা বা রওজা শরীফ
সুফিরা রাসুলুল্লাহ সাঃএর কবরকে এবং তাদের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ পীর আউলিয়াদের করবকে রওজা বলে উল্লেখ করেন। রওজা একটি আরবী শব্দ। যার অর্থ বাগান বা উদ্যান। সহিহ হাদিসে রওজা শব্দটি এসেছে। "আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। আমার ঘর ও আমার মিম্বরের মধ্যবর্তী স্থান জান্নাতের (রওজা) বাগান সমূহ হতে একটি বাগান। আর আমার মিম্বর আমার হাউজের ওপরে অবস্থিত। (সহিহ বুখারি ইঃফাঃ – ৬১৩৭)
মহানবী (সাঃ) কবরকে রওজা বলেছেন বা বলতে বলেছেন এমন কোন প্রমাণ নেই। কুরআন বা হাদীসে কোথাও কবরকে রওজা বলা হয় নাই। সাহাবীগণও বলেন নাই, তাবেয়ীগণও বলেন নাই। সুতরাং যারা পূণ্যবান ব্যক্তিগণের কবরকে ‘রওজা পাক’, ‘রওজা মোবারক’ বা ‘রওজা শরীফ’ বলে তা কবরের প্রতি তাদের ভক্তি বা শ্রদ্ধা প্রকাশের জন্যই বলে। এই ভক্তি বা শ্রদ্ধার বিষয়টি তাদের আকিদা বা বিশ্বাসে পরিণত হয়ে যায়। ফলে এটা শির্ক পর্যন্ত পৌঁছে যায়। যা আমরা সুফিদের আকিদায় পাচ্ছি।
এক হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর নিজের ব্যাপারেই বলেন, আমার কবরকে তোমরা উৎসবের স্থান বানিও না। (সুনানে আবু দাউদ ১/২৭৯)।
স্বয়ং সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর নিজের কবরকে যেখানে করব বললেন সেখানে সুফিরা কীভাবে তাকে রওজা বলে? কবরকে কবর বলাই ইসলামী পরিভাষা। কবরকে রওজা, দরগাহ, মাজার বলা যাবে না। সুফিরা এইসব বলে সাধারণ মুসলমানদের মধ্যে কবর প্রীতি সৃষ্টি করে। যে প্রীতি থেকে ভক্তি আসে ভক্তি থেকে বিশ্বাস এবং সর্বশেষে আসে শির্ক।
আরও পড়ুন জন্মগত মুসলিম ধর্মমতে মুসলিম
মাজার জিয়ারত
সুফিদের গুরুত্বপূর্ণ আমলের মধ্যে একটি আমল হলো অলি আউলিয়াদের করব বা মাজার জিয়ারত করা। তারা নারীপুরুষ সম্মিলিতভাবে মাজার জিয়ারতের উদ্দেশ্যে গমন করে। তারা এটা এইজন্যই করে যাতে তারা সেখান থেকে পূন্য বা সওয়াব অর্জন এবং মনের বাসনা পূরণ করতে পারে। অথচ সুস্পষ্ট সহীহ্ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত কোনো কবরকে প্রথমত পাকা, চুনকাম, ছাউনি ইত্যাদি দ্বারা আলাদা করে চিহ্নিত করা যাবে না। দ্বিতীয়ত কবরের কাছে যাওয়া যাবে শুধুমাত্র পরকালের চিন্তা নিয়ে।
ইসলামের শুরুর দিকে কবর জিয়ারত নিষিদ্ধ ছিলো। কারণ মুশরিকগন করবকে উপলক্ষ্য করে বিভিন্ন শির্কি কাজ করতো। অর্থাৎ তারা কবরকে কেন্দ্র করে কবর পূজা, কবরবাসীর কাছে চাওয়া পাওয়া ইত্যাদির চর্চা করতো। সুতরাং যতদিন মুসলমানদের ঈমান পরিপূর্ণ হয়নি, ততদিন কবর জিয়ারত নিষিদ্ধ ছিলো। পরবর্তীতে যখন মুসলমানরা প্রকৃত ঈমানে বলীয়ান হলো তখনই কবর জিয়ারতের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। তবে নারীদের অনুমতি দেওয়া হয়নি। হাদীসে এসেছে,
আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস (রাঃ) হতে বর্নিত; তিনি বলেছেন-রাসূল (ﷺ) কবর যিয়ারাতকারিনী মহিলাদেরকে এবং যারা কবরকে মাসজিদে (উপাসনার স্থানে) পরিনত করে আর যারা কবরে বাতি জ্বালায় তাদেরকে লা’নত করেছেন। [তিরমিযী,আবূ দাউদ,২য় খন্ড,৪৬১ পৃঃ,নাসায়ি,ইবনু মাজাহ]
এখানে স্পষ্ট কবরে সিজদা এবং বাতি জ্বালানো যাবে না। কিন্তু সুফিরা যে আকিদায় এবং যে পদ্ধতিতে কবর জিয়ারত করে তা কখনোই ইসলাম সম্মত নয়। প্রথমত তারা অলি আউলিয়াদের কবরে যায় কবরবাসী থেকে সাহায্য চাইতে। যেকোনো বিপদে উদ্ধার হওয়ার জন্য কবরে গিয়ে প্রার্থনা করে। সেখানে গিয়ে মোমবাতি জ্বালায়, বিভিন্ন গাছে মান্নতের উদ্দেশ্যে রশি বা দড়ি বাঁধে। যা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ কাজ গুলোর মধ্যে অন্যতম। আল্লাহ্ বলেন, "হে নবী, তুমি কবরে শায়িতদের কথা শুনাতে সক্ষম না। " (সূরা ফাতির-২২)
অর্থাৎ যারা কবরে আছে তাদেরকে কেউ ডাকলে তারা শুনতে পায় না সাহায্য বা উপকার করার জন্য। যেখানে নবী সাঃ কবরবাসীকে শোনাতে সক্ষম নন। সেখানে সুফিদের পীর আউলিয়াদের কীভাবে তাদের ভক্তরা শোনাতে সক্ষম হচ্ছেন?
আরও পড়ুন পূর্বপুরুষদের অন্ধ অনুসরণ
সুফিরা কবর জিয়ারতকে ঈমান আমলের পর্যায়ে নিয়ে গিয়ে শিরকে লিপ্ত হয়ে আছে। কেননা আল্লাহ্ ছাড়া কারো কাছে কোনো কিছু চাওয়া জায়েজ নয়। কেননা সকল ক্ষমতার অধিকারী একমাত্র আল্লাহ্। তিনি ছাড়া আর কারোরই কোনো ক্ষমতা নেই কারো উপকার অপকার করার। যা ইতিমধ্যে বিস্তারিত আলাপ করা হয়েছে।
আরও পড়ুন প্রবৃত্তির অনুসরণ এবং তার পরিনতি
পীর আউলিয়ার কাছে মান্নত পূরণ
অধিকাংশ সাধারণ মুসলমান সুফিবাদে জড়িয়ে পড়ার আরেকটি কারণ হলো দুনিয়াবী সুযোগ সুবিধা। আল্লাহ্ দুনিয়ায় প্রতিটি মানুষকেই পরীক্ষা করবেন এটাই স্বাভাবিক। এই পরীক্ষায় সবাই ধৈর্যের পরিচয় দিতে পারে না। তাই তারা দ্রুত উদ্ধার হওয়ার পথ খুঁজতে থাকে। সাধারণ মানুষদের উৎকণ্ঠা দূর করতে সুফিরা চালু করেছে মান্নতের ব্যবস্থা।
অর্থাৎ যারা সুফিবাদী তারা যেকোনো বিপদে আপদে বা যেকোনো মনোকামনা পূরণ হওয়ার জন্য পীর অলি আউলিয়ার দরবার হাদিয়া তোফাসহ বিভিন্ন কিছু দেওয়ার প্রতিশ্রুতি বা মান্নত করে। সুফিবাদীরা মনে করে তাদের যেকোনো বিপদে বা যেকোনো আশা পূরণের জন্য পীর আউলিয়ার দরবারে কিছু দেওয়ার মানত করলেই বুঝি আল্লাহ্ তাদের উদ্ধার করবেন। সুফিদের এই আকিদাটি খুবই প্রচারিত প্রচলিত এবং ব্যবসাসফল। যেকারণে যেকেউ যেকোনো প্রয়োজনে মানত করে। এই মানত কতটুকু ইসলাম সম্মত তা সাধারণ মানুষেরা কখনোই জানার চেষ্টা করে না।
