বিদআত মানে সুন্নাত বিদায়
বিদআত মানে সুন্নাত বিদায় |
আমরা যারা উপমহাদেশের মুসমান তাদের মধ্যে ধার্মিকতা নয় বরং ধর্মান্ধতা ব্যাপকহারে বিস্তৃত। আমরা নিজেদের ধর্মভীরু বলে মনে করি। কিন্তু ইসলাম নিয়ে জ্ঞানার্জনের কোনো চেষ্টা নেই। ধার্মিকতার প্রথম এবং প্রধানতম শর্ত হলো সঠিক জ্ঞান। যার সঠিক জ্ঞান নেই সে কখনোই প্রকৃত ধার্মিক হতে পারে না। যদি কেউ জ্ঞানহীন থেকে নিজেকে ধার্মিক দাবি করে তাহলে সে লোক দেখানো ধার্মিক।
ধর্মীয় বিশ্বাস এবং আমল নিয়ে ঠিক এমনই বিষয় চালু আছে আমাদের উপমহাদেশে। আমরা আজ আমলের ক্ষেত্রে এমন কিছু বিষয় অনুসরণ করছি যা ইসলাম দ্বারা স্বীকৃত নয়। কেননা উপমহাদেশে যে ইসলাম চালু আছে তা হচ্ছে সুফিবাদের সুফি সুন্নি ইসলাম।
ইসলামে বিদআত হচ্ছে এমনই একটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, যা নিয়ে সঠিক জ্ঞান না থাকার কারণে আজ উপমহাদেশের মুসলমানগণ বিভ্রান্ত। উপমহাদেশে সুফি সুন্নিরা বিদআতে এতোটাই জড়িত হয়ে গেছে যে রাসুল (সা:) এর সহিহ সুন্নাহ পর্যন্ত ছেড়ে দিয়েছে। আজ আমরা জানার চেষ্টা করব বিদআতের মাধ্যমে কীভাবে রাসুলুল্লাহর (সা.) সুন্নাহ ছেড়ে দিয়ে বিদআতী হয়ে গেছি।
আরও পড়ুন উছিলা কী? উছিলার বিস্তারিত ব্যাখ্যা
বিদআতে কীভাবে সুন্নাহ বিদায়
উপমহাদেশে সুফি সুন্নিরা বিদআতের দৃষ্টিনন্দন আমলের দ্বারা জঘন্য কাজে লিপ্ত। যেসব বিষয়ে সুস্পষ্ট সুন্নাত রয়েছে সেইসব বিষয়ে আজ নতুন নতুন বিদআত সৃষ্টি মাধ্যমে চরম পাপে জড়িত। এখন আমরা দেখব কীভাবে বিদআতের দ্বারা রাসুল (সা:) এর সুন্নাত ধ্বংস হচ্ছে।
জসনে জুলুস কথিত ইদে মিলাদুন্নবী একটি বিদআত |
রাসুলের সা. জন্মবার্ষিকী পালন
রাসুল (সা.) এর জন্মবার্ষিকী পালন করা একটি বিদআত। রাসুল (সা.) থেকে এমন কোনো শিক্ষা পাওয়া যায় না, যেখানে তিনি তাঁর জন্মবার্ষিকী পালন করেছেন। জন্মবার্ষিকী পালন তো দূরের কথা। তখন তো হিজরি ক্যালেন্ডারই ছিলো না যে বছর হিসাব করে জন্মবার্ষিকী পালন করার রীতি চালু হবে!
শুধু তাই নয় রাসুলের জন্মবার্ষিকীর তারিখ নিয়ে এখনো যথেষ্ট মতভাদ রয়েছে। সুতরাং কেউ যদি নেকীর আশায় নতুন করে জাকজমকপূর্ণভাবে রাসুল (সা.) এর জন্মবার্ষিকী পালন করে, তাহলে ঐ ব্যক্তি সুস্পষ্ট বিদআতে লিপ্ত। অথচ জন্ম "দিন" নিয়ে রাসুল (সা.) এর সুস্পষ্ট আমল রয়েছে। হজরত আবু কাতাদা আনসারি রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, রাসুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সোমবার রোজা রাখার কারণ জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন,
এদিনে আমি জন্ম নিয়েছি এবং এদিনেই আমার ওপর কুরআন নাজিল হয়েছে।’ (মুসলিম, আবু দাউদ)
সুস্পষ্ট প্রসিদ্ধ হাদিস দ্বারা প্রমাণিত রাসুল (সা.) প্রতি সোমবার সাওম (রোজা) পালন করতেন। অর্থাৎ আল্লাহর কাছে শুকরিয়া স্বরুপ তিনি সাওম পালন করতেন। শুধু তাইনয় যেখানে রাসুলের (সা.) ওফাতের দিন নির্দিষ্ট। সেই ওফাতের দিনকে তথাকথিত সুফিবাদী সুন্নিরা জন্মবার্ষিকী পালন করছে খাওয়া দাওয়া হই হুল্লোড় করে।
রাসুল (সা.) যেখানে নিজের জন্ম "দিনে" না খেয়ে থেকে তাঁর উম্মতকে সিয়াম সাধনার শিক্ষা দিয়েছেন। সেখানে আমরা তাঁর মৃত্যুর দিনে জন্মবার্ষিকী পালন করছি মিষ্টি মন্ডা বিরিয়ানী খেয়ে।
দৃষ্টিনন্দন এই আমলের দ্বারা আমরা নতুন ইবাদত সৃষ্টির পাশাপাশি রাসুল (সা:) এর সুন্নাহ পরিপন্থী কাজ করছি। এই দিবস পালনের পর থেকে কেউ আর নবীর জন্মদিন উপলক্ষে সিয়াম পালন করে না। যা একটি সুন্নাত।
এখন আমরা জসনে জুলুসের নামে মিছিল মিটিং করছি যা সুন্নাহর পরিপন্থী। যা কখনোই সাহাবিদের দ্বারা প্রমাণিত নয়। সুতরাং এই নব্য ইবাদতের মাধ্যমে আমরা রাসুল (সা:) এর সুন্নাহকে বিদায় দিয়ে বিদআতকে গ্রহণ করছি।
আরও পড়ুন কুরআন ই হিদায়াত প্রকৃত মাধ্যম
ঈদ নিয়ে বিদআত
ইসলামে প্রসিদ্ধ ঈদ হচ্ছে দুটি। যা সুস্পষ্ট সহিহ হাদিস দ্বারা প্রমাণিত। অথচ সুফিবাদী সুন্নি দাবিদার তথাকথিত সুন্নিরা নতুন একটি ঈদের প্রচলন করেছে। যা "ঈদে মিলাদুন্নবী" নামে প্রচার হচ্ছে। শুধু তাই নয় রাসুল (সা.) এর তোষামোদ করতে গিয়ে তারা এই দিনকে সকল ঈদের সেরা ঈদ হিসাবে প্রচারিত করছে।
যেখানে রাসুল (সা.) নিজে দুই ঈদের প্রচলন করে গেছেন। সেখানে তাঁর আশেক প্রেমিক দাবিদারগণ তাঁর-ই (অলিখিত) জন্মবার্ষিকীকে শ্রেষ্ঠ ঈদ হিসাবে প্রচার করছে। যা ইসলামের মূলনীতিতে সুস্পষ্ট বিদআত। এভাবেই সুফি সুন্নিরা দুই ইদের সুন্নাহর পরিবর্তে তিন ইদের প্রচলন করে বিদআত সৃষ্টি করে।
শবেবরাতের রাতের আলোকসজ্জা একটি বিদআত |
শবেবরাত উদযাপন
পবিত্র কুরআন এবং সহিহ হাদিস দ্বারা লাইলাতুম কদর প্রমাণিত হলেও শবেবরাত নামে কোনো আমল ইবাদত ইসলামে প্রচলিত ছিলো না। লাইলাতুল কদরের আলোকে ফার্সি শবেবরাত নামে নতুন একটি দিবস ব্যাপকভাবে পালন করা হচ্ছে। যেসব আয়াতে লাইলাতুল কদরের কথা বলা হয়েছে, সেইসব আয়াত দিয়েই শবেবরাতের দলিল দেওয়া হচ্ছে। যা সুস্পষ্ট গোমরাহী।
এই দিবসটি শুধুমাত্র আমাদের উপমহাদেশে ব্যাপকভাবে পরিচিত। এই দিবসটি নিয়ে সাহাবি তাবেয়িদের থেকে সুস্পষ্ট নির্দেশনা পাওয়া যায় না। শুধু তাইনয় এই দিবসকে ঘিরে উপমহাদেশে যেসব আচার অনুষ্ঠান পালিত হয় তা সন্দেহাতীতভাবে বিদআত। ঐসব আমলের কোনো ভিত্তি রাসুল (সা.) থেকে প্রমাণিত নয়।
তবে শবেবরাত নামে কিছু না থাকলেও "মধ্য শাবানের রাত্রির" কিছু ফজিলত সহিহ হাদিস দ্বারা প্রমাণিত। এছাড়াও অসংখ্য দুর্বল এবং জাল হাদিসেও বিভিন্ন আমল ও ফজিলতের কথা এসেছে। যা আবার অন্যান্য সহিহ হাদিসের বিরোধী। তারপরও, দূর্বল হাদিস দ্বারা যেসব আমলের কথা বলা হয়েছে, তার ধারেকাছেও নেই এইসব বিদআতী সুন্নিরা।
এভাবেই সুন্নিরা নতুন নতুন ইবাদত সৃষ্টি এবং আমল করতে উৎসাহী। যা ইসলাম সম্মত নয় এবং সুস্পষ্ট সুন্নাহ বিরোধী। এভাবে তারা বিদআতের দ্বারা সুন্নাহকে ধূলিসাৎ করে দিচ্ছি।
শবেবরাতঃ আমাদের করণীয় ও বর্জনীয়
চল্লিশা একটি সুন্নাহ বিরোধী বিদআত |
ইসালে সওয়াবের নামে চল্লিশা
ইসলামে চল্লিশা নামে কোনো অনুষ্ঠান নেই। মৃত ব্যক্তির কবরে নেকী পাঠানোর জন্য সুফিবাদী সুন্নিরা সুনির্দিষ্ট দিনক্ষণ ঠিক করে ব্যাপক খাওয়াদাওয়ার আয়োজন করে। যার উদ্দেশ্য হলো মৃত ব্যক্তির কবরে নেকী পৌঁছানো। তাদের বিশ্বাস মানুষকে এই ভোজন না করালে তাদের মৃতের আত্মা দুনিয়ায় ঘুরপাক খেতে থাকে। যা সুস্পষ্ট হিন্দু সনাতনী ধর্মের শ্রাদ্ধের মতো।
অথচ ইসলামে রাসুল (সা.) বা সাহাবিদের থেকে এমন কোনো দলিল পাওয়া যায় না যে, মৃত ব্যক্তির কবরে দোয়া পৌঁছানোর জন্য সুনির্দিষ্ট দিনক্ষণ ঠিক করে মানুষকে খাওয়ানো হয়েছে। যদিও তখন দরিদ্র এবং ক্ষুধার্তের সংখ্যা বেশী ছিলো। সাধারণ মুসলমানগন প্রশ্ন করে থাকেন মানুষ খাওয়ানো তো খারাপ কাজ নয়। তাহলে এটা কেন বিদআতের নাম দিয়ে খারাপ বলবেন? তাদের জন্য সহজ উত্তর হলো, কোনো বিদআতই দৃষ্টিগতভাবে খারাপ নয়। খারাপ হলে কখনোই মানুষ এইসব করতো না।
কিন্তু যখনই কোনো আমল করা হবে ইবাদতের উদ্দেশ্যে অর্থাৎ সওয়াবের জন্য। তখনই আমাদের দেখতে হবে এই ইবাদত রাসুল (সা.) করেছেন কিনা। তাঁর সাহাবিদের থেকে প্রমাণিত কিনা। যদি তাই না হয় তাহলে এটা সুস্পষ্ট বিদআত। এখন কথা হচ্ছে আমরা মৃতের নেকীর জন্য মানুষ খাওয়াবো কেন? আমাদের আগে দেখতে হবে রাসুল (সা.) মৃত ব্যক্তির জন্য কী করেছেন বা করতে বলেছেন। সুন্নাহ ত্বরিকায় দোয়া না চেয়ে বিদআতী ত্বরিকায় কেন আল্লাহর কাছে চাইবো? এতে করে কীভাবে আমরা আহলে সুন্নি হলাম? আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, "রাসুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বর্ণনা করেছেন,
‘মানুষ যখন মারা যায়, তখন তার সমস্ত আমলের দরজা বন্ধ হয়ে যায়। তবে তিনটি আমলের দরজা বন্ধ হয় না। ক. সদকায়ে জারিয়া বা আল্লাহর রাস্তায় দান সদকা। খ. যদি কেউ এমন সন্তান রেখে যায়, যে সন্তান বাবা-মায়ের জন্য দোয়া করবে অর্থাৎ নেককার সন্তান। গ. এমন দীনি শিক্ষা রেখে যায়, যার দ্বারা মানুষ উপকৃত হতে থাকে। (মুসলিম শরিফ)
রাসুল (সা.) হাদিস থেকে আমরা মৃত ব্যক্তির কবরে পৌঁছানোর জন্য তিনটি উপায় জানতে পারলাম। এখানে দুটি কাজ মৃত ব্যক্তিকে জীবিত থাকা অবস্থায় করে যেতে হবে। বাকি হচ্ছে তার সন্তানসন্ততিরা। এখন এরা চাইলেই তাদের মৃত পূর্বপুরুষদের জন্য নিজেরা আমল করে পাঠাতে পারে। সেইসাথে সদকা করেও তারা তাদের পূর্বপুরুষদের জন্য নেকী ব্যবস্থা করতে পারে। এই বিষয়ে হাদিসে এসেছে, আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, সাদ ইবনে উবাদা (রা.)-এর অনুপস্থিতিতে তার মা ইন্তেকাল করেন। তিনি রাসুল (সা.)-কে জিজ্ঞাসা করেন, "