মানত করার বিধান কি? ফরজ, ওয়াজিব, সুন্নাত না মুস্তাহাব? সত্যি কথা বলতে মানত করা কিছুই নয়। কেননা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মানত করতে নিষেধ করেছেন। হাদীসে এসেছে : আব্দুল্লাহ ইবনে উমার রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেছেন: ‘"রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একদিন আমাদের মানত করতে নিষেধ করেছেন। আর বলেছেন: মানত কোনো কিছুকে ফেরাতে পারে না। তবে মানতের মাধ্যমে কৃপণ ব্যক্তির সম্পদ বের করা হয়।" (সহিহ মুসলিম, হাদীস নং ৪৩২৫)
অন্য হাদীসে এসেছে, ইবনু উমার রা. থেকে বর্ণিত, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ "মানত কোনো কিছুকে আগেও করে না, পিছেও করে না। বরং এর দ্বারা কেবল কৃপণ ব্যক্তি থেকে বের করা হয়। " (সহিহ মুসলিম, হাদীস নং ৪৩২৬, সহিহ সুনান নাসায়ি)
ইবনু উমার রা. থেকে বর্ণিত, ‘নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মানত করতে নিষেধ করেছেন। আর বলেছেনঃ "মানত কোনো কল্যাণ বয়ে আনে না। এটা শুধু কৃপণ ব্যক্তি থেকে সম্পদ বের করে নেয়। "(সহিহ মুসলিম, হাদীস নং ৪৩২৭, আহমাদ)
আবু হুরাইরা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ "তোমরা মানত করবে না। কেননা মানত তাকদীরের কোনো কিছু-কে ফেরাতে পারে না। এটা শুধু কৃপণ থেকে সম্পদ খসায়। " (সহিহ বুখারি ও মুসলিম, হাদীস নং ৪৩২৯, সহিহ সুনান তিরমিজি, সহিহ সুনান নাসায়ি)
সাহবি আবু হুরাইরা রা. থেকে বর্ণিত, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ "যেই বস্তু মহান আল্লাহ আদম সন্তানের জন্য নির্ধারণ করেননি মানত সেটি তার নিকটবর্তী করে না। বরং তাকদীরে যা আছে মানত সেটাই নিয়ে আসে। এর মাধ্যমে কৃপণ ব্যক্তির সম্পদ বের করা হয় যা সে খরচ করতে চায়নি।" (সহিহ মুসলিম, হাদীস নং ৪৩৩১)
উদ্ধৃত হাদীসগুলো থেকে আমরা জানতে পারলামঃ এক. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মানত করতে নিষেধ করেছেন। অতএব মানত করা ঠিক নয়। অবশ্য মানত করে ফেললে তা পালন করতেই হবে কারণ মানত করলে তা পূর্ণ করা ওয়াজিব হয়ে যায়।
আরও পড়ুন ঈমান আনার পরও যারা পথভ্রষ্ট