আমার অনুপস্থিতিতে আমার মা মারা গেছেন। আমি যদি তাঁর পক্ষ থেকে সদকা করি, তবে কি তাঁর কোনো উপকারে আসবে? তিনি বলেন, হ্যাঁ। সাদ (রা.) বলেন, “আমি আপনাকে সাক্ষী রেখে বলছি যে, আমার ‘মিখরাফ’ নামক বাগানটি আমার মায়ের জন্য সদকা করে দিলাম।" (বুখারি, হাদিস : ২৭৫৬)
অন্য হাদিসে এসেছে আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, একব্যক্তি রাসুল (সা.)-কে জিজ্ঞেস করে,
"আমার পিতা ইন্তেকাল করেছেন এবং ধন-সম্পদ রেখে গেছেন কিন্তু অসিয়ত করে যাননি। আমি যদি তার পক্ষ থেকে সদকা করি, তবে কি তার (গোনাহের) কাফফারা হবে? তিনি বললেন, হ্যাঁ।" (মুসলিম, হাদিস নং : ১৬৩০)
উপর্যুক্ত হাদিস দ্বারা বুঝা যাচ্ছে যে, মৃত ব্যক্তির জন্য দান সদকা করাটা সবচেয়ে বেশী জরুরি। এমন কোনো জাল যইফ হাদিসও সরাসরি পাওয়া যায় না যে মৃত ব্যক্তির জন্য নির্দিষ্ট নির্ধারিত দিনক্ষণ ঠিক করে সমাজের লোকজনকে খাওয়ালে তা মৃতের কবরে পৌঁছাবে?
তবে হ্যাঁ, কেউ চাইলে যেকোনো সময় যেকোনো দিনে গরিব দুঃখীকে খাওয়াতে পারে। এতো অবশ্যই নেকী আছে। কিন্তু আমাদের সমাজে যা যেভাবে কোনো ব্যক্তির মৃত্যুর পর সুনির্দিষ্ট দিনক্ষণ বা বার্ষিক হিসাব করে যে খাওয়া দাওয়ার আয়োজন প্রচলন আছে তা কখনোই ইসলাম সম্মত নয়।
মৃত ব্যক্তির চল্লিশার আয়োজন এখন ফরজ হয়ে গেছে। কারো সামর্থ্য না থাকলেও ধার কর্জ করে হলেও চল্লিশার আয়োজন করছে। যে ব্যক্তিটি মারা গেছে তার চিকিৎসা খরচ কেউ দিতে এগিয়ে আসে না। অথচ মৃত্যুর পর সেই ব্যক্তির চার বা পাঁচ দিনে খাবার আয়োজন বা চল্লিশ দিনে চল্লিশার আয়োজন করতে সামর্থবানেরা একপ্রকার প্রতিযোগিতা শুরু করে। সুতরাং বিধর্মীদের মতো সুনির্দিষ্ট দিনক্ষণে মানুষকে কখনোই রাসুল (সা.) এর সুন্নাহ নয়। মানুষ খাওয়ানো অবশ্যই নেকীর কাজ। ইসলাম ইয়াতীম মিসকিন অসহায়দের খাওয়ানোর ব্যাপারে উৎসাহ প্রদান করে। এতে কোনো সন্দেহ নেই।
কিন্তু আমাদের উপমহাদেশে হচ্ছেটা কী? এখানে গরিব দুঃখীদের নয় বরং যাদের খাওয়ার সামর্থ্য আছে তাদেরই খাওয়ানো হচ্ছে। শুধু তাইনয়, এইসব খাওয়ার অনুষ্ঠানে কোনো গরিব মিসকিন গেলে তাদের তাড়িয়ে দেওয়া হয়। নাহলে অনুষ্ঠানের সবার শেষে যেসব খাবার উদৃত থাকে কিংবা এঁটো খাবার যা থাকে তা ঐসব গরিবদের দেওয়া হয়।
যদি ইসলামে সত্যিই এমন কোনো আমল থাকতো তাহলে হযরত উসমান (রা.) প্রতি বছর নিজের মা বাবা অথবা রাসুল (সা.) এর প্রাণপ্রিয় দুই মেয়ের জন্য বেশী বেশী ইছালে সওয়াব পাঠাতেন। শুধু তাই নয়, আমাদের বর্তমান সমাজে না খেয়ে আছে এমন কেউ নেই। অথচ তৎকালীন আরব সমাজে গরিব দুঃখী অসহায় মিসকিন লোকের অভাব ছিলো না। রাসুল (সা.) জীবনী থেকে আমরা জানতে পারি যে তিনি নিজেও অভাবের কারণে কতশতবার ক্ষুধার্ত ছিলেন।
সুতরাং এটা দিনের আলোর মতো পরিষ্কার যে, মৃত ব্যক্তির জন্য নির্দিষ্ট দিনক্ষণে মানুষকে খাওয়ানো সুস্পষ্ট বিদআত। এতে করে যিনি খাওয়াবেন তার সওয়াব অবশ্যই হবে। কিন্তু তিনি যে উদ্দেশ্যে খাওয়াবেন যেটা কখনোই পূর্ণ হওয়ার নয়।
এই সুস্পষ্ট বিদআত করার মাধ্যমে আমরা আজ সুন্নাহ থেকে দূরে সরে গেছি। যেখানে সুন্নাহ হচ্ছে সাদকায়ে জারিয়া। এমন কিছু করা যাতে মানুষের দীর্ঘস্থায়ী উপকার হয়। যে উপকারের দ্বারা মানুষ সত্যিকারের উপকৃত হতে পারে। মানুষ প্রতি বছর নিজের মা বাবা বা পূর্বপুরুষদের জন্য আত্মীয়স্বজনদের খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা করে। এতে প্রচুর টাকা খরচ হয়। কিন্তু মানুষের উপকার হয় একবেলা ভালো খাওয়া। অথচ তারা দরিদ্র ক্ষুধার্ত নয়।
এই টাকা দিয়ে চাইলে কোনো জনকল্যাণমূলক কাজ, দ্বীনি প্রতিষ্ঠানের কাজ, মসজিদ, মাদ্রাসা এতিম দুস্থদের বা কোনো ঋণগ্রস্তকে উদ্ধার ইত্যাদি ভালো কাজ গুলো করা যায়। যার নেকীর পরিমাণ বেশী। যে নেকী প্রতিনিয়তই চলমান। যে উপকার মানুষের প্রকৃত উপকার।
অথচ আমরা লোককে দেখানোর জন্য আল্লাহ এবং আল্লাহর রাসুল (সা:) এর বিরোধিতা করছি জেনে না জেনে। এভাবেই আমরা বিদআতের দ্বারা রাসুল (সা:) এর সুন্নাহকে বিদায় করে দিচ্ছি।
আরও পড়ুন ইবাদত কবুল হওয়ার শর্তসমূহ
কবর পাকা করা একটি সুন্নাহ বিরোধী বিদআত |
কবর সম্পর্কিত বিদআত
কবর নিয়ে অসংখ্য বিদআতের জন্ম দিয়েছে সুন্নিরা। প্রথমত তারা কবর পাকা করাকে বেশী গুরুত্ব দেয়। কবরের উপর ঘর নির্মাণ, কবরকে সিজদা করা, কবরের উপর চাদর বিছানো, কবরে ফুল দেওয়া, সদ্য মৃতের কবরে হিন্দুদের মতো ফুল দিয়ে শ্রদ্ধাঞ্জলি দেওয়া থেকে শুরু করে কবরবাসী নিকট সাহায্য প্রার্থনা করাকেও জায়েজ মনে করে।
অথচ উপর্যুক্ত কাজগুলোর কোনটিই রাসুল্লাহ (সা.) তাঁর জীবদ্দশায় করেননি। বরং তা না করার জন্য বারংবার নিষেধ এবং নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন। সুতরাং এইসব করা হচ্ছে বিদআত। আর সুন্নিরা নিজেদের সুন্নি দাবি করলেও রাসুলের সুন্নাহর আশেপাশে নেই।
তারা তাদের বড় বড় পীর বুজুর্গের কবরকে পাকা করে তার উপর ঘর নির্মাণ করছে। সেইসাথে সেই ঘরে ঐ কবরকে ঘিরে চালু করেছে নানাবিধ বিদআত। কবর পূজা তথা কবর সিজদা থেকে শুরু করে, কবর তাওয়াফ, কবরবাসীর নিকট মানত, কবরবাসীর কাছ থেকে সাহায্য চাওয়া ইত্যাদি যাবতীয় শিরক বিদআত কুফরিসহ নানান কর্মকান্ড শুরু করেছে।
কবরকে ঘিরে এইসব বিদআতী কর্মকান্ড আজ তাদের ইমান আকিদার অংশে পরিনত হয়েছে। আর এইসব বিদআত করার পরও তারা নিজেদের সুন্নি তথা রাসুলের (সা.) এর প্রকৃত অনুসারী দাবি করে। ভুরিভুরি বিদআত করাও তারা কীভাবে নিজেদের আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামাত দাবি করতে পারে?
মুখে আরবীতে নিয়ত করা
নিয়তের উদ্দেশ্যে মুখে আরবিতে নিয়ত পড়া একটি বিদআত। কারণ রাসুল (সা:) থেকে সাহাবীদের থেকে কোনো প্রমাণ নেই যে তাঁরা মুখে নিয়ত করেছেন বা করতে শিক্ষা দিয়েছেন।
অথচ নিয়ত হচ্ছে অন্তরের বিষয়। নিয়ত করতে হয়। পড়তে হয় না। কেউ যদি মনে মনে নিয়ত করে আমি এই কাজটা এখন করবো। এটা করার জন্য কখনোই সে মুখে মুখে উচ্চারণ করবে না যে আমি এই কাজটা করবো।
ঠিক একইভাবে কেউ যখন সালাত আদায়ের উদ্দেশ্যে ওজু করবে তখন মুখে উচ্চারণ করে নিয়ত পড়বে না। যখন কেউ যোহরের সালাতের জন্য ওজু করবে তখনই তার নিয়ত পরিষ্কার যে সে যোহরের সালাত গুলোই আদায় করবে। সুতরাং এখন সুন্নাত সালাতের জন্য আবার মুখে উচ্চারণ করার দরকার নেই। বরং সে মনে মনেই চিন্তা করবে এখন আমি সুন্নাত আদায় করবো। এটাই হচ্ছে রাসুল (সা:) এর শিক্ষা।
অথচ আমরা উপমহাদেশের মুসলমানগণ মুখে আরবিতে উচ্চারণ করে নিয়ত পড়ি। যদিও নিয়ত পড়ার বিষয় নয় নিয়ত করার বিষয়। সুতরাং আরবিতে নিয়ত পড়ার মাধ্যমে সুন্নাহকে বিদায় দিয়ে নতুন আমল বিদআতকে সৃষ্টি করলাম।
আরও পড়ুন কুরআনের আলোকে মানুষ সৃষ্টির কারণ
ফরজ সালাতের পর সম্মিলিত মোনাজাত একটি সুন্নাহ বিদায়কারী বিদআত |
ফরজ সালাতের পর হাত তুলে সম্মিলিত মোনাজাত
রাসুল (সা:) এবং সাহাবীদের থেকে প্রমাণিত যে, ফরজ সালাতের পর রাসুল (সা:) শতশত দোয়ার শিক্ষা দিতেন। যা প্রতিটি মুসলিম নিয়মিত ফরজ সালাতের পর পাঠ করলে অবশ্যই তার কল্যাণ হবে। কেননা ফরজ সালাতের পর দোয়া কবুল হয়। এই উদ্দেশ্যে রাসুল (সা:) তাঁর উম্মতকে প্রচুর দোয়া শিক্ষা দিয়েছেন।
অথচ সাধারণ মুসলমানদের দোয়া কালাম না শিখিয়ে বড় বড় আলেমগণ নিজেরাই দোয়া করে। যাতে করে হাদিয়া তোফা পাওয়া যায়। বিভিন্ন সময়ের বিভিন্ন হাদীসকে জোড়াতালি লাগিয়ে ফরজ সালাতের পর ইমাম মুসল্লীদের নিয়ে একত্রে হাত তুলে নিয়মিত মোনাজাত করে থাকে।
দুই কি তিন লাইনের যা দোয়া পড়া হয় তার অর্থ শুধু ইমাম সাহেবই জানেন। একজন সাধারণ মুসল্লী তার পুরো জীবন জামাতে সালাত আদায় করলে একটা দোয়া জেনে বুঝে শিখতে পারবে না। কেননা দোয়া করা এবং শেখার সুন্নাহ পদ্ধতি আমরা উঠিয়ে দিয়েছি সম্মিলিত মোনাযাতের মাধ্যমে।
হুজুরদের দ্বারা দোয়া করাতে করাতে আমাদের অবস্থা আজ এমন যে নিজের মা বাবার জন্য কী দোয়া করতে হয় এবং কীভাবে করতে হয় সেটাই জানি না। এখন আমাদের নিজের মা বাবার জন্য দোয়া করানোর জন্য হুজুর ভাড়া করতে হয়। অথচ এই শিক্ষা রাসুল (সা:) দিয়ে যাননি।
যদিও ইমাম এবং মুসল্লি একত্রে মাঝে মধ্যে অনিয়মিত দোয়া করা না জায়েজ নয়। তবে সুন্নাহ হলো প্রত্যেকে তার নিজ নিজ প্রয়োজনে আল্লাহর কাছে সাহায্য চাইবে। এতে করে মুসল্লী দোয়া শিখবে এবং ঘরের সবাইকে শিক্ষা দিবে। মসজিদ থেকে যদি ইসলাম শেখা না যায় তাহলে ঘরে কীভাবে ইসলাম পৌঁছাবে?