দুই. মানত করার মাধ্যমে কৃপণ ব্যক্তির সম্পদ বের করা হয়। এ কথা বলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বুঝিয়েছেন, মানত করা একটি অনর্থক কাজ। সাধারণত কৃপণ স্বভাবের লোকেরা মানত করে থাকে। তারা সুস্থ ও নিরাপদ থাকা কালে দান-সদকা করে না। কিন্তু বিপদে পড়লে আল্লাহর পথে খরচ বা দান সদকা করার বড় বড় মানত করে।
তিন. তাকদীরে যা লেখা আছে তা হবেই। মানত করার মাধ্যমে তাকদীরের লেখা পরিবর্তন করা যায় না। তাকদীরের প্রতি যাদের যথাযথ ঈমান নেই সাধারণত তারাই মানত করে থাকে।
চার. মানত করা হোক বা না হোক। ফলাফল একই হবে। তাকদীরে যা লেখা আছে সেটাই আসবে অবধারিতভাবে।
পাঁচ. আলোচিত সবগুলো হাদীসই মানত না করার জন্য মুসলিমদেরকে নিরুৎসাহিত ও নিষেধ করেছে। রাসুলুল্লাহ সাঃ বলেছেন মানত কোনো ফল বয়ে আনে না বরং শুধু কৃপণের সম্পদ খরচ করায়। এ সকল বিষয় জানার পর কোনো মুসলিমের পক্ষে কোনো প্রকার মানত করা উচিত নয় ।
আরও পড়ুন বর্তমান সমাজের মুনাফিকদের পরিচয় ও পরিনতি
উপরোক্ত হাদিস থেকে আমরা বুঝতে পারলাম মানত করা রাসুলুল্লাহর সুন্নাহ নয়। তারপরও মানত করা হারাম নয়। তবে মানতের উদ্দেশ্য একমাত্র আল্লাহ্ কেন্দ্রিক হতে হবে। অথচ সুফিরা মানতের যে প্রথা বা আকিদা পোষণ করে তা তাদের পীর আউলিয়া কেন্দ্রিক। যা জায়েজ তো নয়ই বরং শিরক। পীর আউলিয়াদের নামে মানত করার সাথে সাথে ঈমান নষ্ট হয়ে যাবে। এব্যাপারে আল্লাহ্ স্পষ্ট করে বলেন, "অধিকাংশ মানুষ আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে, কিন্তু সাথে সাথে শিরকও করে।" (সূরাঃ ইউসূফ, আয়াতঃ ১০৬)
সুতরাং মাজার দরগাহ ইত্যাদিতে মানত করার কারণে সুস্পষ্ট শিরক হয়। যা ঈমান ভঙ্গের কারণ।
কবরবাসীর মাজারে সিজদা
সুফি সুন্নীদের আকিদা হলো তাদের পীর আউলিয়ারা যারা কবরে চলে গেছে, তাদের কবরে সেজদা করা জায়েজ। তাদের দাবি এটা তাজিমী বা সম্মানসূচক সেজদা। যে সেজদা ফেরেশতারা হযরত আদম আঃ কে, ইউসুফ আঃ কে তাঁর পরিবারবর্গ দিয়েছিল। যদিও এই দুটি ঘটনা ইসলামের শরিয়তের বহির্ভূত।
আরও পড়ুন যা ইসলামী শরীয়তের মানদণ্ড নয়
কেননা প্রথম ঘটনা ঘটেছে জান্নাতে। দ্বিতীয় ঘটনা ঘটেছে ইউসুফ আঃ এর যুগে তাঁর শরিয়ত অনুসারে। সুতরাং এই দুটি ঘটনা কখনোই রাসুলুল্লাহ সাঃ এর শরিয়তের দলিল হতে পারে না। তবে দলিল হতো যদি রাসুলুল্লাহ সাঃ এমন করার নির্দেশ দিতেন এবং সাহাবী তাবেয়ীগণ থেকে এমন আমল যদি আমরা সালফে সালেহীনদের মাধ্যমে জানতে পারতাম। অথচ আমরা হাদিসের সুন্নাহ থেকে এর বিপরীত শিক্ষা পাই। পবিত্র হাদীসে এসেছে, "রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন ‘সাবধান! তোমাদের পূর্বে যারা ছিল, তাদের নবীগণ ও সৎ ব্যক্তিদের কবরসমূহকে মসজিদ ও সেজদার স্থানে পরিণত করা হয়েছে। সাবধান! তোমরা কবরসমূহকে মসজিদ ও সেজদার স্থানে পরিণত কর না। আমি তোমাদেরকে এ থেকে নিষেধ করছি।" (মুসলিম : ১২১৬)।