যদিও সার্বজনীন এবং সামগ্রিকভাবে দোয়া করা বৈধ। তবে তা ক্ষেত্রে বিশেষে খুবই জরুরী হলে। রাসুল (সা:) জরুরী প্রয়োজনে সবাইকে নিয়ে দোয়া করেছেন। এখন আমরা সুন্নাহর আমল ছেড়ে সালাতের সালাম ফেরানোর পর পরই হাত তুলে মুনাযাত শুরু করি। যা কখনোই সহীহ্ সুন্নাহ নয়। এটা সুস্পষ্ট বিদআত।স্বার্থবাদী হুজুরদের কল্যাণে আজ আমরা বিদআতের মাধ্যমে সুন্নাহকে ধূলিসাৎ করে দিয়েছি।
আরও পড়ুন তাওহিদ কী কীভাবে আল্লাহর তাওহিদ ক্ষুন্ন হয়
মুর্দারের সামনে কুরআন পড়া এবং টাকা দিয়ে কুরআন পড়ানো বিদআত |
আমাদের সমাজে প্রচলিত একটি বিদআত হচ্ছে মৃত ব্যক্তিকে সামনে রেখে কুরআন পড়া। অথচ আল্লাহ কুরআন নাযিল করেছেন জীবিত মানুষের জন্য। আমাদের সমাজে মুসলমানরা জীবিত থাকা অবস্থায় কখনো কুরআন পড়ে দেখে না। কুরআনে আল্লাহ কী কী আদেশ উপদেশ দিয়েছেন বলেছেন তা কখনোই আমরা খতিয়ে দেখি না।
যদিও আল্লাহ কুরআন নাযিল করেছেন মানুষকে সতর্ক করার জন্য আদেশ উপদেশ মানার জন্য। অথচ আমরা জীবিত থাকতে কুরআন পড়ি না আর মৃত্যুর পর মুর্দারের সামনে কুরআন পড়ি। যে কুরআন তার জীবিত থাকা অবস্থায় পড়া দরকার ছিলো। সেই কুরআন তার মৃত্যুর পর পড়ে তার কী লাভ হবে?
লাভ অবশ্যই হতো যদি এই শিক্ষা আমাদেরকে রাসুল (সা:) এবং তাঁর সাহাবীরা দিয়ে যেতেন। যেহেতু রাসুল (সা:) জীবনী থেকে এমন কোনো নজির নেই সেহেতু এইসব আমল কখনোই করা যাবে না। করলেই আমরা বিদআতে জড়িত হয়ে গেলাম।
আরও পড়ুন বিশ্বকাপ ফুটবল এবং আমাদের ঈমান আকিদা
মহরম
মহরম নিয়ে আমাদের মধ্যে শুধুমাত্র কারবালা কেন্দ্রিক আলোচনাই প্রাধান্য পায়। অথচ কারবালার মর্মান্তিক ঘটনা ইসলাম প্রতিষ্ঠার প্রায় ৬০ বছর পরের ঘটনা। কারবালার ঘটনায় প্রতিটি মুসলমান মর্মাহত। এর ইতিহাস আমাদের জানা উচিত এবং সেখান থেকে শিক্ষা নেওয়া উচিত।
তবে আমরা যদি কারবালার ঘটনাকেই ইবাদত মনে করি। এবং মহরমের ইবাদতের মূল কারবালাকে মনে করি তাহলে তা বিদআত। কেননা ইসলামে মহরমের গুরুত্ব সুপ্রাচীন। প্রতিটি নবী রাসুলের সাথে মহরমের ১০ তারিখ জড়িত। মহরম নিয়ে রাসুল (সা:) এর সুস্পষ্ট সুন্নাহ রয়েছে। রাসুল (সা:) এই মহরমের দিনে সিয়াম পালন করতে নির্দেশ দিয়ে গেছেন। তাও একটি নয় দুটি বা তিনটি।
মহরম উপলক্ষে মুরগি জবাই করা, হালুয়া রুটি খাওয়াকে ইবাদত মনে করা কখনোই সুন্নাহ নয়। শুধু তাইনয় মহরম নিয়ে আমাদের সমাজে একটি জঘন্য প্রথা চালু আছে। তা হলো প্রতিটি মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে জাঁকজমকপূর্ণ করে কোরমা পোলাও ইত্যাদি রোধে পাঠানো।
যা এখন ইসলামের ফরজ আহকামের মতো হয়ে গেছে। যদি এমন কিছু ইসলামে থাকতো তাহলে রাসুল (সা:) তাঁর মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে অবশ্যই এইসব পাঠাতেন। অথচ এই সম্পর্কে রাসুল (সা:) বা তাঁর সাহাবীদের থেকে এমন কোনো আমল পাওয়া যায় না।
আমাদের মহরম হয়ে গেছে কারবালা এবং খাওয়া দাওয়া কেন্দ্রিক। সুন্নাহ আমলের কোনো তোয়াক্কা নেই। এভাবেই আমরা বিদআত করে সুন্নাহকে বিদায় করে দিয়েছি।
আরও পড়ুন সুফি সুন্নীদের তাবিজ সম্পর্কিত আকিদার জবাব
বিয়ে নিয়ে বিদআত
আমাদের সমাজে বিয়ের মোহরানা নিয়ে যে জঘন্য সংস্কৃতি চালু হয়েছে, তা সত্যিই লজ্জ্বাজনক। একজন মেয়ের মোহরানা কখনোই তার স্বামীর আয়ত্তের বাইরে হতে পারে না। সেইসাথে কোনো মেয়ে আকাশচুম্বী মোহরানা দাবিও করতে পারে না। অথচ আমাদের সমাজে মোহরানা সংস্কৃতি খুবই হতাশ পর্যায়ে চলে গেছে।
মোহরানার জন্য আজ হাজার ছেলে সঠিক সময়ে বিয়ে করতে পারছে না। ছেলেমেয়েদের সঠিক সময়ে বিয়ে দেওয়া যেখানে রাসুল (সা:) এর সুন্নাহ এবং নির্দেশ। সেখানে আমাদের সমাজে ছেলেমেয়েদের সঠিক সময়ে বিয়ে নিয়ে কোনো কথা নেই।
মোহরানা নিয়ে জঘন্য বিদআত হচ্ছে মোহরানা আদায় না করা। অথচ সুন্নাহ হচ্ছে মোহরানা আদায় করে তবেই বিয়ে করা। কিন্তু আমাদের সমাজে কখনোই মোহরানা আগে আদায় করা হয় না। কীভাবে করবে? লাখ লাখ টাকা মোহরানা আদায় করা কারো পক্ষে সম্ভব নয়।
যারফলে মোহরানা আদায় না করে বাকিতে রেখে বিয়ে করে। যা কখনোই সুন্নাহ সম্মত নয় বরং এটা হারাম পর্যায়ে চলে গেছে। আমরা কীভাবে এই জঘন্য বিদআত গুলো করে নিজেদের মুসলিম দাবি করছি।
শুধু তাইনয় সবচেয়ে বেশী জঘন্য অপরাধ হচ্ছে, বিয়ের ওলীমা বা খাওয়া দাওয়া নিয়ে। রাসুল (সা:) এর নির্দেশ এবং সুন্নাহ হচ্ছে ছেলে বিয়ে করে তার ঘরেই ওলীমা করা। অর্থাৎ ছেলে নিজেই খানা পিনার আয়োজন করবে তার সামর্থ্য অনুযায়ী। অথচ আমরা নিজেদের মুসলিম দাবিদার করেও কখনোই সুন্নাহর অনুসারী নই। এব্যাপারে কোনো আলেমও কিছু বলে না।
এই জঘন্য বিদআতের জন্য আজ আমাদের সমাজে হাজার হাজার কন্যাদায়গ্রস্ত পিতার আহাজারি। হাজার হাজার মেয়ের আজ বিয়ে হচ্ছে না শুধুমাত্র টাকার অভাবে। অথচ ইসলাম এসেছে মানুষকে উদ্ধার করতে। কুসংস্কার থেকে মুক্ত করতে। অথচ আমরা সুন্নাহকে বিদায় দিয়ে নিজেদের মুসলিম দাবি করে বিধর্মীদের চেয়ে খারাপ আমল করে যাচ্ছি বিদআতের মাধ্যমে।
আরও পড়ুনরাসুল সাঃ ও পীর অলি আউলিয়া সম্পর্কিত আকিদার জবাব
যৌতুক নেওয়া হারাম ও বিদআত |
বিয়েতে যৌতুক নেওয়া এবং দেওয়াটা যেখানে হারাম। সেটা এখন মুসলিম সমাজে ফরজ হয়ে গেছে। এই যৌতুক প্রথাটা এসেছে সরাসরি হিন্দু সনাতন ধর্ম থেকে। আর আমরা সুন্নীরা সেই হিন্দুয়ানী প্রথাকেই প্রাধান্য দিচ্ছি।
বর্তমান সমাজের কোনো আলেমই এইসব নিয়ে কথা বলে না। কেননা সত্য বললে বর্তমান দুনিয়ায় ভাত পাওয়া যাবে না এমনই বিশ্বাস আমাদের। এই বিশ্বাস নিয়ে আজ আমরা সুন্নাতকে ছেড়ে দিয়ে বিদআতকে স্থান দিয়েছি। যদি সমাজে বিদআতের প্রচলন না হতো তাহলে এভাবে জঘন্য বিদআত গুলো সমাজে জায়গা পেতো না।
মেহেদী অনুষ্ঠান
আমাদের সমাজে বিয়ের আগে বর কনের হাতে মেহীদ লাগানো নিয়ে একটি অনুষ্ঠান করে। যাতে রয়েছে বেহাল্লাপনার ছড়াছড়ি। হিন্দুদের রীতিনীতি অনুযায়ী এইসব অনুষ্ঠান করা হয়। যেখানে অগ্নি পূজার মতো ঘটনাও থাকে। রাসুল (সা:) বিয়েকে প্রচার করতে বলেছেন। কিন্তু বিধর্মীদের অনুসরণ নিষেধ করেছেন।
অথচ আজ আমাদের সমাজে যা চলে আসছে তা কখনোই সুন্নাতের অনুসরণ নয়। সুন্নাতের অনুসরণ না করে বিদআতের অনুসারী হওয়ার কারণে আজ আমাদের সমাজে এই অবস্থা।
আরও পড়ুন সুফি সুন্নীদের বিভিন্ন আকিদা সম্পর্কিত জবাব
জন্মদিন পালন
রাসুল (সা:) এবং সাহাবীদের থেকে জন্মদিন পালনের কোনো ইতিহাস পাওয়া যায় না। ইসলামে কোনো বার্ষিকী অনুষ্ঠান নেই। সেখানে আমাদের সমাজে একশ্রেণির মুসলমান তাদের পীর মাশায়েকদের ওরসের নামে জন্মদিন মৃত্যুদিন পালন করে থাকেন। এই সংস্কৃতি এখন সাধারণ সুন্নীদের মধ্যে প্রবেশ করেছে পশ্চিমাদের অনুসরণে।
আজ প্রতিটি ঘরে ঘরে কেক কেটে ঘটা করে জন্মদিন পালন করা হচ্ছে। যা সরাসরি বিধর্মীদের সংস্কৃতি। এটা নিয়ে আলেমদের কোনো মাথা ব্যাথা নেই। কারণ তারা যেখানে নিজেরাই ওরসের নামে জঘন্য বিদআত করে যাচ্ছে। সেখানে সাধারণ মুসলমানদের কীভাবে সুন্নাহ শেখাবে? আর এভাবেই সুন্নাহকে বিদায় দিয়ে আমরা বিদআতকে গ্রহণ করছি।
আরও পড়ুন শিরক কী? মানুষ কীভাবে শিরক করে
তাবিজ
বর্তমানে আমাদের আলেমদের আয়ের প্রধান উৎস হলো তাবিজ কবজ। আমরা তাবিজ কবজ জায়েজ মনে করি। অথচ রাসুল (সা:) থেকে প্রমাণিত সত্য যে তাবিজ কবজ (বর্তমানে সমাজে তাবিজের নামে যা চলছে) জায়েজ নয়। তবে পানি পড়া ঝাঁড়ফুক জায়েজ।
আজ তাবিজ কবজের কারণে সমাজে কুফুরি কর্মকাণ্ডের ছড়াছড়ি। বর্তমান সমাজে যে তাবিজ নিয়ে যে অসুস্থ কার্যকলাপ চলছে তা যেকোনো মুমিনের জন্য ক্ষতিকর। তাবিজ কবজের দ্বারা মানুষ আজ নিজের অজান্তেই শির্ক কুফুরিতে নিমজ্জিত।
সাধারণ মানুষ জানতেই পারছে না তার ঈমান ইতিমধ্যে ধ্বংস হয়ে গেছে। তাবিজ তামীমা কোনো ভাবেই শরীয়ত সম্মত নয়। তারপরও আমাদের সমাজে এতো বড় জঘন্য পাপকে অন্ধের মতো বিশ্বাস করে। যারা তাবিজকে জায়েজ বলে তারা এর কিছু শর্ত দিয়ে জায়েজ করে।