উপরোক্ত এই সহীহ্ হাদীস সুস্পষ্টভাবে আজকের উপমহাদেশের মাজার গুলোর দিকে ইংগিত করে। যেখানে সুফিদের সব আল্লাহ্র অলির কবর আর কবরের পাশেই মজসিদ এবং কবরকে সেজদা করার স্থান। সুফি সুন্নীরা কবরকে বিনা বাঁধা সেজদা করছে সাওয়াবের নিয়তে।
আরও পড়ুন সুফিবাদের শরীয়তের উৎস ও যৌক্তিকতা
যে রাসুল আমাদের ইসলাম দিয়ে গেছে, সেই রাসুলের নির্দেশ অমান্য করে কীভাবে সুফি সুন্নীরা নিজেদের ঈমানদার দাবি করে। অনুরূপ হাদীস রয়েছে বুখারি : ১৩৪৩; মুসলিম : ১২১২। কবর সম্পর্কিত রাসুলুল্লাহ সাঃ এর খুব বেশী নিষেধাজ্ঞা ছিলো। অসংখ্য সহীহ্ হাদীসে এই বিষয়ে এসেছে।
হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, "রাসুলুল্লাহ (সা.) অভিশাপ করেছেন ওই সব স্ত্রী লোকের প্রতি যারা কবর জিয়ারত করতে যায় এবং ওই সব লোকের প্রতি যারা কবরের ওপর মসজিদ নির্মাণ করে ও বাতি জ্বালায়।" (আবু দাউদ : ৩২৩৮; তিরমিজি : ৩২১; নাসায়ি : ২০৫৫)।
হজরত জাবের (রা.) বলেন, "রাসুলুল্লাহ (সা.) কবরে চুনকাম করতে, এর ওপর ঘর তুলতে এবং এর ওপর বসতে নিষেধ করেছেন।" (মুসলিম : ২২৮৯)
হজরত আতা বিন ইয়াছার (রা) বলেন, "রাসুল (সা.) একদা এই দোয়া করলেন ‘হে আল্লাহ! আমার কবরে প্রতিমা স্থাপন কর না যার পূজা হতে থাকবে। আল্লাহর কঠোর রোষে পতিত হয়েছে সেই জাতি যারা তাদের নবীদের কবরসমূহকে মসজিদ ও সেজদার স্থানে পরিণত করেছে।" (মুয়াত্তা মালেক : ৪১৯)
রাসুল আরও বলেন, "তোমরা কবরের ওপর বস না এবং এর দিকে নামাজ পড় না।’ (মুসলিম : ২২৯৪)
উপরোক্ত হাদিস গুলো বিশ্লেষণ করলে যেকোনো ঈমানদারের কাছে এটা স্পষ্ট হবে যে, কবর সম্পর্কে রাসুলুল্লাহ সাঃএর কত ধরনের হুশিয়ারি ছিলো। আর আজ সুফি সুন্নীরা মুখে রাসুল প্রেমের কথা বলে তাঁর আদর্শের বিরুদ্ধে কাজ করে যাচ্ছে অনায়াসেই। যা কখনোই ইসলাম সম্মত নয়। এমন আকিদা পোষণকারী কখনোই মুমিন মুসলিম হতে পারে না।
উপরোক্ত আলোচনা থেকে কুরআন হাদিসের আলোকে এটা স্পষ্ট হলো যে, অলি আউলিয়াদের কবরের মাজারকে নিয়ে সুফি সুন্নীদের যে আকিদা তা সুস্পষ্ট ইসলামের শরিয়তের বিরোধী। শুধু তাই নয় কবর সম্পর্কে তাদের যে আকিদা এবং মনোবাসা তা স্পষ্টতই ঈমান বিধ্বংসী। সুতরাং যারা এইসব আকিদা পোষণ করে তারা কখনোই কুরআন হাদিসের আলোকে মুমিন মুসলিম হতে পারে না।
কৃতজ্ঞতাঃ
মোহাম্মাদ ইস্রাফিল হোসাইন। (বিএ ইন আরবি সাহিত্য ও ইসলাম শিক্ষা)
সাখাওয়াতুল আলম চৌধুরী
১০ মার্চ, ২০২২
পতেঙ্গা, চট্টগ্রাম।