এইসব শর্তের অন্যতম হলো কুরআনের বানী দিয়ে তাবিজ করতে হবে। এবং তাবিজে কী লেখা আছে তা, যিনি তাবিজ নিচ্ছেন তাকে জানতে হবে। যার কোনটাই আমাদের মাঝে নেই। আজ আমরা নিজেদের সুন্নাতের অনুসারী দাবি করেও শির্ক কুফুরিতে লিপ্ত। অথচ সুন্নাহ হলো কুরআনের আয়াত দিয়ে ঝাঁড়ফুক দেওয়া এবং পানি পড়া নেওয়া। আমরা এখন সুন্নাহকে বিদায় দিয়ে বিদআত কুফরিতে লিপ্ত হয়ে আছি।
যাকাত
আল্লাহর বিধানের অন্যতম একটি বিধান হচ্ছে যাকাত প্রদান করা। এই যাকাত পদ্ধতিটি ইসলামে এসেছে দারিদ্রতা দূর করার জন্য। এর আদায়ের বিধান রাসুল (সা:) শিক্ষা দিয়ে গেছেন। কিন্তু আজ আমরা মুসলমান দাবিদার হয়েও রাসুল (সা:) এর সুন্নাতের উপর আমল না করে নিজস্ব ধ্যানধারণার বিদআতী পদ্ধতিতে লোক দেখানো যাকাত আদায় নয় বরং দিচ্ছি।
অর্থাৎ কোনো একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকার কম দামে যাকাতের কাপড়ের নামে শাড়ি লুঙ্গি কিনে গরিবদের বিতরন করে। যা মোটেই শরিয়ত সম্মত নয়। এভাবে নিজের ঘরের সামনে গরিবদের দাঁড় করিয়ে মানুষকে দেখিয়ে দেখিয়ে যাকাত দেওয়ার কথা রাসুল (সা:) শিক্ষা দিয়ে যাননি।
বরং যাকাত আদায়ের মূল উদ্দেশ্য হলোঃ গরিবের উপকার করা। যাতে সে আর গরিব না থাকে। যাকে যাকাত দেওয়া হবে সে যেন যাকাতের টাকা নিয়ে স্বাবলম্বী হতে পারে। ইসলামের শিক্ষা সুন্দর এবং যুগোপযোগী। যদি ধনীরা তাদের নিজেদের আত্মীয়স্বজনকে উপযুক্ত যাকাত দিয়ে স্বাবলম্বী করে দেয়। তাহলে ধীরে ধীরে দারিদ্রতা কমে আসবে। আত্মীয়তার বন্ধন দৃঢ় হবে।
কিন্তু আমাদের মাঝে সুন্নাহর কিছুই প্রচলন নেই। আমরা লোক দেখিয়ে টাকা দান করি। যেখানে হাজার হাজার অসহায় নারী পুরুষ আবাল বৃদ্ধ ধাক্কাধাক্কি করে টাকা নেয়। যারফলে প্রায়শই বহু লোকের হতাহতের ঘটনা ঘটে। রাসুল (সা:) এর আদেশ নির্দেশের বিপরীত বিদআতী আমল করে আমরা সুন্নাহকে বিদায় দিয়েছি।
আরও পড়ুন সুফিবাদী সুন্নীদের আকিদা সমূহ
কুরবানি
পবিত্র কুরবানি নিয়ে আমাদের মাঝে এমন বিদআত রয়েছে যা খুবই দুঃখজনক। বর্তমানে অধিকাংশই মুসলমানই সালাতে অনুপস্থিত। অথচ সালাত একটি প্রতিষ্ঠিত ফরজ। সেখানে কুরবানির ব্যাপারে তারা খুবই কঠোর।
কুরবানি করাটা একটা স্ট্যাটাস হিসাবে দেখি। কারো সামর্থ্যে কুরবানি করতে না পারলে সমাজে মুখ দেখাতে পারে না। অথচ যেখানে সালাত আদায় সবচেয়ে বড় ফরজ। সেখানে কুরবানির ব্যাপারে যথেষ্ট ছাড় আল্লাহ দিয়েছেন। যার সামর্থ্য আছে শুধু সে ই কুরবানি করবে। অনর্থক সামর্থ্যের বাইরে গিয়ে কুরবানি করা জায়েজ নয়।
অথচ আমাদের বিদআতী নীতি হলো প্রয়োজনে ধার কর্জ হলেও কুরবানি করবো। ধার কর্জ না পেলে সুদে টাকা নিয়ে হলেও কুরবানি করবে। দেখুন আমাদের অবস্থা! কুরবানির জন্য হারাম পথের টাকা লাগাতে পর্যন্ত আমাদের বিবেকে বাধে না। এভাবেই আমরা সুন্নাহকে অনুসরণ না করে বিদআতকে আঁকড়ে ধরেছি।
ফিতরা
ফিতরা আদায়ে সুন্নাহ ত্বরিকা ছেড়ে আমাদের উপমহাদেশে বিদআতী পদ্ধতিতে ফিতরা দেয়। রাসুল (সা:) এর সুন্নাহ হলো নির্দিষ্ট পরিমাণ খাদ্যদ্রব্য দিয়ে ফিতরা আদায় করা। আর আমাদের উপমহাদেশে খাদ্যদ্রব্যের কম মূল্য নির্ধারন করে কম টাকায় ফিতরা আদায় করে। যা সুস্পষ্ট রাসুল (সা:) এর সুন্নাত বিরোধী কাজ। এবং এটাও সুস্পষ্ট বিদআত যা দ্বারা আমরা সুন্নাহকে বিদায় দিয়েছি।
আরও পড়ুন সুফি সুন্নীরা শয়তানের অলি
টাকা দিয়ে কারো জন্য কুরআন খতম দেওয়া
আমাদের মাঝে বহুল প্রচলিত একটি বিদআত হচ্ছে অন্যকে দিয়ে কুরআন খতম করা। কুরআন এসেছে মানুষকে সতর্ক করতে আল্লাহকে চিনতে এবং জানতে। যে ব্যক্তি যতবেশী কুরআন পড়বে বুঝবে। সে ততই আল্লাহর নৈকট্য লাভ করবে। কুরআন তিলাওয়াতের যথেষ্ট নেকী রয়েছে। অর্থাৎ কেউ কুরআন পড়লে বুঝলে অবশ্যই তার আমলনামায় নেকী যোগ হবে। এটা রাসুল (সা:) থেকে প্রমাণিত।
কিন্তু আমাদের সমাজে প্রচলিত হলো হুজুরকে টাকা দিয়ে নিজের মৃত মা বাবার জন্য কুরআন পড়ানো। যা কখনোই সুন্নাহ সম্মত নয়। কেউ কুরআন পড়লে তার নেকী হবে। তার নেকী হলে সেই নেকী তার মা বাবার জন্য পৌঁছাবে। এটাই সত্য। এখন কেউ টাকা দিলো আর কেউ পড়ে দিলো। এভাবে কি নেকী পাওয়া সম্ভব?
যদি এমন সিস্টেম ইসলামে চালু থাকতো তাহলে মানুষ আর নিজে আমল না করে টাকা দিয়ে সব ইবাদত হুজুরকে দিয়ে করিয়ে নিতো। তাহলে আর তাকওয়ার প্রয়োজন হতো না। টাকা থাকলেই জান্নাত কিনে নেওয়া যেত। এভাবে আমরা সুন্নাহর আমল না করে বিদআতকে প্রশ্রয় দিয়ে রাসুল (সা:) এর সুন্নাহকে ধ্বংস করছি।
ঠিক একইভাবে খতমে জালালী, খতমে ইউনুস, কুরআন খানি, ফাতিহা খানি, শবীনা খতম, দরুদে তাজ, দরুদে লাক্ষী, দু‘আয়ে গাঞ্জুল আরশ, কুম কুম ইয়া হাবীবা ওযীফা, উরস, কবরে চাদর দেয়া, কবর পাকা করা, কবর পূজা করা, কবরের উপর লেখা, তাতে ফ্যানের ব্যবস্থা রাখা, সেখানে আগর বাতি-মোমবাতি জ্বালানো, সেখানে নযরানা পেশ করা ইত্যাদি আমলের কোনো নজির রাসুল (সা:) বা তাঁর সাহাবীদের থেকে প্রমাণিত নয়। এগুলো কখনোই সুন্নাহ সম্মত নয়। এগুলোর পরিবর্তে সুন্দর সুন্দর সুন্নাহর আমল রয়েছে। যা রাসুল (সা:) এর জীবনী থেকে পাওয়া যায়। আজ আমরা বিদআত দিয়ে সুন্নাহকে বিদায় দিচ্ছি।
একইভাবে সালাতের আযানের আগে মাইকে রাসুল (সা:) কে সালাম দেওয়া। যার কোনো সুস্পষ্ট এবং নিয়মিত আমলের হাদীস পাওয়া যায় না।
আরও পড়ুন ঈমান কী? পরিপূর্ণ ঈমানের বিস্তারিত ব্যাখ্যা
আযানের জবাব এবং দোয়া পড়ার ফজিলত অনেক। কিন্তু আমাদের সমাজে আযানের জবাব এবং দোয়ার চাইতে যখন রাসুল (সা:) এর নাম নেওয়া হয় তখন আঙ্গুলে চুমু দিয়ে চোখে মোছাটাই বেশী সওয়াবের মনে করে। অথচ রাসুল (সা:) বা সাহাবীদের থেকে এমন কোনো আমল প্রমাণিত নয়। যেটা প্রমাণিত সত্য সেটার আমল আমাদের মাঝে নেই। অথচ যা রাসুল (সা:) থেকে প্রমাণিত নয় সেইসব বিদআতী আমল ঠিকই প্রচলিত।
ফরজ সালাতের আগে সুন্নাত আদায় না করার জন্য মসজিদে লাল বাতি জ্বালানো। যার কোনো বিধান ইাসলামে নেই। আমরা নিজেদের আশেকে রাসুল (সা:) দাবি করেও রাসুল (সা:) এর সুন্নাহর অনুসরণ নেই। যা অনুসরণ করছি তা বিদআতই করছি।
আসুন উপরোক্ত আলোচনা আমরা গভীরভাবে অনুধাবন করার চেষ্টা করি। আমরা যদি নিজেদের ঈমানদার দাবি করি তাহলে অবশ্যই দ্বীনের জ্ঞান অর্জন করতে হবে। আমাদের জানার চেষ্টা এইজন্যই করতে হবে যে, হিদায়াতের প্রথম শর্ত ইলম বা জ্ঞান। যার জ্ঞান আছে সে ই হিদায়াতের পথে থাকবে। অর্থাৎ আমাদের নিজের জ্ঞান বিচার বুদ্ধি দিয়ে বিবেচনা করতে হবে যে আমি যা করছি তা কতটুকু সঠিক। যদি সকল বিচার বিশ্লেষনে যদি মনে হয় আমি যা করছি তা সঠিক তাহলে কারো কিছু করার নেই শুধু দোয়া করা ছাড়া।সুতরাং সবার প্রতি উদাত্ত আহ্বান যে আমরা যা কিছুই মানি বা আমল করি তা যেন জেনেই মানি। কারণ ইসলাম জেনে মানার জীবনবিধান।
কৃতজ্ঞতা
মিলাদ কিয়ামের ইতিহাস (নূরুল্লাহ মারূফ, আলেম ও প্রাবন্ধিক
সাখাওয়াতুল আলম চৌধুরী
২৭ এপ্রিল, ২০২২ ইংরেজি
পতেঙ্গা, চট্টগ্রাম।